এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  বই পছন্দসই

  • অসুখবেলার পাণ্ডুলিপি

    পুরুষোত্তম সিংহ
    পড়াবই | বই পছন্দসই | ১৫ অক্টোবর ২০২৩ | ৭৩৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)

  • অমর মিত্র আমার কালের সেই শিল্পী যিনি সঠিক পর্যবেক্ষণে সময়ের নথিনক্ষত্রকে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন গত চার দশকের বেশি সময় পর্ব ধরে। ভয়ানক বয়ান বা ক্ষমতাকে সরাসরি অ্যাটাক না করেও আখ্যানের তলদেশ দিয়ে ক্ষমতার নজরানাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শিল্পের নিশান উড়িয়েছেন। অশুভবোধ থেকে শুভবোধে, অমঙ্গলচেতনার রাহাজানি থেকে মঙ্গলচেতনা, মানব মৈত্রীর মেলবন্ধন গড়ে তুলতেই তিনি কলম নিয়ে বসে থাকেন। সময়ের মানুষ হিসেবে বিপন্ন বিস্ময়কে চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে এক অপার সহানুভূতিবোধ যেমন সঞ্চার করেন তেমনি ক্ষমতা-পুঁজিবাদ-শোষণের অলিগলি দিয়ে ঘুরে সভ্যতার ভুল কোথায় তাই চিহ্নিত করে চলেন। সেই বয়ানে ফ্যান্টাসি, ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা, মায়াবাস্তবতা, লোকায়ত পরিসর লুকিয়ে থাকে। রুদ্ধশ্বাস সময়কে তিনি সরাসরি চিহ্নিত না করে একটু ভিন্ন বলয়ে চিহ্নিত করতে চান। এটাই তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য ও আখ্যান উপস্থাপনের স্বধর্ম।

            হিস্টোরিক্যাল এপিসোড, ইতিহাসের ক্ষত, সময়ের নথিনক্ষত্র ও বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাত দিয়ে দ্বন্দ্বমুখর বিন্যাসে ‘র‍্যাডক্লিফ লাইন’ (২০২৩) আখ্যানের যাত্রা শুরু হয়েছে। সাধের মুসলিম লিগ, জিন্নার স্বপ্নভঙ্গ, কেবল মুসলিম আইডেন্টিটি দিয়ে প্রান্তিক মানুষকে বোঝার অবকাশ, হেলে চাষার কাছে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেয়ে অনেক বড় আব্বাসউদ্দিনের গান। বাস্তবের ঘূর্ণিতে কালচারাল মুভমেন্টের খতিয়ান এই আখ্যান। করোনা, প্রমোটার, বাজার চলতি সাহিত্য, লিটল ম্যাগাজিনের কূপকমণ্ডূকতা, সাহিত্যের নামে বস্তাপচা ভুসিমালের রমরমা, অর্থ-খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার নামে সম্পাদক, প্রকাশক, রিভিউকারী মিথ্যা ভিত্তিহীন লেখককে প্রমোট করার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের দূষিত সমাজের ভাষ্য জানান দেন বিমল। বাঙালির ইতিহাস বহুক্ষেত্রে মিথ্যার ইতিহাস, বহু বাঙালি আত্মজীবনীতে ঢের বেশি মিথ্যা কথা বলেন যা সময়কে উদ্বিগ্ন করে সেই অকথিত সত্য লেখক বের করে দেন। সাহিত্য করা, সাহিত্য লেখা আর সাহিত্যিক হয়ে ওঠা বুঝি এক নয়। ক্ষমতার অন্দরমহলে থেকে সমস্ত রকম ক্ষমতা ব্যবহার করে, প্রয়োজনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, ব্যক্তি জীবন-কর্মজীবনে পুরোপুরি অসৎ হয়ে কেউ সাহিত্যে বানিয়ে তোলা দেশপ্রেম, মানবতা আদর্শের কথা শোনাতে চান। এই পন্থার টুটি টিপে লেখক দেখান আমাদের বাংলা বাজারের অবস্থান। সহ-লেখক, সহ-প্রকাশক, সহ-সম্পাদক বহু ক্ষেত্রেই ভালো লেখাকে প্রমোট করে না। যা প্রমোট করে মুনাফা হবে তাই করে। সাহিত্যের সঙ্গে যেদিন মুনাফার যোগ হল, গাড়ি-বাড়ির যোগ হল, সরকারি খেতাবের যোগ হল সেদিন থেকে সাহিত্য মাঠে মারা গেল। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিসরের দূষণের মাত্রা কত ক্লেদময় লেখক সেদিকে যাত্রা করেন।

            শ্রীমিত্র উপরতল দিয়ে একটা কাহিনি বলেন বটে কিন্তু ভিতর দিয়ে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহমান সংবাদ রেখে যান। ক্রমাগত পরিসরের বদল ঘটছে, আধুনিকতার নামে ঐতিহ্য বিপন্ন হচ্ছে। একটা জাতি নিজেকে আল্টা মডার্ন করতে গিয়ে নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিচ্ছে। কেউ তা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলেও সিস্টেম, সামাজিক রীতির কাছে পরাজিত হচ্ছে। বাড়ির নাম ‘আঁখি মঞ্জিল’ যার পিছনে একটা ইতিহাস ছিল, ইতিহাসের ক্ষত ছিল তা ফ্ল্যাট কালচারের নামে মুছে যাচ্ছে। সেই ক্ষতকে রোধ করতে ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা প্রয়োগ করতে হয়। ক্ষমতার উচ্চনিকেতনে থাকা মানুষ, প্রতিষ্ঠার উচ্চ সোপানে থাকা মানুষ ঐন্দ্রজালিক বিদ্যায় ভয় পাবে। এই হল আমাদের মেকিমারা বাস্তবের আধুনিকতা।

           কোভিড, বিধ্বংসী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বইপাড়ার বিবরণ ‘মার্কো পোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ২০২০’ আখ্যানে এসেছিল। বাঙালি যত আধুনিক হল, যত অর্থবান হল, বিনোদনের নানা উপকরণ পেতেই বই ত্যাগ করল। মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতিপ্রবণ মানুষ কেউ কেউ বইকে আঁকড়েই বাঁচতে চাইল, স্বপ্ন দেখল। বাড়ি গাড়ি ভোগবাদের আতিশয্য বিসর্জন দিয়ে কেউ বাইরে মত্ত হল। ভোগবাদে ভেসে যাওয়া, ক্ষমতার অন্দরমহলে থাকা মানুষ বইকে অবহেলা করতে শুরু করল। বিমলের প্রতি অখিলের মনোভাবের মধ্য দিয়ে লেখক কালের ধ্রুব সত্যের তরঙ্গমালা এঁকে চলেন। সভ্যতার সমস্তটা চলে যাচ্ছে ক্ষমতাবান মানুষের হাতে। সাধারণ মানুষের অস্তিত্বকে ভিত্তিহীন করে কোনরকম মূল্য না দিয়ে চলছে ক্ষমতার আধিপত্য প্রয়োগ। দিশাহীন সাধারণ মানুষ খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। সময়ের দোসর হয়ে লেখক কালবেলার কথকতাকে লিপিবদ্ধ করে চলেন। বাঙালির বই সংস্কৃতি, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা, বইকে আঁকড়ে জীবনসেতু অতিক্রমের ভাবনা ও ক্ষমতাবানের সব ধ্বংস করে দেবার দ্বন্দ্ব নিয়ে এই আখ্যান। যা প্রবলভাবে সময় সরণির গভীর ক্ষতকে চিহ্নিতকরণের বয়ান। বই সংস্কৃতির বিবর্তন এল কীভাবে, বাঙালির রুচিবোধ বদলে গেল কীভাবে সেই নিগূঢ় নিকেতনে পৌঁছে যান। এখন বাজারে থ্রিলার, হরর, সাসপেন্স, রহস্য উপন্যাসের রমরমা। বাঙালি অধঃপাতে যাবার যে ঘোর অমাবস্যা শুরু হয়েছে, তার একটি দিক লেখক পর্যবেক্ষণ করে চলেন।

           বাঁচার জন্য পড়া, পড়ার মধ্য দিয়ে বাঁচা, পড়ার মধ্য দিয়ে জগৎ-জীবন দেখা, সৌন্দর্য খোঁজা, পড়ানোর জন্য পড়া, প্রমোশনের জন্য পড়া নিয়ে নানা রকমফের বয়ান। বঙ্গীয় অধ্যাপকরা প্রমোশনের জন্য লেখে। প্রমোশন হয়ে গেলে বইপড়ার আর খোঁজ নেয় না। সাহিত্যের চলমান প্রক্রিয়ায় কী লেখা হচ্ছে, কোন পথে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য তা জানার প্রয়োজন বোধ করে না। কেউ সময় নেই দোহাই দিয়ে মুখ লুকোয়। অবসরের পর অন্য বিনোদনে মত্ত হয়। বই নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ের বদলে হয়ে ওঠে শখের, নিজেকে সংস্কৃতিবান বলে চিহ্নিতকরণের লোক দেখানো হাতিয়ার। সেই বিরোধাভাস বুনন করে চলেন লেখক।

           কোথায় অমর মিত্রের আত্মসাধনা? লেখা নামক মস্তিষ্কের চাষাবাদ দ্বারা তিনি কোথায় পৌঁছতে চান? মানবধর্মে, মুক্তমনা মানুষের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনে, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিশ্ব নির্মাণে। সেই নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্ভব নয় বলে একের পর এক লিখে যেতে হয়। সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক মানুষ, আত্মভোলা মানুষের সব কেড়ে নেওয়া হবে। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কোনো বক্তব্যই শুনবে না ভোগবাদের কর্তারা। সেখানে একলা দাঁড়িয়ে থাকে বিমল। তবে প্রতিবাদের কায়দা কানুন ভিন্ন। সেটাই আখ্যানের চলন। চারিদিকে আধিপত্যবাদ, ক্ষমতাধারী মানুষের রমরমা। আজকের স্বাধীন দেশে ক্ষমতাধারীদের একরকম শোষণ, ঔপনিবেশিক কালে আরেক রকম। মুসলিমরা কি সত্যি পৃথক দেশে চেয়েছিল? না আলি জিন্না পৃথক তত্ত্ব দ্বারা বিভেদের বীজ মাথায় বুনে দিয়েছিল। বাঙালি মুসলিমের কোনো কথা শোনা হয়নি। ওপার থেকে হিন্দু উচ্ছেদ হতেই এপারের মুসলিমের অবধারিত পরিণাম হয়েছিল দেশত্যাগ। উপনিষদের দেশ কীভাবে ধর্মের কবলে পরে খানখান হল। জিন্না, শোহরাওয়াদিরা কীভাবে মানুষকে ভুল বোঝাল। পর্বে পর্বে ওদেশে হিন্দু বিতাড়ন চলল। জগতের যেখানেই মুসলিম নিপীড়ন হলে তার অত্যাচার সহ্য করতে হয় বাংলাদেশের হিন্দুকে। অবধারিত পরিণাম ঘটে দেশ বিসর্জন। লুণ্ঠণকারী, ধান্দাবাজ মানুষ, ক্ষমতা লোলুপ মানুষ বসেই থাকে হিংসা, বিদ্বেষে মানুষকে উত্তেজিত করার জন্য। আতিকুজ্জামানের পরিবারের ভারত ত্যাগের শুধু মর্মস্পর্শী বিবরণ নয়, গভীর ক্ষতকে স্পর্শ করেন। পক্ষ-বিপক্ষ, লাভ-ক্ষতি, আধিপত্য, প্রকৃত স্বাধীনতার নামে কতবড় মন ভোলানো চক্রান্ত চলেছিল তার স্পর্শবিন্দুতে লেখক পৌঁছে যান। লোভ মানুষকে কোন নরককুণ্ডে নিয়ে যায়, দেশ নামক ধারণাকে বিসর্জন দিতে শেখায়, এক বিভ্রান্তির বাস্তবে মত্ত হতে শেখায় তার কার্যকারণ ও ইতিহাসের ধারাস্রোতের আলেখ্য আখ্যানকে ভিন্ন বয়ানে নিয়ে যায়। সুসংগঠিত দেশ, মহান ঐতিহ্য সম্পন্ন দেশে কীভাবে ভুল ধারণায়, মিথ্যা চক্রান্তে ভেঙে গেল, কোন মহামানবই তা রক্ষা করতে পারল না, ব্যর্থতা কোথায়, বিপরীত পক্ষের শক্তিই বা কোথায় সেই অসুস্থ উপসর্গ ধরে আখ্যান এগিয়ে চলে।

           পিতা আতিকুজ্জামানের সঙ্গে পুত্র আবদুর রবের বিরোধ দেশ নামক ধারণা নিয়ে। ফজলুল হকের লিগে যোগদান, মতাদর্শকে গুলিয়ে দিয়ে, অপব্যাখ্যা করে জিন্নার মুসলিম মস্তিষ্ক গ্রাস ও দেশের হৃদয়কে ছিন্ন করার জঘন্য চক্রান্ত ব্যক্ত হয়ে চলে। আতিকুজ্জামানের দেশ সম্পর্কিত ধারণা, স্বদেশচেতনা, স্বভূমিতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা আর আবদুর রব চায় পাকিস্তান হোক। পাকিস্তনে মুসলিমের স্বপ্নের সৌরভ বিকশিত হবে। দেশ নামক ধারণা নিয়ে পিতা-পুত্রের বিরোধ অমরভুবনে নতুন নয় তা আগেও ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ আখ্যানে এসেছে। ন্যারেটিভের ভিতর ইতিহাস, ইতিহাসের সত্য, বানিয়ে তোলা বিভ্রান্ত বয়ান ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি ফেলে আসা সময়ের উপর বীক্ষণ চালান। ফলে ন্যারেটিভ শুধু কাহিনি বা গল্প হয়ে থাকে না। গল্পের তলে ইতিহাসের বয়ান রেখে পৌঁছে যেতে চান প্রকৃত সত্যের কাছে। মানুষ নির্মিত সত্যের আড়ালে চাপা পড়া আরেক সত্যের বয়ান আছে, যা দেখার অভাবে, উদ্‌ঘাটনের অভাবে ইতিহাসের ধারাস্রোত ভিন্নমুখী। সেই সত্যের খোঁজ লেখকের অন্বিষ্ট। টেল রীতিতে ইতিহাসের সত্য বর্ণনা করে চলা অমর ভুবনের এক ন্যারেটিভ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৃদ্ধরাই সেই ন্যারেটিভে অংশ নিয়েছে (‘কাঁটাতার’, ‘ধুলোগ্রাম’, ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’)। অবশ্যই তা সামাজিক ইতিহাস। রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের সমান্তরাল স্রোতে যে আরও এক ইতিহাস আছে যা জীবনচরিত্রের ইতিহাস, প্রত্যক্ষদ্রষ্টার ইতিহাস, মৌখিক ইতিহাস ও ওরাল ট্রাডিশন। বড় ইতিহাসের পাশে ছোট ইতিহাস, জনজীবনের ইতিহাসকে তেমনভাবে দেখা হয়নি। লেখকের নজর সেদিকেই। আজ নানা প্রতিষ্ঠানে নানারকম গবেষণা হচ্ছে। ব্যক্তির স্মৃতিতে দেশভাগ, ডকুমেন্টারি কোলাজ, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান। বড় ইতিহাসের পাশে ছোট ইতিহাসও যে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ ঔপনিবেশিক বলয় নির্মাণে তা লেখক ব্যক্ত করে চলেন।

           সম্ভ্রান্ত পিতা, আদর্শবান, মূল্যবোধ ও দেশের মৈত্রী সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা সত্ত্বেও পুত্র বিপথে গেল কেন? কোন প্রতিরোধ, আদর্শ, মূল্যবোধ দ্বারা রক্ষা করা গেল না। প্রয়োজনে নিজের বোনকে হত্যা করল আবদুর রব। মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হল কীভাবে? পাকিস্তান ধারণা এমনভাবে মাথায় দূষিত বায়ু প্রবেশ করিয়ে দিল যা শুধু দংশনের জন্ম দিল। সেই ক্ষতের যন্ত্রণা দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হল। মানুষের উপর অত্যাচারের পৈশাচিক সত্য সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির ভয়ে চাপা দেওয়া হল। কিন্তু সত্যই তো জীবনের প্রেরণাদাতা। সেই সত্য অন্বেষণ লেখকের কাজ। অমর মিত্র সেই কাজটাই করে চলেছেন আখ্যানের ভিতর বলয় দিয়ে। দাঙ্গা কীভাবে সৃষ্টি হয়, দাঙ্গাবাজ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে কীভাবে দাঙ্গার ইন্ধন জোগায় তার গূঢ়ার্থ প্রদেশে যান। আবদুর রব হাঁটানো বোনকে লক্ষ্মী পূজার দিন হত্যা করে হিন্দুদের দোষারোপ করে দাঙ্গার সুযোগ খুঁজছিল। কিন্তু আদর্শবান পিতা আতিকুজ্জামান ও ভাই রহিমের তৎপরতায় তা হয়নি। এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানের ধর্ম ও তাত্ত্বিক পরিসরে এত বিভেদ বর্তমান, ক্ষমতার লড়াইয়ে এত জটিলতা বর্তমান যেকোন মুহূর্তে দাঙ্গা ঘটে যায়। যা আজও বর্তমান। লেখক ঘটনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দেখান যে দাঙ্গাবাজের কোনো ধর্ম নেই, কোনো দেশচেতনা নেই, কোনো মানবতা নেই।

           ভারত আত্মর পথিক আতিকুজ্জামান। আদর্শবাদী মূল্যবোধসম্পন্ন উদারচেতন ও যথার্থ মানবিক মানুষ। তবুও দেশ রক্ষা করতে পারলেন না। এই ভারতভূমি থেকে গান্ধী, জিন্নার জন্ম। আতিকুজ্জামানের আত্মজ আবদুর রব, আবদুর রহিম যেন গান্ধী-জিন্নার প্রতীক। এই ভারতভূমির দুই সন্তান দুই মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছে। বিভেদের বীজ ভারতভূমির অভ্যন্তর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। অশুভ শক্তি এই মেদিনী থেকেই জন্ম নিয়েছে। শুভশক্তি, কল্যাণচেতনা, মূল্যবোধ, ন্যায়পন্থা পরাজিত হয়েছে। দেশ ডুবে গেছে অন্ধকারে। সেই অন্ধকার ঘেঁটে সমস্যার সৃষ্টি কীভাবে সেই সত্যে লেখক পৌঁছেছেন। বাইরের খোলস র‍্যাডক্লিফ লাইন থাকলেও ভিতরে বাঙালি আত্মার খোঁজ। ভণ্ডামির প্রকরণ উন্মোচন। সিভিল সোসাইটি কীভাবে ভণ্ডামিতে ডুবে থাকে, যার মূল হাতিয়ার ধর্ম। সেই ধর্মকে নানামাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, বিভাজন, ক্ষমতার তত্ত্বে। সমস্ত পরিসরে ধর্মকে প্রয়োগ করে বাঙালির প্রকৃত আত্মা কীভাবে দূষিত হয়ে চলেছে দীর্ঘদিন যাবৎ সেই সত্য উন্মোচিত হয়ে চলে।

           বিদ্বেষের বীজ কোথায়, কোথায় সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা লুকিয়ে আছে, সিভিল সোসাইটি কোথায় ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করে, মুসলিমকে আপন ভাই বলে মেনে নিতে পারে না, সেই সংকটের সিংহমূলে লেখক পৌঁছে যান। ধর্মকে সামনে রেখে অস্তিত্বের সমস্যা, ব্যক্তির বিদ্বেষ কত প্রকার যা বিভেদের জন্ম দেয় নানা ক্ষেত্রে সেই রহস্য উন্মোচন করে চলেন। দেশভাগ হতেই হিন্দু মুসলমানকে আর আপন ভাই বলে মেনে নিতে পারল না। আগেও কি পেরেছিল? পূর্বের থেকে স্বাধীনতা উত্তর কালে সংকট আরও বৃদ্ধি পেল। খাদ্য সংস্কৃতি, পাশাপাশি অবস্থান, নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রবণতা, অন্যকে বিদ্রুপ ও নস্যাৎ করে দেবার তুঘলকি চিন্তা দেশের অভ্যন্তরে সংকটকে বৃদ্ধি করে। বাঙালি সংস্কৃতির গভীর খননে তিনি পৌঁছতে চান। বই, ফ্যান্টাসি, কিছু চরিত্রকে সামনে রেখে বাঙালির জীবনচরিত্রের নিত্য নৈমিত্তিক জ্যামিতির সাঁচ যা দ্বন্দ্বমূলক সেই পরিসর আখ্যানের কেন্দ্রভূমি।

           ছদ্ম ধর্মবিদ্বেষীর চাপানউতর, অন্যদিকে শিক্ষিত মানুষের জীবনচেতনা। বিবাদ ঘটতে বাধ্য। অ্যাপার্টমেন্টকে যেনতেন প্রকারে হিন্দু অবয়বে ঢেকে ফেলার প্রাণপন চেষ্টা, হিন্দু ধর্মের যাবতীয় ফরমান প্রচার দ্বারা অন্য ধর্মের মানুষকে নাস্তানাবুদের প্রবণতা কাউকে আঘাত করে। এ সমস্ত মানতে পারে না সুচরিতা। দ্বন্দ্ব ঘটে। কোভিডকে কেন্দ্র করে ত্রাহিত্রাহি রব, প্রাণহানির সংকট, তারমধ্যে ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রচলিত ধর্ম নিয়ে উৎসব। ধর্ম আগে না মানুষ আগে? মানুষের বাঁচার জন্য যে ধর্ম তাই আজ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র, প্রশাসন ভোটের দিকে তাকিয়ে সকলেই নির্বিকার। জনমতকে প্রাধান্য দেওয়ার নামে বৃহত্তর সংকট ঘনিয়ে এসেছিল। একজন দায়বদ্ধ লেখক হিসেবে সেই সময়ের নষ্টবিবেককে আখ্যানে তিনি ধরে রাখেন।

           ঘটমান বাস্তবের অন্ধকার, ইতিহাসের অন্ধকার নিয়ে আখ্যানের চলন। বাস্তব থেকে অতীতে, অতীত থেকে বর্তমানে পরিক্রমার মধ্য দিয়ে শাশ্বত সত্যের সন্ধান আখ্যানের স্বধর্ম হয়ে ওঠে। তবে পথ চলাটা আলগা ভাবে। পাঠককে ভয়ংকর অন্ধকারে বা মস্তিষ্কের প্রকোষ্ঠে চাপ সৃষ্টি করে নয়। ইতিহাসের এপিসোড, জনজীবনের বয়ান, চরিত্রের অভিপ্রায়, বাস্তবের সংস্কার, বিশ্বাস যা করোনাকে কেন্দ্র করে ভিত্তিহীন বৃত্ত নির্মাণ করেছিল সেই সত্যে আলো ফেলেন। কিন্তু সেখানেই আখ্যান স্তিমিত নয় পার্টিশনের সত্য, জনজীবনের রহস্য, কবিচরিত সব মিলিয়ে ঔপনিবেশিক পর্ব থেকে ঘটমান বাস্তবকে সময়ের দ্বিচক্র যানে স্পষ্ট করেন। এপারের আতিকুজ্জামান ওপারের সদাশিব ডাক্তার দুজনেই ভদ্র, অসাম্প্রদায়িক, উদার, মানবতাবদী ও বিভেদনীতিতে বিশ্বাসী নয়। তবুও দেশভাগ ঘটল কেন? সমস্যা কোথায়? আসলে দাঙ্গাবাজরা মানুষকে এমন উত্তেজিত করে তুলেছিল, বিধর্মীকে নাস্যাৎ করার চক্রান্তে মত্ত করেছিল ফলে কিছুই রোধ করা যায়নি। একদিকে ভোগবাদের আতিশয্য, চূড়ান্ত আধুনিকতার বিলাস, অন্যদিকে মনের মধ্যে সংস্কারের বাসা। করোনাকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন যখন ওষ্ঠাগতপ্রায়, মৃত্যু এসে যমে মানুষে টানাটানি করছে তখন অন্ধ সংস্কার, বিলাসের ঢালাও আয়োজনে মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করে তোলা হয়। দেশ এমনিতেই নানা পরিসরে ডুবে যাচ্ছে, ধর্মনীতি-মৌলবাদ সেখানে কুসংস্কারের ইন্ধন দিয়ে আরও ত্বরান্বিত করেছে। শিক্ষিত মানুষ প্রতিরোধ না করে হরর থ্রিলার ভৌতিক কাণ্ডকারখানার গল্প লিখে সেই তিমিরযাত্রার রসদ জুগিয়েছে। সাধারণ মস্তিষ্কজীবী মানুষ যাবে কোথায়? ক্রমেই বিপদে পরতে হয়। সুচরিতা বিপদে পরে। আবাসনে করোনা পূজা, এস.এম.এস ফরোয়ার্ডের মধ্য দিয়ে যে কুসংস্কার প্রাধান্য পেয়েছে, যা সিংহভাগ মানুষ পালন করতে ব্যস্ত সেই প্রখর সত্যের আঁতে ঘা দিতেই লেখক কলম তুলে নেন। এই উপমহাদেশের ইতিহাস হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস। ৪৬ এর দাঙ্গা, স্বাধীনতা, ভারত-চিন যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, করোনায় নির্মমভাবে বলি হচ্ছে মানুষ। চক্রান্ত, ক্ষমতালোভী মানুষের ক্ষমতায়ন, নিজেকে রাজা ভাবার উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় মানুষ বলি হচ্ছে। সেই আর্ত মানুষের নির্মম আর্তনাদের সংবেদনশীল ভাষ্য এই আখ্যান। ভালো মানুষ আছে। বিমল, প্রকাশ, আবদুর রহিমদের সংখ্যা নগন্য। আবদুর রহিম ওপারে গিয়েও টিকতে পারেনি। ফলে চলে এসেছেন এপারের উলুবেরিয়ায়। একশ অতিক্রান্ত আবদুর রহিম করোনা জয় করেছে। তাঁকে দেখতে চলেছেন বিমল, সুচরিতা। ঔপনিবেশিক বলয় থেকে একুশ শতকের করোনা মহামারী পর্যন্ত আখ্যানের যাতায়াত। সমস্যা কোথায়, শাসকের অপদার্থতা কোথায়, ক্ষমতাদখলকারী মানুষের পৈশাচিক মানসিকতা কেমন, তার বলি সাধারণ মানুষের পতন কীভাবে ঘটে, বুদ্ধিজীবী মানুষের কোনো কথাই শোনে না দুর্বৃত্ত শাসক। ধর্মের বেড়াজালে সাধারণ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে, মানুষকে হিন্দু-মুসলিম খোলসে বিচার করা হচ্ছে। সেই দূষিত পরিবেশই আখ্যানের পরিমণ্ডল। লেখক বারবার মানবতার সন্ধানে গিয়েছেন। এই মেঘলা বেলায় মানবমৈত্রীর প্রকৃত পথ খুঁজে চলে ‘র‍্যাডক্লিফ লাইন’ আখ্যান।

           করোনার বীভৎসতা থেকে মানুষকে বাঁচাতে একদল যুবক জীবন বাজি রেখে নেমে পড়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিয়েছে। সরকার মানুষের কাগজ দেখা নিয়ে ব্যস্ত। আগে মানুষের পরিত্রাণ না পরিচয়পত্র দেখা? যে দেশের মানুষ খেতে পায় না, ক্ষুধা সংবরণের জন্য ভিন রাজ্যে কাজের সন্ধানে যায় তাদের নাজেহাল করা হল। সুসভ্য সভ্যতার নষ্টচরিত্র যেমন লিপিবদ্ধ হয়, তেমনি আবদুর রবের মতো ধান্দাবাজ-কুচক্রান্ত শ্রেণির উত্তরাধিকারী যে আজও আছে তা নিশ্চিত হয়। তবে সবটাই নষ্ট হয়ে যায়নি। আবদুর রহিমের নাতি শতাব্দ মানুষ উদ্ধারে নেমে পড়েছে। ভালোমন্দ নিয়েই পৃথিবী। একদল বই বাঁচিয়ে রাখতে চায়, একদল ধ্বংস করতে উদ্‌গ্রীব, এক শ্রেণি কুসংস্কারতায় আচ্ছন্ন, এক শ্রেণি মানুষের সেবায় নিয়োজিত, অন্য শ্রেণি সমস্ত ছিনিয়ে নিতে উন্মত্ত। এই দুই শ্রেণি, তার দ্বন্দ্ব, তা দেখে চলা তৃতীয় শ্রেণি নিয়ে আখ্যান এগিয়ে চলে।

           আখ্যানের চলন আলগা হলেও, টেল রীতিতে, কথোপকথনে ও আত্মস্মৃতিতে বর্ণিত হলেও সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে। লেখক হয়ত ইচ্ছাকৃতই আখ্যানের বয়ানকে জটিল করেননি। গল্পের তলে উপমহাদেশের ধর্মকেন্দ্রিক সমস্যা, যার বৃহত্তম ফসল পার্টিশন, যার গোপন ফাঁদে বন্দি ধর্মহীন সাধারণ মানুষের নাজেহাল অবস্থা, তাই বর্ণিত হয়ে চলে। আবার সামগ্রিকভাবে ইতিহাসের সহস্রপথে গিয়েও পাঠককে নিস্তার দেবার জন্য কবিজীবন চরিত্রের বিক্ষিপ্ত চিত্রমালা আঁকেন। রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের পাশে সামাজিক ইতিহাসও জরুরি। ব্যক্তির আত্মখননের দলিলই পার্টিশনের প্রকৃত ইতিহাস। সেই ইতিহাসের চালিকা শক্তি এই আখ্যান।

           করোনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি হুজুগে মাতল। পূজা, ভোট উৎসবকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর স্বার্থ চরিতার্থ করতে মানুষের বিপদ বৃদ্ধি পেল। গণ্যমান্য ব্যক্তির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আদেখলেপনার নামে নিজের, পারিপার্শ্বিক বলয়ের ক্ষতি ডেকে আনল। বহুক্ষেত্রেই প্রশাসন চুপ থাকল। একুশ শতকের বৃহত্তম সংকট, সঙ্গে হিন্দু-মুসলিমের বিভেদনীতির সমীকরণ কোথাও কোথাও এত প্রবল তার নষ্ট পরিসর চিহ্নিত হয়ে চলে। ভালো মানুষের পাশে মন্দ মানুষ বর্তমান। ভালো মানুষ ধর্মের খোলস উন্মুক্ত করতে ইচ্ছুক, মন্দ মানুষ ধর্মের আবরণে ব্যক্তিকে শোষণ করতে অগ্রসর। করোনাকে কেন্দ্র করে ধর্ম-সংস্কার, শ্রাদ্ধ, কাজের লোকের বেতন না দেওয়া, যৌন নির্যাতন, কারখানার কর্মচারী ছাঁটাই সমস্তই লিপিবদ্ধ হয়ে চলে।

           আখ্যানের নাম ‘র‍্যাডক্লিফ লাইন’ হলেও লেখক সেই সীমান্ত বিভাজনে না গিয়ে লাইনের ভিতরে থাকা মানুষের নানা সমস্যায় নজর দিয়েছেন। যা বৃহত্তর অর্থে নাগরিক জীবনের সমস্যা। প্রমোটিং, দুর্নীতি, ফ্ল্যাট কালচার, ফ্ল্যাটের ভিতরের অন্ধকার, যা করোনাকালে স্পষ্ট হয়েছিল সেই রহস্য বের করে আনেন। সামাজিক ক্ষত বহু তলদেশে পৌঁছে গেছে। যেকোন বিষয় নিয়ে আত্মপ্রচার, ফেসবুক পেজ, ভিত্তিহীন বাস্তবে মিডিয়া, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য, সংস্কৃতি ডুবে গেছে। নিজের ঐতিহ্য রক্ষার নামে কূপমণ্ডূকতা, অন্ধবিশ্বাস, ভূত-প্রেত নিয়ে মানুষ বিনোদনে মত্ত হয়েছে। সাহিত্য থেকে সিরিয়াল, সংস্কৃতি থেকে বিশ্বাস সর্বত্রই ভিত্তিহীন বাস্তবের প্রাধান্য। তা ফ্যান্টাসি নয়। সেই ভিত্তিহীন বাস্তবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চলে এই আখ্যান। আখ্যানে শুনতে পাই—“এই উপমহাদেশের মানুষ সবচেয়ে নিরানন্দ জীবন যাপন করে। এত নিরানন্দ মানুষ আর কোথায় আছে এই তিন দেশ ছাড়া?” (পৃ. ১৯৬) যে অসুখের জন্ম দিয়েছিল পার্টিশন। সে অসুখের ক্ষত দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই অসুখলিপি নিয়েই এই অক্ষরভুবন। পার্টিশনের ফলে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। ওপারবঙ্গের বাঙালি যেমন হিন্দুকে আর আপন ভাবল না তেমনি এপারবঙ্গের বাঙালিও মুসলিমকে ভাই বলে কাছে ডেকে নিল না। ওপারবঙ্গে দেশত্যাগের বীভৎসতা এপারে নেই। সরকার গণতন্ত্র রক্ষা করতে সিদ্ধহস্ত। তবুও কোথায় যেন একটা চোরাগোপ্তা ক্ষোভ রয়ে গেছে। হিন্দুত্ববাদী শাসনে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস বা ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচে এপারের মুসলিমকে ভীষণ ভয়ে থাকতে হয়। সেই সামাজিক ক্ষতের নানা রকমফের আছে। আব্বাসউদ্দিন দেশভাগে ওপারে চলে গেলেও, মুসলিম লিগের সমর্থক হলেও মানুষের উপর এমন পৈশাচিক নারকীয় হত্যাকাণ্ডে বিশ্বাসী ছিলেন না। চেয়েছিলেন পবিত্র পাকিস্তান। কিন্তু তার পরিণাম যে এমন বীভৎস রক্তস্রোত যা সময়ের অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হবে তা ভাবতেও পারেননি।

            সংখ্যালঘুর সংকট দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ এক গভীর সমাজিক অসুখের জন্ম দিয়ে গিয়েছিল। পথে-ঘাটে, অফিস-কাছারি, ট্রেনে-ট্রামে সর্বত্র আলোচনায় মুসলিমকে বেকায়দায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যে মানুষরা পাকিস্তান চাননি, পাকিস্তান ভুল জেনে আবার ভারতে ফিরে এসেছেন, দেশের ঐতিহ্য, স্বদেশচেতনা, মানবতা, নীতিবোধ বজায় রেখেছেন, দেশকে নতমস্তকে শ্রদ্ধা করেছেন, হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতির কথা মনে মনে ভেবেছেন সেই মুসলিমকেও কেন অপমানিত হতে হবে? যদিও হতে হচ্ছে। সেই সংকট, ক্ষত, বেদনা থেকে লেখক আতিকুর জীবন ত্যাগ করেছেন। সন্তান শতাব্দ মানুষের জীবনরক্ষায় নেমে পড়েছে লকডাউনে। তাঁদেরও সেই হীন অপমান সহ্য করতে হবে কেন? তবুও হচ্ছে। এ এক গভীর অসুখ। যে অসুখ উদারচেতনা, মহৎ জীবনাদর্শ ছাড়া দূর হবে না। কিন্তু তেমন বাঙালি কোথায়? শুধু তো জনগণ নয়। সমান দায়ী রাষ্ট্র, শাসক, প্রশাসন। নিত্যদিন দাঙ্গা, খুন, জখম, হানাহানি ঘটেছে। বিভেদকে সঙ্গী করে সব ছিনিয়ে নেবার ছুপা রুস্তম মানসিকতা নিয়ে মুনাফাবাজ ঘুরে চলেছে। কে দায়ী এজন্য? বয়ান থেকে শুনতে পাই—“শাসকের হৃদয়ে করুণা নাই, মায়া নাই, ভালোবাসা নাই।”

           আখ্যানে দুটি বৃত্ত আছে। বড় বৃত্ত পার্টিশনের ফলশ্রুতি হিসেবে আতিকুজ্জামানের উত্তরপ্রজন্মের জীবন সংকট। ছোট বৃত্তে বাড়ি প্রমোটিংকে কেন্দ্র করে ফ্ল্যাট কালচার ও তন্ত্রমন্ত্র-সংস্কার যা করোনাকালে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল সেই সংকট। দুই সংকটে সাধারণ মানুষ নাস্তানাবুদ হয়েছে। পার্টিশন বা র‍্যাডক্লিফ লাইনে জনজীবনের কণ্ঠস্বর-ইচ্ছা-অনিচ্ছা, গণভোট যেমন নেওয়া হয়নি তেমনি উত্তর আধুনিক বৃত্তে ক্ষমতায়ন ভিন্ন কণ্ঠস্বরকে পরাজিত করতে বাধ্য। ক্ষমতার প্রতাপ ও প্রতিরোধ বয়ানে এসেছে কিন্তু তার চলন ভিন্ন। আঁকড়া বাস্তবে না গিয়ে লেখক ফ্যান্টাসি, ইন্দ্রজাল, অদৃশ্য জালের মধ্য দিয়ে তা এগিয়ে নিয়ে চলেন। এই দেশের সামাজিক ক্ষত কোন বলয়ে প্রবেশ করেছে তা আবিষ্কারে মত্ত লেখক। সংখ্যালঘু নিষ্পেষণের কত শ্রেণি আছে, কত গোপন ফাঁদ, যেকোন বৃত্তান্তে সংখ্যাগুরুর আক্রোশ বেরিয়ে আসে তা স্পষ্ট করেছেন। বহু সংখ্যালঘু মানুষ দাঙ্গাবাজ, ধর্মান্ধ না হয়েও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে। সেই ভিতরের বলয়ের ক্ষতকে তিনি চিহ্নিত করে চলেন। ক্ষমতা, অশুভবোধ, কুসংস্কারের বিপক্ষে আছেন সুচরিতা, বিমল, শতাব্দ। জীবনের নান্দনিক পাঠ আবিষ্কারে মত্ত শতাব্দ। কিন্তু জীবনের তো প্রতিপদে বাধা। কুসংস্কার, স্বার্থবাজ মানসিকতা মানুষকে নিপীড়িত করতে চায়। লেখক হাজির করেন বনদেবীকে। পরিচারিকা থেকে ঐন্দ্রজালিকতা ব্যবহার করে এক সুস্থ জীবনচেতনা আবিষ্কারে মত্ত থাকেন।

           সময়ের বুক থেকে যেমন বিশ্বাস হারিয়ে গেছে তেমনি সময় গ্রাস করেছে সভ্যতার বহু কিছু। পরিসরের বদল ঘটেছে। সেদিনের গ্রামোফোন, টেপ রেকর্ড, ক্যাসেট আজ অচল। আজ ইউটিউবের যুগ। পুরাতন সময়ের মানুষ সব হারিয়ে যাওয়ায় হা হুতাশ করে। নবীন সমাজের কাছে সেসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। দুই জীবনচিত্রের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ফেলে আসা সময় এবং বাঙালি সংস্কৃতির চাপানউতর প্রতিফলিত হতে দেখি। একজন আদর্শবাদী নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ও ভারত আত্মার আত্মীয় আবদুর রহিমের দৃষ্টি দিয়ে উদ্‌বাস্তু, দেশভাগ, পারাপার, খুনজখম চিহ্নিত করেছেন। দেশভাগে কি মুসলিম জনজাতির ক্ষতি হয়নি? চরম ক্ষতি হয়েছিল। দেশ হারাতে হয়েছিল। বিধর্মীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতাচ্যুত হয়েছে। বিনা অপরাধে ভারত ভাগ না চেয়েও, ভারতের সুমহান ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়েও আউটসাইড হয়ে যেতে হয়েছে। হিন্দু দেখেছে সন্দেহের দৃষ্টিতে। সেই আদর্শবাদী ন্যায় পরায়ণ সংখ্যালঘুর জীবনসংকট আখ্যানের অন্যতম দিক।

           সমস্ত মুসলিম যেমন পাকিস্তান চায়নি, তেমনি সমস্ত উর্দুভাষীও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে উর্দু চায়নি। সমস্ত মুসলিম যেমন লিগকে সমর্থন করেনি তেমনি সমস্ত উর্দুভাষীরাও পশ্চিম পাকিস্তানের জঘন্য কার্যকলাপ মেনে নিতে পারেনি। বলি হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। খানসেনার হাতে যেমন নিরীহ বাংলা ভাষার মানুষ মরেছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধার হাতে উর্দুভাষী মানুষ মরেছে। জঘন্য বাতাবরণে কোন কোন মুসলিম পাকিস্তান ত্যাগ করে এদেশে এসেছে। সভ্য বিবেকবান, রুচিশীল মুসলিম পাকিস্তানকে নিজের স্বভূমি ভাবতে পারেনি। যে কারণে যতীন দাস লিখেছিলেন ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যুর দর্শন’। যার অর্থ ‘পবিত্রভূমি’, জন্মলগ্ন থেকেই তা বিভেদ ও ধর্মীয় কুসংস্কারে ডুবে গিয়েছিল। অবধারিত পরিণাম হিসেবে ভাঙন ধরেছিল।

           চারিদিকে চলছে ভাঙনের রাজনীতি। সমস্ত স্থাপত্য থেকে মুসলিম চিহ্ন মুছে দিতে উঠে পরে লেগেছে বিশেষ মতবাদপুষ্ট রাজনৈতিক দল। ইতিহাস বিকৃতি, ইতিহাস মুছে ফেলা, প্রকৃত ইতিহাস—কোনো কিছুরই ধার ধারে না তারা। মুছে যাচ্ছে প্রকৃত সত্য। বিভেদের রাজনীতি আরও তীব্র হচ্ছে। হিন্দু মুসলিমকে ভাই বলে সম্বোধন করলেও বহু হিন্দু সংস্কারে বিশ্বাসী। সেই সংস্কারের চিহ্ন প্রতিপদক্ষেপে ফুটে ওঠে। ভাই বলে ডাকার আড়ালে আছে ঘৃণা, নিচু মানসিকতা। নিজেকে সংস্কৃতিবাণ, মানবতাবাদী প্রমাণের আড়ালে রয়ে গেছে ধর্মান্ধের নানা রকমফের। সেই অসুখের খনন প্রক্রিয়া কোথাও কোথাও ভয়ংকর। বাস্তবের ধারাপাত ধরেই লেখককে নামতে হয় চরিত্রের বীক্ষণে। উঠে আসে আলো-অন্ধকারের তীব্র ঝাঁজ।বইনির্ভর জীবন, স্বপ্ন দেখা, গানের সন্ধান, অতীত ঐতিহ্য, পার্টিশন কীভাবে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল গানে, সম্প্রীতিতে সমস্ত মিলে প্রবাহমান সময়ের বীভংস বাস্তবতা চিহ্নিত হয়ে চলে। সব পুরাতন ঐতিহ্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে, নবনির্মিত বহুতল আবাসন গড়ে উঠছে, কোথাও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বিল্ডিং এ ফাটল, তা ফেলে দিয়ে নতুন নির্মাণ। মাঝ থেকে সাধারণ মানুষের জীবনস্বপ্নের বারোটা বেজে যাচ্ছে। গোটা সিস্টেমটা ক্ষমতা, দুর্নীতিতে ভরে গেছে। ক্ষমতাতন্ত্রের ঊর্ধ্বমুখী সোপানে স্বাভাবিক জীবন পুরো ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। সাধারণ মধ্যবিত্তের পালানোর পথ নেই, তা বরণ করে নিতেও প্রবল দ্বিধা—সেই দ্বিধার মধ্যবিন্দু নিয়েই এই আখ্যান পরিক্রমা।




    বইঃ র‍্যাডক্লিফ লাইন
    লেখকঃ অমর মিত্র
    প্রকাশকঃ দেজ
    মূল্যঃ ৪৯৪ (হার্ড কভার)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ১৫ অক্টোবর ২০২৩ | ৭৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন