ঘোটুলের সাথে, লিঙ্গোবাবার কিংবদন্তীর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে কোলাং নাচের কথা। ঘোটুলের সাথে সাথেই কোলাং-ও যেন মুছে আসছে বস্তারের অরণ্যজীবন থেকে। অনাবিল আনন্দের স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছ্বাস ও উদযাপন – রঙ্গিন কাপড়, গলায় অদ্ভুত মালা, মাথায় অদ্ভুত পাগড়ী, কখনো বা তাতে পালক গোঁজা, পায়ে ঘুঙুর পরে যুবক-যুবতীরা মেতে ওঠে এই কোলাং-উদযাপনে।
‘কোলাং’ নাচের গল্প
গোঁড় ভাষায় কাঠের লাঠিকে একবচনে কোলা এবং বহুবচনে কোলাং বলা হয়। তবে এই উদযাপনের পরিপ্রেক্ষিতে, কোলাং ‘ধাংবাই’ নামের একটা বিশেষ গাছ থেকেই বানানো হয়। গোঁড় ভাষায় এই গাছের নাম ‘পিট্টেসিতুম’। পৌষ মাসের গোড়া থেকে আরম্ভ হয় এই উদযাপন, পূর্ণিমাতে বাড়তে থাকে এর ধুমধাম, তারপর পঞ্চমী তিথিতে চরমে ওঠে স্ফুর্তির স্ফূরণ। তারপর স্তিমিত হতে হতে অমাবস্যার চাঁদের সাথেই মিলিয়ে যায়। সব ঘোটুলের গানের একজন গুরুটাইপ থাকে, সে আগের থেকেই তার শিষ্য বেছে নেয়, যারা কোরাস দেবে। প্রথম দিন কোনো কাঠের ডাণ্ডার ব্যবহার হয় না। প্রথম রাতে যুবক যুবতীরা ঘোটুলে জমায়েৎ হয়। গোল করে নাচতে গাইতে থাকে। আবার সামনে সিনিয়রদের করা গোলের পিছন পিছন ল্যাজ হয়ে নাচতে থাকে তাদের জুনিয়রগুলি। এদের নাচ-গানের নাম এখন ‘হিচেলহার’। গানের বিষয় হল জীবনের বিভিন্ন রূপ, এবং বিরাট প্রকৃতি ও অন্তহীন ইউনিভার্সের সামনে মানুষ কত সামান্য – শরীর কত নশ্বর। পরের দিন সকালে অন্ন-জল-গ্রহণ না করে ‘লেয়োর’, মানে কোলাং-নৃত্যে সামিল যুবকেরা বনে গিয়ে কেটে আনে অজস্র ধাংবাই গাছের ডাণ্ডা। ছাল ছাড়িয়ে আগুনে সেঁকে সেই ডাণ্ডাগুলো বিশেষ আকার-আকৃতি ধারণ করলে তখনই তা পরিণত হয় কোলাং-এ। এবার সেগুলো এনে জড়ো করে রাখার পালা তাদের ঘোটুলেরই মাইতে। এইবার এরা নাচতে গাইতে বেরিয়ে পরে গ্রামের গাইতার বাড়ি। হাসি-হাসি মুখে বেরিয়ে আসে গাইতা। আশীর্বাদ করে লেয়া-লেয়োরদের। গাইতার পত্নী দেয় ‘শেষা’-দান। দান গ্রহণ করে গাইতার সাথে ওরা হাজির হয় গ্রামের সীমানায়। সেইখানে করে ‘তপররউমনা’-নামের পুজোআচ্চা। এইটা ওদের গ্রামের বাইরে যাওয়ার রাইট অব প্যাসেজ।
গাইতার থেকে বিদায়ী নিয়ে এরপর এরা যাবে পাশের গ্রামে। সেইখানে গিয়ে তারা পরে নেবে নাচগানের বিশেষ সাজসজ্জা। নাচিয়েরা গলায় পড়বে হরেক রকমের মালা। কেউ পড়বে চাঁদির সিক্কা, পুরোনো মোহোর, কয়েন দিয়ে গাঁথা মালা, কেউ পড়বে মুগডালের মুঙ্গামালা, কেউ আবার পড়বে সুতোয় রূপো-বাঁধা হার। আবার পাগড়ীও কর কিসিমের! কারুর বুঝি এক প্যাঁচে বাঁধা – যেইটায় আবার রেশমের দড়ি দিয়ে কারুকাজ করা – তাতে আবার গোঁজা ময়ুরপুচ্ছ – যার গোঁড় ভাষায় নাম ‘কুপার’। এই এক-প্যাঁচের ময়ুরপুচ্ছ পাগড়ির নাম ‘ছত তুমা’। আবার রয়েছে ‘কোসারী’, মানে কোশা কাপড়ের পাগড়ি, যার এক প্যাঁচ মাথার সাথে বাঁধা আর বাকিটা পিছনে ঝুলছে রঙবাহারী ল্যাজের মতো। এই সব পাগড়ির বাহারের ঠেলায় তো গোঁড় ভাষায় একটা কথা প্রচলিতই হয়ে গেছে – ‘বুম গোরর – গোরর কুপার – নেল গোরর – গোরর তোকারৎ’ – অর্থ – ‘আসমান ছোঁয়া পাগড়ির ময়ুরশিখি আর জমিন ছোঁয়া তার ল্যাজ’। এই সব সাজের উপর আবার পায়ে পরা হয় কত রকমারি ঘুঙুর। ১০০-১৫০ টা বড় সাইজের কাঁসার তার বাঁধা ঘুঙুর জোগার হয়। আবার ছোটো ছোটো নুপুরও, পিতলের – তাতে আবার ঝুলছে ডিম্বাকৃতি ছোটো ছোটো ছররা, এক দিক বাঁধা হয় গোড়ালির সাথে তো অপর দিক হয় আঙুলের ফাঁকগুলো দিয়ে।
এই সব পড়ে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে যুবকবৃন্দ হাজির হল পাশের গ্রামের গাইতার কাছে। তার আশীর্বাদ নিয়ে হাজির হল সেই পাশের গ্রামের ঘোটুলে – এইবার চলল সারারাত দেদার গানের পালা। সেই গ্রামের ঘোটুলের লেয়া, মানে যুবতীরা-রা গানের মাধ্যমে হেঁয়ালী কৌতুকের প্রশ্নশেলে বিঁধতে থাকলো লেয়োর, মানে পাশের গ্রামের ঘোটুলের যুবকদের, আর সেই লেয়োরেরা গানে গানেই জবাব দিতে লাগল, উত্তর প্রত্যুত্তরে জমে উঠলে রাতের মৌতাত, রঙ্গকৌতুকের ফোয়ারা। এই গানের লড়াইয়ের নাম ‘দ্রার’। নাচে গানে সকাল হল। এ’বার বেরোনোর পালা। নাচিয়ে গাইয়ের দল আবার চলল গাইতার বাড়ির উঠোনে – এইবারের নাচের নাম ‘দেউর তেররুহানা’। নর্তকেরা একে অপরের কাঁধে চড়ে বানিয়ে তুললো মানব-মীনার – তারিফ ও আশীর্বাদ কুড়োলো গ্রামবাসীর, গাইতার। এইবার সাদরে খাওয়ানো হবে নাচিয়ে-গাইয়েদের, তারপর আবার সেই গ্রামের গাইতা-পত্নীর থেকে ‘শেষা’ বিদাই গ্রহণের পালা।
তারপরে এরা ফিরে আসবে নিজেদের গ্রামে। গ্রামের সীমানায় এসে গানের দলের যে সরদার, মানে ‘পাটা গুরু’, সে গেয়ে গেয়ে আশপাশ থেকে নিয়ে আশা ভুত-প্রেত ও রোগ-অসুখের বালাইগুলো ঝাড়বে, তারপরে লেয়া-লেয়োরের দল ফিরে আসবে গ্রামে। আবার নাচবে গাইবে তাদের নিজেদের গ্রামের গাইতার উঠোনে, সেখান থেকে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতেই ফিরে আসবে নিজদের ঘোটুলে, ততক্ষণে ‘লেয়া’ মানে সেই ঘোটুলের যুবতীরা এক বিশেষ সেজে-বুনে-বিছিয়ে রেখেছে শিমূল অথবা বিংরডোল গাছের ছাল জুড়ে জুড়ে। সেইখানে প্রথমে পাটা গুরু, মানে গানের দলের সরদার – তার কোলাং-ডাণ্ডা রাখবে, তারপর বাকিরা রাখবে। তারপর ঘোটুলের সকলে মিলে আরম্ভ করবে তুমুল ‘কোলাং রেহানা’ নাচ, মানে কোলাং রাখার নাচ।
বলা বাহুল্য, ঘোটুলের সাথে সাথে, ক্ষয়ে আসে লিঙ্গোবাবার রূপকথার সাথে সাথেই, মুছে এসেছে এই সব নাচের বোল, গানের সুর... ঘোটুল না থাকলে কোলাং হবে কেমনে? আর যেইখানে চারিদিকে বন্দুক হাতে টহল দেয় হিংস্র ধর্ষকামী বহিরাগতরা, জল-জঙ্গল-জমির উপর উদগ্র লোভের বিষে চ্যাটচ্যাটে থাবা বসায় মুনাফাকামী ‘ডেভেলপমেণ্ট’বাদীরা, সেইখানে কি আর এই আনন্দ, এই গান, নাচ, মুক্ত জীবনের উচ্ছ্বাস – কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট রাখতে দিয়েছি বা দেবো আমরা? রাওঘাট থেকে, বৈলাডিলা থেকে – লোহা না পেলে, চলবে কি করে আমাদের লৌহযুগ, আমাদের নাগরিকতার প্রয়োজনীয় প্রায় সমস্ত বিষয় ও আষয়গুলো?
কাঁকের
১৪-০৭-২০১৬
এই লেখার কোনো ব্যক্তি মালিকানা নেই। আমরা সবাই মিলে লিখছি, পড়ছি, চিনছি বস্তারকে।