পুজো এসে গেল। অথচ গলিটা অন্ধকার।
চম্পার গালের পাশে কালো দাগ। সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো।
গলির মুখটা অন্ধকার। ভুসভুসে অন্ধকার নয়।
পুরনো ল্যাম্পপোস্টের নিচে ফ্যাকাসে আলোটা হালকা হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে। একটু একটু করে যেন মরে গেছে আধো অন্ধকার এবং তার পরে গাঢ় অন্ধকার।
গলির ঠিক অন্য মুখে দাঁড়িয়ে শিউলি ডাকল "চাম্পা , এই চাম্পা , এই চাম্পা। "
চম্পা শুনল না। শিউলি কিছুটা ব্যথিত হল।
ইদানীং তার হাই প্রেসার হয়েছে। অল্পেই মাথা গরম হয়ে যায়। অনেকদিন মাথা ঘষাও হয়নি। শিউলির এক মাথা চুল কালো চুল কালো অন্ধকারে মিশে যায়। তবে ভেতরে ভেতরে অনেক পেকেছে। শিউলি চুলে গার্নিয়ারের রং লাগায়। তবে সেই কালো আর এই গলির মুখের কালো এক নয়। চম্পা ঘাড় ফিরিয়ে এদিক ওদিক দেখল।
তারপর নর্দমার দিকে এক দৃষ্টে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল শিউলি খুব অবাক হচ্ছিল। সে ডাকবে আর চম্পা আসবে না এমন তো হয় না।
এ-ও কি তাহলে গিভ অ্যান্ড টেক সম্পর্ক হয়ে গেল নাকি!
চম্পার চোখ আশ্চর্যরকম কটা। ওর বাবা ছিল সাহেব। মা ফুলি। চম্পা সাহেবের মতো ফর্সা। এতো ফর্সাকে বলে ধবধবে। মোতি মাঝেমাঝেই মশকরা করে। চম্পার বাপ যে সাহেব তুই জানলি কেমন করে? ফুলি বলেছে কানে কানে?
শিউলি এসব ফক্কড়ি গায়ে মাখে না। দিনমান কাজের শেষে তার গায়ে গতরে টনটনে ব্যথা। আগে সে ছিপছিপে ছিল। ঋতু বন্ধ হওয়ার পর শরীরে মেদ হয়ে গেছে। চুল ঝরে গেছে অনেক। অবিনাশের জন্মের পরেও এতো চুল ঝরেনি তার।
অনেকক্ষণ ধরে জল ফোটায় শিউলি। চা পাতা। দুধ। চিনি। সব ফুটলে একটা আরামের গন্ধ পাওয়া যায়। পায়ের পাতা টনটনায়। কড়া হয়ে গেছে পা। ফাটা জায়গাগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে চায়ের ঘ্রাণ নেয়। এইসময়টা তার একেবারে নিজের। মোতি বা পার্বতী থাকতে পারে। রচনা থাকতে পারে। কিন্তু তারা যেন নিজের মনে কথা বলে যায়। শিউলি জবাব দিল কি না দিল, কিছুই এসে যায় না।
চম্পা আজ কিছুতেই সাড়া দিল না। ফুটন্ত চায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিউলি নিজের মনে হাসছিল। পঁয়তাল্লিশে শিউলিদের চামড়ায় মেচেতা পড়ে যায়। পুরু হয়ে যায়। কিছুতেই কিছু আসে যায় না। সাবওয়ে গেটের কাছে আধা বুড়ো লোকটা যে কনুইয়ের খোঁচা মারলো বুকে তাতেও যেন শিউলির কিছু এসে গেল না। আসলে তার শরীর এখন অনেকটাই পাথর হয়ে গেছে।
চায়ের গন্ধে, রাত আটটার পরে শিউলির শরীর , পাথর শরীর আবার গলতে শুরু করে। মোম মোম ঘাম গড়িয়ে পড়া শরীরে বালতি বালতি জল পড়েছে।
রাণীবালা। শিউলির গর্ভধারিণী মা। চুরানব্বই। এখনও হাঁটা চলা করে। শরীর নুয়ে গেছে বেতের মতো। সন্ধের পরেই শুয়ে পড়ে সে। ভেতর থেকে খুনখুন করে আওয়াজ দেয়।
"খালি পেটে চা খাসনা। "
রোজ এই এক ডায়ালগ। শিউলির বমি পায় শুনলে।
জানলাটা আধখোলা। বন্ধ একপাট কপাটের পাশে খট করে শব্দ হল। শিউলি তাকিয়ে দেখল চম্পা এসে বসরো।
রাণীবালা ভেতর থেকে বললো, চাম্পা এলো নাকি রে?
টিয়া পাশ ফিরে শুলো। হাঁটুর ওপর নাইটি উঠে গেছে। রান্নার জায়গা থেকে সব দেখা যায়। শিউলি মনে মনে বললো, নিলাজ মেয়েছেলে শালা।
মোতি ভেতরে গিয়েছিল বিস্কুট আনতে। তার শরীরেও নাইটি। দেড়শো টাকা দরে একসঙ্গে পাঁচ ছটা নাইটি কিনে রাখে ওরা।
ধপ করে বিস্কুটের কৌটো রেখে বসলো মোতি। আজ সহজে যাবে না।
তোমার ছেলে বউটা মাইরি কুড়িয়া আছে।
শিউলি মনে মনে মুখ বেঁকিয়ে বললো, সে আর বলতে!
টিয়া বাম নাকের নথটা চিকচিক করে উঠলো পাশ ফিরে শোওয়ার জন্য। তার মানে জেগে আছে। ভরসন্ধেবেলা কেই বা ঘুমায়!
মোতি বিস্কুট নিচ্ছে কৌটো খুলে। হলুদ দাঁতে কামড়ে নিচ্ছে মোটা নোনতা বিস্কুট। ফিচেল হাসলো।
"রাত জাগবে বলে ঘুমিয়ে নিচ্ছে !"
শিউলির মাথাটা দপদপ করে উঠলো।
ছেলেটা বৌয়ের কোল ধরা হয়ে গেল। অবশ্য একদিন অবিনাশ টিয়াকে পিটিয়েছিল। সকাল সাড়ে দশটার আগে বিছানা ছাড়ে না মহারানি। একবার কাৎ একবার চিৎ। বর উঠে যায়। শাশুড়ি। ঠাকমাশাশুড়ি। সবাই উঠে যায়। দুখানা খুপড়ির মধ্যে খনখন ঝনঝন বাসনের শব্দ। জলের আওয়াজ। ওটার নিজের বাচ্চার কান্না। মাগি তাও ওঠে না। শিউলি একটা নিঃশ্বাস চেপে চা ঢালে। মোতির সামনে মুখ খুলবে না।
অনলাইনে খাবার আসে চম্পার। চা ঢেলে চুমুক দেয় শিউলি। এবার চম্পাকে দেবে।
চম্পা ইদানীং হলো অনলাইনে আনা খাবার খেতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যদিও ভাত আলাদা করে রান্না করাই থাকে। মাছ থাকে। একটা চাল কুমড়ো বা লাউয়ের তরকারি তো রোজই প্রায় থাকে। কিন্তু অনলাইনের খাবারের গন্ধে চম্পার চোখ মুখ ছলবলিয়ে ওঠে। সে চিনে গেছে কৌটোর খাবারের গন্ধ।
বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে খপ করে একটা কামড় দেয় মোতি। শিউলি মোতির মুখের দিকে তাকায়। ভাবে বিস্কুটে কামড় দেবে কিনা।
ইচ্ছে করে না। শুধু চায়ে চুমুক দিয়ে যায় শিউলি।
ঘন চায়ের গন্ধে মাথাটা একটু হালকা লাগে। বৌদিও শুধু চা খায়। কিন্তু লিকার চা। পাতলা। শিউলিকে শিখিয়ে দিয়েছে। ফ্লেভার। এই শব্দটা শিউলি প্রথম বৌদির মুখেই শোনে। চায়ের ফ্লেভার ভালো হতে হবে। বৌদি বলে। শিউলি শোনে আর চম্পার কথা ভাবে।
টিয়া কি এখন উঠবে? মনে মনে আরো একবার টিয়াকে গাল দেয় শিউলি। এ শালা মেয়েছেলে না কুমড়ো? এত বেলা অব্দি পড়ে পড়ে ঘুমানো সন্ধে লাগিয়ে! অথচ টিয়াকে কিছু বলার সাহস নেই শিউলির। টিয়া তার নিজের বাপের জন্য ভাত রাঁধে। ভাতে আলু সেদ্ধ দেয়। পাতলা কাপড়ে মসুর ডাল সিদ্ধ করে। সেদ্ধ করে ডিম তারপরে কষকষে করে ডিমের ঝোল রাঁধে। গুনে গুনে চারটে ডিম। একটা টিয়ার। একটা অবিনাশের একটা টিয়ার বাপের, একটা গুটলুর। ভুলেও শিউলির জন্য কোন ডিম রান্না হয় না। টিয়া তো পরের মেয়ে। শিউলির পেটের ছেলে অবিনাশ সেও কিন্তু বলে না মা একটা ডিম খাও। বৌদি বরং বলে। একটা ডিম খা শিউলি। বৌদির অবশ্য স্বার্থ আছে। শিউলির শরীর গতর ভাল থাকলে বৌদির সুবিধে। অসুস্থ হলে বৌদির স্কুল কামাই। রান্নার ভার, বাসন মাজা কাপড় কাচার ঝক্কি।
শিউলিকে ভালো রাখা বৌদির দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এটা পুরো গিভ অ্যান্ড টেকের ব্যাপার। শিউলি লেখাপড়া না জানলেও এই গিভান্টেক কথাটা শিখেছে ছেলের কাছ থেকে। অবিনাশ উচ্চ মাধ্যমিক পাস। চানাচুরের ব্যবসা, কবুতরের ব্যবসা, অর্ডার সাপ্লাই এর খুচরো কাজ। বাইরের লোকের সঙ্গে মিশে মিশে দিব্য ইংরেজি বলে মাঝে মাঝে। তার মধ্যে একটা হলো গিভ অ্যান্ড টেক। টিয়া কে বলে বন্ধুদের বলে এবং শিউলি কেও বলে।
শিউলির মা বলে ফেলো কড়ি মাখো তেল তুমি কি আমার পর? গিভ অ্যান্ড টেক ব্যাপারটা ওই রকম। ছোটবেলা থেকে নাকের সিঁকনি গিলে ফেলা শিউলি, ক্লাসে ফেল করা শিউলি, ক্লাস থ্রিতে পড়া ছেড়ে দেওয়া শিউলি, ঠিক সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া শিউলি, বিয়ের তিন বছরের মাথায় একটা বাচ্চা দিয়ে বর ছেড়ে যাওয়া শিউলি চকচকে চিকন শ্যামলা রঙের শিউলি, বছর দশেক হলো বাড়িতে শাড়ি ছেড়ে নাইটি পরে থাকা শিউলি জানে। জানে যে এ পৃথিবীতে সবার সঙ্গেই তার অন্তত গিভ এন্ড টেক সম্পর্ক। শিউলি হাড়ে হাড়ে সেটা জানে। মাঝে মা তার সঙ্গেও এখন গিভেনটেক সম্পর্ক হাতে টাকা দিতে দুদিন দেরি করলে শিউলির মা বুড়ি খুব চেঁচায়। না শিউলিকে মুখের উপর কিছু বলে না কিন্তু তখন তার বাতের ব্যথা ভীষণ বেড়ে যায়, দাঁতে যন্ত্রণা। বকবক বাড়ে খিদে কমে যায়। এইসব লক্ষণ বেশি হলেই শিউলি বুঝতে পারে বুড়ির হাতে টাকা কম পড়েছে। অবিনাশ তো প্রথম থেকেই সিধে সাপটা। মা বা বউ কাউকে রেয়াৎ করে না সে। শুধু টিয়ার মুখের সঙ্গে তেমন সুবিধা করে উঠতে পারে না। চুপ করে থাকে। গিভ অ্যান্ড টেকটা বিছানায় হয়, শিউলি বোঝে।
এ পৃথিবীতে একমাত্র চম্পার সঙ্গেই শিউলির গিভ এন্ড টেক সম্পর্ক নেই। তাও মাঝে মাঝে অবশ্য সন্দেহ হয় এই অনলাইন খাবার এই ভাত এই মাছের ঝোল না পেলে কি চম্পা আসবে?
