১)
‘লুচিগুলো ফুলছে না কেন আজ?’ কড়াইয়ের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে পম্পা ঝাঁজরিহাতা দিয়ে একটু করে তেল কাছিয়ে লুচিগুলোর পেট বরাবর দিয়ে ধারের দিকে হালকা করে চাপ দিতে লাগল। দুটো লুচি এতে একটু ফুলে উঠল বটে, কিন্তু বাকী কটা যেমন ন্যাতানো চ্যাপটামত মত ছিল তেমনিই রয়ে গেল। ওদিকে আলুরদমের বাটিটা গরম হয়ে চড়চড় আওয়াজ করছে, এইরে ধরে গেলেই চিত্তির। তাড়াতাড়ি আঁজলা করে জল ছিটিয়ে হাতা দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেয়। হিং গরম মশল্লার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে রান্নাঘর, খাবার ঘর বসার ঘর জুড়ে। রমেন খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চটি ফটফটিয়ে খাবার টেবলে এসে বসে। দুই ছেলেও এসে বসে। ‘কই হে দ্রৌপদী কী এত রাঁধছ? চা জলখাবার জুটবে টুটবে নাকি?’ রমেন হাঁক পাড়ে।
পম্পা লুচির থালা, আলুরদমের বাটি আর কটা জলখাবারের ছোট থালা দু’হাতে ব্যালেন্স করে আনতে আনতে মনে মনে ভাবে লুচিগুলো ফুলল না, আজ আছে কপালে। থালাগুলো সাজাতে সাজাতে মুখে একটু হাসি টেনে আনার চেষ্টা করে বলে ‘আজ বাপু আমার শরীরটা তেমন জুৎ নেই, দুপুরের খাবারটা একটু বাইরে থেকে আনিয়ে নিও তোমরা।’ রমেন রেগে উঠতে গিয়েও সামলায় নিজেকে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে ‘চাকরিটা তো ছেড়ে বসলে, এত কেনাকাটির খরচতোমার কোন বাপে দেবে শুনি?’ পম্পা মুখ খোলার আগেই বড়ছেলে বলে ওঠে ‘থাক না বাপী, আজ দোলের দিনে একটু ভালমন্দ খাবার আনিয়েই নিই, আমার কাছে টাকা আছে অর্ডার করে দেব আমি। ‘রাগটা গিলে ফেলে রমেন বলে ‘তবে আর কি! বড়লোক রোজগেরে ছেলে তোমার, খাও ঠ্যাঙের ওপরে ঠ্যাঙ তুলে বসে।’
ছোটছেলের সকালে একটা ডিমের পদ না হলে চলে না। সেই ছোটোবেলা থেকেই প্রাতরাশে ডিম না থাকলে ছেলে কিচ্ছু না খেয়ে উঠে যায়। আজকেও লুচির পেট ফাঁসিয়ে পাতলা টুকরো ছিঁড়ে নাড়াচাড়া করছে কেবল, মুখে তোলে নি। পম্পা বলে উঠিস না, দিচ্ছি তোর ডিম এনে। অমলেট করবে ভেবে ফেটিয়ে রেখেছিল, এখন তাড়াতাড়ি ফ্রাইং প্যানে ঢেলে নেড়েচেড়ে স্ক্র্যাম্বল করে নেয়। প্যানের ধারের দিক থেকে ঈষৎ সাদাটে হয়ে ওঠা ডিম মাঝের দিকে ঠেলে আনতে আনতে ভাবে আর একটু বেশি করে করলে হত। যদি বাপ আর বড়ভাইও খেতে চায়! কে জানে চ্যাপটা লুচিগুলো খাচ্ছে কিনা। খাবার ঘর থেকে দুই ভাইয়ের গলা শোনা যায়, রাকেশদের হাউসিঙে হোলিখেলা হবে ওরা সেখানেই যাওয়ার প্ল্যান করছে। হোলি... দোল পম্পা টের পায় কপালের ডানদিকের টিপটিপানি বেড়ে হাতুড়ি পেটার দিকে যাচ্ছে। মাইগ্রেন অ্যাটাক – বছরে এই একটা দিন ওর হবেই হবে।
২)
