গতবছর ক্রিসমাস, অর্থাৎ ২০১৮-র ডিসেম্বরে এই ডাইরিটা উপহার পেয়ে যখন ভাবছি কি করব, তখন বাড়ির আড্ডায় উপস্থিত এক শুভাকাংখী বললেন, ওই যে বলেছিলে তোমার ছোটবেলার কথা, বিশেষত কিশোর বয়সের অনেক কথা মনে হয়? সেগুলিই লেখো না কেন? তাতে আমাদেরও সেই সময় সম্পর্কে একটা ধারণা হবে।
কথাটা মন্দ লাগল না। আমার ছোটবেলা ইতিহাসের এক ক্রান্তিকাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত অবস্থা, ৫০-এর দুর্ভিক্ষ(খ্রীষ্টাব্দ ধরলে ১৯৪৩), ভারতের স্বাধীনতা, নেতাজীর যুদ্ধ প্রচেষ্টা, বোম্বাই-এর রাজকীয় নৌসেনার বিদ্রোহ, দেশভাগ(বাংলা ও পাঞ্জাব), পাঞ্জাবের-তত-নয় কিন্তু বাংলার অকথ্য দুর্দশার শুরু – যা এখনো এই ৭০-৭১ বছর পরেও চলছে। এতে বাংলার সাধারণ মানুষের কিছু ভুল থাকলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভুল, স্বার্থপরতা, চিন্তার দৈন্য, দলাদলিও কম দায়ী নয়। তাই ভাবলাম, ওই সময়ে আমাদের বাড়ির, পাড়ার, গ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু লেখা সম্ভব, চেষ্টা করব। মনে রাখতে হবে যে এই লেখা ইতিহাস লেখা হয়। বরং কৈশোরে পা দেওয়া আট বছরের ছেলে যা দেখেছিল ও নিজের মত বুঝেছিল, তার বর্ণনা। তবে এটাও ঠিক বয়স বাড়লে বুদ্ধি সামান্য পেকেছে, আর তাই আগের দেখাগুলি কখনো কখনো অন্যরকম মনে হয়েছে। তাই একটু “ইধার উধার” হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।
লিখতে চাই এই কারণে যে আমার নিজের খুব জানতে ইচ্ছে করে যে আমার পূর্বপুরুষরা নানা যুগে তাঁদের সময়টুকু কেমন কাটিয়েছেন। আকবর বাদশার আমলে কেমন ছিলেন ওঁরা? আওরংজেবের রাজত্বেই বা কিভাবে জীবন কেটেছে তাঁদের? বারো ভুঁইয়ার সময়? আমার পরবর্তী প্রজন্মেরও যদি এমন জানার ইচ্ছে হয় ? তাহলে আমার এই লেখা থেকে বিশদভাবে না হলেও আমাদের ক্ষুদ্র গ্রামীণ জীবনের কথা অন্ততঃ কিছুটা আঁচ করতে পারবে। এই ভাবনাই আমার লেখার মূল চালিকাশক্তি।
শুভাকাংখী বললেন, শুরু কর তখনকার অন্দরমহলের কথা দিয়ে। অন্দরমহল ? চারুলতা, আমার মায়ের কথা তো আগে লিখেছি । আদিষ্ট হলাম – মা ছাড়া পরিবারে, পাড়ায় আর গ্রামের পরিমন্ডলেও তো আরো অনেকে ছিলেন? কিন্তু আমি তো মোটেই ঘরোয়া ছেলে ছিলাম না, তার উপর শৈশবেই মাতৃহারা, বাইরে বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোতেই উৎসাহ ছিল বেশী। তবু মনে হল, যা মনে আছে তাতে অন্দরমহলের ইতিহাসের কথা একটু বলা যাক প্রথমে।
আমার বাবার ঠাকুরদাদারা ছিলেন দুই ভাই। এই দুভাই পৃথকান্ন হয়ে যাওয়ায় বংশ দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। এপাশে আমরা(উত্তরের হিস্যা) আর ওপাশে দাদামশাই-এর পরিবার(পশ্চিমের হিস্যা)। অবশ্য এই ভাগাভাগি শুধু কাগজে কলমে। খাওয়া দাওয়া আলাদা হলেও উৎসবাদি একসঙ্গেই উপভোগ করতাম। ধর্মচর্চায় একটু অবশ্য ভিন্ন পথের পথিক ছিলাম। দাদামশাইরা ছিলেন একটু গোঁড়া ধরনের আর আমরা একটু নাস্তিকতার দিকে। এতে অবশ্য পারিবারিক বন্ধন ও তার গাঢ়তায় কোনো দাগ পরে নি। জরুরী কাজেকর্মে বাবা-কাকারা তাঁদের খুড়ো কুঞ্জমাস্টারের (পুরো নাম কুঞ্জকিশোর দাস, যতদূর মনে পড়ে যৌবনে যাত্রাদলের মাস্টার ছিলেন বলে নাম কুঞ্জমাস্টার) উপদেশ বা আদেশ পালন করতে একটুও ভুলতেন না। নিজেরা ওনাকে অভিভাবক হিসেবে দেখতেন ও আমাদেরও তাই শিখিয়েছিলেন।
অন্দরহলের ভূগোলে আসি এবার। আমাদের খুব বড়সড়ো একখানা উঠোন ছিল। এই উঠোনের উত্তরের ভিটায় বেশ বড় একটি ঘর। তার পুবমাথার ঘরে থাকেন বড়কাকু। তার পাশেই উগার (স্টোরেজ), যেখানে সমস্ত জিনিস যা রোজকার ব্যবহারের নয় জমা আছে। একখানি মাচান, তার উপরে ডুলি আর বাক্সপ্যাঁটরা। পরের বড় ঘরটিতে মা, বাবা এবং আমরা। পশ্চিমপ্রান্তের ঘরটি হোলো রান্না ও খাবার ঘর। পিঁড়ি পেতে মেঝেতে পাত পেড়ে খাওয়া। একখানা বারান্দা ঘরের পাশে। উঠানের পশ্চিমদিকে বিশাল টানা লম্বা একটা ঘর। আর পুবমুখী একটা পাকা বারান্দা। ঘরটির মেঝে ইঁট-সিমেন্টে পাকা। উত্তরের ঘর, যার কথা আগে লিখলাম তার মেঝে-বারান্দা অবশ্য কাঁচা ছিল। এর পাশে একটি ঘরে থাকেন আমার বালবিধবা রাঙ্গাপিসীমা। রাঙ্গাপিসীমা থাকেন সামনের দিকে আর ঐ ঘরেরই অন্য একটা ছোটো ভাগের একটি কোঠায় পিসীমার নিরামিষ রান্নাঘর। ওখানে মাঝেমাঝেই আমার আর বাড়ির অন্যান্য ছেলেপুলেরা সুস্বাদু নিরামিষ তরকারীর লোভে পাত পাড়তাম। তারপরের ঘরটিতে কাঠের বড়সড় সিন্দুক এবং সেই সিন্দুকের উপরে দাদামশাই-এর বিছানা আর পাশে আরো একটা বাড়তি বিছানা। আমাদের ঠাকুর্দাকে দাদামশাই ডাকতে শেখানো হয়েছিল, এটা বোধহয় পূর্ববঙ্গের রেওয়াজ। এরপরেই শেষে দক্ষিণ প্রান্তে আরেকটা বিশাল ঘর। সে ঘরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকতেন দিদি (অর্থাৎ ঠাকুরমা)। দিদির ঘরে একটা কাঠের ফ্রেম ও কাঁচের দরজাওয়ালা আলমারি ছিল। ওই আলমারি ছিল আমাদের ছোটোদের এক মহা আকর্ষণের জায়গা। কারণ ? ওই আলমারির থাকে থাকে দশ-বারো রকমের আচার আর নানারকম সংরক্ষিত খাদ্য – লেবু, তেঁতুল, আম, আমলকি, জলপাই, কুল, চালতা, কদবেলের আচার। কোনোটা টক, কোনোটা মিষ্টি, কোনোটা ঝাল। পুবপাড়ার এক বাড়ি থেকে তৈরী করিয়ে আনানো কাসুন্দি। আমাদের বংশের কাসুন্দি করার “আস্য” ছিল না। থাকে থাকত আমসত্ত্বও, আমসিও । এইসব আকর্ষণীয় জিনিস মাঝে মাঝে রোদে দেওয়া হোতো এবং তখন কিছু কিছু বস্তু আমাদের কপালে জুটে যেত।
উঠোনের দক্ষিণে প্রস্থ বরাবর মন্ডপঘর। সমস্ত পুজো-আচ্চা ওই ঘরে হয়। লাগোয়া ছিল কবিরাজমশাই-এর শোবার ঘর, আর ঐ শেষের ঘরের পরেও আরেকটি দক্ষিণদুয়ারী ছোট্ট ঘর – ওনাদের শালগ্রাম শিলা ও পূজার ঘর। আঙ্গিনা পেরিয়ে কবিরাজ মশাইদের রান্নাঘর। এই আঙ্গিনাতেই রাসপূর্ণিমায় বসত কীর্তনের আসর। দাদামশাই গোঁড়া বৈষ্ণব ছিলেন, ডিম আর মাংস খেতেন না তবে মাছ খেতেন। অতিথি ভোজন না করিয়ে নিজে খেতেন না। উঠানের পুবদিকের বিশাল উগারে থাকত নানা কৃষি উত্তপাদিত পণ্য। ধান, পাট, কলাই, মুগকলাই ইত্যাদি। কৃষি যন্ত্রপাতি এবং অব্যবহৃত সরঞ্জাম।
এরপর “বাইরবাড়ি” বা বৈঠকখানা ঘরের বর্ণনা দিই। বড়সড় বৈঠক খানা ঘরে পাকা কাঁঠালকাঠের ঝকঝকে পালিশ করা আসবাব – একটি টেবিল আর দুটি চেয়ার। একটু ফাঁক দিয়ে পরপর তিনটি চৌকির উপর তোষক পেতে ঢালাও ফরাস। সেই ফরাসে দিনে ছোটদের পড়াশোনা, রাতে ঘুম। সন্ধেয় বড়দের দাবা-পাশার আয়োজন। দক্ষিণে যে অংশটুকু ছিল কবিরাজ জ্যাঠাদের দখলে, তার সামনের অংশে ছিল একটা মুদিখানা । গ্রামের একমাত্র মুদিখানা যার দ্বৈত মালিকানা কবিরাজ জ্যাঠা ও রমেশ ভুঁইয়া জ্যাঠামশাইদের। আর পেছনের অংশে শোয়ার ঘর। এই কবিরাজ জ্যাঠা আমাদের পরিবারভূক্ত ছিলেন বলা যায়। তখন আমাদের গ্রামে কোনো ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল না। তাই আমাদের কোনো পূর্বপুরুষ অঁদের ডেকে এনে আমাদের এখানে বসতি করিয়েছিলেন। ওঁরা তিন ভাই – বড় ভাই সুরেন ঠাকুর পৌরোহিত্ত্ব করতেন, মেজোজন সারদা ঠাকুর – ওই দোকানে বসতেন আর সখের কবিরাজি করতেন। তেমন পশার ছিল বলে মনে হয় না। ছোটজনের নাম মনে নেই , উনি শালগ্রামের সেবা ও বাড়ির নানা কাজকর্ম করতেন। ওঁদের আসল বাড়ি ছিল সিলেটে। ওঁরা কিন্তু আমাদের বাড়ির পৌরহিত্য করতেন না, খুব জরুরী প্রয়োজন না হলে।
বাইরবাড়ির পূবদিকের উঠানে চলত আমাদের খেলাধুলা, চাষের ফসলের ঝাড়াবাছা, পাট শুকানো, ধান শুকানো ইত্যাদি নানা কাজ। এই উঠানের পূবে ছিলো লম্বা টানা আরেকটা ঘর – পুবের ঘর আর তার উত্তরে গোয়ালঘর। বাড়ির সব ঘরের ছাউনি ও বেড়া ছিল করোগেটেড টিনের। বড়কাকুর শোবার ঘরের পাশে ছিল একটা ছাদভাঙ্গা কিন্তু ইঁটগাথা পাকা বড় ঘর, বাবা ওটাকে অনেক পরে টিনের আচ্ছাদন দিয়ে বাসযোগ্য করে নিজে থাকতেন। এই পাকা দালানের একটা অংশ খুঁড়ে বের করে SOD হিসেবে ব্যবহার করে বাবা সবুজ ঘাস সংরক্ষণের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো ব্যবহারিক জ্ঞান না থাকায় অকৃতকার্য হন।
আমার গর্ভধারিণী মায়ের কথা বলি। বিরাট পরিবারে মায়ের ব্যস্ততা ছিল খুব বেশী। মা বাড়ির বড় বৌ, মায়ের সঙ্গে সবার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এই ব্যস্ততার কারণে আমার সঙ্গে দেখাশোনা কমই হোতো। মনে রাখতে হবে সেই সময় সম্পর্কে গুরুজনের প্রতি সশ্রদ্ধ ও বিনীত থাকা বাড়ির একটা বড় অনুশাসন ছিল। পরিবারের আত্মীয় ও অনাত্মীয়দের নিয়ে বেশ বড় সংসারের কাজ সামলে ছেলেমেয়ের প্রতি অনেক মনোযোগ দেওয়ার সময় মায়ের ছিল না। তবে বিকেলে দাদামশায়ের ঘরের বারান্দায় বারোয়ারী চুল বাঁধার আড্ডায় মাকে দেখেছি। সবার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা ছিল। সাত বছর বয়সে মাকে হারাই। মায়ের গল্প তাই এখানেই শেষ।
এরপর বলব বড়খুড়িমার কথা। আমরা শুধু খুড়িমা বলেই ডাকতাম। আমার জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই খুড়িমা বাড়ির বৌ হয়ে আসেন। বিয়ের কনে এসে “জ্যান্ত পুতুল” পেয়েছিলেন শুনেছি। আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। খুড়িমার আস্কারা পেয়ে অনেক দুষ্টুমি-অন্যায়ও করেছি, মাঝে সাঝে বকুনিও খেয়েছি। কিন্তু কোনো দুষ্টুমির কথা বাবা-কাকার কানে কখনোই ওঠেনি। বাবা অত্যন্ত স্নেহ করতেন এই ছোটোখাটো প্রায় খুকী চেহারার ভাতৃবধূকে। আমি পাঠশালায় পড়াকালীন প্রায় প্রতি বছরই খুড়িমার বাপের বাড়ির নায়রীযাত্রার সঙ্গী হতাম। কিশোরগঞ্জের কাছে পাটাবুকায় খুড়িমার বাপের বাড়ি, বাবার নাম সুর্য সরকার। ওই দাদু আমায় খুব ভালোবাসতেন। যতবার ওই দাদুর বাড়ি গিয়েছি ততবার আমার মাপমত ছোটদের জন্য বানানো একটি ধুতি পেয়েছি। অত্যন্ত অমায়িক শান্তস্বভাবের খুড়িমাকে একবার মাত্র ছাড়া আর কখনো কোনো কারণেই প্রতিবাদ করতে দেখি নি। যদিও ওই প্রতিবাদ তাঁর স্বামী (আমার বড়কাকু) ও দেওরের(আমার সোনাকাকু) ব্যাক্তিত্বের চাপে ফলপ্রসূ হয় নি। সেই সময় খুড়িমার পক্ষ নেওয়ায় দুই কাকুর কাছেই আমি রূঢ় ধমক খেয়েছিলাম।
আর একবারই মাত্র রাগতে দেখেছিলাম খুড়িমাকে। সেটা ওঁর একমাত্র পুত্রের ওপরেই। খুড়িমার একমাত্র সন্তান আমার খুড়তুতো ভাই বংশের মুখোজ্বলকারী পন্ডিত মানুষ ও রসায়নবিদ। শৈশবে একবার সে জেদ ও রাগ করছিল আর খুড়িমা তাকে কোনোভাবেই বাগে আনতে পারছিলেন না। তখন উপুড় করে বঁটি দিয়ে ভয় দেখান, আর অসাবধানে লেগেও যায় একটু। আমি ১৯৫৫ সালে তাতকুরার বাড়িতে যাই শেষবারের মত। খুড়িমা তখন ওনার আঙ্গুল থেকে খুলে একটি সোনার আংটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। যদি আর কখনও না দেখা হয় তবে অই আংটিই থাকবে আমার কাছে ওঁর স্মৃতি হয়ে – এই কামনায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি এই স্মৃতিচিহ্ণটি এক দশক পর হারিয়ে ফেলি। কিন্তু দ্বেষবিহীন খুড়িমার কথা ও ইচ্ছা আমার কাছে সেদিন এবং পরবর্তী কালেও খুব বড় ব্যাপার ছিল। মা মারা যাবার আগে ও পরে এমনকি বড় হয়েও, যখনই খুড়িমা কলকাতায় এসেছেন, অনেক স্নেহ ও আদর পেয়েছি।
এবার আসি কাকিমার কথায়। ছোটোখুড়িমা, তাঁকে আমরা কাকিমা বলেই ডাকতাম। আর ছোটোকাকুকে ডাকতাম সোনাকাকু বলে। সোনাকাকু রিট্রেঞ্চড হয়ে মিলিটারি চাকরিতে ফিরে ভারত সরকারের সেন্ট্রাল এক্সাইজের ইন্সপেক্টার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ভারতভাগের সময়ে “ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র”তে চাকরি করার অপশান নেন। পোস্টিং পান শিলিগুড়ির কাছে থানজোড়া চা বাগানে। নতুন চাকরি পাওয়ার সময়েই সোনাকাকুর বিয়ে হয় ও নববধূ হয়ে কাকিমা আসেন। চা বাগানে কাকিমার কাছে প্রায় দেড় বছর আমি ছিলাম। কাকিমার বাবা ছিলেন ময়মনসিংহ শহরের পোস্ট অফিসের চাকুরে। বিয়ের পর কাকীমা তাতকুরার অন্দরমহলে বেশিদিন কাটানোর সুযোগ পান নি, সোনাকাকুর চাকরির কারণে। কিন্তু আমার জীবনে কাকিমার প্রভাব খুব বেশি কারণ কাকিমার কাছে থাকাকালীন স্নেহ, সৎপরামর্শ প্রচুর পেয়েছি কাকিমার কাছ থেকে।
আমার গর্ভধারিণী মা মারা যান ১৯৪১ সালে, আমার সাত বছর বয়সে। আমরা চার ভাইবোন তখন ৭, ৫,৩ আর সবচেয়ে ছোটোটি সাত/আটমাসের। মা মারা যাবার পর কিছুদিন আমাদের চার ভাইবোনকে সামলেছেন দিদিমা আর খুড়িমা। আমার ঐ সাত-আটমাসের ভাই তাই খুড়িমাকে “মা” বলেই ডেকে এসেছে। মা মারার যাবার বছরখানেকের মধ্যে বাবা আবার বিবাহ করেন। আমার বিমাতা ঢাকা জেলার মেয়ে ছিলেন। এই দাদামশাই-এর কোনো ভাইবোন ছিল না। স্বামী-স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে একক পরিবার।
দেশভাগের পর বাবা কোনো কারণে অভিমান করেই বাংলাদেশ থেকে চলে আসেন। ঠিক কি ঘটেছিল আমার জানা নেই। আর কখনো ফিরে যান নি, এমনকি দেশের কথার কোনো আলোচনাও ওনার মুখে কোনদিন শুনি নি। শুনি নি কারো সম্বন্ধে কোনো অভিযোগের কথাও। ১৯৪৮ সালে বড়কাকু বাবার অনুরোধে আমার বিমাতা, বৈমাত্রেয় ভাইবোন এবং আমার সহোদর বোনকে বাবার কর্মস্থল উড়িষ্যায় রেখে আসেন। বাবা ছিলেন ডাক্তার, পরবর্তীকালে নদীয়া জেলার ফুলিয়ায় এসে পরিবারসহ বসবাস শুরু করেন।
পশ্চিমের হিস্যা অর্থাৎ দাদামশাই-এর কথা আগে উল্লেখ করেছি। দাদামশাই-এর চার বিয়ে। প্রথম দুই স্ত্রী অল্পবয়সে কলেরায় মৃত। তৃতীয় স্ত্রীও দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর মারা যান। প্রথম দুই পক্ষেও কন্যা সন্তান জন্মায়। শুনেছি উত্তরাধিকারী পাওয়ার জন্য চতুর্থ বিবাহ করেন এবং সেই বিবাহের ফলে এক কন্যা ও এক পুত্র হয়। পুত্র সর্বকনিষ্ঠ। এই দাদামশাই বেশ রাশভারী ছিলেন মনে আছে। পরিবারটিতে ভাইবোনদের মধ্যে খুব সৌহার্দ্র্য বজায় ছিল। দিদি(ঠাকুরমা) দাদামশাই-এর চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোটো ছিলেন। ঐ হিস্যায় কোনোদিনও একবিন্দু কথা কাটাকাটি আমরা শুনতে পেতাম না। আনন্দ, হৈচৈ লেগেই থাকত। প্রায় প্রতিদিন ওঁদের ঘরের বাধানো পাকা বারান্দায় চুল বাঁধার আসর বসত। দুই বাড়ির মেয়েরা শুধু নয়, পাড়ার অন্য বাড়ি থেকেও মেয়েরা আসত ঐ আসরে সামিল হতে। আমাদের বাড়িতে যে ঢেঁকিঘর ছিল তা দাদামশাই-এর হিস্যার। মন্ডপঘরের উত্তরের বারান্দায় ঢেঁকি পাতা ছিল, সেই ঢেঁকি অনেকেই ব্যবহার করতেন। ঢেঁকিঘরে যখন কারো কোনো কাজ চলত তখন সেখানে রীতিমত আসর জমে যেত। রঙ্গ রসিকতায় জমজমাট। চাল কোটার মজুরীতে পাড়ার এক বিধবা মহিলা জীবিকানির্বাহ করতেন। আমাদের বাড়ির চাল উনিই কুটে দিতেন। বদলে চালের একটা অংশ, খুদ-কুড়া এবং তুষের একটা অংশ নিয়ে যেতেন, ওনার একলার জীবন এই আয় থেকেই চলে যেত।
কার্তিকপূজায় একটা আসর বসত। পাড়ার মেয়ে বৌরা আসত, সারারাতব্যাপী গান হোতো। রাসপূর্ণিমায় দাদামশাই ভারি জাঁকজমক করে পূজা করতেন, তাতে গ্রামের সবার নিমন্ত্রণ তো থাকতই, অন্য গ্রাম থেকেও নিমন্ত্রিতরা আসতেন। পুজোর প্রসাদ ছিল খিচুড়ি, লাবড়া, আর পায়েস। অন্দরমহলের আড্ডাধারীদের এই সময় কাজের অন্ত থাকত না।
বাবা দেশত্যাগ করলেও ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট ছিল। উড়িষ্যাতে বাবা ডাক্তারি শুরু করেন। কাকিমা একবার বাবার ওখানে বেড়াতেও গিয়েছিলেন। মনে আছে, ফেরার সময় বিছানার মধ্যে উড়িষ্যার নোনা ইলিশ প্যাক করে এনেছিলেন। বিছানার মধ্যে ইলিশের গন্ধ ছাড়ানো যায় নি, তাই দুটি বালিশ ফেলে দিতে হয়!
সেই ক্রান্তিকালের এই ছিল পটভূমিকা। অন্দরমহল ছিল আপাতদৃষ্টিতে শান্ত। কিন্তু এক দশকের মধ্যে দেশভাগকালীন সময়ে সাংঘাতিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ওলটপালট সংঘটিত হয়। এই ঝড়ো হাওয়ায় ভারতের যে প্রদেশের সবচেয়ে ক্ষতি হয় এবং যে ধাক্কার জেরে আজও সেই বিভক্ত প্রদেশ ধুঁকছে সেটি হোলো বাংলা। এই ওলটপালট আমাদের বাড়ির অন্দরমহলেও বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল, বিশেষতঃ আমাদের উত্তর হিস্যার সংসারে – অশেষ ক্ষতি ও মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বাবা ও তাঁর তিনভাই-এর পরিবারকে। সে আরেকদিনের গল্প।