“আমার দম আটকে আসছে বাবু, আমার কষ্ট হচ্ছে খুব...”
যেকোনও হাসপাতালের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। তুলো, স্পিরিট, রাসায়নিক আর ওষুধের গন্ধে ভারি হয়ে আছে এই ঘর। একটা আবছা আলো জ্বলছে। সম্ভবত এখন ভোররাত যা মা টেরও পাচ্ছে না। দোতলার উত্তরের ঘরের জানলা দিয়ে এরকম সময়ে শিউলির গন্ধ ভেসে আসে, তোমার মনে পড়ছে, মা? ঘরের লাগোয়া টানা বারান্দায় যতোটা জায়গা বের করা যায়, তুমি গাছ লাগিয়েছিলে, রকমারি ফুলের গাছ। তোমার সেই কোন অবসর নেবার দিন, আমি সদ্য মাস্টার্স পাশ করে একটা কলেজে পড়াতে ঢুকলাম সেই বছর। সামান্য মাইনে তখন আমার। তারও অনেক আগে থেকেই তোমার প্রবল বাগান করার শখ। যা গোটা স্কুলের চাকরিজীবনে পূরণ হয়নি। ছোটোবেলায় আমার স্কুল যাবার আগে তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। তখনও শিয়ালদা-বনগাঁ ডবল লাইন চালু হয়নি। ফিরতে রাত সাড়ে সাতটা-আটটায়। আমি আর ভাই টিভি দেখতাম। অপেক্ষা করতাম, একতলার লোহার গেট খোলার শব্দ হবে কখন! আমার স্কুল যেতে ভালো লাগত না। প্রায়ই কামাই করতাম। আর বাড়ির সবাই হাসাহাসি করত, সেইসব দিনে আমি তোমার শাড়ি জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতাম। আমি তোমার শরীরের গন্ধ শুঁকতাম, মা। বাড়ির সবাই বলতে ঠাকুমা আর আমাদের বিধবা বড়োপিসি। সেই কবে স্বামী-সন্তান হারিয়ে আমাদের দমদমের বাড়িতে ফিরে এসেছিল। ঠাকুমা বলত এই বংশে অভিশাপ আছে। স্বাভাবিক। অভিশাপের একটা বুনো গন্ধ ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো পাকিয়ে উঠত বাড়ির আনাচে-কানাচে। সেই গন্ধের ঝাঁঝের মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। তার দুই ছেলেকেই অপঘাতে হারিয়েছিল বুড়ি। ছোটো ছেলে, আমার কাকা, মারা যায় ১৩ এপ্রিল, ১৯৮৫। ঠিক তার আগের বছর কংগ্রেসের আশুতোষ লাহা জিতে গেছে দমদম লোকসভায়। ’৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলেও আমাদের দমদম-পাতিপুকুর-জপুর অঞ্চলে পুরোনো কংগ্রেসি গুন্ডাদের বাড়বাড়ন্ত একটুও কমেনি। কাকা কিন্তু কোনও পার্টি করত না সেইভাবে। একটা লোকাল ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিল কাকা। আমার ছোটোবেলাতেও বোমাবাজি-খুনখারাপি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক, জলভাত ওই গোটা অঞ্চলে। কাকাকে আগের রাতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বিপক্ষ গোষ্ঠীর ছেলেরা। পরদিন সন্ধেবেলা লাশ পাওয়া যায় বাগজোলা খালের পাশে। ছন্নছাড়া হয়ে যায় আমাদের পরিবার। কারণ, অবিবাহিত কাকার উপরেই গোটা ফ্যামিলির দৈনন্দিন কাজকর্ম দাঁড়িয়ে থাকত। ছোটো থেকেই উত্তরের ঘরের একটা স্কুলের গ্রুপফটোয় কাকার ছবি দেখে এসেছি আমি। একদিন সেই কাকাও ছবি হয়ে গেল। আমি তখন খুব ছোট্ট। আমাদের খুব শৈশবের স্মৃতি না কি কোন এক আশ্চর্য উপায়ে বেঁচে থাকে। যেমন, ’৭৮-এর বন্যায় গোটা দমদম যখন জলের উপর ভাসছে, সেইসময়ের কিছু খণ্ড ছবি আমার মাথায় আজও ঘাই মারে। কীভাবে? আমি জানি না। কেবল টের পাই, কলার মান্দাসে চড়ে বাজার নিয়ে আসছে পাশের বাড়ির অলোককাকু। আমাদের দোতলা-ভর্তি অজস্র লোক। তাদের বাক্স-প্যাঁটরা। বোঁচকার উপর বোঁচকা। গায়ে গায়ে ঠাসাঠাসি-করা মানুষ। তারা কারা? তারা কি পরিচয়পত্র-বিহীন? কোন বিগতজন্মের ঋতুতে তাদের চিনতাম আমি?
একচক্ষু দানবের মতো বিরাট বাড়ির একতলায় পাঁচঘর ভাড়াটে। জন্মাবধি তাদের দেখে আসছি আমি। এর মধ্যে দুটো ঘর নিয়ে থাকে ঢাকার ঘোষ-পরিবার। দু-ঘর ইউনিভার্সিটির ছাত্র বা সদ্য-চাকুরিরতদের মেস। আর কোণের ঘরটায় থাকত এক মা আর মেয়ের পরিবার। মেয়েটি ছিল মাচা-শিল্পী, অলকা ইয়াগনিক-কণ্ঠী। ঘোষ-পরিবার আর এই মা ও মেয়েকে বিশেষভাবে মনে আছে আমার। টানা ছ-মাস, সাত মাস ভাড়া বাকি পড়ে থাকত ঘোষেদের। প্রত্যেক মাসের গোড়ায় ঝুড়িভর্তি আনাজপাতি নিয়ে আসত ওরা উপরতলায়। ভেট হিসেবে, ভাড়ার টাকার বিকল্প হিসেবে ওগুলো দিয়ে যেত আমাদের। পাড়ার অল্পবয়সি ছেলেদের লিডার ছিল ডাকুদা। আমি দোতলার বারান্দা থেকে ডাকুদা আর তার গ্যাং-এর ক্রিকেট খেলা দেখতাম। ডাকু নাম এমনি এমনি হয়নি। ছেলেটা ছিল সর্বার্থেই ডাকাবুকো আর দুঃসাহসী। পাড়ার সমস্ত কাজে এগিয়ে আসত। আসলে স্মৃতি জিনিসটাই যেকোনও জিনিসকে আগুপিছু হিসেবে সাজিয়ে নিতে ভালোবাসে। যেগুলো আমরা বয়সকালে স্পষ্ট বুঝতে পারি, অনেকসময়েই ভেবে নিই, সেগুলো আমরা গোড়া থেকেই বুঝতাম। যেমন, ওই মাচা-শিল্পী জিনিয়াদি আর ডাকুদার গোপন সম্পর্ক, যা আমাদের নিস্তরঙ্গ ছোটোবেলার পাড়াতুতো জীবনের টক-অফ-দ্য-টাউন ছিল দীর্ঘদিন পর্যন্ত। স্কুল যেতে কখনোই ভালো লাগত না বলে, আমি সারাদুপুর বাড়িতে বসে বই পড়তাম আর বাড়ির কোথায় কী ঘটছে, তা ইথারতরঙ্গে ভেসে পৌঁছে যেত আমার রাডারে। বহুদিন আমি উপরের টানাবারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখেছি, ভর দুপুরবেলা ডাকুদা সন্তর্পণে বেরিয়ে আসছে জিনিয়াদির ঘর থেকে। আমাদের পাড়ায় একটা চালু কথা ছিল, গায়ক-গায়িকা-সিনেমা-যাত্রাপালার শিল্পীরা মূলত চরিত্রহীন হয়। যদিও সেই ছোটোবেলা থেকেই আমি কোনওদিন বুঝতে পারিনি, ‘চরিত্র’ জিনিসটা ঠিক কী বস্তু! যাই হোক, এটা পরিষ্কার বুঝতাম, ওদের দুজনের মধ্যে একটা কোনও অবৈধ সম্পর্ক আছে। কারণ, সুমিত বলে একটা ছেলেকে প্রায়ই দেখতাম জিনিয়াদির ঘরে এসে রাত্রিবাস করে যায়। কালক্রমে জানা গেল, লোকটা জিনিয়াদির কীরকম যেন একটা বর এবং লোকটা দুর্দান্ত গিটার বাজায় ওদেরই অর্কেস্ট্রায়। আবার ডাকুদার সঙ্গে তখন ‘প্রিন্স’দের বাড়ির ক্লাস এইট-ফেল মেয়ে ঝিমলির দুর্দান্ত প্রেম। সেই যে এক বিকেলে কালিন্দি হাউজিং-এর জলের ট্যাঙ্কের মাঠে ফুটবল-পেটানো শেষ হলে ডাকুদা আমাদের সামনে একটার পর একটা কন্ডোম ফুলিয়ে বেলুন বানিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল, সেদিনই আমরা স্পষ্ট বুঝেছিলাম, ডাকুদা এইসব শারীরিক বিষয়ে যথেষ্ট পটু। আমি মাধ্যমিক পাশ করার বছরেই ঝিমলিকে নিয়ে চাষিপাড়ায় আলাদা বেড়ার ঘরে উঠে গেল ডাকুদা। সেই আমাদের প্রথম দেখা লিভ-ইন রিলেশনশিপ। আমি আর ভাই তোমার সঙ্গেই জড়িয়ে বেড়ে উঠছিলাম, মা। আমাদের জীবনে তুমিই ছিলে একমাত্র আশ্রয়। আমাদের কল্পনার হিস্টিরিয়া যখন অদেখা পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসত, তুমিই ছিলে আমাদের জড়িয়ে ধরার মানুষ। আমার জীবনের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তুমি যে আসলে একটা খুব সাদামাটা বিনুনি-দোলানো মেয়ে, যার ভিতরটা পুড়ে আঙরা হয়ে গেছে, সেটাও আমি টের পেতাম। ওই কমবয়সেই।
আজ নার্সিং হোম থেকে শেষ ফোনটা এসেছিল বেলা বারোটা নাগাদ। মে মাসের শেষদিক। গোটা দেশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে। মাকে কিছুতেই ভ্যাক্সিন দেওয়াতে পারিনি। মায়ের রক্ত পাতলা হয়ে এসেছিল। শরীরে বাসা বেঁধেছিল আরও অনেক জটিল অসুখ। ডাক্তার টিকা নিতে বারণ করেছিল। বলেছিল, তাতে সমস্যা আরও বাড়বে। আমার ফ্ল্যাট আর মায়ের বাড়ি শহরের দুই প্রান্তে। প্রায় একদশক মফস্সলের কলেজে কাটিয়ে অবশেষে কলকাতায় ফিরে আমি রুবির পিছনদিকে এই ফ্ল্যাটটা কিনি। আমার বউ, রুচিরা, কিছুতেই রাজি হয়নি দমদমের ওই বাড়িতে গিয়ে উঠতে। আর ততোদিনে আমার মেয়ে তাতিন জন্মেছে। ওকে দক্ষিণ কলকাতার কোনও নামী স্কুলে ভর্তি করার ভাবনাই আমাদের কাছে মুখ্য ছিল। বিয়ের শুরু থেকেই স্বাধীন, নিজস্ব জীবন, সংসার কাটিয়ে এসে আর ওই ভূতের মতো অর্ধভগ্ন আড়াইতলা শহরতলির বাড়িতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব বলেই মনে হয়েছিল আমার। ঠিকই মনে হয়েছিল। জীবনের কিছু পিছুটানের কাছে মানুষ কোনওদিনই আর ফিরে যেতে পারে না। আমিও পারিনি। বছরে অবশ্য বেশ কয়েকবার কলকাতায় ফিরতাম। কলেজের কাজের চাপ, নিজের বিপুল লেখালেখি সামলে আমি সময় বের করতে পারতাম না। আমার মা দিনের পর দিন আমার জন্য অপেক্ষা করত। কেবল, জন্মদিনগুলো মায়ের সঙ্গে কাটাতাম প্রত্যেক বছর। রুচিরাও কোনও কোনওবার আসত। আমার মেয়েও আসত। নাতনিকে চোখে হারাত মা। ঠাকুমা মারা যাবার পর, পিসি মারা যাবার পর ওই ভূতগ্রস্ত বাড়িতে কেবল মা একলা। বহুবার বলেছি আমাদের সঙ্গে এসে থাকো। সামান্য দু-একদিন এসে থাকলেও ওই বাড়ি ছেড়ে আসতে চাইত না মা। হয়তো শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চাইত। গোটা জীবনই একা হাতে আমাদের বড়ো করে তুলেছিল মা। নার্সিং হোম থেকে বলল, প্রায় একলাখ টাকা বাকি। কোভিড পেশেন্টের বডি ওরা বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেবে না। কর্পোরেশনের গাড়ি আসবে। ওরাই যোগাযোগ করবে। এমনকি শ্মশানেও ওরা যেতে দেবে না নিজের লোককে দেখতে।
রুচিরা বলল— তুমি একলা যাবে না কিছুতেই। আমিও যাব তোমার সঙ্গে!
--তাতিনকে কোথায় রেখে যাবে?
--নীচের উৎপলাদিকে বলেছি আমি। কয়েকঘণ্টার ব্যাপার। তাতিন ওদের ফ্ল্যাটে থাকবে...
--এই কোভিডের মধ্যে ওকে অন্যের ঘরে রেখে যাবে?
--চলে আসব তো। কিছুক্ষণ শুধু থাকবে তাতিন।
--টাকা তুলতে হবে তো!
--কতো ক্যাশ আছে তোমার কাছে?
--চল্লিশ মতো। একটা কার্ডে একসঙ্গে কুড়ির বেশি তোলা যাচ্ছে না...
--আমার কাছে তিরিশ আছে... তুমি যাবার আগে একবার বেরোও। বাকিটা তুলে আনো...
গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করলাম। রাস্তায় কোনও ট্যাক্সি নেই। আমি নিজেই ড্রাইভ করব। নার্সিং হোম সাউথ সিটির পিছনে। আনোয়ার শাহ ক্রসিং-এ আসতেই অদৃশ্য জুঁইফুলের গন্ধে ভরে গেল মাথার ভিতরটা। রুচিরা পিছনের সিটে বসে আছে। আমার চোয়াল শক্ত পাথর হয়ে আছে অথচ ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছি আমি। এই তিনদিনে একবারও কাঁদিনি। আসলে আমার ছেলেবেলার সেইসব হারিয়ে-যাওয়া দিনগুলো বোধহয় অনেক গভীরে চাপা পড়ে ছিল। যখন আমি ভোরবেলায় উঠে এই জুঁইফুলের গন্ধ পেতাম। অদৃশ্য বৃষ্টি হত চারপাশে। বাড়ির পিছনে পাগলির মাঠ। এক মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছিলাম গোটা মাঠ অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। সেই ধবধবে জ্যোৎস্নার ভিতরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক পক্ষীরাজ ঘোড়া। পরে রুচিরাকে যতোবার এই অভিজ্ঞতার কথা বলেছি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে আমি না কি ছিলাম সোমনামবিউলিস্ট, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেঁটে বেড়াতাম। ওগুলো ছিল নিছক স্বপ্ন অথবা পিয়র মিথ্যা। বানিয়ে বানিয়ে ওকে ইমপ্রেস করার জন্যই বলেছি এইসব। মা আর নেই, এই খবরটা জানার পর যে আকস্মিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, মনে হয়, এক অদৃশ্য স্পেস শাটলে চেপে আমার এই অতীতে ফিরে যাবার মুহূর্তের সঙ্গে তার যোগ রয়েছে। রুচিরার পক্ষে এটা বোঝাই সম্ভব নয়, আমার শৈশব-কৈশোরের দমদম ছিল আদিগন্ত কুহকে ভরপুর। রহস্যে-মোড়া ব্লেড কারখানার চিমনি, সরু অলিগলি, মেছেতা-পরা আইবুড়ো মেয়েরা বিকেলে দাওয়ায় পা ছড়িয়ে উকুন বাছতে বসত, যখন আমি সাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়াতাম জপুর-বহিরাগত-লালগড়ের কলোনিপাড়ায়। পিছনের বিরাট হাউজিং এস্টেট তখন গড়ে উঠছে। বিশাল কপিখেত। মাঝে ভোজবাজির মতো গজিয়ে ওঠা চায়ের দোকান। মা স্কুল থেকে ফেরার আগে আমার আর ভাইয়ের পড়া শেষ হয়ে যেত। মা ফিরলে একসঙ্গে খাব। মা খাটের মাঝখানে। আমরা দুই ভাই দু-পাশে। এভাবেই ঘুমোতাম রাতে। খুব ভোরে উঠে টের পেতাম মা ঠাকুরঘরে। আলো ফোটার আগেই ঘুম থেকে উঠে বাসি কাপড় ছেড়ে নিত মা। তারপর ঢুকত ঠাকুরের ঘুম ভাঙাতে। ভাই আমার চেয়ে সাত বছরের ছোটো। একা হাতে বড়ো করেছিল আমাদের। ১৯৮৬ সালে কোনও কালেই সংসারের প্রায় খোঁজ-না-রাখা আমাদের বাবা খুন হয়ে যায়। তখন আমার বয়স দশ। ভাইয়ের তিন।
কাউন্টারে একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে দিল আমাকে। রুচিরাকে বললাম নার্সিং হোমের বাইরের পোর্টিকোয় থাকো। ভিতরে ঢুকো না। কেন জানি না মনে হচ্ছিল ভিতরে অজস্র মৃত্যুর জীবাণু। ফর্ম ফিল-আপ করে গেলাম ক্যাশ সেকশনে। টাকা মিটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসছিলাম। এখানকার প্রত্যেকটা স্টাফ অসম্ভব গম্ভীর। বলল, বডি মর্গ থেকে রেডি করে আনতে কিছুটা সময় লাগবে। ঠিক ভোরবেলার মাহেন্দ্রক্ষণে চলে গেছে মা। কর্পোরেশনে ওরাই খবর দিয়েছে। গাড়ি এসে নিয়ে যাবে। “আমরা দেখতে পাব না?”—প্রায় অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠি আমি। “নিশ্চয়ই দেখবেন”—ওরা শান্ত পেশাদারি গলায় বলে ওঠে। আমি স্থানু, দাঁড়িয়ে থাকি।
ট্রেড ইউনিয়ন করত বাবা। পার্টির হোলটাইমার ছিল। সপ্তাহের পাঁচদিন এমনকি ছ-দিনও বাইরে বাইরে কাটাত কোনও কোনও সময়ে। ৭৭-এ বাবার পার্টি ক্ষমতায় আসে। বাবা কাজ করত টিটাগড়-ভাটপাড়া জুটমিল বেল্টে। গেটমিটিং-এর সময় দুষ্কৃতীর গুলিতে মারা যায়। আজ অবধি বাবার মৃত্যুরহস্যের কোনও কিনারা হয়নি। সেই রাতটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার। লাল পতাকায় ঢেকে বিশাল মিছিলসহ বাবার মৃতদেহ এসে ঢুকল আমাদের বাড়ির বিরাট একতলার উঠোনে। পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছিল। মা বসে ছিল, পাথরের মতো স্থির হয়ে। পাগলের মতো আছাড়িপিছাড়ি কান্নাকাটি করছিল ঠাকুমা। উত্তাল স্লোগান উঠছিল যখন শেষরাতে বাবার মরদেহ পার্টির লোকেরা কর্ডন করে দাহ করতে নিয়ে যায়। “শহিদ কমরেড সমর দত্ত তোমায় আমরা ভুলিনি, ভুলব না”—মুহুর্মুহু স্লোগান শুনে কেঁপে উঠছিলাম আমি। দোতলার বারান্দা থেকে দেখলাম, মিছিলটা চলে যাচ্ছে। আমায় শ্মশানে যেতে দেওয়া হয়নি। ঠাকুমা ঠিকই বলত। এই বংশ গ্রহণ-লাগা। লোকাল ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে চলে গিয়েছিল কাকা। আর তারপর বাবার এই আকস্মিক মৃত্যু। মা আরও অসম্ভব শক্ত হয়ে গেল ভিতরে ভিতরে। কীভাবে আমরা লেখাপড়া শিখলাম, কীভাবে বড়ো হলাম, এখন ভাবলেই অবাক লাগে। মা কিন্তু বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি আমাদের। আশির দশকের শেষ অবধি মা বাড়িতে নিয়ে আসত ‘রাদুগা প্রকাশনী’, ‘বেজিং প্রকাশনালয়’-এর বইপত্র। আনত ‘সোভিয়েত দেশ’, ‘সোভিয়েত নারী’। একটা বই আমি অনেকদিন অবধি পড়তাম, পাতা উল্টোতাম বারবার। ‘মহাকাশে মহামিলন’। স্পেস সায়েন্সে সোভিয়েত রাশিয়ার কৃতিত্ব নিয়ে লেখা অজস্র ছবিওয়ালা বই। বইটা কোথায় এখন, কে জানে!
আর এইমুহূর্তে চামড়া-পোড়া গরমের মধ্যে আমি আর রুচিরা দাঁড়িয়ে আছি নার্সিং হোমের বাইরে। কর্পোরেশনের গাড়ি আসছে। ওরা বলল। মায়ের বডি পিছনের গেট দিয়ে বের করবে ওরা। দূর থেকে দেখতে হবে। বডিব্যাগে ঢেকে মায়ের দেহ কাচ-ঢাকা গাড়িতে তোলা হবে। “কর্পোরেশনের ছেলেগুলোর হাতে কিছু বখশিশ দেবেন অবশ্যই”—অ্যাটেনডেন্ট বলেই রেখেছিল। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, তাই না, মা? মুখে অক্সিজেন মাস্ক, স্যাচুরেশন নেমে গেছিল অনেক নীচে। তুমি কি ডেকেছিলে আমায়? কেন আমি কাল সারারাত ঘুমোতে পারলাম না, মা? তুমি এই কটাদিন ভয়ানক কষ্ট পেয়েছ, যেদিন আমি ছুটে গেছিলাম তোমায় আনতে। দমদমের বাড়ি থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তুলে এনে এই ছোটো নার্সিং হোমটায় তোমায় ভর্তি করেছিলাম, মা। আমায় একটা সপ্তাহ সময়ও দিলে না তুমি? কেন, কেন চলে গেলে এইভাবে?