আজ রাস্তায় তাকে দেখে চম্পা এগিয়ে এলোনা সে ডাকলো অথচ চম্পা সাড়া দিল না। এ ভালো লক্ষণ নয়। চম্পা কি অন্য কোথাও বেশি খাবার পাচ্ছে? বেশি চমকিলি কিছু পাচ্ছে শিউলির বরের মতো? যে বিয়ের দু বছর বাদেই শিউলির পেটে লাথি মেরেছিল আর মামনির বাড়ি যাতায়াত শুরু করেছিল শুধু মামনির চটক বেশি বলে!
চা খাওয়া হয়ে গেলে মোতি উঠে শাট পাট করে সব সরিয়ে রাখল। শিউলি টিভিটা চালিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দেখল মহারানি আড়মোড়া ভেঙে উঠছেন। এককাপ চা করে সে রেখে দিয়েছে ছেলের বৌয়ের জন্য।
এই সিরিয়ালটা দেখার সময়ে শিউলি, শিউলির মা, টিয়া, মোতি সবাই এক হয়ে যায়। কোনো ঝগড়াঝাটি থাকে না। সবাই হিরোইনের দুঃখে কাঁদে। তার গয়নার ডিজাইন দেখে। হিরোর দুনম্বর বৌকে অভিশাপ দেয়।
টিয়া উঠেই ফসফস করে বাথরুম চলে গেল।
চম্পা শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে।
"গলির মুখে ডাকলাম যখন সাড়া দিলি না কেন?"
চম্পা মুখের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকল। সাড়া দিল না।
মোতি শিউলির ঘরেই সন্ধের সিরিয়ালগুলো দ্যাখে। তার নিজের ঘরের টিভি তার ছেলের বৌয়ের দখলে। নিজের ইচ্ছেমতো চ্যানেল চলে।
এখন মোতি শিউলির মায়ের কাছে গিয়ে বসবে। একাই বকরবকর করবে অথবা শিউলির মা বকবক করবে।
শিউলি ভাত বসাবে। তরকারি একটা রাঁধবে কিছু। তাদের এক তরকারি হলেই হয়ে যায়।
অবিনাশ আর টিয়া আলাদা খায়। অবিনাশ বেশিরভাগ দিন রুটি তড়কা কিনে নিয়ে আসে কারণ টিয়া রাতে রান্না করবে না।
শিউলিদের বাড়িতে সাড়ে চার জন লোকের জন্য দুটো আলাদা হাঁড়ি। দুটো আলাদা রান্নার ব্যবস্থা! এক হাঁড়িতে শিউলি শিউলির মা খায়। ছেলে ছেলের বউয়ের আলাদা হাঁড়ি। নাতির এখনো এদিক-ওদিক দুই দিকেই চলে যায়। তবে শিউলি নাতিকে বেশি টানে। হাজার হোক বংশের বাতি। যদি ভবিষ্যতে শিউলিকে দেখে! ছেলে অবিনাশ কতটা শিউলিকে ভালোবাসে তা নিয়ে শিউলির বেশ সন্দেহ আছে। শিউলির কপাল মন্দ। তাই নিয়ে শিউলির দুঃখ নেই। শিউলিদের পাড়ার প্রায় সব শিউলিরই কপাল মন্দ। এক হয় বর মরে গেছে না হয় বর ছেড়ে গেছে। যারা বর নিয়ে ঘর করছে তাদের কারুর বর মাতাল কারুর বর দাঁতাল।
শিউলি ভাবে মাতাল দাঁতাল নিয়ে সংসার করার চেয়ে সে বরং ভালো আছে। শুধু বউটা যদি একটু মানুষ হত! কোনদিন তাকে ধরে এক কাপ চা দেয় না।
গত হপ্তায় শিউলির জ্বর হয়েছিল। ঐ গলির মুখে যেমন কালো অন্ধকার শিউলি তেমনই চোখে অন্ধকার দেখেছিল। ডাক্তার বলেছিল ভাইরাল ফিভার। বৌদিই ওষুধ দিয়ে গেল ডাক্তার দেখাল। টিয়া কিন্তু কুটোটি নড়লো না। সকাল দশটা বেজে যায় কিন্তু টিয়া এক কাপ চা ধরে দেয়নি কখনো শিউলির সামনে।
টুনির মা একা একা গজগজ করে গেছে।
খুব ভোরে ওঠে বুড়ি আর নাত বউ দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে থাকে দশটা পর্যন্ত।
সকালের চা মুড়ি ইত্যাদি জলখাবার সব বুড়ি করে। মোতি এসে জিজ্ঞেস করেছিল, কী গো শিউলি দি এখনো চা খাওনি? শিউলি ট্যারা চোখে টিয়ার দিকে তাকিয়েছিল। দেখেছিল টিয়ার কোন লজ্জাও নেই হুঁশও নেই।
সংসারের অভিজ্ঞতা থেকে শিউলি জানে যে বিতে হুয়ে দিন মনে রাখতে নেই।
টিয়া কখনো এক গ্লাস জল ধরে দেয় না, কাপড় কেচে চেপে না, শিউলির ভিজে কাপড় পড়ে থাকলেও ছাতে মেলে আসে না।
এই সমস্ত সত্যই সিরিয়াল দেখার সময় শিউলি ভুলে যায়। আসলে ভুলে যাওয়াই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে দেয়। শিউলি জানে।
শিউলি ভুলেই গেছে, কবে মা তাকে আছাড় মেরেছিল শুধু রোগা আর কালো হওয়ার জন্য।
ভুলে গেছে যে খুব ভুগতো বলে ছোটবেলায় মা বারবার তার মাথার ন্যাড়া করে দিত।
দুটো ভাই জলজ্যান্ত মরে গেল সেই জন্যেও মা শিউলিকেই গাল দিতো। যেন শিউলি খেয়ে রেখেছে তাদের।
এই যে শিউলির বোন জবা মায়ের দিকে ঘুরেও তাকায় না, নিজের বর ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করে বাপের বাড়ি আসে খেয়ে দেয়ে কুড়িয়ে বাড়িয়ে চলে যায়, তাকে নিয়ে মায়ের কোন অভিযোগ নেই। সব তাকঝাক শিউলিকে।
তাই আধা পাগলা বরের প্রকাণ্ড মার শিউলি ভুলে গেছে। ভাসুরের চিমটি কাটা কথাও ভুলে গেছে। শাশুড়ির গালিগালাজ ভুলে গেছে। ছেলে না হওয়া পর্যন্ত কী পরিমাণে গালাগাল , মারধোর তাকে সহ্য করতে হতো সেটাও শিউলি খুব যত্ন করে ভুলে গেছে। কাজের বাড়িতে লেগে সেই যে এক দাদা তাকে বলেছিল তোকে কটা টাকা বেশি দেবো বৌদিকে বলিস না, সেটা শিউলি আর মনে রাখেনি। এইরকম আরো কতকিছু। পায়ে ছ্যাঁকার দাগ। কানের পিছনে কাটা।
এই সমস্ত কথা সে কাপড় কাচা জলের সঙ্গে ভাতের মাড়ের সঙ্গে বইয়ে দেয়। একেকসময় ভাবে ভুলে যাওয়া কথাগুলো যায় কোথায়? পুজো এসে গেল অথচ তাদের গলির মুখে অন্ধকার।
বৃষ্টির জল জমে আছে। মোতিদের বাড়ি তো এখনো জলে ঘেরা। যা জল আছে মনে হয়না পুজোর আগে শুকাবে।
বউ বসেছে খাটে আর মোতি খাটের কিনারায়। শিউলি আর শিউলির মা নিচে। নাতি তার বাপের সঙ্গে বাইরে গেছে। আপাতত বাড়ি শান্ত। কেবলমাত্র টিভির শব্দ শোনা যায়। চম্পার খাওয়া কি হয়ে গেল? রান্না ঘরে বসে আছে নাকি?
রান্নাঘর মানে তো এক চিলতে সিঁড়ির তলা। চম্পা ,কালী, বেদানা, চুমকি কে নিয়ে শিউলির টেনশন থাকে তবে চম্পাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কারণ সে একটু অভিমানী। রাগ করে তিন চার দিন বাড়ি আসে না অনেক সময়। খাওয়া শেষে ভাত নিয়ে শিউলি হাঁক দেয় " চাম্পা ও চাম্পা!"
আজকে কি চম্পা অভিমান করে চলে গেল? শিউলির ভুলে যাওয়া কথাগুলো ও সমস্তই চম্পার কাছে জমা থাকে।
ডালে ফোড়ন দিতে দিতে অথবা মাছ ভাজতে ভাজতে শিউলি আপন মনে চম্পার সঙ্গে বিড়বিড় করে যায়। সবাই জানে শিউলি চম্পার সঙ্গে গল্প করে। অনলাইনে চম্পাদের খাবার আনানো নাকি বড়লোকি চাল, এও শুনতে হয় শিউলিকে।
মাথার মধ্যে একরাশ চিন্তা। আর দুদিনের মধ্যেই ঘর ঝেড়ে ফেলতে হবে। মহালয়া এসে গেল। এর মধ্যে চম্পার এরকম বেগড়বাই শিউলির একেবারে ভালো লাগছে না। জ্বরের জন্যেই তার এক সপ্তাহের মাইনে কাটা গেছে। বৌদি কাটেনি কিন্তু রান্নার বাড়ি কেটেছে। পুজোর আগে কার ভালো লাগে মাস মাইনে থেকে খানিকটা টাকা কেটে যাওয়া?
অথচ শিউলিকে এসব কথা ভুলে যেতে হবে এবং রান্না করতে হবে। চম্পাকে না বললে তো কথাগুলো ভোলা যাবে না। সিরিয়ালের নায়িকা একটা খুব সুন্দর সিল্কের শাড়ি পরেছে। ঘুম থেকে উঠেও তার চোখে কী সুন্দর কাজল। ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক ,গলায় হাতে কানে এক পাল গয়না। আচ্ছা এসব গয়না কি নায়িকার নিজের না সেট থেকে দেয়! টিয়া হয়তো জানবে এসব কথা।
টিয়ার হাতে বড় ফোন। যখনই বিজ্ঞাপন হয় তখনই সে ফোন দেখে। সিরিয়ালের নায়িকা এখন রান্নাঘরে কাঁদছে। এর নাম মধুমিতা।
ফোন দেখতে দেখতে টিয়া হঠাৎ শিউলির দিকে ঝুঁকে পড়ল। একটা শাড়ি দেখাল টিয়া।
তুঁতে কালারের শাড়ি। ঠিক সিরিয়ালের নায়িকার মত। যে শাড়িটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে নায়িকা এখন রান্না করছে অথচ তার চোখের কাজল একটুও ধেবড়ে যাচ্ছে না। টিয়া ঠিক তাক করে নায়িকার শাড়িটা দেখে নিয়েছে আর ফোনে বের করেও ফেলেছে। শিউলি জিজ্ঞেস করার আগেই টিয়া বলল ,দেখো সাড়ে চার হাজার। বিজ্ঞাপনের বিরতিতে শিউলি উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। সিঁড়ির তলাতে ফ্যাকাসে আলো। একটা টিমটিম করে বালব জ্বলছে।
মা বকবক করছে। মহালয়া এসে গেল অথচ ঝুল ঝাড়া হল না। বুড়ি নিজে এখন আর ঝুল ঝাড়তে পারে না। খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্ক বালতি হাঁড়ি ইত্যাদি বের করে পরিষ্কার করতেও পারে না। অথচ শিউলি এখন ছুটি নেবে কি করে? ইদানীং ছুটি বড় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
টিয়া হঠাৎ টরটর করে কথা বলে উঠলো।
"আমি ঝুল ঝেড়ে দেবো দিদা"।
এ যেন টিয়া নয়। ভুল টিয়া। অন্য টিয়া।
বুড়ি চুপ হয়ে গেল। একটু আশ্চর্যই হলো বোধ হয়। এ বউ বিছানা ছেড়ে উঠে এক কাপ চা পর্যন্ত করেনা।
সিঁড়ির তলায় আপন মনে শিউলি একটু হাসলো।
গিভ অ্যান্ড টেকের হিসাব।
পুজো আসছে বউকে তো একটা কিছু দিতেই হবে। তুঁতে সিল্কের শাড়িটা বড় মনে ধরেছে টিয়ার। শিউলির মনে পড়লো তার যখন জ্বর হয়েছিল টিয়া দিব্যি সন্ধ্যেবেলা নিজের বাপের জন্য রুটি তরকারি করে নিয়ে গেল। তার দিকে ফিরেও তাকালো না। কিন্তু আপাতত ওই সব কথা ভুলে যেতে হবে কারণ তার বাড়িঘর পরিষ্কার করার সময় নেই। ঘরের কোণে কোণে প্রকাণ্ড ঝুল পড়েছে। ধুলোও। খাটের তলায় ঢুকলে না জানি কি পাওয়া যাবে! এত বাক্স পেটরা ট্রাঙ্ক স্যুটকেস! জ্বরের পর শরীর বড় দুর্বল হয়ে গেছে। আপাতত টিয়া ঝুল ঝেড়ে দিক। আগেকার সব কথা শিউলি ভুলে যাবে।
সাড়ে চার হাজার টাকা আপাতত শিউলি খরচা করবে না কিন্তু সেসব বলার কী দরকার? ঝুলটা ঝাড়া হয়ে যাক, খাটের তলা পরিষ্কার হয়ে যাক। কিন্তু এই সব কথা তো কাউকে একটা বলাও চাই। চম্পা গেল কোথায়? চাম্পা চাম্পা?
টিনের গেট ঠেলে বাইরে মুখ বাড়িয়ে শিউলি দেখল। পাঁচিলের উপর চম্পা বসে লেজ দোলাচ্ছে। ক্যাটফুড খাওয়া হয়ে গেছে তার। আর গলির মুখে অবিকল চম্পার মত দেখতে আরেকজন।
একই রকম কালো ছোপ ছোপ কানের কাছে।
শিউলি আপন মনে হেসে ফেলে।
গলির মুখে ঢোকার সময় ভুল চম্পা কে ডাক দিয়েছিল সে? অন্য চম্পাকে!
কেন যে মাঝেমাঝেই ভুলভাল লোকজনকে ডেকে ফেলে শিউলি? আর বুঝতেই পারে না কে ঠিক কে ভুল। শুধু ভুলে যাওয়ার জন্য একটা ঠিক চম্পাকে দরকার তার।
.