এই মাৎস্যন্যায়ের ফলে সমগ্র বস্তারের আইনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। আদিবাসীদের জন্য খাতায় কলমে অনেক আইন থাকলেও, ব্যাবহারিক ভাবে দেখতে গেলে দেশের আইনিব্যবস্থায় এঁদের কোনো স্থান নেই। আর বস্তারের মতো কম্ব্যাট-জোন-এ তো আরো-ই নেই। এই বিষয়ে ২০১৩ সালে জ্যাগল্যাগের আর-টি-আই মারফৎ সংগৃহীত বেশ কিছু তথ্যে আলো পড়ে।
১) দন্তেওয়াড়ায় ভৈরমগড় থানার দুইখানি কেসে যথাক্রমে ৯৬ এবং ৯৭ জন লোক এক চার্জশীটে অভিযুক্ত হয়েছে।
২) ২০০৫ সালে দান্তেওয়াড়া সেশন্স কোর্টে যে ক’খানি মামলা রুজু হয়েছিল এবং আজকের মধ্যে রায় বেড়িয়েছে, তার মধ্যে ৯৭% মামলার শেষে অভিযুক্তগন বেকসুর খালাস হন। যদিও মোকদ্দমাসমুহ ঐ কোর্টে বহুদিন চলে। অজস্র আণ্ডারট্রায়াল। তদের মধ্যে দুইজন আণ্ডারট্রায়ালের কাহিনী –
ক। কুঞ্জমই সুক্লু, চল্লিশের কোঠায় বয়স। ১৯৯৯-তে জেল, ২০০৫-এ বেল গ্রাণ্ট, ২০১৩ অবধি কোর্ট থেকে কিছু কাগজপত্র জেল অঞ্চলে আসে নি বলে তিনি অধ্যবধি রাষ্ট্রের আদরে রয়েছেন।
খ। জগদেব পোড়ি, মধ্য ত্রিশের মত বয়স, ২০১২-এ জেল ও নাতিশীঘ্র বেল মকুব। অধ্যবধি তাকে জেল থেকে বের করা যায় নি।
৩) দান্তেওয়াড়ার বাচেলি কোর্ট, কেস নং ৫/১১। ৪ জন আণ্ডারট্রায়ালের জেলে মৃত্যু হয়েছে:
ভীমা কাদাতি, ২৫
কুঞ্জমি কোশা, ২৫
তেলামি আয়াতু, ২৫
কাওয়াসী বেলা, ২২
এঁদের হাজতে ঢোকার আগে কোনোপ্রকার শারীরিক বা রাষ্ট্রীয় অসুস্থতা ছিলো না। উক্ত জেলে হাজতবন্দীদের অধিকাংশের মধ্যে এনিমিয়া-র বিস্তার ঘটে, এবং এইসব জেলের ধারেকাছে চিকিৎসাকেন্দ্র নেই বলে রক্ত আসতে একটু দেরী হয়ে যায়।
৪) দান্তেওয়াড়া জেলে এই মুহুর্তে ৫৬৫ কয়েদী এবং জগদলপুর সেণ্ট্রাল জেলে ১৩৮৮। একটিতেও স্থায়ী ডাকতার বা কোনো ধরণের চিকিৎসাকর্মী নেই। জগদলপুর জেলে চিকিৎসার জন্য একটি ঘর ও একটি বিছানা আছে, যদিও তাতে ড্রিপ দেওয়ার উপায়ন্তর নেই, অন্যকিছু তো সাদ্দাম হোসেন।
৫) জগদলপুর সেণ্ট্রাল জেলে কয়েদীরা দিনে ৮-৯ ঘণ্টা পরিশ্রম করে ও ৩০ টাকা উপার্জন করে, যার মধ্যে ১৫ টাকা তাদের কাছে থাকে আর ১৫ টাকা “ভিকটিমস অ্যাকাউণ্ট”-এ। বহুক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভিক্টিম।
৬) রাষ্ট্র যে সব কেসে ‘ভিকটিম’ সেই সব কেস মুলত অস্ত্র আইনের ধারা ২৫ ও ২৭এবং দণ্ডবিধি সংহিতার ধারা ১৪৭, ১৪৮ এবং ১৪৯, “অফেন্সেস আগেন্সট পাব্লিকি ট্র্যাঙ্কুইলিটি”। এই মোকদ্দমাগুলোর আদরের নাম “নকশাল কেস”। অধিকাংশ অভিযুক্ত দীর্ঘ ট্রায়ালান্তে প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস পান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এইসব মামলার প্রমাণ হিসেবে অস্ত্রগুলি পুলিশ কোর্টকে দেখিয়ে উঠতে পারে না, পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণ হিসেবে পরিবেশিত হয় মূলত কিছু কাস্তে-হাতুড়ি ছাপ কাগজপত্র, যে’র’ম সি-পি-আই-এর নির্বাচনী প্যাম্ফলেট ইত্যাদি। আর সাক্ষ্য হিসেবে থাকে অভিযুক্তদের পুলিশকে করা স্বীকারক্তি। প্রায় সমস্ত কেসেই অভিযুক্তরা পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেন, যদিও আর কারুর কাছে দেন না। যদিও এভিডেন্সে অ্যাক্টের ২৫ নং ধারা এহেন স্বীকারোক্তির আইনী অগ্রহণযোগ্যতার কথা বলেছে, কিন্তু পুলিশ বা লোকাল জজ ম্যাজিস্ট্রেট-সায়েবমেম-গণ ঐটুকু বাদ দিয়ে গ্যাছেন অজস্র ব্যস্ততার কারণে।
৭) উক্ত “অফেন্সেস আগেন্সট পাব্লিক ট্র্যাঙ্কুইলিটি” সংক্রান্ত মামলা ২০০৫ সালে আনিত বিবাদবিতণ্ডার ১০%, ২০১২-এ মেরেকেটে ৬০%।
৮) এই ধরণের ও অন্যান্য মামলা মিলিয়ে এক একটি মামলায় যতজন অভিযুক্ত হন ২০০৫ থেকে ২০১২ অব্ধি গড় করলে তা দাঁড়ায় ৬.৯৪।
৯) সমস্ত মামলার সমস্ত অভিযুক্তদের মধ্যে গড়ে ৯৫.৭% অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
১০) ২০০৫-এ যে সব মামলাগুলো সেসন্স কোর্ট থেকে ফসল্লা করেছিলো সেগুলির মধ্যে সবচে’ বেশীদিন যেটা চলেছিলো সে’টা ৩ বছর ধরে চলেছিলো। ২০১২-এ ডিস্পোসড হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ১৫টা ৬ বছরের বেশী চলেছে।
১২) জেল পরিসংখ্যান –
ক। দান্তেওয়াড়া জেল
ধারণক্ষমতা – ১৫০
মোট কয়েদী – ৫৬৫
আণ্ডারট্রায়াল – ৫৪৯ (৯৭%)
কনভিক্ট – ১৬ (৩%)
খ। জগদলপুর সেণ্ট্রাল জেল
ধারণক্ষমতা – ৬৪৮
কনভিক্ট – মোট ৬২২। নারী ১৪, শিশু ২। নারী ও শিশু সকলেরই সশ্রম কারাদণ্ড
আণ্ডারট্রায়াল – মোট ৪৫২। নারী ২৭, শিশু ৬।
হাই সিক্যোরিটি আণ্ডার্ট্রায়াল (নকশাল কেস) – মোট ৩৮৮। নারী ৫৫, শিশু ৩
হাই সিক্যোরিটি কনভিক্ট – মোট ২১। নারী ১।
স্ট্যাটিস্টিক্স মিথ্যা কথা বলে না। জ্যাগল্যাগের আহৃত পরিসংখ্যান জুড়ে জুড়ে যে ন্যারেটিভ প্রকাশ্যে আসে তা হল –
বস্তার সম্ভাগের বহু আদিবাসীর অবস্থা সৈয়দ মুজতবা আলী বর্ণিত সেই ‘পঁয়তাল্লিশ নম্বর’ কয়েদীর মত। হঠাৎ করে পুলিশ তুলে নেয়। লকাপে চলে মারধোর। চার্জশীটে নাম বসানো হয়, বসানো হয় সাংঘাতিক সব অপরাধের ফিরিস্তি, এবং তার সাথে সংগৃহীত অস্ত্র প্রমাণাদি। এই অস্ত্র মাঝেমধ্যেই তীরধনুক হয় কারণ বস্তারের বিভিন্ন আদিবাসী-গোষ্ঠীরা বহু সহস্রাব্দ ধরে তীরধনুক ব্যবহার করে আসছে। এবং অন্যান্য প্রমাণাদির মধ্যে মাঝেমধ্যেই দেখা যায় স্থানীয় বামফ্রণ্টের নির্বাচনী লিফলেটাদি (অধমের গোচরে আসা এরকমই এক চার্জশীটে প্রতিভ – জনৈক আদিবাসী অস্ত্র আইনে গ্রেফতার, কারণ, চার্জশীট অনুসারে, তাঁর সংগ্রহে কাস্তে, গাঁইতি, শাবল, কোদাল, হাতুড়ি, পেরেক এবং লোহার বাসন-কোসন-রূপী অস্ত্র ছিলো।)
তারপর তাকে চালান করা হয়, ম্যাজিস্ট্রেট-মারফৎ, জেলে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বেল পায় না, কারণ অভিযুক্তের অপরাধ গুরুতর। তারপর দিনের পর দিন মাসের পর মাস শুনানি চলতে থাকে, পুলিশ বা ফৌজিপক্ষের লোক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বেশীরভাগ শুনানীর সময় উপস্থিত থাকতে পারে না। মামলা চলতেই থাকে, আর অভিযুক্ত জেলে বিচারাধীন বন্দী হিসেবে পড়ে থাকেন উপচে পড়া জেলগুলিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ, ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ধারা নং ৪৩৬ক অনুসারে কোনো বিচারাধীন বন্দীকেই তাঁর অভিযোগ প্রমাণ হলে যত বছর মেয়াদের কারাদণ্ড হওয়ার কথা, তার অর্ধেক সময়ের বেশী আণ্ডার্ট্রায়াল হিসেবে জেলে রাখা যাবে না। অর্থাৎ অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর যদি সর্বোচ্চ্ব ১০ বছর কারাদণ্ড হওয়ার কথা তাঁর বিরুদ্ধে আনীত চার্জ অনুসারে, তাহলে বিচার চলাকালীন আণ্ডার্ট্রায়াল হিসেবে ৫ বছর জেলে থাকার পরেই তাঁর স্ট্যাট্যুটারী জামিন পেয়ে যাওয়ার কথা। এহ বাহ্য, এই আইন বস্তার অঞ্চলে খুব কম ক্ষেত্রেই মানা হয়। এ’ছাড়া, অনেককে জেলে রাখা হয় উক্ত সি-আর-পি-সি-র ১০৯ নং ধারা অনুসারে, যে’রকম ২০১৩ সালের অগাস্ট মাসে পশ্চিমবাংলা থেকে জীবিকার সন্ধানে বস্তারে পৌঁছোনো কিছু হকারকে হয়েছিলো। উক্ত ধারায় কোথাও কারাবাসের কথা বলা নেই।
