গত তেসরা মে আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে মণিপুর অশান্ত হয়ে ওঠে। রাজ্যের হাই কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দেয় মেইতেই জনজাতিকে তফসিল উপজাতির তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত করতে। প্রসঙ্গত মেইতেইরা বর্তমানে সাধারণ, অন্য অনুন্নত (ওবিসি) ও তফসিল জাতির অন্তর্ভুক্ত। রাজ্যের উপজাতিরা এই রায়ের বিরোধিতা করে, তাদের মতে ভূতপূর্ব রাজার সম্প্রদায় ভুক্ত হওয়ার কারণে মেইতেইরা পরম্পরাগত ভাবে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। তফসিল উপজাতির অন্তর্ভুক্ত হলে তাঁদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে তারা জমি ক্রয় করার অধিকার পেয়ে যাবে। ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ান’ (আটসু) তেসরা মে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সমাবেশের ডাক দেয়। প্রতিবাদে কুকি এবং নাগা, উভয় সম্প্রদায়ই শামিল হয়। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে গণ্ডগোল বাধে কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে, নাগারা নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। প্রতিবাদ মিছিল হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, কখন, কীভাবে তা নিয়ে নানা মতামত আছে। নানা গুজব রটে। কেউ বলেন উত্তেজিত জনতা চুড়াচাঁদপুরে (যা একটি কুকি সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর ও জেলা) এক মেইতেই ট্রাক ড্রাইভারকে মারধর করে এবং তার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। কোথাও শোনা যায় কুকিদের স্মারকস্তম্ভ ভাঙচুর করা হয়েছে, কোথাও গীর্জা বা মন্দিরে আগুন ধরানো হয়েছে। এরকমও শোনা যায় যে মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। একটা ভিডিও পর্যন্ত ভাইরাল হয় যাতে প্লাস্টিকে মোড়া এক মেয়ের লাশ দেখা যায়। পরে কুইন্ট নামে একটি অনলাইন পোর্টাল ফ্যাক্টচেক করে দেখায় যে মৃতদেহটি ২০২২ সালে মথুরাতে খুন হওয়া এক মহিলার, কোনও ভাবেই যা মণিপুরের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ভুয়ো খবর রটার পরিণাম যে কি সাংঘাতিক হতে পারে তা শীঘ্রই প্রমাণিত হয়। রাজ্য জুড়ে ভয়ঙ্কর হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তিন থেকে পাঁচ মে রাজ্যে সর্বাধিক হিংসা ও অরাজকতা দেখা যায়। এই তিন দিনে ৭২ জন হত্যা হন, যাঁদের মধ্যে অন্তত ৬০ জন কুকি।
মোটামুটি আগস্ট মাসের পর থেকে জাতিগত হানাহানি, সংঘর্ষের তীব্রতা কমে আসে। মণিপুর পুলিশ ১৫ই সেপ্টেম্বর সাংবাদিক সম্মেলন করে জানায় যে মোট মৃতের সংখ্যা ১৭৫, ১১১৮ জন আহত এবং ৩২ জন নিখোঁজ। আশ্চর্যজনক হচ্ছে ৯৬টি লাশ এখনো মর্গে পড়ে আছে। নিরাপত্তার অভাব এতোটাই যে মানুষ প্রিয়জনের মৃতদেহ নিতে যেতেও ভয় পাচ্ছে। ষাট হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, ৩৮৬টি ধর্মস্থান আক্রান্ত হয়েছে। ৫৬৬৮ অস্ত্র লুট হয়েছে, যার মধ্যে ১৩২৯ উদ্ধার করা হয়েছে। ৩৫০টি রিলিফ ক্যাম্প খোলা হয়েছে। ক্যাম্পগুলিতে জায়গা অপ্রতুল। বিশেষ করে উপজাতি এলাকার ক্যাম্পগুলিতে গিজগিজে ভিড়, খাবার, ওষুধ, পোশাকআশাক প্রায় সবকিছুই অপর্যাপ্ত।
বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া আপাত ভাবে মণিপুর এখন শান্ত। রাজ্য এখন আর খবরের শিরোনামে নেই, সেখানে প্রত্যহ আর খুনোখুনি, লুঠতরাজ, নারীদের ওপর অত্যাচার হয় না। এতে এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে রাজ্য সরকার ও পুলিশ প্রশাসন ছয় মাস ধরে চলতে থাকা অরাজকতা অবশেষে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল। বাস্তবটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ছদ্ম শান্তি কোনও প্রশাসনিক দক্ষতা বা নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ঘটেনি, এটা