কিছু বই হয় যেগুলো পড়ার সময় বইটা, তার চরিত্রগুলো ক্রমশ পাঠককে গ্রাস করে ফেলতে থাকে। এইসব বই পড়া শেষ হওয়ার পরেও সঙ্গ ছাড়ে না, মস্তিষ্কের কোষে কোষে জাল বুনে থেকে যায় আরো বেশ কিছুদিন। এমনই এক বই ‘'সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা”। পড়া শেষ হয়েছে তা প্রায় দেড়মাস হয়ে গেল, এখনো মাঝে মধ্যেই সেই মৎস্যভূমি আর তার নয় প্রজন্মের বাসিন্দারা মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়ায়।
‘মৎস্যভূমি’ - ত্রিবেণীতে গঙ্গা, ভাগীরথী ও সরস্বতীতে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় এই দুই শাখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে পলি জমে জমে সৃষ্টি হয় মাছের আকৃতির এক ভূমি, যা প্রাক ইসলামিক পাল ও সেন যুগ থেকে ষোড়শ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ধারণ করে রেখেছে জমজমাট এক বাণিজ্যকেন্দ্র, সপ্তগ্রাম বন্দর। চলতি কথায় সাতগাঁ। সপ্তদশ শতকে সরস্বতী ক্রমশ: ক্ষীণকায়া হতে শুরু করলে সাতগাঁ বন্দর তার কৌলিন্য হারাতে শুরু করে।
সপ্তদশ শতকে সাতগাঁ সংলগ্ন বাঁশবেড়িয়া, ব্যান্ডেল, চুঁচুড়া, চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, শ্রীরামপুর বিভিন্ন ইউরোপিয়ান জাতির কলোনী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। মসলিন ও কাপাসবস্ত্রের চালানের সাথে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজদের ক্রীতদাস ক্রীতদাসী চালানের যোগানদারও ছিল এই অঞ্চল।
অষ্টাদশ শতকে কলকাতা ইংরেজদের অধীনে মূল বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠলে সাতগাঁ বন্দর ও সংলগ্ন অঞ্চল গুরুত্বহীন হয়ে দাঁড়ায়।
এ বই সাতগাঁয়ের এক স্মার্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের নয়টি প্রজন্মের কাহিনী এবং সিলেটের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কাহিনীই শুধু নয়, মৎস্যভূমির বিবর্তনের ইতিহাস এবং সাতগাঁ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা, যা আমরা হুগলীজেলা নামে চিনে এসেছি তার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসও বটে। গঙ্গা আর সরস্বতী তাদের খাত বদলেছে বারেবারে, বন্যায় আসা পলিতে স্তরে স্তরে চাপা পড়েছে পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণসমূহ যা সম্পর্কে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘হিয়ার দ্য পাস্ট এন্ড দ্য প্রেজেন্ট আর সো ইনেক্সট্রিকেবলি লিংকড দ্যাট সিকিং আ প্রপার ক্রনোলজিকাল সিকোয়েন্স ইজ অ্যাজ গুড অ্যাজ চেজিং আ মিরাজ’।
শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথাটি উপন্যাসের মূল সুরটি বেঁধে দিয়েছে। আখ্যানকথক বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে সহসাই ভারতরাষ্ট্রের অনাগরিক ঘোষিত হবার মুখে এসে দাঁড়ান। নির্দিষ্ট একটি তারিখের আগে ভারতে তাঁর জন্ম বা বসবাসের প্রমাণ চায় রাষ্ট্র। অথচ কাগজ কিছুই নেই, থাকার মধ্যে বাপ্পার আছে শুধু স্মৃতি। সেই স্মৃতিকেই প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চেয়ে বাপ্পা শোনান আখ্যান। সেই আখ্যান যার ‘'প্রপার ক্রনোলজিকাল সিকোয়েন্স’ খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। সেই আখ্যান কাটুনিডাঙার মেয়েদের হাওয়াতাঁতে বোনা মসলিনের মতই প্রায় স্বচ্ছ রহস্যময় আখ্যান। তার কিছু স্পষ্ট কিছু শুধু আভাষ।
সাতগাঁয়ের পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাসের মতই এই কাহিনীতে বাস্তবের সাথে মিলেমিশে আছে পরাবাস্তব, ইতিহাসের টুকরো টাকরা। এখানে কলার মান্দাসে ভেসে আসা মেয়ের পাছায় থাকে হার্মাদদের ক্রীতদাসত্বের সিলমোহর, পর্তুগিজ ভাষায় খিস্তি করা কাকাতুয়া মানুষমেয়েকে গর্ভবতী করতে পারে। বাপ্পার দিদিমা গঙ্গায় ডুব দিয়ে দূরবর্তী আত্মীয়া, বান্ধবীদের সাথে কথাবার্তা বলতে পারেন, সাতগাঁয়ের অন্য মেয়েদের সে কৌশল শিখিয়ে দিতেও পারেন।
এই সবই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে আসে। সময় আগুপিছু করে গল্প শোনায় কনৌজি রাজপুত্রদের সাতগাঁয় আসা থেকে বর্গী আক্রমণ, পর্তুগিজ দিনেমার ওলন্দাজদের বাণিজ্যবিস্তার থেকে ইংরেজদের উপনিবেশ তৈরী। বারেবারে এগিয়ে পিছিয়ে বলা আখ্যানসমূহ সান্তা আনার জাহাজের মত ঠেকে যায় না, কোথাও বাধার সৃষ্টি করে না, বরং গল্পের নৌকোখানা এমন তরতরিয়ে এগিয়ে চলে যে সাড়ে ছশো পাতার বই শেষ হয় চারদিনে। স্বচ্ছ রহস্যময়ভ ‘'বফ্ত হাওয়া’য় গড়া এক সুবিশাল ক্যানভাস ছড়িয়ে যায় মস্তিষ্কের কোষে কোষে।
এই বই সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনায় মার্কেজের নাম বারেবারে আসছে। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস যেভাবে সমগ্র লাতিন আমেরিকার ইতিহাস হয়ে ওঠে সাতগাঁয়ের চক্রবর্তী পরিবারের ইতিহাসও বাংলা ও বাঙালির সাতশো বছরব্যপী সাংস্কৃতিক ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস হয়ে উঠেছে। আমি আরো দুটো বইয়ের কথা এই প্রসঙ্গে বলতে চাই বিষয়গতভাবে যারা এ বইয়ের খুব কাছাকাছি। কুররাতুল-আইন হায়দারের River of Fire (উর্দু আগ কি দরিয়া) আর রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা।
রিভার অব ফায়ারে হায়দার ধরেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের ২৫০০ বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, মানুষের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। উপমহাদেশে খ্রীষ্টপুর্ব চতুর্থ শতকে বৌদ্ধধর্মের প্রসার থেকে শুরু করে সপ্তম খ্রীস্টাব্দ থেকে মুসলমান ধর্মের বিস্তার, গঙ্গা যমুনি তেহজিব ও ৪৭এর দেশভাগে তার পরাজয়। রিজিয়ার দৃষ্টিকোণ একটু আলাদা। উপমহাদেশে মোটামুটি আড়াই হাজার বছরের কালক্রমে ‘বং’ নৃ গোষ্ঠী থেকে বাঙালিজাতির নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনকে ধরেছেন বং থেকে বাংলা উপন্যাসে।
হায়দার, রিজিয়া বা পরিমলবাবু কেউই ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন নি, যা লিখেছেন সেগুলিকে ইতিহাসসম্মত বলা যায়। এই তিনটি বইতেই পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের চাইতে অধিকতর ব্যপ্ত পরিপ্রেক্ষিত হল সময়। রিভার অব ফায়ার শেষ হয় দেশভাগ ও রক্তাক্ত বিভাজনে সৃষ্ট দুই রাষ্ট্র, তার নাগরিকদের নতুন করে পথ খোঁজায়। বং থেকে বাংলা শেষ হয় উপমহাদেশের পুনর্বিভাজন ও আরেক নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টিতে, বাঙালি জাতিসত্ত্বার নতুন আশার উন্মেষে।
সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা শেষ হয় সময়ের রথে আরেকটু এগিয়ে এসে নাগরিকত্ব কী, কোথায় কীভাবে তার সীমা নির্ধারণ করা যায় এই প্রশ্নে। রাষ্ট্র কি চাইলেই খুশীমত কাউকে নাগরিক বা অনাগরিক করে দিতে পারে? বইটা পড়ার সময় এই দিনেমারডাঙা ফিরিঙ্গিডাঙা, কাটুনিডাঙা, আর্মানিডাঙা, পোর্তোহাটা জায়গাগুলো চিনতে পারা, আলগোছে ছড়িয়ে রাখা কিছু সূত্র থেকে ঐতিহাসিক ঘটনা ও মানুষগুলো চিহ্নিত করতে পারা অত্যন্ত আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা।
রাজীব চক্রবর্তীর করা প্রচ্ছদ চমৎকার। বইটিতে কিছু মুদ্রণপ্রমাদ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, যেগুলো না থাকলেই ভাল হত। নি:সংশয়ে বলতে পারি এই বই আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা উপন্যাস। বারে বারে আমাকে ফিরে যেতে হবে এ উপন্যাসের কাছে।
বই: সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা
লেখক : পরিমল ভট্টাচার্য
প্রকাশক : অবভাস
দাম - ৮২৫/-