তো যাই হোক, এইভাবে বছরের পর বছর কেস চলার পর, অভিযুক্ত, ৯৭% ক্ষেত্রেই, বেকসুর খালাস পেয়ে যান। এর থেকে প্রমাণ কি হয় না যে বেশীরভাগ কেসই ফ্যাব্রিকেটেড? যে’খানে অস্ত্র হিসেবে বাসন-কোশন পর্যন্ত দেখানোর আগে দুইবার ভাবে না পুলিশ, সেইখানে ‘রুল অব ল্য’-র যা দশা হওয়ার কথা, ঠিক সেই দশাই হয়েছে সমগ্র বস্তার সম্ভাগে, নকশালদমনের নামে। সেই কারণেই রক্ষকের নামে যে সকল ভক্ষক পুলিশের নানান পদ শোভিত করেছে বস্তার জুড়ে, তাদের কোনো শাস্তি নেই।
এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে – নকশালদমনের এই হিড়িক কেন? শুধুই কি নকশালদমন না এর পিছনে কোনো গূঢ় অভিপ্রায় রয়েছে? কেনই বা উক্ত কল্লুরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র-দপ্তরকে কথা দিয়েছে যে এক-বছরের মধ্যে সে বস্তার সম্ভাগকে নকশালমুক্ত করেই ছাড়বে?
সমগ্র বস্তার জুড়ে মাটির নীচে অজস্র খনিজ – মূলত আকরিক লোহা ও বক্সাইট। যে সকল জায়গায় মাটির নীচে অনেক খণিজ থাকে, সে সকল জায়গার মাটির গভীর অবধি ফাটল থাকে, সেই ফাটল থেকে নির্জাশ শুষে নিতে পারে শাল-তমাল-মহুয়ার মত নানান বনস্পতি, কারণ তাদের শিকড় গভীরে যায়। তাই, মাটির নীচে অনেক খণিজ মানে মাটির উপর গভীর জঙ্গল। বস্তারের অবস্থাও ঠিক তাই। এবং সমগ্র মধ্যভারতের মতই বস্তারের ক্ষেত্রেও নিউস-লণ্ড্রী ওয়েবসাইটের একটি কার্টুনে শ্রী সুমিতের করা একটি অমোঘ টিপ্পনী প্রযোজ্য – ‘নীচে মাল, উপর কাঙাল’। কাঙালদের হঠাতে হবে, বনস্থলী সাফ করতে হবে, নইলে খনিজ উঠবে কি করে?
গোটা বস্তার সম্ভাগের যা আয়তন, তার ৫১% জমি তুলে দেওয়া হয়েছে মাইনিং, পাওয়ার-প্ল্যাণ্ট সহ বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য। এর মধ্যে ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্টের খাঁই মারাত্মক। ঐখানে কাজ করা এক বন্ধু জানিয়েছিলো যে প্ল্যাণ্টের যন্ত্রপাতির অবস্থা তথৈবচ। অথচ, ভারতের গৌরব এই বি-এস-পি, নবরত্নের এক রত্ন সে, তাকে তো উৎপাদন করে চলতেই হবে। তাই, আউটপুট বাড়াতে, ইনপুট বাড়াতেই হবে। এ’দিকে ছত্তিসগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলাস্থ দল্লী-রাজারার মাইন শেষ হওয়ার মুখে। অতএব, বস্তার সম্ভাগের কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলা জুড়ে রাওঘাটে আকরিক লোহার নতুন মাইন বানাও নতুন, দান্তেওয়াড়া জেলার খ্যাতনামা বৈলাডিলার চলতি মাইনের প্রোডাকশান ক্যাপাসিটি ২৯ মিলিয়ন টন থেকে ২০২০র মধ্যে ১০০ মিলিয়ন টন কর, রাজনন্দগাঁওর মহামায়া অঞ্চলে ও বস্তার-সংলগ্ন বালোদ জেলার দুলকিতে নতুন মাইন বানাও, প্রভৃতি উদ্যোগ। শুধুই কি ভিলাই স্টীল প্ল্যাণ্ট? আয়রণ ওর মাইনের নাম করে নারায়ণপূরের অবুজমাড়ে, কাঁকেরের চারগাঁ নামের দুইটি গ্রামে এসে গিয়েছে নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানী। দান্তেওয়াড়ার বাচেলি ও কিরণ্ডৌলে তৈরী হচ্ছে আয়রণ ওর বেনেফ্যাকশান প্ল্যাণ্ট। ইতিমধ্যে বস্তারেই তৈরী হচ্ছে তিনটি স্টীল প্ল্যাণ্ট – ডিলমিলি, নগরনাড় ও লোহাণ্ডিগরে। প্রথমটি আবার ‘আল্ট্রা মেগা’। কাঁকেরের আমাবেড়া অঞ্চলে তৈরী হচ্ছে বক্সাইট মাইন।
আকরিক লোহা ও স্টীল প্ল্যাণ্ট ছাড়াও সমগ্র সম্ভাগ জুড়ে তৈরী হতে চলেছে হাইডেল প্ল্যাণ্ট, সিমেণ্ট কারখানা ও তদসংলগ্ন লাইমস্টোনের খণি, তৈরী হয়ে গিয়েছে অজস্র পাথরখাদান ও ক্রাশার, স্পঞ্জ আয়রণ প্ল্যাণ্ট, বাঁধ, রেলপথ, রাস্তা এবং অসংখ্য প্যারামিলিটারী ক্যাম্প। ইতিমধ্যে দান্তেওয়াড়ার বালুদ অঞ্চলে ভারতীয় বিমানবাহিনী পুরোদমে এয়ার-স্ট্রীপ বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। এর জন্য সাফ হয়ে যাবে মাইলের পর মাইল জঙ্গল, ভিটেমাটি হারাবে অজস্র গ্রামের অসংখ্য মানুষ। আর এর বিরুদ্ধে যাঁরা গলা তুলছেন, তুলবেন, তাঁরা চিহ্নিত হবেন উন্নয়ণবিরোধী দেশদ্রোহী হিসেবে। তাই নকশালদমনের ধুয়ো তুলে আদিবাসী-উৎখাতের এই বিপুল তোড়জোড় বস্তার তথা ঝাড়গ্রাম থেকে নাগপুর মধ্যভারতের সমগ্র আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে।
এইবারে, এইখানে, মানুষের ঘুড়ে দাঁড়ানোর কাহিনী। দুইজন আদিবাসী, গোঁড়-মুরিয়া জাতির অন্তর্ভুক্ত – সোনি সোরি ও তাঁর ভাগ্নে লিঙ্গারাম কোড়োপি। নিবাস দান্তেওয়াড়া জেলার সামেলি গ্রাম। দুইজনেই ক্লাস এইট পাস। রাষ্ট্রের চোখে খণিজ-সমৃদ্ধ অঞ্চলের শিক্ষিত আদিবাসী মানেই ডেঞ্জার। উৎখাত-প্রক্রিয়ার অন্তরায়। ২০০৬-০৭ থেকেই লিঙ্গাকে বারংবার প্রলোভন দেওয়া হতে থাকল আদিবাসীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া আদিবাসী কম্যাণ্ডোবাহিনীতে যোগদানের জন্য। লিঙ্গা অস্বীকার করলেন প্রতিবার। ফলাফল হল নিদারুণ।
অগাস্ট ৩১, ২০০৯। কল্লুরি তখন দান্তেওয়াড়ার স্পেশাল সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট অব পুলিশ। তুলে নেওয়া হল লিঙ্গাকে। ৪০ দিন পাব্লিক টয়েলেটের সাইজের একটা বদ্ধ ঘরে রাখা হল তাঁকে, কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বোধ করল না পুলিশ।
অক্টোবর ৬, ২০০৯। বিলাসপুর হাইকোর্টের সামনে আনীত লিঙ্গার ভাই মাসারামের করা হেবিয়াস কর্পাস পিটিশানের জেরে ছাড়া পেলেন লিঙ্গা। দুই ভাই মিলে গ্রামে ফিরে আসছিলেন বিলাসপুর থেকে। এমনসময় মাসারমকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেলো, দুইদিন লকাপবন্দী থাকল সে।
এপ্রিল ২০১০। লিঙ্গা ততদিনে সাংবাদিকতা শিখতে দিল্লিতে। সেইখানে নাগরিক সমাজের সামনে তিনি তুলে ধরলেন নকশাল-দমনের নামে বস্তারের উপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের রূপরেখা। মৌচাকে যেন ঢিল পড়ল।
জুলাই ২০১০। এইবার সোনি সোরির স্বামীকে তোলা হল ডাকাতির ভুয়ো কেসে। সেই কেসের চার্জশীটে পড়ে জুড়ে দেওয়া হল সোনি-লিঙ্গার নাম। বলা বাহুল্য, মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে এবং তিনজনকেই বেকসুর ঘোষণা করেছে কোর্ট।
জুলাই-অগাস্ট ২০১০। সোনির নাম জুড়ে দেওয়া হল আরো ছয়টা নকশাল হামলার চার্জশীটে। অথচ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল না। চার্জশীটে দেখানো হল ‘ফেরার’ হিসেবে। অথচ পেশায় শিক্ষিকা সোনি যে সরকারি আশ্রমের পড়াতেন সেইখানে তিনি নিয়মিত গিয়েছেন, অ্যাটেণ্ডেন্স রেজিস্টারে সই করেছেন, এমন কি জেলে স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছেন বহুবার, এবং বারংবার কল্লুরির সাথে দেখা করেছেন তাঁর স্বামীকে ছাড়ানোর অভিপ্রায়ে। প্রতিবারই কল্লুরি তাঁর সাথে যে ভাষায় কথা বলেছেন তাকে বিশুদ্ধ বাঙলায় ‘খিস্তি’ বলা চলে।
মার্চ ১১ – মার্চ ১৬, ২০১১ – তাড়মেটলায়, কল্লুরির নেতৃত্বে চলল যৌথবাহিনীর পূর্ববর্ণিত তাণ্ডবলীলা। দেশজুড়ে নিন্দার ঝড়। কল্লুরির ট্রান্সফার হল। ঘটনার কিছু পড়েই অঞ্চলে উপস্থিত হলেন লিঙ্গা, ভিডিও রেকর্ডের মাধ্যমে তুলে ধরলেন এই তাণ্ডবলীলার শিকার বহু আদিবাসী মানুষের আলাপচারিতা, ছড়িয়ে দিলেন ভিডিওসমুহ ইউটিউবে।
মার্চ ১৫ ২০১১ – উইকিলিক্সের একটি চাঞ্চল্যকর কেবল প্রকাশ হল এই মর্মে যে বস্তার সম্ভাগে মাওবাদীরা এসার নামক মাইনিং কোম্পানীর থেকে তোলা তুলছে, এবং এসার তাদের অপারেশন বহাল রাখার জন্য টাকা দিচ্ছেও।
মে ২০১১। সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ শেষ করে লিঙ্গা ফিরে এলেন নিজগ্রামে। জেলার কালেক্টর, পুলিশ কমিশানার, পুলিশ সুপার সকলের সাথে দেখা করে জানালেন যে তিনি শান্তিপূর্ণ ভাবে তাঁর বাড়িতে বসবাস করতে চান, স্বাভাবিক জীবনযাপনে ইচ্ছুক।
