India Wins Freedom গ্রন্থটিতে উচ্চারিত মৌলানা আবুল কালাম আজাদের অনুতপ্ত দীর্ঘশ্বাস আজও দুই বাংলার হাওয়ায় কান পাতলে শোনা যায়। এ যেন পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের দায়ভার বহন করে চলেছে উত্তরপুরুষেরা। অমর মিত্রের ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ উপন্যাসে অসহ্য এই বাস্তবতার সঙ্গে সময়ের দূরত্বের অবসরে যুক্ত হয়েছে এক মায়াজগৎ।
অখণ্ড ভারতবর্ষকে যে লোকটির সুপারিশে এভাবে দ্বিখণ্ডিত হতে হয়েছিল, সে লোকটির ভারতবর্ষ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র এক মাসের। এই দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘোষণার পরদিনই তিনি ভারত ছাড়েন; একটি সুপ্রাচীন সভ্যতার দেশকে এভাবে খণ্ডিত করার ভিত্তিমূলে বিজ্ঞানসম্মত কোনো ভাবনার অস্তিত্ব ছিল না; এই সিদ্ধান্তে দেশের অধিকাংশ নেতা ও সাধারণ মানুষের অসন্তোষ ছিল বলে শোনা যায়, কিন্তু এর বিরুদ্ধে তাঁদের উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যকরী প্রতিরোধের সংবাদ পাওয়া যায় না। যার ফলে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল পরবর্তী কালের এক রক্তাক্ত-অবিশ্বাসের পটভূমি; যা আজও আমাদের রোজকার চলার পথে মস্ত পাঁচিল তুলে মাঝে মাঝে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রজীবনে নানা ধরনের বিপর্যয় এনে চলেছে। এ কারণেই দেশকে দ্বিখণ্ডীকরণের এই সীমারেখা ইতিহাসে ‘THE BLOODY LINE’ নামেও কুখ্যাত।
সমাজ-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক সূত্র মেনেই পৃথিবীর সমস্ত বিভাজিত দেশগুলির মতো ভারতীয় সাহিত্যেও এই দেশভাগ একটি স্বতন্ত্র ধারা রচনা করেছে; এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে ভীষ্ম সাহানি, কৃষণ চন্দর, সাদাত হোসেন মান্টো, আব্দুস সামাদ, ইসমত চুঘতাই, কালিন্দী পাণিগ্রাহী প্রমুখ অনেকের কথাই স্মরণযোগ্। বাংলা সাহিত্যেও দেশভাগ অবলম্বনে বা তার প্রেক্ষিতে দুই বাংলাতেই অজস্র কবিতা,গল্প-উপন্যাস,নাটক,প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। এই ধারার বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে জ্যোতির্ময়ী দেবী, সমরেশ বসু, শক্তিপদ রাজগুরু, প্রফুল্ল রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক প্রমুখের নাম অবশ্যই মনে পড়া উচিত। অনেকগুলি পত্রপত্রিকা দেশভাগ নিয়ে বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করেছেন। বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে অনেক পাঠচক্র হয়েছে এবং হচ্ছে।
এই আবহে এ উপন্যাস লেখা হলেও এর অন্তর্গত গোত্র প্রায় সম্পূর্ণই স্বতন্ত্র। একদিকে এর অন্দরমহলে নিরন্তর এক বিষাদঘন রাগিণীর ফল্গুস্রোতের সঙ্গে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কুটিল ষড়যন্ত্র আছে, তেমনি অন্যদিকে সমকালীন সমাজের একটি প্রচ্ছন্ন রূপরেখার পাশপাশি লেখকের কবিতা ছুঁয়ে-থাকা কলমের সাবলীল গতি উপন্যাসটিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে; তবে এসবই ছাপিয়ে গেছে জাদুবাস্তবতাময় অনবদ্য এক চরিত্র। বাংলা উপন্যাসে এই বনদেবী চরিত্রটি খুব সম্ভবত অনন্য গোত্রভুক্ত। সূক্ষ্ম বিচারে চরিত্রটির আড়ালে লেখকের সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবনার ছায়া আছে।
উপন্যাসের শুরুই হয়েছে এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখে,যা সমগ্র উপন্যাসের গতিপথের ইশারা দেয়। ঘটনাটি চমকপ্রদ,- মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিলের সভ। সভাপতি মহম্মদ আলি জিন্না। সভা শুরু হবে আব্বাসউদ্দিনের গান দিয়ে; বাংলার প্রাণের মানুষ আব্বাসউদ্দিনকে দেখতে এসেছে পদ্মা-গঙ্গার দু-পারেরই অসংখ্য মানুষ; কিন্তু ‘উজিরে আজম’; জিন্না চান না এ সভায় কোনো গান হোক- ‘আই সে, নো সং, গান নেহি চলেগি’। জনগণের প্রবল আপত্তি। তারা জানালো, আব্বাসউদ্দিনকে দেখতে, তাঁর গান শুনতেই তাদের এখানে আসা। শেষ পর্যন্ত জনতার দাবির কাছে মাথা নোয়ালেন। আসলে আব্বাসউদ্দিন তো মুসলমান বা হিন্দু নন, তিনি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাংলার প্রাণের মানুষ। অত্যন্ত সুকৌশলে ঔপন্যাসিক সূচনাপর্বেই এ উপন্যসের তার এভাবে বেঁধে দিয়েছেন।
একই সঙ্গে অতীত ও বর্তমান জাদুবাস্তবতার মন্ত্রে হাত ধরাধরি করে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে উপন্যাসটিকে। এই সূত্রেই ভিন্ন দুটি পটভূমি ভিন্ন স্থান ও কালের হলেও জাদুকরী মায়ায় শেষে এসে অনন্ত কালমহিমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এখানেই ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ উপন্যাসের অভিনবত্ব। একদিকে এপারের বইপাগল বিমল চন্দ, সুচরিতা, অখিল, নিখিলেরা, অন্যদিকে ওপারের আতিকুজ্জামান, রহিম, রব, শহিদুলেরা। এই দু’পারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অতিপ্রাকৃত সত্তা আঁখিমঞ্জিলের আঁখিতারা; এছাড়া আর একটি আশ্চর্য চরিত্র বনদেবী, যার মধ্যে মিশ্র অলৌকিকতার সঙ্গে লুকিয়ে আছে এক বুদ্ধিদীপ্ত, প্রতিবাদী, মানবিক মূর্তি; যে কাহিনিতে দেখা দেওয়ার পর থেকে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়িয়েছে অজস্র চমক নিয়ে।
এই উপন্যাসে প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন দু’ভাবেই রাজনীতির অবিসংবাদিত ভূমিকা। প্রথমত, দেশভাগ ও তার পরবর্তী কালের দুই বাংলার রাজনীতি; দ্বিতীয়ত, এই বাংলার সাম্প্রতিক কালের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা। অখণ্ড ভারতের দ্বিখন্ডীকরণে তৎকালীন অনেক রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থান্ধ সক্রিয়তার পাশাপাশি কয়েকজন নেতা ও সাধারণ মানুষের যথার্থ দেশপ্রেম এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্বস্ত বাস্তবতা এখানে ধরা পড়েছে। লেখকের কাছে আতিকুজ্জমান ও তার দুই ছেলে কাহিনিতে গান্ধী, নেহেরু ও জিন্নারই রূপকপ্রতিম হয়ে উঠেছে। বাবার ‘হাঁটানো মেয়েকে’ পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে বড়ো ছেলে রব বন্ধুকে দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, এই হত্যাকে সামনে রেখে কট্টরবাদী রব চেয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে। আতিকুদ্দিন আর তার অন্য ছেলে রহিম কিন্তু এই সর্বনাশা ক্রিয়া-কর্মের বিরোধী। এভাবেই লেখক অত্যন্ত সাবলীলভাবে বাস্তবতার ভারসাম্য রক্ষা করেছেন, আলাদা করেছেন মৌলবাদীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে। এই দেশভাগের ফলে ভিটে হারানোর যন্ত্রণা, প্রতিভার অপমৃত্যু, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় ছিন্নভিন্ন সংসারের সংকট সময়ের কারণেই হয়তো কিছুটা ধূসর হয়ে যেতে পারত, কিন্তু পরবর্তী কালপর্বে উদ্ভূত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেই ধূসরতাই অন্য চেহারায় যে দেখা দিল, সেই বাস্তবতাও অবিমিশ্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অমর। সাম্প্রতিককালে প্রাদুর্ভূত প্রোমোটাররাজের দাপটে বিমল চন্দ্রকে যেভাবে প্রতিদিন হুমকি সহ্য করতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয়ে আঁখিমঞ্জিল ছাড়তে হয়েছে, তা ভিটে মাটি ছাড়ার চেয়ে কম কীসে! মোটা টাকার টানে অনেকেই নিজের বাড়ি ছেড়ে বহুতলের ফ্ল্যাটে (বিনা ভাড়ার খুপড়ি) ঢুকছে; কিন্তু যারা তা চায় না তারাও প্রোমোটারিরাজের দাপটে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। নগর ও মফস্বল জীবনের এই দুর্ভাগ্যজনক ছবি যেন বারবার বলতে চায় যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে র্যাডক্লিফ লাইনে চাপা পড়ে যাওয়া আমাদের রক্তক্ষরণ রকমারি চেহারায় সমান্তরালভাবে এখনও চলছে।
এ উপন্যাসে সচেতন লেখক সাম্প্রতিক কালের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয় এনেছেন। এটি বাংলার তথা সারা ভারতেরই কথা। আমরা জানি শাসক সর্বদাই চায় শাসিতের নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও অন্ধ অনুসরণ। আমাদের দেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেও ইদানীং এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে, যা ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী। উত্তরস্বাধীনতা কাল থেকেই দেখেছি, হিন্দি ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা। আজকাল তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ম ও সংস্কৃতির খুব গভীর ও শীতল আক্রমণ। খাদ্যাভাসেও তার ছায়াপাত চলছে। একে তো বাঙালির নগরজীবনে পরানুকরণের একটা ব্যাপক প্রবণতা আছে। তার ওপর ইদানীং ভিন্নতর জীবনচর্যার চাপে বাঙালির তথাকথিত প্রশস্ত উদার বুক শীর্ণ ও সংকুচিত হতে হতে বিপন্নতার প্রায় প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সুযোগে সুপরিকল্পিতভাবে তার খাদ্যাভাসেও অন্যের হাত পড়ছে। কাহিনির ‘ব্লু ভিউ’ আবাসনে আমিষ খাদ্য যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতারই ইশারা। এর সঙ্গে সঙ্গে সদ্যোজাত করোনা দেবীর পুজো চালু করবার জন্য হেমন্ত আগরওয়ালের চেষ্টার কথা অবশ্যই যুক্ত হবে। একই সঙ্গে এই পুজো বন্ধ করতে বনদেবীর সুচতুর প্রয়াসও যেভাবে দেখানো হয়েছে, তার গভীর তাৎপর্য আছে। এভাবেই বোধ হয় একজন লেখক তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। ‘র্যাডক্লিফ লাইন’-এর মূল দুটি কাহিনি এই দুই ভিন্ন ধারার উপন্যাসের প্রেক্ষিতে আমাদের খুব অপরিচিত নয়। একারণেই আগে বলেছি, এ উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ লেখকের কবিতালগ্ন কথনশৈলী, বিচিত্র জাদুময়তা আর বনদেবী নামের অনন্য চরিত্রটি। আগে বনদেবীর কথা বলি।
বনদেবী এক আশ্চর্য চরিত্র- প্রাইমারি স্কুলে ইব্রাহিম মিদ্দের মেয়ে বনবিবির নাম পাল্টে হয় বনদেবী। সাদী হয়েছিল তারই চাচাতো ভাই ধনু মিদ্দের সঙ্গে। তার বিবাহিত জীবন ও পরবর্তীকালে উপন্যাসে তার ভুমিকা রীতিমতো চমকপ্রদ; তথাকথিত সামাজিক শ্রেণিভুক্তির প্রেক্ষিতে বনদেবীর অমিত সাহস, দূরদৃষ্টি ও যুক্তিবাদী মানসিকতা অভাবিত ব্যাপার। আঁখিতারার মতো সে অতিপ্রাকৃত চরিত্র নয়, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অলৌকিক কিছু ক্ষমতার কারণে চরিত্রটি অনেকটা রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। সে ‘বাও-বাতাস’-এর চরিত্র বুঝে যেভাবে কথা ভাসিয়ে করোনা দেবীর পুজো ভণ্ডুল করেছে তা শুধু সুচরিতার কাছে নয়, আমাদের কাছেও একই সঙ্গে বিস্ময়কর ও প্রশংসনীয়। সে এসব ম্যাজিক না জানলে লোক তাকে মানবে না। সংস্কারমুক্ত বনদেবী এভাবেই সংস্কারকে কাজে লাগিয়ে বনবিবি হয়ে বিপন্নতা থেকে যেন মানুষকে বাঁচাতে চায়। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, চরিত্রটি লেখকের অন্যতম সেরা সৃষ্টি ।
সাধারণত অমর মিত্রের উপন্যাস অনেকাংশেই কবিতলগ্ন। একথার সমর্থন এ উপন্যসেও বহুত্র মেলে। চল্লিশ সংখ্যক পর্বের একেবারে শেষ দুটি অনুচ্ছেদ প্রায় কবিতার ভাষাতেই লেখা। কবিত্বের সঙ্গে এখানে জাদু- বাস্তবতার যোগে যে রসায়ন উঠে এসেছে তা নিবিড় মায়াময়তায় আচ্ছন্ন মন কেমন করে দেওয়া এক কবিতার দেশ।
অতিপ্রাকৃত চরিত্র আঁখিতারা বিমল চন্দ্রের কাছে যখন সন্ধ্যাতারা, সন্ধ্যামালতী কিংবা গন্ধরাজ ফুলের হয়ে যায় তখন সে আর অতিপ্রাকৃত থাকে না। তখন সে যেন একটা উজ্জ্বল কবিতার লাইন হয়ে যায় পাঠকের চোখে। কবিত্বের অনুভব পাই, নিঃসঙ্গতার প্রশ্নে বইপাগল বিমল চন্দ্র যখন বলে- ‘বই আছে।বইয়ের ভেতরে কত মানুষ। ইভান, মিতিয়া, আলিওশা-কারামাজভ ভাইয়েরা, কোপাই নদীর ধারের কাহাররা, শশী ও কুসুম, অপু ও সর্বজয়া’। কবিত্ব এভাবেই তো মানুষের একান্ত কল্পবৃত্তের বিস্তার আনে। তখন সে একা থাকলেও নিঃসঙ্গ নয়। দেশভাগ প্রসঙ্গে বিমল নন্দ পিছু হাঁটতে হাঁটতে পুরাণ প্রদেশে পৌঁছে যায় তখন তার মন কবির ভাষায় ভাবে- রঘুর দিগ্বিজয়ের ছবির ভেতর ছিল মহাকবির এক বৃহৎ অখণ্ড দেশের স্বপ্ন। একেবারে কবিয়ার ভাষায় বলে,- ‘পাসপোর্ট, ভিসা, সীমান্ত ক্রমশ মানুষকে মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। খুব দূর দূরবর্তী করে দিয়েছে।’ বিস্ময়করভাবে আঁখিতারার মুখে শুনি জীবনানন্দের মৃত্যুকথা; আসলে আঁখিতারা তো নয়, লেখকেরই মনে হয়েছে এই দেশভাগ গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল কবিকে। প্রকৃতিমগ্নতা তাঁকে বড়িশালের ‘আকাশ, বাতাস, হিজলের বন, সুপুরিবনের সারির প্রতি সেই ভালোবাসা এনে দিয়েছিল যা ‘মৌন করে দেয়, নিজের ভেতরে নিজেকে প্রবেশ করতে দেয়’। তাই আঁখিতারার ছায়ার আড়ালে থেকে তিনি দেখেছেন দুর্ঘটনার পর কীর্তনখোলা, সন্ধ্যাদেশের উদ্দেশ্যে কবির যাত্রাযন্ত্রণা; ‘সেই যাত্রা ছিল নয়দিন ধরে অবিরাম, নবমদিনে তিনি যেতে পারলেন’। এর পরেও জীবনানন্দ নানা সূত্রে নানা ইশারায় ধরা দিয়েছেন লেখকের কাছে। এ ধরনের মায়াবী কবিরা একবার মাথায় ঢুকে পরলে একবারের উচ্চারণে তাঁর ছায়া ফুরিয়ে যায় না। ব্যক্তিগতভাবে এই জাদুবাস্তবতাময় কবিত্বই এ উপন্যাস থেকে আমার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
‘Possible improbability’-র সূত্র মেনে কাহিনি প্রান্তিক বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। জাদুবাস্তবতাকে সাময়িক-ভাবে পিছনে ফেলেছে ঘটনার অতিপ্রাকৃত সমাপতন। নানা দুর্ঘটনা ও কুসংস্কার আঁখিমঞ্জিলকে প্রায়-পরিত্যক্ত বাড়িতে পরিণত করেছে; আপাতভাবে মনে হতে পারে, যে সুরে এ উপন্যাস শুরু হয়েছিল, পরিণতি পর্ব তার থেকে অনেকটা সরে এসেছে; কিন্তু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যাবে যে লেখক কাহিনিকে সময়ের হাত ধরে এগোতে দিয়েছেন। দেশভাগের ফলে যে সংকট ও যন্ত্রণার জন্ম হয়েছিল, অনেকটা তারই বিবর্তনের পথ ধরে আজকের সমাজ-বাস্তবতা গড়ে উঠেছে। সেদিনের বাস্তবতাই আজকের অবিশ্বাস, নির্বোধ গোঁড়ামি এবং স্মৃতি মেদুরতার পথ ধরে ভিটেমাটি হারানোর দীর্ঘশ্বাস, এমনকি সাংস্কৃতিক বিপন্নতার অনেকখানিই রচনা করেছে।