রুস্তম শেখের মাংসের দোকানটা শেখপাড়া বাজারের পশ্চিম দিকে বাঁকড়া খালের ধারে। বাইরের দুনিয়া তথা কলকাতার দিকে যাবার যাবতীয় পথ পূর্বমুখী বলে এদিকটা অতটা সরগরম হবার কথা নয়, কিন্তু উত্তরদিক থেকে আসা এই বাঁকড়া খালটা দক্ষিণ দিকে বইতে বইতে মৌরীগ্রামে হুগলী নদীতে গিয়ে পড়েছে। ফলে নৌকা করে মালামাল পরিবহনের জন্য খালটা জনপ্রিয় এবং খালের শেখপাড়া ঘাটটা মোটামুটি জমজমাট। বাঁকড়া-মুন্সীডাঙা অঞ্চলটা মূলত কৃষিপ্রধান। শাকসবজি যেমন তেমন এদিকে আমন আর বোরো ধান, দেশি আর তোষা পাট বেশি চাষ হয়। ইদানীং শীতকালে কেউ কেউ গম, যব, আলু আর সর্ষের চাষও করেন। হুগলী নদীর ধারের পাটের কলগুলোতে পাট নিয়ে যেতে বা একটু দূরের হাট-বাজারগুলোতে ধান নিয়ে যেতে খালটা বেশ কাজের। আজকের ডানকুনি অঞ্চলের হেজে মজে যাওয়া ছোট ছোট জলাগুলো এককালে নাকি বিশাল এক হ্রদ ছিল, বর্ষাকালে সেটাকে স্থানীয়দের কাছে সাগর বলে ভ্রম হত। সেই হ্রদ থেকে উৎপন্ন নদীটিই নাকি এখন শুকিয়ে খাল হয়েছে, ডানকুনির জলার সাথেও তার আর যোগ নেই। কেউ কেউ এটাকে হুগলী নদীর শাখানদী বলে মনে করেন। মানে, উজানে হুগলী নদীতে উৎপন্ন হয়ে ভাটিতে একই নদীতে গিয়ে পড়েছে। পরে পলি পড়ে উজানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেটা খাল হয়ে গেছে। এসব কথা আজ আর প্রমাণ করার উপায় নেই। উজানের অজ্ঞাত উৎসের সাথে বাঁকড়া খালের সংযোগ বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেছে। উৎসে মরে গেলেও খালটা এখনো বেশ চওড়া আর গভীর, হুগলী নদীর জোয়ার-ভাটার টান এখানে বেশ বোঝা যায়। ফলে হুগলী জেলার বলাগড়ে বানানো বজরা, পাতাম অথবা বাতনাই নৌকাগুলো ধান বা পাট বোঝাই করে খাল ধরে অনায়াসে হুগলী নদীতে চলে যেতে পারে। খালের পশ্চিম দিকের জঙ্গলপুর বা আলমপুরের পশুর হাটগুলোর তেমন নামডাক না থাকলেও একটু দূরের ধুলোগরী অথবা আরও দূরের বীরশিবপুরের হাটগুলোর বেশ নাম আছে। সেসব হাটে দুধেল গাই, হালের বলদ, পালের ষাঁড়, বলির পাঁঠা তো বটেই ভেড়া, গাধা আর ঘোড়াও পাওয়া যায়। যেখানে নৌকা চলার জন্য নদী বা খাল, অথবা গরুর গাড়ি চলার জন্য ভালো পথ নেই সেখানে মালামাল পরিবহনের জন্য ঘোড়া আর গাধা বেশ কাজের জিনিস। ঘোড়া দিয়ে কখনো কখনো ফসলি জমির আড়াআড়ি বা কোনাকুনি পথও পাড়ি দেয়া যায় বলে মাল পরিবহনে তার চাহিদা ভালো।
