এক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে ঔপনিবেশিক শাসনের বাঁধন ক্রমশ আলগা হতে শুরু করেছে। পরাধীন দেশগুলোতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তৈরী হচ্ছে। যে কোন উপায়ে স্বাধীনতা চাই এমন উদগ্র কামনা জেঁকে বসছে পাশ্চাত্য কর্তৃক শাসিত জনগণের মধ্যে। শিক্ষিত কিংবা অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষ, আবাল বৃদ্ধ নরনারী তাঁদের দুর্দশার জন্য ঔপনিবেশিক শাসকদের দায়ী করছেন। পরাধীন ভারতও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। বিংশ শতকের গোড়াতেই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন সম্পর্কে দুটি ধারা প্রবল হতে থাকে এবং প্রায় সমান্তরাল গতিতে অহিংস ও সহিংস আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মানুষের দুর্গতি আরও চরমে ওঠে। যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয়ভার ঔপনিবেশিক দেশগুলোর ঘাড়ে চেপে বসে ফলে মানুষের অবস্থা অসহনীয় হয়ে ওঠে। ১৯১৭ সালেই বিহারের চম্পারনে গান্ধীজি সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন নীল চাষিদের নিয়ে।১৯১৯ তিনি সমর্থন জানালেন খিলাফত আন্দোলনকে।
এই পরিস্থিতিতে তাবৎ গণ আন্দোলন দমন করতে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই মার্চ ব্রিটিশ সরকার এক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী এবং দমনমূলক আইন আনল। যা কুখ্যাত 'রাউলাট আইন' নামে পরিচিত। এই আইনে জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করা হল। সরকার বিরোধী যে-কোনো প্রচারকার্যকে দন্ডনীয় অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয় এবং কোনো রকম সাক্ষ প্রমাণ ছাড়াই যে-কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় ও বিনাবিচারে গ্রেফতার ও যতদিন খুশি আটক রাখার অবাধ ক্ষমতা ও ঘরবাড়ি তল্লাসির অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়। এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের ন্যায়বিচার লাভের অধিকার সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যে কারণে রাওলাট আইনকে কালো আইন বলে পরিচিত হল। এই আইনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ৩০শে মার্চ এবং ৬ই এপ্রিল গান্ধিজির ডাকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ হরতাল পালিত হয়। দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় জনসভা অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। আইন প্রয়োগের এক মাসও পূর্ণ হলনা, ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে রাওলাট আইনের বিরোধিতায় উপস্থিত হয়েছিলেন ১০ হাজার মানুষ। বৃটিশ সেনাপতি জেনারেল ডায়ার সমবেত জনগণকে কোন রকমের আগাম সতর্কতা না দিয়েই জনতার ওপর তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্বিচার গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। সরকারি হিসেবে দেড় হাজার আর বেসরকারি হিসেবে অন্তত আড়াই হাজার নারী পুরুষ শিশু নিহত হন।
ইতিহাস বলছে, ১৯১১ সালে জুলাই মাসে বৃটিশ বিরোধী কার্যকলাপে অভিযুক্ত হয়ে সেলুলার জেলে দীপান্তরিত হন দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী ভাবনার জনক বিনায়ক দামোদর সাভারকার। আগষ্ট মাসেই তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করে প্রথম চিঠি দিয়ে ফেলেছেন। এরপর ১৯১২, ১৯১৩, ১৯১৪ সেই একই চিঠি। তারপর ১৯১৫, ১৯১৬,১৯১৭। সব চিঠির বয়ান মোটামুটি একই রকম। দয়া করে সরকার যদি তাঁকে মুক্তি দেয় তবে জীবনে স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারে কাছে যাবেন না। ৬ নম্বর চিঠিতে সাভারকার যেন বলছেন, হুজুর আমার মাঈ-বাপ। বলছেন, “অন্যভাবে যা পাওয়া যেতে পারে, সেই তুলনায় আমাকে জেলে আটকিয়ে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না। শক্তিশালীর পক্ষেই একমাত্র ক্ষমাশীল হওয়া সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত সন্তান পিতৃতুল্য সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে। মহামান্য হুজুর অনুগ্রহ করে বিষয়টি বিবেচনা করবেন এই আশা রইল।”
১৯২০ সালে অর্থাৎ জালিওনাবাগ গণহত্যার পরের বছর সাভারকার তাঁর সপ্তম ক্ষমা প্রার্থনার চিঠিতে বৃটিশ সরকারের কাছে মুক্তি ভিক্ষার যে আবেদন করেছিলেন, তাতে বললেন "সংবিধান মেনে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাতে তিনি রাজি আছেন এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য রাজনৈতিক কোন কার্যক্রমে তিনি জড়িত থাকবেন না" কথা রেখেছিলেন সাভরকার। বৃটিশ কারাগার থেকে বেরিয়ে আর কোনদিন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করেননি বরং বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নিজের কাজ করে গেছেন।
১ লা জুলাই ২০২৪, সোমবার থেকেই ভারতে চালু হচ্ছে নতুন তিনটি আইন ব্যবস্থা। উঠে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, আইপিসি(ভারতীয় দন্ডবিধি) এবং ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসি। সেই প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করার জন্য উপক্রমণিকায় ওই টুকু শৈব গীতের প্রয়োজন ছিল কারণ ২০২৩ সালের সংসদের শীতকালীন অধিবেশন ১৪৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করে ওই তিনটি আইন পাশ করিয়ে নিয়েছিল দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকার। আর সেই প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন ১৬০ বছরের পুরোনো বৃটিশ আইনকে সরিয়ে নতুন আইন ব্যবস্থা প্রনয়ণ করছেন তাঁরা। অর্থাৎ শুরু থেকেই এমন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যেন এতদিন আমরা বৃটিশের তৈরী করা আইন ব্যবস্থার অধীনে ছিলাম আর এখন আমরা পুরোপুরি নতুন কোন ভারতীয় আইনের আওতায় চলে যাচ্ছি। আসলে এখানেও খুব কৌশলে ভারতীয় কড়ায় ভারতীয় তেলে পুরানো আইনকেই সদ্য বানানো ‘তেলে ভাজা’ বলে বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে যা শুধু বাসিই নয়, পচাও বটে।
যে সাভারকার বৃটিশ সরকার আমাদের মাঈ-বাপ বলে তাদের আইনের আওতায় সমস্ত ভারতীয়দের থাকা উচিত বলে মনে করেছিলেন, যিনি কুখ্যাত রাওলাট আইন ও জালিওনাবাগ গণহত্যা নিয়ে কোনদিন একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি তাঁর উত্তরসূরিরা ভারতবাসীকে এমন কোন আইন উপহার দিতে পারেনা যা জনগণের মুক্ত চিন্তা, প্রগতি ভাবনা, মানবাধিকার, অগ্রণী জীবন যাপনের অধিকার রক্ষার পথ কে প্রশস্ত করবে। মোদীশাহীর দশ বছরে তা পদে পদে প্রমাণিত হয়েছে। ১লা জুলাই ২০২৪ থেকে যে নতুন তিনটি আইন ব্যবস্থা চালু হতে চলেছে সেই ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইন আদতে মোদী শাহীর দশ বছরের শাসনের অভিজ্ঞতার নিরীখে তৈরী যা কিনা স্বৈরতন্ত্র বিরোধী জনমত দমনের প্রচেষ্টা ঠিক যেমনটা বৃটিশরা তাদের শাসনকালের শেষার্ধে রাওলাট আইন প্রবর্তনের মধ্যে দিয়ে করতে চেয়েছিল। যার মূল কথা হল, এমন একটি পুলিশি ব্যবস্থা কায়েম কর যেখানে পুলিশ তার হাতে থাকা সর্বাধুনিক শক্তিশালী প্রযুক্তি ও হাতিয়ারকে আইনি পদ্ধতিতে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। এই পর্বের আলোচনায় আপাতত আমরা নতুন ভাবে তৈরি করা এই পুলিশি ব্যবস্থার প্রক্রিয়াতেই মনোনিবেশ করছি।
প্রথম কথা এতদিন আমরা বৃটিশ আমলে তৈরি হওয়া একটা আইনি ব্যবস্থার অধীনে ছিলাম এই ধারণাটা ভুল। কারণ স্বাধীন ভারতে বিভিন্ন আইনসভা বিভিন্ন সময় আইপিসি কিংবা সিআরপিসিতে বিভিন্ন সংশোধনী এনেছে, সময়োপযোগী করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার সবটাই ভালো ছিল এমন নয় কিন্তু বৃটিশ ব্যবস্থারই পুরো আইপিসি কিংবা বিআরটিসি মেনে আমরা গত ১৬০ বছর ধরে চলে আসছি আরএসএসের এই ন্যারেটিভটা বিভ্রান্তি ছড়ানোর লক্ষ্যেই। যদিও তারা নিজেরা এবং তাদের সহযোগী সংগঠন তা শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা কিংবা আরএসএসের হেডগেওয়ার বৃটিশ কালাকানুনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেনি। সাভারকারের কথা আগেই বলেছি।
স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে কালো সময় ছিল জরুরি অবস্থা। সারা দেশ যখন জরুরি অবস্থার মিসা কিংবা ডিআইএসআইআরের মত আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন তৎকালীন আরএসএস প্রধান বালাসাহেব দেওরস পুনের ইয়েরাওয়াদা জেল থেকে মুক্তি ভিক্ষা করে জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করে ইন্দিরা গান্ধীকে একাধিক চিঠি দেন। শুধু তাই নয়, তিনি বলেন, আরএসএস কে জয়প্রকাশ নারায়ণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর ২০ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করে যাবেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী সহ ৩০ জন আর এস এস নেতা জেল থেকে মুক্তির বিনিময়ে জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সুতরাং আজকের বিজেপি ভারতীয়দের জন্য উক্ত তিন আইন বিধিমালার মধ্যে দিয়ে কোন নতুন যুগের সূচনা করছেন না।
