(এই আখ্যানের সকল চরিত্র, ঘটনাবলী ও ভৌগলিক অবস্থান সম্পুর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের কোন চরিত্র, ঘটনা, বা স্থানের সাথে কোন প্রকার মিল কাকতালীয় মাত্র এবং তা সম্পূর্ণরূপে লেখকের অনিচ্ছাকৃত। আখ্যানে বর্ণিত কোন চরিত্রের দেয়া বক্তব্যের দায় সংশ্লিষ্ট চরিত্রের মাত্র। তার জন্য কোনভাবে লেখকের দায় নেই।)
১.
শৈশবের যে সময়কালের বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি কেবল মানুষের মনে থাকে ঐ বয়স থেকে বাহ্রামের কাছে ‘পরী’ একটা আকর্ষণীয় বিষয়। বাহ্রামের মা বলতেন, বাহ্রাম যখন সবে হাত বাড়াতে শিখেছে তখনই সে কোন পরীর ছবি দেখলে খটখটিয়ে হেসে উঠে হাত বাড়াতো। সে কথা সত্যি হোক বা না হোক জ্ঞান হবার পর থেকে পরীর ব্যাপারে বাহ্রামের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং দিনে দিনে তা একটু একটু করে বেড়েছে।
পড়তে শেখার বয়সে বাহ্রামকে যেসব বড় বড় রঙিন ছবিওয়ালা বই কিনে দেয়া হয়েছিল সেগুলোতে থাকা সুশ্রী চেহারার, শাড়িপরা, পিঠে দুটো ডানাওয়ালা নারী ওরফে পরীর ছবি দেখতে দেখতে আর নানা জনের কাছ থেকে পরীর গল্প শুনতে শুনতে তার কাছে পরী দেখতে কেমন সেটা জানা হয়ে গিয়েছিল। সে জানতো পুরুষরা কখনো পরী হয় না, অন্তত পিঠে ডানাওয়ালা কোন পুরুষের ছবি সে কখনো দেখেনি বা গল্প শোনেনি। পরীদের গায়ের রঙ কখনো কালো বা শ্যামলা হয় না, তাদের পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল থাকে না, তাদের গায়ে অপার্থিব সৌরভ থাকে, তাদের গলার স্বর মিহি সুরেলা হয়, তারা শুধু রাতে চলাফেরা করে এবং তারা আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন জগত যেমন, পরীস্থান বা কোহক্বাফে বাস করে। পরীরা পৃথিবীতে ফুলের বনে ঘুরতে, ফুল তুলতে, মধু খেতে, প্রজাপতি ধরতে আর স্নান করতে আসে। স্নান করার সময় তারা তাদের ডানাগুলো খুলে জলাশয়ের পাড়ে রেখে দেয়। পরীরা ফুল, মিষ্টি, গান আর ছোট বাচ্চাদের ভালোবাসে। তারা মূলত স্বপ্নে দেখা দেয়, তবে কোন কোন সৌভাগ্যবান বাস্তবেও তাদের দেখা পায়, পরীদের সাথে তাদের বন্ধুত্বও হয়।
সাত-আট বছর বয়সে বাহ্রাম যখন বায়তুস সালাম জামে মসজিদে শুক্রবার সকালের মক্তবে কোরান পড়া শিখতে যায় তখন ইমাম সাহেবের ছেলে আসগরের সাথে তার বেশ ভাব হয়। আসগর জানায় তার বাবা এমনসব দোয়া-কালাম জানেন যেগুলো দিয়ে জ্বীনপরী বশে আনা কোন ব্যাপার না। জ্বীনের সাথে পরীর কী সম্পর্ক এমন প্রশ্নে আসগরে বলে, আসলে তারা একই জিনিস; শুধু ছেলেগুলোকে জ্বীন আর মেয়েগুলোকে পরী বলে। বাহ্রাম আসগরের সাথে তর্ক করে না, কিন্তু সে জানে আসগর ঠিক বলেনি। সে টেলিভিশনে ‘আলিফ লায়লা’ সিরিজে দেখেছে জ্বীনেরা দেখতে বদখত আর স্বভাবে খুব শয়তানপ্রকৃতির হয়। তাছাড়া জ্বীনের গায়ের রঙ কালো, মাথায় শিং থাকলেও পিঠে ডানা নেই। সুতরাং জ্বীন আর পরীরা এক জাত হতেই পারে না। আসগর ঠিক বলুক আর ভুল বলুক ইমাম সাহেব পরীদের বশ করতে পারে এমন ভাবনায় বাহ্রাম উৎসাহিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ইমাম সাহেবকে কী করে অনুরোধ জানানো যায় সেটা ভেবে কূল পায় না। আসগর তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার বাবাকে সে এইসব অনুরোধ করতে পারবে না। কারণ, তাতে ইমাম সাহেবের হাতে ব্যাপক ধোলাই হতে হবে। আমপারা পড়ানোর সময় ইমাম সাহেবের হাতের লিকলিকে বেতটা বাতাসে যেভাবে উঠানামা করে সেটা দেখলে আসগরের কথা বিশ্বাস না হবার কোন কারণ থাকে না।
২.
দাদী যখন বেঁচে ছিলেন তখন বাহ্রাম আর তার বড় বোন বেহ্নাজ তার দুপাশে শুয়ে ঘুমাতো। প্রতি রাতেই দাদীর কাছে বাহ্রামের আবদার থাকতো পরীর গল্প শোনানোর। বেহ্নাজ এতে বিরক্ত হতো — প্রতিদিনই কেন পরীর গল্প শুনতে হবে! তার পছন্দ ছিল ভূতের গল্প। এদিকে বাহ্রামের আবার ভূতকে বেজায় ভয়। রাতে অন্ধকার বারান্দা পার হয়ে বাথরুমে যেতেও ভয়ে তার কলিজা কাঁপে। দাদী বাহ্রামের আবদারে বিরক্ত হতেন না, তবে তার কাছে তো আর অফুরান পরীর গল্প ছিল না তাই পুরনো গল্পগুলোই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতেন। পরীর পুরনো গল্প শুনতে বাহ্রামের ভালোই লাগতো, কিন্তু বেহ্নাজ এতে রাগ করতো। বাহ্রাম বলতো, আব্জি, তুই যখন ভূতের পুরনো গল্প বার বার শুনতে চাস্ তখন কি আমি না করি? দাদী অবশ্য দুজনকেই প্রশ্রয় দিতেন — একদিন স্কন্ধকাটা ভূতের গল্প বলতেন তো পরের দিন বদিউজ্জামাল পরীর গল্প বলতেন। বাহ্রাম আর বেহ্নাজের কপালে দাদীর গল্প শোনার সৌভাগ্য বেশিদিন থাকেনি। বাহ্রাম দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় মাত্র একদিনের অসুস্থতায় দাদী মারা যান। দুই ভাইবোনের ঘুমুতে যাবার সময় দাদীর গল্প শোনার ব্যাপারটা ফুরিয়ে গেল, কিন্তু বাহ্রামের গল্প শোনার ব্যাপারটা ফুরায় না। বেহ্নাজ তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে, স্কুলের লাইব্রেরী থেকে প্রতি সপ্তাহে দুটো করে গল্পের বই নিয়ে আসে। দাদী না থাকায় সে-ই ছোট ভাইকে বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতে থাকে। প্রতি বিকালে দেখা যেতো রেলিং-এ হেলান দিয়ে, বারান্দার মেঝেতে পা লম্বা করে বসে বেহ্নাজ জোরে জোরে গল্পের বই পড়ছে আর তার সামনে বসে বাহ্রাম হা করে গল্প শুনছে। এই বৈকালিক গল্পের আসরেও বাহ্রামের আবদার ছিল পরীর গল্প শোনানোর। কিন্তু গল্পের বই তো আর তার দাদী নয় যে আবদার করলেই পরীর গল্প বলবে, তাই সেখানে যে গল্প লেখা থাকতো তাই শুনতে হতো। এই সমস্যার একটা আপাত সমাধান হলো যখন বাহ্রাম নিজেই গল্পের বই পড়তে শিখে গেলো।
শিক্ষার্থীদের মগজে সর্বতো উপায়ে ‘জ্ঞান’ ঢেলে দেবার মানসে শিক্ষকেরা স্কুলের লাইব্রেরীগুলোতে কেবল নানা প্রকার জ্ঞানের, চরিত্র গঠনমূলক আর বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীর রাখার চেষ্টা করেন। সেসব বই পড়লে শিশুকিশোরদের গায়ে জ্বর আসে। এমনকি সেখানকার ছড়া-কবিতার বইগুলোতে যেসব শিক্ষামূলক কবিতা থাকে সেগুলো পড়লেও তাদের গায়ে ঘাম দেয়। সেখানে রূপকথা, লোককাহিনী ধরনের বই প্রায় থাকেই না। এই কারণে বাহ্রাম স্কুলের লাইব্রেরীতে কয়েকদিন গিয়ে আর যায়নি। একটু খোঁজ নিতে দেখা গেল সহপাঠীদের ভেতর তো বটেই উপরের-নিচের ক্লাস ছেলেদের সাথে মিলেও গল্পের বই চালাচালির এক গোপন নেটওয়ার্ক আছে। সেই নেটওয়ার্কের সদস্যরা একে অন্যকে দুই/তিন দিনের জন্য বই ধার দেয়। এখানে টাকাপয়সা বা মেম্বারশীপের কোন ব্যাপার নেই। এখানকার অলিখিত শর্ত হচ্ছে — বই ছেঁড়া, কাটা, ভেজানো, দুমড়ানো, দাগানো, নষ্ট করা বা হারানো চলবে না; এবং অতি অবশ্যই বাসায় অভিভাবকদের হাতে বা স্কুলে শিক্ষকদের হাতে ধরা খাওয়া যাবে না। দুয়েকজন দায়িত্বহীন বেয়াক্কেল এসব শর্ত ভঙ্গ করার দায়ে নেটওয়ার্ক থেকে বহিষ্কার হয় বটে তবে বাকি সবাই নির্বিঘ্নে নেটওয়ার্কে থেকে নতুন নতুন গল্পের বই পড়ে যেতে থাকে।
বইপড়ার এই নেটওয়ার্কে দেখা গেলো ‘ঠাকুমা’র ঝুলি’ নামের এক প্রকার বই আছে। এর একটা মাত্র বইয়ে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের নাম লেখা থাকলেও বাকি বইগুলোতে কারো নাম নেই। সেসব বইয়ের কোনটাতে দশটা গল্প তো কোনটাতে পঞ্চাশটা গল্প। আসলে বিভিন্ন প্রকাশনী নামে-বেনামে আরব্য রজনী (আলিফ লায়লা), পারস্য রজনী (হেযার আফসানেহ্), শাহ্নামেহ্, হোজ্জার গল্প, বীরবলের গল্প, গোপাল ভাঁড়ের গল্প, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, পঞ্চতন্ত্র, বেতাল পঞ্চবিংশতি, জাতক, ঠাকুমা’র ঝুলি, মৈমনসিংহ গীতিকা, স্থানীয় লোককাহিনী ইত্যাদি সব উৎস থেকে গল্প নিয়ে নানা আকার-প্রকারের বই একই ব্রান্ড নেম ‘ঠাকুমা’র ঝুলি’ নামে বেচতো। ঠাকুমা’র ঝুলির এই বিভিন্ন প্রকরণে বাহ্রামের কোন আপত্তি ছিল না, কারণ সেখানে শুধু পরীদের গল্প নয় তাদের রেখাচিত্রও থাকতো। বাহ্রাম সেসব গল্প যেমন বার বার পড়তো তেমন লম্বা সময় ধরে অপলক চোখে পরীদের ছবিও দেখতো। যেহেতু গল্পগুলো বিভিন্ন দেশের উৎস থেকে আসতো তাই সেখানকার পরীদের মধ্যেও পার্থক্য থাকতো। একটা বিশেষ কারণে ঠাকুমা’র ঝুলির এই বইগুলো নেটওয়ার্কের অকালপক্কদের বেশ প্রিয় ছিল। যে সব উৎস থেকে গল্পগুলো সংগ্রহ করা হতো তার অনেকগুলোই কিশোরদের উপযুক্ত না। এমনকি সেসব গল্পের অলঙ্করণও ছিল বেশ প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী। বাহ্রাম অবশ্য সেসবের কিছু জানতো না। তাই স্বল্পবসনা পরীর রেখাচিত্রের দিকে তাকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে দেখে কেউ ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বললেও সেসব তার বোধে আসতো না।
৩.
স্কুলে আসাযাওয়ার পথে বাজারের ‘আদি গন্ধেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর সাইনবোর্ডটার দিকেও বাহ্রাম মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতো, কারণ সেখানে দুই দুইটি পরী থালাভর্তি মিষ্টি নিয়ে সাইনবোর্ডের দুই প্রান্ত দিয়ে উড়ে আসছে এমনটা আঁকা ছিল। বাহ্রাম যে পরীদের দেখে সেটা তার স্কুলের সহযাত্রীরা বুঝতে পারেনি। একদিন সহপাঠী জাভেদ তার হাত জোরে টেনে বলে, অ্যাই শালা! অমন হ্যাংলার মতো দোকানের মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? বাহ্রাম তাকে বোঝাতে পারে না যে সে মোটেই দোকানের মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিল না, বরং সাইনবোর্ডের পরীগুলোকে দেখছিল। জাভেদ তার কথা বিশ্বাস করে না — সাইনবোর্ডের পরীর ছবি দেখার কী আছে! পরদিন জাভেদ বলে, আয় আজ তোকে অন্যরকম পরীর ছবি দেখাই। তারা বাজারের বেশ ভেতরে রশীদ তসবিরওয়ালা’র ছবি বাঁধানোর দোকানে যায়। জাভেদ তাকে বোরাকের ছবি দেখায়। বোরাকের ছবি দেখে বাহ্রাম বিস্ময়ে হা হয়ে যায়। ডানাওয়ালা ঘোড়ার শরীরে এমন অনিন্দ্যসুন্দর নারীর ছবি সে আগে কখনো দেখেনি। তার রূপ, তার ডানা, তার সাজ-পোশাক-অলঙ্কার একেবারে পরী হবার মতো, কিন্তু তার ঘোড়ার মতো শরীর বাহ্রাম মানতে পারে না। পরীর শরীর মানুষের মতো না হয়ে ঘোড়ার মতো হবে কেন? সে বলে, এটা তো পরী না! জাভেদও স্বীকার করে এটা পরী নয়। তারপর সে বাহ্রামকে বোরাকের আখ্যান শোনায়। যেহেতু বোরাক পরী নয়, তাই তার ব্যাপারে বাহ্রাম আর কোন আকর্ষণ বোধ করে না।
অমন সময়ে একদিন বাহ্রাম পরীসংক্রান্ত এক দুর্ঘটনায় পড়ে। এক বিকালে মা তাকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে বাজার থেকে চা পাতা, চিনি আর গুড়ো দুধ আনতে বলেন। বাজারে যাবার পথে দেখা গেলো দর্জিপাড়ার ফরহাদ ছোট একটা চটের বস্তা নিয়ে ছুটছে আর তার সাথে একদল বাচ্চা ছেলে হই হই করতে করতে ছুটছে। ফরহাদ বাহ্রামের চেয়ে বয়সে অল্প বড় তবে বেশ ডাকাবুকো ছেলে। বাহ্রামকে দেখে তার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি খেলে। সে বলে, “অ্যাই বাহ্রাম! এই বস্তায় কী আছে বলতে পারবি”?
বাহ্রাম তার অজ্ঞতা প্রকাশ করে।
ফরহাদ বাহ্রামের পরীপ্রীতির কথা বিলক্ষণ জানতো তাই গোপন কথা বলার ভঙ্গীতে একটু ফিশ্ফিশ্ করে বলে, “বাচ্চা পরী”!
বাহ্রাম তার অবিশ্বাস প্রকাশ করে। উলটো জিজ্ঞেস করে সে কোথা থেকে পরী ধরে আনলো।
পরীর উৎসের ব্যাপারে কিছু না বলে ফরহাদ বলে, “বিশ্বাস করা না করা তোর ব্যাপার। এই দ্যাখ্ বস্তার ভেতরে পরী নড়াচড়া করছে। এটাকে এখন বাজারের পেছনের খালে নিয়ে পিটিয়ে মারবো”।
পিটিয়ে মারার কথায় বাহ্রাম হাহাকার করে ওঠে। তার মনে হয় না ফরহাদ মিথ্যা কথা বলতে পারে। সে পরীটাকে ছেড়ে দেবার জন্য কাকুতি মিনতি করে।
বাজারগামী বাহ্রামের পকেটে যে টাকা থাকতে পারে সেটা ভেবে ফরহাদ জানায় একশ’ টাকা দিলে সে বস্তাবন্দী পরীকে দিয়ে দেবে। বহু ঝোলাঝুলি করে বাহ্রাম পঞ্চাশ টাকায় রফা করে। টাকাটা পকেটে পুরতে পুরতে ফরহাদ জানায় বস্তাটা নির্জন জায়গায় খুলতে হবে নয়তো অনেক মানুষজন দেখে পরী ভয়ে পালিয়ে যেতে পারে। বস্তাবন্দী পরীকে বাহ্রামের হাতে দেয়া মাত্র ফরহাদ এক দৌড়ে কোথায় যেন পালিয়ে যায়। বাকি বাচ্চাগুলোও ফরহাদের পিছু পিছু দৌড় দেয়। হতভম্ব বাহ্রাম বস্তা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
ধারেকাছের নির্জন জায়গা মানে বাজারের পেছনের খালপাড়। সেদিকে যেতে যেতে বস্তার নড়াচড়া দেখে তার সন্দেহ হয়, কিন্তু তখন আর করার কিছু নেই — টাকা নিয়ে ফরহাদ পালিয়ে গেছে।
খালপাড়ে বস্তার মুখ খুলতেই ফোঁস শব্দে কিছু একটা ভেতর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। বাহ্রাম এক চীৎকার দিয়ে লাফ দিয়ে পেছনে সরে আসে। দেখা গেলো বস্তার ভেতর থেকে কালো রঙের, আড়াই-তিন হাত লম্বা একটা সাপ বেরিয়ে এলো। তীব্র আতঙ্কে সে পাথর হয়ে যায় — সে নড়তেও পারে না, চীৎকার করতেও পারে না। সাপটা অবশ্য তার দিকে না এসে খালের পাড়ের ঝোপের ভেতর ঢুকে পড়ে।
সেই রাতে বাহ্রামের প্রচণ্ড জ্বর আসে। সেটা কি বোকার মতো পঞ্চাশ টাকা খোয়ানোতে মায়ের মার খেয়ে, নাকি সাপ দেখে ভয় পেয়ে, নাকি পরী হারানোর শোকে তা বোঝা যায় না।
তার পর অনেক দিন বাহ্রামের মনে হতো ওটা হয়তো সত্যি পরী ছিল, কেবল সাপের রূপ ধারণ করেছিল। সে অযথা ভয় পেয়ে হেলায় সুযোগ হারিয়েছে।
৪.
বাহ্রামের বয়স বাড়তে থাকলে সে যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারে পরী একটা কাল্পনিক বিষয়, কিন্তু তার মন মানতে চাইতো না। জেলা লাইব্রেরীতে বিশ্বকোষ ধরনের বইগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে সে নানা দেশের পরীদের ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করতে থাকে। সে ছবি আঁকতে পারেনা বলে তার আফসোস হয়, কিন্তু সেসব ছবি তার মাথায় গেঁথে থাকে। তাই কেবল ছবি দেখে সে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রকার পরীদের আলাদা করতে পারতো। এই দেশের গল্পগুলোতে লালপরী, নীলপরী, ঘুমপরী, স্বপনপরী, ফুলপরী, জলপরী, মেঘপরী আর বনপরী ছাড়া অন্য কোন পরীর নাম পাওয়া যায় না। কিন্তু এতগুলো আলাদা নাম হলে কী হবে তাদেরকে আঁকা হয় মোটামুটি একইভাবে। এটা নিয়ে বাহ্রামের মনে ক্ষোভ আছে, কিন্তু কাউকে কি আর সেকথা বলা যায়! অথচ অন্য দেশের গল্পগুলোতে যেসব পরীদের কথা বলা হয় তাদের প্রকৃতিই কেবল ভিন্ন নয়, তারা দেখতেও ভিন্ন রকমের। এতসব পরীর মধ্যে বাহ্রামের পছন্দ ফুলপরী। সেই ফুলপরী দেশী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে দেখানো রূপকথার গল্পের ফুলপরী নয় যারা আসলে পিঠে শোলার ডানা লাগানো সাধারণ মানুষ, বরং গল্পের বইয়ে রেখাচিত্রে আঁকা ফুলপরী। ছবির সে ফুলপরীর রঙ নেই বটে, কিন্তু বাহ্রাম মনে মনে তাকে নিজের ইচ্ছেমতো রাঙিয়ে তোলে।
বাহ্রামের ছোটবেলায় তার মা নার্গিসের একটা কমলা রঙের শাড়ি ছিল। মা যেদিন সেই শাড়িটা পরতেন সেদিন তাকে সত্যিকারের পরী বলে মনে হতো। ঐসময়ে বড় বোন বেহ্নাজের একটা গোলাপী রঙের জামা ছিল — অনেক কুঁচি আর লেস দেয়া। ঐ জামাটা পরলে বেহ্নাজকেও তার কাছে পরী বলে মনে হতো। এমন পরীরূপী মানুষ বাহ্রাম তার জীবনে খুব একটা দেখেনি। কৈশোরে সে প্রতিবেশি রুখসারার আর প্রথম যৌবনে কলেজে গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের তারানার প্রেমে পড়েছিল। দুটো প্রেমই ছিল এক তরফা তাই ভুগতে হয়েছিল প্রচুর। সেই ভোগান্তির কালে যখন তার চিন্তাচেতনায় রুখসারা অথবা তারানা ছাড়া আর সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তখনও তার কাছে তাদের দুজনের কাউকেই পরী বলে মনে হয়নি। বাহ্রাম বিশ্বাস করতো একদিন না একদিন সে একটা সত্যিকারের পরীর মুখোমুখি হতে পারবে।
৫.
বাহ্রামের মাথায় রূপকথার পরী থাকলেও তার বাস্তবের জীবনটা আর রূপকথার মতো হয় না। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার বাবা এক অদ্ভুত দুর্ঘটনায় মারা যান। রাস্তায় দুটো বাস একে অন্যের আগে যাবার জন্য দ্রুত গতিতে ছুটছিল, ইচ্ছেমত পাশ কাটাচ্ছিল। তার একটা বাস হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাথ ছাড়িয়ে পাশের ‘ইরানী কাবাব ও বিরিয়ানী হাউসের’ দেয়ালে ধাক্কা মারে। এই প্রকার অবৈধ স্থাপনাগুলোর দেয়াল বিশেষ মজবুত হয় না, ফলে বাসটি দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে। রেস্তোরাঁর ভেতরে খেতে থাকা লোকজনের কয়েকজন ভেঙে পড়া দেয়াল আর বাসের ধাক্কায় আহত হলেও সেটা গুরুতর কিছু হয় না। কিন্তু দেয়াল ভাঙার সাথে সাথে সিলিং-এর কড়িবরগা মড়মড় করে দুলে ওঠে। সেই দুলুনিতে সিলিং-এ ঝোলানো একটা পাখা হুক থেকে ছিটকে বাহ্রামের বাবার মাথার উপর পড়ে। বেচারাকে বেশিক্ষণ কষ্ট পেতে হয়নি, দুর্ঘটনার প্রাথমিক ধাক্কা সবাই সামলে ওঠার কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি মারা যান। এই দুর্ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি। বাস-ট্রাক চাপা পড়ে কেউ মারা গেলে সেটার মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। মামলা হলে পুলিশকে তদন্ত করতে হয়, আসামীকে গ্রেফতার করতে হয়। এসব করলে পরিবহনকর্মীরা অনেক সময় ধর্মঘটে চলে যায়, তাতে আবার পুলিশকে উপর মহল থেকে চাপ দেয়া হয়। অহেতুক চাপ এড়াতে বাস-ট্রাকের ঘটনায় মামলা নিতে তাই কেউ কেউ একটু অনীহ হন। তাছাড়া এই ঘটনায় বাসচালক দায়ী নাকি রেস্তোরাঁর দুর্বল কাঠামো দায়ী সেটা নিয়ে বিতর্ক ওঠায় মামলা-ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো দুর্বল হতে থাকে। বাস মালিক রেস্তোরাঁর মালিককে অথবা বাহ্রামদের পরিবারকে কোন ক্ষতিপূরণ দিতে রাজী হয় না। রেস্তোরাঁটি অবৈধ স্থাপনা হওয়ায় তার মালিকও কোন মামলা করতে আগ্রহী হয় না। খুব দ্রুত বিষয়টি কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।
বাবা মারা যাবার পর দুটো অপ্রত্যাশিত অথচ অবধারিত ঘটনা ঘটে — বিনা আয়োজনে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া বেহ্নাজের তার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী এক লোকের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়া এবং কোনদিন চাকুরি না করা বাহ্রামের মায়ের ‘ফাইনটেক্স গার্মেন্টস’-এ অফিস সহকারী হিসাবে যোগদান। বেহ্নাজের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সংসারের একজন মানুষ কমে বটে কিন্তু মায়ের মাসিক আয় বাবার আয়ের অর্ধেকেরও কম হওয়ায় সংসার চলাটা কঠিন হয়ে যায়। ফলে আগের বাসা ছেড়ে মায়ের গার্মেন্টসের কাছের জামশেদ পেইন্টারের আধা-বস্তিতে উঠতে হয়। বাহ্রাম একবার ভেবেছিল পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কোন গার্মেন্টসে অপারেটর পর্যায়ে কাজে ঢুকে পড়বে কিনা। এক কালে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে শিশু শ্রমিক নেয়া হলেও ‘সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স’ চালু হবার পর ব্যাপারটা আর আগের মতো থাকে না। ফলে বাহ্রামের পক্ষে গার্মেন্টসে ঢোকা সহজ ছিল না। বয়স ভাঁড়িয়ে হয়তো ঢোকা যেত কিন্তু ব্যাপারটাতে মায়ের একেবারেই সায় ছিল না। তাঁর সোজা কথা, দিনে এক বেলা খেয়ে থাকতে হলেও বাহ্রামের পড়াশোনা ছাড়া চলবে না। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া বালকের পক্ষে টিউশনি যোগাড় করা সম্ভব হয় না বলে স্কুল থেকে ফিরে বাহ্রাম ‘জিনিয়াস কোচিং সেন্টারে’ সন্ধ্যা পর্যন্ত সহকারীর কাজ করতে থাকে। এতে মাস শেষে অতি অল্প কিছু টাকা আসার পাশাপাশি বিনা মূল্যে সব বিষয়ের নোট, মডেল টেস্টের প্রশ্ন মিলতো; ফলে মা আর আপত্তি করলেন না।
বছর পাঁচেক এভাবে কেটে যায়। এরমধ্যে বাহ্রাম মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় পাঁচের মধ্যে তিনের মতো জিপিএ নিয়ে পাশ করে ‘মহাকবি ফেরদৌসী ডিগ্রি কলেজে’ ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়, বেহ্নাজ এক কন্যা সন্তান জন্ম দেয় আর মা হঠাৎ করে বুড়িয়ে যেতে শুরু করেন। বেহ্নাজের মেয়েকে দেখে বাহ্রামের মনে হলো এই বাচ্চা বড় হয়ে পরী না হয়ে যায় না। সুতরাং একমাত্র মামা তার একমাত্র ভাগ্নীর নাম রাখে ‘পরী’। বাচ্চার মা, বাবা এবং নানী এক বাক্যে এই মান্ধাতা আমলের নাম বাতিল করে দেয়। তারা নানা চিন্তাভাবনা করে বাচ্চার নাম রাখেন ‘সারেহনাজ’। এতে বাহ্রাম দমে যায় না, বরং ভাগ্নীকে কোলে নিয়ে আহ্লাদ করার সময় তাকে ‘পরী’ বলে ডাকতে থাকে।
৬.
ইসলামের ইতিহাসে অনার্স পড়লে পাশ করার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না বটে তবে টিউশনি পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কোন বাচ্চা স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়লেও বাবা-মা চান গৃহশিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের কোন বিষয়ের শিক্ষক বা সেই বিষয়ে পড়ুয়া হন। নিজের খরচ যোগাতে বাহ্রামকে তাই আগের মতোই গলদঘর্ম হতে হলো। ঠিক এই সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটে যা বাহ্রামের জীবনের গতিপথ পুরোপুরি পালটে দেয়।
ফাইনটেক্স গার্মেন্টসে তার আশেপাশের অন্য গার্মেন্টসগুলোর তুলনায় নিয়মিত ও বেশি কাজ থাকলেও এর কর্মীরা নিয়মিত পুরো বেতন পেতেন না। এর জন্য মালিক পক্ষ কোন অজুহাতও দেখাতেন না। মালিক পক্ষের সাথে ‘যার নাম শুনলে সারা দেশ কাঁপে’ পর্যায়ের একজনের আত্মীয়তা থাকায় তারা কোন নিয়মনীতি বা অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া বিধিগুলো মানতে চাই্তেন না। একবার প্রায় তিন মাসের বেতন বকেয়া হয়ে পড়ায় কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র হয়। তখন রমজান মাস চলছিল, কর্মীরা চাইছিলেন তিন মাসের বকেয়ার সাথে তাদের প্রাপ্য ঈদ বোনাসও একবারে দিয়ে দেয়া হোক। এই সময়ে একটা বড় অর্ডারের শিপমেন্ট আসন্ন থাকায় মালিক পক্ষ জানায় যেদিন শিপমেন্ট করা হবে সেদিনই বকেয়া বেতন ও বোনাস দিয়ে দেয়া হবে। তার মানে যত তাড়াতাড়ি শিপমেন্ট তত তাড়াতাড়ি বেতন-বোনাস। মালিক পক্ষের এহেন ঘোষণা কর্মীদের অনেকে বিশ্বাস করলেন না। তবু শিপমেন্টের কথা ভেবে সবাই একটু দ্রুত হাত চালাতে লাগলেন। এতে দেখা গেলো নির্ধারিত সময়ের তিন দিন আগেই শিপমেন্ট করে ফেলা সম্ভব হবে। শিপমেন্টের দিন কাজ সারতে সারতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেলো। কর্মীরা ভাবলেন এখন সবাইকে বেতন-বোনাস দিতে গেলে প্রায় সেহেরীর সময় হয়ে যাবে। এতে ভালোই হবে, কারখানা থেকে একবারে সেহেরী করে ফজরের নামাজ পড়ে বের হলে বাড়ি ফিরতে রাস্তায় নিরাপত্তাজনিত অসুবিধা থাকবে না। অর্ডারের শেষ কাভার্ড ভ্যানটি কারখানা থেকে বের হবার ঘন্টাখানেক সময় পার হবার পরও যখন দেখা গেলো বেতন নেবার জন্য ডাকা হচ্ছে না তখন অনেকের আশঙ্কা হলো আদৌ বেতন মিলবে কিনা। কয়েকজন অ্যাকাউন্টস সেকশনে গিয়ে দেখেন সেখানকার কর্মীরা কম্পিউটার বন্ধ করে চুপ করে বসে আছেন। তা দেখে আগত কর্মীরা যা বোঝার তা বুঝে ফেললেন। মুহূর্তের মধ্যে গোটা কারখানায় অসন্তোষের বারুদে আগুন জ্বলে উঠলো। কর্মীদের অধিকাংশ শ্লোগান দিতে দিতে নিচে নেমে আসলেন।
কর্মীদের হিসাবের মধ্যে যা ছিল না তা হচ্ছে মালিক পক্ষ এই প্রকার প্রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি হয়ে ছিল। সম্ভবত এই প্রকার প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টিটাও ছিল তাদের পরিকল্পনামাফিক। হঠাৎ দেখা গেলো কিছু সশস্ত্র মানুষ কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বোমার বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ আর আর্তের চীৎকারে কারখানা কম্পাউন্ড ভারি হয়ে ওঠে। মূল ফটক বন্ধ থাকায় কেউ পালাতে পারছিলেন না। এই সময়ে কয়েকজন কর্মী মিলে পেছন দিকের একটা পকেট গেট খুলে ফেলতে সক্ষম হলে কর্মীরা সবাই সেদিকে দৌড় দেন। বাহ্রামের মা তিনতলার অফিসে আটকা পড়েছিলেন। এই অফিসকক্ষটার পাশের কক্ষে ‘ঝুট’ কাপড় স্তুপাকারে রাখা ছিল। আততায়ীদের কেউ ঝুট কাপড়ের স্তুপে আগুন ধরিয়ে দিলে ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। নিঃশ্বাস আটকে আসায় তিনতলাতে আটকা পড়া সবাই সিঁড়ির দিকে ছুটতে থাকেন। এই সময় সিঁড়িতে পদদলিত হয়ে যে অজ্ঞাতসংখ্যক কর্মী মারা যান বাহ্রামের মা ছিলেন তাদের একজন। ফাইনটেক্সের ঘটনায় কতজন পুড়ে বা দমবন্ধ হয়ে বা পদদলিত হয়ে মারা যান, অথবা কতজন আততায়ীদের ছোঁড়া গুলি বা বোমা বিস্ফোরণে বা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কোন সাংবাদিককে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এসব ঘটনায় যা হয় — সরকার বা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষের কেউ বাদী হয়ে একটা মামলা করে, মালিক পক্ষও পালটা মামলা করে; উভয় মামলার তদন্ত হয়, দু’চার জন গ্রেফতার হয়, কিছুদিন পরে তারা ছাড়াও পায়; দুয়েকটা এনজিও এবং গুটিকয় বাম শ্রমিক সংগঠন এটা নিয়ে কিছুদিন মিছিল-মানববন্ধন করে। এরপরে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলতে থাকে, সাক্ষী পাওয়া যায় না, কোন কোন মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে নানা টানাপোড়েন তৈরি হয়। ফাইনটেক্সের ঘটনায় একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। মাঝখান থেকে বাহ্রাম আর বেহ্নাজ এতিম হয়ে যায়।
৭.
মায়ের মৃত্যু বেহ্নাজকে ধাক্কা দিলেও সংসারের চাপে এক সময় সে শোক কাটিয়ে ওঠে। কিন্তু একা থাকায় বাহ্রামের পক্ষে শোক কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। যেহেতু বাহ্রাম ঘরকন্নার কিছুই পারতো না তাই তার পক্ষে দিন চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া তার যা আয় তাতে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। সহজ সমাধান ছিল পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে কোন গার্মেন্টস কারখানায় প্রডাকশন বা কোয়ালিটি কন্ট্রোল বিভাগে ঢুকে পড়া, বা নিদেনপক্ষে কোন সেলস সেন্টারে বিক্রয়কর্মী হিসাবে যোগদান করা — কিন্তু বাহ্রাম সেসব কিছু করতে চায়নি। মায়ের মৃত্যুতে হঠাৎ তার কাছে যাপিত জীবন, পরিপার্শ্ব, তার শহর, পরিচিত লোকজন — সব কিছু অসহ্য মনে হলো। তার ইচ্ছে করতো এক ছুটে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। মাঝে কয়েকদিন দূরের কয়েকটি জেলায় মাজারে মাজারে ঘুরেছে কিন্তু তাতে না হয়েছে অন্নসংস্থান না মিলেছে মনের শান্তি। বেশিরভাগ মাজারে কালেভদ্রে খাবারের ব্যবস্থা হয়, থাকার কোন ব্যবস্থা থাকে না। নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা আছে এমন মাজারে অন্নপ্রার্থীদের ভীড় এতো বেশি যে খাবার জোটার সম্ভাবনা কম হয়। এমন জায়গায় নানাপ্রকার চক্র থাকে, তাদের নেকনজরে না থাকলে মাজার প্রাঙ্গনে টিকে থাকা মুশকিল। অবশেষে হাতের সব টাকাপয়সা শেষ হয়ে গেলে বাহ্রাম বাড়ি ফিরে আসে।
বাড়ি ফিরে বাহ্রাম দেখে তার আর বাড়ি নেই। ভাড়া বাকি পড়ায় বাড়িওয়ালা জামশেদ পেইন্টার তার জিনিসপত্র বেহ্নাজের স্বামীকে ডেকে তার হাওলায় দিয়ে সেখানে নতুন ভাড়াটে বসিয়েছে। অগত্যা বাহ্রামকে জামশেদ পেইন্টারেরই মেসে খাবারের ব্যবস্থা ছাড়া একটা সিট ভাড়া নিতে হয়। ভাড়ার ঘর ছেড়ে মেসের সিটে ওঠায় বাহ্রাম বরং অনেক স্বস্তি বোধ করে — যাক্, এখানে অন্তত ঘরকন্নার ব্যাপার-স্যাপারগুলো সামলাতে হবে না। খাবার ব্যাপারটা কামরানের ছাপড়া হোটেলের ওপর ছেড়ে দিলেই চলবে। শুধু সপ্তাহে একবার নিজে নিজে কাপড় কাচতে হবে। এতসব কৃচ্ছতাসাধনের পরেও বাহ্রামের দিন চলা কঠিন হয়ে পড়ে। বেহ্নাজের কাছে হাত পাতার উপায় নেই, কারণ তার স্বামী যে চাকুরি করেন সেখানে নিয়মিত বেতন মেলে না। এমন কঠিন দিনে বাহ্রামের সাথে সাবের আগা’র দেখা হয়ে যায়।
৮.
সাবের আগা যে স্থানীয় লোক না সেটা বোঝা যায় তার কথায় উর্দ্দুর টান দেখে। কথা বলার সময় প্রায়ই তাকে বাংলা শব্দ হাতড়াতে হয়। বাহ্রামের সাথে তার দেখা হয় কামরানের হোটেলে। সাবেরই আগ বাড়িয়ে তার সাথে কথা বলে। কোন কাজ না থাকায় বাহ্রাম তার সাথে লম্বা গল্প জুড়ে দেয়। তিন-চার দিনের ভেতর দেখা গেলো সাবের তার নাড়িনক্ষত্রের খবর নিয়ে নিলেও সে সাবেরের ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানতে পারেনি।
একদিন সাবের তাকে জিজ্ঞেস করে সে বিদেশে কাজ করতে যেতে ইচ্ছুক কিনা। এই প্রশ্নে বাহ্রাম হাসে, কারণ সে জানে এই মুহূর্তে সুযোগ পেলে সে দুনিয়ার যে কোন দেশে কাজ করতে যেতে রাজী কিন্তু বিদেশে যাবার মতো এক কানাকড়িও তার নেই। টাকাপয়সা নেই জেনে সাবের একটু দমে যায় তবু হাল ছাড়ে না, খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে বেচার মতো কোন জমিজমা আছে কিনা। জমিজমার কথায় বাহ্রাম হো হো করে হেসে দেয়। সে পালটা সাবেরকে জিজ্ঞেস করে, জমিজমার মালিক হলে সে কেন জামশেদ পেইন্টারের মেসে সিট ভাড়া নিয়ে থাকবে? সাবের তবুও হাল ছাড়ে না। সে জানায়, টাকাপয়সা থাকলে বিদেশ যাবার ব্যাপারটি সহজ হতো, প্লেনে করে যাওয়া যেতো। টাকা না থাকলেও বিদেশ যাওয়া সম্ভব, তবে সেক্ষেত্রে বাস-ট্রাক-হাঁটাপথে যেতে হবে। তাতে কষ্ট অনেক, বিপদও অনেক। যাওয়ার যা খরচ হবে সেটা প্রথম বছরের বেতন থেকে কেটে রাখা হবে। কিন্তু বিদেশ মানে কোন দেশ? সাবের জানায় জার্মানী, ইতালী, ফ্রান্স বা বেলজিয়ামের মতো ইউরোপের দেশ — যেখানে কাজ পাওয়া যাবে সেখানে। বাহ্রামের কাছে এসব দেশ ভুগোলে পড়া, খবরে শোনা বা চার বছর পর পর বিশ্বকাপ ফুটবলে দেখা কয়েকটি নাম মাত্র। সে ধারণা করতে পারে না এসব দেশে কী করে যাওয়া যায়, আর সেখানে গিয়ে কী কাজ করা যায়।
সাবের ভরসা দেয়। জানায় কাজ মানে হচ্ছে ফসলের জমিতে কাজ করা, ফ্যাক্টরিতে ছোটখাটো কাজকর্ম, নির্মাণ শ্রমিক, দোকান শ্রমিক ইত্যাদি। এসব কাজের কোনটাতে বাহ্রামের আপত্তি নেই। স্থলপথে যাবার একটা রুট হচ্ছে হয় ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইরান-তুরস্ক হয়ে নৌকায় করে সাইপ্রাস অথবা গ্রীস, পরে আবার নৌকায় করে ইতালী। আরেকটা রুট হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আফগানিস্তান-উযবেকিস্তান-কাযাখস্তান-রাশিয়া-বেলারুস-পোল্যান্ড হয়ে জার্মানি। প্রথম পথের বিপদ হচ্ছে নৌকায় করে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দেয়া, আর দ্বিতীয় পথের বিপদ হচ্ছে যুদ্ধপীড়িত আফগানিস্তান পাড়ি দেয়া। যুদ্ধের মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও বাহ্রামের কাছে দ্বিতীয় রুটটি আকর্ষনীয় বলে মনে হয়। কারণ, দ্বিতীয় রুটটি যে ‘স্তান’গুলো দিয়ে যাবে তার কোনটাতে যেন কোহ্ ক্বাফ পর্বত আছে। সেই পর্বতের উপত্যকায় আছে কোহ্ ক্বাফ নগরী, আর একথা কে না জানে যে, কোহ্ ক্বাফ নগরী হচ্ছে পরীদের রাজ্য!
কোহ্ ক্বাফ দেখার সম্ভাবনা ভেবে বাহ্রাম দ্বিতীয় রুট ধরে বিদেশ যাবার ব্যাপারে রাজী হয়। কিন্তু সে বিদেশ যাবে কী করে, তার যে পাসপোর্টই নেই! পাসপোর্টের কথা শুনে সাবের বাহ্রামের অজ্ঞতায় হেসে ফেলে। সে জানায়, যারা ভিসা নিয়ে বিদেশে যায় তাদের পাসপোর্ট লাগে। বিনা ভিসায় অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্টের কোন ব্যাপার নেই। তবু কেউ কেউ সাথে পাসপোর্ট রাখে বিদেশে বিপদে-আপদে যদি নিজ দেশের সরকারের সাহায্য চাইতে হয় বা দেশে ফেরত আসতে চায়। পাসপোর্টের জন্য বাড়তি কয়েক হাজার টাকা খরচ করার উপায় ছিল না বলে বাহ্রাম বিনা পাসপোর্টে যেতে রাজী হয়।
বাহ্রামের একমাত্র বন্ধন ছিল তার বোন বেহ্নাজ আর তার মেয়ে ‘পরী’ সারেহ্নাজ। সব শুনে বেহ্নাজ আপত্তি তোলে ঠিকই কিন্তু সে আপত্তিতে জোর ছিল না। কীসের ভরসায় সে বাহ্রামকে থেকে যেতে বলবে! যেখানে তার নিজের সংসারই চলতে চায় না সেখানে সে ভাইকে রাখবে কী করে! এরচেয়ে ভাই বরং নিজের ভাগ্যটা একবার যাচাই করুক। ভাগ্যে থাকলে সে ইউরোপের কোন দেশে ঠাঁই পেয়ে যেতে পারে। এভাবে বাহ্রাম একদিন বিনা পাসপোর্টে বিনা ভিসায় পরীস্থানে পৌঁছানোর আশায় এক অজানা বিদেশে রওয়ানা হয়।