আমি চাকরিসূত্রে কলকাতা ছাড়ার আগেই ভাই ব্যাঙ্গালোর চলে গিয়েছিল। এমবিএ পড়তে। যেহেতু বাবা ছিল না আমাদের, মাকেও রিটায়ারমেন্টের আগে সারাদিন পেতাম না আমরা, ভাইয়ের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বেশ পোক্ত ছিল আমার। আমি তখনও ইউনিভার্সিটির ছাত্র, আমরা দুজনে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আমাদের পুরোনো পাড়ার আশেপাশে। লেকটাউনের ঝিলের সামনে গিয়ে বসে থাকতাম দুজনে। ভাইয়ের সঙ্গে বাল্যপ্রেম ছিল যে মেয়েটার, সে কোন্ এক অজানা কারণে ব্রেক-আপ করে চলে যায়। ভাই, আমার চেয়ে খানিকটা ছোটো বলেই বোধহয় সেরকম ভেঙে পড়েনি। সম্পর্ক, স্থায়িত্ব এগুলো ক্রমে খাটো হয়ে আসছিল একুশ শতকের গোড়া থেকেই। এইদিক থেকে ভাই ঠিক আমার উলটো ধাঁচের। আমি অল্পেই ভেঙে পড়ি, স্পর্শকাতর স্বভাবের মানুষ আমি। কিছুটা নির্বোধ, কল্পনাপ্রবণও বটে। আর, আমাদের ছোটোবেলার পাড়া তো পাল্টেও যাচ্ছিল চোখের সামনে। সেই বদল আমি সেরকম একটা গ্রহণ করতে না পারলেও ভাই ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। আমিও কলেজে পড়ার সময় অল্পবিস্তর ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়েছি। ভাই ওসবের ধারপাশ দিয়েও হাঁটেনি কোনওদিন। খুব ক্যালকুলেটিভ আর ঠান্ডা মাথার ছেলে ছিল ও। বরাবরই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সেই যে ঘর ছাড়ল পড়াশুনোর জন্য, আর ফেরেনি ভাই। ব্যাঙ্গালোরেই চাকরি নেয় দামি কর্পোরেট সংস্থায়। বেশিদিন এক শহরে থাকেও নি। ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, দিল্লিতে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ও আমেরিকা পাড়ি দেয়। ততোদিনে আমিও কলকাতা ছেড়েছি। ঠাকুমা মারা গেছে অনেকদিন আগেই। দমদমের ওই ভূতের মতো বিরাট বাড়িতে কীভাবে প্রত্যেকটা মুহূর্ত একলা কাটাত মা? জানা নেই আমার। ভাই নিউ জার্সিতে সেটল করার পর এক মার্কিন মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের পর বেশ কয়েকবার দেশে এসেছিল। তারপর দীর্ঘদিন আর আসত না। সেরকম একটা যোগাযোগও রাখত না আমাদের কারও সঙ্গে। আমি অপরাধভোগে ভুগতাম। এইভাবে এক বৃদ্ধাকে একলা রেখে দূরে বেঁচে থাকা যায়? কোভিড শুরু হবার পর ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। সেকেন্ড ওয়েভের সময় তো ভাইয়ের পক্ষে দেশে আসা সম্ভব ছিলও না। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সঙ্গে সঙ্গেই ভাইকে খবর দিয়েছিলাম আমি। ভাইও ফোনে যোগাযোগ রাখছিল। আর শেষ কয়েকটা বছর তো মায়ের একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই মোবাইল ফোনটুকুই। হোয়াটসঅ্যাপ কলে কথা বলত আমাদের সঙ্গে। গল্প করত আমার মেয়ের সঙ্গে। নিউ জার্সিতেও ফোন করত। কিন্তু কোনও অজানা কারণে, মা এবং আমিও টের পেতাম ভাইয়ের তরফ থেকে সেই উষ্ণতা আর নেই। কেবল ও কয়েকবছর আগে যখন নিউ জার্সির অভিজাত পাড়ায় দোতলা ছ-কামরার বাড়িটা কিনল, নিজে থেকেই মাকে ফোন করে মোবাইলে গোটা বাড়ির ছবি দেখিয়েছিল। আর, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ভাই যে পৃথিবীর বাসিন্দা হতে পেরে তৃপ্ত, আমি বা মা, আমার গোটা পরিবারের কাঠামোয় সেই তৃপ্তি বেমানান। আজীবন লাল পতাকার অহঙ্কার বুকে জড়িয়ে খুন হয়ে যাওয়া সমর দত্তর ছেলে নিউ জার্সির পশ এলাকায় বাড়ি কিনে এতোখানি তৃপ্ত! ভাবা যায়?
মায়ের বডি আমি দেখতে পাইনি। জীবাণুনিরোধক প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়া মায়ের ডেডবডি ওরা গাড়িতে তুলল। রুচিরা আমার জামার হাতা খামচে ধরছিল বারবার। আমার মাথার মধ্যে ফের তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল সব। বডি ওরা ধাপায় নিয়ে যাবে, কথাবার্তা শুনে বুঝলাম। আমি তখনই স্থির করে নিয়েছি, রুচিরাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়েই দমদমে ছুটব আমি। মৃত্যুর মুহূর্তে তুমি ঠিক কী বলেছিলে মা? আমার কথা, ভাইয়ের কথাই মনে পড়েছিল তোমার? ওই ফাঁকা, অর্ধভগ্ন বাড়িটা এক বিকট একাকিত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে এখনও তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি স্পিডোমিটারের কাঁটা উপরে তুলে দিই। উল্টোডাঙা ব্রিজে উঠেই মনে হয়, ভাইকে একবার ফোন করে সবটা জানানো দরকার। পরমুহূর্তেই মনে হয়, ওই পেল্লায় একচক্ষু দানবের মতো বিশাল বাড়িটা কেবল আমার জন্যই বসে আছে। আমি ছাড়া ওই বাড়িটার কেউ নেই আজ আর। এক তীব্র অসহায়তা আর শ্বাসরোধ করে দেবার মতো অনুভূতি হচ্ছিল আমার। লেকটাউন মোড় যখন পেরোচ্ছি, মনে হচ্ছিল সময় যেন আর ফুরোচ্ছে না। মাথার ভিতরে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল সব। আমার শৈশব থেকে আজকের এই কোভিড-অধ্যুষিত ফাঁকা কলকাতার বুক চিরে আমার একলা গাড়ি চালিয়ে ছুটে যাওয়ার এই খণ্ড মুহূর্তগুলো যেন পুরোটাই অন্য কারও দেখা স্বপ্ন। এদের সঙ্গে মুখে ডবল মাস্ক-পরা এই আমির কোনও যোগ নেই।
সরু গলির মধ্যে কোনওক্রমে গাড়ি পার্ক করে আমি বাড়ির উঠোনে পা রাখি। সন্ধের অন্ধকার নামছে। জং-ধরা বহু পুরোনো লোহার গেট আর্তনাদ করে ওঠে। একতলার ভাড়াটেরা উঠে গেছে বহুদিন আগে। প্রায় ভগ্নস্তূপ একতলাটা। আমি সিঁড়ি ভেঙে পাগলের মতো উপরে উঠি। খাঁ খাঁ করছে হাট-খোলা দরজা। দোতলার পাঁচটা ঘরে কেউ নেই। মায়ের বিছানা একইরকম অগোছালো পড়ে আছে। মেঝেতে অত্যধিক ধুলোর পরত। আমি একছুটে ছাদে পৌঁছই...
গোটা ছাদ ম ম করছে জুঁইফুলের গন্ধে। যে গন্ধ আমি আশৈশব পেয়ে এসেছি। একবার ছাদ থেকে ঝুঁকে নীচের ফাঁকা উঠোনের দিকে তাকাই। শুকনো পাতা ঝরে পড়েছে গোটা উঠোনে। কোথাও কেউ নেই...
দমবন্ধ কোভিড-ঋতু। মানুষ নেই। একফোঁটা বাতাস নেই কোথাও...