— তুমি এবার নাকি আসবে না শুনেছিলাম, কাজের ভীষণ চাপ, আরও কী কী যেন অযুক্তি শোনাল তোমাদের বাড়ির গেটের বোগেনভেলিয়াটি। ঝমঝমে রোদ্দুরে, কেউ কোত্থাও নেই, লাঞ্চের পর ক্লাস ছিল না আমার, ফিরছিলাম। দেখতে পেয়েই সাতকাহন জুড়ে দিল তোমার। আমি কি জিজ্ঞেস করতে গেছি ওকে? তোমার কথা কেন আমায় শোনানো বারবার? তুমি পুজোয় এলে বা না এলে কী এসে যায় আমার?
— ওরে বাবা! এত অভিমান? মানছি, দোষ আমারই। এমন জরুরি এক মিটিঙে এমন ফেঁসে ছিলাম — তোমার ফোন তোলা হয় নি সেদিন। তোমাকে তো আর পরে সুবিধামতো ফোন ব্যাক করার উপায় নেই। সবই একমুখী — তোমারই শর্ত অনুযায়ী। সম্পর্ক, না কি অফিস টাইমের শহরের ট্রাফিক বোঝা দায়! একটু এদিক থেকে ওদিক হ'লেই পুলিশ কেস দেবে ওদিকে হাজিরা খাতায় লাল কালির দাগের ভয়…
— থাক থাক, অনেক হয়েছে, সম্পর্কের কথা আর তুলো না তুমি, ওটার অর্থ, ওজন, ব্যাপ্তি কিছুরই তোয়াক্কা কর নি কখনও তুমি। আর তোমায় ফোন করতে বারণ কেন করেছি, জানো ভালো করেই, যাই হোক ঝগড়া করতে শিখেছ দেখলাম। শহরের জল হাওয়ার গুণ, যাই বলো..
— এটা কী হচ্ছে! কীভাবে যে সব সামলে তোমার জন্যই এবার আসলাম, তা যদি জানতে। ভাবলাম খুশি হবে এতে, ভেবেছিলাম.. না থাক। যাই বলি না কেন — সবই বিপক্ষে যাবে।
— খুশি তো হয়েছি খুবই। দেখছ না, না কি দেখতে চাইছ না, সেজে উঠেছি এই ভোরবেলাতেও। দেরিতে পুজো বলে একটু কুয়াশা যদিও, তবু দেখ শিশিরে ধুয়েছে প্রতিটি ঘাস। এখনই রোদ্দুরে মাথা মুছে ঝকঝকে হবে বলে। আসলে সেদিনের পর থেকে কিছু ভালো লাগছিল না যে। তোমার কেটে দেওয়া ফোন আমায় ছুড়ে ফেলে দিল যেন আস্তাকুঁড়ে, যেভাবে এতদিন প্রত্যেকে করে এসেছে যাদের কাছে ছুটে গেছি আমি, জানো তুমি সবই…
— জানি তো, আর এও জানি অভিমানের আড়াল থেকে সকাল শুরুর সময়টা একটু ধীর লয়ে আসে। বাড়িতে কোনওমতে ব্যাগটা রেখেই বেরিয়ে পড়েছি তাই দেখা করতে। এও জানি উচ্চারিত শব্দই যথেষ্ট নয় সবসময় যেখানে প্রেক্ষিত আরও বড় নৈবেদ্য সাজিয়ে বসেছে।
— এত কথা বল কেন? সময় নষ্ট হয়ে যায়। উত্তরের হাওয়া তাড়িয়ে বেড়ায় যেন রুক্ষ শীতে এক নির্মম প্রান্তরে। গাছ দেখ, শব্দ উচ্চারণ ব্যাতিরেকে সামান্য শাখার আন্দোলনে পাতাটি বা ফুলটি ছড়ায় তোমার তাকানর মুহূর্ত স'মে। কত হাজার বছরের আলো জমে জমে এমন মুহূর্ত আসে বল তো। এখান থেকে আবার পাড়ি দেবে লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে, হয়ত কালসীমানার বাইরে অন্য কোথাও দেখা যাবে তাকে।
— এ ভাবে যখন বল, ভয় হয়। দেখা হ'লে আনন্দের চেয়ে মাথা চাড়া দেয় রংমশালের মুহূর্তকালীন আয়ুর কথা। এর চে বরং শহরের দিনগুলোতে অফিসের যন্ত্রে পিষ্ট হয়ে থাকার সময়টা ভালো, সে অন্তত তোমার দিকেই পৌঁছে দেয়। আর এই একফালি সময় কে দেখ ক্ষ্যাপার মতো ছুটে যাচ্ছে খাদের দিকে — থামা তো দুরস্ত, একটু হেঁটে হেঁটে পথ চলতেও শেখেনি।
— আরও কথা বল বরং, আরও দৃশ্য তৈরি হোক, মুহূর্তের গর্ভে সারি সারি বিন্দু বিন্দু মুহূর্তের অণু-পরমাণুগুলি। বিশ্বাস করো, এখনও জমাই আমি পাগলের মতো তোমার সঙ্গে কাটানো সময়গুলি। প্রতিটি বাক্য, তার মধ্যের আলাদা আলাদা শব্দরা, তার উচ্চারণ, তখন কী বৃষ্টি হচ্ছিল না কি ফুরফুরে হাওয়া, কেমন ছিল এই কালভার্টের পাশে অল্প ঘাসগুলি, ইটভাটি থেকে ধোঁয়া উড়ছিল নাকি তখন, ফড়িং উড়ছিল কি না। জানো মস্ত এক রাজ্য বানিয়েছি অন্দরে। এইসব মুহূর্ত নিয়ে। তুমি শহরে ফিরলে আমিও টুপ করে ওখানে বেড়াতে চলে যাই। এক একটা দেখা হওয়ার দিনের এক একটা গুমটি দোকানঘরের মতো সেই চুরানব্বই সালের এগারোই নভেম্বর থেকে পর পর সাজানো। ঈশ, যদি তোমাকে দেখানো যেত!
— আশ্চর্য মানুষ তুমি! এতই আলাদা আমরা অথচ… কিন্তু আবার দেখ, বেশ মিলমিশ থাকলে হয়ত এতখানি বিনিময় হতে পারত না আমাদের। আজীবন পাশাপাশি থেকেও পরিপূরক রেললাইনকে কখনও দেখেছে আলাপচারিতায়? আবার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী হ'লেও কথা হয় না, শুধু দেখা হয় আর তার পরেই যে যার দিকে এগিয়ে যায় — পাশ কাটিয়ে, চেনাশোনা থাকলে সামান্য মৃদু হেসে বা না-চেনার ভাব করে কখনও সখনও। তার চেয়ে বরং ক্লিশে হয়ে যাওয়া ফুল-ভ্রমরের তুলনাটি ভাল, মিল আছে, গরমিল আছে, হয়ত প্রয়োজনও তবু কী কখনও অপ্রয়োজনীয় একটা ফুলও কখনও ফোটে নি, বা ভ্রমর অকারণ আসে নি একবারও?
— বাব্বা, আপিসে কলম-পেশাই থুড়ি, কি-বোর্ডে তবলা বাজাতে বাজাতেও এত সব গুছিয়ে বলার অভ্যাস থাকে কী ভাবে?
— এখনও জানি না কোনটা আসল আমি। একজন মানুষ, যে উদয়াস্ত কাজ করে, গালি খায় উর্ধ্বতনের আর নিঝুম নিজের ডেরায় ফেরে অনেক রাতে তালা খুলে, যেখানে সিঙ্কে রাখা সকালের জলখাবারের শুকনো এঁটো ডিশে চলাফেরা করা আরশোলারা স্বাগত জানায় তাকে দিনের পর দিন। নাকি অন্য একজন কেউ যে সারাক্ষণ সময়সমুদ্রে সাঁতরে যাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে আর কথার তুবড়িতে যোগ করে যাচ্ছে নানান ধাতব লবণ যা কী না সে কয়েক মুহূর্তের আয়েশে ফুরিয়ে ফেলবে রঙের ফুলকি উড়িয়ে। হয়ত দুটোই আমি, হয়ত পথ চলি শুধু পৌঁছতে। পৌঁছলে দপ করে জ্বলে উঠে দীপাবলির পর ফের অন্ধকারে সাঁতরানো শুরু, ধুলোবালি থেকে অভ্রকুঁচি ছেঁকে নেওয়া, আজীবন।
— আর আমি তো বেড়াই শুধু মুহূর্তমণ্ডিত রাজ্যটিতে বারংবার। প্রতিটি ফুলকি যা তুমি উড়িয়ে যাও প্রতিবার গুছিয়ে তুলে রাখি অবিকল। রীতিমতো সন-তারিখ দিয়ে সাজিয়ে। হয়ত আমার সময় অনেকটাই বেশি থাকে তোমার চেয়ে। হয়ত যা সাজানো আছে তা সম্পূর্ণ তুমি নও। একসঙ্গে থাকা তো হয় না আমাদের। হয়ত আমাকেও জানো না তুমি পুরোটা, কিন্তু তাও বলব আমাদের সেই অল্প অল্প অংশটুকুর এক আলাদা স্বকীয় অস্তিত্ব আমি টের পাই। আমরা রক্তমাংসের হ'লে তাকেই হয়ত আমাদের সন্তান বলা যেত, মাঝে মাঝে যে তোমাকে অসময়ে ফোন করে বসি তা অনেকটা ওর জন্যই…
— জানি আমি, তোমাকে দেখতে এসে তার সঙ্গেও দেখা হয় আমারও। কিছুটা তো আমারই মতো সেও, তাই না? কে জানে, কিছুদিন পরে হয়ত চিনতে পারবে না — এত কম দেখাসাক্ষাৎ আমাদের…
— ফিরে যাওয়ার সময় হ'লে বারবার একটা মন খারাপের কথা না বললে চলে না তোমার?
— কিন্তু ভেবে দেখ আলোর তালের মধ্যে অন্ধকারের অংশটুকু মিশলে তবেই তো তার আকার আকৃতির ধারণা পাওয়া যায়, যেমন টানা আওয়াজের মধ্যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফারাক আর তার মধ্যেকার ছেদ, অনুচ্ছেদ নি:শব্দের অংশটুকুই ত ভাষা, কথা, গল্প।
— কই, কবিতা বললে না যে এবার?
— বলিনি বুঝি? সত্যি?