আজ পুরো একহপ্তা হয়ে গেল ঘরে একটাও খদ্দের আসেনি। পুঁটি প্রথম প্রথম প্রতিদিন দুপুরবেলা খেতে এসে নানা ছলে জেনে নিতে চাইত সেদিনের হাল হকিকত।
- আজ কি বিকেলবেলা ভাইকে নিয়ে গঙ্গার ধার থেকে ঘুরে আসব?
মা যদি বলত আজ আরেকটু বেশি দূরে ঘুরে আয়, তবে পুঁটি বুঝবে ঘরে বাবু আসবে , দু'একদিনে মুরগীর মাংস হলেও হতে পারে। কিন্তু এ কথা অনেকদিন শোনে না সে, বরং তার মা রেখা বলে ওঠে,
- পটে জল নেই। সন্ধ্যেবেলা জল ভরে নিয়ে আসবি, দেরি করবি না, সাতটায় জল চলে যাবে।
এখন আর ঘর ছেড়ে এদিক ওদিক যাবার দরকার পড়ে না। পুঁটি তবু ঘরে থাকে না, অনেকদিনের অভ্যেস। তাছাড়া যত বড় হচ্ছে ততই এ ঘর যেন তার কাছে খুবই ছোট হয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নগুলো এ ঘরে আর খেলে না। জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না, বরং পিঙ্কিদের কোঠার পাঁচিল দেখা যায় । ভাইকে নিয়ে লালবাতির বাল্যশিক্ষা কেন্দ্রে দিয়ে আসে পুঁটি, আর নিজে চলে যায় মন্টুদাদের ক্লাবে। সেখানে পট্টির বাকি ছেলেরা থাকে, ক্যারাম পিটায়, বিড়ি-সিগারেট-গাঁজা ফোঁকে, কেউ কেউ মদও খায়। পুঁটির সেখানে কোনও কাজ নেই, তবুও সেখানেই যায়, অকাজের ছেলেদের এই একটা যাবার জায়গা আছে এখানে। যদি ক্যারামটা কখনও ফাঁকা পেল তো লালগুটিটা নিয়ে একটু পেটাপেটি করল, নইলে আর কোনও কাজ নেই তার সেখানে, ফেলনা হয়ে দাঁড়িয়ে-বসে থাকে । মেয়েদের সঙ্গ তার ভাল লাগে না, লালবাতির মেয়েদের তো সেই এক কাজ, ওসব দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। ছেলেদের সঙ্গও তার ভাল লাগে না, অন্তত মন্টুদার ক্লাবে যে লুখ্খা ছেলেগুলো থাকে তাদের দেখে পুঁটির গা জ্বলে যায়। আরও জ্বলে কারণ ওরা পুঁটির পেছনে লাগে, এটা সেটা বলে, গোপন জায়গায় হাত দেয় আর হাসে । তাছাড়া, চুল ধরে টানা, কিল চড় ঘুষি এসব তো আছেই। এসব সবসময় হয় না, কিন্তু মাঝে মাঝেই হয়, যেন এসব ঘটার একটা সময় বরাদ্দ করে দেওয়া আছে, ওই খানিকটা রেলগাড়ির টাইমটেবলের মত। এসব হয় ওর সাথে, তবুও পুঁটি ওই ডেরাতেই যায়। কোনও কোনও দিন ওর সাথে কিছুই হয় না সেখানে। তখন যেন ও অপেক্ষা করে থাকে কেউ কিছু বলবে, খারাপ বলুক তবু বলবে তো। গঙ্গার ধারে যায় মাঝে মাঝে, কিন্তু সেখানে একা গিয়ে ওর মনখারাপ করে। রেলস্টেশনেও যায়, সেখানে গেলে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় যাবে? সে জায়গাটাও যদি এরকম হয়! তারপর যাবে কী করে তার কোমরে যে তাদের পট্টির ওই ছোট ঘরের সাথে দড়ি বাঁধা রয়েছে।
রেখার খুব ইচ্ছে ছিল একটা মেয়ে হোক। পুঁটি জন্মানোর আগে বৃদ্ধা ক্ষেন্তিমাসি এসে বলল,
- কস্ কী? আবার মাইয়্যা? আরে ও আবাগি , বলি শরীলের সাথে মনটারেও খাইসিস নাকি ? মেয়ে আনবি এই বেশ্যাপাড়ায়? বেশ্যামাগি! মর! মর! মর!
পাশের খোপের করুণা এসে বলল,
- তা ভাল ভাই, তোর কোলে তবু একটা জম্মালো, আমার তো ডিমই নাই। শোন! ওই বুড়িমাগির কতা শুনিস না বেটি , একটা খুকি হোক। বয়েসকালে তবু গতর বেচে খাওয়াতে পারবে।
রেখার বুকটা ঝনঝন করে উঠেছিল। আপন সন্তানকে কেউ কি আর এসব পথে পাঠাতে পারে! তার একটা খুকির শখ। সেই কোন ছোট্টবেলায় পুতুল ছেড়ে এসেছে সে। নিজের মেয়েকে মনের মত সাজাবে, পড়াশুনো করাবে, তারপর সেই মেয়ে ইস্কুলে পড়াবে, নয়তো ডাক্তার হবে। এসবের জন্য যে খরচাপাতি হবে, একটা বাবু ধরে কি সেই টাকা উঠে আসবে না?
না, রেখার মেয়ে হল না, ছেলেই হল। সবাই আনন্দ করে বলল, নে রেখা, এবার তোর কপাল ফিরল। করুণা যেন সাবধান বাণীর মত করে বলল, দেখ আবার, এ পাড়ার জল তো, ছেলে আবার দালাল না হয়ে ওটে । তবু শখ করে সে ছেলের নাম রাখল পুঁটি। মেয়ে না হোক, মেয়ের নামটা থাক , আর এ তো ডাক নাম ! কিন্তু সেই মেয়ের নাম ছেলের শরীর মনে ছাপ ফেলেছিল বোধহয়। পুঁটি শরীরে ছেলে, মনে মেয়ে নাকি ঠিক মেয়েও নয়, হাবভাবে মেয়ে!
ছোট থেকেই এ পাড়ায় সকলে এত কিছু দেখে যে এদের আলাদা করে জীবনের মূল গুপ্তবিদ্যাগুলো আর শেখাতে হয় না। পুঁটিকে দেখা গেল মুকেশের সাথে। পাশের খোলের লাভলিনের ছেলে, এখন দালালি করে মাঝে মাঝে, কম্পিউটারের আরও কীসব করে যেন। লাভলিন চোস্ত ব্যবসাদার, যৌবনে এক মাড়োয়ারি বাবুকে ধরে একটু টাকা জমিয়ে নিয়েছে। পাশের খোলের তিনটে ঘর কিনে ফেলেছে সে। তার দুটো ছেলেই শেয়ানা। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে এই লালবাতি এলাকা থেকেই, চাট্টিখানি কথা নয়, সবাই এর জন্য ওকে বাহবা দেয়, একটু সমঝে চলে। ছেলেদুটো এরই ফায়দা লোটে। দুই ছেলে মিলে পট্টির তিনটে মেয়ের জল খসিয়েছে। সে নিয়ে কী মারাত্মক ক্যাচাল, মেয়েদের ষোলো হয়নি তখনও, দালালরা এসে টাকার দাবি করল। কিন্তু টাকা কি আর গাছে ফলে! পাওয়া যায়নি। ছোট ছেলে মুকেশের সাথে যে মেয়েটার ঘষাঘষি হয়েছিল, সেটা নাকি প্রেম ভালোবাসা ছিল। যাই হোক, সেসব চুকে গেছে। এখন পুঁটির সাথে মেশামিশি করতে দেখল সবাই। ঘোষেদের পোড়ো বাড়ির অন্ধকারে, গুপ্তাদের একচিলতে বাগানে রাতের বেলায়, রেললাইনের ধারের ঝোপে, আর লাভলিন না থাকলে ওদের বাড়িতে। সবই গোপনে, কিন্তু এ পাড়ায় শরীরের মেশামিশি গোপন থাকে না।
ক্ষেন্তিমাসি এসে রেখাকে বলে গেল,
- পেটে কী বিয়োলি র্যা? এর থেকে মেয়েই ভাল ছিল... এরে দিয়ে কিসুই হবে না। ঘরের হবে না, পরের হবে না, ছোঃ!
রেখা সেসবে গা করেনি, তার শরীরে এখন নিত্যদিন রোগের জ্বালা, পেটেয় খিদের জ্বালা। আর এর পেছনে রেখার নিজের কোনও হাত নেই। সে এসব ভাবার পরিস্থিতিতেই নেই। তবু সন্তানের কথা মাকেই শুনতে হল।
মুকেশের সাথে পুঁটির দাপাদাপি একেবারেই আর চাপা থাকল না। মন্টুদাদের ক্লাবের কয়েকটা ছেলে এখন পুঁটিকে ঝোপে টেনে নিয়ে যেতে চায়, পারলে ক্লাবের মধ্যেই পুঁটির প্যান্ট খুলে দেয়, হাত ঢোকায়। গায়ে হাত দিতে দেয়নি বলে রকি রেগে গিয়ে বলল, বেশি খরামি... পোঁদে নেই চাম, হরেকৃষ্ণ নাম। স্লা! হিজড়া, কতি, হিজড়েদের ঠেকে গিয়ে তালি বাজা, দেখ যদি কিছু পয়সা পাস,থুঃ!
কে যেন একটা বলল, এ ভাই, ক্লাবের মধ্যে বাওয়াল নয়, মন্টুদা কিন্তু বলে গেছে। রকি চুপ করে গেল।
ক্লাবের সভাপতি তন্ময় এসে বলল, আর যাই করো না কেন, কন্ডোমটি পরে নিও, ছেলে ছেলে বলে কিন্তু রোগ আটকাবে না । মদ গাঁজা খেয়ে যমের দুয়ারে পড়ে থাকা হাড় জিরজিরে ছেলেগুলো সুখের আশায় পুঁটির কাছে এসে দাঁত বের করে হাসে। সেসব ছেলেকে পুঁটির পছন্দ হয় না। পুঁটি একটা প্রেমিক চায়, শাহরুখ খানের মতো দেখতে না হোক, একটু ছিরি তো থাকবে সেই ছেলের। কিন্তু পুঁটি কীভাবে আর বলবে যে মুকেশের সাথে পুঁটির ভালোবাসার সম্পর্ক, অন্য কোনও বাজে সম্পর্ক নয় !
সে ভালবাসা বেশিদিন টেকেনি। এক বসন্ত থেকে আরেকটা বসন্তও পার হয় নি। মুকেশ একদিন বলল,
- তু পহলে মাফিক চার্মিং নহি রহা...
পুঁটি বুঝল না, জিজ্ঞেস করল,
- চার্মিং? মানে?
- চার্মিং বোলেতো... খিঁচাও... উয়ো টা-ন... উমর বড় গয়া তেরা...
উমর! কত আর উমর! এই তো চোদ্দ থেকে পনেরো হল পুঁটির, ভাল করে গোঁফটাও গজায়নি। আর এই একবছরেই এত উমর বেড়ে গেল যে টানটাই নষ্ট হয়ে গেল! অবাক হল পুঁটি।
রেখার শরীর দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। আয়ের ব্যবস্থা একেবারেই নেই। মন্টুদার কাছে এমনিতেই একবছরের ভাড়া বাকি। এরপর হয়তো এখান থেকেই উঠিয়ে দেবে। না খদ্দের, না ভাড়ার টাকা এভাবে আর কী করে চলে! পুঁটি একটা দোকানে, একটা গ্যারেজে, একটা হোটেলে কাজের চেষ্টা করল, কিন্তু কোনওটাই সপ্তাহের বেশি টিকল না। এইট পাশ করার পরেই পুঁটির স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়েছিল, দুপুরের খাবারটা আর স্কুলে দিত না যে। তারপর পড়ার মনই ছিল না তার, কিছুটা ছেলেদের প্রতি ছোঁকছোঁক মন, কিছুটা বাড়ির কাজ, কিছুটা রাকেশের সাথে প্রেম, কিছুটা পাড়ার পরিবেশ,কিছুটা মায়ের কুস্বাস্থ্য তাকে পড়া থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল । সবাই তো আর অনবরত যুদ্ধ করতে পারে না। সেই সময়ে পুঁটি একরকমভাবে রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। কিন্তু এখন যেন আবার নতুন একটা যুদ্ধস্থলে এসে পড়েছে সে।
পট্টির একজনকে একদিন বলল, আমি ব্যবসায় নামব। পুঁটির এই কথা শুনে পট্টির মেয়েরা হেসে গড়াগড়ি খায়। মরদের তো আর যাবার জায়গা নেই যে এই চিমড়ে কাঠের কোমরগুলো ধরে দুলতে আসবে! হাসালি। একটা নতুন মেয়ে বলে উঠল, শুনেছি এসব ছেলে ছেলেতে হয় বটে কিন্তু সে তো মুষ্ক মত চেহারা থাকতে হয়, শরীলে রস থাকতে হয়। তোর তো এখনও গা থেকে দুধের গন্ধটাই যায়নি ! গোঁফ নাই, দাড়ি নাই, তোর গায়ে মাংস নাই, তোকে কোন ছেলে পুষবে রে? আর তোকেই যদি পুষতে হয় তবে আমরা কী দোষ করলাম হতভাগা? ভাগ্। তবু যেন পুঁটির বিশ্বাস হয় না, তবে কেন মুকেশের মত সুন্দর ছেলে পুঁটির সাথে এতকিছু করল? মেশামিশিতে কেনই বা ছিল তার এত সরস ভাব? নিশ্চয়ই আরও কেউ এরকম আছে, যাদের পুঁটির মত ছেলে লাগে।
রকির কাছে গিয়ে একদিন দাঁড়াল সে। রকি ওকে দেখে মৃদু হাসল। এমন দাঁড়ানো রকির চেনা, ঘা খেয়ে পাখি ফিরে এসেছে। কিন্তু রকির কাছেই কেন, তা বুঝতে পারল না, তাই রকি নিজেকে একটু সামলে নিল, কী জানি! কী মতলব আবার কতিটার! রকি এ চত্বরের নামকরা দালাল, ওর হাত দিয়ে শরীর ব্যবসার লাইনে নামলে নাকি বেশ কামানো যায়, এ ব্যবসায় চেনাচিনিটাই বড় কথা, ঠিক খদ্দের পাওয়াই বড় ব্যাপার। তারপর গাড়ি এমনিই চলতে থাকে। সাঙ্গপাঙ্গ ছেড়ে রকি গঙ্গার ধারে পুরোনো শিবমন্দিরের পাশে নিয়ে গেল ছেলেটাকে। বলল,
- কী রে? এখানে এসেছিস কেন?
- ব্যবসায় নামব...
রকির যেন কৌতুক হল, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে বলল,
- মাইরি, কী ব্যবসা করবি তুই?
- যে ব্যবসার দালাল তুই...
- কেলো করেচে! কী বেচবি? আছে টা কী তোর?
- অনেক আছে...
- খুশি করতে পারিস?
- পারি।
- দেখি তবে... আজ আসিস ঘরে।
পুঁটি চলে যেতে উদ্যত হলে রকি থামিয়ে বলল,
- শোন্, সেই যখন ভাঙলি, সেইদিন অত রোয়াব দেখালি কেন? শুধু হাত দিয়েই তো মাপছিলাম, আর তো কিছু করিনি।
পুঁটি উদাস তখন, পেছন ফিরেই উত্তর দিল,
- এমনি।
রাতে রকি খুব ধামসালো পুঁটিকে। শেষে বলল,
- পারিস কিছু কিছু, এ পাড়ার মেয়েদের মত না যদিও...
পুঁটি চুপ করে রইল। যেন ওর পরীক্ষার ফল বেরোচ্ছে। রকি আবার বলল,
- মাংস টাংস বেশি নেই তোর, হাত দিয়ে ধরাই যায় না। খদ্দের ভাল পাবি না... অবশ্য কপাল ভাল থাকলে পাবি... বুড়ো বিহারি, মাড়োয়ারিদের খুশি করতে পারবি? মোটা টাকা দেবে কিন্তু...
পুঁটি বলল,
- পারব ।
রকি দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল,
- অত সোজা না, তোর কিন্তু কিছুই সুখ হবে না। জোয়ান ছেলের সাথে তবু কিছু সুখ পেতিস, এখানে কিন্তু সবটাই ঘাটার খাতায়।
- বললাম তো, তুমি দাও, আমি পারব।
- ঠিক আছে, এই ওষুধটা দু'মাস খেয়ে আয়। গায়ে একটু মাংস হবে, তাছাড়া দাপাদাপি করার জোর পাবি, নে...
পুঁটির হাতে দুটো ওষুধের পাতা ধরাল রকি। পুঁটি বলল,
- কিছু টাকা দেবে?
- স্লা! খসানোর দাম চাওয়া হচ্চে আবার... এরকম ফ্রী তে আরও দিতে হবে, তৈরি থাক, মোবাইল দেখে ভাল জিনিস শিখে নে, নইলে ব্যবসা চৌপাট হবে। আমি আর কত বলে দেব... নে যা এবার...
- দাম চাইছি না, ধার চাইছি। ঘরে চাল নেই, তেল নেই, মায়ের ওষুধ নেই, দাও, কাজ শুরু হলে শোধ করে দেব। নইলে তুমি কেটে রেখো।
- স্লা! শুধু নেই নেই নেই! এতদিন করচিলিস কী! যাও, আরও ফ্রিতে ঝোপ নাড়াও গিয়ে ওই মুকেশের সাথে... ভা-লো-বা-সা! ঝোপে গিয়ে ভালোবাসা শেখাচ্চে! কত দেখলাম ওরম বালুবাসা! তোদের আবার ভালোবাসা! ওয়াক থুঃ! স্লা!... মেয়ে মরদে তবু ভালবাসা হয়, তোরা হলি শুধু মাল...
পুঁটি আশ্চর্য হয়ে শুনল। আওড়ালো,
- মা-ল!
এ কথাটা পুঁটি এর আগেও পট্টিতে বহুবার শুনেছে। ছেলে ছোকরারা মেয়েদেরও মাল বলে ডাকে, বিশেষত সুন্দরী মেয়েদের। পট্টির নতুন মেয়েগুলো এই 'মাল' নামে ডাক শুনলে যেন গলে পড়ে, চোখমুখ দিয়ে জেল্লা বেরোয় ওদের। তাই মাল শব্দটা যেন অজান্তেই একটা গর্বের শব্দ বলে মনে হত পুঁটির। মাল মানে এমন কিছু যার দাম আছে। নিজের নামের সাথে মাল শব্দ শুনলে পুঁটিরও নিজেকে দামি মনে হত। কিন্তু আজ রকির কাছ থেকে একটা অন্য প্রসঙ্গে সেই মাল কথাটির পুনরাবৃত্তি যেন নতুন কিছুর সাথে পরিচয় করাচ্ছে পুঁটিকে। রকির কাছে মাল হল এমন কিছু যার প্রাণ নেই, জড় পদার্থ, যাকে যেমন খুশি ব্যবহার করা যায়, তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় অন্ধকারে। তাই এই মালদের জীবনে ভালোবাসা আসে না, কোনও গোপন কুঠুরিতে তালাবন্ধ হয়ে দম আটকে সে মরে। এই মালের ধারণার সাথে পট্টির মেয়েগুলোর মালের ধারণা কত আলাদা, মনে হল পুঁটির। একই শব্দ, অথচ নারী-পুরুষ ভেদে, কাজের ধরন, চেনাজানা, শক্তির মাপে শব্দের মানে নিমেষে দিন-রাতের মতো বদলে গেল। পুঁটির মনে অন্ধকারের ছায়া গাঢ় হল।
গালাগালি দিয়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট ছুঁড়ে রকি বলল,
- মনে রাখিস।
মাস দুয়েক পরে পুঁটি চোরবাগানের এক অবাঙালি বাড়িতে গিয়ে উঠেছে, রকি নিয়ে গেছে। ততদিনে পুঁটির গায়ে গতরে একটু মাংস লেগেছে, রকির সাঙ্গপাঙ্গর সাথে বিস্তর মহড়া চলেছে। রকি বলল,
- ঘাঘরা চুনরি পড়তে পারবি তো?
- সে কী! আবার মেয়ে সাজতে হবে নাকি? এই যে বললে ছেলে শরীরেই কাজ চলবে...!
- সে চলবে... কিন্তু ওই প্রথমটুকু লাগবে। আর একটু হেলেদুলে হাঁটিস...
- সেই তো একই হয়ে গেল...
- না এক নয়, ওসব তুই বুঝবি না... যাক, আর একটা নাম লাগবে... মমমম... লহরণ...
- এ আবার কেমন নাম? তার চেয়ে বরং মাধুরী দীক্ষিতের নামে রাখি?
- ও নাম কুড়ি বছর আগে চলত, আর মাধুরীর নাম রাখলে কেমন পুজো পুজো মত লাগবে... এটাই ঠিক আছে...
- হিন্দি নামই লাগবে?
রকি একটা চোখ মেরে বলল,
- হ্যাঁ, লাইনে সব খদ্দেরই হিন্দি নামে এক গেলাস জল বেশি খায় । সেই গানটা শুনিসনি, লহরা কে বলখা কে... তারপর কী যেন... আগ লগাকে... কে যেন একটা নেচেছিল...
- কিন্তু পুরোপুরি হিন্দি যে আমি পারি না।
- যা পারবি তা-ই বলবি, ওতেই হবে। আরে কলকাতায় থেকে লোকে কী আর বাংলা বোঝে না! এসব হল ঢঙ , এসব কাজে একটু রঙ ঢঙ মির্চ-মসালা লাগে। বাংলা যে জানে পেয়ারের সময় সে বলবে হিন্দি, আর হিন্দি যে জানে সে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলবে, নইলে নষ্টামিটা খোলতাই হবে না, আসর জমবে না, মুড হবে না। লাইনে থাক, সব শিখে যাবি। মায়ের পেটের ভাষায় এসব করতে লোকের একটু ইয়ে ইয়ে লাগে, বেজাতের ভাষা বলে তখন এরা সব অন্য লোকে বনে যায়।
- কিন্তু নামটা যেন কেমন, ঠিক মানুষের নাম বলে মনে হচ্ছে না...
- সেটাই তো চাই... নামেই একটা আলাদা আলাদা ব্যাপার লাগবে, তোরা তো আলাদাই! ওসব করিনা ক্যাটরিনা ছুকরিদের নাম হয়। জিগোলো হিসেবে যখন ছিলাম তখন এই রকি নামটা দিয়েছিল আমায়। রকি, রাজ, রাহুল, জিৎ, জন এসব নাম শুনেই মেয়েরা বৌদিরা শুলশুল করে উঠত। এখন ভাব লাইনে সুপ্রিয়, সৌম্য এসব নাম রাখলে কীরম শোনাত! হিহিহি। তোর নাম এটাই ঠিক আছে।
- একটু ভেবেচিন্তে নাম রাখলে হত না?
- ধুর বাঁ, অত ভাববি কী রে, এ লাইনে অত ভাবনা নেই। নাম এভাবেই ঠিক হয়। পরে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পাল্টে নিস।
লহর মানে ঢেউ। পুঁটি কীসের ঢেউ কে জানে! পুঁটিকে দেখে রকির এ নামই বা কেন মনে এল তাও পুঁটি জানে না। কী জানি! ছেলে মেয়ের মাঝে বিচিত্র এই চাওয়া পাওয়াকে রকির কোনও ঢেউ মনে হয়েছে কিনা! পুঁটির মনে পড়ল যে ওর নিজের একটা ভাল নাম আছে, ইস্কুলে পড়তে সে নামে ডাকাডাকি হত। কিন্তু এখন দীর্ঘদিন সে নামে যেন কেউ ডাকে না। নামটা যেন হারিয়েই যাচ্ছে, এখন আবার এই নতুন একটা নামের পাল্লায় পড়ে সে নাম একেবারেই বেপাত্তা না হয়ে যায়!
লহরণের লহরা চলল একের পর এক। ভাবসাব বদলেছে তার, অবাঙালি পাড়ায় বেশ কদর। মন্টুর ভাড়ার টাকা মিটিয়ে, বস্তির গলির ঘরটা ছেড়ে বড় রাস্তায় একটা দু-কামরার ঘর নিয়েছে পুঁটি। রাতে কাজ, দিনের বেলাটা নিরিবিলি ঘুমোতে হয় তাকে । পাঁচ বছর কেটে গেছে, পুঁটির বয়স এখন কুড়ি। তার মা এখন বেশ সুস্থ। ভাইটা স্কুলে পড়ে, মাধ্যমিক দেবে। রকি যেমন বলেছিল, লহরণ নামেই সে খদ্দেরদের বাজারে পরিচিত।
একদিন খদ্দেরের বাড়ি থেকে রাতে চুপিচুপি বেরোনোর সময় পুঁটিকে দেখে ফেলে তার বছর পঁচিশের নাতি সুজল। সুজল হাত ধরে পুঁটিকে নিজের ঘরে নিয়ে এল। বলল,
- দাদুকে ছেড়ে দাও...
- সরি, এসব কথা আমি আপনার সাথে আলোচনা করতে পারব না।
- এসব কী তুমি টাকার জন্য করো? নাকি ভালোলাগে?
- কার ভালোলাগে এসব করতে? এ তো আমার কাজ...
- আচ্ছা, ধরো যদি আমি তোমায় অন্য কোনও কাজের ব্যবস্থা করে দিই।
পুঁটি হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সুজল অবাক হয়ে দেখল পুঁটির চোখমুখ বদলে গেছে, সুজলের কাছে ধরা পড়ার প্রাথমিক অস্বস্তিটুকু তার আর নেই , হাসি থামতেই সুজল জিজ্ঞেস করল,
- এভাবে হাসলে কেন?
পুঁটি তার কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে কোমর বেঁকিয়ে শরীরে একটা ঢেউ তুলে পাশের চেয়ারে বসে পড়ে বলল,
- তোমায় ব্যঙ্গ করলাম, এটুকু বুঝলে না সুজল বা-বু...!
- কেন করলে?
পুঁটি সুজলের গায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল,
- তোমার মুখটাও এত সরল যে তাতে বলতেও পারছি না আমার সাথে শোয়ার জন্য এত দরদের কথা বলছ! টাকা দেবে তো? নাকি ফ্রীতেই...?
- কী সব যা তা বলছ! একটা ভাল কথা বললাম, সহ্য হল না, এই যে বলছিলে এসব করতে ভালোলাগে না তোমার...!
পুঁটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
- ভালো তো লাগেই না... কিন্তু আদর করার চোখেমুখে কত খদ্দেরদের কাছ থেকে এই একই কথা শুনেছি... অন্য কাজ করো, আমি ব্যবস্থা করে দেব... তারা কেন এ কথা বলত জানি না, কিছুটা হয়তো আবার জানিও। আজ আবার তুমিও বললে। তুমি কি ভেবেছ আমি নিজে চেষ্টা করে দেখিনি? প্রতি মূহুর্তে বাজে কথা শুনেছি। দেখেছি, লোকে যত না কাজটা চায়, তার থেকে কাজের জায়গায় প্যাঁচটা বেশি চায়, ছেলেদের প্যাঁচ, মেয়েদের প্যাঁচ, তার মাঝে আমাদের মত ছেলেদের জায়গা হয় না। অত সোজা নয়, মেয়েদের আলাদা কাজ আছে, ছেলেদের আছে পেশি ফোলানো কাজ। আমাদের যে কোন জায়গায় ফেলবে তা নিয়ে মালিকের নিজের ধারণাই স্পষ্ট হয় না। তারপরে একসময় বের করে দেয়, মালিকের গলার কাঁটা আমি। না পারি ছেলে হয়ে উঠতে, না পারি গা থেকে মেয়ের গন্ধ মুছতে। তুমি কাজ দেবে বলছ ! এই বন্ধ ঘর থেকে একগাদা লোকের সামনে অর্ধেক ছেলে অর্ধেক মেয়ে হিসেবে আমায় দাঁড় করাতে তোমার লাগবে না? তোমার দোকানের খদ্দেররা মেনে নেবে তো?
সুজল একটা ঢোক গিলে বলল,
- তুমি কি সত্যিই চাও কাজ করতে? চেষ্টা করতে?
সুজলের চোখের দিকে তাকিয়ে পুঁটি নির্বাক হয়ে গেল, ঘরটাকে মায়াবী মনে হল তার।
সুজলের কাপড়ের ব্যবসায় পুঁটি যোগ দিয়েছে অনেকদিন হল। লহরণ নাম ব্যবহার করার প্রয়োজন এখন আর তার পড়ে না। সুজলের দোকানে পুঁটির টিকে যাওয়া একদিনে সম্ভব হয়নি। কিছুটা পুঁটি এগিয়েছে, কিছুটা সুজল চেষ্টা করেছে। আর এই করতে গিয়ে ওদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এই কাজের পেছনে সুজলের ভয় ছিল, পুঁটির মেয়েলি স্বভাব ছাড়াও যাতে পুঁটির অতীতের কাজের কথা সকলের সামনে না চলে আসে। এমনিতেই এমন মেয়েলি ভাবের ছেলেদের পেছনে লোকে নানান অছিলায় লেগে মজা পায়। তারপর যদি তারা জানতে পারে পুঁটি যৌনব্যবসার সাথে জড়িত ছিল তাহলে প্রত্যক্ষ কুপ্রস্তাবের আগমন একেবারে অভাবনীয় হবে না। সুজল সতর্ক ছিল যাতে বাড়ির লোকেদের সাথে পুঁটির আর যোগাযোগ না হয়, পুঁটিও এ ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রেখেছিল। সুজলের দায় ছিল নিজের দাদুর এই গোপন কীর্তির বিনাশ ঘটানোর। কিন্তু পুঁটি সরে গেলেও যে নতুন কেউ সে জায়গায় আসবে না তার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। তবু সুজল চেষ্টা করেছিল। আর এই নতুন চেষ্টার বিভিন্ন মোড়ে পুঁটির সাথে সুজলের সম্পর্ক ঘন হল। পুঁটি একদিন হেসে বলল,
- লোকে যে এবার বলবে, দাদু ছেড়ে নাতিকে ধরলাম, তখন?
- লোকে বলুক, তুমি নিজেও কি তাই বল?
সুজলের মুখের ভদ্র ভাবসাব এতদিনেও পুঁটি বিশ্বাস করেনি। খুব কাঁচা বয়সে তার মনটা চটকে গেছে। হৃৎপিন্ড থেকে সব রক্ত বেরিয়ে গেছে যেন। কতরকমের লোক দেখল এই বছর কুড়ি বয়সে পুঁটি , শুধু কী লোক! টাকা দেখল, টাকা সামলালো। মা- ভাইকে সামলালো। কুড়িতে বুড়ি কথাটা আসলে মনে হয় রূপ নিয়ে নয়, মস্তিষ্কের পরিণতি নিয়ে। তা-ই হয়েছে পুঁটির, সন্দেহ দানা বাঁধে শুধু মনে, লোক দেখলেই সন্দেহ। যে লাইনে ছিল সে সেখানে শুধু শরীর পেলেই লোকেরা শান্ত হয় না, শরীরের পিছু নেয় শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছে। লম্পট লোকগুলোর মনে যেন অনন্তকাল দাসপ্রথা জিয়িয়ে রাখার ইচ্ছে। এই সুখ, ক্ষমতা ও শোষণের হাতছানিতে কার যে পা পিছলেছে, আর হাতের নিয়ন্ত্রণ অবাধ গতিহীন হয়ে পড়েছে তা বোঝা বড় মুশকিল। তাই সকলকেই সন্দেহ হয় পুঁটির। টোপ ফেলে পুঁটি,
- তোমার কি আমার কাছে ওসব কিছু চাহিদা নেই?
- আছে।
- তবে তো সে কথাই সত্যি হল!
- কোন কথা?
- সেই যে বলেছিলাম, সরল মুখের আড়ালে কামনার ভাব লুকিয়ে আছে সন্দেহ হয়...
- আবার সেসব কথা...
- কী বলব তবে? কামের কথাই তো বললে...
- কীসের কথা বললাম, সে তো সময়ে বলবে... সময় এলে বুঝবে ঠিক...
পুঁটি যে একেবারে অবুঝ তা মোটেই নয়। তার বেড়ার ঘরের ফুটো করা জানলার বাইরে পাঁচিল উঠেছিল একদিন, কিন্তু স্বপ্ন তো সে ঘরে শুয়েও দেখত পুঁটি, সে রোগ ছাড়েনি ।
রকি একদিন রাস্তায় ধরল ওকে,
- ভদ্দর লোক সেজেছিস। এদিকে আবার লুকিয়ে আমার খদ্দের টানিস?
পুঁটি অবাক হয়ে গেল। ভাবল এসব রকির কোনও নতুন কুমতলব হবে, রকি আবার বলল,
- হাতে মাল নেই, সব দীঘা গেছে, পিক সিজন। তুই আজ রাতটা চালিয়ে দে তো, অ্যাডভান্স নিয়ে রেখেছি।
পুঁটি বলল,
- আমি ওসব ছেড়ে দিয়েছি...
- আবার মিথ্যে কথা? তোর নামে তাহলে বাজার গরম করছে কে?
- আমার নাম? মানে?
- লহরণ... ভুলে গেলি? নামটা তো আমিই দিয়েছিলাম...
পুঁটির গা শিরশির করল, এ নাম কতদিন শোনেনি সে, এ কটা দিনেই সে নাম যেন পাতালে চলে গেছে। অপছন্দের জিনিস লোকে কত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। বলল,
- মনে আছে, কিন্তু এ কাজ আমি এখন করি না...
- আবার ঝুট!
- ঝুট নয়, সত্যি...
রকি নিজের শুকনো থুতনিটা একটু চুলকে নিল। রকি জানে আজই লহরণের একজনের সাথে বসার কথা আছে। হাতেনাতে ধরবে তখন। রকি রেগে গেল প্রথমে, আজ রাতের জন্য আটকে গেছে সে, কাজটা করে দিল না পুঁটি। বলল,
- পুরোনো কথা ভুলে গেলি রে... আজকের রাতটা আমায় টেনে দিতে পারতিস, একসময় তোকে তৈরি করেছি আমি...
- কাজ করলে করে দিতাম। এসব অনেকদিন ছেড়েছি বিশ্বাস করো। সেই সময়ে তুমি আমায় সাহায্য করেছ সে কথা মনে আছে।
রকির যেন কেমন সন্দেহ হল। রকি আর কথা বাড়াল না। শুধু বলল,
- তোর ফোন নম্বরটা দে, কাছে থাকুক...
জামাকাপড়ের নকশার জন্য পুঁটিকে একটা নতুন কোর্সে ভর্তি হতে হবে। লোন নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের একটা বুটিক চালু করবে পুঁটি। মা, ভাইকে নিয়ে ও পাড়া থেকে উঠে আসবে ভাল পাড়ায়। সুজলের সাথে আলাপ যেন পুঁটিকে নতুন জীবনীশক্তি জুগিয়েছে। পট্টির সেই ঘিঞ্জি ঘরের পাঁচ-ছ বছর আগেকার কথা যখন মনে পড়ে তখন এই নতুন সব কিছু যেন স্বপ্নের মত মনে হয়। ভাগ্যিস সুজল সেদিন চেষ্টা করার কথা বলেছিল, পুঁটি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। সুজলের স্বপ্নালু চোখের দিকে তাকিয়ে পুঁটি বলল,
- তোমার ভয় করে না?
- কীসের?
- এই যে আমার সাথে মেশো?
- তোমার ভয় করে?... এই যে আমার সাথে মেশো...!
- না, আমার কেন করবে?
- তাহলে আমারই বা কেন করবে? তুমি আমার দিকে ঠিক করে কোনওদিন দেখনি মনে হয়। নইলে তোমার মতই একটা অংশ আমার মধ্যে খুঁজে পাবে...
- দেখেছি, তবু তুমি আমার মত নও, আলাদা। আমাকে লোকে এই মেয়েলি হাবভাব দিয়েই আলাদা করে চেনে।
- সে চিনুক। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আর এতে তোমারও কিছু যায় আসে না...
- যায় আসে...
- সে কেমন?
- এই যে লোকজনের নজরে কেমন যেন প্রথমেই একটা আলাদা হয়ে যাই, সেটাতে যায় আসে। ভালোর আলাদা হয়ে যাওয়া যায় আসে না, এটা খারাপের আলাদা হয়ে যাওয়া, লোকের কাছে যে সেটা অস্বস্তির তা টের পাই। আর সেটাই আমাকেও অস্বস্তিতে রাখে... আচ্ছা, তোমার দাদুকে নিয়েও তো তুমি অস্বস্তিতে থাকো, তাই না?
সুজলদের বাড়ি থেকে বেরোনোর পর, আর ও বাড়িমুখো হয়নি পুঁটি। ওদের এতদিনের বন্ধুত্বে একবারও এ প্রসঙ্গ উঠে আসেনি। পুঁটি সতর্ক ছিল। আজ একটা অন্য খেয়াল চেপে বসেছে পুঁটির মাথায়।
- দাদুর সাথে এটা নিয়ে কখনও কথা হয়েছে তোমার?
- না, বলিনি, অস্বস্তি হয়। খুব বিদঘুটে লাগে।
সুজলের মুখটার দিকে তাকাল পুঁটি। তাকাত না হয়তো, কিন্তু বিদঘুটে লাগে কথাটা এমনভাবে সুজলের মুখ থেকে বেরিয়ে এল যে তাকাতেই হল। বস্তিতে ওদের পাশের খোলে অনাদির দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল খুব, মরো মরো অবস্থা, মাথাটাও গেছিল বোধহয়। অসুস্থতায় চৌকির মধ্যে বসে বসেই পোঁদ খুঁচে গু আনত সেই বৃদ্ধ। অনাদি ঠিক এইরকম ঘেন্নার চোখেই দেখত ওর দাদুকে। যে দাদু এককালে কোলে পিঠে মানুষ করেছে, যার চওড়া হাতের তালুতে গ্রীষ্ম ও শীতে ঘানির সর্ষের তেল মেখেছে অনাদি। সেই দাদুর অসুস্থতা কেউ নিল না, কেউ নেয় না। পাপ, অসুস্থতা কেউ নেয় না। লোকে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে। যেমন করে ওর দাদুর পাপটা দূর থেকে দেখেছে সুজল, কাছে যায়নি, দুটো কথা বলেনি। শুধু যেদিন একবছরের বিল্টু অনাদির কোলে হেগে দিল, বাচ্চাটা দুইহাতে গু মেখেছে, মুখে দিতে গেছে, সেইদিন অনাদি বলেছিল, বুড়ো হলে মানুষ বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক, তখন তার যত্ন লাগে, তখন মনে তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মাথার একেবারে ভেতরে কিছু জোরালো স্মৃতি থেকে যায়, সেগুলো উঠে আসে শুধু। বাকি সব গুরুত্বহীন মনে হয়। পুঁটি ভেবেছিল বলবে এসব , এ বয়সে লোকে কতটা আর যৌনতায় মেতে ওঠে, সামনে থাকা ল্যাংটো শরীর জুলজুলে চোখের তারায় কতটুক বা ধরা দেয়! এসব কী শুধুই বিকৃতি! একটা বয়স্ক মানুষের কামনা বাসনার কথা শুনলে হয় হাসি পায় নয় ঘেন্না ! মজা, টিটকিরি আর ভীমরতি। বয়স্ক মানে কি ক্লীব ? এতদিনের প্রাণ, এতোদিনের অভ্যেস আর সকলের নির্বাসনে এত বৃথাই আড়াল হয়ে যাবে? এ প্রাণের ধর্ম নয়। বলল না এত, ভাবল গুছিয়ে বলা কি যাবে ! শুধু বলল,
- কিন্তু দেখো, দাদুও একটা সময় আমাদের মতো বয়সের ছিল। হয়তো সে সময়ে তার একটা ছেলেবন্ধু ছিল, আমাদের যেমন থাকে।
সুজল যেন নেতিয়ে পড়েছে,
- ছিল হয়তো। কিন্তু এখন সেটা দৃষ্টিকটু, এত সংসার করার পর, উফ্! আমি এসব আবার ভাবতে পারছি না...
- জানি, কষ্ট হয়। পরিস্থিতি মানুষকে রাক্ষস বানায়। অথবা যাকে আমরা রাক্ষস হিসেবে দেখছি, ব্যাপারটা তেমন নয়। আমাদের ভাবনার ভুল...
- ভাবনার ভুল! কী বলছ তুমি !
- তোমার দাদু হয়তো এইরকম সংসার চায়-ই নি। এ তো আর আজকের কথা নয়। কত পুরোনো সেসব দিন বলো!
- কিন্তু দাদু সঙ্গী হিসেবে বেছেছিল তোমায়, তোমাদের বয়সের পার্থক্যটা দেখো! এটা লালসা নয়?
- লালসার চোখমুখ দেখেছি আমি। অনেক ছোট থেকে লোকের খিদে মিটিয়েছি। এমনও তো হতে পারে যে উনি একটা বয়সে আটকে গিয়েছিলেন কোথাও! এখন সেসবের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে...
সুজল অবাক হয়ে বলে উঠল,
- তুমি কি দার্শনিক নাকি?
- কী বললে?
দার্শনিক শব্দটি আগেও শুনেছে পুঁটি। লালবাতির বস্তিতে, শবনমের ঘরে। শবনম লালবাতির অনেকের থেকে আলাদা ছিল, মুজরা করত, মেহফিল সাজাত। ঠুমরি, গজল, আবার খেয়ালও গাইত। লখনউতে ছিল একসময়, কোঠায় কী একটা খুনের কেসে গা ঢাকা দিয়ে কলকাতায় আসে। সেই তদন্ত থেকে রেহাই পেলেও আর সে যায়নি লখনউ। তার কাছে এক বাবু আসত, সে শবনমকে ছুঁয়েও দেখত না। শবনমের গজল আর সাজানো পান, এই ছিল তার আয়েশ। পট্টীর বাকি কিছু মেয়েরা এসব দেখে হাসত। বলত, ছলা কলা কি আমরা শুধু টাকার জন্য করি নাকি? শুধু গান গেয়ে আমেজ হয় না, বেশ্যাপাড়ায় ধার্মিক লোকের বাস শুরু হলে পাততাড়ি গোটাতে হবে। নখরাই আমাদের মূলধন, সে ভুলে গেলে চলবে না ।
খুব তোড়জোড় করে সেই ভদ্রবাবুকে দেখতে গিয়েছিল পুঁটি, তখন সে ব্যবসায় নেমে পড়েছে। এ আবার কেমন বাবু! ধামসায় না, চড় চাপাটি গালাগালি নেই, ছুঁয়ে দেখে না, মদ খায় না, শুধু পান চিবোয় আর গান শোনে! পুঁটির মনে হল, এমন বাবু বাঁধাধরা থাকলে বেশ হবে। গান না হয় শবনমের কাছ থেকে শিখে নেওয়া যাবে। শেখাবে না শবনম? প্রথম প্রথম এইসব ভাবনা ছিল ওর মনে। অনেকেই একটা সবসময়ের বাবু পায়, পেটে সেই বাবুর বাচ্চা নেয় অনেকে, প্রতি মাসে ধরা টাকা। এর একটা নিশ্চয়তা আছে। অন্তত এটুকু পেলেও...
শবনমের দুয়ারে যে মাসিটা পাহারায় থাকে তাকে গিয়ে বলল পুঁটি,
- আজ আসেনি তোমাদের সেই ধার্মিক লোক?
- সে আবার কে?
- ওই তো যে শুধু পান চিবোয় আর গান শোনে...
- কেন? তাকে দিয়ে কী কাজ?
- না, একটু দেখতাম...
- দূর সে ধার্মিক কোথায়! কোনোদিন একটু ঠাকুর দেবতা নমস্কার করতে দেখলাম না। একদিন গিয়েছিলাম ঠাকুরের প্রসাদ দিতে, হাতটুকু মাথায় ঠেকানো দূরের কথা, ছুঁয়েও দেখল না। বিশু তো বলে সে এক মহা দার্শনিক লোক। জীবনের বিচিত্র সব খবর নাকি তার ঝুলিতে । আমি বলি পাগল, বুঝেছ! পাগল। কত পাগল দেখলাম এ পাড়ায়। খালি ছোঁকছোঁক আর এদিকে বেড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোব না, কাশী যাব, হুহ! ... আসবে, যাও উপরে যাও, দূর থেকে দেখো। রস ভেঙো না আবার, নইলে বিবিজান আবার গোসা হবেন।
দূর থেকেই দেখেছিল পুঁটি, দুদিন পরে শবনমের কোঠায় গজল শিখতে গিয়েছিল সে । আশমানি কাফতান পরে একটা তানপুরার সামনে বসে শবনম শুরু করেছিল পুঁটির সঙ্গীতের পাঠ,
- দর্দ। গানা তো দিল সে গায়া যাতা হ্যয়, গলে সে নহি। অর দিল মে দর্দ হোনা চাহিয়ে, তভি আয়েগি সুর মে জান...
তারপরের হিন্দি উর্দু বাংলা মিশ্রিত কথায় পুঁটি যেন এক জানালা আকাশ দেখতে পেয়েছিল সেদিন। জিন্দেগি আর ফলসফার নতুন নতুন কথা সঙ্গীতে ভর করে শবনমের আশমানি কাফতানে একটা গোটা আকাশ নামিয়ে এনেছিল । দার্শনিক! সে কি সেই মখমলে বসে বালিশে হেলান দিয়ে পান চিবোনো দর্শক শ্রোতা লোকটি, নাকি লালবাতির এই শবনম?
আজ আবার সেই শব্দই সুজলের মুখে ফুটে উঠল। বঞ্চনার সাথে লড়াই করতে করতে জীবনের কুণ্ডলীকৃত গতিপথ মানুষকে এমন করে তোলে, তখন উল্টোদিকের লোকগুলোর কাছে যেন আকারে ইঙ্গিতে একটা দার্শনিক ধরা দেয়, এরা তাদের ধার্মিক বলে, ভাবে ধার্মিক লোকেরা নীতিপরায়ণ হয়, দরদী হয়। কী আছে এই দার্শনিকদের মধ্যে? কই পট্টির বাকি ছেলেমেয়েরাও তো কম লড়াই করে না ! দারিদ্র্য, দুর্ভাগ্য, অবিচার, রোগজ্বালা। ওদেরকে কি কেউ কখনও দার্শনিক হতে দেখেছে, অন্তত কোনো এক বিচ্ছিন্ন সময়ে? বলেছে কেউ? এই এতদিন ধরে একসাথে থেকে সুজলকেই কি তার কম দার্শনিক মনে হয়!
সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে পুঁটির ফোন বেজে উঠল, অন্যপ্রান্তে রকির হাসি যেন থামছে না। পুঁটি আশ্চর্য হয়ে উল্টোদিকের কথার অপেক্ষা করছে। অট্টহাসি থামার পর রকি বলল,
- অ্যাই পুঁটি, দ্যাক কী কাণ্ডি! লহরণ কে আজ ধরেছি রে, তোর নাম ভাঙিয়ে আমার খদ্দের খাচ্ছিল, সাথে মোটা টাকা...
পুঁটি বিরক্ত হয়ে বলল,
- তোমায় সেদিন বলেছিলাম, আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি, বিশ্বাস করলে না। এখন দেখলে তো! আর আমাকে ফোন কোরো না।
রকি আবার একটা অট্টহাসি শুরু করার আগে বলল,
- আরে ফোন রাখিস না এক্ষুনি, শোন রে, তোকে তো আসতেই হবে। তোর ছেড়ে দেওয়া খোলসে তোর ভাই শুরু করেছে রে... হাহাহা, নতুন লহরণ!
পুঁটি ফোনটা কান থেকে নামিয়েছে দেখে সুজল বলল,
- শোনো, একটা খবর আছে, তুমি মনে হয় মাধ্যমিকটা দিতে পারবে। আমাদের পাড়ায় যে হাইস্কুলটা আছে তাতে একটা মুক্ত বিদ্যালয় আছে, আমি কথা বলেছি। কাল যাবে একবার? এরপর তাহলে ভাল জায়গা থেকে ডিপ্লোমা কোর্স করতে পারবে। আর যদি চাও তো আরও পড়তেও পারো। আজকাল তো লোকে কত দেরি করে পড়াশুনো শেষ করে...
পুঁটির চোখমুখ ম্রিয়মান। মুহূর্তের মধ্যে যেন তার এতদিন ধরে তৈরি করা জয়ের সামান্য রসদটুকু কেড়ে নিয়েছে রকির কথাগুলো। চোখের সামনে সেই কবেকার গুচ্ছ গুচ্ছ ছবি অনেক ভাবনার তরঙ্গের মধ্যে ভেসে উঠছে। তাতে কী নেই!... মা, ভাই, বস্তির ঘুটঘুটে ঘর, সাদা হলুদ প্লাস্টিকের পটে করে নিত্যদিন বয়ে আনা খাবার জল, ফাঁকা রেলস্টেশন, গঙ্গার ভাঙা ঘাট, এসি ঘরে গিয়ে রকির সামনে জামা প্যান্ট খুলে দাঁড়ানো, মুকেশের চুম্বন , শবনমের গান , সুজলের দোকান । ভাইকে ফিরিয়ে আনতে হবে, এ কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার মনে । সুজল বলল,
- কী হয়েছে?
- কিছু না।
- তাহলে কাল যাবে স্কুলটায়?
- হ্যাঁ। কখন?
শত শত ঝড় ঝাপটার মধ্যেও একটা সঙ্গী লাগে। সেই চিরকালের বন্ধু মানুষ হতে পারে, ঈশ্বর হতে পারে, বিদ্যাপাঠ হতে পারে, আর যাদের কিছু নেই নিঃসঙ্গতাই তাদের সঙ্গী। এই নিঃসঙ্গ অবস্থান শূন্য নয়। এ নিজের উপর বিশ্বাস, ধারাবাহিক আস্থা অর্জন, কখনও একটা আঘাত। অন্য অনেক সাধারণ মানুষের মতো পুঁটি এইরকম সমস্ত কিছুর মধ্যে অবিরাম দুলে চলে।