গঙ্গাপুত্র, পরমাত্মার অংশ অথবা অবতার যাই হোন না কেন আদতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্পোরেট মাফিয়াদের দাস। নয়া সংসদ ভবনে সেঙ্গালের প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজেকে ভারত সম্রাট ভাবতে শুরু করেছেন, মনে করছেন ভারতবাসী তাঁর প্রজা। সেঙ্গালের প্রতিষ্ঠা থেকে অবতার তত্ত্ব সেই ভাবনারই ফসল। রাজারা নিজেদের ভগবানের প্রতিনিধি হিসাবেই দেখাতে চাইতেন। মোদিও তাই করছেন বটে কিন্তু দাসত্বের ঋণ রয়ে গেছে কর্পোরেট মাফিয়াদের কাছে। সে ঋণের কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে নির্বাচনী বণ্ডে যদিও তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। দাসত্বের ঋণ আরও গভীরে। আপাতত অরণ্য আর পাহাড় লুটে কর্পোরেট মাফিয়াদের সরকারি সাহায্য দেওয়া। পুর্ববর্তী লেখায় ছত্তিশগড়ের হাসদেও-আরন্দ অরন্য লুটের একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে কী পরিমাণ অরণ্য কেটে ফেলা হচ্ছে তার একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই অংশে আমরা দেখি ১লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টর জঙ্গল কেটে ফেলা হলে সরাসরি কাদের ওপর প্রভাব পড়বে।
আমরা জানি হাসদেও-আরন্দ অরণ্য ও সংলগ্ন এলাকা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ভূখণ্ড গন্দোয়ানা ল্যান্ডের অংশ। ভারতের আদিম উপজাতি গোন্দ (PTG) ছাড়াও বাইগা, ওঁরাও, লোহারদের মত ১০ হাজার অধিবাসী বসবাস করেন এই অরণ্যের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট বড় ৩০টি গ্রামে। এদের জীবন যাপনের ৮০ শতাংশই অরণ্য নির্ভর। অরণ্যের ঘাস, পাতা, লতা, কন্দ ইত্যাদি নানা ধরনের উপাদান এঁদের আয়ের উৎস। হাসদেও-আরন্দ অরণ্যে ১২ রকমের ঘাস পাওয়া যায় যা দিয়ে দড়ি, ঝুড়ি, ধামা, ঝাঁটা, চাটাই ইত্যাদি বানিয়ে স্থানীয় শহরগুলিতে বিক্রি করে অরণ্যের আদিবাসীরা। স্থানীয় শহর ও বাজার গুলিতে বিক্রি হওয়া পরিবেশ বান্ধব থালা বাটির কাঁচামাল এখানকার আদিবাসীরা জোগান দিয়ে থাকেন। এছাড়াও রয়েছে বিড়ির পাতার জোগান ইত্যাদি। এসবের জন্য সরকারকে কিছুই করতে হয়না। সরকার খেতে না দিলেও উৎখাত করতে পারে। এখন সেই উৎখাত আতংকে সুরগুজা, সহলি, জনার্দনপুর, ঘাটবড়া, ফতেপুর, হরিহরপুরের ৭০০ পরিবার। হাজার বছর ধরে অরণ্যই জুগিয়েছে পেটের অন্ন, পরণের বাস। সেই অরণ্যের ৪ লক্ষ গাছ কাটা পড়লে মানুষের উৎখাত অবশ্যম্ভাবী অথবা মৃত্যু। মানুষ তা’হলে করবে কী? মনে রাখতে হবে এই অরণ্যে মোট ৮৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ৫১ ধরণের ব্যতিক্রমী ওষধি ও ১৯ ধরণের ভেষজ উদ্ভিদ!
এ তো গেল গাছ আর মানুষের কথা। এবার প্রাণী কুলের কথায় আসা যাক। মনে রাখতে হবে এই অরণ্যের নামকরণ হয়েছে হাসদেও নদ থেকে। অরণ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এই নদী মহানদী নদীর উপনদ। সুতরাং এখানকার প্রাণীকুল জল ও স্থলে বিন্যস্ত। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফরেষ্ট্রি রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন (ICFRE) এবং ওয়াইল্ডলাইফ ইন্সিটিটিউট অফ ইন্ডিয়া (WII) বলছে সারা ভারতের ১২.৫% সরীসৃপ থাকে এখানে। বলা হচ্ছে ৪৭টি বংশের ৩২টি পরিবার ভুক্ত ৭৫ প্রজাতির সাপ, গোসাপ, গেকো, টিকটিকি, গিরগিটি, খঞ্জনি, ক্যামেলিয়ান, কুমীর, ঘড়িয়াল, কচ্ছপ, কাছিমের বসবাস এই অরণ্যে। নদী, বাঁধ ও জলাশয়ে রয়েছে ২৯ প্রজাতির মাছ।
রয়েছে পাহাড়ি ময়না, দাগযুক্ত পেঁচা, লাল জঙ্গল ফাউল, র্যাকেট-টেইলড ড্রংগো, ময়ূর, তোতা, স্টেপ ঈগল, রেড স্পারফাউল, ফাকতা, ভুরা টিটার, ট্রি পাই এবং হেরন সহ ১১১টি প্রজাতির পাখি। আর ৮২ প্রজাতির প্রজাপতি সহ নিশ্চিত মুছে যাওয়ার মুখে নানা ধরনের ফড়িং, পতঙ্গ, ব্যাঙ।
স্তন্যপায়ী জীবজন্তুদেরও এক বিশাল মুক্তাঞ্চল হাসদেও অরণ্য। মোট ৩৪ টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব রয়েছে এই অরন্যে। যার মধ্যে রয়েছে এশিয়ান হাতি, লেপার্ড, শ্লথ ভালুক, দাগ যুক্ত হায়না, ধূসর রঙা নেকড়ে, বন্য বিড়াল, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, বানর ইত্যাদি। ভাবা যায়? কর্পোরেট মাফিয়াদের কাছে নিজের দাসত্বের ঋণ শোধ করার জন্য কী বিশাল জৈব্য বৈচিত্র্যকে বলি দিতে চলেছেন আমাদের ভেল্কি অবতার!
জঙ্গলে বাঘ, নেকড়ে কিংবা হায়না ইত্যাদি প্রাণীরা যতই হিংস্র ও চতুর হোকনা কেন বুদ্ধিমত্তায় হাতিই শ্রেষ্ঠ। এদের স্মরণ শক্তি ও টিকে থাকার লড়াই অভিনব। অভিযোজনের জন্য তারা অভিবাসন করে হাজার হাজার কিলোমিটার। এক জায়গায় খাদ্য সংকট হচ্ছে টের পেলেই সম্ভাব্য খাদ্য নিরাপত্তা যুক্ত জায়গায় পাড়ি দেয়। এই যাতায়াত ঘুরে ফিরে চলতেই থাকে। খাদ্য চক্রের এই প্রক্রিয়ায় এক অঞ্চলে খাদ্য সংকট দেখা দিলে অন্য অঞ্চল যেখান থেকে হাতি সরে এসেছিল সেই জায়গা ফের খাদ্য পরিপূরক হয়ে ওঠে। হাতি ফের সেই পথে ফিরতে থাকে। এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে যাওয়ার নিশ্চিত চেনা পথ। যে কারণে বনদপ্তর এলিফেন্ট করিডোর নিশ্চিত করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ চূড়ান্ত খাদ্য সংকট ও অন্যান্য কিছু কারণে কখনও কখনও হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। মানুষের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
বনদপ্তরের হিসাব বলছে সারা ভারতে ২৭ হাজার হাতি রয়েছে যার দশ শতাংশ ছত্তিশগড় সহ মধ্য ভারতে অবস্থান করে। হাসদেও-আরন্দ ও সংলগ্ন এলাকায় হাতির সংখ্যা ৫০টির মত। মিতু গুপ্তা ছত্তিশগড় রাজ্য বন্যপ্রাণ বোর্ডের সদস্যা এবং একটি বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ বিষয়ক একটি এনজিও পরিচালনা করেন। মিতুর প্রধান কার্যালয় রায়পুরে। তিনি জানাচ্ছেন, হাসদেও কিংবা ছত্তিশগড়ের অন্যান্য বনবাসীরা যে বাড়ি গুলো বানান তার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে বাড়ির পেছনে কিংবা পাশে অতিরিক্ত একটি দরজা রাখা। অর্থাৎ ইমার্জেন্সী একজিট ডোর। হাতি বাড়ির কোন একটা দিকে আক্রমণ করলে যাতে অন্য দরজা দিয়ে পালানো যায়। যদিও কয়েক বছর আগে অবধি হাতি মানুষ সংস্পর্শ এড়িয়েই চলত ফলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হতনা। অবস্থাটা বদলে গেছে শেষ পাঁচ বছরে। হিসাব বলছে এই সময়ে হাতি বনাম মানুষের সংঘাতে ৩২৫ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন আর ৭০টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এই হিসাব ছত্তিশগড়ের সমগ্র বনাঞ্চলের যেখানে হাতি অবস্থান করে। কারণ জঙ্গলের পরিসর ছোট হয়ে আসছে।
হাসদেও অরন্য বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির (HABSS) আহ্বায়ক, যিনি সবুজ রক্ষার লড়াইয়ে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছেন সেই ‘গোল্ডম্যান’ বা ‘গ্রীণ নোবেল’ পুরস্কার প্রাপক অলোক শুক্লা বলেছেন, “হাসদেও-আরন্দ বনাঞ্চলের হাতিদের জন্য একটি মুক্ত কারাগার উপহার দিতে চলেছে সরকার ও আদানি গ্রুপ।” কেন এটা বলছেন তিনি? তাঁর যুক্তি, রাজস্থান বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগম যা কিনা আদানি গ্রুপ পরিচালনা করে তারা ‘পারসা ইস্ট ও কাঁটা বাসন’ কোল ব্লকের জন্য বরাত পেয়েছে। এরজন্য ৪ লক্ষ গাছ কেটে ফেলা হবে। ইতিমধ্যেই ৩০ হাজার গাছ কাটা হয়ে গেছে। অনতি বিলম্বে কাটা পড়বে আড়াই লক্ষ। হাতিরা যাবে কোথায়? শুক্লা বলেছেন, “হাসদেও অরণ্যের পূর্ব দিকে আগে থেকেই একটি কয়লা খনি আছে। দক্ষিণ পূর্বে শিল্প শহর কোরবা। দক্ষিণ পশ্চিমে হাসদেও নদ। বাকি রইল পশ্চিম এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত যেখানে আদানি গ্রুপ কয়লা খনির জন্য গাছ কাটতে শুরু করেছে।”
ছত্তিশগড় সরকার বলছে ১ হাজার ৯৯৫ বর্গ কিলোমিটারের একটি এলিফেন্ট স্যাংচুয়ারি তৈরি করা হবে। যদিও এই প্রবোধে আস্থা রাখতে পারছেন না অরণ্য রক্ষার লড়াইয়ে নামা মানুষজন। অলোক শুক্লা বলেছেন, “ যদি তা হয়ও তবুও সেটা যথেষ্ট নয়। ঝাড়খণ্ড, অসম, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরল, উত্তরাখণ্ডের একেকটা এলিফেন্ট স্যাংচুয়ারিরং আয়তন ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার অবধি। সেখানে ওই আয়তনে কী হবে? যেটা হবে তা’হল একটা ওপেন এয়ার এলিফেন্ট প্রিজন।” তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, “একটা হাতি কয়েক মাসে ৩ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। হাতি এক জায়গায় থাকেনা।”
ইতিমধ্যেই ৩৪৩ নম্বর জাতীয় সড়ক করিডোর বরাবর ২৭ হাতির একটা দল সরে গেছে। তারা ফিরবে কোথায়? যদি হাতিরই এই অবস্থা হয় তবে হাসদেও-আরন্দের বাকি প্রাণীকুলের ভবিষ্যৎ কী? সেঙ্গালধারি পরমাত্মার অংশের কাছে জবাব আছে কি?