বর জিনিস তো ভালো। সবাই ভালোইবাসে। তা বলে কি সর্বসময় পিছনে চিপকে থাকা ভালো!
এই পর্যন্ত বলে কনক ছিপ করে পানের পিক ফেললো পুঁইলতার পাশটিতে।
মলিনা নতুন কেনা মাটিতে পুঁই লাগিয়েছে। কুমড়ো লাগিয়েছে। শীতের কালে ফুলকপি, বাঁধাকপি। সূর্যমুখী লঙ্কার গাছ আছে খান-কয়। সজনে গাছ। বাঁদরে খেয়ে যাওয়া সজনে পাতা দেখতে দেখতে কালো দড়ি দিয়ে আঁট করে চুল বাঁধছিল মলিনা। এবার রান্না করতে বসবে। রাঁধার সময় চুল খোলা রাখা মোটে পছন্দ নয় তার। উড়ে উড়ে চুল পড়ে। এখনো মাথা ভর্তি কুচকুচে কালো কোঁকড়া চুল তার। ছেলে উচ্চ-মাধ্যমিক দেবে। মেয়ে সেভেন।
কিছুটি রাখা যাচ্ছে না। পুঁইপাতাও সাবড়ে খেয়ে যাচ্ছে বাঁদরে। উৎপাত করে জ্বালিয়ে খাবে বলে মলিনা পেঁপে গাছ লাগায়নি জমিতে। বাঁদরে পেঁপে পাতা খেতে বড় ভালোবাসে।
ভালোবাসার কথা বলতে বরের কথা মনে এল মলিনার। বেগুনভর্তা বানাতে হবে তার জন্য। রুটি আর বেগুনভর্তা মুখের সামনে ধরে দিলেই খুশি লোকটা। চুল বাঁধা শেষ করে সে কাঁচের প্লেটে দুটো বড় নিমকি আর রসগোল্লা এনে ধরলো কনকের সামনে। এইবছর একটা ফ্রিজ কিনে ফেলতেই হবে। বাঁদর ঘরে কোনও জিনিস রাখতে দেয় না। বিস্কুটের টিন খুলে বিস্কুট খায়। তায় আবার টিভি দেখতে দেখতে। মলিনা বাঁদরকে চ্যবনপ্রাশের শিশি খুলে আঙুল ঢুকিয়ে চ্যবনপ্রাশ খেতেও দেখেছে। আবার প্যাঁচ ঘুরিয়ে কৌটোর মুখ বন্ধ করতেও জানে। হুবহু ছোটভাশুর। বর আর ছোটভাশুর পাশাপাশি খেতে বসত। বাঁহাতে চ্যবনপ্রাশের কৌটো ধরে ডানহাতের আঙুল দিয়ে চ্যবনপ্রাশ তোলার সময় ছোটভাশুরের মুখ হাঁ হয়ে থাকত। ওয়াক আসত দেখে মলিনার। কোনওদিন সে চ্যবনপ্রাশ মুখে তোলেনি এই বাড়িতে।
সেই ছোটভাশুর একদিন দুম করে মরে গেল। কথা নেই, বার্তা নেই, ভালোমানুষ, বাজার থেকে ফিরে বলল, মলিনা আটার পরোটা আর আলু চচ্চড়ি করো দেখি। একটু ঝাল করে কোরো। নিজে হাতে বাজার করে পুঁইমেটুলি আনল। দুপুরে ভাতের সঙ্গে আলু, বেগুন, কুচো চিংড়ি আর পুঁইমেটুলির চচ্চড়ি খাবে। এইসব বলে কয়েক সে মানুষ কলঘরে গেল গামছা নিয়ে। গেল তো গেল সেই গেল। আর বেরোল না। মলিনা আটা মেখে ময়ান দিয়ে পরোটা বেলেছে কি না বেলেছে, ছোটভাশুর মাথা ঘুরে পড়ে কলঘরেই মরে গেল। মরা মাছের মত থির হয়ে রইল চোখের দৃষ্টি। আর তারপর থেকে মলিনার বর আরও বেশি করে মলিনার কোলঘেঁষা হয়ে গেল। বড় বেশি শান্ত, রা না-কাড়া লোকটা। এত বেশি ভালোমানুষ নিয়ে সংসারে সমাজে চলা বড় মুশকিল।
সুযোগ পেয়ে কনক সেই কথাই ঠারেঠোরে শুনিয়ে দিল মলিনাকে।
