জানলার কাঁচে শব্দ হচ্ছিলো-- টক টটক, টকটকটক, টটক। টেলিগ্রাফের মত শুনতে লাগে। "কেউ কাউকে খবর পাঠাচ্ছে"-- ভাবতে ভাবতে লোকটা জানলার কাঁচে আঙুল দিয়ে শব্দ করে। লোকটার নাম 'আমি'। আমি খবর পাঠাচ্ছিলাম নিজের কাছ থেকে নিজেকে। "ওদের আসতে দিও, কেউ যেন রাস্তা না আটকায়। ওরা কোনো আইডেন্টিটি কার্ড দেখাক বা না দেখাক, নিজেদের নাম কেউ বলবে, কেউ কেউ বলবেনা। তবু যেন কাউকে আটকানো না হয়। জরুরি নির্দেশ। আই রিপিট -- জরুরি নির্দেশ।" জানলার ওপাশে অনেক খানি নীল আকাশে রুক্ষ ন্যাড়া পাহাড় আলস্য ভরে শুয়ে আছে। তার কোল ঘেঁষে অসম্ভব রূপসী একজন শহর। ঝলমলে, ঝকমকে, চকচকে। আর কী কী বিশেষণ হয়? হয়তো অত বিশেষণ লাগেও না। নামেই পরিচয় -- লাস ভেগাস। এইখানে 'ওদের' আসা আটকানো মানা। ইন্দ্রিয়জ অনুভূতিদের।
এই শহরে আমি জিততে এসেছি। সবাই-ই তাই আসে। টাকা, মজা, শরীরের সুখ, তরল-গুঁড়ো - কিম্বা হাওয়াই নেশার গন্ডোলা চড়ে খানিকক্ষণের জন্য পালিয়ে থাকার জাদু। জেতা জিনিসটা যদিও একটা বিভ্রম ছাড়া কিছু নয়। অনেক অনেক দাম দিয়ে তুমি হয়তো দুটো মাটির ঢেলা পাবে। কপাল ভালো থাকলে। মন্দ থাকলে তার থেকেও কম দামে হয়তো একটা বিষদাঁত। তবু মানুষ ভাবে জিতছে। ভাবাটুকুই লাভ। তবু আমি এসেছি। না এসে করবোই বা কী? দাম দেওয়া আছে যে অনেকদিন ধরে এর জন্য। সেই একদিন মাঝরাস্তায় দুটো গাড়ির চাকার তলায়, অনেক গুঁড়োগুঁড়ো কাঁচ আর দুমড়ানো লোহার টুকরোদের সাথে আমি ঘুমিয়েছিলাম। একটা ন্যাতার পুতুলের মত, রক্তমাখা চুল নিয়ে। জীবন নিজে এসে তখন দাম নিয়ে আমার মস্তিষ্কে রসিদ লিখে গেছিলেন -- "ঘ্রাণশক্তির শতকরা পঁয়ত্রিশ ভাগ বুঝিয়া পাইলাম। স্বাদশক্তির তিরিশ ভাগ। আরো কিছু খুচরোখাচরা ফাউ লইতেছি - কিছু স্মৃতি, কিছু ক্ষমতা, এই, সেই।" জীবন, না মরণ? তাও আজ অব্দি বুঝে ওঠা হলোনা। কিন্তু নিজের মাথার মধ্যে, মনের মধ্যে, চেতনার মধ্যে, রসিদটা নিয়ে, 'আমি' নামের সেই লোকটা সেই থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক কিছুই ফিকে হয়ে যায় এইরকম হলে। কিন্তু ফিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে থাকতে থাকতে, আমার আজকাল অন্যরকম মনে হয়। আজকাল আমি একটা বইয়ের পাতা দেখতে পাই। অপ্টিকাল ইলিউশনের মত। যার দিকে অনেকক্ষণ ধরে থাকিয়ে থাকলে অন্য একটা ছবি ফুটে ওঠে। আমি দেখতে পাই এই ফিকে রঙগুলোও অন্য একটা মাত্রায়, অন্য ছবি এঁকে রেখেছে। এখানে, এই শহরটাতে আমি হিসেব কষে, পরিকল্পনা করে, ঐ ছবিগুলো জিতে নিতে এসেছি। ঠিক অতখানি জীবন্ত, ওরকম অসম্ভব সুন্দর ছবি বাস্তবের দুনিয়ায় রোজরোজ কোথায় আর দেখা যায়? দেখতে পাবে, যদি একমাত্র তুমি 'ওদের' পূর্ণমাত্রায় আসতে দাও। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শদের ।
সেন্স-কনশাসনেস, ইন্দ্রিয়ের চেতনা। একে সহজ কথায় কী বলে? আমি জানিনা। সবকিছু সহজ ভাবে বলা যায়ও না। কিছুকিছু জিনিস কঠিনই হয়। জটিল। তাকে সহজভাবে বলবে কেমন করে? আজকাল আমি এই সেন্স-কনশাসনেস কথাটা মনের মধ্যে বারবার নাড়াচাড়া করি। ধারণটা নিয়েও। জীবন থেকে যখন অনেক কিছু বাদ হয়ে যায়, তখন সেন্স-কনশাসনেস তোমার হাতে একটা গুপ্তধনের ম্যাপ তুলে দেবে। অবশ্য এমনিতে ম্যাপটা সবার চোখের সামনে পড়েই থাকে। কিন্তু লোকে দেখতে পায়না তাকে। ঝলমলে জিনিসের হাতছানি ছাড়া কী-ই বা আর দেখতে পায় মানুষ? তো, এই ম্যাপের দিকে ভালো করে তাকালে দেখতে পাবে, এই ইন্দ্রিয়ের চেতনাকে যদি পুরোপুরি নিতে পারো তাহলে ঐ "বাদ হয়ে যাওয়া অনেক কিছু"র থেকেও অনেক অনেক বেশি কিছু পাবার উপায় বলা আছে। জীবনটা সাদাকালো হয়ে একটু একটু করে হাত থেকে ফসকে চলে যাচ্ছে। দালির ঘড়িগুলোর মত গলে গলে টুপ টুপ টুপ করে অবিরত ঝরে যাচ্ছে। ইন্দ্রিয়-চেতনা তার মধ্যে এক মিলিয়ন রং গুলে দিতে পারে। যেকোনো মুহূর্তে। পৃথিবীর গরিব, শব্দদীন ভাষাগুলোতে সে সব রঙের নাম হয়না কোনো। বিশুদ্ধ জীবনের রঙ ঐ রকম হয়। নামহীন।
আজকাল ছ-টা ইন্দ্রিয়র সাথে ভাব করাটাই আমার মূল লক্ষ্য। তাদের সাথে সময় কাটানো, তাদের সব কথা সারা সত্ত্বা দিয়ে শোনা। যদি ঠিকমতো তা পারো, তাহলে ম্যাপ পড়া সার্থক হলো তোমার। ঐ গুপ্তধন, নিখাদ আনন্দ ছাড়া আর কী?
খুব সহজ নয় কাজটা সবসময়। অনুশীলন লাগে অনেক, মনোযোগ লাগে। তবু সহজ হয়না। একেক সময়ে পরিস্থিতির কাছ থেকে সাহায্য দরকার হয়। পরিস্থিতি হয়তো একটা সাদা চাদর পেতে দিলো। যাতে তুমি পা গুটিয়ে বসতে পারো। কনশাসনেস মুঠোমুঠো জোনাকির মত খালি জ্বলে, নেভে, পালিয়ে যায়। চুপটি করে চাদরের ওপর বসে তুমি ফিসফিসে হাতের পাতা দিয়ে ওদের আস্তে আস্তে ছুঁতে পারো। আদা আর মধুর গন্ধ অলা ওদের কথা। তুমি নরম ছোঁয়ায় মৃদুভাবে শুনতে পারো। সেই রকম একজন সহৃদয় পরিস্থিতির খোঁজ পেয়ে এসেছে 'আমি' লোকটা । এই শহরে।
নিজের নাম লেখা কার্ড দিয়েছিলো পরিস্থিতি। আইভরি ফিনিশের ওপর কালো টানা অক্ষরে লেখা। 'ব্ল্যাকআউট ডাইনিং'। নামটা মনের মধ্যে বেশ বড় মাপের একটা কৌতুহলের ঢেউ তোলে। শুধু নামে আজকালকার দিনে আর কী-ই হয়? পরিচয় চাই না একটু? তা পরিচয়ও দিয়েছিলো বই কি। নাহলে লোকে আসবে কেন ওর কাছে? নামেই অনেকখানি বলা আছে, তবু কনসেপ্টটা বোঝা দরকার। এটা একটা রেস্টুরেন্ট যেখানে তোমাকে খেতে দেওয়া হবে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে। ইন্দ্রিয়দের মধ্যে আমরা সচরাচর সবথেকে বেশি যাকে কাজে লাগাই সেই চোখকে এখানে ইচ্ছে করেই অকেজো করে দেওয়া, যাতে খাবারকে পুরোপুরি বুঝতে তোমায় বাকি ইন্দ্রিয়দের সাহায্য নিতে হয়। "দেখবেন আজকাল", পরিস্থিতি বলে চলে, "আজকাল বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টে মানুষ খাবারের থেকেও খাবারের ছবি তোলার ওপরে বেশি মন দেয়। ইনস্টা-ওয়র্দি হলো কিনা। আমি যে খাচ্ছি তা সবাই জানলো কিনা। কিম্বা টেবিলে বসে সবাই যে যার ফোনের পর্দাতে বন্দি হয়ে থাকে। খাবার আসে, খাবার যায়। কেউ তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়না। এই অন্ধকারে কি আপনি খাবারকে 'খাবার' হিসেবে চিনতে শিখবেন? সেটাই দেখার। হা হা, স্যরি, সেটাই 'না দেখার'।" কৌতুহল ওর নরম মুঠো দিয়ে শক্ত করে আমার হাত ধরে। ইন্টারেস্টিং। টোট্যাল সেন্সরি এক্সপেরিয়েন্স। আই হ্যাভ টু ডু ইট। আই হ্যাভ টু ডু ইট।
রেস্টুরেন্টটা সাউথ ভ্যালিভিউ বুলেভার্ডে। স্ট্রিপ থেকে, যৌবন আর অযৌবন যেখানে উদ্দাম খেলায় নিজেকে বারবার হারাচ্ছে-খুঁজে পাচ্ছে-আবার হারাচ্ছে, সেখান থেকে একটু দূরে। ছোট্ট একটা সাদামাটা বাড়ি, যদিও লেখা আছে ফাইন ডাইনিং রেস্টুরেন্ট। বাইরে থেকে, বা ভেতরে রিসেপশন এরিয়াতে ঢুকেও কিছু ইম্প্রেসিভ লাগেনা। না লাগারই অবশ্য কথা। 'দেখে কী মনে হয়' সেই ধারণাকে বাতিল করতেই এখানে আসা। এখানে ঢুকে প্রথমেই তোমায় একটা ওয়েভারে সই করতে হবে। "আমি অমুক, সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বেচ্ছায় এই অভিজ্ঞতা লইতে স্বীকৃত হইতেছি। আমার যদি কোনোরূপ শারীরিক বা মানসিক বৈকল্য ঘটে তার জন্য কোং দায়ী নহে।" এই জিনিসটা করার সময় মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়। কিছুটা উত্তেজনা, কিছুটা ভয়, কিছুটা গা শিরশির। কোনো বৈকল্য হবার সম্ভাবনা আছে তাহলে? "অন্ধকারকে অনেকে ভয় পায় জানেন না? কত লোক ক্লস্ট্রোফোবিক ফিল করে।" অজানাকেও ভয়ই পায়, অনেকেই।
কাগজপত্রের পালা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। এর পর তোমাকে লিখে দিতে হবে তোমার কোনো খাবারে কোনো অ্যালার্জি আছে কিনা। থাকলে কিসে আছে। ওঁদের বিকল্প ব্যবস্থা আছে অনেক। অ্যালার্জি সিন্দাবাদের বুড়োটার মত তোমার ঘাড়ে চেপে বসে আছে বলেই কি তুমি অভিজ্ঞতার পূর্ণতা থেকে ফাঁকি পড়বে নাকি? না, অন্তত এখানে নয়। এর পর, তিন নম্বর কাগজটা একটা ড্রিংক মেনু। অন্তত সাতটা সিগনেচার ককটেল আছে ওদের। এর মধ্যে কোনটা চাও, একাধিক চাইলে কার পরে কাকে চাও বা অন্য কোন পানীয় চাও কিনা, সেসব লিখে, নিজের নাম দিয়ে সই করে দাও, ব্যাস। আর খাবারের মেনু? না, সে পাবেনা। সেটাই একটা ব্যাপার তো এখানে। সাত কোর্স ডিনার। তোমার সার্ভার প্রতিটা কোর্স টেবিলে দেবার সময় হালকা একটা আভাস দিয়ে দেবেন। এবার তোমার পালা। শুধু গন্ধ, স্বাদ আর স্পর্শ দিয়ে তোমায় খাবারের সাথে এই খেলায় নামতে হবে। আন্দাজ করতে হবে কোনটা কী। ডিনারের শেষে, বাইরে বেরিয়ে এসে এই রিসেপশন কাউন্টারে তোমার জন্য মেনুকার্ড রাখা থাকবে। তখন মিলিয়ে দেখো তোমার সেন্স-কনশাসনেস কতখানি ঠিক বা ভুল। এও এক ধরণের জুয়া খেলা। তো এই শহরে এসেছো আর জুয়া খেলবেনা তাও আবার হয় নাকি?
মিনিট কতক পরে আরো একজন সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁর নামও 'ক্রিস'। তিনিই আজ সারথি, সঞ্চালক ও পরিবেশক। এই অন্ধকার অভিযানের। ক্রিস বলেন "তোমরা এক লাইনে একজনের পেছনে একজন দাঁড়াও। ইস্কুলের বাচ্চাদের মত। আমি প্রথমজনের হাত ধরবো। বাকিরা ডানহাত দিয়ে সামনের জনের ডানকাঁধ ধরে থাকো। সাবধান, কোনোমতেই যেন হাত ছেড়ে না যায়। সবাই তৈরি? আচ্ছা, বড় করে শ্বাস নাও একবার। এই তোমাদের আঁধার-মানিকের রাজ্যে যাত্রা শুরু হচ্ছে।" একটা মোটা পর্দা সরিয়ে উনি প্রথমজনের হাত ধরলেন।
পর্দা ফেলে দিতেই নিকষ কালো অন্ধকারে পৃথিবীটা ডুবে গেলো। একেবারে পিচ-ব্ল্যাক। এত ঘন অন্ধকার আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আচ্ছা, অন্ধকারকে কি দেখা যায়? কোনোকিছুকেই দেখতে না পাওয়া, যে আমাদের অন্ধ করে দেয়, তাকে কি কখনো দেখা যায়? হাঃ!
অন্ধ ছুঁচোর দলের মত আমরা সামনের জনের কাঁধ ছুঁয়ে এগোতে থাকি। চারপাশে অনেক আওয়াজ। লোকজন কথা বলছে। মেঝের ওপর কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। কেউ চেঁচিয়ে বলে উঠছে "এই যাঃ, আমার হাত থেকে চামচটা যে পড়ে গেলো!।" খুব আন-নার্ভিং লাগতে থাকে আমার। যদি এই শব্দগুলো না থাকলেই মনে হয় ভালো ছিলো। চোখে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা, অথচ চারপাশে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে, এই ব্যাপারটা অন্ধত্বের বোধকে আরো সত্যি করে তোলে। হাত দিয়ে ছুঁতে পারার মত শক্ত, ঘন সত্যি। মাথার মধ্যে জোরে এসে ধাক্কা মারে। আমার মনে হয় একটা খুব সরু তক্তার ওপর দিয়ে যেন হেঁটে যাচ্ছি। এতটুকু এদিক ওদিক হলেই অতল খাদে পড়ে যাবো। অন্তত পক্ষে অন্য কোনো টেবিলে গিয়ে ধাক্কা মারবো। ভীষণ একটা অস্থিরতা ঝপ করে গলা চেপে ধরে। আমার বুকের গভীর থেকে সারভাইভাল ইনস্টিংট একটানা আর্ত চিৎকার করে ওঠে। মনে হয় চেঁচিয়ে বলি "না না, আর এগোতে চাইনা। আমাকে আলোয় ফিরিয়ে নিয়ে চলো।" একটা তীব্র ভয় নিকষ কালো কম্বলের মতো জড়িয়ে ধরে -- প্রাইমাল ফিয়ার।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, চিৎকার করতে পারলাম না। যেমন অতর্কিতে এসেছিলো তেমনিই হঠাৎ করেই এবার ভয়ের ঢেউ নেমে আসে। মাথার মধ্যেকার প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স এসে জোরালো হাতে চিন্তার লাগাম ধরেছে। "পিছিয়ে যাবার কথা ভুলেও ভেবোনা। আমরা জিততে এসেছি এখানে।" হ্যাঁ, সেটা ভুলে গেছিলাম। এও ভুলে গেছিলাম যে ক্রিস ও অন্য সব সার্ভারের চোখে নাইটভিশন গগল রয়েছে। অন্ধদের হাত ধরে নিয়ে চলার দায়িত্ব কেউ এমনি এমনিই নেয়না।
তারপরে ....
(তারপরে কী তা পরের পর্বে)