অগাস্ট ২০১১ – সোনি ও লিঙ্গা বারংবার ফোন পেতে লাগলেন কিছু অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির থেকে, তাঁদের বলা হতে লাগল বি-কে লালা নামধারী একজনের সাথে দেখা করতে। এই নামে কাউকে তাঁরা চিনতেন না।
সেপ্টেম্বর ৯, ২০১১ – লিঙ্গাকে তাঁদের গ্রামের বাড়ি থেকে সাদাপোষাকের পুলিশবাহিনী তুলে নিয়ে গেল। সোনি বুঝতে পারলেন না যারা তুলে নিয়ে গেছে তারা পুলিশ না ফৌজি না নকশাল।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১১ – উদভ্রান্ত সোনি ছুটে গেলেন দিল্লিতে। সাংবাদিক সম্মেলনে জানালেন পরিস্থিতি, নিখোঁজ লিঙ্গার নামে হেবিয়াস কর্পাস ফাইল করার উপক্রম করলেন।
ইতিমধ্যে তেহেলকা পত্রিকা একটা স্টিং অপারেশন করল। সোনির সাথে ফোনে কথা বলানো হল ছত্তিসগড় পুলিশের দান্তেওয়াড়ায় পোস্টেড এক কন্সটেবলের, যিনি স্পষ্ট জানালেন যে লিঙ্গার নামে, এমনকি সোনি ও তাঁর স্বামীর নামেই ভুয়ো কেস সাজানো হয়েছে। সেই স্টিং অপারেশন প্রকাশিত হয় তেহলকা পত্রিকাতেই (The Inconvenient Truth of Soni Sori, by Shoma Chaudhary in Tehelka Magazine, Vol 8, Issue 41, Dated 15 Oct 2011)
বেগতিক দেখে রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে ছুটে চলল ছত্তিসগড় পুলিশ, হানা দিলো রাজস্থানে খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী কবিতা শ্রীবাস্তবের বাড়ি অবধি।
অক্টোবর ৪, ২০১১ – ছত্তিসগড় পুলিশ সোনিকে তুলে নিয়ে গেল দিল্লি থেকে। তখনো দশেরার ছুটির কারণে লিঙ্গার উদ্দ্যেশ্যে হেবিয়াস কর্পাস পিটিশান আনা সম্ভব হয় নি।
অক্টোবর ৮-১১, ২০১১ – জেরার নামে সোনি সোরিকে কাস্টডিতে বিবস্ত্র করা হল, ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হল, বারবার গ্যাংরেপ করা হল, তাঁর যোনিতে ও পায়ুছিদ্রে প্রেরণ করা হল পাথর। পুরোটাই হল উপস্থিত ও-সি অঙ্কিত গার্গের তত্ত্বাবধানে। এসারের থেকে পয়সা নেওয়ার মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে চালান হওয়ার কথা তাঁর। অসুস্থতার কারণে তিনি এজলাসে উপস্থিত থাকতে পারলেন না। যোনিতে পাথরকূচি নিয়ে হাঁটাচলা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। দেশের আইন বলে অসুস্থ অভিযুক্ত এজলাসে উপস্থিত হতে না পারলে তাঁকে জ্যুডিশিয়াল রিম্যাণ্ডে জেলে পাঠানো যায় না। অথচ জজ তাই করলেন।
অক্টোবর ২০১১ – রায়পুরের আম্বেদকার হাসপাতাল জানালো যে সোনি অসুস্থতার মিথ্যা ভান করছে।
২০শে অক্টোবর ২০১১ – সুপ্রীম কোর্টে যে মামলা আনার আগেই সোনিকে গ্রেপ্তার করা হয় সেই মামলা অবশেষে প্রাথমিক শুনানী হল। মামলার নম্বর Writ Petition (Crl) 206 of 2011। সুপ্রীম কোর্ট আম্বেদকর হাসপাতালের সিদ্ধান্তে দ্বিমত প্রকাশ করে নির্দেশ দিলো কলকাতার নীল রতন সরকার হাসপাতালে তাঁর আঘাতের আবার পরীক্ষা করাতে।
২৫শে নভেম্বর ২০১১ – নীল রতন সরকার হাসপাতালের পরীক্ষায় জানা গেল যে দুইটি পাথরকুচি তাঁর যোনির এবং একটি তাঁর পায়ুনালীর গভীরে গেঁথে রয়েছে, এবং শিরদাঁড়ার নিম্নভাগের কিছু মাংসপেশী ছিঁড়ে গিয়েছে।
২রা মে, ২০১২ - এন-আর-এস কর্তৃক প্রদত্ত মেডিকাল রিপোর্টের এক অংশ ধরা পড়ল উপরোক্ত মামলায় সুপ্রীম কোর্ট প্রদত্ত অন্তর্বর্তী রায়ে, নিম্নখচিত বয়ানে –
