বারোই জুলাই কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান অবশেষে জানিয়ে দিলেন যে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের স্নাতক স্তরের পাঠ্যসূচিতে কোন রদবদল করা হচ্ছে না এবং ওই পাঠ্যসূচিতে 'মনু স্মৃতি'র অংশ বিশেষ অন্তর্ভুক্তি করার যে প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টি সুপারিশ করেছিল তা বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রী এ কথাও বলেন যে, কেন্দ্র সরকার দেশের সংবিধানকে সর্বত ভাবে মান্যতা দিয়ে চলবে এবং সংবিধানের সঙ্গে সাযুজ্য নেই এমন কোন জিনিস গ্রহণ করবে না। শিক্ষামন্ত্রীর এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে অর্থাৎ এগারো জুলাই প্রায় মধ্য রাতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যোগেন্দ্র সিং জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, পাঠ্যসূচিতে মনু স্মৃতি অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব তিনি তাঁর একক ক্ষমতা বলে বাতিল করে দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল দুটি ঘোষণাই খুবই তড়িঘড়ি করে করা হল। তড়িঘড়ি এই কারণেই বলা যে, আর কিছুক্ষণ পরেই বাতিল হওয়া প্রস্তাবটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা হতে যাচ্ছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টির তরফে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে প্রস্তাবটি পেশ করার কথা ছিল। যে দ্রুততার সঙ্গে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফে প্রস্তাবটি বাতিল করা হয় তাতে এমনটা মনে হতে পারে যে, কেন্দ্র সরকার কিংবা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ধরনের উদ্ভট প্রস্তাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তাই প্রস্তাবটি দেখা মাত্রই খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও বিষয়টি তেমন নয় বরং তার উল্টো। খুবই পরিকল্পনা মাফিক 'মনু স্মৃতি'-র মত একটি পশ্চাৎপদ ভাবনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পাঠ্য হিসেবে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল যাতে ভবিষ্যতের আইনবিদরা বিশ্বের আধুনিক আইন ব্যবস্থার পরিবর্তে ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুশাসন সমূহের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় আইন ব্যবস্থাকে দেখতে পারেন।
গত জুন মাসে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টি আইন বিভাগের প্রথম ও তৃতীয় বর্ষের (এলএলবি) ছাত্রছাত্রীদের 'মনুস্মৃতি' বা 'মনুর আইন' পড়ানোর লক্ষ্যে পাঠ্যসূচিতে ওই সংশোধনী আনতে চেয়ে একটা সভা করেছিল। সেখানেই আইন ফ্যাকাল্টির সদস্যরা সর্ব সম্মতিক্রমে এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিল। ঠিক হয়েছিল বিষয়টি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে পাঠানো হবে জন্য প্রস্তাব আকারে। বারো জুলাই এই অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। পাঠ্যসূচি বা সিলেবাস সংক্রান্ত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা এই অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে প্রস্তাবটি আলোচনার আগেই আইন তা খারিজ করে দেন উপাচার্য অধ্যাপক যোগেশ সিং এবং কয়েক ঘণ্টা বাদে সরকারের তরফে শিক্ষা মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান।
ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, মনুস্মৃতি বিষয়ক দু'টি বিশেষ ভাষ্য গঙ্গানাথ ঝা'র 'মনুস্মৃতি উইথ মনুভাষ্য অব মেধা তিথি' এবং টি কৃষ্ণস্বামী আয়ারের 'কমেন্টারি অব মনুস্মৃতি- স্মৃতিচন্দ্রিকা' আগামী আগস্ট মাস থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন পাঠ্যবর্ষ থেকে শুরু করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে যে, গত চব্বিশ জুন ফ্যাকাল্টির কোর্স কমিটির বৈঠকে 'সর্বসম্মতিতে' এই পাঠ্যসূচি পরিমার্জনের প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। সেই বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ২০২৩ সালে আইন বিভাগের প্রধান তথা 'ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপিকা অঞ্জু ওয়ালি টিকু। এই প্রস্তাবটি জানাজানি হওয়ার পরই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতায় নামেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বামপন্থী সংগঠন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক টিচার্স ফ্রন্ট (এসডিটিএফ)। উপাচার্য যোগেশ সিংকে লেখা এক চিঠিতে এসডিটিএফ'র চেয়ারপারসন এসকে সাগর এবং সাধারণ সম্পাদক এসএস বারওয়াল স্পষ্ট বলেছেন, "প্রস্তাবিত এসব ভাষ্য সমাজে পশ্চাদমুখী দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে; মহিলা এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকারের বিরোধিতা করে; প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থারও সম্পূর্ণ বিরোধী।"
ওই অধ্যাপকরা বলেছেন, "ছাত্রছাত্রীদের মনুস্মৃতি পড়ানোর সুপারিশ অত্যন্ত আপত্তিকর। কারণ মনুস্মৃতি আসলে ভারতের মহিলা ও পিছিয়ে থাকা মানুষের প্রগতি এবং শিক্ষার উলটো কথা বলে।” উপাচার্যকে অধ্যাপকরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, "মনুস্মৃতির বেশ কয়েকটি জায়গায় মহিলাদের শিক্ষা ও সমানাধিকারের বিরোধিতা করা হয়েছে। ফলে মনুস্মৃতির কোন অধ্যায় বা অংশ পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামো এবং নীতির পরিপন্থী হবে।" শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান যেন অনেকটা এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, "ভারতীয় সংবিধানকে সর্বত ভাবে মান্যতা দিয়ে চলবে এবং সংবিধানের সঙ্গে সাযুজ্য নেই এমন কোন জিনিস গ্রহণ করবে না।" অথচ মজার বিষয় হল, ধর্মেন্দ্র প্রধানের এই বক্তব্য বিজেপি এবং তার মতাদর্শ নিয়ন্ত্রক আরএসএসের ভাবনার পরিপন্থী। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শিক্ষা সংস্কৃতি, ইতিহাস থেকে থেকে বিজ্ঞান, সর্বত্রই পশ্চাদমুখী ভাবনাচিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়ার যে ঘৃণ্য অভিযান শুরু হয়েছে তারই অঙ্গ হিসেবে মনু সংহিতাকে ভারতের আইন হিসেবে চালু করার চেষ্টা চলছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা চাইছে আইনের আড়ালে সাম্প্রদায়িক ও জাতপাতের ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার।
২০২৩ মোদী সরকারের শেষ দশ বছরের সংসদের শেষ অধিবেশন হয়। সেই শীতকালীন অধিবেশনে অধ্যক্ষ নজিরবিহীন ভাবে ১৪৬ জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করে দেশের জন্য নতুন আইন বিধি প্রণয়ন করে। ২০২৪ সালের পয়লা জুলাই থেকে দেশে ওই নতুন তিনটি আইন বিধি চালু হয়েছে যা ভারতীয় আইন সংহিতা নামে পরিচিত। সরকারের আসল উদ্দেশ্য ছিল ওই আইন সংহিতা সমূহের পরিপ্রেক্ষিতে একটি মনুবাদী আইনি চিন্তাধারাকে ক্রমশ সংঘটিত করা। পাঠ্যসূচিতে সেই ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটানো। যে কারণে এই প্রস্তাবের প্রধান উদ্যোক্তা, ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপিকা অঞ্জু ওয়ালি টিকু বলেছেন, "পাঠ্যসূচিতে মনু স্মৃতির অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবটি ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির (এনইপি-২০২০) লাইনকে অনুসরণ করেই তৈরি করা হয়েছিল।" তিনি আরও বলেছেন, "মনু স্মৃতি মহিলাদের স্বনির্ভরতা ও শিক্ষা বিস্তারের বিরোধী এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের অগ্রগতির পরিপন্থী বলে যে দাবি করা হয় তা ভুল।" অর্থাৎ অধ্যাপিকা টিকু পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনি যা করেছেন তা বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবনার প্রতিফলন। এমনটা নয় যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার এসব জানত না।
আসলে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন ভারতের অষ্টাদশ লোকসভার চরিত্র আমূল বদলে দিয়েছে। ২০২৩ সালের সর্বশক্তিমান নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে অষ্টাদশ লোকসভা। এখন আর 'মোদী সরকার' কিংবা 'মোদীর বিজেপি সরকার' বলতে পারা যাচ্ছে না। খুব কষ্ট করে নরেন্দ্র মোদীকে বলতে হচ্ছে, এনডিএ সরকার। সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে তাঁকে নির্ভর করতে হচ্ছে একটি অস্থিতিশীল জোটের ওপর। মোদীর জোটের বন্ধুরা হলেন অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের নীতিশ কুমার। দু’জনেই আঞ্চলিক ও নিজ নিজ অঞ্চলের স্থিতিস্থাপকতা আঞ্চলিক কম্পালসনের ওপর নির্ভরশীল। এই কম্পালসন দু’জনেরই হাতের বাইরে। এই রকম পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে নতুন করে বিতর্কে জড়াতে চাইছেনা বিজেপি। যে কারণে ধীরে চলার নীতি। যে কারণে পিছিয়ে আসা পাঠ্যসূচিতে মনু স্মৃতির অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়া থেকে।
২০২৪ লোকসভায় নরেন্দ্র মোদীর চারশো পারের খোয়াব যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হত তাহলে ২০২৫ সালে আরএসএসের শতবর্ষে সংঘকে হিন্দু রাষ্ট্র উপহার দেওয়া কিংবা আইন হিসেবে মনু সংহিতাকে প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব ছিল না খুব। কারণ নিজের তৃতীয় দফার সরকারে তিনি যে সংবিধান বদলাবেন এমন আভাস নরেন্দ্র মোদী নিজে এবং অমিত শাহ দিয়ে রেখেছিলেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে বারংবার তাঁদের বিরক্তি প্রকাশ পেয়েছে মুসলিম ও দলিতদের প্রতি। বড়সড় আঘাত আসার উপক্রম হয়েছিল পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণ নীতিতে। এই নীতিগুলি নিয়ে আপাতত নীরব থাকবে বিজেপি কারণ অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রীরা তাহলে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করবে। কিন্তু তার জন্য পুরোপুরি থেমে থাকবে না এই প্রচেষ্টা। এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে ধর্মেন্দ্র প্রধানের ঘোষণার সাথে সাথে বিজেপি বা আর এস এস এই প্রস্তাবটিকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে। তারা সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে মাত্র। পরিস্থিতির কারণেই এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে এলো তারা। সুযোগ পেলে লাফানোর কসুর করবে না তারা। নতুন বন্ধু খোঁজার প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। তেমন বন্ধু পেলে স্বরূপে ফিরবেনই মোদী। তাই আত্মসন্তুষ্টির কোন জায়গা না রাখাই ভালো।