ঘরের ভিতরের ছিটকিনি জোরে ঠ্যালা দিতেই একরাশ বাতাস
আকুলি বিকুলি করে বেড়িয়ে এলো
আটকে থাকা বাতাস নাকি খবর দিতে চাওয়া?
তখন কত বেলা? কার ফোনে এলো কালোগাড়ি?
এতক্ষণে তো ওর ক্যান্টিনে চা খাবার কথা ছিল
তারপরে ডায়নামিক্সের ক্লাস
পশ্চিমদিকের দেওয়ালে লাগানো সূর্যগ্রহণের পোস্টারের একদিক ঝুলে আছে। ঘোরের মধ্যে থাকা বাতাস একটানে খুলে দেয় পূর্ণ গ্রহণের উপরের ভাগ। নীল রঙের উপর কালো লাল অক্ষর ভেসে ওঠে, ক্রমশঃ ফুটে ওঠে বাক্য একে একে, জেগে ওঠে পংক্তিমালা।
ঠান্ডা পায়ের কাছে ডায়নামিক্সের খাতার পাতাগুলি ফড়ফড় শব্দে জানিয়ে দেয় তাকে স্পর্শ করেছিল নিশ্চুপ হাত গতরাতে
সেই হাতের আঙুল লিখেছিল গ্রহণের আড়ালে – ‘আরেকটি রাত বেঁচে থাকা যাক’। নিরন্তর। অনেক বিনিদ্র জাগরণে।
কালোগাড়ির ওরা খুলে নেয় পূবের দেওয়ালের বিবর্ণ শচীন-কে। তার তলা থেকেও বেরিয়ে আসে অন্য আঙুল লিপ্ত শব্দের সমাহার।
একটি তারিখ, ‘আজও চিঠি এলো না’, ‘মেসের ডিউ’, ‘মেসের ডিউ’, ‘রাতের গঙ্গার জল এত ঠান্ডা কেন?’, ‘গত রাতে বিছানায় চাঁদ এসেছিল’, অন্য আরেক তারিখ, ‘থার্ড বেঞ্চ থেকে দেখা যায়’, ‘শরীর পেতে আছি ভোর ধরব বলে’, ‘জোছনা কি রঙ পালটে দেয়? – চাদরের, আঙুলের নখের’?, ‘মাছ খাওয়া ছেড়ে দেব ভাবছি’, ‘কাল চন্দনের গন্ধ লাগিয়েছিল কেউ, অবশ হয়ে নূপুরের শব্দ শুনছিলাম’, ‘তুই তো পাশের ঘরেই, দেওয়াল কি সবই আটকে দেয়?’
কালোগাড়ির লোক অবাক হয়ে সব দ্যাখে আর ছবি তোলে – ঘর জুড়ে শুধু ক্ষণিকের শব্দ এক দেওয়াল থেকে অন্য দেওয়ালে অবছা হয়ে যায়।
এক সময় সরে যায় বিবর্ণ আর মরচে ধরা সেই কোণের আলমারিটা। তার পিছন থেকে মুক্তি উঁকি মারে – কারা যেন লিখে রেখেছে সারিবদ্ধ পিঁপড়ে। দিনের বেলাতেও সেই কোণে আলো জ্বাললে দেখা যায় এক সময়ের চেনা অতিথিদের রাতের (খুব সম্ভবত) কিছু সময় -
“গতকাল ধর্মতলায় তরমুজ খেতে খেতে তোমার লাল পুঁতির দুলটা খুব মনে পড়ছিল – আচ্ছা পুঁতি কি ঠান্ডা হয় পাথরের মত? কোন দিন ছুঁয়ে দেখতে পাব?”
“রোল সতেরো যখন সকালে গামছা পরে বাথরুম যায়, আমি দাঁড়িয়ে থাকি ওর মসৃণ পা দুটো দেখবো বলে। ও যদি জানতে পারে কতবার ওর শুকাতে দেওয়া গামছায় মুখ মুছেছি, তাহলে কি খুব রাগ করবে?”
“আমার কোন উত্তেজনা জাগে না – বিছানায় নগ্ন মেয়ে শুয়ে আছে, তার পাশে আরেকজন - স্থির। আলো নিভিয়ে ভাঁজ করে দিই তাদের – এই অন্ধকারেই না হয় ওরা একে অপরের গায়ের উত্তাপে চুমুক দিক”
“ওরা পাশের ঘরে দল বেঁধে গান গায়, গাঁজা খায় মাঝে মাঝে। আমাকে ডাকে গলা মেলাতে ওদের সাথে – যাওয়া হয় না। আসলে কিছুই মেলাতে পারি না - প্রতিবাদের গান, মুক্তির গান, প্রেমের গান। সবাই যেন কিছু শোনাতে বসেছে, বলতে বসেছে কিছু। আমি অপেক্ষায় থাকি কিছু না বলার – শুধুই দেখতে চাই চাঁদ পা থেকে ছোঁয়া শুরু করে ঠোঁটের কাছে যখন আসবে, ঠিক তখনই কি হবে ভোর?”
“লাইব্রেরী যেতে ইচ্ছে করে না। যদিও জানি ওখানেই রোমের স্পর্শ পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে প্রবল। একদিনই শুধু পিছনের টেবিলে বসে দেখেছিলাম – ছেড়ে রাখা খাদিমের চপ্পলে কয়েকটা শুকনো বকুল লেগে আছে”।
“রোজ ভোরে ভিজে কাপড়ে যে সামনের বাড়িতে ঢুকে যায়, সে কি ধুয়ে আসে? গত রাতের গ্লানি? শরীরে জমে থাকে অপরের শরীরপাত? ভাবতে ইচ্ছে করে নির্জনে কাপড় সরালে এখনো পদ্মের গন্ধ পাওয়া যায়”।
“এ এক অসম্ভব গল্প – যেখানে ডায়নামিক্সের ক্লাসের শেষ নেই। আমি তবুও অবুঝ টানে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে বসি”।
কালো গাড়ির লোকেরা আরো ছবি তোলে – ভুরু কুঁচকে থাকে। এ কার গল্প? ঘরের? অতিথির? নাকি ক্লান্ত অবশ আঙুলের?
ঠান্ডা পা দুটি দরজা দিয়ে বের হয় প্রথমে – রোল সতেরো অবাক হয়ে দেখে মুখে ব্রাশ নিয়ে। আজও তার পা মসৃণ। বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যায় আরেকটি রাত বেঁচে না থাকতে চাওয়া ছেলেটি, কালোগাড়ির লোকেদের সাথে।