রাম। অভিষেকের এক বছর অতিক্রান্ত হল। এতদিন আমরা চার ভাই এত ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাদের সঙ্গে একবারও মিলিত হতে পারিনি। রাজসিংহাসন যাঁরা অলঙ্কৃত করেন তাঁদের জীবনে তোমাদের মতো সুহৃদরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তোমরা যে শুধুই রাজাকে হাস্যরসে এবং বাক্চাতুরীতে আমোদে রাখো তা-ই নয়, রাজা যদি অন্যায় বা ভুল করেন তাঁকে সে কথা অকপটে বলার লোক শুধু তোমরাই। তাই তোমাদের জিজ্ঞাসা করি, আমরা যখন নির্বাসনে বনবাসে ছিলাম এবং আমার কনিষ্ঠ ভরত প্রজাপালনের দায়িত্বে ছিলেন, তখন অযোধ্যার রাজকর্মে কোন ত্রুটি তোমাদের চোখে পড়েছে কি?
বিজয়। একেবারেই নয়। ভরত জটাজুটধারী বনবাসী তপস্বীর জীবন যাপন করতেন, নিজেকে রাজা বলে কখনও প্রচার
করেননি, এবং অতি দক্ষতার সঙ্গে রাজকার্য পরিচালনা করেছেন।
মধুমত্ত। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে বলি, আর্য ভরতের রাজত্বকালে একটিই কষ্ট প্রজাদের ছিল।
রাম। কী কষ্ট?
মধুমত্ত। মনোকষ্ট।
দন্তবক্র। অসম্পূর্ণ কথা বলছ কেন? বলো কর্মহীনতাজনিত মনোকষ্ট।
রাম। কর্মহীনতাজনিত মনোকষ্ট? সে কী? কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বস্তসূত্রে আমি তো খবর পেয়েছি যে সকল সুস্থ কর্মক্ষম অযোধ্যাবাসীর জন্যই ভরত কর্মসংস্থান করেছিলেন।
সুমাগধ। মহারাজ, যে খবর আপনি পেয়েছেন, তা যথার্থ। শুধু পাঁচটি অভাগা অযোধ্যায় বেকার ছিলো, কারণ যে ব্যবসায়ে তাদের কিছুমাত্রও পারদর্শীতা আছে, অযোধ্যায় তার প্রয়োগের কোন উপায় ছিলো না!
রাম। কে তারা? কী ব্যবসা? কেন উপায় ছিলো না?
দন্তবক্র। আপনার সম্মুখে উপবিষ্ট পাঁচজন অধম। এই পাঁচজন কর্মক্ষম মানুষ কর্মহীন থাকতে বাধ্য হয়েছিল গ্রহীতার অভাবে। আর্য ভরতের জীবন বিগত চোদ্দ বৎসর সম্পূর্ণ হাস্যরসমুক্ত ছিলো।
ভদ্র। এক কথায়, এই সময়ের মধ্যে তাঁকে কেউ কখনো হাসতে দেখেনি।
বিজয়। যদিও এ কথাও ঠিক যে এই পাঁচজন কর্মহীন মানুষ তাঁদের মাসিক ভাতা থেকে বঞ্চিত হননি কখনো।
রাম। তোমাদের স্বভাবসুলভ লঘু ভঙ্গীতে বললেও বোঝা গেল ব্যক্তিগত বিষাদ সত্ত্বেও রাজ্য পরিচালনার গুরু দায়িত্ব ভরত ঠিক মতই পালন করেছেন। দায়িত্ব আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় তিনি দুটি বিষয়ে বিশেষ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একটি কোষাগার এবং দ্বিতীয়টি সৈন্যদল। ভরত বলেছিলেন তিনি রাজ্যের দায়িত্ব নেবার পর রাজ্যে অর্থ এবং সৈন্যদলের দশগুণ বৃদ্ধি হয়েছে। সৈন্যদলের বিষয়ে আমি পরে আসছি, কিন্তু রাজ্যের অর্থসম্পদের এই বিপুল বৃদ্ধিতে আমি একটু অস্বস্তি বোধ করছি। কোথা থেকে এই বিপুল অর্থ এলো? প্রজাদের উৎপীড়ন করে নয়তো?