‘From the Report, which was submitted by the Chairman of the Medical Board and Medical Superintendent-cum-Vice Principal, NRS Medical College & Hospital, Kolkata, it appears that two foreign bodies were recovered from her vagina and one foreign body of the same size was recovered from her rectum. The same were removed, abelled, sealed, and signed and, thereafter, sent to this Court along with the Report. The existence of foreign bodies measuring 2.5 X 1.5 X 1.0 cm and 2 X 1.5 X 1.5 cm, is still to be satisfactorily explained by the investigating authorities, since it has been asserted by Ms. Soni Sori that the same were inserted by the police during her custodial interrogation’
ইতিমধ্যে দুটো বছর কেটে গেলো। পুলিশের বর্বরতার ফলে সোনি ও লিঙ্গা পরিণত হলেন বস্তারের সামগ্রিক রাষ্ট্রনির্ঘোষিত সন্ত্রাস ও আদিবাসী-পীড়নের বিরুদ্ধে উত্থিত কঠিনতম স্বরে। সমস্ত ভুয়ো মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেলেন তাঁরা। অন্যদিকে অঙ্কিত গার্গকে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় দিলেন সোনার মেডেল। আর ২০১৪ সালে, সমস্ত বস্তার সম্ভাগের পুলিশের মাথা তথা ইনস্পেক্টর-জেনারেল অব পুলিশ পদে উন্নীত হলেন এস আর পি কল্লুরি। ২০১৪ সালের ঘটনা। জোরকদমে বেড়ে চলল বস্তার জুড়ে একের পর এক ফলস এনকাউণ্টার তথা খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, গৃহদাহ, ভুয়ো চার্জে অ্যারেস্ট প্রভৃতি। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই, প্রাণের উপর ঝুঁকি সত্ত্বেও, সোনি ও লিঙ্গা আওয়াজ তুললেন। পাশে পেলেন আম আদমী পার্টিকে, পেলেন কিছু সদিচ্ছুক, শান্তিকামী, ন্যায়কামী আইনজীবি, বুদ্ধিজীবি ও সাংবাদিককে।
কল্লুরি ও তাঁর বাহিনীও থেমে থাকলো না। নিয়ত ফোনে, সাক্ষাতে সোনি ও লিঙ্গাকে নানান ভাবে শাসায় এই নরপিশাচ আইজি। থানায় উপস্থিত হওয়ার জন্য নিয়ত ফোনকল চলতে থাকে।
২৯শে জুলাই ২০১৫-এ দান্তেওয়াড়ার নাহাড়ি গ্রামে নেমে আসা পুলিশি বর্বরতার বর্ণনা দিয়েছি উপরে – যেইখানে হেমলা পোড়িয়ার মৃত্যু হয় এবং ১৮জন শিশু ও কিশোরকে নাটক-গানের দলের সাথে এসে নকশাল চার্জে জেলে ঢোকানো হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদ করার ফলে কল্লুরি সোনিকে প্রবলভাবে থ্রেট করে, এবং প্রেস কনফারেন্স মারফৎ জনসাধারণের কাছে আর্জি জানায় সোনি-লিঙ্গাকে সপরিবার একঘরে করে দেওয়ার।
আবার ৬ই অক্টোবর ২০১৫তে, দান্তেওয়াড়ার অরণপূর থানাস্থ নিলভয় গ্রামে ভীমা মাড়বি পঞ্চাশোর্ধ এক আদিবাসীকে এনকাউণ্টার করে পুলিশ, তাঁর শব দাহ করা হয় সুরক্ষা-বাহিনীর এক বিরাট দলের ঘেরাটোপে এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের অনুপস্থিতিতে; যখন উক্ত ভীমা নকশাল নয় বলে তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠেন গ্রামের মানুষ, তখন সোনি যান এফ-আই-আর রুজু করতে। এফ-আই-আর তো নিলোই না পুলিশ, উলটে সোনিকে ভয় দেখানো হল যে তাঁর নামে আবার মামলা ঠুকে দেওয়া হবে এই মর্মে যে তিনি গ্রামের মানুষকে ভীমার শব পুলিশের অবর্তমানে দাহ করে প্রমাণ-লোপাটের চেষ্টা করেছেন। এই বিষয়ে ১৩ই অক্টোবর তিনি ছত্তিসগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিংএর সঙ্গে দেখা করবার উপক্রম করলে তাঁকে ও অন্যান্য কিছু গ্রামবাসীকে তাঁরই গ্রাম সামেলির ক্যাম্পে ডিটেন করা হয়।
ইতিমধ্যে, ২০১৫ সালেই, গীদম শহরের এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করার পর, কোনো প্রমাণ বা যৌক্তিকতা ছাড়াই কাল্লুরি সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে এই হত্যার পিছনে সোনি-লিঙ্গার হাত রয়েছে। যদিও সে বিষয়ে অদ্যাবধি কোনো চার্জশীটে তাঁদের নাম জোড়া হয় নি, কিন্তু, হতে কতক্ষণ?
ইতিমধ্যে আর-এস-এস ও পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’, ‘নকশাল পীড়িৎ সংঘর্ষ সমিতি’ প্রভৃতি – যেগুলির পুরোভাগে রইলো মধুকর রাও সহ সলওয়া জুড়ুমের বহু কুখ্যাত পুরোধাগণ। আদিবাসী ও দলছুট প্রাক্তন-মাওবাদীদের নানান অস্ত্রে সজ্জিত করার পালা শুরু হল পুরোদমে।
এরই পরে ঘটে গেল ২০শে ফেব্রুয়ারী ২০১৬র কেমিক্যাল অ্যাটাক। সেইদিন সকাল বেলা সোনি গিয়েছিলেন কল্লুরির বিরুদ্ধে এস-সি-এস-টি (প্রিভেনশান অব অ্যাট্রোসিটিস) অ্যাক্ট, ১৯৮৯ অনুসারে নালিশ রুজু করতে। হামলাকারীরা সোনির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে যে উক্তি ছুঁড়ে দেয় তার সারমর্ম হল – ‘তোর কত বড় সাহস তুই কল্লুরির বিরুদ্ধে নালিশ করতে যাস?’
আমরাও ভাবি, কত বড় সাহস এই সোনি সোরির যে আজ সব কিছু সত্ত্বেও সমস্ত ভয় তুচ্ছ ফৌজি ক্যাম্পে ঘেরবন্দী তাঁর গ্রাম সামেলিতে ভিটেমাটি আঁকড়ে বসে আছেন, প্রতিবাদ করে চলেছেন এই সকল অনাচারের?
সোনির উপর হামলা ও তার তদন্তের প্রতিবাদে দেশজুড়ে নিন্দা হয়, প্রতিবাদে মিছিল বের হয় বম্বে, দিল্লী, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর ও কলকাতায়। রায়পুরেও গত ১৮ই মার্চ জমায়েত হন কিছু মানুষ, যাঁর মধ্যে সোনি সোরি, ডক্টর বিনায়ক সেন প্রভৃতিও উপস্থিত ছিলেন। তীব্র প্রতিবাদ করা হয় বস্তারের পুলিশি ও ফৌজি বর্বরতার।
এদিকে ১৭ই মার্চ অকস্মাৎ খবর আসে, ছত্তিসগড়-মুক্তি-মোর্চা-দল্লি-রাজারার সাথে যুক্ত তথা রাজনন্দগাঁওয়ের দল্লি-রাজারায় অবস্থিত শহীদ হাসপাতালের প্রবীণ ডাক্তার শৈবাল জানাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ছাব্বিশ বছর পুরোনো একটি কেসে। ছাব্বিশ বছর আগে, ১৯৯২ সালের ১লা জুলাই, ভিলাইতে ‘রেল রোকো’ অভিযান চালায় ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চার অযুত শ্রমিক। সেই সময় ভিড় লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় পুলিশ, প্রাণ হারান ১৭জন শ্রমিক। সেই সময় অ্যাম্বুলেন্স সহ আহত শ্রমিকদের শুশ্রূষার কথা মাথায় রেখে এবং ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চার সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডঃ জানা। ছাব্বিশ বছর এ’বিষয়ে তিনি কোনো নোটিশ পাননি, জানতেনও না যে এরকম একটা মামলায় শান্তিভঙ্গ, রায়টিং প্রভৃতির দায়ে নালিশ রুজু হয়েছে তাঁর নামে। বাকি যাঁদের নামে হয়েছিলো তাঁদের কেস ক্লোসড হয়ে গেছে এতদিনে। অথচ, সহসা এই চার্জে গ্রেপ্তার হলেন তিনি, সুপ্রীম কোর্টের একাধিক রায়, সি-আর-পি-সি প্রভৃতি সমস্ত আইন ভেঙে হাতে হাতকড়া পড়িয়ে চেন দিয়ে বেঁধে তাঁকে জেলে নিয়ে চলল পুলিশ। গতকাল অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ২০১৬ তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়। এতদিন ছুটিছাটা এবং জজের অনুপস্থিতির কারণে তাঁর জামিনের আবেদন গ্রাহ্য করা হয় নি।
আসলে, বস্তার তথা সোনি-লিঙ্গার উপর হামলার প্রতিবাদে আর বহু মানুষের মতই মুখর হয়েছিলেন ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চা-দল্লি-রাজারার বর্ষীয়ান নেতা জনকলাল ঠাকুর। সেইজন্যই কি সহসা এই গ্রেপ্তারী ও হাতকড়া?
১৮ই মার্চ রায়পুর-জমায়েতের আগের দিনই ল্যাণ্ড-মাইন বিস্ফোরণে বস্তারে প্রাণ হারায় ৮ বছরের এক আদিবাসী শিশু। পুলিশ বয়ান দেয়, এই ল্যাণ্ডমাইন মাওবাদীদের পোঁতা। এর প্রতিবাদে ঐ ১৮ই মার্চই জগদলপুরে সমাবেশ করে সামাজিক একতা মঞ্চ। পুলিশের নানান হর্তাকর্তা উপস্থিত ছিলেন সেই র্যালীতে। বিরাট সব পোস্টার পড়ে – ‘নকশালী শালিনী গেরা বস্তার ছোড়ো’ ইত্যবিধঃ, সোনি সোরির বিরুদ্ধে জমিয়ে স্লোগানবাজি হয়। অথচ, এই লেখাটা লেখার সময় জুড়ে অধম কিছু বস্তাররের স্থানীয় মানুষের সাথে এ’বিষয়ে কথা বলে। সকলেরই অভিমত, মাইনটি নকশালদের পোঁতা নয়, পুলিশেরই কাজ, যাতে রায়পুরে সোনি সোরিদের বস্তারের পুলিশ ও ফৌজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-জ্ঞাপক জমায়েতের পাশাপাশি জগদলপুরে এঁদেরই ধিক্কার জানিয়ে র্যালি বের করা যায়।
ইতিমধ্যে, এই লেখাটা লিখতে লিখতেই, খবর এলো যে, প্রভাত সিং-এর পাশাপাশি আরেক সাংবাদিক দীপক জয়সওয়ালকেও গ্রেপ্তার করেছে ছত্তিসগড় পুলিশ। দীপক ও প্রভাত একসাথে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন ছত্তিসগড়ের স্কুলে শিক্ষকদের সহায়তায় ছাত্রদের করে চলা অনবরত চীটিং-এর। তাই শিক্ষকেরা এঁদের বিরুদ্ধে একযোগে নালিশ এনেছে যে তাঁরা নাকি সরকারী চাকুরে শিক্ষকদের জোর করে ভয় দেখিয়ে পরীক্ষা চলাকালীন হলে ট্রেসপাস করেছিলেন। অর্থাৎ আই-টি অ্যাক্টের পাশাপাশি প্রভাতের বরাতে জুটলো ভারতীয় দণ্ডবিধি সংহিতার ধারা। আজ দীপকের জামিনের আবেদন জানান দান্তেওয়াড়া কোর্টের এক আইনজীবি। পত্রপাঠ আবেদন খারিজ হয়।
ইতিমধ্যে বেলা ভাটিয়ার নামে ‘নকশালী বেলা ভাটিয়া বস্তার ছোড়ো’ পোস্টার লটকিয়ে, তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করেই খান্ত হয় নি পুলিশি মদতে বাড়তে থাকা স্থানীয় গুণ্ডাবাহিনী। গতকাল অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ২০১৬ বস্তার জেলায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে হাজির হন ১০০ জন গুণ্ডা। সৌভাগ্যবসতঃ তিনি তখন গ্রামে ছিলেন না। গ্রামজুড়ে তারা র্যালী করে – স্লোগান তোলে – ‘বেলা ভাটিয়া মুর্দাবাদ’ এবং তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী জঁ দ্রেজকে নকশাল হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের অবিলম্বে বস্তার ছাড়ার চেতাবনি দেওয়া হয়।
সমগ্র বস্তার থমথম করছে আজ, খুনে গুণ্ডা ধর্ষকদের কায়েমী আধিপত্বে। নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার-কামীদের বিরুদ্ধে, ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধে খোলামেলা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে কল্লুরিবাহিনী। ‘সুপারস্পাই’ অজিত দোভাল ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর অতি পেয়ারের এই নরপিশাচের বাহিনীরা অবাধে খুন ধর্ষণ লুঠতরাজ চালিয়ে চলেছে নকশালদমনের নামে। গণতান্ত্রিক সমস্ত কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। কল্লুরি কেন্দ্রসরকারকে জানিয়েছে, এক বছরের মধ্যে বস্তার-সম্ভাগকে নকশালমুক্ত করবেই সে। ২০১৯এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বেশ কিছু মাইনিং কোম্পানী প্রভৃতিকে তুষ্ট করতেই হবে যে ক্ষমতাসীন গেরুয়া সন্ত্রাসবাদীদের!
তবুও সোনি সোরিরা লড়ে চলেছে, চলবে। আমরা দেখব, অবাক হব আর অনুপ্রেরণা খুঞ্জে নেব এঁদের আশ্চর্য্য উজ্জ্বল সাহসের পরশমণিতে। কি ভাগ্যিস প্যাণ্ডোরা পুরো বাক্সটা খুলে ফেলে নি!
কাঁকের, ২৭/০৩/২০১৭
ভোর চারটে
এই লেখার কোনো মালিকানা নেই। সবাই পড়ুন, ছড়িয়ে দিন চারিদিকে।