যে কথা বলছিলাম, স্বাধীন ভারত বৃটিশের তৈরি আইনবিধি মেনে চলছিল এই ধারণাটা ভুল কারণ আমাদের আইনবিধি আমাদেরই পণ্ডিতদের তৈরি করা সংবিধানের অধীন। ভারতের বিচার বিভাগ কোনও আইনকে তখনই আইনের মর্যাদা দেন যখন তা সংবিধান অনুমোদন করে। শুধু মাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনও আইন পাশ করিয়ে নেওয়া যায়না। যে কারণে নরেন্দ্র মোদীর ‘নির্বাচনী বণ্ড’ আইন করে পাশ করানোর পরও বিচার বিভাগ তা অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিয়েছে। সুতরাং বৃটিশ ভারতে তৈরি হয়েও আইপিসি কিংবা সিআরপিসিকে সংবিধানের আওতায় এসে ভারতীয় হতে হয়েছে তবেই তা কার্যকর ছিল।
দুই
এবার আমরা দেখে নেই কিভাবে চালু হতে যাওয়া নতুন আইন বিধিতে পুলিশ রাজ কায়েম করা হয়েছে। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক, ভারতীয় সংবিধানের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে বাক স্বাধীনতা, সভা, সমিতির অধিকার দেওয়া হয়েছে। সরকারের সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে। এই দিকে নজর রেখে সুপ্রিম কোর্ট বারবার ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইন বাতিল করতে বলেছে। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলেছেন, সরকারের বিরোধিতা মানে রাষ্ট্রের বিরোধিতা নয়। পুরানো আইন অর্থাৎ আইপিসি ১২৪(এ) ধারায় স্থগিতাদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন কাউকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় অভিযুক্ত করা যাবেনা। কিন্তু নতুন আইন অর্থাৎ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৫০ ও ১৫২ ধারায় কৌশলে রাষ্ট্রদ্রোহ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কেউ বা কারা ইচ্ছাকৃতভাবে বা জেনেশুনে বক্তব্যে অথবা লিখিত, বা সাংকেতিক চিহ্ন দ্বারা, বা দৃশ্যমান উপস্থাপনা দ্বারা, বা বৈদ্যুতিন যোগাযোগ দ্বারা, অথবা আর্থিক উপায় ব্যবহার করে বা অন্যভাবে উত্তেজিত বা উত্তেজিত করার চেষ্টা করে যাতে বিচ্ছিন্নতা বা সশস্ত্র বিদ্রোহ বা নাশকতামূলক কার্যকলাপ, বা কেউ যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে উৎসাহিত করে যার দ্বারা ভারতের সার্বভৌমত্ব বা একতা বা অখণ্ডতাকে বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় তবে তা উক্ত ধারায় শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে শাস্তির যেখানে আগে নূন্যতম ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন ছিল তা নতুন আইনে নূন্যতম ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, 'বিধ্বংসী কার্যকলাপ' বা 'বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ' কাকে বলা হবে? কোন কাজ বা কোন বক্তব্য বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ তৈরি করতে উৎসাহ দেবে, কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে যে একজনের কার্যকলাপ, বক্তব্য, পোস্ট ভারতের সার্বভৌমত্ব বা একতা বা অখণ্ডতাকে বিপন্ন করছে? এর কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, সংজ্ঞা এই আইনে নেই। ফলে এই ধরনের অস্পষ্ট এক বিস্তৃত ভাসা ভাসা কথামালায় আইনের অপব্যবহার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে অথবা ইচ্ছা করে রাখা হচ্ছে। ভারতের মতো একটি বিস্তীর্ণ, বৈচিত্র্যময় দেশে, বিভিন্ন জাতি এবং সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর অভাব অভিযোগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা বা কার্যকলাপে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বলে বোঝানো যেতে পারে। আইন প্রনেতাদের দাবি আইপিসি আইপিসি ১২৪ (এ) তে 'ভারতের সার্বভৌমত্ব, বা একতা বা অখণ্ডতা' বলে তবুও কিছুটা সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এখন অর্থাৎ ১৫২ ভারতীয় আইন সংহিতা রাষ্ট্রের জন্য ধ্বংসাত্মক বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ, ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য এবং অখণ্ডতাকে বিপন্ন করার অনুভূতিকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি বলে রাষ্ট্রের জন্য এমন একটি বিস্তৃত অস্পষ্ট পরিসর তৈরি করেছে যেখানে যে কাউকে এই আইনে বেঁধে ফেলা যায়।
ধরা যাক ভারতের দক্ষিণের লোকেরা এই বলে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করল যে একই পরিমাণ কর দেওয়া স্বত্ত্বেও তারা উত্তরের বাসিন্দদের কম সুযোগ সুবিধার অধিকারী কিংবা সরকার সেখানে পর্যাপ্ত উন্নয়ন করছেনা। তাঁরা উত্তরের মানুষদের দ্বারা বৈষম্যের শিকার। অথবা কোন আদিবাসী গোষ্ঠী এই বলে অভিযোগ করল যে তাঁরা সংরক্ষণের সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, শিক্ষাগত কোটা বা উন্নয়নে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন সেক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী অনুভূতিতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য মামলা করা যেতে পারে। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই ধারার সুস্পষ্ট লক্ষ্য হল গণতান্ত্রিক এবং অহিংস প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থা এবং সরকারগুলির নীতি ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রচারণাকে অপরাধীকরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া। গণতান্ত্রিক দাবী এবং ভিন্নমত ও বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে আইনি অস্ত্র যোগান দেওয়া।
তিন
২০২২ সালে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি রোহিত আর্য আরও একবার উচ্চারণ করলেন, পুলিশ হল সংগঠিত গুন্ডা বাহিনী! বারবার আমরা পুলিশি অত্যাচারে সাধারণ মানুষের মৃত্যু দেখে আসছি। লক আপে পিটিয়ে মারার ঘটনা আকছার ঘটে এ দেশে। বিচার বিভাগ যথেষ্ট তৎপর হওয়া সত্ত্বেও এর খুব একটা সুরাহা হয়নি। নতুন আইনে পুলিশি অত্যাচারের সম্ভাবনা কয়েকশ গুণ বাড়িয়ে পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইপিসিতে পুলিশি হেফাজতে অভিযুক্তকে সর্বাধিক ১৫ দিন রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় আইন সংহিতায় ৬০ থেকে ৯০ দিন সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নতুন আইনের ১৮৭(৩) ধারায় বলা হয়েছে জামিনের শর্ত পূরণ করলেও অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পর থেকে ৯০ দিন পুলিশ নিজস্ব হেফাজতে রাখতে পারবে। গ্রেফতার করার ক্ষেত্রেও তাই। ১৭২ ধারায় পুলিশ যাকে ইচ্ছা গ্রেফতার করতে পারে তার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন নেই। ১৭৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের করা যাবেনা। তিন থেকে সাত বছরের সাজা হতে পারে এমন অভিযোগের ক্ষেত্রে আগে প্রাথমিক তদন্ত করে তারপর এফআইআর করতে হবে। অর্থাৎ পুরোটাই পুলিশের ইচ্ছাধীন। বিচার চেয়ে অভিযোগ দায়ের করার পর সাধারণ মানুষকে পুলিশের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হবে যে সেটি আদালতে যাবে কিনা!
আমরা জানি যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে অনশন কর্মসূচি অহিংস আন্দোলনের একটা বড় অংশ ছিল। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত শর্মিলা চানু কিংবা সোনম ওয়াংচুকের অনশন সারা ভারতের নজর কেড়েছিল। নতুন আইনে অনশনকে অপরাধ যোগ্য বলা হয়েছে এবং পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ২২৬ ধারায় বলা হয়েছে, "আইনসম্মত ক্ষমতা প্রয়োগে বাধ্য বা বাধা দিতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা" ভারতের দণ্ডবিধিতে প্রবর্তিত একটি নতুন বিধান। এই নতুন বিধানটি নাগরিক প্রতিবাদের একটি রূপ হিসাবে উপবাস করার চেষ্টা করে এমন কাউকে অপরাধী প্রমাণ করতে পারলে অভিযুক্তকে এক বছরের সাধারণ কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। অর্থাৎ অহিংস পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে অপরাধ হিসেবে পরিধান করে অপরাধীকরণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আইনি রক্ষা কবচ নিচ্ছে রাষ্ট্র। যদিও এর বাইরে আরও অনেক বিষয় রয়ে গেল যা বিস্তারিত আলোচনার দাবি করে কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে সব মিলিয়ে আইন নিজেই নিপীড়নের একটা হাতিয়ার হয়ে উঠছে এই নতুন প্রক্রিয়ায় এবং মানুষের পরাধীন হয়ে থাকাকে বৈধতা প্রদান করছে। একটা গণতান্ত্রিক খোলস তৈরি করার আড়ালে গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো মুছে ফেলার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রাষ্ট্র চাইছে নিপীড়নকে শক্তিশালী বৈধ অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে।