উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলন ২০২৩। এই অনুষ্ঠানে নানাবিধ বিশৃঙ্খলা এবং গুণী শিল্পীদের হেনস্থা প্রসঙ্গে অনেক কাহিনী সামনে এসে গেছে। এই বিশৃঙ্খল অনুষ্ঠানে যোগদানকারী একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে সামান্য দু-একটি কথা। প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক – কী কী বিষয়ে বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েছে। প্রথমদিনের অনুষ্ঠান প্রায় বাতিল হয়ে যায় সময়মতো ভেনু না পাওয়ায়। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান কোনো কারণ ছাড়াই বারবার বিলম্বিত হয়, জনশ্রুতি অনুসারে—শিল্পীরা পারিশ্রমিক না পাওয়া অবধি অনুষ্ঠান শুরু করতে চাননি। প্রধান মঞ্চে স্থানীয় অনুষ্ঠান চলতে থাকে, কোনো পেশাদার শিল্পীকে সেখানে জায়গা দেওয়া হয়নি। পণ্ডিত তেজেন মজুমদারকে অনুষ্ঠান শেষ করতে তাড়া দেওয়া হয়, তিনি অনুষ্ঠান শেষ করার আগেই স্থানীয় ব্যান্ডের লোকজন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মঞ্চে উঠে পড়ে। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর অনুষ্ঠানে স্থানীয় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা গোলমাল বাধান (তাদের মঞ্চ দেওয়া হয়নি বলে)। খাবার জায়গায় স্বেচ্ছাসেবক না থাকায় দর্শকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। যে খাবার দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল—তা দেওয়া হয়নি, অর্থাৎ এখানেও ব্যয় সঙ্কোচন করা হয়। পরের দিন—সব শিল্পীদের মূল মঞ্চে অনুষ্ঠান করতে দিলেও—মাত্র ২০-২৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়। ক্যাকটাসের অনুষ্ঠান আটকে রেখে স্থানীয় অনুষ্ঠান চলতে থাকে, শেষে দর্শকদের প্রতিবাদে মাঝপথে সেই অনুষ্ঠান বন্ধ করে ক্যাকটাসকে ৪-৫ টি গান গাইতে দেওয়া হয়। মূল সমস্যার সূত্রপাত হয় অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরের দিন। শিল্পীদের হোটেলের ঘরের চাবি অকেজো হয়ে যায়; তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়নি, অনেকের পারিশ্রমিকও মেটানো হয়নি – এমন খবর সামনে আসতে থাকে।
অন্যদিকে দুটি হিন্দি গানের অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। তাঁরা মঞ্চ প্রস্তুত করার জন্য তিন ঘণ্টা সময় পান। মোটামুটি নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন। জনশ্রুতি অনুসারে—তাঁদের পারিশ্রমিক এবং অনুষ্ঠান পরিবেশনার খরচ সমস্ত বাঙালি শিল্পীর মিলিত পারিশ্রমিকের চেয়ে বেশি। এবার আসা যাক এই দুই শিল্পীর অনুষ্ঠানের উৎকর্ষের বিষয়ে। প্রথম শিল্পীর অনুষ্ঠান পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর অনুষ্ঠানের সঙ্গে একই সময়ে (অন্য মঞ্চে) থাকায় তা উপভোগ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে মূল মঞ্চের পাশ দিয়ে আসার সময় মনে হয়েছে, ‘শব্দ নেহাত কম নয়’। (আশেপাশে ভাগ্নে থাকলে জানিয়ে দিতেন, ‘শব্দের পেছনে অর্থও নেহাত কম নয়’)। মূল শিল্পীর অনুষ্ঠানে জাঁকজমক এবং শব্দের মাত্রা আরো কয়েককাঠি ওপরে। কেউ যে নিজের গাওয়া অত্যন্ত বিখ্যাত কিছু গানের পিণ্ডি এইভাবে চটকাতে পারেন—তা না শুনলে বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। শিল্পীর যত না গানে মনোযোগ, তার কয়েকগুণ বেশি মনোযোগ কেশসজ্জায় কিংবা লাফালাফিতে। তবে যে পুজোর যা মন্ত্র—যেরকম মাল দু-তিন কোটি টাকায় বিক্রি হবে, গায়ক তো তেমন জিনিসই উপহার দেবেন। সুরমণ্ডল সহযোগে সঠিক সুরে গাওয়া গানের দাম যদি দু্-তিন কোটির সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র হয় (এবং তাও যদি সঠিক সময়ে না পাওয়া যায়), তবে কর্কশ চেঁচামেচির রাস্তা বেছে নেওয়াই ভালো। তবে, মূল শিল্পীর অনুষ্ঠানের পর বাইরে যতজনের সাথে দেখা হল, তাঁরা কেউই দেখলাম সন্তুষ্ট নন। অনুষ্ঠান চলাকালীন বিশেষ কেউ নাচানাচিও করছিলেন না। ক্যাকটাসের পাঁচটি গানের সময় উন্মাদনা যেন অনেক বেশি ছিল। তবে কি তিন কোটি টাকার যে মাল কেনাবেচা হলো, তাতে কোথাও ভুল বোঝাবুঝি রয়ে গেল? যারা কিনলেন, তাঁরা কি অনুষ্ঠান শেষে ভাবতে বসলেন, “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই…”
রূপঙ্কর সম্ভবত এই প্রশ্নটিই তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, কী এমন সেই গায়কের পরিচয়, যাঁর গানের দাম পঁচিশ লক্ষ (মতান্তরে পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা? বঙ্গ সম্মেলনের মূল অনুষ্ঠানের পর আমাদের অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগছে – কী এমন শুনলাম, যার মূল্য (পরিবেশনার খরচ ধরে) চার-পাঁচ কোটি টাকা? কলেজ জীবনে কেনা ১০০ টাকার সিডি-তে এই গায়ক ঐ একই গান অনেক শ্রুতিমধুরভাবে উপহার দিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন রূপঙ্কর, আবার আশ্চর্যভাবে উত্তরও তাঁর জানা। হোটেলের লবিতে ঘরের চাবি অকেজো হয়ে যাওয়ায় গুরুজি বসে আছেন, তাঁর সামান্য পারিশ্রমিক না দেওয়া কর্মকর্তারা ফোন তুলছেন না, ওদিকে হিন্দি গানের মূল শিল্পী গান শুরু করেছেন এ্যাকাউন্টে ২-৩ কোটি ঢোকার পর। উত্তর মনে হয় গুরুজিরও জানা। অবাঙালি চ্যানেল মালিকের রিয়েলিটি শোতে অবাঙালি হেঁড়ে গলার গায়িকার কর্কশ চেঁচামেচি, কিংবা ক্ষীণতনু গায়কের বেদনাবিধুর কান্নাকাটিকে দিনের পর দিন সুমধুর সঙ্গীতের মর্যাদা দিতে গিয়ে একটু একটু করে কমিয়েছেন নিজের ভাষায় গাওয়া প্রকৃত সঙ্গীতের দাম। মান্নাবাবুর গান সঠিকভাবে গাওয়া প্রতিযোগীকে চেঁচামেচির অগ্নিপরীক্ষা দিতে হলেও হেঁড়ে গলার গায়িকাকে ‘প্রিয়া ভোলো অভিমান’ গাইতে হয়নি। বাজারি অর্থনীতির মানদণ্ড ভারি নিষ্ঠুর। অবাঙালি চ্যানেল মালিকের তৈরি চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে সে গানের মূল্যতালিকা তৈরি করে নিয়েছে। সম্পূর্ণভাবে বাঙালি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত বাঙালি দর্শকের অনুষ্ঠানে বাংলা গানের মূল্য তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনো সময় আছে, সতর্ক হোন। নিজেদের গানের দাম নিজেরাই কমানোর খেলায় মেতে উঠবেন না। একদিনের মহীরুহ আজ চারাগাছে পরিণত হয়েছে।