সাদা-কালোর মধ্যে যে সম্পর্ক, ভালো মন্দের মধ্যেও অনুরূপ একই ধরনের সম্পর্ক বলা যেতে পারে। একে অপরকে ছাড়া সকলেই যেন গুরুত্বহীন। তবে ভালো ও মন্দকে পাশাপাশি রাখলে এমন কোনো মানুষ নেই যে সে ভালোকে পছন্দ করবে না।সকলেই ভালো থাকতে চাই। আর ভালো থাকার জন্যই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান। সেই সব উৎসব দেখা গেছে কখনও পরিবারকেন্দ্রিক আবার কখনও বা সমাজকেন্দ্রিক। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন উৎসব যেমন আবির্ভূত হয়েছে, আবার কিছু কিছু উৎসব কালের আবর্তে বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায়। এমনকি কিছু উৎসব তার রূপের পরিবর্তন করেছে। যাইহোক না কেন উৎসব মানেই কতগুলো বৈশিষ্ট্য বহন করে থাকে, হতে পারে তা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়।
আদিম মানুষ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করত প্রকৃতির সঙ্গে। আর প্রকৃতি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত তারা। এভাবেই মানুষ একা একা না থাকতে পেরে সঙ্গবদ্ধভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। এভাবেই সময়ের আবর্তনে সভ্যতা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের মানুষ হাসিখুশি আনন্দে মেতে ওঠার প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটাল যাকে আমরা উৎসব বলে থাকি। আর উৎসব মানেই পারিবারিক, সামাজিক সকল সদস্যের সঙ্গে একসাথে সময় কাটানো, সমস্ত কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিজেদের এক অন্য মাত্রায় উপস্থাপন করা। তবে এই আনন্দ উৎসব ঈশ্বরকেও খুশি করার অন্যতম মাধ্যম। তেমনই এক উৎসব হল মুসলমান অর্থাৎ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঈদ অর্থাৎ ঈদ-উল-ফিতর। কিন্তু এই উৎসবের পূর্বে রমজান মাসে রোজা পালন করতে হয়। রমজান বা আরবি রমাদান হল ইসলাম বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে নবম মাস। এই পবিত্র মাসে পৃথিবীর সমস্ত ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ রোজা পালন করে থাকেন। ইসলাম ধর্মে যে পঞ্চ স্তম্ভ রয়েছে তার তৃতীয় স্তম্ভ হল রমজান মাসে রোজা পালন করা। সাধারণত চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে এই রমজান মাসে ২৯ বা ৩০ টি রোজা পালন করার পর ঈদুল ফিতরের উৎসব পালিত হয়।
এই মাসে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম ব্যক্তির উপর রোজা পালন ফরয, কিন্তু অসুস্থ, গর্ভবতী, সুগারের রোগী, ঋতুবর্তী নারীদের ক্ষেত্রে তা শিথিল করা হয়েছে। রোজা বলতে সুবহে সাদিক অর্থাৎ ভোরের পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, পঞ্চেন্দ্রিয়র দ্বারা গুনাহের কাজ, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে যৌনসংগম থেকে বিরত থাকাকে বোঝায়। এই পবিত্র রমজান মাসে মুসলিম সম্প্রদায় অধিক ইবাদত করে থাকে। কেনোনা অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে ইবাদতের সওয়াব বা ফল বা নেকী বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসের লাইলাতুল কদর রাতে পবিত্র আল-কুরআন যা মুসলিমদের সর্বপ্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ, নাযিল হয়েছিল এবং এই রাত্রিকে মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলেছেন যা হাদীসে বর্ণিত। এ রাতে ইবাদত করলে হাজার মাসের ইবাদতের থেকেও অধিক সওয়াব পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস। রমজান মাসের শেষ দিকে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে মুসলমানগণ ঈদুল-ফিতর পালন করে থাকে যেটি মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি।
আর এই উৎসব পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ন্যায় মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তেও বেশ ধুমধাম করে পালিত হয়। নতুন পোশাকের কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রঙিন আলোকে বাড়িকে সুসজ্জিত করন, মসজিদ, ঈদগাহকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাঙিয়ে তোলা সবই ঈদের ১-২ দিন আগে থেকে হয়ে থাকে। কচিকাঁচারা আনন্দ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে এই দিনটিতে। খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মসজিদ বা ঈদগাহতে পৌঁছে ইসলাম সম্পর্কে জানা, ইসলামের করণীয় কাজ, নামাজ আদায় করা হয়। তারপর ঈদকে কেন্দ্র করে যে বাজার বসে সেখানে বিভিন্ন খাবার, খেলনা এসব নিয়ে বাড়ি ফেরা। এই ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তে বাড়িতে বাড়িতে বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়। যেমন ;রানীনগর থানার অন্তর্গত কাহারপাড়া গ্রামের দিকে প্রায় সমস্ত বাড়িতেই খিচুড়ির বন্দোবস্ত করা হয়। এছাড়াও ফ্রাইড রাইস, বিরিয়ানি, লাচ্ছা, সীমায়, বোঁদে এগুলোও হয়ে থাকে।
শক্তিপুর থানার অন্তর্গত নারকেল বাড়ি গ্রামের দিকে আবার পায়েস, চালের রুটি, মাংস, ক্ষীর, হাতে তৈরি সিমাই রান্না করা হয়। হরিহরপাড়ার অন্তর্গত তরতিপুর গ্রামে চালের রুটি, বিরিয়ানি, পরোটা এই দিনটির বিশেষ আকর্ষণ। ডোমকলে বেশ রাজকীয়ভাবে এই দিনটি পালিত হয়। এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বিরিয়ানি, সীমাই, পায়েস, ক্ষীর হয়ে থাকে।
একেবারে বাংলাদেশ লাগোয়া আখেরিগঞ্জে হাতে তৈরি সিমাই, লাচ্ছা, পরোটা, সাদা ভাত, দই মিষ্টি প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হয়ে থাকে।জঙ্গিপুরে একটু ভিন্নভাবে পালিত হয়। এখানে সকালের দিকে খাবারের মধ্যে থাকে বিভিন্ন ধরনের হালুয়া। যেমন গাজর, ছোলা, ডিম। এছাড়াও আলুর হালোয়া হয়ে থাকে। দুপুরের খাবারে থাকে বিরিয়ানি, দই, মিষ্টি। জীবন্তিতে সকাল সকাল খুরমা খেজুর খেয়ে নামাজ আদায় করা হয়।তারপর সমস্ত কবর জিয়ারত করে বাড়ি ফিরে হালোয়া, চালের রুটি, বিভিন্ন ধরনের মাংস, পায়েস, সীমাই খেয়ে থাকে। এছাড়াও বিরিয়ানি হয়ে থাকে।
অর্থাৎ সার্বিকভাবে দেখলে মুর্শিদাবাদের প্রায় সমস্ত স্থানেই একইভাবে পবিত্র এই দিনটিকে পালন করা হয়।