এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • তন্ত্রপুর ( ১ম পর্ব )

    ARIJIT MUKHOPADHYAY লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ জুন ২০২৫ | ৩২ বার পঠিত
  • |

     
    প্রথম পর্ব:
     
     
     
    হেতমপুর গ্রামে নতুন বিয়ে হয়েছে রূপার। নতুন বলতে বছর তিনেক হবে। বাপের বাড়ি পাশের গ্রামেই - বেলডিহা। বিশু - ওর স্বামী, শহরের একটা পেপারমিলে কাজ করে। পরিবারে তেমন আর কেও নেই। বিশুর বাবা মা দুজনেই গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর হল। আর্থিক অনটনের কথা বাদ দিলে ওদের সমস্যা একটাই - রূপা এখনও নিঃসন্তান। বিয়ের তিনবছর পরেও বিশুর কোন সন্তান না হওয়ায় শহরে ডাক্তারও দেখিয়েছে অনেক, কিন্তু আশানুরূপ ফল এখনও পেয়ে ওঠেনি। পাড়ার লোকজনও অনেক কটূক্তি করে ওদের। এমনকি রূপাকে কুনজর, কুপরামর্শ বা কুপ্রস্তাব দিতেও ছাড়েনি। এই সন্তান না হওয়ার সমস্যা ছাড়া ওদের জীবনে আর কোন সমস্যা ছিলনা এযাবৎ। পয়সা কড়ির টান থাকা সত্ত্বেও বিশু আর রূপা নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল ওই পরিস্থিতিতে, সংসার সাজিয়েছিল নিজেদের মত করে। আসলে সত্যিকারের ভালবাসলে প্রিয়জনের সঙ্গটাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর্থিক দুর্দশাকে তুচ্ছ মনে হয়, মনে হয় সে পাশে থাকলেই পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান চট করে হয়ে যাবে। রূপা আর বিশুও হয়ত সেরকমই কিছু একটা ভেবেছিল!
     
    কিন্তু ইদানিং বিশুর শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। সম্প্রতি পেপারমিলে কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে সে। এখন প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে তার, কখনও পেটের ভীষণ গণ্ডগোল, কখনও বা মাথার যন্ত্রণা, শ্বাসকষ্ট, কখনও আবার কাজ করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া। এই ছুটকো বাধা বিপত্তি হামেশাই লেগে থাকে এখন বিশুর দৈনন্দিন জীবনে। এর আগে কোনোদিনই বিশুর এরকমটা হয়নি, কস্মিনকালেও না!
     
    রূপারও কদিন হল পেটে ভীষণ যন্ত্রণা। বিশেষ করে রাত্রিবেলা ব্যথায় ছটফট করে সে! ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খেলেও সে যন্ত্রণা কমার কোনো ইঙ্গিতই পাওয়া যায়না। চোখের নিচে কালি পড়ে রূপার সোনার টুকরো মুখখানা এক্কেবারে ভূতের মত হয়ে গেছে। দিন দিন তার জৌলুস কমছে আশ্চর্যরকম ভাবে। অথচ ছোটবেলায় তার গায়ের উজ্জ্বল রঙ আর রূপের জন্যই ওর ঠাকুমা নাম রেখেছিলেন - রূপা। কয়েকমাস আগেও রূপের বহরে গ্রামে বেরোনো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল রূপার। গ্রামের বখাটে ছেলেগুলো ওর সন্তানহীনতাকে কটূক্তির হাতিয়ার করে উত্যক্ত করতো। পাড়ার মোড়ের মুদিখানার দোকান যাওয়া অবধি অন্তরায় উঠেছিল রূপার, শুধুমাত্র তার মোহময়ী রূপের জন্য। ছেলেগুলো চাতকের মত ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো, সুযোগ নিয়ে কথা বলতে আসতো যেচে, কুপ্রস্তাব দিতো।
     
     ইদানিং রূপার দিকে আর কেও ঘুরেও তাকায়না। বরং লোকে এখন টোন টিটকিরি মারে, বলে,"ও বৌদি? তোমার রূপের ঝলক কোথায় গেল? দাদা খেতে টেতে দিচ্ছে না নাকি?" কেও কেও ওকে দেখে ফিসফিস করে বলে - ডাইনি! কেও আবার মুখ টিপে হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যায়! রূপার এই হঠাৎ শরীর ভেঙে বুড়িয়ে যাওয়াটা সত্যিই অদ্ভুত - মনে হয় কেও যেন ' কালা জাদু ' করে ওর এই অবস্থা করেছে! না হলে এমন হঠাৎ শারীরিক পরিবর্তনের প্রমাণ দেখে ডাক্তারও হতভম্ব হবেন কেন?
     
    একথা বিশু জানলেও ওই বজ্জাত ছেলেগুলোর সাথে পেরে ওঠার শক্তি বা সামর্থ্য কোনোটাই ছিলনা তার। এই তো কটা টাকা আয়! সুন্দরী বউ থাকায় বিশুকে গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ সহ্য করতে পারেনা। চেনা জানার মধ্যে শুধু পাশের বাড়ির মিতন আর তার বউ কনকচাঁপা। টোটো চালায় মিতন। মিতনের অবশ্য একটা দুবছরের ছেলে আছে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলে রূপার চোখ ছলছল করে ওঠে - এরকম একটা ফুটফুটে বাচ্চা যদি তারও থাকত!
     
    কয়েকদিন পর মিতনের বউ কনকচাঁপা রূপার কাছে এসে এক তান্ত্রিকের সন্ধান দেয়, বলে,"এ্যাই রূপা, যা না রে একবাট্টি ওর কাছে! শুনেছি মস্ত বড় তান্ত্রিক! যে কোনো সমস্যার সমাধান ওর কাছে আছে বটে! তোর বরকে একটিবার বল তোকে নিয়ে যেতে! এত তো ডাক্তার - বদ্যি করলি - কিছু হল কী? শুনেছি উই মাঝমাঠে এখন ছাউনি করে থাকছে বটে!"
     
    রূপা কিছু উত্তর না দিয়ে কাজ করে যায়। সে হয়ত শেষ আশাটুকুও উপড়ে ফেলে দিয়েছে! হয়ত এটাই তার ভাগ্য, নিয়তি! কিন্তু ও তো কারোর কোনোদিন খারাপ করেনি, চায়ও নি! তবে ঈশ্বর ওর কপালেই কেন এমন লিখন লিখলেন? এর উত্তর শুধু উনিই দিতে পারেন!
     
    সন্ধ্যেবেলা বিশু কাজ থেকে ফিরে রূপাকে জানায়,"আজ ফেরার পথে এক তান্ত্রিক বাবার কাছে গিয়েছিলুম জানো? নাম বলল - বাবা বিরূপাক্ষ তান্ত্রিক! খুব নাম ডাক! আমার সামনে একটা বাচ্চাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন জানো? বাচ্চাটা হাঁটতে পারত না। কী একটা মন্ত্র পোড়া জল খাইয়ে দিলেন - ছেলেটা নিজের থেকেই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হল সিনেমা দেখছি! এ যে বাস্তবে হয় - এই প্রথম জানলুম, দেখলুম!"
     
    কনকচাঁপা যে ওবেলায় তার কাছে এসে তান্ত্রিক বাবার খোঁজ দিয়ে ওর কাছে যেতে বলেছিল তা গোপন রেখেই রূপা উনুনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে জিজ্ঞেস করল,"আর কী দেখলে? সে বাবা কী মন্ত্র পড়ে পেটে বাচ্চা এনে দিতে পারবেন? পারবেন আমার কোলে আমার খোকাকে এনে দিতে?"
     
    "পারবেন বৈকি! ওসব ওঁদের বাঁ হাতের খেল! গণশা বলল, বাবা নাকি কুম্ভমেলা থেকে পায়ে হেঁটে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনকয়েক এখানেই থাকবেন, তারপরেই নাকি আবার অন্যকোথাও চলে যাবেন। শুনলাম, উনি নাকি হিমালয় পর্বতে সাধনা করেছিলেন বছরখানেক!"
     
    এবার রূপা এদিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল,"তা এই গণশা-টা কে শুনি?"
     
    "গণেশ গো? আমার সাথে কাজে যায় না? পাশের গ্রামের গো? হারু কাকুর ছেলে। ওর সাথেই তো গিয়েছিলুম আজ বাবার কাছে। দেখলুম- সিঁদুর মাখানো মরার মাথার খুলিগুলো সামনে ডাঁই করা! বাবার হাতে একটা হাড়ের টুকরো! গায়ে লাল কাপড়! গলায় হরীতকী ঝুলছে অনেকগুলো! চুল আর দাড়ি এত্ত বড় হয়ে গিয়ে মিশে গেছে যে আলাদা করা মুসকিল! গোটা গায়ে সাদা ছাই মাখা! কপালে তিলক! গণশা বলল - ওগুলো শ্মশানের ছাই, মরা পোড়ার ছাই! এসব তান্ত্রিকরা নাকি শ্মশানে আসা আধপোড়া লাশ গুলো তুলে এনে সাধনা করে! মৃতদেহের সাধনাই নাকি এদের আসল তন্ত্র সাধনা!"
     
    "তা এতই যখন নামগান করছো, তাহলে একটিবার নিয়েই চল না বাপু?"
     
    "আরে সেজন্যই তো গিয়েছিলুম গো। তাহলে আর বলছি কেন? কথা বলে এসেছি। সামনের রোববার সময় দিয়েছেন উনি। আমারও ওইদিন ছুটি। কী বলো? বেশি দেরি করা যাবে না। বাবা যদি আবার অন্য কোথাও চলে যান?"
     
    "টাকা পয়সা কিছু....?"
     
    "ছিঃ ছিঃ! গণশাকে জিজ্ঞেস করেছি। বললে বাবা কিছু নেন টেন না! তাঁর নাকি টাকা পয়সার দিকে টান নেই! সে এসব মায়া, লোভ থেকে মুক্ত!"
     
    "এ তো খুব ভাল কথা গো! মিতনদার টোটো টা তাহলে বলে রাখবো নাকি?"
     
    "হ্যাঁ বলে রেখো, আমি বরং গোটা দশেক মন্ডা কিনে আনবো শংকরের দোকান থেকে। টাকা পয়সা কিছু নেবেন না যখন, কিছু হাতে করে নিয়ে যেতে তো হবে?"
     
     
     
     
    (চলবে....)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন