চন্দ্রোদয়। এমন জন্মদিনের পার্টি এদেশে আর হয়েছে কখনও?
বাকিরা। কখনও নয়, কখনও নয়, এখন থেকে সব নিয়ম বদলে গেল। দুয়েকটা অধার্মিক রাজ্য বাদ দিলে গোটা স্বর্গভূমির সব রাজ্যেই এখন থেকে এরকমই পার্টি হবে।
চন্দ্রোদয়। স্বর্গভূমি বোলো না, স্বর্গভূমি বোলো না, বল নয়া স্বর্গভূমি। এখন আর তোমাদের ওই পুরোনো স্বর্গভূমি নয়, এখন নয়া স্বর্গভূমি!
একজন। ঠিক। নয়া স্বর্গভূমি! নয়া স্বর্গভূমি! বল, জয় মা নয়া স্বর্গভূমি!
সকলে। জয় মা নয়া স্বর্গভূমি!
চন্দ্রোদয়। তবে হ্যাঁ, এখনো একটা কাজ আমাদের বাকি আছে। ( প্রায় কাঁদতে কাঁদতে) আমি ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার পর সাত মাস হয়ে গেল, এখনও সব পাপ কাজ আমার রাজ্য থেকে বন্ধ হল না।
বলরাম। না গুরুজি, এখন সব পাপ শেষ হয়ে গেছে। পাপ খতম!
চন্দ্রোদয়। কী বাজে কথা বলছ বলরাম! তোমার সেই ধর্ষণের কেসটা...
সি-এ। (ছোট ছেলেটিকে দেখিয়ে) এসব কথা একটু পরে হলে হত না গুরুজি, ছোটদের সামনে...
চন্দ্রোদয়। ছোটদের সামনেই বলতে হবে, বুঝলে? ওদের মনটা এখন জলের মত স্বচ্ছ, আমাদের এই স্বচ্ছ স্বর্গভূমির মতো। ভালো খারাপ চিনতে শিখুক, আদর্শ কাকে বলে সেটা বুঝতে শিখুক, ওরাই তো আমাদের নতুন স্বর্গভূমির ভবিষ্যৎ। সামনের নির্বাচন থেকে আমরা সব অবোধ শিশুকে ভোট দেবার অধিকার দেব, জান না? শিশুরাই ভোট দেবে এখন থেকে, বিধর্মী আর না-ধর্মীরা সব বাতিল। হুঁঃ, দেশছাড়া করে ছাড়ব সব কটাকে। (বলরামকে) কী বলরাম, সেই ধর্ষণের কেসটা...
বলরাম। ধর্ষণের কেসটা, হাঃ হাঃ, সেটাও শেষ। সেটাও শেষ। পাপের শেষ। ওসব পাপের কথা ঈশান প্রদেশে আর কেউ ভাববেই না কোনদিন।
চন্দ্রোদয়। মানে? এ রাজ্যের গৃহ মন্ত্রী, মানে পুলিশ মন্ত্রী হিসেবে তুমি বলছ এ কথা? শেষ বললেই শেষ? কীভাবে শেষ হল? মেয়েটাকে যখন হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এক্স-রে করবার জন্যে, তখন সেই অ্যাম্বুলেন্সকে তোমার ওই নম্বরহীন লরিটা দিয়ে ধাক্কা মারার ব্যবস্থা করনি তুমি?
বলরাম। আমিই করেছিলুম গুরুজি। কিন্তু সে তো আপনার পরামর্শেই।
চন্দ্রোদয়। আমার পরামর্শে? আমি বলেছিলাম সব পাপের শেষ করতে হবে। শেষ! শেষ হয়েছিল? মাঝখান থেকে কোমর আর শিরদাঁড়া ভেঙে 'সব পাপের আধার নারী' – সে আবারও ফিরে এল হাসপাতালে!
বলরাম। মনে হচ্ছে লেটেস্ট আপডেট আপনি এখনো পাননি গুরুজি।
১। হ্যালো। হ্যালো, হ্যাঁ...। কে বলছেন? কাকে চাই?
২। আমি একটু সি-এম-এর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলুম, কিন্তু ওঁর ফোনটা সুইচ অফ করা আছে, এমনকি ওঁর
সি-এ-র ফোনটাও পেলুম না।
১। কে বলছেন আপনি? কোন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি নাকি? সি-এম-এর নম্বর, ওনার সি-এ-র নম্বর, এসব পেলেন কোথায়?
২)। না না, আমি সংবাদ মাধ্যমের কেউ নই, আমি একজন সাধারণ নাগরিক। অনেক কষ্ট করে ওঁদের নম্বর যোগাড় করেছি স্যর, প্লিজ একটু কথা বলিয়ে দিন।
১)। আপনি লাইনে থাকুন, চেষ্টা করছি। (১ মঞ্চে প্রবেশ করে, মুখ্যমন্ত্রীর সি-এ-র সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে, চন্দ্রোদয় মিষ্টি খেতে থাকে। একটু পর সি-এ সরাসরি চন্দ্রোদয়কে )
সি-এ। স্যর, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন, টেলিফোনে অপেক্ষা করছেন।
চন্দ্রোদয়। সব কথা শুনেছি। বলে দাও আমি একজনের জন্মদিনের একটা সাত্ত্বিক পার্টিতে আজ ব্যস্ত আছি। পরে সি-এ-কে ফোন করে যেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নেয়।
১)। ঠিক আছে স্যর (ঝুঁকে অভিবাদন করে বেরিয়ে যায়)।
চন্দ্রোদয়। আচ্ছা ঠিক আছে, সবাই মিষ্টি খেয়ে বেরিয়ে যাও, পার্টি আজ এখানেই শেষ। ( একটা সোফায় বসতে বসতে) বলরাম থাকবে, আর (সি-এ-কে) তুমি থাকবে।
চন্দ্রোদয়। (ছেলেটিকে দেখিয়ে) না না, ও যাবে না, ও যাবে না, এই তুই এখানে এসে বোস, (নিজের পাশে সোফায় বসায় – ছেলেটার কান ধরে) কী যেন নাম তোর?
ছেলে। রামদাস। রামদাস চৌধুরি।
চন্দ্রোদয়। বাঃ বাঃ, বেশ নাম, খাসা নাম। বোস্ এখানে। বসে বেশ মন দিয়ে শোন্ আমরা কী মিটিং করছি। মনটাকে পরিষ্কার কর্। তোরাই দেশের ভবিষ্যৎ। (হঠাৎ মুখটা একটু বেশিরকমের গম্ভীর করে – বলরামকে) হ্যাঁ, তুমি বলছিলে পাপের শেষ। শেষটা হলো কোথায়? কীভাবে? কোমর আর পা ভাঙলে শেষ হয়?
বলরাম। না গুরুজি, অন্য ডেভ্লাপমেন্ট হয়েছে।
চন্দ্রোদয়। কী ডেভ্লাপমেন্ট?
বলরাম। আজ বেলা চারটের সময় ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথে একটি মেয়েকে প্রায়-সম্পূর্ণ দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রায় বললুম এই জন্যে যে মুখে হাত চাপা-দেওয়া থাকায় মেয়েটির মুখের এক অংশ, আর হাতের ওই অংশটুকু বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। এই মেয়েটিই সেই মেয়ে।
চন্দ্রোদয়। জানলে কী করে, সেই মেয়ে? মানে, যে মেয়েকে তুমি ধর্ষণ করেছিলে?
চন্দ্রোদয়। তুমি কি সি-এ সাহেবকে দেখে ঘাবড়াচ্ছ? তুমি জান উনি কে? পার্টি-হায়ারার্কিতে উনি তোমার চেয়ে অনেক ওপরে। আর কিছুদিন পরেই উনি সান্দ্রপ্রস্থে ফিরে যাবেন। স্বয়ং পি-এম ওঁকে চাইছেন সে-কথা জান?
বলরাম। জানতুম না গুরুজি। তবে বলি?
চন্দ্রোদয়। হ্যাঁ, বলে ফেল। (হাতের ঘড়ি দেখে) হাতে সময় নেই বেশি।
বলরাম। দুর্জয় সিং আর রামখেলাওন শর্মাকে তো আপনি ভালোভাবেই চেনেন?
চন্দ্রোদয়। হ্যাঁ হ্যাঁ চিনি চিনি। রামখেলাওন তো আমার চিফ ইলেকশন এজেন্ট ছিল অ্যাসেম্বলি ইলেকশনে।
বলরাম। হ্যাঁ গুরুজি। আর দুর্জয় আমার। ওদের দুজনকে আমি দায়িত্ব দিয়েছিলুম। আমিই। আমি নিজে।
চন্দ্রোদয়। (শঙ্কিত ও উত্তেজিত) তার মানে? কী দায়িত্ব দিয়েছিলে? মেয়েটাকে পোড়াবার? ওরা আমাদের পার্টির অ্যাসেট, ওদের দিয়ে তুমি এই কাজ করিয়েছ?
বলরাম। (হেসে) আপনি আমাকে এত কাঁচা ছেলে মনে করলেন গুরুজি? ওরা করেনি, ওরা করবে কেন? ওদের হাতে কত ছেলে আছে, তাদের কাউকে দিয়ে করিয়েছে।
চন্দ্রোদয়। করিয়ে – ছে! তুমি কেমন করে জানলে? তুমি কাজটা দিয়েছিলে। কাজটা হয়ে গেছে তুমি জানলে কেমন করে?
সি-এ। হ্যাঁ, কাজটা হয়েছে। আমার কাছেও খবর আছে আজ বেলা চারটের সময় ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথে একটি মেয়েকে প্রায় সম্পূর্ণ দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে মেয়েটি কে, কীভাবে হলো, আর এ ব্যাপারে দায়ী কে, এসব এখনো জানা যায়নি।
বলরাম। আমি পার্টিতে আসবার জন্যে বেরোবার ঠিক আগেই দুর্জয় আমাকে ফোন করেছিল। ও কনফার্ম করেছে, পাপ খতম। আর ওরা নিজেরা স্পটের কাছাকাছিও ছিল না।
চন্দ্রোদয়। বললেই মানবো? যার কোমর আর শিরদাঁড়া ভাঙা সে জাতীয় রাজপথে কীভাবে এলো? আর, এলোই বা কেন? পোড়বার জন্যে? ঠিক আছে, আজ মিটিং শেষ। (বলরামকে) তুমি অফিসে আসছ তো কাল? সকালে আমার সঙ্গে অফিসেই দেখা কোরো, এখন একটু ঘুমোনো দরকার।
চন্দ্রোদয়। কী ব্যাপার, আপনি কে? এখানে কেন?
নাগরিক। নমস্কার স্যর, আমি একজন নাগরিক, আপনার কাছে এসেছি।
চন্দ্রোদয়। এখানে ঢুকলেন কীভাবে? কী চাই আপনার?
নাগরিক। কী চাই বলব বলেই তো এসেছি। বলি?
চন্দ্রোদয়। কিন্তু কে ঢুকতে দিল আপনাকে? আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল? নাকি ঘুষ দিয়ে ঢুকলেন?
নাগরিক। ঘুষ তো, স্যর, নাগরিকরা দিয়েই থাকে। সেটা তো নিয়মের মধ্যেই পড়ে। তা-ই দিয়েছি ধরে নিন।
চন্দ্রোদয়। চোপ। ঘুষ দিয়ে আবার বড় মুখ করে বলা হচ্ছে! (টেবিলের কলিং বেলটা জোরে বাজায়, সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করে গৃহমন্ত্রী বলরাম) (বলরামকে) তুমি কেন?
বলরাম। আমারই তো আসার কথা ছিল।
চন্দ্রোদয়। আসার কথা ছিল? ও হ্যাঁ, ছিল। বসো। (বলরাম নাগরিকের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে, চন্দ্রোদয় আবার বেল বাজায়, খাকি পোশাকের এক আর্দালি এসে সেলাম ঠোকে) বেল দিলাম, এলে না কেন?
পুলিশ। আমি তো ঢুকতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু এইচ-এম স্যর ঢুকে গেলেন।
চন্দ্রোদয়। বেল বাজিয়ে আমি এইচ-এম স্যরকে ডাকি, না তোমাদের ডাকি? এইচ-এম স্যর ঢুকে গেলেন আর তুমি বসে রইলে! যত্ত সব! (নাগরিককে দেখিয়ে) যাও, এই ভদ্রলোককে ভিজিটর্স রূমে বসিয়ে রাখ, আমি পরে ডাকব (চেয়ার থেকে উঠে নাগরিক পুলিশের দিকে এগিয়ে যায়, পুলিশের পেছন পেছন এগোতে থাকে, এমন সময় চন্দ্রোদয় চেঁচিয়ে) ওঁকে কফি দিও, আমার লোক।
বলরাম। রামখেলাওন আর দুর্জয়, দুজনেই আমার সঙ্গে দেখা করেছে। ওরা খুব বিশ্বস্ত চার জন ছেলেকে দায়িত্ব দিয়েছিল। ভালো ছেলে গুরুজি, প্রত্যেকের অনেকগুলো করে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। ওরা হাসপাতাল থেকে মেয়েটাকে বাইরে আনবার ব্যবস্থা করে, তারপর রাজপথে ওর গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগায়।
চন্দ্রোদয়। বডিটা?
বলরাম। (স্পষ্টতই অস্বস্তিতে) বডিটা, মানে, বডিটা কী করবে জানতে চেয়ে ছেলেগুলো ফোন করেছিল রামখেলাওনকে। তখন কী বলবে বুঝতে না পেরে রামখেলাওন আর দুর্জয় দুজনেই চেষ্টা করে আমাকে মোবাইলে ধরতে। আমার মোবাইল নাকি তখন সুইচ অফ ছিল। রামখেলাওন আপনাকেও নাকি তারপর চেষ্টা করেছিল মোবাইলে। ধরতে পারেনি। তারপর ওরা স্পটে যায়। স্পটে গিয়ে, মানে, বডিটা, মানে, গুরুজি, বডিটা ওরা আর দেখতে পায়নি। ওরা বলছে ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথের কাছেই একটা জঙ্গলের মতো জায়গা আছে। শেয়াল-টেয়ালে...
চন্দ্রোদয়। চুপ কর! নিজের কনস্টিটুয়েন্সির খবর রাখো না আবার মন্ত্রী হয়েছ! পাছায় লাথি মেরে বের করে দিতে হয় এই সব এম-এল-এদের! শেয়াল-কুকুর নয়, কী হয়েছে আমার কাছ থেকে শোন। গতকাল বিকেলে কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশনে একটা ফোন আসে। পুরুষ মানুষের গলা, নিজের পরিচয় দেয় নাগরিক বলে। সে ফোনে বলে,
ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথের ওপর একটা আধপোড়া বডি পড়ে আছে। খবর পেয়ে পুলিশ বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর এই নাগরিক লোকটাও এসে পৌঁছোয় থানায়। সে বলে, বডিটার ব্যাপারে সে-ই ফোন করেছিল, এখন একটা
এফ-আই-আর করতে চায়। ও-সি রাজি হয়নি। লোকটা একটু টেঁটিয়া গোছের ছিল, সে তক্ক জুড়ে দেয়। ও-সি তখন ফোন করে কান্নাও-এর এস-পি-কে। শেষ পর্যন্ত এস-পি-র পরামর্শে গ্রেপ্তার করা হয় লোকটাকে।
বলরাম। (উঠে দাঁড়িয়ে, আবেগে কম্পিত কণ্ঠস্বর) আপনাকে কী বলবো গুরুজি, আপনার পায়ের ধুলো দিন। (হামাগুড়ি দিয়ে বসে টেবিলের ফাঁক দিয়ে চন্দ্রোদয়ের পা ছোঁবার চেষ্টা করে, ততক্ষণে চন্দ্রোদয় পা তুলে দেয় টেবিলের ওপর, ভক্তিভরে প্রণাম করে বলরাম) কী আপনার নেটওয়র্ক, এমনকী রামখেলাওন আর দুর্জয় জানবার আগেই আপনি সবটাই জেনে গেছেন। (হাত তুলে ভঙ্গী করে) রাধামাধবের দয়া যে বুদ্ধি করে লোকটাকে গ্রেপ্তার করে রেখেছে পুলিশ।
চন্দ্রোদয়। নেটওয়র্ক আমার নয় বলরাম, নেটওয়র্ক তোমার। তুমি পুলিশ মন্ত্রী, কার কাছে রিপোর্ট করে তোমার ডাইরেক্টর জেনারাল অফ পুলিশ?
বলরাম। অফিশিয়ালি তো আমার কাছেই, কিন্তু বড্ড বেশি ইংরিজি বলে লোকটা, পুলিশে আসার আগে নাকি ইংরিজির প্রফেসর ছিল।
চন্দ্রোদয়। ইংরিজির ভয়ে যদি অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাও, তাহলে বলে দাও, আজই তোমাকে অফিস পরিষ্কার করার দপ্তরের মন্ত্রী করে দেব। সেখানে নিরক্ষরও চলবে।
বলরাম। (হাত কচলিয়ে) কী যে বলেন গুরুজি।
চন্দ্রোদয়। চোপ। এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে নিজের কনস্টিটুয়েন্সি ছেড়ে লক্ষ্মণাবতীতে বসে আছ কেন? এখানে বিনি পয়সায় বাংলো পেয়েছ বলে? মেয়েটা তো শুনলাম তোমার পাশের বাড়ির, কলেজে বি-এ পড়ে। পাশের বাড়ির মেয়েকে রেপ করতে গেলে?
বলরাম। ওর বাবা বিরোধী দলের একজন নেতা, অ্যাসেম্বলী ইলেকশনের সময় বিরোধী ক্যাম্পে নেতাগিরি করছিল।
চন্দ্রোদয়। করছিল তো করছিল, কী হয়েছে তাতে? জিতে তো গেছ। আর অতই যদি রাগ, লোকটাকে রেপ করলেই পারতে। মেয়েটাকে করতে গেলে কেন? কলেজে পড়তো, তোমার মেয়ের চেয়েও তো ছোট।
বলরাম। আমি একা করিনি গুরুজি।
চন্দ্রোদয়। জানি জানি। গ্যাং রেপ। তোমার পরে লাইনে তোমার আরও অনেক ছেলে ছিল যতক্ষণ না মেয়েটা জ্ঞান হারায়। আমাকে ঘাঁটিও না, সব জানি আমি। এখন যা বলছি কথা শোন। এখান থেকে বেরিয়ে এখনই কান্নাওতে ফিরে যাও। ওখানে অবস্থা ভালো নয়, অ্যাজিটেশন হচ্ছে, কাল থানা ঘেরাওও হয়েছিল। আর একটুও সময় নষ্ট করবে না। যাঃও। (বলরামের প্রস্থান। বলরাম বিদায় নেবার পর আবার ঘন্টা বাজায় চন্দ্রোদয়, খাকি পোশাকের পুলিশটি এসে, স্যাল্যুট করে দাঁড়ায়) হ্যাঁ, ওই যে লোকটাকে বসাতে বলেছিলাম, নিয়ে এস ওকে। (চন্দ্রোদয় কাগজ-পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে, নাগরিক লোকটি হাজির হয়)
নাগরিক। নমস্কার স্যর, বসছি (বসে)। যে ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছিলাম সেটা সেরে নিই। গতকাল দুপুরে
ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথে একটি মেয়েকে প্রায় সম্পূর্ণ দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়, আপনি জানেন?
চন্দ্রোদয়। জানি, দুপুরে পড়েছিল। কিন্তু মোবাইল পুলিশ বডিটাকে স্পট করে থানায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে।
নাগরিক। আপনি তাহলে ব্যাপারটা জানেন স্যর। অর্থাৎ আপনার সম্বন্ধে যে কথাটা এই রাজ্যে চালু, দেখা যাচ্ছে সেটা ঠিকই, সি-এম সবই জানেন। খুব আশ্বস্ত হলাম স্যর। তবে মোবাইল পুলিশকে নিয়ে যে কথাটা বললেন, সেটা ঠিক নয়। কিন্তু সে কথা থাক, বডিটা যে এখন পুলিশের জিম্মায় আছে সে খবরটা ঠিকই। আমি আপনার কাছে এসেছিলাম শুধু একটা কথা জানতে। বডিটা কার?
চন্দ্রোদয়। এই কথার উত্তর জানবার জন্যে আমার কাছে এসেছেন? পুলিশে যান, পুলিশে যান। যেটা যার কাজ এ রাজ্যে সে-ই সেটা করে। মেয়েটা আমার জিম্মায় যে নেই সেটা তো আপনার জানা। পুলিশকে জিজ্ঞেস করুন, পুলিশই বলবে। তবে হ্যাঁ, আপনাকে বলবে কেন? আপনি কে?
নাগরিক। আমি বিশেষ কেউ নই, বলেইছি তো আপনাকে, আমি একজন সাধারণ নাগরিক। কিন্তু সেটা খুব জরুরি কিছু নয়, আসলে আপনাকে একটা জরুরি – মানে, আপনার পক্ষে জরুরি – খবর আমার দেওয়া দরকার ছিল। সেটা দিয়েই চলে যাব। গত পরশুদিন কান্নাও-এর কোতয়ালী থানার কাছেই, মানে এ রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীর বাড়ি যেখানে, সেখানে একটি মেয়ে সকালে কলেজ যাবার জন্যে বেরিয়েছিল। মর্ণিং কলেজ, বারটার মধ্যেই তার ফেরার কথা। রাত আটটার মধ্যেও সে ফেরেনি।
চন্দ্রোদয়। এ সব গল্প আমার কাছে করছেন কেন? আমার অনেক কাজ আছে, সময় নষ্ট করবেন না।
নাগরিক। আপনি যদি না শুনতে চান স্যর, তাহলে চলেই যাব। তবে, ওই যে বলছিলাম আপনার রেপুটেশনটার কথা, এ রাজ্যের সব খবর আপনি জানেন, সব খবরই আপনি রাখেন, তাই ভাবলাম আপনি শুনতে চাইবেন। বিশেষ করে, আপনার একজন সহকর্মীর কথাও এ কাহিনীতে এসে যাবে স্যর।
চন্দ্রোদয়। কোন্ সহকর্মী?
নাগরিক। পুলিশমন্ত্রী, স্যর। আসলে, যে মেয়েটার কথা বলছিলাম, ওর বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ির পরেই আপনার পুলিশমন্ত্রীর বাড়ি। মেয়েটা যখন অত রাতেও ফিরল না, তখন তার বাড়ির লোকরা কোতয়ালী থানায় গেল একটা মিসিং ডায়েরি করাতে। থানা কিছুতেই সেই ডায়েরি নিতে রাজি নয়।
চন্দ্রোদয়। কেন?
নাগরিক। সেটাই ধাঁধা স্যর। অনেক চাপাচাপি করবার পর থানার ও-সি বললেন, ডায়েরি নিতে হলে ওই মন্ত্রীকে দিয়ে লিখিয়ে আনতে হবে। কেন? না, মন্ত্রীর খুব বিশ্বস্ত একজন নাকি থানায় এসে বলে গেছে ওইদিন সারাদিন, আর পরের দিন সকালে, এ দেশের কোন থানাতেই কোন মিসিং ডায়েরি নেওয়া হবে না। দেশের পক্ষে এটা খুব জরুরি, ইন্টারনাল সিকিউরিটি ইস্যু আছে। কেউ যদি খুব ধরাধরি করে, সত্যি-সত্যিই যদি জেনুইন মিসিঙের কেস হয়, তাহলে তাকে মন্ত্রীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। মন্ত্রী লিখে দিলে তবেই ডায়েরি হবে। ওরা মন্ত্রীর বাড়িতেও গিয়েছিল, তাঁকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।
চন্দ্রোদয়। সে তো হতেই পারে, মন্ত্রীদের কত রকমের কাজ থাকে। কিন্তু মেয়েটার কী হল? পরের দিন দুপুরে থানা নিল ডায়েরী?
নাগরিক। আপনি জানেন না স্যর? সত্যিই জানেন না? তাহলে আর বসে কী হবে? আমি ভেবেছিলাম আপনি তো সবই জানেন, এটাও জানেন নিশ্চয়ই, আপনার কাছ থেকেই জানা যাবে। জানেনই না যখন, তাহলে আমি যাই (চেয়ারটা পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ায়)।
চন্দ্রোদয়। যাবেন? নেহাৎই যাবেন? আর একটু বসুন না। বসুন বসুন, শুনুন। একটা কথা আপনি এসেই বলেছিলেন, সেটার ব্যাপারে একটু কথা বলা যাক। চেয়ারে বসতে বসতেই আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল ছিয়াত্তরের
ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথে একটি মেয়েকে প্রায় সম্পূর্ণ দগ্ধ অবস্থায় যে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় সেটা কি আমি জানি? আমি বললাম, জানি, এবং এ-ও বললাম, মেয়েটিকে মোবাইল পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে। আপনি আমার খবরটার বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না, একবার শুধু বললেন, মোবাইল পুলিশের ব্যাপারে আমি যা বলেছি সেটা ঠিক খবর নয়। যা বলছি তা ঠিক?
নাগরিক। হ্যাঁ, ঠিকই তো।
চন্দ্রোদয়। ঠিক। আপনার খবরটা একেবারে ঠিক ছিল নাগরিকবাবু, একেবারে ফার্স্টহ্যান্ড খবর ছিল আপনার হাতে। আপনার চেয়ে বেশি কেউ জানতো না আসলে কী হয়েছিল। কিন্তু আমাকে বলুন, কীভাবে কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশন থেকে আপনি বেরিয়ে এলেন আজ সকালে, এবং বেরিয়ে এসেই যে কাজটা প্রথম করলেন তা হল একেবারে আমার অফিসে চলে আসা। আমার অফিসে ঢোকবার জন্যে আপনি কী কৌশল নিয়েছিলেন আমি জানি না, আমিই জিজ্ঞেস করেছিলাম ঘুষ দিয়ে ঢুকেছেন কিনা। আপনি খুব স্মার্ট লোক, স্পষ্ট করে আমার জিজ্ঞাসার জবাব দেননি, বলেছিলেন হতেও পারে। ঠিক বলছি?
নাগরিক। এক্কেবারে ঠিক বলেছেন। ঠিক 'হতেও পারে' এভাবে বলিনি, সম্ভবত বলেছিলাম, সেটাই ধরে নিন।
চন্দ্রোদয়। এখন আমি আপনাকে স্পষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করি, পুলিশ স্টেশনের লক-আপ থেকেও কি ঘুষ দিয়েই বেরোলেন?
নাগরিক। আপনার প্রশ্নটা কিন্তু বুঝতে পারলাম না স্যর।
চন্দ্রোদয়। খুব সহজ প্রশ্ন। একেবারে প্রাঞ্জল করে বলেছি। আবারও বলছি, শুনুন। গতকাল দুপুর থেকে শুরু করে সারারাত আপনি কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশনে ছিলেন কিনা।
নাগরিক। না তো।
চন্দ্রোদয়। নাগরিকবাবু, আপনাকে একটা কথা বুঝতে হবে। আপনি যেখানে বসে আছেন সেটা হল ঈশান প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর মুখোমুখি। ঠিক এই জায়গাটা যদিও কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশন নয়, এইখানে, এই মুহূর্তে, একটা পুলিশ স্টেশনে যা যা ঘটনা ঘটতে পারে, তার সবই আমি ঘটাতে পারি। অর্থাৎ আপনাকে অ্যারেস্ট করে, হাতে হাতকড়া লাগিয়ে, প্রয়োজন হলে পায়েও। এবং তারপর এমনকি একটা নির্জন লক-আপে অন্তত একটা রাত্তিরের জন্যে রেখে দেওয়া, এবং তারপর যা যা ব্যবস্থা।
নাগরিক। কিন্তু, কেন করতে যাবেন এসব?
চন্দ্রোদয়। আপনি করতে বাধ্য করছেন বলে। আপনাকে আমি শেষ সুযোগ দিচ্ছি। গতকাল ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথে একটি দগ্ধ মৃতদেহ আপনি দেখেন। দেখেই একটা কথা আপনার মাথায় আসে। কী কথা? যে কথা আপনি আজ এ ঘরে ঢুকেই বলবার চেষ্টা করেছিলেন। ঈশান প্রদেশের জনপ্রিয় গৃহমন্ত্রী শ্রীযুক্ত বলরাম চৌধুরীর সঙ্গে আপনার কী ব্যক্তিগত শত্রুতা বা বন্ধুত্ব আছে আমি জানি না। কিন্তু এটা আপনার কথা থেকে বোঝা গেল যে গত পরশু শ্রীযুক্ত চৌধুরীর প্রতিবেশী একটি মেয়ে কলেজ যাবার নাম করে বাড়ি থেকে পালায়। তারপর গতকাল একটা দগ্ধ মৃতদেহ আপনি জাতীয় সড়কে দেখেন। সেটা পুড়ে এতই বিকৃত দেখাচ্ছিল যে তা পুরুষ না নারীর তা বোঝা যাচ্ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে আপনার মাথায় একটা মতলব আসে। মৃতদেহটা যদি কোন মেয়ের হয়, এটাকেই সেই পলাতকা মেয়ে বলে চালিয়ে ঘটনাটার সঙ্গে শ্রীযুক্ত চৌধুরীকে হয়তো ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়। আপনি প্রথমেই পুলিশ স্টেশনে ফোন করে মৃতদেহটা সেখানে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। তারপর নিজেও সশরীরে চলে আসেন সেখানে, এবং মৃতদেহটাকে কোন মেয়ের মৃতদেহ হিসেবে নথিভুক্ত করে একটা এফ-আই-আর করতে চান। আমাদের অত্যন্ত দক্ষ এবং বুদ্ধিমান পুলিশ আপনার মতলব ধরে ফেলে, এবং আপনার কথা মতো এফ-আই-আর নিতে আপত্তি করে। তখন আপনার ব্যবহার এতটাই অমার্জিত ও হিংস্র হয়ে ওঠে যে আপনাকে স্পটেই অ্যারেস্ট করে লক-আপে রাখা হয়। নিয়ম অনুযায়ী আজ আপনাকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হত, কিন্তু সে সুযোগও আপনি দেননি। এবং আপনার আত্মবিশ্বাস এমনই প্রবল যে লক-আপ থেকে পালিয়ে আপনি সোজা চলে এসেছেন আমার অফিসে।
নাগরিক। এতক্ষণ পর্যন্ত নীরবে আপনার গল্পটা শুনলাম স্যর। ভালো গল্প, তবে আরও ভালো হত যদি চরিত্রগুলোও আপনার গল্পের মতো কল্পিত হত। আপনার জনপ্রিয় পুলিশমন্ত্রী বা আমি, বা যে মৃতদেহটিকে নিয়ে আপনার গল্প, তার কোনটাই কল্পনার নয়। শুধু ওইখানটাতেই একটু অসুবিধে হয়ে গেছে, না হলে ভালো, বেশ ভালো গল্প।
চন্দ্রোদয়। (গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও, বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলে) আপনাকে আজগুবি গল্প বলবার জন্যে আমি এখানে বসিয়ে রাখিনি নাগরিকবাবু। যা যা বললাম তার প্রত্যেকটার প্রমাণ আছে, আমাদের প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা প্রয়োজন হলে সে প্রমাণ যথাযোগ্য জায়গায় দাখিল করবেন। কেমন যেন মাঝে মাঝে হয় না? – কোন কোন মানুষকে বিনা কারণেই ভালো লেগে যায়, আপনার ক্ষেত্রেও বোধ হয় আমারও সেরকমই একটা কিছু হচ্ছিল, তাই একটা সুযোগ দিচ্ছিলাম আপনাকে। আপনি নিলেন না। ঠিক আছে, আমি টেলিফোনে একজনের সঙ্গে কথা বলব, আপনি সামনেই থাকবেন। তারপর, সবটা শোনবার পর, আপনি ওই চেয়ারে বসে থাকা অবস্থাতেই আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে (বলতে বলতে উঠে পড়ে চন্দ্রোদয়, তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে হন হন করে ভেতরে চলে যায়, নাগরিক তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটা বই বের করে পড়তে থাকে, কিছুক্ষণ পর চন্দ্রোদয় ফিরে আসে, কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের চেয়ারে বসে)।
চন্দ্রোদয়। (নাগরিকের দিকে ঘুরতে ঘুরতে) একটু বসুন, একটা ফোন আসছে। (হঠাৎ খেয়াল করে নাগরিক একটা বই পড়ছে) বাঃ, দিব্যি আছেন তো আপনি, একটুও সময় নষ্ট নয়, ঝোলায় সব সময় একটা বই...
নাগরিক। ভাবলাম হয়তো দেরি হবে আপনার।
চন্দ্রোদয়। কী বই ওটা?
নাগরিক। মাইন কাম্পফ্। হিটলারের আত্মজীবনী। (কথা বলতে বলতে টেবিলের ল্যাণ্ডফোনটা বেজে ওঠে, চন্দ্রোদয় ফোনটা ধরে)
চন্দ্রোদয়। হ্যাঁ বল। ও। (টেলিফোনের মাউথপিসে হাতটা চেপে ধরে) হ্যাঁ, ইন্টারকমে ঢুকিয়ে কলটা ট্রান্সফার করে দাও আমাকে, তোমার রিসিভারটাও অ্যাক্টিভ রাখ, কথাবার্তা সব নোট কর। (নাগরিকের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে বোঝায় কলটা তারও শোনা দরকার, রিসিভার থেকে এবার স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা যায়।)
রিসিভার। গূড মর্ণিং স্যর, আমিই আপনাকে ফোন করতাম, কিন্তু সান্দ্রপ্রস্থ থেকে, মানে পি-এম-এর সেক্রেটারিয়েট থেকে একটা কল এসেছিল তাই একটু দেরি হয়ে গেল।
চন্দ্রোদয়। কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশনে যে লোকটাকে কাল আটক করা হয়েছিল তাকে আজ কোর্টে প্রডিউজ করা হয়েছে কিনা জান?
রিসিভার। কেসটা একটু ডিফিকাল্ট হয়ে গেছে স্যর, সেটা বলবার জন্যেই আপনাকে ফোন করতে চাইছিলাম।
চন্দ্রোদয়। হুঁ, জানি তো, তোমার কালপ্রিট আমার সামনেই বসে আছে।
রিসিভার। আপনার সামনে? ঠিক শুনছি স্যর? হাউ'জ ইট পসিব্ল্? এত তাড়াতাড়ি? কোর্ট তো এত তাড়াতাড়ি বসেই না।
চন্দ্রোদয়। কোর্ট? কী বাজে কথা বলছ? নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও, না মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?
রিসিভার। আমি ঠিক আপনার কথা বুঝতে পারছি না স্যর। কাউকে অন-স্পট অ্যারেস্ট করলে তাকে উইদিন দ্য নেক্সট টুয়েন্টি-ফোর আওয়ার্স কোর্টে প্রড্যুস করতে হয় ঠিকই, কিন্তু যতই তাড়াতাড়ি হোক, এইটুকু সময়ের মধ্যে কোর্টে প্রড্যুস করে রিলিজ করা তো ইম্পসিব্ল্।
চন্দ্রোদয়। প্রশাসনের টপ পোস্টে বসে আছ, আর বসে বসে ঘুমোচ্ছো। তোমার নীচের লোকরা তো তোমাকে পাত্তাই দেয় না, কোথায় কী হচ্ছে কোন খবরই পৌঁছোয় না দেখছি তোমার কাছে। এখ্খুনি এস-পির সঙ্গে কথা বলে প্রথমে নিজে জানবে, লোকটার পক্ষে এই মুহূর্তে আমার সামনে বসে থাকা কীভাবে সম্ভব। আর তারপর আমাকে জানাবে, বুঝলে?
রিসিভার। ইয়েস স্যর, শ্যোর স্যর, এখ্খুনি।
চন্দ্রোদয়। দাঁড়াও। লাইনটা কেটে দিও না হড়বড় করে। তুমি যে বললে তুমিই আমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলে,
পি-এমের সেক্রেটারিয়েটের একটা কল পেয়ে দেরি হয়ে গেল, কী কথা বলতে চাইছিলে আমার কাছে?
রিসিভার। স্যর, গতকাল মাঝরাত্তিরে ঘুম ভাঙিয়ে একটা কল আসে আমার কাছে। হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার ফোন করেছিল।
চন্দ্রোদয়। হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার কেন?
রিসিভার। চিফ জাস্টিসের কাছ থেকে একটা এক্সট্রীমলি ইম্পর্ট্যান্ট অ্যাণ্ড আর্জেন্ট মেসেজ ডেলিভার করার জন্যে। ও আমাকে মেসেজটা মুখে বলেছে অ্যাট ওয়ান-থার্টি এ-এম, তারপর আজ সকাল সাতটায় ওই ওয়ান-থার্টি এ-এমের মেসেজ কনফার্ম করে আমার রেসিডেন্সে ফিজিকাল ডেলিভারী দিয়ে গেছে। ডেলিভারী পেয়েই অবিশ্যি আমার অফিস থেকে ফ্যাক্স করে কান্নাওয়ের এস-পির অফিসে আর কান্নাও সদর পুলিস স্টেশনে ওই মেসেজ পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু কীভাবে জানিনা আজ সকালের মধ্যেই সেই খবর পৌঁছে গেছে এমনকী সান্দ্রপ্রস্থেও, তাই আপনাকে আমি কিছু জানাবার সুযোগ পাবার আগেই পি-এমের সেক্রেটারিয়েট থেকে ফোন এসেছিল।
চন্দ্রোদয়। মেসেজটা কী?
রিসিভার। পুরোটাই বলব, না আগে এস-পিকে ফোন করে নেব স্যর?
চন্দ্রোদয়। এই বুদ্ধি নিয়ে কীভাবে প্রশাসনের শীর্ষে বসে আছ বুঝতে পারি না। পি-এমের কাছে খবর চলে গেছে, আর তুমি আমাকে জানাবার আগে এস-পির সঙ্গে কথা বলতে চাও? মেসেজটা কী?
রিসিভার। কাল যখন কান্নাও সদর পুলিস স্টেশনে বডিটা আনা হয়েছিল, আর তারপরেই এক নাগরিক, ইভেনচুয়ালি যাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল সে, সে এসে এফ-আই-আর করতে চেয়ে অনেকটা সময় নষ্ট করল, ততক্ষণে বোধ হয় সেই নাগরিকের বন্ধু আর কয়েকজন নাগরিক হাইকোর্টে চলে যায়, চিফ জাস্টিসের সঙ্গে দেখা করবে বলে। ওদের মধ্যে দুয়েকজন উকিলও ছিল মনে হয়। চিফ জাস্টিস ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু লোকগুলো নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত রাত ন'টার সময় চিফ জাস্টিসের চেম্বারে ওরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে। ওই উকিল নাগরিকরা নাকি ওদের সঙ্গে কিছু কাগজ-পত্রও এনেছিল, সেগুলো ওরা চিফ জাস্টিসের হাতে দেয়, তিনি পড়েন। পড়ার পর কয়েকটা প্রশ্ন করেন ওদের, জবাব দেয় ওরা। চিফ জাস্টিস বলেন, আমি সুয়ো মোটো কগনিজেন্স নিচ্ছি। দিস নীডস টু বি স্টপ্ড্ ইমিডিয়েটলি। হাইকোর্টে তখন চিফ জাস্টিস নিজে আর রেজিস্ট্রার ছাড়া ইম্পর্ট্যান্ট আর কেউ ছিল না বোধ হয়। চিফ জাস্টিস নিজের হাতে একটা নোট লেখেন, তারপর রেজিস্ট্রারকে বলেন সেটাকে টাইপ করাবার ব্যবস্থা করিয়ে নিয়ে আসতে। উনি নিজের হাতে সেটাতে সই করে তারপর যাবেন। নোটটা আমাকে অ্যাড্রেস করে। উনি লিখেছেন, গতকাল যে বডিটা ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথ থেকে কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশনে এসেছে, সে বিষয়ে উনি একটা পিটিশন পেয়েছেন। এক্সট্রা-অর্ডিনারী সিচুয়েশন হিসেবে কোর্ট এ ব্যাপারে ইমিডিয়েট কগনিজেন্স নিচ্ছে। বডিটাকে টিল ফার্দার অর্ডার যেন ক্রিমেশনে না পাঠানো হয়। এটাকে প্রিজার্ভ করতে হবে। ইন ডিউ কোর্স পিটিশনটাকে ডিসপোজ করা হবে। (টেলিফোনে কথা শুনতে শুনতে চন্দ্রোদয়ের চোখে-মুখে প্রবল ভীতি এবং ক্রোধের চিহ্ণ ফুটে ওঠে সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে।)
চন্দ্রোদয়। চিফ জাস্টিস এখন কে?
রিসিভার। জাস্টিস গুণময়...
চন্দ্রোদয়। শুয়োরের বাচ্ – রাধামাধব – সরি, মুখ দিয়ে খারাপ কথা বেরিয়ে যায়। ও লোকটা এখনও আছে? কবে থেকে পি-এমকে বলছি লোকটাকে ছায়ালয় প্রদেশে বদলি করে দিতে। দুজন মাত্র জাজ ওখানে! বুঝতো কত ধানে কত চাল!
রিসিভার। স্যর, ওই যে আপনি বলছিলেন এস-পিকে ফোন করে আপনাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানাতে, এস-পিকে কী জিজ্ঞাসা করব স্যর?
চন্দ্রোদয়। হুঁ, মেমারী বটে! তোমাকে যে কোথায় ট্রান্সফার করা যায় ভেবে পাই না। জিজ্ঞেস করবে কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশনে যে লোকটাকে কাল আটক করা হয়েছিল তাকে আজ কোর্টে প্রডিউজ করা হয়েছে কিনা।
রিসিভার। রাইট স্যর, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে জানাচ্ছি। (ফোন কেটে যায়)
চন্দ্রোদয়। (নাগরিককে) আপনি তো আশ্চর্য লোক মশাই, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে হাতে-পায়ে বেড়ি লাগিয়ে অন্ধকার সেল-এ পুরে দেওয়া হবে, আর আপনি নিশ্চিন্তে পা দুলিয়ে দুলিয়ে বই পড়ে চলেছেন! একেবারে হার্ডেন্ড্ ক্রিমিনাল! কী যেন বললেন বইটা, একটা খটোমটো নাম? শুনলাম তো মহাত্মা হিটলারের লেখা। ভালো বই?
নাগরিক। আপনার পড়া নয়? পড়তে চান তো দিয়ে দিতে পারি আপনাকে।
চন্দ্রোদয়। আমার কি আর পড়ার সময় আছে? ছোটবেলায় মহাত্মা হিটলারের নাম শুনেছি গুরুজিদের (খোলা ডানহাত বুকের সামনে নিয়ে এসে দলীয় স্যাল্যুট করে) মুখে, তাই জিজ্ঞেস করলাম। (টেলিফোন বেজে ওঠে, রিসিভার তোলে চন্দ্রোদয়, রিসিভারে মুখ প্রায় লাগিয়ে কথা বলে) হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক কিছুক্ষণ আগেই যা করেছিলে। হ্যাঁ, ইনটারকমে দিয়ে দাও, আর তোমার এণ্ডে... (ফোন রেখে দেয়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ফোনটা বেজে ওঠে, চন্দ্রোদয় রিসিভার তুলে নেয়) হ্যাঁ, বল।
রিসিভার। এস-পি কান্নাও সদর পুলিস স্টেশনেই ছিল স্যর, আজ সকালে আমার কাছ থেকে চিফ জাস্টিসের মেসেজটা পেয়েই দৌড়েছে বডিটা দেখতে। যাক, বডিটা রয়েছে এখনো।
চন্দ্রোদয়। তোমাকে কি বডির খবর জানাবার জন্যে আবার ফোন করতে বলেছিলাম?
রিসিভার। না স্যর, মানে আমার মাথায় ঘুরছিল কথাটা। মেসেজ পাবার আগেই যদি বডিটাকে ক্রিমেট করে দেওয়া হয়ে থাকত, তার কন্সিক্যুয়েন্স কী হবে ভেবে একটু অস্বস্তিতে ছিলাম।
চন্দ্রোদয়। কিন্তু যে কথাটা আমি জানতে চেয়েছিলাম, সেটা হলো কালকের ওই এফ-আই-আর করতে আসা নাগরিক, ওকে আজ কোর্টে প্রডিউজ করা হয়েছে কিনা।
রিসিভার। প্রডিউজ করা হচ্ছে, মানে পুলিস ভ্যানে অন্যান্য ক্রিমিনালদের সঙ্গে ওকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোর্ট চত্বরে ওরা পৌঁছিয়েও গেছে। কোর্ট বসলেই ওদের পেশ করা হবে। তবে আরও একটা অ্যাডিশনাল খবর আপনাকে দিই স্যর। আজ সকাল হতে-না-হতেই আরও একদল নাগরিক পুলিস স্টেশনে পৌঁছোয়, ওরাও আমাদের ভ্যানের সঙ্গে সঙ্গেই গেছে। ওদের কথাবার্তা আমাদের ফোর্স যতটুকু শুনেছে তাতে মনে হয় ওই নাগরিকদের সঙ্গে আরও কয়েকজন নাগরিক ছিল, ওরা উকিল। আর শুধু তা-ই নয়, ওরা বোধ হয় চিফ জাস্টিসের কালকের অর্ডারটা এর মধ্যেই জেনে গেছে।
চন্দ্রোদয়। তার মানে, তুমি বলছ, আমার অফিসের এই ঘরে আমার ঠিক উল্টোদিকে যে নাগরিক বসে আছে, সে নাগরিক কালকের নাগরিক নয়? কাল সে সদর পুলিশ স্টেশনে আটক ছিল না?
রিসিভার। না স্যর, ছিল না।
চন্দ্রোদয়। ঠিক আছে, এখন তুমি রাখতে পারো। আজ সারাদিন যেন তোমাকে পাওয়া যায়, আমি আবারও ফোন করতে পারি। অনেকবার! (লাইন কেটে দেয়, তারপর অপেক্ষমান নাগরিকের দিকে তাকিয়ে) তাহলে নাগরিকবাবু, আজ ছাড়া পেয়ে গেলেন। কপাল ভালো আপনার। আপনাকে কিন্তু ভালোই লাগল আমার, আপনি লোক মন্দ নয়। ঠিক আছে, যান। (নাগরিক উঠে দাঁড়ায়) আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায়, কী বলেন! সময়ে-অসময়ে দুজনেরই কাজে লাগতে পারে। (বলতে বলতে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে) হ্যাঁ, আমার এই নম্বরটাই নোট করুন।
নাগরিক। মোবাইলে স্যর?
চন্দ্রোদয়। তাহলে কিসে? নিন, বের করুন মোবাইল। (নাগরিক মোবাইল বের করে) হ্যাঁ, এ নম্বরটা মনে রাখা সহজ, নাইন-থ্রী-সেভেন-ওয়ান-ওয়ান, তারপর পাঁচটা ওয়ান, অর্থাৎ নাইন-থ্রী-সেভেন-ওয়ান-ওয়ান,ওয়ান-ওয়ান-ওয়ান-ওয়ান-ওয়ান। যেই নাইন-থ্রী-সেভেন করলেন, সেভেন, মানে সাত, তারপরেই ঠিক সাতটা ওয়ান, হা-হা-হা...। ঠিক আছে, এবার আপনার নম্বরটা বলুন তো।
নাগরিক। (ঢোঁক গিলে) আমার নম্বর, স্যর?
চন্দ্রোদয়। হ্যাঁ, আপনার নম্বর। চট করে বলুন।
নাগরিক। নেহাৎই রাখবেন? ঠিক আছে, নাইন-এইট-সেভেন-সিক্স-ফাইভ, তারপর ফোর-থ্রী-টু-ওয়ান-জিরো (চন্দ্রোদয় বোতাম টিপে নম্বরটা নিজের ফোনে নিতে থাকে)। বদনাম হয়ে যাবে না তো স্যর?
চন্দ্রোদয়। বদনাম? আমি ওসবের পরোয়া করি না।
নাগরিক। আপনার নয় স্যর, আমার। (চন্দ্রোদয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় নাগরিক)
চন্দ্রোদয়। (ফোনে) ডিরেক্টর জেনারাল অফ পুলিশ। এখ্খুনি কানেক্ট করবে, ইন্টারকমে ঢুকিয়ে কলটা ট্রান্সফার করে দেবে আমাকে আর সি-এ সাহেবকেও পাঠিয়ে দাও। মনে করে ইন্টারকমে কলটা দিও, যাতে সি-এ সাহেবও শুনতে পায়। (ফোন নামিয়ে রাখে, একটু পর সি-এ প্রবেশ করে।)
সি-এ। (ঢুকতে ঢুকতে) আপনার সেই নাগরিক গেছে তাহলে!
চন্দ্রোদয়। গেছে, কিন্তু আমার মাথায় খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা চিন্তা ঢুকিয়ে গেছে।
সি-এ। চিন্তা? আচ্ছা!? আপনার মাথায়?
চন্দ্রোদয়। হুঁ, আমারই। কিন্তু চিন্তাটা তোমার মাথাতেও ঢোকাতে চাই আমি। কখনও ভেবে দেখেছ, এদেশে নাগরিক আছে কতজন?
সি-এ। কতজন? ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু কেন?
চন্দ্রোদয়। এই যে লোকটা এতক্ষণ বসেছিল এখানে, ওকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? – উত্তরে বললো, নাগরিক। লোকটা আমার কাছে কেন এসেছিল জানিনা, কিন্তু লোকটা যে বলরামের কীর্তিটা জানে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এবং, এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে, ও কোনমতেই বলরামের বন্ধু নয়। আমার ধারণা বলরামকে জব্দ করাই ওর মতলব।
সি-এ। সে না হয় হল, কিন্তু তার জন্যে দেশে কতজন নাগরিক আছে সে হিসেবের কী দরকার?
চন্দ্রোদয়। একটু শোন, তাহলেই বুঝবে কী দরকার। গতকাল ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথে একটি মেয়েকে যে প্রায় সম্পূর্ণ দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় তা তুমি জান। তুমি এ-ও জান যে এই মেয়েটিকেই বলরাম ধর্ষণ করেছিল এবং দুর্জয় আর রামখেলাওনের লোকরা একেই হাসপাতাল থেকে এনে জাতীয় রাজপথে পোড়ায়। যেখান থেকে তুমি জানো না সেটা বলি এবার। পুলিশকে টেলিফোন করে একজন এই মেয়েটার বডিটা থানায় আনায়, এবং পুলিশ যাতে কোনমতেই এটাকে অন্য কোন শব বলে চালাতে না পারে, তাই একটা এফ-আই-আর করতে চায়। পুলিশ যখন তার পরিচয় জানতে চায়, সে বলে সে নাগরিক। অর্থাৎ, আজ সকালে এখানে-আসা-নাগরিক ছাড়াও আরও একজন নাগরিকের খোঁজ পাওয়া গেল। এখন পর্যন্ত দুজন নাগরিক, ঠিক আছে?
সি-এ। বুঝলাম। অতএব?
চন্দ্রোদয়। দাঁড়াও দাঁড়াও, ধৈর্য ধর। এই যে দ্বিতীয় নাগরিকের কথা বললাম, পুলিশ একে অ্যারেস্ট করে। কিন্তু একে অ্যারেস্ট করার একটু পরেই আর একদল লোক – এরাও নিজেদের নাগরিক বলেই পরিচয় দিচ্ছিল – থানায় এসে এর খবর নেয় এবং সেখান থেকে সোজা চলে যায় হাই কোর্টে। এই দলে দুয়েকজন উকিলও ছিল। কতজন ঠিক ছিল এরা, সে খবর আমি পাইনি। কিন্তু একদল বলতে আমি ধরছি পাঁচজন, ঠিক আছে?
সি-এ। হ্যাঁ, দল মানে পাঁচ অন্তত ধরাই যায়।
চন্দ্রোদয়। আর দুয়েকজন উকিল বলতে যদি আমি দুই-ই ধরি, তাহলেও পাঁচ আর দুই মিলিয়ে সাত। হাই কোর্টে যতক্ষণ পর্যন্ত না চিফ জাস্টিস এদের সঙ্গে কথা বলে ততক্ষণ কোর্টেই এরা অপেক্ষা করে, এবং শেষ পর্যন্ত রাত ন'টারও পরে চিফ জাস্টিসের সঙ্গে কথা বলে একটা অর্ডার বের করে। অর্ডারটাতে স্পষ্ট লেখা আছে বডিটাকে টিল ফার্দার অর্ডার ক্রিমেট করা যাবে না। এই পর্যন্ত তাহলে নাগরিকের সংখ্যা দাঁড়াল আগের দুই আর এই সাত, অর্থাৎ নয়।
সি-এ। হ্যাঁ নয়, নয়ই তো।
চন্দ্রোদয়। নয়, নম্বরটা মনে রাখবে। (রিসিভারে মুখ রেখে অন্য প্রান্তের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে।) হ্যালো, হ্যাঁ তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। তুমি অফিসে আছ?
রিসিভার। এখনো পর্যন্ত আছি স্যর।
চন্দ্রোদয়। এখুনি বেরিয়ে পড়। কান্নাও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে চলে যাও। নাগরিকটা কিছুতেই যাতে বেল না পায় তার চেষ্টা করবে। নিজের ইনফ্লুয়েন্স খাটাবে।
রিসিভার। সরি স্যর, আমাকে তো আজ হাই কোর্টে যেতেই হবে। চিফ জাস্টিস পার্সোনালি প্রেজেন্ট থাকবার ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন।
চন্দ্রোদয়। ঠিক আছে, তাহলে এস-পিকে পাঠাও। লোকটা যেন কোনমতেই বেল না পায়। রাখছি। (লাইন কেটে দেয়, তারপর সি-একে) হ্যাঁ, কতজন হিসেব করেছিলাম? নাগরিক?
সি-এ। নয়।
চন্দ্রোদয়। হ্যাঁ নয়, আরো আছে। গতকালের সেই অ্যারেস্ট-হওয়া নাগরিককে আজ আদালতে পেশ করার কথা। পুলিশ যখন আজ সকালে তাকে ভ্যানে তুলছে ঠিক সেই সময় আবার একদল নাগরিক – তারাও নাকি উকিল – ভ্যানের সঙ্গে সঙ্গে যায়। এবারও একদল বলতে পাঁচই ধরলাম। তাহলে এখন পর্যন্ত আমরা, নয় আর পাঁচ, চোদ্দ জন নাগরিকের খবর পেলাম। ঠিক তো?
সি-এ। ঠিক। এবং এরা প্রত্যেকেই আমাদের বিরোধী, অর্থাৎ সরকার বিরোধী, মানে দেশদ্রোহী।
চন্দ্রোদয়। অর্থাৎ সিডিশাস। অথচ আমরা এতটা অপদার্থ, যে এদের খবরই রাখতাম না এতদিন! এত নাগরিক, এরা এক জায়গায় এলো কোথা থেকে? তার মানে, আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে নাগরিকরা সংঘবদ্ধ, তাদের একটা সংগঠন আছে?
সি-এ। সেরকমই তো মনে হচ্ছে।
চন্দ্রোদয়। সংগঠনই যদি থাকে, তাহলে আমরা তার খবর রাখি না কেন? তুমি তো পার্টির নেতা, তুমিও তো জানো না যে একটা সংগঠন আছে, তার সভ্যদের বলা হয় নাগরিক, এবং নাগরিক মানেই দেশদ্রোহিতাই তার কাজ? এদের মাথা কে কীভাবে জানা যাবে?
সি-এ। সংগঠনটা যদি আণ্ডারগ্রাউণ্ড হয়, তাহলে কাজটা সহজ নয়, কিন্তু যখন-তখন থানায় ঢুকছে, আপনার অফিসে এসে খোদ আপনার সঙ্গে কথা বলছে, হাইকোর্টে গিয়ে চিফ জাস্টিসের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছে, এসব তো আণ্ডারগ্রাউণ্ড সংগঠনের লক্ষণ নয়!
চন্দ্রোদয়। চিফ জাস্টিসের কথা বাদ দাও। আমার তো মনে হয় ও নিজেও একজন নাগরিক! কতবার পি-এমকে বললাম ছায়ালয়ে বদলি করে দিতে, তা উনি শুনছেনই না। যাই হোক, এখন বল উপায় কী?
সি-এ। দেখুন, আমার মনে হয়, সংগঠনটা আণ্ডারগ্রাউণ্ড না হওয়াই সম্ভব। সেক্ষেত্রে একটা রেজিস্ট্রেশন তো থাকবে। কাগজপত্র চেক করলেই সব নেতাদের নাম-ঠিকানা পাওয়া যাবে। সব কটাকে ধরে ভরে দিলেই হবে।
চন্দ্রোদয়। রেজিস্ট্রেশন? কারা রেজিস্ট্রেশন করে?
সি-এ। কেন, সরকার।
চন্দ্রোদয়। কোন সরকার? সেন্টার না আমরা?
সি-এ। না না সেন্টার কেন হবে? স্টেটই।
চন্দ্রোদয়। কোন মিনিস্ট্রি?
সি-এ। কমার্স অ্যাণ্ড ইণ্ডাস্ট্রি।
চন্দ্রোদয়। কমার্স অ্যাণ্ড ইণ্ডাস্ট্রি? মানে, চিদানন্দ দাস? ডেকে আন তো।
সি-এ। ফোন করুন না।
চন্দ্রোদয়। না না, ফোনের কাজ নয়। নিজে যাও, ধরে আনো। (সি-এ উঠে দাঁড়ায়, এগোয়) হ্যাঁ, সেক্রেটারিকেও সঙ্গে আনবে, মিনিস্টার কিস্যু জানে না। (সি-এ বেরিয়ে যায়, চন্দ্রোদয় গভীর চিন্তা করতে করতে আনমনে টেবিলে ছোট ছোট ঘুষি মারতে থাকে, হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে) হ্যালো, হ্যাঁ, কী খারাপ খবর?... ওই নাগরিক বেল পেয়ে গেছে?... অ্যাঁ, আর কী?... তিনদিন হিমঘরে রাখতে হবে?... টেলিভিশন, খবরের কাগজ, সব জায়গায়?... অন্তত দশটা কাগজে?...আইডেন্টিফাই করার যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে সবাইকে? যত্ত সব... (লাইন কেটে দেয়; চিদানন্দ, সেক্রেটারি কমার্স অ্যাণ্ড ইণ্ডাস্ট্রি আর সি-এ প্রবেশ করে)।
চিদানন্দ। (ঢুকতে ঢুকতে) ভালো আছেন গুরুজি? (সি-এ বসে পড়ে, চিদানন্দ আর সেক্রেটারি দাঁড়িয়েই থাকে)
চন্দ্রোদয়। আরে তোমরাও বোসো। (বাকিরা বসে) কেন তোমাদের ডেকেছি সি-এ সাহেব বলবেন।
সি-এ। প্রশ্নটা হচ্ছে, নাগরিকদের কোন রেজিস্টার্ড বডি আছে? (চিদানন্দ সেক্রেটারির দিকে তাকায়, ইঙ্গিত করে জবাব দিতে)
সেক্রেটারি। কী ধরণের নাগরিক?
চন্দ্রোদয়। কী ধরণের আবার কী? নাগরিকের আবার ধরণ কী? নাগরিক, মানে, সরকারের ভালো ভালো কাজে যারা বিঘ্ন ঘটায়, অযথা ভালো ভালো মন্ত্রীদের বদনাম করার চেষ্টা করে, নানারকমের আজগুবি ফ্যাকড়া তুলে গণ্ডগোল করে, এক কথায় দেশদ্রোহী যারা।
সেক্রেটারি। দেখুন, কোন দেশেই দেশদ্রোহীরা সরকারি নথিতে সই করে, নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে রেজিস্ট্রেশন করাবে না। কী চাইছেন সেটা যদি একটু স্পষ্ট করে বলেন।
চন্দ্রোদয়। স্পষ্ট আবার কী করব? আমাদের রাজ্যের গৃহমন্ত্রীকে একদল লোক নানারকমের আইনি প্যাঁচ করে একটা রেপ কেসে ফাঁসাবার চেষ্টা করছে। তারা কারা, জানতে চাইলেই বলছে তারা নাগরিক। বেশ সংগঠিত ভাবে কাজ করছে তারা। গত দুদিনেই এরকম চোদ্দ জনকে আইডেন্টিফাই করেছি আমরা। আমার সন্দেহ, আমাদের জজ সাহেবরাও কেউ কেউ নাগরিক। তলে তলে ওদেরই দলে আছেন। ওই সংগঠনের মাথাদের আমরা ধরবার চেষ্টা করছি। আপনাদের রেজিস্টারে যদি ওদের ঠিকানা না থাকে, তাহলে কী কাজ করছেন আপনারা?
চিদানন্দ। ঠিকই তো, কী কাজ করছেন আপনারা?
সি-এ। কী কাজ করছেন আপনারা?
সেক্রেটারি। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। যদি আইডেন্টিফাই করেইছেন তাহলে অ্যারেস্ট করছেন না কেন?
চন্দ্রোদয়। সংগঠনটা কোথায় সেটা জানা দরকার, ওই চোদ্দ জনকে অ্যারেস্ট করলেই ওদের মাথারা তো আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যাবে। সেটা চলবে না। এ দেশে কতজন নাগরিক আছে সেটা জানতে হবে। প্রতিটি রাজ্যে কতজন আছে জানতে হবে সেটা।
চিদানন্দ। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানতে হবে সেটা।
সেক্রেটারি। আমি ঠিক এখনো বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে-টেলিভিশনে নাগরিক
সমাজ-টমাজ শুনতে পাই বটে, কিন্তু সে তো কথার কথা।
চন্দ্রোদয়। শুনতে পাচ্ছেন তবুও কিছু-না-করে বসে আছেন! এসব আমি অ্যালাউ করব না। দশ দিন সময় দিলাম, তারপর এই সংগঠনের ব্যাপারে যাবতীয় খবর আমার চাই। যান।
চিদানন্দ। (উঠে পড়ে) আসি, গুরুজি। (চলে যায়, পেছনে পেছনে সেক্রেটারি, নীরবে। তাকে খুব চিন্তিত দেখায়, সি-এ বসেই থাকে)
চিদানন্দ। (সি-একে) তুমি তো কাল সান্দ্রপ্রস্থ যাচ্ছ, না?
সি-এ। মর্ণিং ফ্লাইটে, গুরুজি।
চিদানন্দ। পি-এমকে আমার হয়ে পার্সোনালি বলবে, আমি খুব চিন্তিত। এতদিন তো কোন নাগরিকের কথা শুনিনি, হঠাৎ এত নাগরিক গজিয়ে উঠল কোথা থেকে? একটা কিছু করা দরকার। নাগরিকদের বাড়তে দেওয়া চলবে না। আর কিছু না হোক, পি-এমের সেই অব্যর্থ দাওয়াই! ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল। কিছু সংখ্যক মানুষকে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের চেয়ে ছোট আর ডেঞ্জারাস বলে রটানো। মানুষের স্বাভাবিক পরিচয় যেন মানুষ না হয়ে হয় বিশ্বাসযোগ্য মানুষ, মানে আমরা যাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করি, আর বিশ্বাসঘাতক মানুষ। ঠিক ঠিক মতো এটা করতে পারলেই দেশের মঙ্গল!
এস-পি। (শেঠের দিকে তাকিয়ে) ওই যে ডাক্তার, কী যেন নাম, মালিক, হ্যাঁ, সে কখন আসছে?
শেঠ। মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে স্যর, বড় জোর মিনিট পনের-কুড়ি।
এস-পি। ঘটনাটা তাহলে তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
শেঠ। পরশুদিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ডাক্তারের ফোন আসে থানায়। সে আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চায়। আমি ফোনটা ধরলে সে বলে, সে সকালে হাসপাতালে ডিউটি করতে এসে দেখে আউট-ডোরের ফ্লোরে একটা মেয়েকে কেউ ফেলে রেখে গেছে। মেয়েটা অজ্ঞান অবস্থায়। ওপর থেকে দেখেই বোঝা যায় তার সমস্ত শরীরে কাদা মাখা এবং অত্যাচারের চিহ্ণ।
এস-পি। জামাকাপড়?
শেঠ। ডাক্তার বলেছে, ছেঁড়া-খোঁড়া, প্রায় নেই বললেই হয়। ওপরের কামিজটার সামনের দিকটা পুরোটাই ছেঁড়া, আর নীচে বোধ হয় গামছা-গোছের একটা কিছু কেউ জড়িয়ে দিয়েছে।
এস-পি। কী করে এল মেয়েটা?
শেঠ। এই হাসপাতালটা তো প্রাইমারী হেল্থ্ সেন্টার, পাঁচটা বোধ হয় বেড আছে, সেগুলো খালিই ছিল। ডাক্তারটার বয়েস কম, মনে হয় এটাই প্রথম চাকরি, কাছাকাছি কোথাও থাকে। সুইপারের একটা কোয়ার্টার আছে, সে থাকে হেল্থ্ সেন্টার কম্পাউণ্ডেই তার ফ্যামিলি নিয়ে। সে সকালে উঠেই আউটডোরটা খুলে তার বালতি ফিনাইল এসব আনতে গেছে, ফিরে এসে দেখে মেয়েটা পড়ে আছে মেঝেতে। কারা ফেলে গেছে জানে না।
এস-পি। তুমি কখন গেলে হাসপাতালে?
শেঠ। আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেছি, মেজবাবুকেও সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম। আমি যখন গেছি, ততক্ষণে কম্পাউণ্ডারবাবুও এসে গেছেন। সুইপার আর কম্পাউণ্ডারকে নিয়ে মেয়েটাকে একটা বেডে তুলেছে ডাক্তার, একটা চাদর দিয়ে ঢেকেও দিয়েছে তাকে। কী সব নল-টলও ঢুকিয়ে দিয়েছে। একজন মাত্র নার্স আছে হাসপাতালে, সে তখনও আসেনি। আমাকে দেখে বলল, গ্যাং রেপের কেস, মারধর ছাড়াও সারা গায়ে অনেক অত্যাচারের চিহ্ণ। ইমিডিয়েটলি একটা হোল-বডি সিটি স্ক্যান করা দরকার, তার জন্যে সাব-ডিভিশন হাসপাতালে পাঠাতে হবে। আমি বললাম, আপনি যা ভালো মনে হয় করুন, কিন্তু অনেক ফর্মালিটি আছে, আপনাদের সবাইকে ইন্টারোগেট করব, ডায়েরী করব, দু-আড়াই ঘন্টার আগে কোনমতেই হবে না। তারপর আপনি সাব-ডিভিশন হাসপাতালেই পাঠান, বা যেখানেই হোক।
এস-পি। তুমি বলেছিলে? তাহলে অত তাড়াতাড়ি হেল্থ্ সেন্টার থেকে বেরিয়ে গেল কী করে?
শেঠ। কী বলব স্যর, নেহাৎই ছেলেমানুষ ডাক্তার। বলল, আমি সময় নষ্ট করতে পারব না। আমি শুধুমাত্র একজন নাগরিকই নই, ডাক্তারও। মেয়েটা বিনা চিকিৎসায় মরবে, তা হয় না। আমি একটা প্রাইমারী অবসার্ভেশন লিখে ফেলেছি, এখানে যে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সটা কাজ করে তাকে খবর পাঠিয়েছি, প্রিলিমিনারি চিকিৎসা যা আমার পক্ষে এখন করা সম্ভব, শুরু করে দিয়েছি। অ্যাম্বুলেন্সটা এসে গেলেই ওকে পাঠিয়ে দেব, তারপর আপনি যা যা বলবেন সব হবে।
এস-পি। তারপর ডেকে পাঠিয়েছিলে সবাইকে?
শেঠ। সবাইকে নয় স্যর, শুধু ডাক্তারকে ডেকেছিলাম। এসেওছিল। খুব কড়কে দিয়েছি, ঘাবড়েও গেছে একটুখানি। ওকে দিয়ে লেখাইনি কিছু, কিছু লিখতে বলিওনি। তবু যাবার আগে ওর প্রাইমারী অবসার্ভেশন লেখা কাগজটা আমাকে দিয়ে গেল। এই দেখুন না স্যর (কাগজটা বের করে এস-পিকে দেখাবার চেষ্টা করে, সে ফিরেও তাকায় না)।
এস-পি। হুঁ, একটু ঘাবড়ে থাকাই ভালো। ওই ঘাবড়ানোটাই কাজে লাগবে। কিন্তু তোমার সব প্রোসিডিওরাল ফাংশন ঠিক আছে তো?
শেঠ। আমি তো স্যর, ডিটেইলে সব কিছু লিখে একটা মেমো পাঠিয়ে দিয়েছি সি-আই সাহেবকে, এস-ডি-পি-ও সাহেবকেও কপি দিয়েছি।
এস-পি। তুমি কখন থেকে ইনিভল্ভ্ড্ হলে এই কেসটায়?
সিন্হা। সকাল নটা-সাড়ে নটা নাগাদ ট্র্যাফিক গার্ড থেকে অ্যাকসিডেন্টের খবরটা আসে, দুটো ডেথ-এর খবর ছিল। আমি নিজেই ট্রাকটা সঙ্গে নিয়ে ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে যাই। অ্যাম্বুলেন্সটার সামনের দিকটা উড়ে গেছে, একেবারে ড্রাইভারের পাশেই বোধ হয় নার্সটাও বসেছিল, দুটোই স্পট ডেড। নার্সটার স্যর নিয়তি ওকে ডাকছিল, নাহলে ড্রাইভারের পাশে বসতে যাবে কেন, ওর তো পেছনে পেশেন্টের সঙ্গে থাকবার কথা! যে লরিটা মেরেছে সেটাকে আমি দেখতে পাইনি স্যর, আমি যাবার আগেই ট্র্যাফিক গার্ড ছেড়ে দিয়েছে। (একটু গলাটা নামিয়ে) চেনা লরি স্যর, আমাদের মন্ত্রী বলরাম চৌধুরির, লাইসেন্স প্লেট নেই, এই সব কাজেই লাগান মন্ত্রী সাহেব। অ্যামবুলেন্স গাড়িটার পেছনে ঢুকলাম, পেছনের মেয়েটা ওর বেডেই আছে, বেল্ট বাঁধা, তাই পড়েনি, কিন্তু সেন্সলেস। ড্রাইভারের ব্যাকরেস্টটা ভেঙে মেয়েটার গায়ের ওপর। ব্যাকরেস্টটা তোলা হলো, তারপর, আশ্চর্য স্যর, এই যে শেঠ বলল, ডাক্তারের প্রাইমারী অবসার্ভেশন আর প্রিলিমিনারি চিকিৎসার কথা, ওইসব লেখা দুখানা কাগজ মেয়েটার গায়ের চাদরের সঙ্গে পিন দিয়ে সাঁটা, ডাক্তারের সই আর সীল দেওয়া! দেখে বুঝতে পারলাম কোন্ হাসপাতালের কেস, আমাদের ফোর্সকে দিয়ে সেখানেই পাঠিয়ে দিলাম মেয়েটাকে।
কনস্টেব্ল্। ডাক্তার মালিক নামে একজন দেখা করতে এসেছে।
এস-পি। কোথায় আছে?
কনস্টেব্ল্। বাইরের রিসেপশনে।
এস-পি। ওখানেই বসিয়ে রাখ, একটু পরে ডাকব।
কনস্টেব্ল্। ঠিক আছে স্যর (স্যাল্যুট দিয়ে বেরিয়ে যায়)।
এস-পি। (সিন্হাকে) কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছিয়ে দিয়েও তো মুক্তি পেলে না। ওই যে নিয়তির কথা বলছিলে না, তোমার নিয়তিই বোধ হয় মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনলো তোমার কাছেই!
সিন্হা। কিন্তু আপনি কী করে শ্যোর হচ্ছেন স্যর যে বার্ন্ট বডিটা ওই মেয়েটারই?
এস-পি। ভেরি গূড ভেরি গূড। ডিনায়াল ইজ অলওয়েজ দ্য বেস্ট পলিসি ফর আ পুলিস অফিসার। দ্যাট সেভ্স্ য়্যু ফ্রম মেনি ট্রাব্ল্স্।
সিন্হা। আমি তো স্যর তা-ই করেছি। আমি যখন আমার রিপোর্টে লিখছি নেম আননোন সেক্স আননোন, তখনই, ঠিক তখনই, যে লোকটা ফোন করে জানিয়েছিল বার্ন্ট ডেডবডিটার কথা, সে হাজির। এসেই বললো, আমি একটা
এফ-আই-আর করব। বারবার বলছে মেয়েটা মেয়েটা! আমি বললাম, মেয়েটা কেন বলছেন, বডি দেখে তো ছেলে মেয়ে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমার সঙ্গে তক্ক জুড়ে দিল। তখনই তো স্যর, আপনাকে ফোন করলাম। আপনি পারমিশন দিলেন, তাই ওকে অ্যারেস্ট করতে পারলাম।
এস-পি। তুমি কীভাবে এখানে এলে শেঠ?
শেঠ। মোটর সাইকেলে, স্যর।
এস-পি। তোমাদের ব্লক টূ তে কোন অ্যাজিটেশন চলছে?
শেঠ। গতকাল সকালের দিকে কয়েকজন লোক থানা ঘেরাও করে কিছুক্ষণের জন্যে। সাধারণত ঘেরাও-টেরাও যারা করতে আসে, তাদের সঙ্গে দুয়েকটা ব্যানার-ফ্যানার থাকে। এখানে কিছুই ছিল না। আমি ওদের জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কোন রাজনৈতিক দলের? ওরা বললো, ওরা কোন দলের নয়, শুধুই নাগরিক। একটু খটকা লাগল, ডাক্তারও বলেছিল সে একজন নাগরিক। শুধু নাগরিক নয়, একজন ডাক্তারও। পরপর দুদিন নাগরিক কথাটা শুনলাম!
এস-পি। হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি সেটা।
শেঠ। যাই হোক, আমিও ওদের না ঘাঁটিয়ে ভেতরে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর ওরা চলে গেল। তখন একজন কন্স্টেব্ল্ এসে বললো, একজন লোক একটা খবরের কাগজ নিয়ে এসে ওদের কিছু দেখিয়েছে, তার একটু পরেই ওরা চলে গেছে।
এস-পি। হুঁ। শোন। আজ সি-এম আর হোম মিনিস্টার সিন্হার থানায় আসতে পারেন বলে জানিয়েছেন। ব্লক টূতে হোম মিনিস্টারের বাড়ি, এবং গণ্ডগোলটাও ওখান থেকেই শুরু। আমার মনে হয়, তোমার থানাতেও ওঁরা ঘুরে যেতে পারেন। তুমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও। আর একটা কথা। সিন্হার তোমার চেয়ে বয়েস এবং এক্সপিরিয়েন্স বেশি। আমি যতদূর জানি, ও খুব হেল্পফুলও। কোন ব্যাপারে কিছু কনফ্যুজন বা প্রবলেম হলে ওর সাথে আলোচনা কোরো। আমার মনে হয় সুবিধে হবে তোমার।
শেঠ। আমি তো করি স্যর, আর ভবিষ্যতেও করব (উঠে দাঁড়ায় এবং স্যাল্যুট করে)। বাই স্যর ( বেরিয়ে যায়, এস-পি কলিং বেল বাজায়, আগের কনস্টেব্ল্টি এসে স্যাল্যুট করে দাঁড়ায়)।
এস-পি। ডাক্তার মালিককে ডাক।
কনস্টেব্ল্। ঠিক আছে স্যর (আবার স্যাল্যুট করে বেরিয়ে যায়)।
এস-পি। আসুন ডাঃ মালিক, বসুন, (ডাঃ মালিক বসে) আপনি তো ফেঁসে গেছেন মনে হচ্ছে। (ডাক্তার সন্ত্রস্তভাবে এস-পির দিকে তাকায়, কোন জবাব দেয় না।) ছোট জায়গায় আপনিই তো হাসপাতালের বস্, একটু-আধটু আইন তো বুঝতে হবে।
ডাক্তার। মেডিকাল জুরিসপ্রুডেন্স একটুখানি কলেজে পড়েছিলাম স্যর, কিন্তু আইন সত্যিই বুঝিনা।
এস-পি। সেটাই তো কথা ডাক্তারবাবু, বেশির ভাগ মানুষই বোঝে না, কিন্তু ইগনোরেন্স অব ল ইজ নো এক্সক্যুজ। থানায় আপনি খবর দিলেন টেলিফোনে, বললেন একটি আননোন মহিলাকে আপনাদের অনুপস্থিতিতে কে বা কারা আউটডোরে ফেলে রেখে সরে পড়েছে। অথচ, থানার বড়বাবু গিয়ে দেখলেন মেয়েটা একটা বেডে। দিব্যি ধপধপে সাদা চাদরে ঢাকা, নানা নল ঢোকানো অবস্থায় সে শুয়ে আছে। মেঝেতে পড়ে থাকা পেশেন্ট – তা-ও নাকি আবার সেন্সলেস – বেডে উঠল কীভাবে? আপনি, আপনার কম্পাউণ্ডার আর সুইপার নাকি তুলে শুইয়ে দিয়েছেন! কোন আউটসাইড উইটনেস ছাড়াই। আপনিই বলেছেন, শুধুই যে বলেছেন তা নয়, লিখেছেনও, সে গ্যাং রেপ ভিক্টিম। কিন্তু গ্যাং রেপের পারপিট্রেটর কারা? (কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ, টানটান টেনশন এস-পির ঘরে, এস-পি ডাক্তারের দিকে তাকায়, তারপর তার চোখ যায় সিন্হার দিকে, ফিরে আসে ডাক্তারের দিকে আবার, তারপর হঠাৎ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে) আপনারাই রেপ করেছেন! আপনারা তিনজন!
ডাক্তার। (ভীষণ ঘাবড়িয়ে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর) কী বলছেন স্যর!
এস-পি। (ডাক্তারের কথার উত্তর না দিয়ে) শুধু তা-ই নয়, এই মেয়ে এক্স-রে করাতে গিয়ে যখন একটা অ্যাকসিডেন্টে পড়ল, আর আমাদের ফোর্সের লোকরা নিজেরা গিয়ে তাকে পৌঁছে দিয়ে এলো আবার আপনার হাসপাতালেই, তাদের সামনেই আপনি তাকে পরীক্ষা করে বললেন, কোমর আর শিরদাঁড়ায় চোট লেগেছে, মনে হচ্ছে ভেঙেছে। বলেননি?
ডাক্তার। হ্যাঁ স্যর বলেছি তো, আমার মনে হয় ঠিকই বলেছি।
এস-পি। অথচ আপনি এমন অমানুষ, ফোর্সের লোকরা যাবার পরেই আপনি হাপিস করে দিলেন মেয়েটাকে! নিজের অপকীর্তি ঢাকবার জন্যে!
ডাক্তার। এসব স্যর আপনি কী বলছেন আমি বুঝছি না।
এস-পি। তাহলে কোথায় গেল মেয়েটা বলুন।
ডাক্তার। কোথায় গেল? (একটু চুপ করে থাকে ডাক্তার, তারপর একটা লম্বা শ্বাস টানে) এরকম পেশেন্টকে মূভ করানো একটু রিস্কিই হয়, কিন্তু আমাদের হেল্থ্ সেন্টারে এমনকি এক্স-রে করাবারও কোনও ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে ওকে পাঠাচ্ছিলাম সাব-ডিভিশনাল হসপিটালে, ওখানে হোল-বডি স্ক্যান করানো যায়। মেয়েটার কপাল খারাপ, কোমর আর শিরদাঁড়ায় চোট নিয়ে আমাদের হেল্থ্ সেন্টারেই ফিরে এল। ফিরে এল আরও চোট নিয়ে। আমি তাই মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলাম সাব-ডিভিশনাল হসপিটালে যাব বলে, ওদের কাছে যদি একটা পোর্টেব্ল্ মেশিনও থাকে। কম্পাউণ্ডারবাবুকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি মেয়েটা উধাও। কম্পাউণ্ডারবাবু মিনিট দশেকের জন্যে একটু খেতে বেরিয়েছিলেন, আর সুইপারের কোন পাত্তাই নেই। রোজই এরকম করে, দুপুরের আগেই বেরিয়ে যায়।
এস-পি। এ সবই ইনভেস্টিগেট করা হবে ডাক্তারবাবু, তারপর ইন-চার্জ হিসেবে আপনি কী ফেস করবেন, কীভাবে সামলাবেন সেটা আপনিই জানেন! হুঁ, নাগরিক! এখন সামলান ডাক্তার-কাম-নাগরিকের দায়িত্ব!
ডাক্তার চুপ করে থাকে, তার চোখ ভাষাহীন। সিন্হা ইঙ্গিতে বাইরে যাবার অনুমতি চায়, এস-পিও ইঙ্গিতেই অনুমতি দেয়। ফাঁকা ঘরে
ডাক্তার আর এস-পি। একটু পর এস-পি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। পায়চারি করতে থাকে। আবার এসে চেয়ারে বসে। এখন তার চোখে অনুকম্পা।
এস-পি। আপনি ছেলেমানুষ ডাক্তারবাবু, আসল দুনিয়াটাকে এখনও চেনেনই না। মেডিকাল কলেজের যাবতীয় আইডিয়ালিজ্ম্ এখনও বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যে সব প্রশ্ন আর মন্তব্য আমি করলাম, সেগুলোই হয়তো ফেস করতে হবে আপনাকে। এবং আপনি সামলাতে পারবেন না। কীভাবে এসেছেন এখানে?
ডাক্তার। আপনি তো ডেকেছিলেন স্যর, ও-সি সাহেব ফোন করে তো তা-ই বললেন।
এস-পি। (হেসে) আমি তা জিজ্ঞেস করিনি। ট্রান্সপোর্ট, কোন্ ট্রান্সপোর্টে এলেন?
ডাক্তার। আমার মোটর সাইকেলে স্যর।
এস-পি। ফিরে যান আপনার হেল্থ্ সেন্টারে। দুশ্চিন্তা করবেন না, নিজের কাজ করুন। কেউ, সে যে-ই হোক, কোন কথা জিজ্ঞেস করলে অ্যাভয়েড করবেন, সোজাসুজি কথা বলবেন না। কাউকে অ্যাকিউজ করবেন না, নিজেকেও কোন অবস্থাতেই ডিফেণ্ড করবেন না। আর একটা কথা। আপনার থানার বড়বাবু, মিস্টার শেঠের পরামর্শ ছাড়া এক পা-ও চলবেন না আপাতত। প্রয়োজন হলে আমাকেও ফোন করতে পারেন, আমার নম্বর শেঠবাবুর কাছেই পেয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, আমরা আপনার শুভাকাঙ্খী, সাহায্যই করতে চাই। তবে সবই ডিপেণ্ড করবে আপনার ওপর। ওকে, গূড লাক।
এস-পি। হ্যাঁ, তোমাকে যে কথাটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। বডিটা কোথায় রেখেছ?
সিন্হা। এখানে তো স্যর অন্য কোন ফেসিলিটি নেই, ডিস্ট্রিক্ট হসপিটালের মরচুয়ারির একটা পার্ট পরিষ্কার করে সেখানে রাখা হয়েছে।
এস-পি। প্রোটেকশন?
সিন্হা। দশ জন কনস্টেব্লের ফোর্স লেড বাই অ্যান এ-এস-আই। (হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে, এস-পি ধরে ফোনটা)
এস-পি। হ্যালো। হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কনেক্ট করিয়ে দিন (রিসিভারের মুখ চেপে ধরে সিন্হার উদ্দেশে)। সি-এম-এর কল। লাউডস্পীকারে দিয়ে দেব, নোট কর। কনফিডেনশিয়াল হলে লাউডস্পীকার অফ করে দেব, ঘাবড়িও না। (লাউডস্পীকারে সিএম চন্দ্রোদয়ের গলা শোনা যায়)
চন্দ্রোদয়। হ্যালো।
এস-পি। ইয়েস স্যর, আপনার আসতে দেরি হবে স্যর?
চন্দ্রোদয়। আমি আজ আসছি না, প্রয়োজন হল না। আপনার বডির কী খবর?
এস-পি। আজ এখনো পর্যন্ত কেউই আসেনি স্যর আইডেন্টিফাই করতে। আমরা কন্টিন্যুয়ালি মনিটর করছি।
চন্দ্রোদয়। ওখানে ফোর্স রাখবেন। নাগরিকরা ঘোরাফেরা করছে কিনা খবর রাখবেন। সন্দেহ হলেই তুলে নেবেন।
এস-পি। রাইট স্যর, দশজনের ফোর্স লেড বাই অ্যান এ-এস-আই টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স মোতায়েন আছে।
চন্দ্রোদয়। ব্লক টূ-এর কোন খবর জানেন?
এস-পি। এখনো পর্যন্ত পীসফুল। লোকাল পুলিস স্টেশনের ও-সি আপনাকে এক্সপেক্ট করছে।
চন্দ্রোদয়। একটু সাবধানে থাকতে বলুন। ওই অঞ্চলে অনেক নাগরিক আছে, বা এসেছে বলে শুনছি। পুলিশ মন্ত্রী বলরাম চৌধুরির বাড়ি ওদের টার্গেট। আর বলরামের বাড়ির খুব কাছাকাছি একটা বাড়ি।
এস-পি। এই বাড়ির ওনারের নাম জানেন স্যর?
চন্দ্রোদয়। আমি জানি না। লোকাল থানা নিশ্চয়ই জানে।
এস-পি। ঠিক আছে স্যর। আমি নিজেই যাচ্ছি। দেখেশুনে ব্যবস্থা নেব। দরকার হলে একটা ওয়ান ফর্টি ফোর করিয়ে দেব। আপনি চিন্তা করবেন না স্যর।
চন্দ্রোদয়। ঠিক আছে। লাইন কেটে দিলাম। (লাইন কেটে যায়)
এস-পি। (সিন্হাকে) তুমি জান নাকি ওই বাড়ির ওনারের নাম?
সিন্হা। জানিনা স্যর, তবে শুনেছি ওই বাড়ির মেয়েকে নিয়েই গণ্ডগোল।
এস-পি। শুনেছ? ছি ছি ছি ছি, একেবারে শুনবে না এসব।
“বিকাশবাণী। লক্ষ্মণাবতী কেন্দ্র থেকে মধ্যদিনের খবর পড়ছি আয়ুষ কাশ্যপ। এখনকার প্রধান প্রধান খবর হল, কান্নাও জেলার দু নম্বর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রহৃত কম্পাউণ্ডারের জেলা সদর হাসপাতালে মৃত্যু। তিন দিনের জন্য জেলা শবাগারে রক্ষিত অর্ধদগ্ধ নারী-শবটিকে শেষদিনে, অর্থাৎ গতকাল সন্ধ্যায়, শনাক্ত করেন মৃতার বৃদ্ধা জননী। ঘৃণ্য যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে একটি বিশাল মিছিল অপরাধীদের আশু গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে কান্নাও দু নম্বর ব্লক থেকে আজ সকালে জেলা শবাগারের দিকে রওনা দিয়েছে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঈশান প্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীযুক্ত বলরাম চৌধুরী। 'স্বস্থ কন্যা, বিদুষী কন্যা' আন্দোলনের সাফল্যের জন্য ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের সর্বোচ্চ সামাজিক পুরস্কার আজ রাজধানী সান্দ্রপ্রস্থের জ্ঞান ভবনে স্বর্গভূমির প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেবেন।”
“এখন সংবাদ বিশদে। গতকাল সন্ধ্যায় অর্ধদগ্ধ মৃতাকে তাঁর জননী শনাক্ত করার পর কান্নাও দু নম্বর ব্লক কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অধিকারী এবং পুলিশ বাহিনী ওই ব্লকের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই মৃতার চিকিৎসা সংক্রান্ত শেষ নথি সংগ্রহের জন্য যান। খবরে প্রকাশ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অপহৃত হবার আগে মৃতা এখানেই চিকিৎসিত হচ্ছিলেন। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসা অধিকারী গত চার তারিখ সন্ধ্যায় হঠাৎ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে সংজ্ঞাহীন অবস্থায়, লক্ষ্মণাবতীতে, সাধু রামদাস চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হওয়ায় পুলিশ বাহিনী নথি সংগ্রহে ব্যর্থ হন। তাঁরা যখন ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, সেই সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কম্পাউণ্ডার রোগীর ফাইল থেকে একটি কাগজ উদ্ধার করেন। কাগজটিতে চিকিৎসা অধিকারীর দস্তখত এবং শীলমোহরসহ একটি মন্তব্য পাওয়া যায়, সেখানে অসুস্থতার কারণ-শীর্ষক স্তম্ভে স্পষ্টতই লিখিত আছে গণধর্ষণ ও অন্যান্য। কাগজখানি পুলিশবাহিনী সংগ্রহ করে এবং কম্পাউণ্ডারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের গাড়িতে তোলে। সেই সময় একদল দুষ্কৃতি হঠাৎ কম্পাউণ্ডারের উপর আক্রমণ করে। আক্রান্তকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ সকালে হাসপাতাল তাঁকে মৃত ঘোষণা করে। (কয়েক সেকেণ্ডের বিরতি। যথারীতি বিরতিতে আর একটি বিজ্ঞাপনী সঙ্গীত: )
“অর্ধদগ্ধ রমণীর যে শবটি জনসাধারণ কর্তৃক শনাক্ত করার সুবিধার্থে কান্নাও জেলা শবাগারে তিনদিনের জন্য রাখা হয়েছিল, গতকাল ছিল তার শেষ দিন।...
চন্দ্রোদয়। (নিজের চেয়ারে বসতে বসতে) বন্ধ কর বন্ধ কর রেডিও, যত বাজে বক বক। (আর্দালি তাড়াতাড়ি রেডিও বন্ধ করে দিয়ে ব্যাগটা মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে যত্ন করে বসায়) ভিজিটর্স্ রূমে কতজন আছে?
আর্দালি। মোট পাঁচ জন স্যর।
চন্দ্রোদয়। পাঁচ জন? কে কে?
আর্দালি। স্যর, এস-পি আছেন কান্নাওয়ের, আরো দুজন পুলিসের অফিসার আছেন। তা ছাড়া আরও দুজন, আমি চিনিনা।
চন্দ্রোদয়। হোম মিনিস্টার?
আর্দালি। এইচ-এম স্যর নিজের অফিসে আছেন। বলেছেন আপনি এলে খবর দিতে।
চন্দ্রোদয়। বলেছেন? তাহলে দাও খবর। আর, এস-পিকেও ডাক। (আর্দালি বেরিয়ে যায়, চন্দ্রোদয় ব্যাগ খুলে একটা খবরের কাগজ বের করে পড়তে থাকে, কিছুক্ষণ পর এস-পি আর বলরাম চৌধুরি প্রবেশ করে, বসার আগে তারা দুজন একটু কুণ্ঠান্বিত। চন্দ্রোদয় কাগজের থেকে মুখ তুলে তাকায়) হুঁ, বোসো। (বলরাম বসে, এস-পি তখনও দাঁড়িয়ে) বসুন বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? (এস-পি বসে।)
বলরাম। গুরুজি, রামখেলাওন আর দুর্জয়ও আমার সঙ্গে এসেছে। ওদেরও কি ডাকব?
চন্দ্রোদয়। একেবারেই না। (এস-পিকে) কতজন অ্যারেস্ট হল?
এস-পি। এখনো পর্যন্ত একজনও না। থানার অফিসারদের বলে দিয়েছি আমাকে জিজ্ঞেস না করে যেন একজনকেও অ্যারেস্ট না করে। না হলে তো কম্পাউণ্ডারের উপর যারা আক্রমণ করল তাদের থানার কম্পাউণ্ডেই অ্যারেস্ট করা যেত।
চন্দ্রোদয়। (বলরামকে) যারা আক্রমণ করল তাদের অ্যারেস্ট করতে অসুবিধে আছে?
বলরাম। ওরা তো সবাই আমাদেরই ছেলে গুরুজি।
চন্দ্রোদয়। আমাদের ছেলেদের যদি অ্যারেস্ট না করতে হয় তাহলে অ্যারেস্টটা তো তোমাকেই করতে হয়।
বলরাম। আমি রামখেলাওন আর দুর্জয়, দুজনের সঙ্গেই কথা বলেছি। ওরা বলছে এদের অ্যারেস্ট করলে সংগঠন একেবারে ভেঙে যাবে।
চন্দ্রোদয়। তিলে তিলে তৈরি করা সংগঠন যদি এত সহজে ভেঙে যায়, তাহলে সংগঠন থেকে লাভ কী?
বলরাম। ওরা আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে বসে আছে। ডাকব গুরুজি? আপনি একটু ওদের বুঝিয়ে বলুন না।
চন্দ্রোদয়। আমাকে যেদিন ওদের বুঝিয়ে বলতে হবে, সেদিন আর তোমার থাকার প্রয়োজন হবে না বলরাম। যাও, ওদের বলে এসো অপেক্ষা করার দরকার নেই। (বলরাম বেরিয়ে যায়, চন্দ্রোদয় এস-পির দিকে তাকায়।) কী এস-পি সাহেব, কী বুঝছেন?
এস-পি। দেখুন স্যর, এই যে এইচ-এম একটা মিছিল বের করলেন, এরপর কিন্তু সাধারণ মানুষের দিক থেকে চাপ বেড়ে যাবে। কাউকে-না কাউকে ইমিডিয়েটলি অ্যারেস্ট না করলে কিন্তু চলবে না।
চন্দ্রোদয়। কাকে অ্যারেস্ট করতে চান? আপনি কি মিনিস্টারের দিকে আঙুল দেখাচ্ছেন?
এস-পি। ছি ছি স্যর, এটা কী বলছেন?
চন্দ্রোদয়। তবে? (বলরাম ফিরে আসে, নিজের চেয়ারে আবার বসে। চন্দ্রোদয় বলরামকে) এস-পি সাহেব বলছেন কালকের মিছিলের পর এখন যে অবস্থা, তাতে কয়েকটা অ্যারেস্ট না করলে লোককে সামলানো যাবে না। কী এস-পি সাহেব, ঠিক বললাম?
এস-পি। একেবারে, স্যর।
চন্দ্রোদয়। (বলরামকে) তুমি কী বল, কাকে অ্যারেস্ট করা উচিত হবে এখন? কোনও কোনও নাগরিককে?
বলরাম। ক্ষতি কী গুরুজি? এখনো পর্যন্ত কারো কোন ধারণা নেই কে রেপ করেছে। অ্যারেস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ফাঁসির দাবিতে এমন শোরগোল তুলে দেব, ওদের গলাই শোনা যাবে না। আজ দুপুরের রেডিওর খবর শুনেছেন? কালকের কম্পাউণ্ডার আজ হাসপাতালে মারা গেছে। এটা নিয়ে একটা ইশ্যু তোলার সুযোগ নাগরিকরা ছাড়বে নাকি? অ্যারেস্ট করে নিলে এখন তো নিজেদের বাঁচাবার জন্যে ব্যস্ত থাকুক। অন্য সব ইশ্যু ধামাচাপা পড়ে যাবে এখনই।
চন্দ্রোদয়। হুঁ, অনেক কিছু ভেবে রেখেছ দেখছি। (স্বগত) মেয়েটাকে রেপ করবার আগে এত কিছু ভাবলে সুবিধে হত। (এস-পিকে) আপনি কী বলেন সাহেব?
এস-পি। আমি আর কী বলব স্যর, আপনারা ভেবেচিন্তে যেমন নির্দেশ দেবেন...
চন্দ্রোদয়। বোঝা যাচ্ছে বসকে আপনি চটাতে চাইছেন না। (একটু ভাবে, তারপর বলরামকে) তোমার মনে আছে বলরাম, রেপ যেদিন হয়েছিল, সকাল বেলা কলেজ যাবার জন্যে বেরিয়ে মেয়েটি সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ি না ফেরায় মেয়ের আত্মীয়স্বজন কোতয়ালি থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করতে গিয়েছিল। থানা ডায়েরি নেয়নি। অনেক ধরাধরি করায় থানা ওদের বলে দিয়েছিল, ডায়েরি করাতে হলে তোমার কাছ থেকে লিখিয়ে আনতে হবে। কারণ, তোমার নির্দেশেই ডায়েরিটা নেওয়া হচ্ছে না, মনে আছে তোমার?
বলরাম। মনে তো আছেই, মনে থাকবে না? কোতয়ালি থানার ও-সি সেদিন বিট্রে না করলে আজ এত জটিলতা হয়?
চন্দ্রোদয়। উঁহুঁ বলরাম, ঠিক বলছ না তুমি। ও-সি বিট্রে করেনি। যাকে দিয়ে তুমি একটা বেআইনী কাজ করাবে, তাকেও সত্যি কথা বলবে না? কনফিডেন্সে নেবে না? তুমি বলে পাঠিয়েছিলে, একটা বিশেষ ইন্টার্নাল সিকিওরিটি ইশ্যু আছে তোমার নির্দেশের পেছনে। তুমি তো শুধু মন্ত্রী নও, তুমি লোকাল এম-এল-এও! কাজেই ও-সি তোমার কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে আসতে পাঠিয়েছে। ফলে কী হল? সেদিন যারা ডায়েরিটা করাতে পারল না, পরের দিন তারা, আর কিছু নাগরিক মিলে থানা ঘেরাও করল। এখন যদি একজন নাগরিককে গ্রেপ্তার কর, লোকে খাবে? নাগরিকদের অবিশ্বাস করার তাদের কোন কারণ আছে? (বলরাম কোন জবাব দেয় না, মাথা নীচু করে বসে থাকে। এস-পির দিকে তাকায় চন্দ্রোদয়) আপনি কী বলেন?
এস-পি সাহেব? আপনার কী মত?
এস-পি। কিছু মনে করবেন না স্যর, আমি একটা প্রস্তাব দেব। আমার অফিসে আমি আজ কোতয়ালি আর সদর – দুটো পুলিশ স্টেশনের ও-সিকেই ডেকে পাঠিয়েছিলাম। যাকেই অ্যারেস্ট করা হোক-না-কেন ওই ও-সিদের তো ইনভল্ভ করতেই হবে। ওদের আমি আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি, ওরা ভিজিটর্স্ রূমে অপেক্ষা করছে। আপনি পারমিশন দিলে ওদের একটু ডেকে পাঠানো যেত, ওরা বোধ হয় ভ্যালুয়েব্ল্ ইনপুট দিতে পারত।
চন্দ্রোদয়। ডাকবেন? ডাকুন। (বেল বাজায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খাকি পোশাকের আর্দালির প্রবেশ) ভিজিটর্স রূমে দুজন পুলিশ অফিসার অপেক্ষা করছেন, ডেকে আনো। (আর্দালি বেরিয়ে যায়, একটু পর শেঠ ও সিন্হা প্রবেশ করে, এবং প্রবেশের মুখেই ঘরের সবাইকে গোড়ালি ঠুকে জমকালো স্যাল্যুট করে।)
চন্দ্রোদয়। ভেতরে আসুন। (চেয়ার নির্দেশ করে) বসুন। (খুব সঙ্কোচে দুটো চেয়ার একটু টেনে নিয়ে দূরত্ব রেখে পাশাপাশি দুজনে বসে)
এস-পি। শেঠ, আজ যখন মিছিল বেরিয়েছিল তুমি তখন কী করছিলে?
শেঠ। আমাদের থানা-এলাকার মধ্যে সবকটা মোড়ে ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছিল, আমি আর মেজবাবু মোটর সাইকেল নিয়ে পুরো এলাকা ইনস্পেক্ট করছিলাম। (বলরামকে দেখিয়ে) স্যরকেও তো দেখলাম, আমি বাইক থামিয়ে স্যাল্যুট করলাম। স্যর দেখতে পেয়েছেন কিনা জানি না। (বলরাম মৃদু হেসে হাত তুলে এবং মাথা নেড়ে বোঝায়, সে দেখেছে)
এস-পি। আচ্ছা, হেল্থ্ সেন্টারে যখন কম্পাউণ্ডারকে অ্যাসল্ট করা হচ্ছিল তার কোন ছবি তোলা হয়েছে?
শেঠ। আমাদের জীপের ড্রাইভার মোবাইলে তুলেছে।
এস-পি। তুমি দেখেছ?
শেঠ। মাথায় যে মেরেছে তার ছবিটা তো খুবই ভালো এসেছে। বাকিগুলোও ভালোই।
এস-পি। প্রিন্ট নেওয়া যাবে?
শেঠ। যাবে স্যর।
এস-পি। অ্যাসল্টারদের মধ্যে চেনা কেউ আছে?
শেঠ। অন্তত তিন-চারজন। পুরোনো মাল – সরি স্যর – ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে।
এস-পি। সিন্হা? তুমি মিছিলের সময় কোথায়?
সিন্হা। আমাদের ফোর্স পাঠানো হয়েছিল ইউজুয়াল রূটে সকালেই। মিছিলটা পরে আমাদের এলাকার একটু বাইরে দিয়ে ঘুরে যায়, সে খবরটা আমাদের কাছে ছিল না। খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ফোর্সকে ফিরে আসতে ইনস্ট্রাকশন দিই। তারপর আমি আর আমাদের স্টেশনের দুজন এ-এস-আই হাইওয়ের দিকে যাই। যে এ-এস-আই বার্ন্ট-আপ ডেডবডিটা কলেক্ট করে নিয়ে এসেছিল, সে সঙ্গেই ছিল, এরিয়াটা তো আমাদের জুরিসডিকশনের মধ্যেই। সে আমাদের ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথের ওই স্পটটায় নিয়ে গেল, আমরা কাছাকাছি সিসি টিভি ক্যামেরাগুলো মার্ক করে চলে এলাম। তারপর ফিরে এসে ইমেজগুলো পরীক্ষা করলাম মাইন্যুটলি। তিনটেতে বার্ণিং অ্যাকশন ধরা পড়েছে। দলে মোট চারজন ছিল। (এই সময় চন্দ্রোদয় আর বলরাম চোখাচোখি করে।)
এস-পি। কী অ্যাকশন?
সিন্হা। একটা মারুতি ভ্যানের মতো গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটাকে চারজনে ধরাধরি করে নামালো। মনে হল মেয়েটা সেন্সলেস ছিল, নো মুভমেন্ট অ্যাট অল। রাস্তাতেই শুইয়ে দিল মেয়েটাকে। দুজনে গাড়ি থেকে একটা জেরিক্যান নামালো, সেটা বডিটার কাছে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় রাখলো। তারপর ছেলে দুটোকে আর দেখতে পাইনি।
এস-পি। দেখতে পাওনি মানে কী? কোথায় যাবে ওরা?
বলরাম। হ্যাঁ, কোথায় যাবে?
সিন্হা। জানিনা স্যর, তবে এমন হতে পারে, ছেলে দুটো রাস্তার দুদিকে দূরে গিয়ে নজর রাখছিল। সন্দেহজনক কেউ, বা কোন গাড়ি-টাড়ি অ্যাপ্রোচ করলে মোবাইলে জানিয়ে দেবে।
এস-পি। পসিব্ল্।
সিন্হা। তারপর বাকি ছেলে দুটো জেরিক্যান থেকে লিকুইড কিছু ঢেলে দিল মেয়েটার গায়ে, তখন কেমন যেন মনে হল বডিটা মূভ করছে একটু একটু। ছেলে দুটো তখন দুজনে দুটো দেশলাই কাঠি জ্বেলে মেয়েটার বডিতে ফেলতেই দাউ দাউ করে আগুন। দশ সেকেণ্ড মতো অপেক্ষা করলো ওরা, তারপর ওই ভ্যানেই চলে গেল।
চন্দ্রোদয়। আর বাকি ছেলে দুটো?
সিন্হা। ওদের আর দেখতেই পেলাম না।
এস-পি। ছেলেগুলোকে বোঝা যাচ্ছিল? পরে দেখলে চিনতে পারবে?
সিন্হা। খুব অস্পষ্ট স্যর। তবে ক্লোজলি স্টাডি করলে ইণ্ডিভিজুয়াল গেইট বোঝা যাবে। ফলে, আন্দাজ করা যাবে।
এস-পি। (শেঠকে) কম্পাউণ্ডার তো মারা গেল শেঠ। তুমি কী করতে চাও এখন?
শেঠ। সবার সামনে একজনকে এমন পেটাল যে হাসপাতালে যেতে-না-যেতেই মারা গেল। অ্যারেস্ট তো করতেই হবে স্যর। অ্যাসল্ট অ্যাণ্ড হোমিসাইড।
সিন্হা। আমি একটা কথা বলব স্যর? শুধু অ্যাসল্ট অ্যাণ্ড হোমিসাইড কেন? ছেলেগুলো মারল কেন কম্পাউণ্ডারকে? কারণ ডাক্তারের রিপোর্ট সে যেটা বের করে দিল, তাতে গ্যাং রেপ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। আপনার কি মনে হয় না স্যর, সেটাই কারণ, এই গ্যাং রেপের সঙ্গে এরা যুক্ত?
এস-পি। হতে পারে। ওয়র্থ কনসিডারিং। (এবার চন্দ্রোদয়ের দিকে ফিরে) আপনারা কি এদের আর কিছু প্রশ্ন করবেন স্যর? নাহলে এদের আর আটকাব না।
চন্দ্রোদয়। ঠিক আছে, আপনারা এখন আসতে পারেন। (দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে এক-পা করে পিছিয়ে গিয়ে স্যাল্যুট করে, তারপর বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ায়। চন্দ্রোদয় হাতের ইঙ্গিতে ওদের থামায়) চা খেয়েছেন আপনারা?
সিন্হা। হ্যাঁ স্যর, ওয়েটিং রূমে দিয়েছিল। (বেরিয়ে যায়)
চন্দ্রোদয়। (বলরামকে) তাহলে কী ঠিক হল? যতগুলো ছেলে ছিল সবাইকে অ্যারেস্ট করবে?
বলরাম। দলের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে, গুরুজি।
চন্দ্রোদয়। সে তো হবেই। আগে ভাবলেই পারতে, কিন্তু কাণ্ডটা যখন ঘটিয়েই ফেলেছ, এখন উপায় কী আছে বল?
এস-পি। যদি অনুমতি দেন স্যর, তাহলে আমি একটা প্রস্তাব দিতে পারি।
চন্দ্রোদয়। বলুন।
এস-পি। একটা দিন অপেক্ষা করা যাক। সিসি টিভির ফূটেজ আর কোতয়ালি থানায় তোলা ফটোগুলো আমি নিজে একবার এগ্জামিন করি। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, মানে একটা হাঞ্চ আর কী – ওই ফূটেজের ছবিগুলোর ছেলেদেরও থানায় অ্যাসল্টারদের মধ্যে পাওয়া যাবে। যদি পাওয়া যায়, সবাইকে অ্যারেস্ট না করে আমরা ওই চারজনকেই শুধু অ্যারেস্ট করব। কারণ বডি পোড়ানোর এভিডেন্সটাও ওদের বিরুদ্ধে গ্যাং রেপের কেসটা আরও জোরদার করবে।
চন্দ্রোদয়। হ্যাঁ, আমাদের তো দরকার শুধু কয়েকজন রেপিস্ট, যাদের অ্যারেস্ট করে আমরা পাবলিককে স্যাটিসফাই করতে পারি। কী বলরাম, দশজন চাও না চার?
বলরাম। আমি আর কী বলব গুরুজি, যা আপনি ভালো বোঝেন...
এস-পি। তাছাড়া আমার আরও একটা হাঞ্চ আছে। যে কাগজটা রেপের কথা বলছে, সেটা ওই ডাক্তারের প্রিলিমিনারি রিপোর্ট। ওটা তো কোন অথেণ্টিক ডক্যুমেন্ট নয়। কেস কোর্টে উঠলে ডাক্তারকে সাক্ষী দিতে ডাকবে। ডাক্তার সিভিয়ার ব্রেন হেমারেজ নিয়ে হাসপাতালে। আমার মনে হয়, সে আর কোনদিনও সুস্থ হবে না। হলেও মেন্টালি আনস্টেব্ল্ হবে। ওর সাক্ষী গ্রাহ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে অ্যাকিউজ্ড্দের বেনিফিট অব দ্য ডাউট পেয়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে।
চন্দ্রোদয়। ঠিক আছে, আপনি দেখুন ওই চারজনকে থানার ক্রাউডের মধ্যে আইডেন্টিফাই করতে পারেন কিনা। আজ রাতের মধ্যেই আমাকে জানাবেন।
এস-পি। রাইট স্যর, তাহলে আমি উঠি এখন। (উঠে দাঁড়ায়, স্যাল্যুট করে বেরিয়ে যায়।)
চন্দ্রোদয়। (বলরামকে) রামখেলাওন আর দুর্জয়কে আমার সঙ্গে আজ রাতে দেখা করতে বোলো।
বক্তা। মিছিলের সমস্ত বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলছি। গত পাঁচ সপ্তাহ ধরে কান্নাওয়ের মানুষ সরকারের যে কুৎসিত নৃশংস অত্যাচারের নমুনা দেখছে, পৃথিবীর ঘৃণ্যতম নৃশংসতম কোন রাক্ষস সরকারও এমন দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি। আমাদের এই কান্নাও দু নম্বর ব্লকের মেধাবী কলেজ ছাত্রী অনিতা তার মর্ণিং কলেজ থেকে গত দোসরা সেপ্টেম্বর বাড়ি ফেরেনি। অনিতাকে যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন তার মতো মেধাবী শান্ত ও নিয়মানুবর্তী ছাত্রী প্রায় বিরল। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর অনিতার উদ্বিগ্ন পিতামাতা যখন স্থানীয় কিছু নাগরিকের সঙ্গে থানায় একটি মিসিং ডায়েরি করতে যান তখন পুলিশ ডায়েরি নিতে অস্বীকার করে। পুলিশ জানায় যে স্থানীয় এম-এল-এ যিনি এ রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীও বটে, তাঁর নির্দেশেই দুদিনের জন্য কোনরকম মিসিং ডায়েরি নেওয়া বন্ধ। কিন্তু বন্ধুগণ, কেন? মিসিং ডায়েরি নেওয়া বন্ধ কেন? পুলিশ বলেছে নাকি জাতীয় নিরাপত্তার কারণে। কোন্ জাতীয় নিরাপত্তা? তাহলে কি মাননীয় মন্ত্রী জানতেন সেদিন অনিতার মতো কোন কোন তরুণীকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না? আর সেই খুঁজে-না-পাওয়ার জন্যে যে নরপশুরা দায়ী তাদের নিরাপত্তাই জাতীয় নিরাপত্তা? কার স্বার্থে, কার জঘন্য বিকৃত পাশবিক বাসনা চরিতার্থ করে আইন-ব্যবস্থা থেকে পালাবার সুবিধে করে দিলেন মন্ত্রীমশাই? এই পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দেশের সকলেই নানা সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে জেনে গেছেন, কীভাবে অচেতন ধর্ষিতা অনিতাকে কে বা কারা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সকলের অলক্ষ্যে ফেলে যায়, সেদিনই কীভাবে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার গাড়িকে ধাক্কা মারা হয়, এবং অবশেষে একই দিনে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে হরণ করে দগ্ধ করে খুন করে রাস্তায় ফেলে যাওয়া হয়। লক্ষ্য করবেন, যে নাগরিক অনিতার মৃতদেহটি দেখতে পেয়ে নিকটতম থানায় খবর দেয়, এফ-আই-আর করার চেষ্টা করলে তাকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অথচ যে দুর্বৃত্তরা এই অপরাধগুলো সংঘটিত করেছে তাদের ব্যাপারে পুলিশ ও প্রশাসন নিশ্চেষ্ট। শুনলে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, যে চারজন ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিজেদের হেপাজতে রেখে দিয়েছে, গত পাঁচ সপ্তাহে বারংবার আদালতের ধমক সত্ত্বেও পুলিশ তাদের চার্জশীট তৈরি করতে পারেনি। বন্ধুগণ, সরকার বোধ হয় মনে করছে নিশ্চেষ্ট হয়েই তারা স্বচ্ছন্দে রাজত্ব চালিয়ে যাবে। আমাদের সাধুপুরুষ মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রীকে আমরা নাগরিকরা জানিয়ে দিতে চাই, এই পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার জন্যে আপনাদের দুজনকে আমরা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করব। এর মধ্যেই সারা দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা এক দিনের প্রতীকি ধর্মঘট করেছে। আগুন জ্বালিয়ে একটি ছাত্রীকে আপনারা হত্যা করেছেন, পরিণামে সারা দেশে এখন আগুন জ্বলবে। হত্যাকারীদের আড়াল করে দেশে আগুন জ্বালছে কে?
চন্দ্রোদয়। (এস-পিকে) আপনি তো এখনই এলেন, রাস্তাঘাটের অবস্থা কেমন? (বাড়ির ভেতরের দিকে মুখ করে, চেঁচিয়ে) আরে এই হরি, কফির কী হল?
এস-পি। আনইউজুয়াল কিছু দেখলাম না। দুয়েকটা কুকুরের চিৎকার, যেমন হয়েই থাকে।
বলরাম। চার্জশীট দিচ্ছেন না কেন? মীডিয়া তো আর টিকতে দিচ্ছে না। এমনকি রেডিওর স্টেশন ডিরেক্টরও সেদিন টেলিফোনে হোম সেক্রেটারিকে বলেছে, যা হোক কিছু একটা করুন। এরকম একটা সেন্সিটিভ ইশ্যুতে চুপ করে থাকলে রেডিও আর শুনবে না লোকে, রেভিনিউও কমে যাবে, সেন্টার থেকে চাপ আছে।
এস-পি। (চন্দ্রোদয়কে) বলুন স্যর, কী চার্জশীট দেবো? তিনজন ল'য়্যার অ্যাডভাইস করছেন আমাদের, তিনজনই বলছেন কোনমতেই ওদের বাঁচানো যাবে না। অনেক ফাইট করে গ্যাং-রেপে বেনিফিট অব দ্য ডাউট যদি পাওয়াও যায়, বার্ণিং উইদ ইন্টেনশন টু হোমিসাইডের জন্যে লাইফ টার্ম আটকানো যাবে না। ইন ফ্যাক্ট, রেয়ারেস্ট অব দ্য রেয়ার ক্রাইমের জন্যে ক্যাপিট্যাল পানিশমেন্টও রূল-আউট করা যায় না। (একটা ট্রেতে তিনটে ধুমায়িত কাপ নিয়ে হরির প্রবেশ, সোফার পাশে পাশে ছোট ছোট টেবিলে আলাদা আলাদা কাপ রেখে দ্রুত চলে যায় সে।)
চন্দ্রোদয়। আগে বলুন, চারজনের চারজনই যাবে, না দুএকটাকে বাঁচানো যাবে?
এস-পি। বাঁচানো যাবে মনে হয় না স্যর।
বলরাম। কেন যাবে না? দুজন তো পোড়ানোর মধ্যে ছিল না।
এস-পি। পোড়ানোর মধ্যে সবাই ছিল স্যর। গাড়ি থেকে মেয়েটাকে নামিয়েছে চারজন মিলে ধরাধরি করে। তারপর দুজন জেরিক্যানটা নামিয়েছে। নামানোর পর তারা আলাদা যতই হোক, পোড়ানোতে পার্টিসিপেট করার চার্জ অ্যাভয়েড করতে পারবে না। আইনের চোখে সবাই ইকোয়ালি গিলটি।
চন্দ্রোদয়। আচ্ছা, একটা কাজ করলে হয় না? আপনি যদি সিসি টিভির কথাটা না-ই বলেন?
এস-পি। আমি না বললেও জজ সাহেব নিজেই বলবেন। যদি বলি সিসি টিভি চেক করিনি, প্রথমেই ইনকম্পিটেন্ট পুলিস ফোর্স বলে রিমার্ক করবেন, পরের দিন মিডিয়ায় হৈ হৈ হয়ে যাবে।
বলরাম। হল। মাথা কেটে তো নেবে না।
এস-পি। নিতেও পারে স্যর। কেসটা এত পুরোনো নয় যে মনিটরে ব্যাক-আপ থাকবে না। যদি বলি ব্যাক-আপ নেই, পুলিসের কমপ্লিসিটি ক্লীয়ার! দিনের মতো পরিষ্কার!
চন্দ্রোদয়। ছেলেগুলো কোথায় আছে? জুডিশিয়াল কাস্টডি না আপনাদের কাছে?
এস-পি। সদর পুলিস স্টেশনের লক-আপে এখনো পর্যন্ত আছে, তবে মনে হয় না এরপর জাজ আর অ্যালাউ করবেন। চার্জশীট এখন দিতেই হবে।
চন্দ্রোদয়। আপনাদের কাস্টডিতে আছে, থার্ড ডিগ্রী দিচ্ছেন না কেন?
এস-পি। কিসের থার্ড ডিগ্রী স্যর? কী কনফেস করবে ওরা? যা কনফেস করবে সেটা কি আপনাদের পক্ষে ভালো হবে? যদি বলেন, তাহলে করব। এমন ভয়ঙ্কর কাজ যারা করেছে তাদের থার্ড ডিগ্রী দেবার জন্যে পুলিস তো সব সময় উন্মুখ!
বলরাম। গুরুজি সে কথা বলেননি। হাড়গোড় ভেঙে দিন, এক বছরের জন্যে হাসপাতালে থাকুক।
এস-পি। সে তো দিতেই পারি। কিন্তু যে কনফেশন নিতে চাই না বলে হাসপাতালে পাঠাব, তখন সেই কনফেশন নেবে মিডিয়া। সেটা ভালো হবে কি?
চন্দ্রোদয়। এখন তাহলে উপায়? আচ্ছা, আপনাদের অ্যাডভাইস দিচ্ছে যারা তাদের মধ্যে ত্রিবেদী আছে, তাই না?
এস-পি। হ্যাঁ স্যর, ওমপ্রকাশ ত্রিবেদী।
চন্দ্রোদয়। ওকে একবার ডেকে আনা যায়?
এস-পি। কেন যাবে না স্যর? আনাব?
চন্দ্রোদয়। ডাকুন না একবার। এখনই আসুক।
এস-পি। (পকেট থেকে মোবাইল বের করে, বোতাম টেপে) ত্রিবেদী সাহেব ঘুমোচ্ছেন না জেগে?... হ্যাঁ, ডাকুন একবার, বলুন কান্নাওয়ের এস-পি ফোন করছে...আমি লাইনে থাকছি, লাইনটা কাটবেন না...হ্যাঁ তাড়াতাড়ি... ঠিক আছে...হ্যাঁ, ত্রিবেদী সাহেব? আপনাকে এখনই একবার সি-এমের বাড়িতে আসতে হবে, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি... দশ মিনিট... কুড়ি মিনিটে আপনাকে এক্সপেক্ট করব, রেডি হয়ে থাকবেন। ওকে।
ত্রিবেদী। (বিশেষ কারো দিকে না-তাকিয়ে) কী খবর স্যর, জরুরি তলব?
চন্দ্রোদয়। ত্রিবেদী সাহেব, আমরা এখনো কেন গ্যাং রেপ কেসটায় চার্জশীট দিতে পারছি না?
ত্রিবেদী। দিতে চাইছেন কি? দিলে কি আপনাদের পক্ষে সুবিধে হবে?
চন্দ্রোদয়। সেটা আলোচনা করবার জন্যেই তো আপনাকে ডাকলাম। আপনি কী মনে করেন?
ত্রিবেদী। আমার মনে করায় কিছু যায়-আসে না স্যর। শুধু একটা কথা। এমনিতে আমাদের পাবলিক প্রসিক্যুটর হয়তো প্রসিক্যুশন চাইবে না, তবুও তার পক্ষে আসামিদের ডিফেণ্ড করা তো সম্ভব নয়। কিন্তু আসামিরা নিজেরা? কোন লোকই নিজের ফাঁসি চায় না, ধরুন ওরা ঘটিবাটি বেচে একজন ভালো ডিফেন্স ল'য়্যার লাগিয়ে দিল, পুলিশকে সে ছেড়ে দেবে? আদালতে সর্বসমক্ষে পুলিশ এবং পুলিশের সাক্ষীদের নাস্তানাবুদ করলে তার ফল নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন!
চন্দ্রোদয়। আপনি তাহলে কী করতে বলেন?
ত্রিবেদী। সব দিক রক্ষে করতে গেলে রাস্তা একটাই। দেখুন, আমি একজন ক্রিমিনাল ল'য়্যার, আমাদের খুব বদনাম, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ক্রিমিনাল তো নই। আমি কী বলব! আপনাদের দলের কোন কোন লোকের ব্যক্তিগত সম্মান যদি রক্ষা করতে হয়, এবং সরকারেরও সম্মান যদি বাঁচাতে হয়, এবং, এবং আপনারা যাদের জনগণ বলেন তাদের আবেগকেও মূল্য যদি দিতে হয়, তাহলে রাস্তা একটাই। এই আসামিদের আদালত থেকে মুক্তি দিন।
চন্দ্রোদয়। আদালত থেকে মুক্তি? কীভাবে সম্ভব?
ত্রিবেদী। ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে স্যর, আদালতের হাত থেকে মুক্তি দেবার রাস্তা আপনাদের চেনা যে নয়, সেটা কি ঠিক? মনে করে দেখুন বছর বিশেক আগের কথা। সেই আপনারা যখন পশ্চিম প্রদেশে ক্ষমতায় ছিলেন। সেই যে গোকর্ণ রেলওয়ে স্টেশনে কী একটা গণ্ডগোল হল, মনে আছে? একটা নতুন শব্দ তারপর থেকে তৈরি হয়ে গেল স্বর্গভূমির শাসন প্রণালীতে? মনে আছে আপনার? এ-ন-কা-উ-ন্-টা-র!
চন্দ্রোদয়। সে প্রণালীর প্রয়োগ এখানে কী করে হওয়া সম্ভব?
ত্রিবেদী। (হাত জোর করে) স্যর, আমি শাসক নই, প্রশাসকও নই। শুধুই একজন উকিল। আমাকে আজ যেতে দিন স্যর, আমাকে দিয়ে এর বেশি আর বলাবেন না। এস-পি সাহেব আছেন এখানে, উনি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, আপনারাও কম বিশেষজ্ঞ ন'ন। (উঠে দাঁড়িয়ে এস-পির উদ্দেশ্যে) আমাকে কি পৌঁছিয়ে দেওয়া যাবে স্যর?
এস-পি। আপনাকে তো সিকিওরিটি পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল? (মোবাইল ফোনে কথা বলে) আপনি ওই দরজার মুখে দাঁড়ান, আপনাকে সিকিওরিটি নিয়ে যাবে, ড্রাইভার পৌঁছিয়ে দেবে। (ত্রিবেদী সোজা দরজা দিয়ে বাইরে চলে যায়, পেছনে ফিরে তাকায় না।)
চন্দ্রোদয়। আদালতের পরিবেশটাই খারাপ হয়ে গেছে, এ লোকটাও কি এখন নাগরিক?
এস-পি। আমার ভাবা হয়ে গেছে স্যর। (ঘড়ি দেখে) আজ এখন ভোর পৌনে চারটে। আগামী কাল ঠিক এই সময়ের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। এনকাউন্টারই রাইট আইডিয়া। খতম হবার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই আমি আপনাকে ফোন করব, ধরবেন ঠিক।
চন্দ্রোদয়। কিন্তু কী করবেন একটু ডিটেইলটা বলবেন না?
এস-পি। আমার ওপর ভরসা রাখুন স্যর, এটুকু শুধু আমাদের মধ্যেই কনফাইণ্ড থাকুক। আমি এখন উঠব, আপনারা নিজেদের মধ্যে ভেবে রাখুন ঠিক কীভাবে সিচুয়েশনটা নিজেদের অ্যাডভান্টেজে আনতে পারেন।
রেডিও। “বিকাশবাণী। লক্ষ্মণাবতী কেন্দ্র থেকে সকাল দশটার খবর পড়ছি আয়ুষ কাশ্যপ। এখনকার প্রধান প্রধান খবর হল, কান্নাওয়ে গণধর্ষণের দায়ে ধৃত চারজন আসামীর মৃত্যু। সারা দেশে পুলিশি রক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাবার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীসভা-শাসিত ও প্রধান মন্ত্রী পরিচালিত গণতান্ত্রিক দেশচালনার পরিবর্তে সংবিধানের আমূল সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি-শাসিত দেশচালনার যে প্রস্তাব প্রধান মন্ত্রী দিয়েছেন আজ লোকসভায় তার প্রবল বিরোধিতা।
“এখন সংবাদ বিশদে। আজ ভোর তিনটে নাগাদ কান্নাওয়ে গণধর্ষণের দায়ে ধৃত চারজন আসামীকে কান্নাও সদর পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত ইনস্পেক্টর আর-কে সিন্হার নেতৃত্বে ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। খবরে প্রকাশ, ওই অঞ্চলেই গণধর্ষিতা বলে কথিত তরুণীর দেহে এই চারজন আসামি অগ্নিসংযোগ করেছিল। এই অগ্নিসংযোগের ফলে তরুণীর মৃত্যু হয়। ইনস্পেক্টর আর-কে সিন্হা আমাদের বিশেষ প্রতিনিধিকে জানান, অগ্নিসংযোগ এবং তার অব্যবহিত পূর্বে এবং পরে যা ঘটেছিল সেই ঘটনার পুনর্নির্মাণের সাহায্যে প্রতিটি আসামির দায় এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করাই গভীর রাত্রে এই অকুস্থল ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল। এই সময় অতর্কিতে এক আসামী কোন একজন সাব-ইনস্পেক্টরের গুলিভরা রিভলভারটি ছিনিয়ে নেয় এবং গুলি চালাতে চালাতে দলের সকলে দৌড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার দায়ে এক মুহূর্তের দ্বিধার পর পুলিশের গুলিচালনায় চার আসামীই ধরাশায়ী হয়। খবরটি সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ঝঞ্ঝাবাতের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এবং সকাল আটটার সময়েই জনসাধারণের একটি বিশাল মিছিল কান্নাও ব্লক টূ, অর্থাৎ তরুণীর বাসগৃহের সামনে থেকে সদর পুলিশ স্টেশনের দিকে যাত্রা করে। পথিমধ্যে কাতারে কাতারে সাধারণ মানুষ মিছিলে যোগ দেয় এবং পুলিশের জয়ধ্বনি করতে করতে এগোতে থাকে। আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন এত দ্রুত এই নারকীয় গণধর্ষণের নায়কদের চুড়ান্ত শাস্তিপ্রাপ্তি জনগণকে সুশাসিত ভবিষ্যতের পথ দেখানোর ফলেই আমজনতার এই উল্লাস। অঞ্চলের অনেক বিশিষ্ট মানুষকে মিছিলের পুরোভাগে দেখা যায়, এঁদের মধ্যে রামখেলাওন শর্মা, দুর্জয় সিং এবং রাজ্যের গৃহমন্ত্রী বলরাম চৌধুরি উল্লেখযোগ্য। মিছিলটি থানায় পৌঁছোবার পর সর্বসাধারণের সম্মতিক্রমে পুলিশবন্ধুদের আগামী সপ্তাহে একদিন সম্বর্ধনা দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ধর্ষণকাণ্ডে চরম শাস্তি দিল কে? কান্নাওয়ের পুলিশবন্ধু, আবার কে!
কান্নাও পুলিশ জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ!
সারা দেশে প্রেপ্তার হওয়া সব ধর্ষকের ফাঁসি চাই। ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই!
আগামী সোমবার সদর থানায় পুলিশ সম্বর্ধনায় যোগ দিন। দলে দলে যোগ দিন!
মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রোদয় স্বামী অমর রহে। অমর রহে অমর রহে!
পুলিশমন্ত্রী বলরাম চৌধুরি অমর রহে। অমর রহে অমর রহে!
চন্দ্রোদয়। (ফোন ধরে) হ্যাঁ হ্যাঁ, থ্যাঙ্ক য়্যু থ্যাঙ্ক য়্যু... না না পি-এমের সঙ্গে কথা হয়নি... না আজ অফিসে আসছি না, বাড়িতে অনেক ভিজিটর থাকবে... না না, বাড়িতে আছি কাউকে বলার দরকার নেই, যাদের জানার দরকার তারা জেনেই যাবে। ওকে। (ফোন রাখতে রাখতেই আর একটি ফোন বাজে, চন্দ্রোদয় ধরে।)
চন্দ্রোদয়। হ্যালো, হ্যাঁ। কী বলছো, বুলেটিন?... না শুনিনি তো...অ্যাঁ?... প্রতি ঘন্টায়?... ঠিক আছে, চলে এস।... না, তুমি একাই আসবে...কেউ না কেউ না...কোন কথা নেই... আমি খুচরো ঝামেলা চাই না। রাখলাম। (চন্দ্রোদয় ফোন রেখে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করে, মনে হয় মন লাগছে না, কাগজ রেখে দিয়ে পায়চারি করে কিছুক্ষণ, আবার বসে পড়ে কিছুক্ষণ, এরকম চলে কয়েকবার, এমন সময় বলরামের প্রবেশ)
বলরাম। শুনেছেন?
চন্দ্রোদয়। কী শুনব?
বলরাম। বুলেটিন। ঘন্টায় ঘন্টায় চলছে। (নিজের হাতের ঘড়ি দেখে) এই তো, সময় হয়ে গেল পরেরটার। (নিজেই উঠে গিয়ে রেডিওটা চালিয়ে দেয়, এসে বসে চন্দ্রোদয়ের বিপরীতে, বুলেটিন শুরু হয়।)
“বিকাশবাণী। লক্ষ্মণাবতী কেন্দ্র। এখন পড়ছি একটি বিশেষ বুলেটিন। আজ সকাল দশটায় লক্ষ্মণাবতী হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি কতিপয় নাগরিকের একটি দরখাস্তের জবাবে ঈশান প্রদেশের পুলিশ-প্রধান পুলিশ-মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীকে একটি জরুরি বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ উপরিউক্ত তিনজনের কাছে পৌঁছোনো মাত্র বলবৎ হবে। নির্দেশে বলা হয়েছে আজ ভোরে ছিয়াত্তরের ঘ-সংখ্যক জাতীয় রাজপথে পুলিশ এবং কতিপয় আসামির তথাকথিত অস্ত্রসংঘর্ষের ফলে ওই আসামিদের নিহত হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সবরকমের মিছিল, সভা বা যে কোন কথিত ও লিখিত মন্তব্য পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এই উপলক্ষে রাজ্যের পুলিশ বাহিনীকে কতিপয় ব্যক্তির একটি সম্বর্ধনা দেবার প্রস্তাব আদালতের নজরে এসেছে। এই প্রস্তাবও কার্যকরী না-করার বিশেষ নির্দেশ আদালতের পক্ষ থেকে দেওয়া হল। বুলেটিনটি শেষ হল।”
বলরাম। হোঃ, নাগরিকদের নালিশে বিচার, আর রায় দেয় আর এক শালা নাগরিক। এ দেশের আর কী হবে বল!