রমেনদের বাড়িটা এখনো ফ্ল্যাট হয় নি, ঠাকুর্দার বানানো পুরানো আমলের একতলা বাড়িতে বাবা আধুনিক ধরণে দোতলা করেছিল। ওতেই দিব্বি চলে যাচ্ছে, দুই ছেলের বিয়ে হয়ে গেলেও অসুবিধে হবে না, একতলার ভাড়াটেকে উঠিয়ে দিলেই দিব্বি কুলিয়ে যাবে সবার। তবে ছেলেরা এখানেই থাকবে কিনা জানে না, আজকালকার ছেলে, হয়ত কলকাতায় গিয়ে ভাড়াবাড়িতেই উঠল। রমেনের প্রাইভেট কোম্পানি, ৬৫-৬৬ বছর অবধি আরামসে কাজ করতে পারবে। কিন্তু পম্পা হঠাৎ কোন পরামর্শ না করেই দুম করে লাইব্রেরীর চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। দিব্বি ছিল, বিকেল তিনটেয় যেত আর রাত সাড়ে ন’টার দিকে চলে আসত। সকালে বর ছেলেদের অফিস, ইস্কুল কলেজ যাওয়ার তদারক, টিফিন গুছিয়ে দেওয়া কোনটাতেই কোন অসুবিধে হত না। এদিকে মাস গেলে হাজার কয়েক টাকাও দিব্বি ঘরে আসত।
‘বেয়াড়া মেয়েছেলে’ এইটাই পম্পার সম্পর্কে তার বর, শ্বশুর শাশুড়ি মায় বাপ মা পর্যন্ত বরাবর বলে এলো। কলকাতা ঘেঁষা ওদের মফস্বল ছিল গ্রাম আর শহরের একটা পাঁচমিশালি জগাখিচুড়ি। ছিল নয় এখনো আছে আসলে ওইরকমই। জায়গায় জায়গায় পাঁচতলা বড়জোর ছয়তলা ফ্ল্যাট উঠেছে, জি+৫ বা জি+৬ বলে লোকে। একতলায় পার্কিং, ছাদের কার্নিশে বাহারি রেলিং। আবার একই পাড়ায় পরপর কটা দোতলা তিনতলা এমনকি একমেটে ছোট্ট একতলা বাড়িও আছে। মফস্বলের মাঝ বরাবর দুইখানা টানা লম্বা রাস্তা জিটি রোড আর ট্রেনলাইনের মধ্যে যোগাযোগ করে। বড় রাস্তার ধারে বাজার বসে সকাল বিকেল, বড় দুটো বাজারও আছে রেলস্টেশন আর বাসরাস্তার ধারে। এইসব ফ্ল্যাটবাড়ি অবশ্য এই গত কুড়ি বচ্ছর ধরে একটা দুটো করে হচ্ছে। পম্পার বিয়ের সময় গোটা মফস্বলে একটাই ফ্ল্যাট ছিল, বাসরাস্তার দিকে।
রাজেন্দ্রামোহন পাবলিক লাইব্রেরীর চাকরিটা পম্পা পেয়েছিল বিএ পাশ করে বেরোতে না বেরোতেই। ডেকে নিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন তখনকার লাইব্রেরিয়ান হারানবাবু। বাবার বন্ধু ছিলেন, পরীক্ষা শেশ হতেই এসে বলে গেছিলেন রেজাল্ট বেরোলে দেখা করতে। পম্পা ততদিনে পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক সঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য। গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে ছোটখাট নাটকেও পার্ট করতে শুরু করেছে। গান, নাটকের মহড়া সন্ধ্যে থেকেই হয়, ফলে শুরুতে চাকরিটা নেবার খুব একটা ইচ্ছে ওর ছিল না। কিন্তু বাবা নাকি কথা দিয়েছে হারানবাবুকে, ‘বেয়াড়া মেয়ে বাবার কথার মান রাখতে না পারলে যা বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে। যা দেখ গিয়ে কোন চুলোয় কে তোকে থাকতে দেয়!’ মা চীৎকার করেছিল পাড়া জানিয়ে। দাদাও তখন পুরোদস্তুর নাট্যকর্মী। লিটল ম্যাগাজিন, গণসঙ্গীত আর নাটক নিয়ে মেতে থাকে সারাদিন।
৩)
ছেলেরা ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বেরোতে বেরোতে বাবা মা’কে বলে গেল ওরা দুপুর আর রাতের খাবার অর্ডার করে দিয়েছে। ঠিক সময়ে এসে যাবে। ছোটছেলে রমেনকে বলে ‘দোলের দিনেও এমন উচ্ছেখাওয়া মুখে বসে আছো কেন? একটু বেরোও না, সবার সাথে দেখাও হবে। ‘বলেই টুক করে বেরিয়ে যায়। রমেনের মেজাজ জানা আছে ওদের। রানী আজ আসবে না কাজে, আগেই বলে গেছে। দোলের দিন আসে না কোনো বছরই। আগে তো লোকাল ট্রেনও বন্ধ থাকত বেলা বারোটা অবধি। তার পরে ট্রেন চালু হলেও ঘণ্টায় একটা করে চলত। এখন অবশ্য ট্রেন বন্ধ হয় না, বাসও চলে অল্প করে। তা রমেনদের বাড়িটা বাসরাস্তার কাছাকাছিই। দরকার না হলে ট্রেনে চাপে না তেমন। সে ছিল পম্পাদের বাড়ি। মাসের বাজার করতেও ওর বাবা বড়বাজার যেতেন, ট্রেন ছাড়া অচল ছিল ওরা।
মাথাটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়, পম্পা রান্নাঘরের সিঙ্কে জলখাবারের বাসনগুলো নামিয়ে জল ঢেলে শোবার ঘরে চলে আসে। ছেলেরা বড় হবার পর থেকে বারান্দা লাগোয়া ছোট ঘরটায় একটা ক্যাম্পখাট পেতে নিয়েছে নিজের জন্য। ঘরটা বানানো হয়েছিল ঠাকুরঘর হিসেবে। পম্পার কোনোদিনই ঠাকুর বাকুরে মতি নেই, তাই সংসারের বাড়তি জিনিসপত্র রাখতেই ব্যবহার হত ঘরটা। শাশুড়ির ঠাকুরঘর একতলায় ছিল। উনি মারা যাবার পরে ভাড়া দেওয়া হয় একতলাটা। ভাড়াটেদের বেশ ভক্তিটক্তি আছে, ওরাই ব্যবহার করে একতলার ঠাকুরঘরটা। এই ঘরটার সবচেয়ে ভাল ব্যপার হচ্ছে লাগোয়া চিলতে বারান্দাটা। ওদের বসার ঘর আর শোবার ঘরের বাইরে অর্ধেক চাঁদের আকারে মস্ত বড় বারান্দা আছে, রমেন ওটাতেই বসে। কিন্তু এই চিলতে বারান্দাটা পম্পার একেবারে নিজস্ব।
তা এই বাড়ির কোনকিছুই ওর নিজস্ব মনে হয় না, হয়ও নি কোনোদিন। আর শুধু বাড়ির কেন, এই পৃথিবীতে কোথায়ও কি ওর নিজস্ব কিছু আছে আদৌ! চাকরিটা বাবার জন্য শুরু করতে হয়েছিল, বিয়ের পরেও ছাড়তে পারে নি রমেনের জন্য। দাদার জন্যই লাইব্রেরীর চাকরি করেও পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক সঙ্ঘের হয়ে গণসঙ্গীত গেয়ে নাটক করে বেড়াতে পেরেছে। সেইটুকুই ছিল ওর নিজের আনন্দে বাঁচা। বাবা মায়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতো দাদা। সেই দাদাটাও অমন করে চলে গিয়ে পম্পাকে একেবারে শূন্য করে দিয়ে গেল। সেই যে ওর বুকের মধ্যে একটা আস্ত মরুভূমি ঢুকে গেল, সে কেবলই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একটু একটু করে প্রাণরস শুষে নিয়ে ওকে এমন তব্দাধরা কাঠের পুতুল বানিয়ে দিল। ফুলশয্যার রাত থেকে রমেন হিসহিস করে বলত ‘দ্রৌপদী! দ্রৌপদী এসছে আমার ঘাড়ে!’ পম্পাকে ব্যবহার করত ঠিক বাথরুমের মত। ওই করেই দুই ছেলে হল দেড় বছরের তফাতে।
৪)
এলোমেলো কতকিছু ভাবতে ভাবতে কখন যেনো চোখটা লেগে এসেছিল পম্পার। হঠাৎই ঘুমের মধ্যে টের পায় কোথায় কারা গর্জন করছে। আঁতকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসতে গিয়ে গড়িয়ে যায় পম্পা, সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টের পায় হঠাৎ লাফিয়ে ওঠায় হাত পা কাঁপছে থরথর করে, কাঁপুনি টের পায় পেটের মধ্যেও। ওদিকে একতলায় কারা যেন একসাথে অনেক কিছু বলছে, দোতলার দরজায় কেউ দুমদাম করে ধাক্কা দিচ্ছে। কে? কারা? কী হয়েছে? আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে আসে পম্পার, ছাব্বিশ বছর আগের এক দোলের দিন হঠাৎই ফিরে এলো কি? ‘পম্পামাসিইইই’ দরজার বাইরে থেকে গলা চিরে চেঁচাচ্ছে কেউ। কোনোমতে টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলতে যায় – ‘খবরদার খুলবে না দরজা।’ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে রমেনও।
‘পম্পাআমাসিইইই’ এবার চীৎকারের সাথে মিশে গেছে কান্নাও, আরে এ তো সুনেত্রা, সুনু। একতলায় কারা যেন গাইছে ‘বেশরম রঙ...’ সঙ্গে তীক্ষ্ণ সিটি আর অশ্লীল চীৎকার। ওরা কি সিঁড়ি দিয়ে উঠেও আসছে? পম্পা দিকবিদিক ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দরজা আগলে দাঁড়ানো রমেনের উপরে, সজোরে দাঁত বসিয়ে দেয় ওর হাতে। রমেন ঝাপটা মেড়ে ছাড়াতে যায়, কিন্তু পম্পা যেন মরণকামড় বসিয়েছে, একটুও সরে না। রমেন কাতরে উঠে পাশে সরতেই পম্পা হাট করে খুলে ধরে দরজাটা। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পম্পার বুকের ওপরে ভেঙে পড়ে মেয়েটা। ওকে ধরে নিয়ে খাবার টেবলে বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে চপারটা হাতে করে বেরিয়ে আসে পম্পা। নীচের ভীড়টা সত্যিই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছে। রংমাখা ভুতের মত কতগুলো ছেলে, আলাদা করে নাকমুখ বোঝা যাচ্ছে না, বাংলামদের গন্ধে গা গুলিয়ে বমি এসে যায়।
চপার হাতে পম্পাকে দেখে থমকে যায় দলটা। ‘আররে আন্টি হোলি কা সিম্পল মজাক হ্যায় আপ গুসসে কিঁউ হোতে?’ বলে একজন। আরেকজন চেঁচিয়ে বলে ‘ওয়ে নখরেওয়ালি নিকাল জলদি’। চপার দিয়ে নীচের দিকে দেখায় পম্পা, মুখে কিছু বলে না। থতমত খেয়ে দলটা নামে কয়েক ধাপ। ‘আন্টি সুনু আমাদের সাথেই খেলছিল তো জিগ্যেস করুন ওকে। এখন ফালতু ন্যাকামি মারছে’। পম্পা আবারো নীচের দিকে দেখায়, এবারে দলটা নেমে যায়। যেতে যেতে কয়েকটা অশ্লীল শব্দ ছুঁড়ে দিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে ফিরে দেখে দু’চোখে আগুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রমেন, টেবলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সুনেত্রা। ওকে ফিরতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ‘নষ্ট। নষ্ট মেয়ে। নিজের মতন জুটিয়েছিস আরেকটাকে।’ চপার তুলে শোবার ঘরের দরজা দেখায় পম্পা, চোখ নামিয়ে ভীতু ছাগলের মত সুড়সুড় করে ঘরে গিয়ে ঢোকে রমেন।