ভদ্র। প্রজা উৎপীড়ন একেবারে হয়নি এ কথা বললে অসত্য বলা হবে মহারাজ। এই যেভাবে আমরা উৎপীড়িত হয়েছিলাম সে কথা তো আপনি শুনলেনই।
রাম। (মৃদু হেসে) হ্যাঁ, কিন্তু সে উৎপীড়নে ভরতের কোষাগারের শ্রীবৃদ্ধি হয়নি, অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী তোমাদের নিয়মিত মাসিক ভাতাপ্রাপ্তিটা কোষাগারের পক্ষে স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
দন্তবক্র। তাহলে অন্য রকমের উৎপীড়নের কথা বলি মহারাজ। এখন শান্তির সময়, কিন্তু আর্য ভরত বিপুল পরিমাণে যে সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়েছেন তাদের কাজ হলো বিভিন্ন গৃহে এবং পরিবারে খোঁজ নেওয়া তাদের কোন শারীরিক সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা, এবং থাকলে সেই সাহায্যের ব্যবস্থা করা। একটা উদাহরণ দিই। আমার বন্ধু মধুমত্তের প্রতিবেশী বৈদ্যচূড়ামণি শ্রীবৎস। মধুমত্তের আর এক প্রতিবেশী হরিদাস। হরিদাসের অতি অল্প বয়সে স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে, তার একমাত্র পুত্রের বয়স দ্বাদশ বৎসর মাত্র। হরিদাস এক রাত্রে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিন্তু তাকে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাবে কে? বৈদ্যচূড়ামণির চিকিৎসালয়ে সংবাদ পাঠালে চিকিৎসালয় থেকে একটি বিশেষ শকট হরিদাসকে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তার বিনিময়ে বৈদ্য শ্রীবৎস দশটি রৌপ্যমুদ্রা দাবি করবেন। আর্য ভরত যে বিপুল সৈন্য নিয়োগ করেছেন কোশল রাজ্যের প্রতিটি মহল্লাতে তাদের শিবির আছে। এখন হরিদাসের পুত্র যদি সেই শিবিরে কোনমতে খবর পাঠায় তাহলে সেনাবাহিনীই হরিদাসকে চিকিৎসালয়ে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে। নিঃশুল্ক। ভেবে দেখুন মহারাজ, বৈদ্যচূড়ামণি শ্রীবৎসের দশটি রৌপ্যমুদ্রার কি ক্ষতি হল না? তিনি কি উৎপীড়িত হলেন না?
রাম। বুঝলাম।
প্রহরী। মহারাজের জয় হোক্।
রাম। কী সংবাদ প্রহরী?
প্রহরী। আর্য দুর্মুখ দেখা করতে চাইছেন।
রাম। দুর্মুখকে পাঠিয়েছিলাম সমস্ত রাজ্য পরিদর্শন করে অত্যাচার অথবা উৎপীড়নের খবর সংগ্রহ করতে। দেখা যাক্, সে কী সংবাদ নিয়ে এলো। (দুর্মুখের প্রবেশ)
দুর্মুখ। মহারাজের জয় হোক্।
রাম। বলো দুর্মুখ, কী সংবাদ?
দুর্মুখ। সংবাদ শুভ মহারাজ।
রাম। শুভ? শুভ অর্থে?
দুর্মুখ। রাজ্যে কোন অভিযোগ নেই। অত্যাচারিত অথবা উৎপীড়িত মানুষের দেখা পাওয়া ভার।
রাম। দেখা পাওয়া ভার! দেখো দুর্মুখ, আমি আশা করব তুমি স্পষ্ট কথার উত্তর স্পষ্টই দেবে। তুমি কি একজনও এমন মানুষ দেখেছ যার রাজ্যশাসন সম্পর্কে অভিযোগ আছে?
দুর্মুখ। আপনি আমার অপরাধ নেবেন না মহারাজ, রাজ্যশাসন এমন বৃহৎ একটি বিষয় আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তির সে বিষয়ে মন্তব্য না করাই শ্রেয়।
রাম। তুমি তোমার উত্তরে আবার অস্পষ্টতার আশ্রয় নিচ্ছ দুর্মুখ। আমি তোমার নিজস্ব মন্তব্য শুনতে চাইনি।
দুর্মুখ। (উপস্থিত বিদূষকদের দিকে তাকিয়ে, চোখে-মুখে অসহায়তা) আমি ঠিক কী বলব বুঝতে পারছি না।
রাম। বুঝলাম।(বিদূষকদের দিকে তাকিয়ে) আর্য বিজয়, মধুমত্ত, ভদ্র, দন্তবক্র এবং সুমাগধ, তোমাদের ধন্যবাদ, আমি একটু নিভৃতে আর্য দুর্মুখের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সমবেত বিদূষকগণ। মহারাজের জয় হোক্, আমরা আসি মহারাজ। (প্রস্থান)
রাম। বলো দুর্মুখ।
দুর্মুখ। মহারাজ, আমি নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে, বিভিন্ন পল্লীতে এতদিন ভ্রমণ করেছি। পান্থশালায় নিশিযাপন করেছি, দরিদ্রের গৃহে এবং ধনীর গৃহে আশ্রয় নিয়েছি। প্রায় সকল রকম পেশার এবং বয়সের নারীপুরুষের সঙ্গে কথা বলেছি। সকলেই বলেছেন তাঁরা সুখে-শান্তিতে আছেন, তাঁদের কোন অভিযোগ নেই। অবশেষে ফেরার সময় অযোধ্যার প্রান্তবর্তী এক শ্রেষ্ঠীপল্লীতে এক পান্থনিবাসে নৈশভোজনের কালে সুলোচন, সুবুদ্ধি এবং সুকণ্ঠ নামক তিনজন শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনজনই ঈষৎ মত্ত অবস্থায় ছিলেন। পূর্বে এঁদের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম, এঁরা কোন অভিযোগ করেননি। কিন্তু সেইদিন এঁরা আশ্চর্য এক অভিযোগ করলেন। বললেন, তাঁরা শ্রেষ্ঠী, এবং গত কয়েক বছরে বাণিজ্যে তাঁদের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রাজকোষে তাঁদের দেয় করের পরিমাণও অনেক বেড়েছে। আজ রাজকোষের যে বৃদ্ধি, সে বৃদ্ধির জন্য তাঁদের এবং তাঁদের মতো শ্রেষ্ঠীকুলের যে অবদান, তার স্বীকৃতি তাঁরা রাজার কাছ থেকে পাননি!
রাম। কী ধরণের স্বীকৃতির কথা তাঁরা বলছেন?
দুর্মুখ। আমি তাঁদের প্রশ্ন করেছিলাম, কিন্তু স্পষ্ট উত্তর পাইনি।
রাম। তুমি কি তাঁদের বলেছিলে আমার ব্যক্তিগত আদেশে তুমি তাঁদের ক্লেশের কথা জানতে চাইছ? বলেছিলে কি স্বয়ং রামচন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে তুমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলছ?
দুর্মুখ। শুধু বলেছিলাম তাই নয়, আপনার স্বাক্ষরলাঞ্ছিত রত্নখচিত যে অঙ্গুরীয় আপনি অভিজ্ঞান হিসাবে আমাকে দিয়েছিলেন, সেই অঙ্গুরীয় দেখানো সত্ত্বেও তাঁদের অভিযোগ তাঁরা আমার কাছে বলেননি।
রাম। তোমার কাছে বলেননি কেন? তোমার প্রতিনিধিত্বের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে অবজ্ঞা করা স্বয়ং রাজাজ্ঞার প্রতি অবমাননা এ কথা কি তাঁরা জানেন না?
দুর্মুখ। আমার অপরাধ মার্জনা করবেন মহারাজ। আমার মনে হয় যে কথা তাঁদের মনে আছে তা প্রকাশ করতে তাঁরা কুণ্ঠিত। আপনার স্মরণে আছে যে প্রথমবার যখন তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয় তখন তাঁরা কোন অভিযোগই করেননি। যখন পান্থনিবাসে দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয় তখন তাঁরা ঈষৎ মত্ত ছিলেন। মদ্যপান মানুষকে সঙ্কোচরহিত করে, তাই তাঁরা বিনা সঙ্কোচে তাঁদের অসন্তোষটুকুই আমার কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এর বেশি আর নয়। তাঁরা শিক্ষিত শ্রেষ্ঠী, ততটা মদ্যপান তাঁরা করেননি যাতে তাঁরা আত্মবিস্মৃত হবেন। মনে হয় তাঁরা আর কথা বাড়াতে চাননি।
রাম। কথা বাড়াতে চাননি? কিন্তু যে অসন্তোষের কথা তাঁরা একবার ব্যক্ত করেছেন তা এখন না শুনলে তো আমার চলবে না। রাজ্যের কোন প্রজার মধ্যে সুপ্ত অসন্তোষও বাঞ্ছনীয় নয় দুর্মুখ।
দুর্মুখ। আপনি আমাকে কী আদেশ করেন মহারাজ?
রাম। দুর্মুখ, এই শ্রেষ্ঠীদের সঙ্গে যথাশীঘ্র আমার দেখা হওয়া প্রয়োজন। কী উপায়ে তা সম্ভব?
দুর্মুখ। মহারাজ, আমার নাম দুর্মুখ। কী অপরাধে আমার পিতা আমার এই নাম রেখেছিলেন আমি জানিনা। আমি এমন প্রস্তাব আপনাকে দেব যা আপনার বিরক্তি উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু এই অপ্রিয় কাজ করাই হয়তো আমার পক্ষে পূর্বনির্ধারিত ছিল, আমার নাম হয়তো তা-ই সূচিত করে।
রাম। তুমি নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে তোমার প্রস্তাব দাও দুর্মুখ। প্রস্তাবের গ্রহণযোগ্যতার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না।
দুর্মুখ। মহারাজ! রাজনিযুক্ত অনুচর হিসাবে ছদ্মবেশে আপনিই তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। যে কাজ করতে গিয়ে আমি বিফল হয়েছি, সে একই কাজে যদি আপনার ব্যক্তিত্ব এবং ধী যুক্ত হয় তাহলে শ্রেষ্ঠী তিনজন হয়তো তাদের অভিযোগ গোপন রাখতে অপারগ হবে, আপনি সরাসরিই তাদের অভিযোগ শুনতে পাবেন।
রাম। (খানিকটা চিন্তার পর) তোমার প্রস্তাব সুচিন্তিত হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণযোগ্য নয়। রাজা এবং প্রজার যে সম্পর্ক তার মধ্যে ছদ্মবেশের কোন জায়গাই নেই, বিশেষত রাজার পক্ষে। ভয় বা সঙ্কোচের কারণে অনেক সময় প্রজা তার মন রাজার সামনে উন্মুক্ত না-ও করতে পারে, কিন্তু ছদ্মবেশ, ছলনা কিংবা কোন রকমের চালাকির সাহায্যে তার মানসিক অবস্থান জেনে নেওয়ার চেষ্টা রাজার পক্ষে অপরাধ। আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম। এই শ্রেষ্ঠীদের সঙ্গে দেখা করে তুমি প্রাসাদে তাঁদের আমন্ত্রণ কর। আমি তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব।
দুর্মুখ। মহারাজ, এই শ্রেষ্ঠীরা কোশলরাজ্যে অতি বিখ্যাত এবং পরিচিত মুখ। এঁরা প্রাসাদে প্রবেশ করলে প্রাসাদে তাঁদের আসার সংবাদ গোপন থাকবে না।
রাম। জানি দুর্মুখ। তোমার প্রস্তাবের সার নিয়েই আমার এই প্রস্তাব। তুমি শ্রেষ্ঠীদের জানাবে তাঁদের প্রাসাদভ্রমণ একেবারেই গোপন রাখতে হবে। তাঁরা তিনজন অন্ধ, খঞ্জ এবং বধির ভিক্ষু হিসাবে প্রাসাদের সাপ্তাহিক ভিক্ষাদানের দিন, অর্থাৎ আগামী শনিবার, এখানে আসবেন। অন্য ভিক্ষুকদের বিদায় দেবার পর আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলব। সেদিন তুমিও উপস্থিত থেকো।
দুর্মুখ। আপনার আদেশ শিরোধার্য মহারাজ।
(প্রস্থান)