এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • তন্ত্রপুর ( ২য় পর্ব )

    ARIJIT MUKHOPADHYAY লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ জুন ২০২৫ | ২৫ বার পঠিত
  • |
     

     
     
     
     
     
     
     
     
    দ্বিতীয় পর্ব:
     
     
     
    রবিবার বিশুদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মত। সকালেই ওরা স্নান সেরে নতুন জামা কাপড় পরে তৈরি। শুধু মিতন আর কনকচাঁপার টোটো নিয়ে আসার অপেক্ষা। 
     
    রূপার আর তর সয়না, বলে,"একবার গিয়ে দেখো না গো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো?"
     
    বিশু উত্তর দেয়,"দেরি কেন হবে? মিতন ঠিক সময়ে এসে হাজির হবে দেখো, ওর সময়জ্ঞান আছে। দেখলে না? সেবার বাস ধরতে গেলুম, কেমন ঠিক সময়ে পৌছে দিল?"
     
    ঠিক এমন সময় টোটোর হর্ন শুনে বিশু বেরিয়ে দেখে মিতন হাজির, সঙ্গে ওর স্ত্রী কনকচাঁপা। দুজনে এক্কেবারে পরিপাটি হয়ে এসেছে। এসব ব্যাপারে কনকচাঁপার আবার একটু বেশিই আগ্রহ। তুকতাকে সে খুব বিশ্বাসী। জ্যোতিষ, তন্ত্র, শাস্ত্র সে খুব মেনে চলে।
     
    বাড়িতে ঠাকুর প্রণাম করে দরজায় তালা দিয়ে বিশুরা রওনা দিল মাঠের দিকে যেখানে বিরূপাক্ষ তান্ত্রিকের আখড়া গড়ে উঠেছে। সুন্দর একটা গ্রাম হেতমপুর। দু একটা চুলোচুলি বাদ দিলে গ্রামের সবাই মিলেমিশেই থাকে। ছ'টা পাড়া, চাষের জমি আর পুকুর টুকুর বাদ দিলে পুরোটাই ঘন জঙ্গলে ঢাকা এলাকা এই হেতমপুর, জঙ্গলের ওপারে বেলডিহা - রূপার বাপের বাড়ি। বিরূপাক্ষ তান্ত্রিকের আখড়া গড়ে উঠেছে এই দুটো গ্রামের মাঝে - যেখানে মাঠ শেষ আর জঙ্গল শুরু। রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতরে, একেবারে শ্মশানের দোরগোড়ায়!
     
    বৈশাখ মাসের অসম্ভব গরমে শুনশান রাস্তা দিয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে আখড়ার দিকে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় এখন এই রাস্তা একটু বেশীই ব্যস্ত। দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ সমস্যা সমাধানের আশায় ছুটে আসছে এখানে। 
     
    মিতন বলল,"দেখছো বৌদি? কত লোক? এসব বাবার ভক্ত! বাবা সাক্ষাৎ ভগবান গো ভগবান! জানবে তোমার অনেক ভাগ্য যে বাবা তোমার বিপদে এখানে ঠাঁই নিয়েছেন। সব ওনারই ইচ্ছা।"
     
    রূপা কিছু না বলে বিশুর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি হেসে গ্রামের প্রকৃতি উপলব্ধির দিকে মন দিল। এবার তাহলে মনে হয় একটা খোকা আসবেই কোলে, ভরে উঠবে সংসার! রাস্তাটা পিচের হলেও খানা খন্দে ভর্তি। সেই শেষ পঞ্চায়েত ভোটের আগে একটু ঠিকঠাক করেছিল কিন্তু বেশিদিন টেকে নি। শেষ বর্ষায় তো এত জল জমেছিল যে একদিন কাজ থেকে ফেরার সময় বিশুকে প্যান্ট ওপরে তুলে, চটি হাতে করে ফিরতে হয়েছিল। 
     
    ডানদিকে তালপুকুরে বাচ্চাগুলো সাঁতার কাটছে আনন্দে। ঐতো হেতমপুর প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার নকুলবাবু সাইকেল চালিয়ে বোধ হয় স্কুলে যাচ্ছেন। পিছনে একদল ছেলেমেয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিঠে ব্যাগ নিয়ে গল্প করতে করতে আসছে। গরুগুলো তালতলায় ঘাস খাচ্ছে একমনে। মাঠে ধানের বীজতলা তৈরিতে ব্যস্ত গোপাল আর মৃদুলরা। একদল মেয়েছেলে মাথায় করে শুকনো কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐদিকে। একটু এগিয়েই রাস্তার বাঁদিকে সেই পুরোনো তেঁতুলগাছটা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কত নাম না জানা পাখির দল এসে বাসা বেঁধেছে তেঁতুলগাছের ডালে ডালে। সুনীল আকাশে দু এক টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে বটে কিন্তু তা কোনমতেই কালবৈশাখীর আজ্ঞাবহ নয়।
     