৫)
ছেলেরা ফিরেছে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যের পরে মস্ত থালার মত চাঁদটার দিকে তাকিয়ে চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল পম্পা, সুনেত্রা ওর বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। কোনোমতে অল্প কিছু খাওয়ানো গেছিল, সেই থেকে চুপ করে বসেই আছে। বড়ছেলে এসে ডাকল ‘মা’। এতক্ষণ ধরে কন্ঠায় আটকে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেলল ও – ‘হ্যাঁরে বাবু তুইও কি ওদের সাথে ...’ মাথা নীচু হয়ে যায় ছেলের। হাঁটুমুড়ে ঝুপ করে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে ‘হ্যাঁ প্রথমদিকে আমিও ছিলাম, আমিও রঙ মাখিয়েছি ওকে কিন্তু বিশ্বাস করো মা আমি আর কিছু করি নি, পরে ওদের থামাতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা ...।’ সুনেত্রা এই সময় আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। নিজের গলার আওয়াজে চমকে নিজেই নিজের মুখে হাত চাপা দেয় তাড়াতাড়ি। পম্পার সব গোলমাল হয়ে যেতে থাকে আবার। খাটে বসে ও কে? সুনেত্রা না পম্পা নিজেই?
সেদিন পম্পাও দোল খেলতে বেরিয়েছিল প্রত্যেক বছরের মতই। গণসঙ্গীতের দলের ওরা পূর্বাঞ্চলের ক্লাবঘরের সামনে আবির নিয়ে খেলেছিল প্রথমে, তারপর যা হয় খেলতে খেলতে ওরা বেরিয়ে পড়ে, এ পাড়া সে পাড়া, অলি গলি। রেল কলোনীর সামনে যেতেই যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো একদল। রঙমাখা মুখ দেখে কাউকে চেনার কোনও উপায় নেই। দলের বাকীদের ছেড়ে ওরা পড়ল পম্পাকে নিয়ে। দু’হাতে রঙ মাখাতে শুরু করায় রত্না শীলারা যখন ওকে পালাতে বলেছিল, তখন একটুও পাত্তা দেয় নি। সত্যি বলতে কি ওর মনে মনে একটু গর্বই হয়েছিল। ভেবেছিল ওদের তো আর রঙ দিচ্ছে না, ওকেই দিচ্ছে। তারপরেই সেই অশ্লীল হাসি, সিটির আওয়াজ আর হাতগুলো কাঁকড়ার মত আঁকড়ে খিমচে ধরছিল ওর বুক পেট, পাছা। আতঙ্কে দু’হাতে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করতেই একজন একটানে ভেজা কামিজের সামনেটা ছিঁড়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল বুকের ভেতরে।
তারপরে সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। কোত্থেকে দাদা এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ওকে হ্যাঁচকা টানে ওদের থেকে টেনে নিয়ে চীৎকার করে বলেছিল ‘দৌড়ো পাপু, বাড়ি না গিয়ে থামবি না খবরদার।’ ও দৌড়েছিল। তারপর ...মা’র সেই আগুনে মুখ, বাবার গালিগালাজ ‘নষ্ট মেয়ে! যাও আরো নাটক করতে!’ কারা এসে বলেছিল দাদার বডি পাওয়া গেছে লাইনে। সবাই বলল মদ খেয়ে দিক ভুল করে লাইনে উঠে ট্রেনে কাটা পড়েছে, বডিতে নাকি ভুরভুরে মদের গন্ধ। পম্পা চীৎকার করে বলতে চেয়েছিল ‘না না দাদা মদ খায় নি’, কেউ শোনে নি। সারা পাড়া দেখেছে ওকে ছেঁড়া জামা পরে দৌড়ে আসতে, ওকে দেখলেই লোকে সরে যেত, ঘরে ঢুকে যেত। আর কথা ...জ্বলন্ত শিকের মত ঢুকে যেত কানে সেসব। তারপরে রমেন এলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। বাবা মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওর বিয়ের পরে বাড়ি বিক্রি করে ওরা হরিদ্বার না বেনারস কোথায় চলে গেল। কোনদিন ওর খোঁজ নেয় নি আর।
৬)
ছোটছেলের ডাকে সম্বিত ফেরে পম্পার। কখন ঘরে ঢুকে এসে খাটে বসেছে মনে পড়ে না। দুই ছেলে, সুনেত্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছোটছেলে আলতো করে হাত দুটো নামিয়ে ওর কোলের ওপরে রাখে। ভ্যাবলামুখে ওদের দিকে তাকাতে সুনেত্রা, এখানো ফোঁপাচ্ছে অল্প অল্প, বলে ‘তুমি অমন করছিলে কেন মাসি? অমন আঁ আঁ আঁ আঁ করে চীৎকার’ বলতে বলতে একটু কেঁপেও ওঠে। ছোটছেলে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে মা বিশ্বাস করো দাদা শুরুতে ওদের সাথে থাকলেও, কিছু করে নি, বরং ওদের থামাতে চেষ্টা করেছিল। আর সুনুদি যা জোরে দৌড়ায়! ওকে কেউ ধরতেই পারে নি।’ সুনেত্রাও ঘাড় নাড়ে আস্তে করে। ‘হ্যাঁ মাসি ও কিছু করে নি। তুমি দরজা না খুললে ওরা ধরে ফেলত। তারপরে ...’ আবার ফুঁপিয়ে ওঠে। পম্পার মাথা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে আসছে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পরে পুব দক্ষিণ খোলা বড় বারান্দায় রমেন ছাড়া বাকী সবাই বসেছে এসে। সুনেত্রাকে আর বাড়ি যেতে দেয় নি পম্পা, ওর বাড়িতে ফোন করে দিয়েছে কাল সকালে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। চকচকে রূপোর থালার মত চাঁদ একটু ওপরে উঠে গিয়ে আর অতটা বড় দেখাচ্ছে না। পম্পা কতদিন পরে এই বারান্দায় এলো মনে করার চেষ্টা করছিল, পাঁচ বছর? দশ বছর? চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে ছাব্বিশ বছর আগের সেই দোলের দিনের কথা। বলা শেষ করে টের পায় বুকের ভেতরের খাঁ খাঁ মরুভূমিটা কেমন সজল হয়ে উঠছে, মরূদ্যান জন্ম নেবে এইবার। বলে ‘ভেবেছিলাম চাকরি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব, যেখানে কাজ করে দিলে চাট্টি খেতে দেবে। কিন্তু নাহ, পালাবো না আর। অনেক কাজ সামনে। তাছাড়া তোদের বাবাকেও কটা কথা জিজ্ঞাসা করার আছে।