মলিনার একটু রাগ হল। থোড়ি তার বর চিপকে থাকে তার সঙ্গে। তবে হ্যাঁ। পাড়ার আর সব বাড়ির মতো তার বাড়িতে অশান্তি নেই কোনো। স্বামী স্ত্রীতে সদ্ভাব আছে, লোকটা মোদো মাতাল না, সাত চড়ে মুখে কথা বলে না। মুশকিল এই, যে লোকটা কাজকর্মের তেমন নয়। একটা রাস্তা পার হতে দশবার ভাবে। ছোটভাশুর যতদিন বেঁচেছিল, দাদার হাত ধরেই চলেছে লোকটা। সে মরার পরে ছোটজা ভিন্ন হয়ে গেল। দেখা গেল দোকানে ছোট ভাইয়ের কোন শেয়ার নেই। অথচ দোকানঘর কেনার সময় মলিনার যাবতীয় গয়নাগাটি, বরের টাকা সবই দু-হাত পেতে নিয়েছিল ভাশুরঠাকুর। সেই দোকান নিয়ে, নিজের ছেলেপুলে নিয়ে ভিন্ন হয়ে গেল ছোট জা। মলিনার বরের তাতেও কোনো হেলদোল হল না। এই যে এতবড়ো সব্বোনাশটা করে গেছে ছোটভাশুর, কোনও অভিযোগ নেই তা নিয়ে। অন্য কোনও পুরুষমানুষ হলে মামলা মোকদ্দমা করে তুলকালাম করে দিত। মলিনার বর কমল কিছুই বলল না। মলিনা বলল, তাহলে আমি লোকের বাড়ি কাজ ধরি। বর বলল, ধরো।
কনকের কথায় রাগতে গিয়েও রাগল না মলিনা। অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে, রাগ করে লাভ নেই। আপনজনের ওপরেই রাগ করে লাভ নেই, পর তো পর।
কনক যুত করে বসে নিমকি খাচ্ছে। বলল, মিষ্টিটা তুলে নে মলিনা। মলিনা চুল বাঁধা শেষ করে মিষ্টি তুলে রাখল। আজকাল কেউ মিষ্টি খেতে চায় না। তার ছেলেমেয়েও চায় না।
পেঁয়াজ তুলে নিল ছোট ছোট কয়েকটা। কুচি করে কাটতে কাটতে কনকের দিকে না তাকিয়েই বলল, চিপকে থাকবে কেন গো? মানুষটা ভালো, এ তো তোমরাও চোখের সামনে দেখতেই পাও। রাগ ঝাল নেই, নেশা ভাঙ নেই, মুখে গালমন্দ নেই।
কনকের একটা শ্বাস পড়ল। তার বর নেশা ভাঙ-ও করে, রাগ যেন দুব্বাসা আর মারধোর লেগেই আছে। একথাও পাড়াতে সবাই জানে। ঢেকে চেপে লাভ নেই। অবশ্য তাতে লজ্জার আছেই বা কী! ভালোবেসে বলেই মারে!
মলিনার বর কমল যে ছেলে ভালো, তা কনক দিব্য জানে।
মলিনার তাই নিয়ে একটু গর্ব আছে বৈকি। কাজে কর্মে হয়তো তেমন দড় নয়, কিন্ত একেবারে মাটির মানুষ। মা দেখেশুনে একটা পাত্তর যোগাড় করেছিল বটে। সম্বন্ধ এনেছিল গরু কাকা। গরুর দালাল সুখেন। মলিনার তখন মোটে আঠেরো। গরু কেনাবেচা চলত ভিতরের মাঠে। সুখেন মল্লিক গরুর দালালি করতে করতে বিয়ের ঘটকালি করে ফেলেছিল।
মলিনার মা নয়নতারা মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিল তখন। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ দিয়েছে মলিনা তখন। দেখতে শুনতে বেশ বড়োসড়ো। মুখখানা বোঁচাপানা হলেও বয়সের লাবণ্য আছে। গরু কাকা কমলের কথা পেড়েছিল। ভদ্র ঘর। কামাই তেমন নেই। তবে লোক ভালো। নয়নতারার তেমনি পছন্দ। গরিব হোক, ছেলে ভালো হতে হবে। পয়সা নাই তো কী, নয়নতারার পয়সা আছে। মেয়েকে যতটা পারে দেবে। তা দিয়েওছে। টাকা, সাইকেল, জমি, গরু। কমলের সঙ্গে মলিনার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে মলিনা দেখল, এবাড়ির মানুষজন সত্যি খুব ভালো। শুধু ঐ ছোট জা কি না একটু অন্যরকম। তা হোক। নিজেরটা একটু বেশি আর সংসারে কে না বোঝে। এ বাড়িতে নেশা নেই। মারধোর, ঝগড়াঝাটি নেই। এর চেয়ে ভালো মলিনা চায়নি। তবে পাড়ার বউঝি রা তাকে একটু কথা শোনায়, তাদের নিজেদের কপাল মন্দ কি না! বুদ্ধিমতী বলে মলিনা সেসব কথা এড়িয়ে যায়।
এই দুপুরের দিকটা পাড়ার মেয়েরা মলিনার উঠোনে এসে জড়ো হয়। পাশেই ভাশুরের মুদির দোকান। তিনটে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত মেয়েদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কেউ নাইটি। বেশির ভাগ শাড়ি। ন্যাতানো। অন্তর্বাসহীন ব্লাউজ। রঙিন শায়ার শেষভাগ দেখা যায় একচিলতে।
কনক দুটো ফ্রুটি নিতে এসেছিল নাতির জন্য। ছেলে ভালো, নাতি ভালো। ছেলের বউ ভালো না। এই হল কনকের বক্তব্য। আর বর? সে তো মানুষের মধ্যেই পড়ে না। কাজেই মলিনার বর ভাগ্যে চোখ টাটায় কনকের। সব রাগ, বিরক্তি, ঘেন্না পানের পিকের সঙ্গে থুক করে ফেলে।
কুচো চিংড়ির ঘন্ট বানাবে বলে মিষ্টি কুমড়ো সরু সরু ডুমো ডুমো করে কেটে নেয় মলিনা। কুচো চিংড়ি বেছে নুন হলুদ মাখিয়ে রেখেছে আগেই। তেলে পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা দিয়ে কুমড়ো ছেড়ে দেবে। কাজের বাড়ি ফেরত কুমড়োটা পেয়েছে সস্তায়। চিংড়িও। দুপুরের দিকে জিনিসের দাম সকালের অর্ধেক হয়ে যায়। নয়নতারার জন্য চিংড়ি কুমড়ো ঘন্ট করবে মলিনা। বরের জন্য ভর্তা রুটি। সুগার ধরেছে বলে ভাত ছেড়েছে কমল। ছেলে মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে ম্যাগি খাবে। বিকেলে কাজের বাড়ি যাবার পথে মাকে ঘন্ট দিয়ে যাবে সে। এই যে সে নিজের মাকে এতকিছু করে, এই জন্য কখনো কিছু বলেনা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আর বলবেই বা কেন। নয়নতারা কিছু কম করে নাকি এবাড়ির জন্য!
বাছুরটা জন্মানোর পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে নয়নতারা। গোয়ালে গিয়েছিল গরু কে সুরকা খাওয়াতে। সদ্য মা হওয়া গরুর গোবর পিছলা হয়। নয়নতারার পা পিছলে গেছিল গোবরে। সেই পড়ার পর থেকেই শরীর দুবলা হয়েছে মায়ের। দাদার বউ দুই বাচ্চার মা। অত সেবাটেবা করতে পারে না। কাজের বাড়ি যাতায়াতের পথে মলিনাই টেনে দেয় যতটা পারে। গরুদুটি বাছুর বিয়োনোর পরে দুধ দিচ্ছে প্রচুর। ছানা হচ্ছে অনেকটা করে। নয়নতারার হাঁটাহাঁটি বন্ধ। ছানা বিক্রি করবে কে? মলিনার দাদা সারাদিন টোটো চালায়। দাদার বৌ এসবের ধারেকাছে নেই। দুই বেটি নিয়ে নিজের ঘরে ব্যস্ত টিভি খুলে। মলিনাকে গতি করতে হবে অতখানি ছানার।
খুব টেনশন। ছেলের কোচিং-এ এগারো হাজার টাকা জমা করতে হবে কাল। নয়নতারার কাছে চাওয়ার প্রশ্ন নেই এখন। তার নিজের কাছে আছে ছয় হাজার। বাকি পাঁচ আসবে কোত্থেকে! মশলা বাটাতে বাটতে মলিনা ভাবতে শুরু করেছে ছানা বিক্রির কথা।
শিলনোড়া টেনে নিয়ে ধনে বাটা শুরু করতে করতে দেখল, তার কাছে বিশেষ সাড়া শব্দ না পেয়ে কনক উঠি উঠি করছে। মলিনার এই এক বুদ্ধি করে। কথাবার্তা পছন্দ না হলে মুখে কিছু বলে না। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মশলা কষতে শুরু করলে মাইক বেজে উঠল। গান শুরু হল আবার।
কনক আলগোছে হাই তুলে বলল, যাই। ঐ ওদের শুরু হল আবার। আজ চাঁদ দেখা যাবে।
ওদের মানে সামনে মুসলমানপাড়া। ইদ এসে গেল। ছেলেপিলে নতুন জামা পরে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিয়েছে।
ইদের সময় নূরবানুর প্রধানতম শখ হল চোখে সুর্মা পরা আর কানের পাশে, হাতের কবজিতে আতর লাগানো। তার পুরোনো কাঠের ড্রেসিংটেবিল, যা কি না অনেকটাই আধ ক্ষয়াটে আর জীর্ণ তাতে বেশ কিছু আতরের শিশি। ফুফির ছেলে সুলতান বিদেশ থেকেও এনে দিয়েছে দুচারটি শিশি। সেগুলো প্রাণে ধরে ব্যবহার করে না নূরবানু। শুধু এই ইদের সময় তাদের গন্ধ পাওয়া যায়। বয়স হয়েছে তার। কোমরে ব্যথা। হাঁটুতেও। ডাক্তার বলেছে হাঁটাচলা চলবে না বেশি। অল্পবয়সের তুখোড় সুন্দরী নূরবানু তাই রান্নাঘরে দিনযাপন করে। খাসির রেজালা। চালের রুটি। হালুয়া। আনারসাগোল্লা। নতুন শাড়ি শাড়ির মতো পরে থাকল। ছেলেপুলেদের সুন্নতের ব্যবস্থা করে দই দিয়ে মাংস মেখে রেখেছিল নূরবানু। তার হাত এখনও তুলতুলে নরম। এই হাতে কী অপূর্ব মেহেন্দি খচিত হত যৌবন কালে তার। বরটি তো মেহেন্দি পরা হাত দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল! এখন অমন সুন্দর করে মেহেন্দির ডিজাইন আঁকতে পারে না কেউ। সে ছিল আলতা বিবি। এক একজনকে এক একরকম মেহেন্দির ডিজাইন পরাতো ইদের সময়। এখন ছুঁড়িগুলো কী মেশিন দিয়ে মেহেন্দি পরায়, সব একরকম। মন ওঠে না নূরবানুর।তাই সে মন দিয়ে রান্না করে। ছাতে এখনো পাঁচিল দেওয়া হয়ে ওঠেনি। নূরবানুকেই খেয়াল রাখতে হয় বাড়ির বাচ্চাকাচ্চা খোলা ছাতে উঠে গেল কি না। ছেলের বউরা তো সাজনগোজন নিয়ে ব্যস্ত। তাও যদি বয়সকালের নূরবানুর মত রূপ থাকত এদের! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূরবানু ঘন দুধ দিয়ে, দুই চামচ চিনি ঢেলে এক কাপ চা বানায় নিজের জন্য। আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিয়ে মাংস নেড়ে দেখে কতখানি মজল। তার ছেলে বৌরা আজকাল কেউ দুধ চিনি দিয়ে চা খায় না। দুধ চা খেলে নাকি অ্যাসিড হবে। বড় নাতি তো আবার রাত জেগে পড়বে বলে কালো কফি খায়। নূরবানু ঐ দুধচিনি ছাড়া চা, কফি ছুঁয়েও দেখে না।
প্রতিবছর রোজা দশদিন এগিয়ে আসে। ইদগাহের মাঠ সেজে উঠছে। নূরবানুর তাতে আর কীই বা আসে যায়। মাংসের জন্য কেনা মশলা মরলেও ব্যবহার করবে না সে। কামিলাকে ডেকে বললো, বড় শিলনোড়া বার করে দে। কামিলা তালে ছিল মিক্সিতে মশলা বাটার। নূরবানুর সুর্মা পরা চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জো নেই। মিক্সিতে বাটা মশলায় রান্না আর নোড়াতে বাটা রান্নায় আকাশপাতাল তফাত। পরবের দিনে সেটি হতে দেবে না নূরবানু।
জাকাতের পালা উঠে গেছে এ বাড়ি থেকে কর্তা দেহ রাখার পরেই। এখন শুধুই ফিতরা। নূরবানুর বড় শখ করে আবার আগের মত জাঁকজমকের জাকাত দেয়। তা আর হয়ে ওঠে না। বলেই বা কোন মুখে ছেলেদের। মেয়েরা বিয়ে হয়ে দূরদেশে। বড়োছেলের মেয়েদের পড়ার খরচ চালাতেই হিমশিম। মেজোর ছেলেটার মাথা ভালো। ডাক্তারি পড়ানোর ইচ্ছা। ছোটোটার বাচ্চাগুলো ইংলিশ মিডিয়াম। অনেক টাকা ঢালতে হয়। জাকাতের টাকা জমে না আর। নূরবানুর নিজের কী-ই বা আছে।
এক কেজি ছয়শো পঞ্চাশ গ্রাম গম বা আটার বিক্রয়মূল্য বলে কথা। নূরবানুর বাড়িতে কাচ্চা বাচ্চা মিলিয়ে ষোলো জন। কামিলাকে ধরলে সতেরো। এক ফিতরার দাম পড়বে প্রায় সত্তর টাকা। তারপর নিজেদের কাপড়জামা খাওয়া দাওয়া আছে। নাহ। জাকাতের কথা আর ভাবা চলে না।
সে ছিল যখন তার বর ছিল বেঁচে। জাকাতের টাকা, নতুন কাপড় আলাদা করে রাখা থাকত। কাপড় দেখেশুনে কিনতো তার আম্মিজান। আহা, সে বড় ভালো দিন যখন ইদের তিন চাররকমের মাংস আসতো তাদের বাড়িতে। এমনকি হাঁসের মাংসও।
এখন আর আসে না। শুধু মাটন আর চিকেন। ছেলে বৌরা বেশি মাটন খেতে চায় না। বলে ফ্যাট হবে। মুরগির ঝোলের একটা আলাদা ডেক তাই ধরেই রাখা থাকে। এই ডেক বিশাল বড়। বাড়িতে আসা কোনও মেহমান না খেয়ে যাবে না। অন্তত সরু চালের ভাত, মুরগির ঝোল আর সেমাই খেয়েই যাবে তারা।
নূরবানু কামিলাকে মশলা বার করে দেন পেষার জন্য। কতজন আসবে কে জানে। তবে বানাতে হবে প্রচুর পরিমাণে।
ছোট নাতি দৌড়ে এল কাছে।মশল্লার গন্ধ নাকে গেছে। একটু টেস্ট করা চাই তার। এখনো তো তেলেই পড়েনি মশল্লা।
এসে বড় করে নাক টানলো সুলেমান। নতুন হলুদ জামায় টকটকে রঙ ফেটে পড়ছে।
সুলেমানের বয়স পাঁচ। টকটক করে কথা বলে।
নূরবানুর একটা পায়ের ওপর থপ করে বসে পড়ে বলল, "রাজাকে ডেকে আনি?"
নূরবানু চুপ করে বসে থাকল।
রাজা হিন্দু পাড়ার ছেলে। বামুনবাড়ির ছেলে। বাপের পোস্ট অফিসে চাকরি। সুলেমানের ক্লাসে পড়ে।
নূরবানু জানে।
রাজা কখনোই এ বাড়িতে খেতে আসবে না।
মুসলমান ছেলেপুলে দিব্যি দোলে দুর্গোৎসবে হিন্দু মহল্লাতে গিয়ে মালপোয়া, ঘুগনি, লুচি, তরকারি খেয়ে আসে। কিন্ত আশ্চর্যভাবে হিন্দুরা মুসলমান বাড়িতে খায় না। এই এক অনাদি অনন্ত নিয়ম চলে আসছে।
— তাহলে টুবাইদাদাকে ডাকি?
টুবাইদাদা মলিনাকাকির ছেলে। সুলেমান পুজো পার্বণে ঠিক মলিনাকাকির হাতের রান্না, মিষ্টি খেয়ে আসে। তাহলে টুবাইদাদারও তাদের বাড়িতে আসা উচিত মাংসের ঝোল ভাত খেতে। সুলেমানের হিসাব অতি সোজা সাপটা। মলিনাকাকির বাড়ি যেতে সে ভালোবাসে। গরু আছে। টুবাইদাদা আছে। দোলাদিদি আছে।
নূরবানুর মনে পড়ল। তাঁর কিশোরীবেলায় দাদার হিন্দু বন্ধুরা বাড়ি থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে এসে মুরগির মাংস খেয়ে যেত তাঁদের বাড়িতে। কিশোরী নূর তখন রূপের ছটা ছড়ায়। তার দিকে আড়চোখে তাকাতও হিন্দু ছেলেদের কেউ কেউ। কিন্ত ঐ তাকানো পর্যন্তই। টুবাইয়ের ছোট দাদুও আসতো। মলিনার ছোট খুড় শ্বশুর। দিব্যি হাট্টা কাট্টা জওয়ান ছেলে। নূরবানুর বেশ ভালোই লাগত তাকে। অসময়ে পটাশ করে মরে গেল লোকটা। তাকানোর ভঙ্গী ভারি ভালো ছিল তার।
সেইসব দিন আর নেই। এখন সব বাড়িতেই মুরগি ওঠে। ইদের মাংস খেতে হিন্দু ছেলেরা আসে না আর।
এই যে খাওয়া দাওয়া হবে দাওয়াতে, এত শালপাতার প্লেট ফেলা হবে কোথায়!
ডাস্টবিন উঠিয়ে সেখানে কৃষ্ণমন্দির বানানো হয়েছে ওয়ার্ডে। শালপাতা ফেলার গাড়ি রাখতে হচ্ছে আলাদা। সে গাড়ি সময়মতো আসবে তো?
নূরবানুর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। চোখে খুব ভালো দেখে না সে।ফোন ধরে জিজ্ঞেস করল, কে?
মলিনা নূরবানুকে কাকি বলে। নূরবানুর নাতি মলিনাকে কাকি বলে।
চেনা গলা। মলিনার গলা শুনলেই মন খুশি হয়ে যায় নূরবানুর। আহা! কমলের মতো ছেলে কটা হয়। নেহাতই রোজগারপাতি কম ছেলেটার। ভাগ্যিস মলিনা কমলের মতো বর পেয়েছে। নূরবানুর ইচ্ছে করে কমল আর মলিনাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াতে একদিন। কিন্ত তারা মুসলমান বাড়িতে খায় না।
— ছানা নিবা কাকি? দুটো গরু বাচ্চা দিয়েছে। হুড়হুড় করে দুধ দিচ্ছে খুব।
গরুকে খুব করে সুরকা খাওয়ানো হয়েছে। জলে ভেজানো কারি। তিসির খোল। সর্ষের খোল। লবণ জলে ভেজানো। কাটকুড়ার পাতা। এত দুধের ছানা এখন নেবে কে?
নূরবানুর ইদের দাওয়াতে এবার ছানার বড়ার ডালনা যোগ হল।
তিনরকম মাংসের পাশে একটা ছানার তরকারি থাকলে ভালো। মিষ্টিও বানানো যাবে। মোটামুটি দেড়শো মেহমান তো আসবেই।
দাওয়াত দিলে আসবে না কেউ। প্রতিবারের মতো এইবারেও চিনি আর লাচ্ছি যাবে হিন্দু পাড়াতে। ভাত ডাল যা ফেলা যাবে, হিন্দুদের গরু খাবে। নূরবানু জানে, হিন্দুরা নিজেরা খাবে না কেউ। ফেলে দেবে। নয় গরুকে দেবে। দিক। তবু পাঠানোর নিয়ম ফেলবে না নূরবানু।
বাঁদরটা লাফ দিয়ে সামনের গাছে এসে বসল। নূরবানু নাতিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ঐ পাড়া টহল দিয়ে এখন এদিকে এলো। নূরবানু কামিলাকে আঙুলের খোঁচা দিলেন। তরিতরকারি সব ঢেকে রাখুক। নাহলে ছোঁ মেরেই নিয়ে যাবে। খেজুর রাখা আছে গামলা ভর্তি। খেজুর খেতে ভারি ভালোবাসে বাঁদরগুলো।
তেল গরম হয়ে গেছে। মশলা কষাতে শুরু করলো নূরবানু। বাতাসে ভাসছে গোটা গরম মশলা আর তেজপাতার গন্ধ। সুলেমান ধৈর্য ধরে বসেই থাকল।
রাস্তার এপারে আর ওপারে। এ পাড়া আর ঐ পাড়া।
মলিনার কুমড়োর ঘন্টের গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে নূরবানুর মাংসের গন্ধ। বাতাসে সব মিশে যায়।
শুধু কেউ কারুর বাড়িতে খেতে যাচ্ছে না।