শুধুমাত্র প্রমাণ করে যে গত সাত দশক ধরে এই রাজ্যে ঘৃণা ও হিংসার যে অবিরাম চাষ হয়েছে তা আজ সফল। মণিপুর আজ পুরোপুরি ‘বলকানাইজড’, বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকাতে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত। মর্গে এতোগুলি মৃতদেহ পড়ে থাকাই প্রমাণ করে যে রাজ্যে এখনো পুরোপুরি একটা আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের এলাকার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। অন্যত্র গিয়ে তারা স্বজনের লাশ গ্রহণ করার সাহস পাচ্ছে না। পুলিশ প্রশাসনের নানা আশ্বাস সত্ত্বেও তাঁরা যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করছেন না। সবাই নিজের এলাকার গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে আর কোনও সংঘর্ষও হচ্ছে না। তাই এটা আদপে কোনও স্বাভাবিক পরিস্থিতিই নয়। রাজ্যের তিন প্রধান জনগোষ্ঠী, মেইতেই, কুকি ও নাগাদের মধ্যেকার বিষাক্ত সম্পর্ক মেরামত না করতে পারলে, সুন্দর শান্তিপূর্ণ মণিপুরের কথা কল্পনাও করা যায় না।
এদের মধ্যেকার সম্পর্কের এতো অবনতির কারণটা কি? জাতিগত এই ঘৃণা, হানাহানি এটা কি রাজ্যে বরাবরই ছিল? এরা কি কখনই একত্রে বসবাস করতে পারেনি? এদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করা কি একেবারেই সম্ভব নয়? এই প্রশ্নগুলির ওপরেই কিন্তু রাজ্যের ভৌগলিক ঐক্য অটুট থাকবে কি না তা নির্ভর করছে। এটা ঘটনা যে এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার আন্তসম্পর্ক জটিল। এই প্রতিবেদনে আমরা নিজেদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সমস্যাগুলো বুঝবার চেষ্টা করবো এবং সামনে এগোনোর কিছু সূত্র সন্ধানের চেষ্টা করব।
প্রথমে আমরা কিছু সদর্থক ঘটনার ওপর আলোকপাত করতে পারি। ‘ছেইথারোল কুম্বাবা’, মণিপুর রাজপরিবারের উপাখ্যান অনুযায়ী মণিপুর প্রায় দু হাজার বছরের একটি প্রাচীন রাজ্য। নাগা, মেইতেই, কুকি প্রত্যেকেই এখানকার আদি বাসিন্দা; কুকিদের আগমন ঘটে প্রায় তিনশো বছর আগে। এমনটা নয় যে তারা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী। এটা সত্যি যে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার পরে কিছু মানুষ রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু সেটার জন্য পুরো একটা সম্প্রদায়কে ঘুসপেটিয়া বলে দেগে দেওয়া মোটেও ঠিক নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে নানা দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও তিন শতাব্দী ধরে এই সম্প্রদায়গুলি পাশাপাশি অবস্থান করেছে। ইতিহাস আমাদের জানায় কুকি গাঁওবুড়া, সর্দাররা বিভিন্ন সময়ে মণিপুর মহারাজার পাশে দাঁড়িয়েছেন। ১৮১০ সালে রাজা চৌরাজিত সিং বর্মি সেনাদের আটকানর জন্য কুকিদের সাহায্য চান। তিনি কুকিদের পাহাড়ে বাঁশের বেড়া গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ১৯৪৯ এ ভারতে অন্তর্ভুক্তির সময়ে কুকিরা রাজার প্রাসাদ রক্ষা করার জন্য ইম্ফলে চলে এসেছিল।
এর উল্টো দিকের চিত্রটা কিন্ত ভয়াবহ। অতীতের সময় থেকে আজ অবধি রাজ্যের বিভিন্ন শাসকেরা---রাজপরিবার, বৃটিশ থেকে স্বাধীনতা পরবর্তি বিভিন্ন রাজ্য সরকার---এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বিভেদ কাজে লাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দৃঢ় করেছে। মণিপুরের রাজাদের সঙ্গে নাগাদের সম্পর্ক ছিল নানা দ্বন্দ্ব ও সংশয়ে ভরা। নাগাদের এরা বিনা পারিশ্রামিকে শ্রম দিতে বাধ্য করতো, আবার যুদ্ধের সময় এদের মধ্যে থেকে কুলি নিয়োগ করতে ইংরেজদের সাহায্য করত। নাগারা যখন প্রতিবাদ করতো তখন ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে তাদের এলাকায় হামলা করত। আবার কুকিদের দমন করতে তারা নাগাদের সাহায্য নিত। ব্রিটিশরা কুকি ও নাগাদের বর্মিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে। ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার পরেও বিভিন্ন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার রাজ্যের জাতি উপজাতিদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা দমন করার জন্য চতুর ভাবে জাতিদ্বন্দ্বকে খুঁচিয়ে দিয়েছে এবং কাজে লাগিয়েছে। মানুষ যখন সামরিক অত্যাচার, দানবীয় আইন আফপ্সার প্রতিবাদ করেছে তখন সরকার প্রবল বলপ্রয়োগ করে ও জাতিগুলির মধ্যেকার বিভেদ কাজে লাগিয়ে তাদের দমন করেছে।
প্রশাসনিক নীতি কিংবা নানা সিদ্ধান্ত কী ভাবে জাতিদ্বন্দ্ব বাড়িয়ে তুলেছে সেটার কিছু নিদর্শন আমরা দেখতে পারি। আমাদের দেশের বহু সমস্যার উৎস ব্রিটিশ যুগে নিহিত। কুকিরা নিজেদের দেশকে বলেন জালেঙ্গাম যা উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্য, চট্টগ্রাম ও মায়ানমারের মধ্যে বিস্তৃত। ‘কুকি ন্যাশানাল অর্গানাইজেশন’ এর নেতা পি এস হাওকিপের মতে ব্রিটিশরা কুকিদের সম্মতি না নিয়ে বলপূর্বক ভারত ও মায়ানমারের মধ্যেকার আন্তর্জাতিক সীমানা টেনে দেয়। পরে দেশভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হয় যার ফলে কুকিরা নানা দেশ ও রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু কুকিরা আজও নিজেদের ঐক্যবদ্ধ দেশ জালেঙ্গাম গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। একই সাথে এই ব্রিটিশরা কুকিদের ওল্ড কুকি ও নিউ কুকি নামে ভাগ করে । ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধের (১৮২৪-১৮২৬) পরে যারা মণিপুরে এসেছে তাঁরা নিউ কুকি, তার আগে যারা ছিল তারা ওল্ড কুকি। তাদের মতে ওল্ড কুকিরা নাগাদের সঙ্গে মিশে যায় এবং নিউ কুকিরা উপজতিদের আসল প্রতিনিধি। কুকিদের মধ্যে এই কৃত্তিম ভাগ করার কারণেই মেইতেইরা দাবী করে কুকিরা রাজ্যের আদি বাসিন্দা নয়, তারা সাম্প্রতিক কালে রাজ্যে প্রবেশ করেছে।
প্রশাসনকে পাহাড় ও সমতলের মধ্যে ভাগাভাগি করাটাও বৃটিশদের কীর্তি। এটা কুকি-মেইতেই বিদ্বেষ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বৃটিশদের যুক্তি ছিল যে পাহাড়ের মানুষদের চেহারা, স্বভাব, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি সমতলের থেকে গুণগত ভাবে আলাদা, তাই তাদের জন্য পৃথক প্রশাসন থাকা প্রয়োজন। এই ভাবে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে তারা ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তিকালে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একই প্রথা অনুসরণ করেছে। অসম উন্নয়ন ও সম্পদের অসম বন্টন সমস্যাকে আরও গভীর করেছে। আজ রাজ্যের প্রায় সব ভালো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, গুরুত্বপূর্ণ অফিস সমতল অঞ্চল অর্থাৎ ইম্ফল ও তার আশেপাশে সীমাবদ্ধ। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ২০২১ এর এসডিজি রিপোর্ট (সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস) পাহাড় ও সমতলের মধ্যেকার এই বিপুল বৈষম্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই সমীক্ষায় উন্নয়নের মাপকাঠিতে রাজ্যের পুরানো নয়টি জেলার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে সমতলের জেলাগুলি পাহাড়ের থেকে অনেক এগিয়ে। সমতলের জেলার মধ্যে ইম্ফল পশ্চিমের স্থান সবচেয়ে ওপরে ১৩, নিম্নতম স্থান থৌবাল জেলার, ২৯। পাহাড়ি জেলার মধ্যে উচ্চতম স্থান চান্ডেল, ৪৪, নিম্নতম তামেংলং, ৬৫। বলাই বাহুল্য এই প্রকট বৈষম্যের কারণে উপজাতিরা, বিশেষ করে কুকিরা, যথার্থ ভাবেই নিজেদের বঞ্চিত মনে করে।
সাম্প্রতিক সময়ের আর একটি ঘটনার ওপর আমরা আলোকপাত করতে পারি। কুকিদের ওপর রাজ্য সরকারের বিদ্বেষ কতোটা তীব্র তা প্রমাণ হয় যখন কুকিরা ইঙ্গ-কুকি যুদ্ধের একশো বছর পূর্তিতে কাংপোকপি জেলায় একটি স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। স্তম্ভের ওপরে ‘ইঙ্গ-কুকি যুদ্ধ, ১৯১৭-১৯২০, আমাদের পূর্বপুরুষের দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে’ বাক্যটি খোদিত করার কথা ছিল। রাজ্য সরকার এর বিরোধিতা করে। তারা বলে ওটা যুদ্ধ ছিল না, শুধুমাত্র একটা বিদ্রোহ ছিল। দ্বিতীয়ত তারা ‘আমাদের পূর্বপুরুষের দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে’ লেখার বিরোধিতা করে। অনেক টালবাহানার পর নিরুপায় কুকিরা সরকারের প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়। সেই স্তম্ভের ওপর এখন ‘ওয়ার’ এর পরিবর্তে ‘আপরাইজিং’ লেখা, ‘পূর্বপুরুষের দেশ ও স্বাধীনতার’ কোনও উল্লেখ নেই। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের এই স্মারকস্তম্ভ উদ্বোধন করার কথা ছিল কিন্তু তিনি শুধুমাত্র ভিডিওর মাধ্যমে তাঁর দায়িত্ব সম্পাদন করেন। সম্প্রতি ‘ইঙ্গ-কুকি যুদ্ধ’ নিয়ে বই লেখার জন্য মণিপুর সরকার দুজন কুকি শিক্ষাবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত এক আর্মি কর্নেলকে ‘সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং ‘বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি’র অপরাধে অভিযুক্ত করেছে। কুকি-বিদ্বেষের আর কী বড় প্রমাণ থাকতে পারে!
সমতল-পার্বত্য অঞ্চল, ধর্মীয় বিভেদ ও নানা ঐতিহাসিক কারণে কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে বৈরিতার অবকাশ আছে। কিন্তু কুকি ও নাগারা উভয়েই মূলত পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দা এবং উভয়েই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বি, তাঁদের মধ্যে বিদ্বেষের তো সে ভাবে কোনও কারণ নেই। অথচ মণিপুরের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাত্ত অধ্যায় হল ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া কুকি নাগা সংঘর্ষ যা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে জারি ছিল। এই নরমেধযজ্ঞে হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছিলেন, ৩৫০ গ্রাম উচ্ছেদ হয়েছিল এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিলেন। আমরা দিল্লির শিখ নিধন, গুজরাট গণহত্যার কথা বলি, কিন্তু এতো ভয়ঙ্কর দাঙ্গার খবর কজনই বা রাখি। এই দাঙ্গায় কুকিরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তাঁদের অভিযোগ সেই সময়ও প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী নিছক দর্শকের ভূমিকায় ছিল। নাগা সংগঠনগুলি কিন্তু এতো বছর বাদেও এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করে। কুকিরা বলে সরকার তাঁদের রক্ষা করেনি তাই তাদের অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল। তাদের আক্ষেপ তারা নাগাদের (ইউনাইটেড নাগা কাউন্সিল-ইউএনসি) সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাদের দিক থেকে কোনও সদর্থক প্রতিক্রিয়া পাননি। নাগারাও কুকিদের সম্পর্কে একই অভিযোগ করে। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক এখনো শীতল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নানা বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মিল থাকা সত্ত্বেও কেন এই বিরোধ? মূল বিরোধ হল এলাকা বাটোয়ারা নিয়ে। রাজ্যের পাহাড়ের একটা বড় এলাকার ওপরে কুকিদের এবং নাগাদের উভয়েরই দাবী রয়েছে। কুকিদের প্রস্তাবিত স্বায়ত্ত শাসন এলাকা আর মণিপুরে নাগাদের ‘নাগালিম’ অনেকটা একই জায়গা জুড়ে। মণিপুরের মোট এলাকা ২২০০০ বর্গ কিমি, কুকিদের প্রস্তাবিত ‘হোমল্যান্ড’ ১২৯৫৮ বর্গ কিমি। যে সব এলাকা/জেলা এর মধ্যে পড়ে সেগুলি হল ঃ---- সদর হিলস, চুড়াচাঁদপুর, চান্ডেল জেলা যা কুকি এবং নাগা অধ্যুষিত এবং তামেংলং ও উখরুল জেলা যেগুলিতে নাগারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই এলাকাগুলি ‘নাগালিম’ এর মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত। দেখা যাচ্ছে একই এলাকার ওপর উভয় সম্প্রদায়েরই দাবি রয়েছে যা তাদের মধ্যে বৈরিতার প্রধান কারণ।
একই ভাবে নাগা-মেইতেই সম্পর্কেও অনেক জটিলতা রয়েছে। ঐতিহাসিক কারণে তাঁদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব হয়তো চূড়ান্ত হানাহানিতে রূপান্তরিত হয় না, কিন্তু ছোটোখাটো সংঘর্ষ, অবরোধ, ঠাণ্ডা লড়াই লেগেই থাকে। এক্ষেত্রেও মূল দ্বন্দ্ব এলাকার দখলদারি নিয়ে। নাগারা তাঁদের ‘নাগালিম’ অঞ্চলে অন্য কারো কর্তৃত্ব পছন্দ করেন না। সেরকম কিছু ঘটলেই তাঁরা রাজ্য অবরোধ করে। এখানে বলে রাখা দরকার ইম্ফলে দুটি হাইওয়ে প্রবেশ করে, একটি নাগাল্যান্ডের দিমাপুরের দিক থেকে, আরেকটি বরাক উপত্যকার করিমপুরের দিক থেকে। সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এই দুটি রাস্তা দিয়ে সমতলে আসে। হাইওয়ে অবরোধ করলে ইম্ফল ও পাশ্ববর্তি এলাকায় হু হু করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ২০১০ সালে ‘নাগা স্টুন্ডেন্টস ফেডারেশন’ এর আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে এবং ৬৪ দিন পর তা সমাধান হয়। ২০১৬-১৭তে আরও বৃহৎ অবরোধ হয়েছিল, ১৩৯ দিন। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়---পেট্রোলের দাম ২৪০ টাকা, রান্নার গ্যাস ১৯০০ টাকা। পয়লা নভেম্বর অবরোধ শুরু হয়েছিল, মার্চ মাসের শেষে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চার দিন পর নতুন সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কারণে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
বর্তমানে জাতিদ্বন্দ্ব, পারস্পরিক ঘৃণা প্রকট। বিশেষ করে কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে তা প্রায় অনতিক্রম্য। প্রথমেই বলা দরকার যে রাজ্য সরকারকে নিরপেক্ষ হতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের সর্বস্তরে মেইতেইরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এর ফলে এই গোষ্ঠীর প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব প্রকট। কুকিদের কাছে এদের বিন্দুমাত্রও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এই সম্প্রদায়কে লাগাতার ভাবে নেশাখোর, পপি-চাষি, আফিমসেবনকারী, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে গালমন্দ করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য একটা পুরো সম্প্রদায় আফিম চাষে লিপ্ত হতে পারে না। সরকার এদের প্রতি সদর্থক মনভাব না নিলে অবস্থার পরিবর্তনের কোনও আশা নেই।
এরপরে কুকি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন করে বোঝাপড়া শুরু করতে হবে। এই পর্বটি দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক। প্রাক্তন পুলিশ অফিসার থৌনাওজাম বৃন্দা বলছেন অতীতেও এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তারক্তি হয়েছে কিন্তু তাঁরা আবার মিলেমিশে থেকেছে। নাগাল্যান্ডের অতিমান্য বরিষ্ঠ বিদ্দজ্জন নিকেতা ইরালু যিনি দীর্ঘ দিন ধরে যুযুধান বিভিন্ন নাগা গোষ্ঠীর মধ্যেকার বিবাদ মেটানোর জন্য কাজ করেছেন, তিনি করন থাপারের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য সোজা সরল। নিজের ভুল স্বীকার করতে হবে; সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব বৈরিতা ঝেড়ে ফেলে পরস্পরের মুখোমুখি হতে হবে। এই কাজ কঠিন, বাছাই করা কয়েকজনকে নিয়ে শুরু করতে হবে। কিন্তু এই কাজ অসম্ভব নয়। মেইতেইদের কাংলেইপাক, নাগালিম এবং জালেঙ্গামের সহাবস্থান সম্ভব। নাগাদের মধ্যে কী অস্বাভাবিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, বৈরিতা ছিল তা অনেকেই জানেন। অনেক বছরের চেষ্টায় নিকেতা ইরালু অন্যদের সাহায্যে সেই দ্বন্দ্ব প্রশমিত করেছেন। আশা করা যায় মণিপুরেও সেটা কোনও এক দিন সম্ভব হবে।