দাগের ওপর দিয়ে সাইকেল চলে গিয়েছিল না ওটা সাইকেলের দাগ। সাইকেলের দাগ মানে চাকার দাগ যাকে সাইকেলের দাগ বলে। সেটা দেখে বোঝা গেল দুই চাকা আছে সাইকেলের। ওই দাগের আসপাশে কুকুরের দাগও দেখা যায় তবে সেটা বেশ কিছু কিন্তু অনেক কুকুর কি এসেছিল? সে রকম তো কথা নয়। তিনটে কুকুর আছে যারা এলাকাটা ডমিনেট করছে তারা ছাড়া কে সে আসতে পারে নরম সিমেন্টের ওপর দিয়ে দিয়ে। এই সদ্য সিমেন্টের একটা চিলতে বানানো হল। বানানোর আগে সুকুমার খোঁজ নিতে লাগল-
— আজ গাড়ি বার করবে না তো?
— না, তুমি সিমেন্ট লাগাও।
— লাগাবো?
— হ্যাঁ। চিপস্ আছে দেখে নাও। চিপস দিয়ে লাগাও।
— আধ বস্তা সিমেন্ট বেঁচে গেছে তবে ডেলা ডেলা হয়ে গিয়েছিল। কাজে লেগে যাবে।
— লাগাও। পাটা মেরে দিও। বড্ড কাদা ওঠে গাড়ি চেপে উঠলে। নোংরা হয়। চাকায় লেগে থাকে।
এরপর কথা শুরু হতে গিয়ে দাগের ওপর দিয়ে আবার চলাচল করল। সুকুমারকে পাটা মারতে দেখা যায়। সব ঠিকঠাক থাকে। খালি পাটার আওয়াজ হয় ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ থ্যাস। আর কোদালের আওয়াজ হয় খ্যারর খ্যারর। কর্নিকের আওয়াজ থ্যাস থ্যাস থুপুস। সব আওয়াজ থেমে গেলে নিঃশব্দ হয়। চারদিক নিঃশব্দ না হলেও একটুখানি জায়গা যেখানে কাজকাম হচ্ছিল নিঃশব্দ হয়ে পড়ল তারপর সেটা হয়ে উঠল এমন এক নরম সরম জায়গা যেখানে খুব শিগ্গির শক্তপোক্ত এক আস্তরণ গড়ে উঠবে। সে রোদ আসুক আর না আসুক। দিনের শেষে বা রাতের শুরু আস্তে আস্তে নরম সরম জায়গার সিমেন্ট জমাট হয়ে যাবে। সেখানে তখন দাগের সম্ভবনা তৈরি করতে তিনটে কুকুর ঘোরাফেরা করতে করতে নানান দাগ সত্যিই তৈরি করছিল। সে সব ঘুরে ঘুরে নরম জায়গার আসপাশে তৈরি করা দাগেরা। একটা একটু গভীরে গিয়ে কুকুরের থাবার আস্ত আদল বানিয়েছে। মনে হচ্ছে ওটা তার লাফের জন্যই হয়েছে। নরম জায়গায় দাঁড়িয়ে সে যখন লাফ মারবে বলে ঠিক করে তখন একটা পাঁচিল থাকতেই হয় না হলে লাফ হবে কী করে? লাফ দিয়ে পাঁচিল ডিঙতে গেলে পাঁচিলকে ততটা উঁচু হলেই বা চলবে কী করে? মনে হচ্ছে কুকুরটা লাফ মেরে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়ে আছে তো আছেই কারণ তার আর ফেরার কোন পায়ের চিহ্ন নেই। সে কুকুর ফেরেনি তো ফেরেনি তা বলে অন্য দাগেরা কী করে মুছে যাবে তারাও আলাদা আলাদা কুকুরের পা যাকে থাবা বলে তার প্রমাণ হয়ে আছে। নদীর ওপর থেকে সে তাকিয়ে ছিল। সোঁতার ওপরে। জঙ্গলে নদী থাকে না অথচ স্রোত থাকে সেই থেকে সোঁতা তৈরি হয় সেখানে বাঘের থাবা আসে। তার দাগ রেখে যায় বাঘ। কখন রেখে যায় এ আবিষ্কার কবেই হয়েছে কিন্তু কিছুতেই বাঘ কখন দেখা যায় বোঝা যায় নি। কুকুরেরা লভ্য তারা ফেলা খাবার খায়। কোন খাবার খাবে মানুষ ঠিক করেছে আর কুকুর তার পরের খাবার খাচ্ছে যাকে উচ্ছিষ্ট বলে নাম দিয়েছে। অথচ কুকুর সব কিছু খায় না। অনেক কিছু অখাবার খেয়ে ফেললে তার বমি পায়। নরম আস্তরণ জমাট বাঁধার আগে যে গভীর দাগ পাতা রয়ে গেল সে কেবল বমি করার জন্য কি? সে কি অখাবার কিছু খেয়ে ফেলেছিল ফলে তার বমি পেয়ে ওইরূপ গভীর যাবার দাগ তৈরি করে দিল।
ঠিক তখনই সেখান দিয়ে যাচ্ছিল বাচ্ছু। সে ছোটবেলায় ইংরিজি ইস্কুলে পড়েছিল- পড়তে পারে নি। সে তারপর বাংলা ইস্কুলে পড়েছিল- পড়তে পারে নি। সে তারপর ঘুরেছে, ফিরেছে, বাড়ি ফিরে গেছে - ঘুরতে পারে নি। কেন পারে নি এই অসম্ভব ভাবতে ভাবতে এখন সে সাইকেল চালায়। সে এখন সাইকেল চালাতে পারে নি এ অসম্ভব কারণ সে সাইকেলই চালাচ্ছে আর বাড়ি বাড়ি পুজো করতে যাচ্ছে। সে মন্তর পড়তে পারে নি তবু লোকে তাকে রোজ ডাকছে। তাদের পুজো করতে হবে, সে সব তারা অভ্যাসবশত করছে। এই বাড়ির সামনে বাচ্ছু এক নরম আস্তরণ বানানো হচ্ছে সিমেন্ট দিয়ে। দেখে সে দাঁড়ালো।
— বাচচচচচচচচউউউউউ…..
— কী?
— কোথায় যাচ্ছিস?
— জান না?
— না।
— পুজো করব।
— কটা বাড়ি পুজো করবি?
— পাঁচটা ছটা।
— পাঁচটা না ছটা?
— কী জানি।
— মনে করতে পারিস না?
— পারি।
— কই পারিস?
— পারি।
— কটায় আসবি?
— কোথায়?
— এখানে। নারায়ন পুজো করবি না?
— নারায়ন শিলা বল।
— কোথায় বলছ। ঠাকুরের নাম ঠিকঠাক বলবে।
— আচ্ছা। তুই ঠিকঠাক ঢুকবি। দেখছিস না সিমেন্টয়ের রাস্তা হচ্ছে।
— দেখছি।
— তার ওপর দিয়ে সাইকেল চালাবি?
— চালাব না তো কী।
— বাচচচচচচচচউউউউউ…..
— ইয়ারকি মারবে না।
— কেন? তুই যে নরম ঢালাইয়ের ওপর দিয়ে চালাবি?
— পুজো করতে ঢুকব।
— না।
— শুনব না তোমার কথা।
— বাচচচচচচচচউউউউউ…..
— শুনব না তোমার কথা।
— ঘুরে ঢুকবি।
বাচ্ছু সাইকেল চালাতে চালাতে চলে গেল। সেকি সাইকেল চালাতে পারে? নাকি তাকে চলে যেতে দেখা যাবে। সে রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে সাইকেল চালাতে চালাতে চলে গেল। তার চলে যাওয়া দেখা যায়। তার চলে যাওয়া চোখে পড়ে বলে তখন বোঝা যায় সে সাইকেল করে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। আর সন্ধে ঘনাতে থাকে, তাড়াতাড়ি সন্ধে ঘনায়। তখন নানারূপ শাঁখের আওয়াজ হল। ঘন্টা ধ্বনি হল।গন্ধ হল। গন্ধ চলে গেল আর কিছু হয়ত রেখে যাচ্ছে দেখা গেলো -গন্ধ। সুন্দর গন্ধ আর বদ গন্ধরা রয়ে যাচ্ছে। সুকুমার বেশ কিছুক্ষণ আগে কাজ শেষ করেছে। তার পাটা মারার আওয়াজ। কর্নিকের আওয়াজ। কোদালের ঘষটানি সে রেখে গেছে সিমেন্টের নরম আচ্ছাদনের ওপর।
— জায়গাটা ঘিরলে পারতে।
— তুমি গাড়ি বার করবে না তো?
— না।
— ও কিছু হবে না।
— কুকুরগুলো জ্বালাবে।
— রাত হয়ে এলে কুকুর আসবে তখন জমে যাবে।
— দাগ হবে না তো?
নদীর ওপারে যাবে বলে সুকুমার এখন জেটিঘাট ধরেছে। সে তার লোকজন নিয়ে নদী পার হবে। যাবার আগে অবশ্যই পারাপারের খরচ নিয়েছে। এখন সন্ধে ঘনাচ্ছে। আর কুকুরেরা, তিনটে কুকুর ,যারা এলাকা ডমিনেট করে, তারা দাগ রাখার জন্য ঘিরে ঘিরে ধরছে নরম জায়গাটা। তারা থাবার দাগ রেখে গেল। তা কখনও গভীর হয়েছে কখনও হাল্কা। আর সব কিছু জ্বল জ্বল করছে এই সন্ধেয়, তার পরের সন্ধেয়, তার পরের সন্ধেয়। রাত আসার আগেই সন্ধেরা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে কারণ শীতকাল। ঘন্টা ধ্বনি হচ্ছে, শাঁখেরা নিজেরা নিজেরা অভ্যাসে বেজে বেজে উঠছে। বাচ্ছু একটার পর একটা বাড়ি যাচ্ছে। মন্ত্র পড়তে পারছে না — পুজো করছে। পুজো করতে পারছে না তবু অভ্যাসবশত লোকে তাকে পুজো করতে দিচ্ছে। ঘরে ঘরে শীতের সন্ধেয় এইরূপ হচ্ছে। ফলত আর রাত্রি হতেই চাইছে না। রাত্রি না হলে, সময় না কাটলে, সিমেন্টের নরম আস্তরণ শক্ত হবে কী করে? কিছুতেই সময় কাটছে না, শীতকাল বলে সন্ধে পার হয়ে রাতের দিকে এগোন চলছে না কিছুতেই। সন্ধেবেলার মধ্যে বাচ্ছু ফিরছে। তার চারপাশে সন্ধে ঘিরে রয়েছে। চলার পথের সবরকমের আওয়াজ সে নিয়ে এসেছে। কেমন এক আবছায়া সন্ধেবেলা হয়ত কিছু দেখতে দেয় না, শুনতে দেয় না। এবার সে নারায়ন শিলা পুজো করতে ঢুকবে। পুজো করতে পারবে কি?
পরদিন সন্ধেবেলা একই রকম করে ঘন জমাট হয়েছিল। একটুও কুয়াশা হয় নি। হিম হাওয়া দিচ্ছিল সকাল থেকে। সন্ধেবেলা সে হাওয়া থেমে গিয়েছিল। দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কুকুরের দাগ। সাইকেলের দাগ। সাইকেলের দাগ মানে তার চাকার দাগ। বাচ্ছু নারায়ন শিলা পুজো করতে ঢুকছিল ঘুর পথে।
— বাচ্ছুবাচচচচচচচউউউউউ …..
— ঘুরে যাচ্ছি।
— কাল গিয়েছিলি?
— দেখতে পাইনি।
— বলেছিলাম না?
— মনে ছিল না।
— কেন?
— পুজো করতে করতে ভুলে গেছিলাম।
— ভুলে গেছিলি?
— হ্যাঁ ।
— দুটো দাগ হল কী করে?
— দুটো চাকার দুটো দাগ।
— হয়?
বাঘ নদী পাড় দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল। নদীর ওপর থেকে সে তাকিয়েছিল। পাহাড়ী জঙ্গলে নদী হয় না স্রোত হয় যাকে সোঁতা বলে। বাঘ হাঁটলে দুপায়ে হাঁটছে বলে মনে হয় থাবার ওপর থাবা পড়ে বলে? সোঁতার ওপর যে কালভার্ট আছে তার নীচে জলের ধারে বালির ওপর সে দেখছিল থাবার ছাপ যা নানান দেখার কৌশল অবিষ্কার হল অনেক কিন্তু বাঘটি অদৃশ্যই থেকে গেছে। কেউ জানে না কখন তাকে দেখা যাবে আর যখন যাবেই তখন থাবার দাগ দেখার কথা কারুর মনেই ছিল না। বাচ্ছুকে দেখে কিন্তু সাইকেলের দাগ বেশ মনে ধরছে সেটা কেবল বালিতে না হয়ে সিমেন্টে যুত করে জমেছে বলে?
— বাচ্ছু, বাচচচচচচচচউউউউউ…..
— কী?
— হয় নাকি?
— কী হয়?
— দুই চাকার।
— সাইকেলের?
— না তো কী।
— কার?
— কার আবার।
— কার? — তোর, তোর।
— কী! আমার? — হ্যাঁ রে বাবা, তোর।
— আমার হবে কী করে?
— জানিস না?
— না। মাইরি বলছি।
— তাই আরকি!
— মাইরি বলছি।
— বালুলে বালুলে সোনাটা। আবার মাইরি বলেছে।
— কী বলবে তো?
— বলব?
— কিসের কথা? বলবে তো?
— বলছি।
— বলো না। বলো না।
— আলাদা, আলাদা।
— কী?
— দু-দুটো।
— কী?
— দাগ।
বাচ্ছু কথা বলবে না। সে সিমেন্টের চাকার দাগের দিকে তাকাবে। বেশ কদিন আগে হয়েছে। সিমেন্ট কাঁচা ছিল বলে দাগ রয়ে গেছে। সেই সময়টা রয়ে গেছে। রয়ে যাচ্ছে। অনবরত রয়েই যাচ্ছে সময়টা অথচ কিছুতেই দাগ মুছবে না বলে ঠিক করেছে। দুটো দাগ। সাইকেল গেলে পড়বেই দাগ তাই বিকেল থেকে সন্ধের আলোয় এখন মিটমিট করে জ্বলছে। তারাদের আলোরা তাদের ওপর পড়ব পড়ব করছিল। বাচ্ছু ঘুর পথে ঢুকতে ঢুকতে পুজো করতে যাচ্ছে অভ্যাসবশত।