দেবজ্যোতি রায় গল্প, গপ্প, কাহিনি, ছোটোগল্প কিছুই লিখতে চাননি। তিনি একটি দর্শন রচনা করতে চেয়েছেন। তিনি একটা নিজস্ব গদ্যসরণিতে হেঁটে যেতে চেয়েছেন। যে পাঠক গদ্যসরণি, অস্তিত্বের আত্মখননে আসতে চান তাকে স্বাগত, যে চান না তাকে সদম্ভে নিকুচি করা। তিনি কোনো লক্ষে পৌঁছতে চাননি। অস্তিত্বের জায়মান অন্ধকারে যে বিদ্রোহ, আত্মগ্লানি, সংশয়, যৌন পিপাসা, বিভ্রান্ত প্রবণতা, সংস্থিতির অহমিকা, মরবিড, অ্যাবসার্ড তাই দেখাতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্ত মেকিবোধের সমূল উৎপাটন ঘটাতে চেয়েছেন। ফলে তাঁকে নেমে যেতে হয়েছে অন্ধকারের জগতে। সভ্যতার জাতীয় সড়ক দিয়ে না গিয়ে জাতীয় সড়কের আশেপাশে যে অলিগলি, যেখানে মানুষ আত্মত্রাণের জন্য নীরবে অবস্থান করে অথবা নিজের চাহিদা-পিপাসা মেটাতে গোপনে প্রবেশ করে সেই বন্ধ দুয়ারে প্রবেশকের তালাচাবির আবিষ্কারক তিনি। এই মনন প্রবণতা কোথা থেকে গড়ে উঠল? ব্যক্তিগত জীবনে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া, নকশাল আন্দোলনসহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যাবতীয় বীভৎস বাস্তবতার অভিশাপ বহন, পর্বে পর্বে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের রকমফের প্রত্যক্ষ করা এবং যৌবনেই হাংরি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সাহিত্যের নতুন প্রবণতার পরিচয়ের মধ্য দিয়েই তিনি নিজের পথ করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেবজ্যোতি রায়ের আখ্যানের ভিতরে রয়েছে দর্শনের চোরাগোপ্তা চিরুনি তল্লাশি। অস্তিবাদ, নৈরাশ্যবাদ, শ্লীলতা-অশ্লীলতার পাঠ, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামি, আলো-অন্ধকারের হরেকরকম খেলাসহ ব্যক্তির খননের যাবতীয় পাঠতন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হলেই তাঁর আখ্যানের স্বাদ নেওয়া সম্ভব। এখানে কোনো গল্প পাওয়া যাবে না। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা। বিচ্ছিন্ন কিছু দৃশ্য। যা জীবনচরিতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যক্তির খননখাদকে উন্মুক্ত করতে অগ্রসর হয়েছে।
‘আমি আর এখন চিরুনি কিনিনা’ দুই পুরুষের গল্প। উন্মাদ নিরঞ্জন ও সুস্থ দীপেনের। নিরঞ্জন কেন উন্মাদ হল? সভ্যতা জানে। সুস্থ দীপেনের জীবনচেতনায় নিরঞ্জন কীভাবে প্রভাব ফলেছে তার উত্তর আখ্যান জানে। হে পাঠক আপনার মতো আমিও হরিদাস পাল। জানা-অজানার মধ্য দিয়েই লেখক ব্যক্তি মনের খননকে এক প্রকোষ্ঠ থেকে আরেক প্রকোষ্ঠে নিয়ে যেতে চান। সেখানে আলো-অন্ধকার, অস্তিত্বের সংকট, যৌন পিপাসা, উদোম যৌনতা, ভোগাকাঙ্কা, ব্যক্তির ক্ষমতাহীন দ্রোহ, আত্মগ্লানির বাজনা নানা সুরে বাজতে থাকে। দেবজ্যোতি রায় যেমন ব্যক্তির অন্তর্দর্শনের কাছে যান তেমনি ব্যক্তি মনস্তত্ত্বে লাঙল চালিয়ে দেখতে চান মানব প্রবণতা কেমন হতে পারে। নানা ঘটনা, অন্ধকার, হত্যা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পন্থা, সভ্যতার মেকিবাদ, সিস্টেমের ধান্দাবাজি ব্যক্তির অন্তর্গহ্বরে কেমন দৃশ্যজাল রচনা করতে পারে। ক্ষমতার নানা ডালপালা, নাশকতার বারান্দা, ভোক্তা-উপভোক্তার রহস্য, মেকিপনার চৌহদ্দি ও নিজেকে ভাঙতে গিয়েও একটা সীমাবদ্ধ বলয়ে আটকে যাওয়ার দ্বন্দ্ব কেমন তাই তাঁর আত্মখননের চাবিকাঠি। মধ্যবিত্ত হেজিমনি, কোনো দিকে না গিয়ে সুস্থ জীবন পরিসর গড়ার ভিতরে কোথায় খেদ, কোথায় হিংসা, কোথায় বিদ্রোহ, কোথায় আলগা যৌন পিপাসা, কোথায় নিজের আড়াল খোঁজা, তার সংবিত্তময় সংরূপের কত ভাষ্য হতে পারে তার তিনি আবিষ্কারক। বয়ানে ভেসে আসে—
“প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটা আরোগ্যহীন অসুখকে আমরা বহন করে নিয়ে চলেছি আমাদের চামড়ায় ঢেকে। বাইরেরটা কোলাহলে মুখর, ভিতরে অনন্ত শূন্যতা। সুরঞ্জনা এই শূন্যতার ভয়াবহ ভার সহ্য করতে পারেনি। তাই আত্মহত্যা করেছিল। আমিও নিজেকে উথথড্র করে নিচ্ছি এই সভ্যতার থেকে। আই ডু রেজিস্টার মাই টোটাল রিজেকশান টু দিস সিভিলাইজেশন।” (বলদের যোনি এবং অন্যান্য গল্প, আপনপাঠ, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০২৩, পৃ. ২১)
কী সেই অসুখ? কী সেই ক্লেদ যা মানুষকে বাতিল করে দেয়। কী সেই অস্থিরতা যা মানুষকে উন্মাদের পাঠক্রমে নিয়ে যায়। কী সেই নীতিহীনতা যার অংশীদার হতে না পরে সভ্যতার বর্জিত অংশ হয়ে ওঠে। কেউ কেউ প্রচলিত সিস্টেমকে মানতে পারে না। প্রচলিত সমাজ কাঠামোর ভিত্তিহীন নিয়মতান্ত্রিকতা, সমাজ বিন্যাসকে সমূলে উৎপাটন করতে চায়। ব্যক্তির একক দ্রোহ সেখানে সিস্টেমের বদল আনতে পারে না। ব্যক্তি নিজেই বাতিল হয়ে যায়। সেইসব উন্মাদের নিজস্ব জীবনবীক্ষা নিয়ে তিনি উপস্থিত হন।
‘ফাক মি আনটিল উই ওয়েক আপ দ্য নেবারস’ আখ্যান চারটি পরিচ্ছেদে চারটি পূর্ণচ্ছেদে সমাপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরেই যা বলার দেবজ্যোতি রায় পাঠককে বলে দিয়েছেন। তিনি আমাদের শেখাচ্ছেন কাহিনিটা মূল কথা নয়। কথাপালা একটা জার্নি। সেটা এক পাতার হতে পারে, একশ পাতারও হতে পারে। তিনি দেখাচ্ছেন টেক্সট পাঠকের মস্তিষ্কে কিছু জানান দিতে সক্ষম হচ্ছে কিনা। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরেই গোটা সিস্টেমের গণ্ডগোল কোথায় তা স্পষ্ট। শ্রেণি সংগ্রাম থেকে বিচারের নামে প্রহসন, রাষ্ট্রীয় নিধনের মিথ্যা প্রকরণ, মানুষের সহযাত্রী হয়ে উকিল, মোক্তারের নানা ছলাকলার মধ্যে দিয়ে সময় কীভাবে মিথ্যার অংশ হয়ে ওঠে। নিরাপরাধ, অপরাধহীন সাধারণ-অতিসাধারণ মানুষ কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়মে নিপীড়িত হয়, শুধুতাই নয় শ্রেণি সংগ্রাম থেকে বৃহত্তর পুঁজির কাছে সাধারণ মানুষ কীভাবে বারবার হেরে যায়। লেনিন, মার্ক্স আসে বটে, একটা শ্রেণিতত্ত্ব গড়ে ওঠে বটে কিন্তু সেই কাকতাড়ুয়া মহাজনকে আঘাত করতে পারে না। শ্রেণি যে তিমিরে সেখানেই থেকে যায়। যুগ থেকে যুগান্তরে চলে শোষণের ধারাপাত। ব্যর্থ মানুষ হেরে বিদায় নেয়। প্রতিবাদী মানুষ চিৎকার করে উঠলেও রাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হয়ে নিরুদ্দেশ হয়। শৃঙ্খলাহীন সেই অনিয়মতান্ত্রিক বয়ানের কত প্রকরণ হতে পারে তা দেবজ্যোতি রায় আমাদের দেখান।
দেবজ্যোতি রায় বারবার অন্ধকার জগতে নেমে গেছেন। সভ্যতার আদিম সত্যে পৌঁছতে চেয়েছেন। সভ্যতার আদিম বাস্তবতার আলোয় নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাঁর প্রায় সব লেখাই আত্মজৈবনিক ঢঙে লেখা। তিনি তো একটা মানবদর্শন রচনা করতে চান। আত্মখননের মধ্যে দিয়ে দেখাতে চান সভ্যতার ভুল কোথায়। সেই ভুল থেকে মানুষের মুক্তিই বা কোথায়। না কোনো নৈতিকতার নীতিমালা নয় তিনি দেখান জীবন কোথায় দায়বদ্ধ। সভ্যতার দোহাই দিয়ে, নিজেকে উন্নত রুচির মালিকানা করতে গিয়ে, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে গিয়ে আমরা যে কেবলই কৃত্রিম, মেকি হয়ে উঠছি সেই চক্রান্তে তিনি আঘাত করেন। ‘নিজেকে নষ্ট করবার অর্থ সদর দপ্তরে কামান দাগা’ আখ্যানকে সাহিত্যিক বীক্ষণ হিসাবে দেখতে চাই। ‘হ্যাঁ’ সাহিত্য আর ‘না’ সাহিত্য। হাংরি, শাস্ত্রবিরোধী ছোটোগল্প, সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার পাঠ চুকিয়ে দেবার নামে যে নতুন আধুনিকতা সেদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা থেকে একদল লেখক, পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিল। তা ছিল জীবনের সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব। রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দরের পূজারী হয়ে একদল সাহিত্যিক মিথ্যার কৃত্রিম ছদ্ম আবরণে ভেসে গেল আর একদল লেখক জীবনানন্দ দাশকে বরণ করে অন্ধকার, নগ্ন বাস্তবতার স্বরূপ সন্ধানে অগ্রসর হল। এ আখ্যানেও আছে দুইজন লেখক—জ্যোতির্ময় ও বিনোদবিহারী সেনগুপ্ত। দুইজনের লেখার পরিমণ্ডল আলাদা। জ্যোতির্ময় অন্ধকারের শিল্পী। বিনোদবিহারী কৃত্রিম বাজারি সাহিত্যের মিথ্যে ছলাকলায় বিশ্বাসী। দুজনের মধ্য দিয়ে আলোচনায় সাহিত্যের প্রকৃত স্বরূপ ব্যক্ত হয়ে চলে। শুধু সাহিত্য নয় জীবনেরও। জ্যোতির্ময় জীবনের গুপ্তপ্রদেশে বারবার নেমে দেখান জীবনের প্রকৃত আলো কোথায়। সাহিত্য থেকে ইতিহাস, সমাজতত্ত্বের অন্দরমহল থেকে ঔপনিবেশিক-উত্তর ঔপনিবেশিক পর্বে বাঙালির স্বভাব-সভ্যতা-সংস্কৃতির কীভাবে বিবর্তন ঘটল। জ্যোতির্ময়ের একটি লেখা পড়ে বিনোদবিহারী সাহিত্যিক তর্কে মেতে ওঠে। সেই ভাষা সন্ত্রাস, আপাতত অশ্লীলতা, ‘হ্যাঁ-না’ সাহিত্যের দ্বন্দ্বে। আর জ্যোতির্ময় দেখান কীভাবে আমরা সভ্যতার আদিম অবস্থা থেকে সময় বদলে কৃত্রিম হয়ে উঠলাম। জ্যোতির্ময়ের বয়ানে ভেসে আসে—
“একদল নেমে পড়ল খুল্লমখুল্লা বেলেল্লাপনায়, এরা পায়রার বিয়ে দিত লক্ষ লক্ষ টাকা পুড়িয়ে। দেশ-সমাজ ভোগে যাচ্ছে কি না সে নিয়ে এদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না, মোসাহেব পুষত আর তাদের পুটকিতে হাত রেখে নিজেদের ছুঁচু করাত। আর অন্যদলটা এরই প্রতিক্রিয়ায় আঁকড়ে ধরল ওই ভিক্টোরিয়ান শুচিবায়ু—বেশ্যার মুখ দেখা পাপ, মদ খাওয়া পাপ, এমনকী যৌনতাও পাপ, যদিও বাচ্চাকাচ্চা এঁরাও পয়দা করতেন এবং সেজন্যই নাককান মুলে যতটুকু রতিক্রিয়া, অনেক যৌন শব্দও ক্রমশ সমাজে অশ্লীল বলে গণ্য হলো। আসলে দুটোই ছি প্রকাণ্ড দুই ভুল।” (তদেব, পৃ. ৩২)
জীবন সম্পর্কে জ্যোতির্ময়ের বিশ্লেষণ বিনোদবিহারীকে প্রভাবিত করেছে। সেও অন্ধকার জগতে নামতে এসেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হতে পারেনি। এমনকি একটা গ্লানি, একটা দ্বিধা থেকে গেছে। তেমনি বেশ্যা কালীও বিনোদকে বরণ করেনি। দেবজ্যোতি রায় জীবনের বিরোধাভাসকে ব্যক্ত করে চলেন। দীর্ঘদিন ভুল প্রক্রিয়ায় থাকতে থাকতে মানুষ যেমন ভুলভুলাইয়াতে ঢেকে যায় তেমনি একটা পরিসর খুব সহজেই অন্য একটা পরিসরকে বরণ করতে পারে না বা জায়গা ছেড়ে দেয় না। জীবনের মধ্যেই কোথায় যেন একটা থরথর দ্বিধা থেকে যায়। তা কী চেতনার সহজপাঠ না অন্যকিছু? নাকি নষ্ট সভ্যতায় থাকতে থাকতে আমরা সবাই নষ্ট বিবেকের ফসল! কালী বিনোদকে নষ্ট করতে পারেনি বলে জ্যোতির্ময় যে বয়ানে উপনীত হয় তা স্মরণ করা যাক—
“আরে এই ভালো লোকগুলোই তো হাজারটা খারাপ লোকের চেয়ে বেশি ক্ষতি করে আমাদের। এই মাদারচোদ বুর্জোয়া সভ্যতার এইসব ভালো লোকেরাই তো সব একেকটা মুখোশ। রক্তখোকা বুর্জোয়া ব্যবস্থার মুখ ঢাকা পড়ে এইসব ভালো লোকেদের বিজ্ঞাপনে। সভ্যতার দেহের সবক’টা দগদগে ঘাকে তো এরাই এদের ভালত্ব দিয়ে ঢেকেঢুকে রাখে। গন্ধটুকুও বের হতে দেয় না। এদেরকে নষ্ট করাটাই তো সবচেয়ে পবিত্র কাজ। তাহলে হিংস্র মৃত বিশাল হাঙরটার বিশাল মুখ বেরিয়ে পড়বে।” (তদেব, পৃ. ৩৪)
কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্ব এখানেই শেষ নয়। জ্যোতির্ময় খুন করে কালীকে। কেন খুন? জ্যোতির্ময় ভেবেছিল কালীও বুঝি তাঁর মতো শক্ত মানসিকতার অধিকারী। কিন্তু নারী তো সর্বদাই কোমল। কিন্তু এখানেই শেষ নয় খুনের মামলায় জ্যোতির্ময় পুরো সত্য ঘটনা স্বীকার করেছে। মৃত্যুতে তাঁর ভয় নেই। কেননা সে জীবনকে ভালোবেসেছে। সে প্রকৃতপক্ষে জীবনকে জানতে চেয়েছে, জীবনকে বুঝতে চেয়েছে। জীবনের বহুমাত্রিক ছলাকলাকে সে বীক্ষণে ধরতে চেয়েছে। ওই যে কবি বাক্য—‘সব ভালোবাসা যার বোঝা হল—দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে’। সে হয়ে ওঠে অপরাজিত নায়ক। বলা ভালো লেখকের মননজাত দর্শনের সার্থক প্রয়োগকারী। অবচেতন, অবদমনের অন্ধকার নিকেতেনে দেবজ্যোতি রায় প্রবেশ করতে চেয়েছেন। জীবনের ছিন্নভিন্ন অন্ধকার ভেদ করে, অদৃশ্য জালে ছুরি চালিয়ে দেখাতে চান জীবনের নগ্ন বাস্তবতা। সেই বয়ানে কৃত্রিম সভ্যতাকে বারবার আঘাত করতে হয়েছে। ভাষার অঙ্গ হিসেবে সাধু-চলিত, খিস্তিখেউড় ভেসে এসেছে। গদ্যে আছে একটা চলমানতা। দেবজ্যোতি রায়ের আখ্যানে নানা তাত্ত্বিক পরিসর, শ্রেণিতত্ত্ব থাকলেও তা গদ্য বীক্ষণে সদা চলমান। যা একজন বলিষ্ঠ লেখকের আত্মসত্তা জাহির করবার প্রধান হাতিয়ার।
সেক্স ভায়োলেন্স, যৌন রাজনীতি, ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব, নারীকে কেন্দ্র করে পুরুষের প্রতাপের আধিপত্যের বয়ানে তিনি বারবার পৌঁছতে চেয়েছেন। কেন এত ধর্ষণ? কেন এত আড়ালে যৌনতা? অবদমনের রিপু কোন সত্য খুঁজতে চায়। প্রতাপ, ক্ষমতার নজরানা অবদমনকে কীভাবে উপভোগ করায়। সর্বত্রই ক্ষতির স্বীকার হতে হয় নারীকে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুরুষের প্রতাপের কাছে পরাজিত হতে হয়। সেক্স ভায়োলেন্সকে সামনে রেখে তিনি বারবার পৌঁছতে চেয়েছেন ক্ষমতার তত্ত্বে। ক্ষমতার বারান্দা, রাষ্ট্রের উর্দীধারী পুলিশ কীভাবে নিজের চাহিদা মেটানোর নিমিত্তে নারীকে ব্যবহার করে। ‘একটি কাল্পনিক নির্মাণ অথবা গল্পে গরুরা যেমত গাছে চরে’ আখ্যানের গদ্যভঙ্গিটি জরুরি। তিনি তো সর্বদা গদ্য নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন। পোশাক যেমন দেহের গঠন অনুসারে, আঙ্গিক অনুসারে সাযুজ্য লাভ করে তেমনি গদ্যও। এক ধরতাই দিয়ে সব আখ্যান চলতে দিতে নারাজ দেবজ্যোতি রায়। বাক্যের অসমাপ্ত ভঙ্গি দ্বারা জীবনের খণ্ড মুহূর্তকে তিনি ব্যক্ত করেছেন। আখ্যানে দেখা যাবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নামক পুলিশ অফিসার আত্মহত্যা করেছে। থানায় যে বিপ্লবী নারীদের একের এক ধর্ষণ করেছে সেই বিছানায় স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংগমে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতাই কি আত্মহত্যার কারণ? না মনস্তত্ত্বে খান কয়েক ধর্ষিত নারীর ক্রমাগত এগিয়ে আসার ভুলভুলাইয়া। সে যাই হোক লেখক আসলে পৌঁছতে চান যৌনতা নিয়ে এক গভীর বীক্ষণে। ধর্ষণ, খুনের রাজনীতি, যৌনতার ছলাকলা, উত্তেজনা ও মানসিক অবস্থান মিলিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় উর্দিধারীদের জঘন্য পাশবিক অত্যাচারের বয়ানকে যেমন ব্যক্ত করেন তেমনি ধর্ষণকে সামনে রেখে দোদর্ণ্ডপ্রতাপের আড়ালে পুরুষের আধিপত্য, দ্বিধা, সামর্থহীনের হতাশা থেকে আরেক সত্যে পৌঁছে যান। এই পৌঁছে যাওয়া কিন্তু মরবিড নয়, জীবনের অভ্যন্তরে টর্চ লাইট জ্বেলে জ্বেলে জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে দেখা।
প্রান্তিক মানুষের জীবনযুদ্ধ নিয়ে তিনি বারবার আখ্যান সাজিয়েছেন। সেখানে মৃত্যুর বিচিত্র প্রকরণ এনে বহির্জীবন, অন্তর্জীবনের অন্তর্লীন রহস্যকে জানান দেন। সেই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রাজনীতি, প্রশাসন, নিয়মতান্ত্রিক পরিসর, যৌনতার ইউটোপিয়া। যৌনতা নিয়ে ট্যাবু যেমন ব্যক্ত হয় তেমনি নারীর শরীরকে সামনে রেখে ভোক্তা-উপভোক্তার দ্বন্দ্ব ভাষিত হয়ে চলে। ঘরে-বাইরে যৌনতার রকমফের, নারী-পুরুষের কামনা, পুরুষের পেশিশক্তির ঠাট-ঠমক, অন্ধকার জীবনের অঙ্গ হিসেবে খিস্তির ধারাপাত মিলে তিনি পৌঁছে যেতে চান জীবনের গভীর খনন খাদে। তিনি ক্রমাগত জীবনকে তন্নতন্ন করে বিলিখন করে দেখতে চান। সেই গাঁইতি প্রক্রিয়ায় সেক্স, সন্ত্রাস, প্রতাপের চিত্রনাট্য সংযুক্ত থাকে। ‘হাওয়া থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে’ আখ্যানের পরিসর প্রচলিত বাস্তবের রাজনীতির অমাবস্যা। গোরুর দুধে সোনা বা গোরুর মূত্র সেবন থেকে লকডাউনকে সামনে রেখে শ্রমিক দুর্দাশার বয়ান। সেই সময় পরিসর স্থানিক বৃত্তে ঘোষের জীবনযুদ্ধকে সামনে রেখে যে উড়ান তিনি দেন সেটাই জরুরি। দেবজ্যোতি রায় এক গল্পের বয়ান থেকে অন্য গল্পে গিয়ে নিজেকে পুরোটা বদলে ফেলেন। কী লিখবেন, কেমন করে লিখবেন এবং সেই পরিসরের ভাষা কী হবে সব নিয়ে তিনি বিচিত্র বোধে উপনীত হন। এইসব আঙ্গিক, ভাষা, বীক্ষণ নিয়ে তাঁকে দিনের পর দিন ভাবতে হয় বলেই তাঁর লেখার পরিমাণ স্বল্প। সেই সঙ্গে অবলোকনকে তিনি যে মাত্রায় প্রয়োগ করেন তা মেধাবী মনন বলেই মনে হয়। প্রচলিত বাস্তব আর বয়ানের বাস্তব নিয়ে তিনি যেখানে পৌঁছতে চান তা বীক্ষণের পরিসর। সেখানে শিল্প আছে কি নেই সেটা জরুরি নয়, সেখানে তিনি একটা টেক্সট গড়ে তোলেন। সেখান থেকে দেখান এই আমার সময়, এই আমার সময়ের ছলাকলা। আর সেই রঙ্গভঙ্গকে এইভাবে দেখানো যেতে পারে। তা কিন্তু কোনোভাবেই অতিলৌকিক বা মরবিড নয়। বাস্তবকে সমনে রেখে, বাস্তবের উপর হাতুড়ি পিটিয়ে তিনি দেখান জীবনের অন্ধকার এখানে কত প্রক্রিয়ায় বিরজমান। হে পাঠক, তবে কি দেবজ্যোতি রায়কে অন্ধকারের শিল্পী বলবেন? আপনি যাই বলুন তিনি রোমান্টিকতার সমূল উৎপাটন করে গায়ে গতরের ভাষায় সংগঠিত অপরাধের নামাবলি এবং পরিসরের সঙ্গে বদলে যাওয়া যৌনতার রকমফের চিত্রশিল্পী।
‘বলদের যোনি’ নামক দীর্ঘ আখ্যানে তিনি চিরকালীন মানুষের জীবনযাত্রার টেক্সট গড়ে তুলেছেন। কালস্রোতে হারিয়ে যাওয়া মানুষ, মানুষের জীবন্ত মূর্তির বদলে ছায়ার পিণ্ড হয়ে বেঁচে থাকা মানুষ, ক্ষমতাতন্ত্রের যূপকাষ্টে বলি হওয়া মানুষ, খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের আড়ালে ভোক্তা-উপভোক্তার সম্পর্কজালে বিরজমান মানুষ, নিয়মতান্ত্রিক বেড়াজালে পিষ্ট মানুষের নিয়তিকে বীক্ষণে দেখেছেন। এও কি এক নিরুদ্দেশ হবার আখ্যান নয়? সিস্টেমের গোলকধাঁধা মানুষকে ক্রমেই বাতিল থেকে বাতিলতর করে দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনের মোহিনী মায়া, শ্রেণিচক্রের হরেকরকম সত্য, মানুষের স্বাভাবিক বেঁচেবর্তে থাকায় ধর্ম-রাজনীতির নানা ছলাকলা, টোপ মানুষকে ক্রমেই বিভ্রান্তির সত্যে নিয়ে যাচ্ছে। সময় পরিসরের নানামাত্রিক উপাদান, ব্যবসা সম্পর্কিত ধর্ম, ক্ষমতাতান্ত্রিক রাজনীতি মানুষকে বুঝতেই দিচ্ছে না প্রকৃত সত্য কোথায়? কেউ প্রকৃত সত্য খুঁজতে চাইলে হয় খতম করে দাও নয় পাগল বলে দাগিয়ে দাও। দেবজ্যোতি রায় সংগত কারণেই লিখতে বাধ্য হন—
“কিন্তু ভেতরে জীবন ও মৃত্যুর খেলাটা একই থেকে গেছে। সেই খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক, সে সম্পর্কের নানাবিধ জটিল বুনন, টানাপোড়েন। টেনশন, আতঙ্ক, আলো ও অন্ধকারের এই চিরকালীন খেলা, একটা বিশাল দাবার ছকের মধ্যে যেন আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আর সবাইকে নিয়ে খেলাটা খেলে যাচ্ছে অন্য কেউ। কে সেই খেলুড়ে? আস্তিক বলবে ঈশ্বর। নাস্তিক বলবে তোমাদের ঈশ্বর যদি থাকেও আসলে এক পাকা মাথার শয়তান এবং মানব জীবনের শুরু থেকে দু’দল আজও নিজেদের মধ্যে লড়ে যাচ্ছে। জীবন এবং মৃত্যু, এরাই সেই আসল খেলুড়ে, ছকের দু’ধারে বসে নিজেদেরকেই দান দিচ্ছে। কোনওপক্ষই সম্পূর্ণ জেতে না। একবার জীবন চাল দিচ্ছে তো পরেরবার মৃত্যু।” (তদেব, পৃ. ৭৮)
এই চিরকালীন সত্যকে খনন করতে তিনি শুরু করেছেন ইউরোপীয় চার্চ ও পেগানদের বিরোধিতার সম্পর্ক থেকে। সেখান থেকে গত শতকের সাতের আটের দশকে নায়কের পিতা থেকে বর্তমানে নায়কের জীবনচরিতে। প্রশ্ন উঠতে পারে বলদের যোনি কী? গ্রামীণ বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত মানুষের এই সত্য আর জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কী এই বলদের যোনি সন্ধান? গল্পের বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে তা একটি স্থানের নাম। আসলে লেখক আমাদের বিভ্রান্তির বাস্তবে নিয়ে যাচ্ছেন। যে বাস্তব মানুষকে ভুলভুলাইয়াতে হারিয়ে দেয়। সেই ইউরোপীয় চর্চা, যিশু, বুদ্ধের আমল থেকেই তো মিথ্যার দোসর গড়ে উঠছে। যৌনতার প্রকৃত সত্য মানুষ জানারই সুযোগ পেল না। যারা জানাতে চাইল তাদের সভ্যতা, রাষ্ট্র, ধর্ম, মধ্যবিত্ত ভেকধারী পরিমণ্ডল বাতিল করে দিল। মানুষ বেঁচে রইল বটে কিন্তু তা ছায়ার অংশ হিসেবে। পিতার নিখোঁজ হওয়া থেকে পুত্রের নিরুদ্দেশ হবার অভিপ্রায়, বদলে যাওয়া স্বপ্নের বিভ্রম, বিড়াল-ইঁদুর সংঘর্ষের রূপক, পৃথিবীর যাবতীয় সম্পর্ক যেন খাদ্য-খাদকের টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে লেখক পৌঁছে যান শাশ্বত সময়ের বয়ানে। স্থিরতা থেকে অস্থিরতা, অস্থিরতার কালবেলা থেকে দৈনন্দিন জীবনের ঘেরাটোপ, মানুষের একাকিত্ব, নৈরাশ্য, মানুষের অস্তিত্বনাশ, টেবিলের ওপারে আধিকারিকের সেয়ানাবাজি, এপারে উপভোক্তার নাজেহাল এবং ছায়ার পিণ্ড হয়ে বেঁচে থাকার রূপকের মধ্য দিয়ে আবহমানকালেরই চিত্র ব্যক্ত হয়ে চলে। এখন প্রশ্ন হল আবহমানকালের চিত্রনাট্য নিয়ে বহুগল্প তো লেখা হল দেবজ্যোতি রায় আবার কেন লিখতে গেলেন। আগেই বলা হয়েছে তিনি একটা দর্শনে পৌঁছতে চান। সেই ফলিত দর্শনকে তিনি প্রয়োগ করেন আখ্যানে। এই পরিত্যাক্ত সময়ে নিজস্ব অস্থিমজ্জা বিসর্জন দিতে বাধ্য হওয়া মানুষ, নিজস্ব জল পুষ্টি বিচ্যুত সিস্টেমের-সমাজের-সংস্কৃতির অংশ হয়ে বেঁচে থাকা মানুষ চিন্তা চেতনায় স্বাধীন না কেবলই নিয়মের দাস? এই যে নিয়মের দাস, সমাজ সম্পর্কিত প্রচলিত প্রথা মেনে চলা, সমস্ত কিছুকে বিনা বিচারে গ্রাহ্য করা অথবা বিচার করার মস্তিষ্ক বিদ্যাটাই লোপ পাওয়া, সেই ভেকতন্ত্রের পর্ব-পর্বান্তরের খোলস তিনি উন্মুক্ত করতে চেয়েছেন।
মিথের বাস্তব, মিথের মধ্যে চিরুনি তল্লাশি, মিথের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা জীবনের জৈবিক প্রবণতা, পুরাণকে কেন্দ্র করে বানানো গল্প থেকে হাংরি আন্দোলন হয়ে রাষ্ট্রের দমন পীড়নের সত্যে অবতীর্ণ হয়েছেন ‘দ্রৌপদী এবং মোগলাই পরোটা’ গল্পে। পুরাণের কাহিনির মধ্যে মানুষ ঐশ্বরিক মহিমা, ন্যায়নীতির পরম্পরা, ধর্ম, অলৌকিক মহিমার বীজ খুঁজতে অগ্রসর হলেও যৌনতার বিষয়টি খুঁজে দেখেনি। বিজ্ঞান অনুসারে আমরা জানি যৌনতা শুধু জীবনের আদিম প্রবৃত্তি নয় তা জীবনের অনিবার্য অংশ। অথচ দেবদেবীর মহিমায় আমরা সেই সত্য খুঁজে দেখিনি। এই মধ্যবিত্ত কাল্টকে যারা ভাঙতে একদিন অগ্রসর হয়েছিল তাদেরও বরেণ্য সাহিত্যিকরা সুনজরে দেখেনি। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রের গোপন আঘাতে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আর্য-অনার্য, ক্ষমতার কায়দাবাজি, নারীকে ভোগের পরম্পরা অথচ অস্বীকারের মধ্য দিয়ে যে শ্রেণিচ্যুত সমাজের নানা গোপন রহস্য উদ্ঘাটন গল্পের শরীরে ঝুলে থাকে। আগেই বলা হয়েছে তিনি গল্প লেখেন না। সেজন্য ‘বলদের যোনি এবং অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের প্রচ্ছদেই ঘোষণা করে লিখতে হয়েছে ‘গল্প নয়’। প্রচলিত গল্পের ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যেমন ‘না’ গল্পের দিকে যাত্রা করেন তেমনি পাঠককে দেখান এভাবেও গল্প গড়ে তোলা সম্ভব। আধুনিকতার পর্ব-পর্বান্তরে, বাঁকবদলের যে নানান বীক্ষণ সেখানে দেবজ্যোতি রায়রা একটা স্বতন্ত্র অভিঘাত হিসেবেই চিহ্নিত হবেন। যদিও এই অভিঘাত সুবিমলমিশ্র থেকে রমানাথ রায়, সুভাষ ঘোষ থেকে মলয় রায়চৌধুরী, সুব্রত সেন থেকে অজিত রায়, উদয়ন ঘোষ থেকে রবীন্দ্র গুহরা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে এসেছেন। দেবজ্যোতি রায় তাঁদেরই সম্পূরক।
দেবজ্যোতি রায় বারবার বিভ্রান্তির বাস্তবে এগিয়ে গেছেন। প্রশ্ন হতে পারে কেন এই প্রমোহ বাস্তব। সময়টাই কি ভ্রান্তিজালে আবদ্ধ নয়? রাষ্ট্রের নানাবিধ নিয়ম, সামাজিক গোণ্ডি মানুষকে কি সুস্থভাবে বাঁচতে দিচ্ছে? মানুষের স্বাধীন জীবনচেতনা, মৌলিক অধিকার বা জীবনবোধ বিকাশের সঠিক পরিসর কোথায়? সিস্টেমের অংশ হয়ে কেউ মানিয়ে নেয়, যারা মানিয়ে নিতে পারে না হয় বিদ্রোহ করে নয় আত্মদংশনে এক ভুল বাস্তবে এগিয়ে যায়। সেই সঙ্গে আছে রাষ্ট্রের নানাবিধ হুকুমজারি, নিয়মতন্ত্রের নামে মানুষের উপর অত্যাচার। ‘রাষ্ট্রের খোঁজে যেভাবে জনৈক’ আখ্যানে পাগলের অন্যের পিষ্টদেশ দেখার আয়োজনের বয়ানের মধ্য দিয়ে আইন ব্যবস্থার কুনজর বা সিস্টেমের গায়ে থাপ্পড়ই নয় ‘অপর’ ভুবনের আমরা যে কতকিছুই জানি না সেই রসদ বের করে আনেন। নাগরিক মনন নিজের রুচি, সংস্কৃতি, বোধ বিবেক অনুসারে একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে নেয়। ভাবে এটাই সর্বজনীন। এর বাইরের বৃত্তের মানুষের যে ভিন্ন ভাষা, রুচি, সংস্কৃতি থাকে তা সে মানে না। শুধু না মানাই নয় অশ্লীল, দূষিত বলে বাতিল করে দিতে চায়। ক্ষয়িষ্ণু নশ্বর প্রজন্মের আঁতেল মননচেতনাকেই যেন তিনি ব্যঙ্গের তীর নিক্ষেপ করতে চেয়েছেন। তেমনি তিনি বারবার জীবনের তত্ত্বে পৌঁছতে চান। যৌনতা, রাজনীতির ফাঁক-ফোকর, মধ্যবিত্তের ভণ্ডামি, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শর্ত, প্রেম-বিদ্রোহের ছালাকলায় সংকট কোথায়। মানুষ এক সত্য থেকে আরেক সত্যে কোন শর্তে, লোভে এগিয়ে যায়। মানুষ কেন নষ্ট বিবেকের অংশ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র কোন অছিলায়, কোন গোপন ইন্ধনে জনজীবনের শ্রেণিচিত্রকে ধ্বংস করতে চায়। ‘রিজাউলের সঙ্গে হঠাৎ’ আখ্যান থেকে একটা বয়ান তুলে ধরা যাক—
“বিপ্লবীর মগজেও থাকে একটা রাষ্ট্রের মানচিত্র।–আজকের বিপ্লবী আগামীদিনের শাসক।
আমি এখনো নিজেকে বিদ্রোহী ভাবি। বিপ্লবী আর বিদ্রোহী এক নয়। বিপ্লবীর মগজে একটা রাষ্ট্রের মানচিত্র থাকে। যে আগুন জ্বলে ওঠে ফের নিভে যায়। পড়ে থাকে কিছু ছাই। পুরনো দিনের বিপ্লব এখন ইতিহাসের সংগ্রহশালায়। বিদ্রোহী যে সবসময়ই বিদ্রোহী। তার মগজে কোনো রাষ্ট্রের মানচিত্র থাকে না। (তদেব, পৃ. ৯৫)
এই হল বিপ্লবী আর বিদ্রোহীর ফারাক। গল্পে রিজাউল আর সুকুমার দুটি চরিত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় নতুন দিন আনার স্বপ্নে দু’জন ঘর ছেড়েছিলেন। এমনকি পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিল রিজাউল আর সুকুমার পালিয়ে গিয়েছিল। আজ সুকুমার নামি অধ্যাপক এমনকি শাসকদলের কর্তাবাবুও। আর রিজাউল আজও বিদ্রোহী থেকে গেছে। কালে কালে পৃথিবীর ছদ্ম আবরণে পরিবর্তন ঘটেছে। বিপ্লবের স্বপ্নে মশগুল হয়ে নানা ফতেয়া জারি হয়েছে। কিন্তু পুঁজি ও বিশ্বায়নের দাপটে আরও সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠেছে। বিপ্লবের বদলে আজ প্রয়োজন ব্যক্তির বিদ্রোহী হয়ে ওঠা। বিদ্রোহী সত্তাই রাষ্ট্রকে আঘাত করার পক্ষে উপযুক্ত পরিসর।
(২)
‘নষ্ট আত্মার নোটবই’ আখ্যান প্রকৃতপক্ষে নীলকণ্ঠে ডায়েরি। যদিও এই নামে দেবজ্যোতি রায়ের একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল। এই ডায়েরি আসলে সমাজ সভ্যতার দলিল। ব্যক্তি মনের আয়না দ্বারা রাষ্ট্র, শ্রেণিব্যবস্থা, শ্লীলতা-অশ্লীলতার দ্বন্দ্ব, অন্ধকারের চিত্রনাট্য, ব্যক্তির ক্ষোভ, বিদ্রোহের লড়াই। ভদ্র বাঙালি, মেকি বাঙালির মিথ্যা মোহিনীমায়ার বুকে তিনি লাঙল চালিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেখান এই হল প্রকৃত সত্য, আর এই সত্য নিয়ে তুমি বেঁচে আছো। প্রকৃত সত্য ও ভদ্র বাঙালির বাঁচার প্রক্রিয়ায় নির্মিত সত্যের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। সেই ব্যবধানকেই তিনি চিত্রিত করতে চান। ফলে বারবার রাষ্ট্র, সিস্টেম, মধ্যবিত্ত মনন, প্রচলিত পরিসরের বিরুদ্ধে আঘাত আনতে হয়। ‘রিজাউলের সঙ্গে হঠাৎ’ আখ্যানের রিজাউল নিজেকে বলেছিল ‘বিদ্রোহী’। নীলকণ্ঠ ব্যবহার করেছে ‘অন্তর্ঘাত’ শব্দ। প্রকৃতপক্ষে একই জেহাদ। দেবজ্যোতি রায় আসলে একটি ক্রুদ্ধ গদ্য লিখতে চেয়েছেন। মিনমিনে, খুকুমনির ভাষা ও শিশুপাঠ্য বয়ানে এই পচনশীল সভ্যতাকে ধরা যাবে না। তা ধরলে তা হবে মিথ্যা, প্রবঞ্চনা। সভ্যতার বিপরীত পিঠে যে নগ্ন বাস্তবতা, অন্ধকার, মানুষের সৎ-সত্য জীবনচেতনা তাই তিনি ব্যক্ত করে তোলেন। তিনি চরিত্রকে সাজিয়ে গুছিয়ে পুতুলনাচের পুতুল বানাতে চান না। তাঁর চরিত্ররা বিদ্রোহী। অন্তর্ঘাতকে মেনে নেয়। অন্তত খিস্তি দ্বারা নিজের ব্যক্তিগত ক্রোধ, প্রতিবাদ জাহির করে। ব্যর্থ, পরাজিত, ক্ষমতাহীন মানুষের খিস্তি ছাড়া তো প্রতিবাদের বয়ান নেই। সে জানে এই খিস্তি দ্বারা সমাজ সভ্যতার কিছুই বদলাবে না। তবুও তারা সত্যদ্রষ্টা। তারা দেখাতে চান সভ্যতার প্রকৃত অবস্থা এমন। নীলকণ্ঠের যে ডায়েরি সেখানে সমাজ, সাহিত্য, দর্শন, সমাজ, মধ্যবিত্ত মননকে আঘাত, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিপ্লবের ব্যর্থ প্রয়াস, হতাশা-ক্লেদ, যৌনতার ট্যাবু, বাঙালির ভোগবাদ সব আছে। সেটি হয়ে উঠেছে সভ্যতার দলিল। গল্পকথক প্রথমে ভেবেছিলেন তা ফেলে দেবেন। কিন্তু সম্পূর্ণ পাঠ করে মনে হয়েছে এটা কি ব্যক্তি মনের আয়না না নিজেরই আত্মদর্শনের প্রতিলিপি। দেবজ্যোতি রায় আমাদের বারবার নিয়ে যান আক্রমণের ভাষায় আক্রান্ত সভ্যতার নষ্ট আত্মার কাছে। এই সভ্যতাকে ব্যক্তি কীভাবে বদলাবে? বয়ানে ভেসে আসে—
“সেখানেই থেকে যাব আমরণ এই স্বপ্নটা নিয়ে যে এই ছাগলচোদা সভ্যতার দেহে কোথাও আমি ঢুকে যাচ্ছি একটা তীক্ষ্ণ ছুরির মতো, যাকে তুলে আনবার ক্ষমতা এই পচে যাওয়া সভ্যতার নেই। এজন্যে কোনো পুলিশ খুন, সরকারি বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া, সংসদ বা বিধানসভা ভবনগুলোতে পতাকা উড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মতো, অকার্যকারী, পুনরাবৃত্তিমূলক, বিরক্তিকর, বোকা বোকা কাজ করবার দরকার নেই। দরকার নেই দল পাকাবার। শুধু নিজেকেই একটা তীক্ষ্ণ ছুরির উজ্জ্বলতা ও কাঠিন্যে রূপান্তরিত করে সভ্যতার দেহে ঢুকিয়ে দেওয়া ছাড়া।” (গদ্য সংগ্রহ-১, শহরতলি, প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল ২০২৩, পৃ. ৪৮-৪৯)
ব্যক্তি এইভাবে অন্তর্ঘাত গড়ে তুলবে। এইভাবে নিজেকে কার্যকারী করে তুলবে। একক ব্যক্তির পক্ষে সভ্যতার বদল সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যক্তি উকুনের মতো সভ্যতার দেহে ঢুকে অন্তর্ঘাত চালাবে। ঈশ্বরের সন্তান মানুষকে দেখাবে নক্ষত্রের নিচে এই হল তোমার প্রকৃত অবস্থান। তুমি মিছেই ভেকধারী সাজতে যাচ্ছ। সেখানে আঘাত আসবে তবুও চরিত্র অটল থাকবে নিজস্ব দর্শনে। সেজন্য চাই জীবনচর্চা ও ক্লাসিক সাহিত্যপাঠ। যা নীলকণ্ঠ সেই যুবক বয়সেই হাতিয়ার করেছিল। নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠে লেখকের মানস সন্তান, জীবনদর্শনের দ্রষ্টা।
দেবজ্যোতি রায় পাপ-পুণ্যের আপাতত মানদণ্ডকে ভাঙতে চেয়েছেন। অবৈধ যৌনতায় কোনো পাপ নেই। যা মানুষের আকাঙ্ক্ষা, যা মানুষের অন্তরের পিপাসা তা ঢেকে রাখাই যেন পাপ। সভ্যতার দোহাই দিয়ে, সমাজের বন্ধনে আটকে গিয়ে যৌনতার অবদমনই যেন পাপ। তা দেহের ধর্ম। সেখানে বয়স, জাতি, ধর্মের কোনো ভেদ নেই। ‘অনিশ্চিতের দিকে’ আখ্যানে কাকীমা সামাজিক ইউটোপিয়াকে ভেঙে হাসতে হাসতে সমাজচ্যুত হয়েছিল। তাঁর আখ্যানের মূল দ্বন্দ্ব হল ব্যক্তি সামাজিক পঙ্কিল পরিসরকে ভেঙে নতুন দিনের সূত্রপাত করতে যাচ্ছে, অথচ তা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে গোষ্ঠীমানস দ্বারা। একা ব্যক্তির পক্ষে লড়াই সম্ভব হচ্ছে না। ব্যর্থ হয়ে খিস্তি দিচ্ছে। তবে সামাজিক বিন্যাসে একটা আঘাত হানছে। অবদমিত যৌনতার ফলেই যেন ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ঘটে যাচ্ছে নানা যৌন অপরাধ। মধ্যবিত্ত সমাজ বিবাহ নামক উৎসব দ্বারা যৌনতার ছাড়পত্র দেয়। অথচ ব্যক্তি ভিতরে ভিতরে নিজের যৌন আকাঙ্ক্ষা নানাভাবে, নানা কায়দায় জানান দেয়। অবদমিত অবদমনের ফলে সে সমস্ত সম্পর্ককে অতিক্রম করে যৌন পিপাসা খোঁজে। বা নারী দেখলেই চোখের যৌন খিদে মিটিয়ে নেয়। তেমনি দাম্পত্যের নামে এক বন্ধন গড়ে তুলে যৌনতাকেও যেন আটকে দেওয়া হয়। কেউ কেউ সেই বন্ধন অতিক্রম করে স্বাধীন যৌন জীবনে মেতে থাকে। মানা-না মানার প্রক্রিয়ায়, আকাঙ্ক্ষা-অনাকাঙ্ক্ষার সমীকরণে দাম্পত্য সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে যায়। বয়ানে ভেসে আসে—
“যৌনতাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে পৃথিবীর কোনো সুমহান তত্ত্বই তার ঈপ্সিতকে আয়ত্তে আনতে পারে নি আজও শুধু বিকৃতিকে সিংহাসনটি ছেড়ে দেয়া ছাড়া! ওটা এমনই এক জীবনীশক্তি, উহা শুধুই রতিক্রিয়া ইহরূপ কে বলিল উহাতে একটি কলা আছে জানিও, যা সেকেন্ড মিনিট ঘণ্টাকে অনন্ত করিয়া তোলে করিয়া তোলে সমগ্র জীবনব্যাপী ও যা মানুষকে মুক্ত স্বাধীন ও সৃষ্টিশীল রাখে যেমন তেমনি সোজা পথ না পেলে মানুষকে চুবিয়ে মারে বিকৃতির বাঁকা অজস্র নোংরা নালায় আমারা বোকাচোদা বনে রই, আর এগোতে থাকি আত্মধ্বংসের দিকে ক্রমাগত এক অন্ধের মতো!” (তদেব, পৃ. ৫৫)
ব্যক্তির সম্পর্কসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়, সে খোঁজে অন্য স্বাদ, অন্য সম্পর্ক। স্বাদে-আহ্লাদে, তৃপ্তিতে ঢুকে যায় অন্য গহ্বরে। যৌনতা নিয়ে মধ্যবিত্ত ট্যাবুকে তিনি ভাঙতে চেয়েছেন। তিনি দেখাতে চান প্রকৃত সত্য কোথায়। কিন্তু আমাদের এই ভেকধারী, মিথ্যা মায়ায় ডুবে থাকা সমাজে সামাজিক গ্লানির ভয়ে মানুষ সেই সত্য থেকে পিছিয়ে থাকে। একজন চিন্তক হিসেবে তিনি জানেন অন্ধকারের সত্য, অবদমনের অন্ধকারকে প্রতিষ্ঠা করাই লেখকের কাজ।
বাংলা গল্প বৃত্তের প্রথাগত স্কুলের মাস্টার নন দেবজ্যোতি রায়। তিনি রুটিন ভাঙা কারিগর। তাই পঞ্চাশ শব্দের টেক্সটকে (‘একটা বোকা লোক ঘরে ফিরছে’) যেমন গল্প হিসেবে চিহ্নিত করেন তেমনি ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’ এর মতো বৃহৎ টেক্সটও গল্প হিসেবেই চিহ্নিত হয়। তবে এইসব উপমালায় (গল্প, বড়গল্প, অনুগল্প, নভলেট, উপন্যাস) তিনি আখ্যানকে সাজাতে চাননি। তিনি একটা দর্শনে পৌঁছতে চান। তা হয়ে ওঠে ভাষাবিদ্যার স্কুল। যতক্ষণ না সেই ধারণায় পাঠককে পৌঁছে দিতে পারছেন ততক্ষণ চলে টেক্সটের পাঠক্রম।