    মিতনের নতুন টোটো যখন ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে জঙ্গলের কাছে এসে থামল তখন প্রায় দুপুর ১২ টা। রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে নেমে মাঠের আল বরাবর অনেকটা হেঁটে যেতে হবে এখনও। তবে জায়গাটা কদিন বেশ জমে উঠেছে লোকজনের ভিড়ে। সাইকেল স্ট্যান্ড খুলেছে হেতমপুর স্টার ক্লাবের ছেলেরা। মেলা বসেছে হরেক রকম। খাবার দোকানের সামনে দিয়ে গেলে রোল বা চাউমিনের গন্ধে খিদে পেয়ে যাওয়ার উপক্রম! সব মিলে বিরূপাক্ষ তান্ত্রিকের ওষুধে কাজ হোক বা না হোক, তার কদিনের উপস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের যে পোয়া বারো তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
     
    মিতন নামল না, বলল,"আমি টোটো নিয়ে একটু এখানেই দাঁড়াই। তোমরা ঘুরে এসো।"
     
    বিশু জিজ্ঞেস করল,"কেন রে? কী হল? যাবি না কেন?"
     
    "নতুন টোটো পার্কিংয়ে রেখে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া, এখানে দাঁড়ালে দু দশ টাকার প্যাসেঞ্জারও পেয়ে যাব। পেটের দায়ে যে বড় দায় বন্ধু? তোরা ঘুরে আয়, আমি এই এখানেই থাকব। এসে না খুঁজে পেলে একটা ফোন করে নিস।", বলে মিতন টোটোটা পাঁই করে ঘুরিয়ে একটা গাছতলায় এনে দাঁড় করালো।
     
    "বেশ, তাহলে আমরা যাই? ঘন্টা খানেকের মধ্যেই হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।", এই বলে বিশু নেমে গেল ডানদিকের মাঠের রাস্তা দিয়ে। রূপা আর কনকচাঁপা এগিয়ে চলল ওর পিছু পিছু।
     
    খানিকটা যেতেই সামনে থেকে একটা দমকা হওয়া যেন কোত্থেকে এসে হঠাৎ ওদের ঠিলে ফেলে দিল! আশ্চর্য! খাঁ খাঁ দুপুরে নির্মল আকাশে এমন দমকা হওয়া এল কোত্থেকে? বিশু আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,"সব্বনাশ করেছে! মেঘ এলো কোত্থেকে? একটু পা চালিয়ে কিন্তু? নাহলে আজ নির্ঘাত কপালে দুর্গতি আছে!"
     
    রূপার কেমন যেন অন্যরকম লাগল! এইতো কিছুক্ষণ আগেও পরিষ্কার আকাশ ছিল! হঠাৎ এমন ঘন, কালো, নিকষছায়ার মত মেঘ যেন পশ্চিমদিকে সূর্য ওঠার মতই কাল্পনিক! কেও যেন বাবার আখড়ায় যেতে মানা করছে রূপাকে! আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে কোনো অশুভ শক্তি! কে যেন পিছন থেকে বলছে, "যাস নে রূপা! যাস নে! এখনও সময় আছে! পালা......পালা!" একবার পিছন ফিরে তাকাল রূপা, নাহ্ কেও নেই, পরক্ষনেই হনহন করে এগিয়ে চলল বিশুর পিছু পিছু! 
     
    কুচকুচে কালো মেঘ যেন রাহুর মত ঘিরে ধরেছে ওদের! বেড়েছে হওয়ার বেগ! হাঁটা তো দূর, ঠিকমত দাঁড়ানো যাচ্ছে না সরু রাস্তায়! কে যেন উল্টোদিক থেকে বলপ্রয়োগে থামিয়ে দিতে চাইছে ওদের! প্রচণ্ড ঝড়ে আখড়ার মাঠ সাদা ধুলোয় ভরে গেছে! দূরের কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না! চোখের ভিতরে ধুলো ঢুকে অন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম! মেঘের গর্জনের তীব্র গোঙানি যেন কিছু বলতে চাইছে! তবে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে প্রত্যেকটি লোক নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়চ্ছে দিকভ্রষ্টের মত! আর ওরা তিনজন এগিয়ে চলেছে এক ক্লান্ত মাতৃগর্ভের সন্তানধারণের ইচ্ছাপূরণ করতে! রূপার গর্ভে সন্তানসুখের নিদারুণ আকুতির প্রশ্রয়ে! বাবার আখড়ার দিকে! বিরূপাক্ষ বাবার আশ্রয়ে! এক অঘোরী তান্ত্রিকের চরণে! কোন এক অলৌকিক শক্তির অমোঘ টানে! 
     
     
     
    (চলবে...)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন