চতুর্দশ শতকের কোনও এক সময় সুদূর দক্ষিণে পম্পা নদীর তীরে নয় বছরের এক বালিকা মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে চোখভর্তি জল নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল তার আত্মীয় এবং অন্যান্য পরিচিত মহিলারা এক এক করে সামনের মস্ত অগ্নিকুণ্ডে শান্তমুখে উঠে যাচ্ছেন। এক সময় বালিকার মা, তার ধরে রাখা হাত আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে ধীর মাপা পদক্ষেপে উঠে যায় সেই গণচিতায়। বালিকা আতঙ্কিত হয়ে দেখে তার মায়ের অগ্নিপ্রবেশ, অনুভব করে মা তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয় কারণ মায়ের মনের কোথাও আর তার সম্পর্কে কোনও উৎকন্ঠা বা অনুভুতি নেই। সেই সময় অতগুলি নারীর পুড়ে যাওয়া মাংসের গন্ধের সঙ্গে মিশে ছিল ঘি, দারচিনি, বড় এলাচ, জিরে, রসুন কর্পুরের গন্ধও, গণচিতা তৈরীর সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ এসবও দেওয়া হয়েছিল, সে রাতে পম্পা নদীতীরে মস্ত উনুনে যেন বা নারীমাংস দিয়ে কোনও সুস্বাদু খাদ্য তৈরী হচ্ছিল। এই মেয়েটি পরবর্তীতে তার অবশিষ্ট ২৩৮ বছরব্যপী জীবনে আর কোনওদিনও মাংস খেতে পারে নি। মেয়েটি সেই মুহূর্তে স্থির করে সে চিতায় উঠবে না, কিছুতেই না। সে বরং দেখবে অন্য কোনও মেয়েকেও যেন জ্যান্ত চিতায় উঠতে না হয়। এই মেয়েটি, পম্পা কম্পনা, সলমন রুশদীর সাম্প্রতিকতম বই 'দ্য ভিক্টরি সিটি'র নায়িকা তথা প্রধান চরিত্র।
ভিক্টরি সিটি বা বিজয়নগর, এক পর্তুগিজ ব্যবসায়ীর উচ্চারণে যে শহরের নাম হয় বিসনাগা, তার সৃষ্টি, উত্থান, পতন ও সম্পূর্ণ ধ্বংসের কাহিনি আসলে পম্পা কম্পনার জীবনেরও কাহিনি বটে। লেখক বইয়ের শুরুতেই আমাদের জানিয়ে দেন এ পম্পা কম্পনারই লিখে যাওয়া মহাকাব্য, যা তার মৃত্যুর সাড়ে চারশো বছর পরে অতি প্রাচীন এক শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এক মুখবন্ধ মাটির পাত্রে পাওয়া গেছে, লেখক তারই পুনঃবয়ান করছেন মাত্র। অতি দীর্ঘ, রূপকথার মত এই কাহিনি তিনি লিখছেন সব রকম পাঠকের বিনোদনের জন্য, শিক্ষালাভের জন্যও বটে। পম্পা কবি ভবিষ্যদ্বক্তা, দেবী পম্পার (যাঁকে অন্যত্র দেবী পার্বতী বলে জানে লোকে) বরে প্রায় অনন্ত যৌবন ও জাদুক্ষমতার অধিকারিণী হন। ‘জয়পরাজয়’ নামে পম্পা কম্পনার সৃষ্ট এই মহাকাব্যটিতে ২৪০০০ সংস্কৃত শ্লোক আছে, যা বলে একমুঠো বীজ থেকে বিসনাগা রাজ্যের গড়ে ওঠা এবং প্রায় আড়াইশ বছরব্যপী নানা উত্থানপতনের পরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া। বইয়ের পটখানা একেবারে ভিন্টেজ রুশদি, আড়াইশো বছরের মুহূর্তকে ধরেছেন রূপকথা, পুরাণ, উপকথা, লোককাহিনি ও ইতিহাস মিলিয়ে মিশিয়ে সরু মোটা তুলির সুক্ষ্ম আঁচড়ে, চওড়া ব্রাশস্ট্রোকে।
কাহিনির কাল চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক হলেও কাহিনি, তার পাত্রপাত্রীরা থেকে থেকেই আমাদের মুখের সামনে আয়না ধরে, মুখোমুখি করে অস্বস্তিকর প্রশ্নের। প্রকৃত বিজয়নগর রাজ্য পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতের দক্ষিণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আপন আধিপত্য কায়েম করেছিল, শিল্প ও স্থাপত্যের চুড়ায় উঠেছিল। বিজয়নগরের বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল চীন, ভেনিস অবধি। একইসাথে ছিল রাজপ্রাসাদের ভেতরে কূটকচালি, ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ছিল পাশের বহমনী রাজ্যের সাথে তুমূল শত্রুতাও। এই সমস্ত এক ফ্রেমে একটি বইয়ের মধ্যে ধরা এবং সেই পটভূমি ব্যবহার করে বর্তমানের ছায়াছবি দেখানো অতীব মুন্সিয়ানার কাজ। রুশদী সে কাজে একশো শতাংশ সফল। পম্পার দেওয়া এক থলি বীজ থেকে হুক্ক আর বুক্ক দুইভাই গড়ে তোলে যে রাজ্য, বিজয়নগর ওরফে বিসনাগা, পম্পা কম্পনার মননে সেই রাজ্যে পুরুষ ও নারীর হবে সমান অধিকার, মেয়েদের সেখানে পর্দা অথবা ঘোমটার আড়ালে থাকতে হবে না; মেয়েরা সেখানে সৈনিক থেকে স্থপতি, মালাকর থেকে শিল্পী সবকিছুই হতে পারে। যথাক্রমে হুক্ক ও বুক্কর রাণী হয়ে সব কাজে সর্বত্র মেয়েদের উপস্থিতির বাস্তবায়ন করেওছিল সে।
কিন্তু হায়! সর্বোচ্চ ক্ষমতায়ন অর্থাৎ পুত্র নয় কন্যাকে রাজ্যাধিকারী ঘোষণার ইচ্ছামাত্রই ধ্বসে যায় পম্পা কম্পনার রাণীর আসন। বাস্তবে যেমন হয় আর কি। ২৪৭ বছরের জীবৎকালে পম্পা কম্পনা রাণী হয়েছে তিনবার। প্রতিবার সে চেষ্টা করে গেছে নারীর সর্বোচ্চ ক্ষমতায়নের, প্রতিবারই সমাজের ধর্মান্ধ গোঁড়া অংশের তীব্রতম প্রতিরোধে সে চেষ্টাই শুধু ভেঙে গেছে তাই নয়, ভেঙেছে বিসনাগা রাজ্যটাও। আমরা দেখি ‘শান্তি স্থাপনের জন্য’ হুক্ক, বুক্ক এবং পরবর্তীতে কৃষ্ণদেবরায়া অনবরত যুদ্ধ করে চলে। ‘শান্তির জন্য যুদ্ধ’ চেনা চেনা লাগছে না? বিসনাগার প্রতিটি মানুষ ও প্রাণীর ইতিহাস আসলে পম্পা কম্পনার গড়ে তোলা ইতিহাস। যখন দ্বিতীয় হুক্করায়া, সঙ্গমা রাজত্বের তৃতীয় রাজা তাঁর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে বলেন তাঁরা ইতিহাসের পুনর্লিখন করাবেন, ডাইনী ও ডাইনীকন্যাদের তৈরী ইতিহাস তিনি মুছে দেবেন মানুষের মন থেকে,“Henceforth our narrative, and our narrative only,will prevail, for it is the only true narrative. All false narratives will be suppressed,” সাম্প্রতিক শাসকদের অবিকল কন্ঠস্বর যেন কানে আসে। ক্ষমতাময়ী নারীকে ভয় পাওয়া এবং তাকে ডাইনী বলে খারিজ করা পিতৃতন্ত্রের চিরকালীন অভ্যেস, লেখক জানেন তা এবং দেখান নির্দ্বিধায়।
বিসনাগা পম্পা কম্পনার কল্পনায় এক আদর্শ রাজ্য, কিন্তু আদর্শ আর কতটুকুই বা স্থায়ী হয়! তাই ধর্ম এসে থাবা বসায় রাষ্ট্রনীতিতে, ‘ওদের ধর্ম’ আর ‘আমাদের ধর্ম’ জড়ায় সংঘাতে। রুশদি দেখান বিসনাগা আর তার প্রতিবিম্ব জাফরাবাদ (এই নামেরও মানে ‘বিজয়ের শহর’) দুই রাজ্যেই চরমপন্থী ধার্মিকরা টুঁটি টিপে ধরে শিল্প সংস্কৃতি, উদারবাদ ও মানবিক বোধ, মায় নাগরিকের অধিকার পর্যন্ত। গোটা বইতে কোথাও ধর্মদুটির নাম করা নেই কিন্তু বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না বরং দৈনন্দিন খবরাখবরের সাথে মিল দেখে রীতিমত চমকে উঠতে হয়। যেটা লক্ষ্য করার মত ব্যপার তা হল একটা ধর্মের ধর্মান্ধতার চেহারা দেখিয়ে রুশদি প্রায় গোটা জীবনই হুমকীর মুখে কাটালেন, এবং এর পরেও একই সাথে দুটো ধর্মের ধর্মান্ধতার রূপ অবলীলায় দেখিয়ে গেলেন। সব ধর্মই যে অন্তর্নিহিতভাবে অসহিষ্ণু ধর্মান্ধতার দিকে ঝুঁকে থাকে এবং কোন না কোনও সময় সম্পূর্ণ ধর্মান্ধদের কবলে চলে যায় এই সত্য পরিষ্কার ফুটে ওঠে পাঠকের সামনে। বইয়ের প্রায় শেষের দিকে আমরা দেখি পম্পা কম্পনা সারাজীবন সব ধর্ম সম্পর্কে সহিষ্ণু হবার কথা বলে এসে শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হয় তারই জন্য। তথাকথিত ‘ধর্ম বিরোধিতা’র শাস্তি দেয় রাজা তার চোখ উপড়ে নিয়ে অন্ধ করে।
এই বই লেখা শেষ করে প্রকাশকের কাছে জমা দেবার সময় রুশদি অবশ্য জানতেন না এর বেশ কিছু মাস পরে তাঁকেও এক ধর্মান্ধের আক্রমণে একটি চোখ হারাতে হবে। এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে আমার এর লিঙ্গ রাজনীতির পরিব্যাপ্তি। পম্পা কম্পনার সৃষ্ট রাজ্যে মেয়েরা প্রচলিত সামাজিক নিয়মে লিঙ্গ নির্ধারিত ভূমিকায় বাঁধা নয়, তারা কবি কিম্বা শ্রমিক, শিল্পী কিম্বা উকীল, চিকিৎসক কিম্বা যোদ্ধা বেছে নিতে পারে যে কোন পেশা তাদের ইচ্ছেমত। সিংহাসনে মেয়েদের উত্তরাধিকারের চেষ্টা করতে গিয়েই সর্বস্ব খুইয়ে প্রাণ হাতে করে অজ্ঞাতবাসে যেতে হয় নিজের তিন মেয়েকে নিয়ে, তবু সেই সমানাধিকারের স্বপ্ন ছাড়ে না সে। এমন এক ভবিষ্যত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে পম্পা কম্পনা যেখানে শুধু যে স্বামীর অনুগামিনী হয়ে তার মৃত্যুর পর মেয়েদের আর চিতায় উঠতে হবে না তাই নয়, এমনকি ‘বিয়ে’রও কোনও প্রয়োজন হবে না। অন্যের পরিচয়ে নয় মেয়েরা পরিচিত হবে তাদের নিজেদের নামে ও কর্মে। মেয়েদের আদর্শ লৈঙ্গিক ব্যবহারকে উলটে দেওয়ার ইচ্ছে পঞ্চদশ, ষোড়শ শতকের এক মেয়ের, তা হোক সে জাদুকরী, হোক সে রাণী, চরিত্রে দেখানো এই বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক বলে মনে হয়েছে আমার।
দুই শতাব্দীব্যপী এই উপন্যাসকে অনায়াসে মহাগ্রন্থ আখ্যা দেওয়া যায়। অসংখ্য চরিত্র, তাদের ছোট ছোট গল্প, অসংখ্য উপকাহিনি, গল্পের মধ্যে আরো গল্প,মানুষের সাংঘাতিক হিংস্র আচরণ, পাশাপাশি অহৈতুকি ভালবাসা, সাহায্য, দেবীপ্রদত্ত জাদু ,সেই জাদুর বিরুদ্ধাচরণ সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ উপন্যাস, শেষ পর্যন্ত যা দেখায় মানুষ, ভাল মনের মানুষ না থাকলে জাদু কিচ্ছু করতে পারে না। ভোজবাজিতে সাত স্তরের দেওয়াল উঠে ঘিরে রেখে সুরক্ষা দিতে পারে রাজধানীকে, কিন্তু সেখানকার মানুষ যদি ভরসা, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তবে সে দেওয়াল ধ্বসে যায় বালির বাঁধের মতই। যেখানেই অত্যাচার, সেখানেই গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। নিপীড়ন যেখানে ভয়ানক হয় প্রতিরোধের বীজ অঙ্কুরিত হয় সেখানেই। মানুষ তো কুমোরপাড়ায় তৈরী এক সাইজের মুর্তি নয়, এক জাতি এক ধর্ম, এক রাজা, একই সংস্কৃতি জোর করে চাপাতে গেলে তা ভেঙে ছত্রখান হবেই, আজ হোক বা কাল। জীবনের শেষপ্রান্তে পম্পা কম্পনা অনুভব করে সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে আবার ধ্বংস হয় কিন্তু “Words are the only victors,” she concludes, and stories, at their best, cheat death and live on.
শব্দই একমাত্র কালজয়ী হয়,মৃত্যুকে উপেক্ষা করে কেবল গল্পেরাই বেঁচে থাকে।
বই – The Victory City
লেখক – Salman Rushdie
প্রকাশক – Penguin Hamish Hamilton
দাম - ৪৪৬/-টাকা