রুস্তমের দোকানটা ছোট, বেচাবিক্রিও তেমন ভালো না, তাই তাঁর দোকানের জন্য প্রতিদিন গরু বা পাঁঠার দরকার পড়ে না। সপ্তাহে একদিন জঙ্গলপুর বা আলমপুরের ছোট হাট থেকে একটা গরু আর সাত-আটটা পাঁঠা কিনলেই চলে। সেগুলো বাড়িতে তাঁর বৌ জাহেরা আর দুই মেয়ে সায়েরা আর মাহিরার তত্ত্বাবধানে থাকে। বাংলা ১৩৪৬ সনে যখন সায়েরার বয়স দশ, মাহিরার বয়স ছয় তখন তাদের মা জাহেরার বয়স পঁচিশ বছর। তাদের তিনজনের কাছেই গরু-ছাগলগুলো খেলার সাথীর মত। রুস্তমের নিজের বয়সও তখনো ত্রিশ হয়নি। গরু-ছাগল নিয়ে বৌ-বাচ্চাদের আহ্লাদীপনা তারও ভালো লাগে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় এসব হাড়-মাংস কাটাকুটি ছেড়ে দিয়ে গরু-ছাগল পেলেপুষে দুধের ব্যাবসা করবেন। কিন্তু সেটা তাঁর পৈত্রিক ব্যাবসা নয়, দুধের গরু পালার ব্যাপার-স্যাপারও তাঁর জানা নেই। বৌ জাহেরা কসাইয়ের মেয়ে বলে তিনিও ওসবের কিছু জানেন না। মুসলমানদের মধ্যে জাতিভেদ নেই এটা একটা কেতাবি কথা মাত্র। বাস্তবে বিত্ত বা পেশা বিচারে জাতিভেদ মুসলমানদের মধ্যেও কম না। কসাই, মেথর, চামার, জেলে, নাপিত, কলু, জোলাদেরকে মুসলমানরাও ‘নিচু জাত’ বলে মনে করেন। কসাই পরিবারের ছেলের আর্থিক সামর্থ্য যত ভালোই হোক, অথবা তিনি যত শিক্ষিতই হন না কেন, খুব সহসা কসাই ভিন্ন অন্য কোনো পরিবার তাঁর কাছে নিজেদের মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। কসাইয়ের ঘরে জন্মে, কসাইয়ের মেয়ে বিয়ে করে রুস্তমের পক্ষে অন্য কোনো পেশায় যাওয়া সম্ভব না — যদি না তিনি চোর-ডাকাত হন, অথবা অন্য কোনো ‘নিচু জাতের পেশা’ গ্রহণ করেন। সপ্তাহের দিনে রুস্তমের একটা পাঁঠা আর জুম্মাবারে তার সাথে একটা গরু কাটলেই চলে। কাটাকুটির কাজটা দোকানের পেছনের ঘরে সারা হয়। এলাকাটা মুসলমান প্রধান হলেও গরুর মাংস দোকানের সামনে ঝোলানো হয় না। গরু আর পাঁঠার মাংস পাশাপাশি ঝুলিয়ে রাখলে বিক্রি হবে না। বিশেষত, পাঁঠার মাংসের মূল ক্রেতা কালীতলা, পালপাড়ার সামর্থ্যবান হিন্দুরা গরুর মাংস দেখলে আর দোকানে ঘেঁষবেন না। যদিও সবাই জানেন রুস্তম পাঁঠার পাশাপাশি গরুর মাংসও বেচেন।
কসাই পরিবারের মেয়েরা কয়েক দিনের জন্য গরু-ছাগল পালন ছাড়া মাংস কাটাকুটি মোটামুটি পারেন, বাঁশ বা সুপুরির কাণ্ডের উপরে মোটা রোঁয়ার বালি দিয়ে তাতে ছুরি-চাপাতি ঘষে শান দিতে পারেন। তবে ছোটবেলা থেকে তাঁরা যে কাজটা খুব ভালো পারেন, সেটা হচ্ছে উজুড়ি বা বট সাফ করা। ছুরি দিয়ে কেটে ভেতরের গোবর-ময়লা পরিস্কার করা; ঝিনুক দিয়ে চেঁছে কালো চামড়া আর চাওটা পরিষ্কার করা; গরম জল, হলুদ আর চুণ দিয়ে ভেতরে বাইরে পরিষ্কার করে উজুড়িকে রান্নার উপযুক্ত করে তোলা। উজুড়ি নিয়মিত বিক্রি হয় না বলে কসাই পরিবারে সেটা নিয়মিত আমিষের উৎস হিসেবে চলে। রুস্তমের পরিবারে লেখাপড়ার চর্চ্চা, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। আসলে কসাইদের কারো পরিবারেই লেখাপড়ার ব্যাপার নেই। ‘মেয়েছেলের আবার পড়াশোনা কী?’ কথাটির সাথে ‘নিচু জাতের লোকদের আবার পড়াশোনা কী?’ কথাটি যখন যুক্ত হয় তখন সায়েরা আর মাহিরার লেখাপড়ার অবস্থা কী সেটা বোধগম্য। তবে মুসলমানের মেয়ে নামাজ-রোজা না জানলে, দোয়া-কালাম না শিখলে, কোরান পড়তে না পারলে বিয়ের বাজারে ঠেকে যেতে হবে। তাই সাত/আট বছর বয়স হতে সায়েরাকে গামছা-শাড়ি পরিয়ে, মাথা ঢেকে সরদারপাড়ায় আলীর দাদী’র কাছে এসব শিখতে পাঠানো হত।
আলীদের যৌথ পরিবার খুব ধনী না হলেও মোটামুটি অবস্থাপন্ন কৃষক পরিবার। আলীর দাদা জাকের আলী সরদার বিয়ে করেছিলেন রাউতড়ার মানিক পীরের খাদেমের মেয়ে উম্মে বাতুলকে। চার ছেলে আর এক মেয়ের জন্ম দিতে দিতে উম্মে বাতু্লের নাম ‘মান্নাফের মা’ হয়ে যায়। দু’মাস বয়সী নাতি ‘আলী’কে রেখে মেজো ছেলে নওশের আলী সরদার গুটি বসন্তে অকালে ইন্তেকাল করার পরে তিনি লোকমুখে ‘আলীর দাদী’ হয়ে যান। একবার ‘মালোয়ারির জ্বর’ আর ‘সান্নিপাতিক জ্বর’ দেশ-গ্রামের মানুষকে একেবারে কাবু করে ফেললো। মালোয়ারিতে ভুগে কারো পেট ফুলে শরীর ডিগডিগে হয়ে গেলো, সন্নিপাতিকে ভুগে দুয়েকজন অন্ধ হয়ে গেলেন। তবে তারচেয়ে ঢেড় বেশি মানুষ এই দুই রোগে ভুগে মারা গেলেন। মালোয়ারির জন্য কুইনাইন আর সান্নিপাতিকের জন্য চামড়া ফুঁড়ে সুঁই দেবার চিকিৎসা যে লোকের জানা ছিল না তা নয়। তবে সেসবে গাঁয়ের লোকের ভরসা কম, কিছু ভয়ও আছে। একথা কে না জানে যে চামড়া ফুঁড়ে সুঁই দিয়ে শরীরে ওষুধ ঢোকালে পুরুষ মানুষের মর্দামী চলে গিয়ে হিজড়ে হয়ে যায় আর মেয়ে মানুষ বাঁজা হয়ে যায়! তাই সেবার জাকের আলী সরদারকে মালোয়ারি নাকি সান্নিপাতিকে যখন ধরলো তখন হাতে পয়সা থাকলেও কলকাতা গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়নি। সপ্তাহ তিনেক ভুগে তিনি ইন্তেকাল করেন। ছেলেদের কেউ তখনো বিষয়বুদ্ধিতে দড় না হওয়ায় স্বামী মারা যাবার পরে পীরের খাদেমের পরিবারের মেয়ে উম্মে বাতুলকে সংসারের আয়ের মূল উৎস চাষবাসের ব্যাপারে পুরো মনোযোগ দিতে হয়। মাথার ঘোমটাটা কপাল পর্যন্ত টেনে কানের পেছনে এঁটে তিনি দ্রুত, শক্ত হাতে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। শিক্ষিত বলে হিসাব-নিকাশে কেউ আর তাঁকে ফাঁকি দিতে পারল না।
ছেলেরা বিষয়বুদ্ধিতে একটু শক্ত-সমর্থ হতে হতে ‘মান্নাফের মা’ যখন লোকমুখে ‘আলীর দাদী’ হয়ে গেছেন, তখন তিনি ঠিক করলেন দুনিয়াবি কাজকর্ম কিছু কমিয়ে আখিরাতের কাজকর্ম কিছু বাড়াবেন। হয়তো মেজো ছেলের অকাল মৃত্যুর শোক ধর্মচর্চ্চার আবরণে ঢাকতে চাইছিলেন, অথবা হয়তো তিনি যে মানিক পীরের খাদেমের মেয়ে সেটা নিজেকেই মনে করাতে চাইছিলেন। অতএব তিনি পাড়ার নাতনীর বয়সী মেয়েদেরকে দ্বীনি এলেম তালিম দেয়া শুরু করেন। তিনি প্রথমে মেয়েদেরকে ওজু করা (পবিত্রতার উদ্দেশ্যে প্রক্ষালন), ফরয গোসল করা (ধর্মীয় রীতিতে আবশ্যিক স্নান), নামাজ পড়া, ছোট সুরা মুখস্থ করা, দরকারী দোয়া মুখস্থ করা, রোজা রাখা – এসব শেখালেন। তারপরে তাদেরকে একটু একটু করে ক্বায়দা পড়া, আমপারা পড়া শেখাতে লাগলেন। এসব শিক্ষার পাশাপাশি মুসলমান মেয়েদের চলাফেরা-আচারব্যবহার কেমন হওয়া উচিত, কীভাবে পর্দা করতে হয়, কাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে হবে, বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতে কেমন আচরণ করতে হবে সেসব শেখাতেন। এসব শিক্ষার জন্য তিনি ছাত্রীদের কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা তো নিতেনই না, উলটো মেয়েদেরকে ক্বায়দা বা আমপারা কিনে দিতেন। কোনো কোনো দিন মুড়ি, চিঁড়ে, খই এবং এসবের সাথে গুড়, শসা, দুধ, কলা বা আম খেতে দিতেন। এমনিতে দ্বীনি এলেম শেখার ব্যাপারে মেয়েদের খুব বেশি আগ্রহ না থাকলেও খাবারের লোভে দরিদ্র পরিবারের কিছু মেয়ে নিয়মিত আসতো। সায়েরার খাবারের লোভ ছিল বটে, তবে তার শেখার আগ্রহও ছিল। সায়েরার খুব ইচ্ছা হত দ্বীনি এলেমের পাশাপাশি হিন্দুপাড়ার উচ্চ প্রাইমারী স্কুলে বাংলা, ইংলিশ, অংক – এসব পড়তে। কিন্তু হিন্দু পাড়ার স্কুলে অল্প কিছু মুসলমান ছেলে পড়লেও কোনো মুসলমান মেয়ে পড়ে না – এমনকি ধনী কৃষক পরিবারের মেয়েরাও না। খুব অল্প কিছু পরিবার যাদের কলকাতাতেও বাড়ি আছে তাদের কোনো কোনো মেয়ে সেখানকার স্কুলে যায়। স্কুলে পাঠালে মুসলমান মেয়েরা বেপর্দা-বেশরম হয়ে যায়, মুরুব্বীদেরকে মানে না, পালিয়ে গিয়ে হিন্দু ছেলের সাথে নিকে বসে – এমন কথা তো সবাই জানেন! তাই ওসব হারাম নাকি মাকরূহ কাজে না যাওয়াই ভালো।
বাংলা পড়া শেখার কথা সায়েরা একদিন ভয়ে ভয়ে আলীর দাদীকে বলেও ফেলে। আলীর দাদী কিন্তু মোটেও রাগ করলেন না। উলটো তিনি বললেন, মেয়েদের বাংলা পড়তে ও লিখতে, গোনাগুনতি শিখতে পারা উচিত। তাহলে তারা নামাজ শিক্ষাসহ ইসলামী বইগুলো পড়তে পারবে, নিজের বাচ্চাকাচ্চাকে দ্বীনি এলেম শেখাতে পারবে, খসম দূরে কোথাও কাজে গেলে তাঁকে চিঠি লিখতে পারবে, চিঠি লিখে নিজের বাবা-মায়ের খোঁজও নিতে পারবে। তাছাড়া মেয়েরা যদি গোনাগুনতি না শেখে, পাই পাই হিসেব করতে না পারে তাহলে সংসারের আয়-রোজগার বারো ভূতে লুটে খাবে। সায়েরার ইচ্ছার কথা শুনে আলীর দাদী ঠিক করলেন তিনি মেয়েদেরকে বাংলা আর হিসেবও শেখাবেন। এই কথা জানার পরে মেয়েদের বাবারা তো বটেই, আলীর চাচা মান্নাফ, ইয়ার নবী আর হারুনও বেঁকে বসলেন। সবার এক কথা, মেয়েছেলেদের এসব শেখার দরকারটা কী? দ্বীনি এলেম আরবীতে বলে সেটা মুখস্থ করলেই চলে, তার জন্য বাংলা লাগে না। এগাঁয়ের মেয়েদের সব আশেপাশের গাঁয়ে বিয়ে হয়, তাদের চিঠি লেখার দরকার নেই। আর অমন বিশেষ দরকার হলে চিঠি লেখার জন্য শ্বশুর, ভাসুর, দেবর বা ছেলেরা তো আছেই। তবে হ্যাঁ, গোনাগুনতি শেখার দরকার আছে বটে কিন্তু তার জন্য শ্লেট-পেন্সিলে আঁক কষার দরকার নেই। সেই আদ্যি কাল থেকে মেয়েরা মুখে মুখেই সেসব শিখেছে। নিজের ছেলেরা বা পাড়ার পুরুষেরা যে যাই বলুন, খাদেমের বেটি উম্মে বাতুল সেসবের তোয়াক্কা করেন না। তিনি যেটা ঠিক মনে করেন, সেটা তিনি করেই ছাড়েন। এই যেমন, মেজো ছেলে নওশের মারা যাবার পরে তার যুবতী বউ মালেকা, অপোগণ্ড ছেলে নবী আর দুধের বাচ্চা আলীকে এই বাড়ি থেকে তাড়াবার জন্য তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে আর ছেলের বউয়েরা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি সেটা হতে দেননি। তার মানে এই না, যে, তিনি মালেকা আর তাঁর বাচ্চাদের দুধে-ভাতে রেখেছেন। মালেকাকে তিনি তিনজন বাঁদীর খাটুনি খাটিয়ে নেন। তাঁর পরিকল্পনা আছে আলী বড় হলে তাকেও তিনজন মজুরের খাটুনি খাটিয়ে নেবেন। মাঝখান থেকে নবী ছোঁড়াটাকে তার বড় খালা নিয়ে যাওয়ায় একটু ক্ষতি হয়ে গেছে। অতএব আলীর দাদী পাড়ার মেয়েদেরকে দ্বীনি এলেমের পাশাপাশি বাংলা আর হিসেবও শেখাতে লাগলেন। সায়েরার লেখাপড়ার ব্যাপারে রুস্তমের খুব একটা সায় না থাকলেও মেয়ের আগ্রহের কথা ভেবে বিশেষ কিছু বলেননি। তাছাড়া অভাবের দিনে তাঁদেরকে প্রায়ই আলীর দাদীর কাছে ধারকর্জ চাইতে হয় তাই তিনি চুপ করে গেলেন। অতএব সায়েরা দ্বীনি এলেমের পাশাপাশি বাংলা আর হিসেবও শিখতে লাগলো।
মাহিরা যখন বছর ছয়েকের তখন সায়েরার দেখাদেখি সেও আলীদের বাড়িতে যাতায়ত শুরু করলো। তবে মাহিরার দ্বীনি এলেম হাসিলের ব্যাপারে বা বাংলা শেখার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না। তার ভালো লাগত বছর পাঁচেকের ছোট আলীর সাথে কুমীর-ডাঙা খেলতে। আলী যখন আধো আধো গলায় ‘মাহিরাবু, মাহিরাবু’ বলে ডাকতে ডাকতে তার পিছু ছুটত তখন তার বেশ ভালো লাগত। মনে হত আলীর মত একটা ছোট ভাই থাকলে মন্দ হত না। গোটা ব্যাপারটা আলীর দাদীর একেবারেই পছন্দ ছিল না। প্রথমত, তিনি যখন অন্য মেয়েদেরকে পড়ান তখন উঠোনে বাচ্চাকাচ্চাদের খেলাধুলা, হৈচৈ তাঁকে বিরক্ত করত। দ্বিতীয়ত, কসাইদের মত আতরাফদের মেয়েদেরকে দ্বীনি এলেম শিক্ষা দেয়া যেতে পারে কারণ সেটা দ্বীনি দায়িত্ব, কিন্তু তাদের মেয়ের সাথে নিজের নাতির মাখামাখিটা মানা যায় না। তৃতীয়ত, পড়ুয়া মেয়েদেরকে তিনি যখন কিছু খেতে দেন তখন মাহিরা আর আলীও এসে খাবারের ভাগ চায়। আলী নিজের নাতি হলেও তাকে এবং তার মা মালেকাকে তিনি একটু শক্ত মুঠিতে রাখতে চান। যখন তখন খেতে দিলে বাচ্চা ছেলে আলীর নোলা বড় হয়ে যাবে। তাতে বড় হলে বার বার বেশি করে খেতে চাইবে। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। আর মাহিরা তো তাঁর কাছে পড়তে আসে না, তাহলে তাকে কেন খেতে দেবেন? তিনি তো আর পাড়াসুদ্ধ আণ্ডাবাচ্চাদেরকে খাওয়াবার দায়িত্ব নেননি। এজন্য আলী আর মাহিরাকে খেলতে দেখলেই তিনি তাঁর মেয়ে মাকসুরনকে বলতেন মাহিরাকে তাড়িয়ে দিতে।
জুম্মাবার = শুক্রবার
উজুড়ি বা বট = গরু-ছাগলের অন্ত্র
সাফ = পরিষ্কার করা
চাওটা = অন্ত্রের ভেতরে লেগে থাকা পরজীবী
দাদা/দাদী = ঠাকুরদা/ঠাকুমা
পীরের খাদেম = ধর্মগুরুর সেবাইত
ইন্তেকাল = পরলোক গমন
‘মালোয়ারির/সান্নিপাতিক জ্বর’ = ম্যালেরিয়া/টাইফয়েড
দুনিয়াবি = পার্থিব
আখিরাত = পরকাল
দ্বীনি এলেম = ধর্মীয় শিক্ষা
তালিম = শিক্ষা
ওজু করা = পবিত্রতার উদ্দেশ্যে প্রক্ষালন
ফরয গোসল করা = ধর্মীয় রীতিতে আবশ্যিক স্নান
নামাজ পড়া = প্রাত্যহিক প্রার্থনাসমূহ
ছোটো সুরা = কোরানের ছোটো অধ্যায়
দোয়া = মন্ত্র
রোজা = নিরম্বু উপবাস
ক্বায়দা = আরবী বর্ণপরিচয়
আমপারা = ছোটো ছোটো সুরা সম্বলিত কোরানের শেষ খণ্ড
মুরুব্বি = গুরুজন
নিকে বসে = বিয়ে করে
হারাম = নিষিদ্ধ
মাকরূহ = ঘৃণ্য
চাচা = কাকা
খালা = মাসি
আতরাফ = নীচ জাত