প্রতিবেশী বাংলাদেশ উত্তপ্ত। কোটা বিরোধী আন্দোলন সে দেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এক বিশাল অংশের ছাত্র সমাজ সরাসরি রাস্তায় নেমেছে। পুলিশের সঙ্গে এবং অন্যান্য সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন ছাত্র রয়েছেন কিন্তু সিংহভাগই সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে পুলিশ কর্মীরও। এই বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মৃত্যু বুঝিয়ে দিয়েছে আন্দোলন ও সংঘর্ষের ব্যাপকতা কতখানি ছিল যার ঢেউ ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে রাজপথে আছড়ে পড়েছে। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের দাবি, কোটা প্রথার বিলোপ অথবা সংস্কার করতে হবে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় যে, আন্দোলনকারীরা মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধা কোটার বাতিল চেয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রায় সবক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশেষ আবেগকে বহন করে। এই আবেগ পাক ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই। কৃষক, মজুর থেকে শুরু করে শিক্ষক, অধ্যাপক, সাধারণ মানুষ ও বহু যুবক যুবতী এই লড়াইয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সর্বস্ব খুইয়েছেন, নারীরা পাক সেনাদের গণধর্ষিতা হয়েছেন। আধুনিক অস্ত্র সম্ভার, সেনাবাহিনীর সংখ্যা সব কিছুতেই পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকা একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর লড়াই ও জয় সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তরিক আত্মোৎসর্গের জন্য। একে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই।
স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে এই বিপুল সংখ্যক নিগৃহীত, নিপীড়িত, সর্বস্ব হারানো মুক্তিযোদ্ধাদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা প্রধান ও প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল। সেই পরিস্থিতিতে সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ বা কোটা ব্যবস্থা চালু করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমানের উদ্যোগে এই ব্যবস্থা চালু হয়। তারপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ চলেছে। মুজিবর রহমানের হত্যা, সামরিক শাসন, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরশাসন, ইত্যাদি নানা ঘটনা প্রবাহকে ঘিরে বাংলাদেশ আলোড়িত হয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে।
এটা ঘটনা যে যখনই বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক শক্তি, মৌলবাদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তখনই বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার চেষ্টা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শাসকের অশ্রদ্ধা, অসহনীয়তা, ঘৃণা ও আস্ফালন প্রকট হয়েছে। কারণ ওই শাসক কুলের বড় অংশই পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ছিল। পাশাপাশি একটি অংশ বরাবর বাংলাদেশকে ঐস্লামিক মৌলবাদী শাসন ব্যবস্থার অঙ্গ করতে চেয়েছে এবং এখনও তারা সক্রিয়। আরও একটা বিষয় মনে রাখার যে ওই মৌলবাদ, স্বৈরশাসক ও একনায়করা ঐতিহাসিক ভাবে ভারত বিরোধী। এই বিরোধিতার কারণ শুধুমাত্র এই নয় যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সমর্থন ছিল কিংবা ভারতই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, বিরোধিতার আরও একটি বড় কারণ হল শত প্রতিকূলতা ও হিন্দু মৌলবাদের চোখ রাঙানোর মধ্যেও এই উপমহাদেশে ভারতে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের অবস্থান রয়েছে।
তা’বলে বাংলাদেশের কোটা বিরোধী কিংবা কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রসমাজের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনকে অস্বীকার করা যায় না। সমাজের একটি বিশেষ অংশকে কতদিন ধরে কোটার আওতায় রেখে দেওয়া হবে, বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে এই কোটার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তার পর্যালোচনা জরুরি। এর আগেও বাংলাদেশে কোটা বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল এবং নিরন্তর আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনা সরকার ২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তখন ছাত্র আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে কিন্তু গোল বাধে ২০২১ সালে যখন সরকারের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি পরিবার হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। হাইকোর্ট সরকারি সিদ্ধান্তকে বাতিল করে ফের পুরানো কোটা ব্যবস্থাকেই বহাল রাখে যার ফলে ফের ৫৬ শতাংশ সংরক্ষণ ফিরে আসে। হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন কোটা বিরোধীরা।
২১ শে জুলাই সেই বিষয় নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের শুনানি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তার মাত্র কয়েকদিন কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং সারা বাংলাদেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে দেশ এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। ২১ শে জুলাই সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে কোটা ব্যবস্থার ব্যাপক রদবদল করে ৫৬ থেকে মাত্র ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। প্রশ্ন হল ২১ শে জুলাই সুপ্রিম কোর্টে শুনানি নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও সেই পর্যন্ত অপেক্ষা না করে কেন তার মাত্র কয়েকদিন আগেই আন্দোলন শুরু হয়ে গেল? হতে পারে আন্দোলনকারীরা আদালতকে, সরকারকে চাপে রাখতে চেয়েছিল বা অন্য কিছু কিন্তু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায়ের পরও আন্দোলনকারীরা আন্দোলন থেকে সরে আসতে রাজি হননি। এবার তাঁদের দাবি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইত্যাদি। নতুন করে হিংসার খবর না এলেও বাংলাদেশ থমথমে, সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, কারফিউ জারি হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হাসিনা সরকারের দুর্বলতা প্রকট হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য, পুলিশের গুলিতে আবু সঈদ নামক সহ কয়েকজন ছাত্রের মৃত্যু, কোটা বাতিল করেও কোটার প্রতি সরকারের দুর্বলতা, শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দাদাগিরি ইত্যাদি আন্দোলনকে হিংসাত্মক হয়ে উঠতে সুযোগ করে দিয়েছে। এর সংগে যুক্ত হয়েছে সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব, ২০২৪ সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ না হওয়ার অভিযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অবস্থায় সরকার কী উপায়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ প্রশমিত করে তাদের ক্যাম্পাসে প্রত্যাবর্তন ঘটায়, দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনে সেটাই দেখার।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই আন্দোলনের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নব্য রাজাকাররা। তারা শ্লোগান দিয়েছে, "জাতির পিতা মুজিবর রহমান ঘোড়ার ডিম,জাতির পিতা সবার প্রিয় ইব্রাহিম।" শ্লোগান উঠেছে, "ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।"
বাংলাদেশের কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে বুঝে অথবা না বুঝে ভারতেও সংরক্ষণ বিরোধী মনোভাবের পালে হাওয়া তুলতে মরীয়া উচ্চ বর্ণবাদী চেতনা। তারা বাংলাদেশ ও ভারতের সংরক্ষণ পদ্ধতিকে এক করে দেখাতে চাইছে। যুগের পর যুগ ধরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ না করায়, কর্মসংস্থান না করায় ভারতে যে বেকারত্বের পাহাড় তৈরি হয়েছে সেই মুল কারণটিকে আড়াল করে সংরক্ষণকেই বেকারির মূল কারণ বলে নিশানা করা হচ্ছে। আর রয়েছে দু'দেশের মৌলবাদী শক্তি যারা হাত ধরাধরি করে দু'দেশেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটানোর জন্য ঘোলা জলে মাছ ধরার জন্য মরীয়া। প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের তেমন কিছু করার সুযোগ নেই কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের যাতে অগণতান্ত্রিক শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারে তা দেখার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমাদেরই।