তুম শাহেনশাহ হো বদৌলত খাক কি
খাক পে হর জা হুকুমত খাক কি
খাক মে খুদ কো মিলা দেতে হ্যাঁয় জো
ওহ সমঝ সকতে হ্যাঁয় ইজ্জত খাক কি
খাক মে মিলনা না জো ইয়াদ হো
খাক সমঝেগি ওহ ইজ্জত খাক কি.....
( রাম তেরা গোরখধন্দা- রাগি নিজামি)
' ফসল-ধানের ফলে যাহাদের মন
ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা করে গেছে
পৃথিবীর সব সিংহাসন-
আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়-
যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়
মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নীচে
পৃথিবীর তলে।'
(অবসরের গান-জীবনানন্দ)
খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ সনে সাতবাহন নামের এক রাজবংশ, উজ্জয়িনীর দক্ষিণে, যাকে মুঘলরা বলতো 'দক্কন' আর ইংরেজরা 'ডেকান', সেই বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ উপত্যকা আর সমভূমির বিস্তীর্ণ ভূভাগে শাসন করতো। সাতবাহনেরা আসলে ছিলো মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থানিক ক্ষত্রপ গোষ্ঠী। বৈদিকসাহিত্য অনুযায়ী তাঁরা ছিলেন অনার্য অন্ধ্রজাতির লোক। মৌর্যদের সেনাপতি হবার পর তাঁরা ক্ষত্রিয়ত্বে উন্নীত হ'ন। মৌর্য শাসকদের পতনের পর স্বাধীন নৃপতি হিসেবে তাদের জয়যাত্রা শুরু হয়। সাতবাহন সাম্রাজ্যের মূল নগরগুলি ছিলো, ধরণীকোট, অমরাবতী, প্রতিষ্ঠান আর জুন্নর। প্রথম দুটি বসতি আজকের অন্ধ্রপ্রদেশে আর পরের দুটি আজকের মহারাষ্ট্রে। মৌর্যদের থেকে তারা নিয়ে এসেছিলো বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগ। যার নিদর্শন আজকের ইলোরা থেকে অমরাবতী পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা বহু স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও অন্যান্য সংস্কৃতিগত সূত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথমযুগে সাতবাহনদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো সুঙ্গ ও কন্ব রাজবংশ এবং পরবর্তীকালে পশ্চিম থেকে আসে শক, যবন (ইন্দো-গ্রিক) ও পহ্লবেরা (ইন্দো-ইরানিয়) । এভাবেই ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহে শেষ হয়ে যায় সাতবাহন শাসনের কাল। তবে সাতবাহন রাজারা বা বিশেষ করে প্রথম সাতকর্ণী রাজা ও পরে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী (সালিবাহন) তাঁদের যথাক্রমে ছাপান্ন ও আঠাশ বছরের রাজত্বকালে ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে যান, তা হচ্ছে বিন্ধ্যের উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধের সূচনা। তাঁরা অত্যন্ত প্রতাপশালী নৃপতি ছিলেন। প্লিনির লেখায় মেগাস্থেনিসের যে বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে আমরা দেখি এই রাজবংশের অধীনে ছিলো এক লক্ষ সেনানী, এক হাজার হাতী, দুহাজার অশ্বারোহী সৈন্য আর ত্রিশটি দুর্গ। এরা ছিলো 'অন্দরীয়' নামক এক যোদ্ধৃ জাতি, যাদের বীর্যবত্তা ছিলো অতুলনীয়। এই 'অন্দরীয়' নামের জাতিটি আসলে অন্ধ্র জনগোষ্ঠী। এঁরা প্রথম এদেশে রাজাদের মুখচ্ছবি দিয়ে মুদ্রার প্রচলন করেন। সেই সব রাজপ্রতিকৃতিতে আমরা দেখি কুঞ্চিত কেশ, দীর্ঘ কর্ণ ও স্থূল ওষ্ঠের মানুষদের। মুদ্রায় অঙ্কিত হরফ ছিলো ব্রাহ্মীলিপিতে প্রাকৃত আর আদি তেলুগুলিপিতে তেলুগু। আজকের উত্তর পশ্চিম অন্ধ্রপ্রদেশ অর্থাৎ তেলেঙ্গানা অঞ্চলের আদি পুরুষ ছিলেন তাঁরা। ১৯০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সাতবাহন রাজত্ব শেষ হয়ে যায়।
উত্তরে গোদাবরী থেকে মহেন্দ্রগিরি হয়ে দক্ষিণে কৃষ্ণা পর্যন্ত যে বিশাল উর্বর কৃষিভূমি তাকে ভেঙ্গি বলা হতো। আজকের মানচিত্রে পূর্ব ও পশ্চিম গোদাবরী এবং ধান্যশষ্যের শীর্ষ উৎপাদক খম্মাম জেলা এই এই ভেঙ্গি ভূখন্ডের অংশ। এহেন সোনাফলানো মাটির অধিকার নিতে সেই মৌর্য যুগ থেকে নানা রাজবংশ, যেমন সাতবাহন, কন্ব, পহ্লব, চালুক্য ও শেষ পর্যন্ত চোলাদের অনেক রক্তক্ষয় করতে হয়েছিলো। সাতবাহনেরা শক্তিহীন হয়ে পড়ার পর অন্ধ্র ইক্ষাকু বংশীয় রাজারা ভেঙ্গির দখল নিয়ে নেয়। তারপর ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পহ্লবদের প্রতিনিধি সালংকায়নেরা আসে । পঞ্চম শতকে বিষ্ণুকুণ্ডিনা'দের অধিকারে চলে যায় ভেঙ্গি অঞ্চল। সপ্তম শতকের প্রথমদিকে চালুক্য রাজা দ্বিতীয় পুলকেশিন দ্রাবিড় দেশ পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করে চোলাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করেন। এই সম্পর্কের সুবাদে অন্ধ্র ভূখণ্ডের গরিমাশীল ঐতিহ্য আবার ফিরে আসে। এই চালুক্যদের বলা হতো পূর্বচালুক্য, যাদের সঙ্গে পশ্চিম চালুক্যদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। পশ্চিম চালুক্যদের অধিকারে ছিলো আজকের মহারাষ্ট্র, প্রায় সম্পূর্ণ কর্ণাটক আর তেলেঙ্গানা অঞ্চল। এদের রাজধানী ছিলো বাতাপীতে (আজকের বাদামি)। চালুক্যদের পর দ্বাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত রাজত্ব করে যায় কাকতীয়রা। রাজধানী ছিলো আজকের ওয়রঙ্গল।
‘.....যে যুদ্ধ শুধুই পৃথিবীকে ধ্বংস করে, কিছুই গড়েনা-- আমরা তার থেকে দূরে,
ঢের
দূরে, কান পেতে
শুনবো আন্তর্জাতিক সংগীত, শুদ্ধ চৈতন্যের জয়ধ্বনি..........’
(অন্য যুদ্ধঃ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
দশম শতকের আগেই দেবগিরির ( বর্তমান দৌলতাবাদ) যাদবরা বিন্ধ্যের দক্ষিণ উপত্যকায় রণকৌশলের উপযোগী পাহাড়চূড়ায় একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করে। এই দুর্গটির অবস্থান ছিলো রাষ্ট্রকূট রাজত্বের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায়। ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকূট রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণের সেনাপতি গুণোদয় পূর্ব চালুক্যদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণ গুণোদয়ের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁর পুত্র আর্যকে ওরুগাল্লুর (বর্তমান ওয়রাঙ্গল) রাজত্ব রক্ষার দায়িত্ব দেন। আর্য কাকতিপুরাতে রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর সময় থেকেই কাকতীয় রাজবংশের সূচনা হয়।
কাকতীয় রাজবংশে বেশ কিছু প্রতাপশালী রাজা এসেছিলেন। বিশেষতঃ। প্রতাপরুদ্র, গণপতি ও রানি রুদ্রাম্মা। কাকতীয়রা যাদবদের থেকে এই মাটির দুর্গটি দখল করে নেয়। এই দুর্গটিকে বলা হতো গোল্লা কোন্ডা। অর্থ, গোচারণের পাহাড়। কাকতীয়রা এই পার্বত্য দুর্গটিকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করেননি। এর কৌশলী অবস্থানের জন্য এখান থেকে শুধু নজরদারি করা হতো।
১২৯৬ সালে দিল্লি সলতনতের অলাউদ্দিন খলজি দেবগিরি লুণ্ঠন করার পর কাকতীয়দের বিশাল সম্পন্ন রাজত্বের প্রতি প্রলুব্ধ হন। ১৩০৩ সালে উপ্পরপল্লির যুদ্ধে কাকতীয়দের কাছে খলজি সুলতানের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়। এর পর ১৩০৯ সালে খলজি সেনাপতি মালিক কাফুর সিরিপুর ও হানমকোন্ডা দুর্গ দখল করার পর ওয়রঙ্গল আক্রমণ করেন। মালিক কাফুরের লুণ্ঠন ও বিধ্বংসী নিষ্ঠুরতা থেকে অব্যাহতি পেতে তৎকালীন কাকতীয় রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র মালিক কাফুরের বশ্যতা স্বীকার করলেন। ১৩২০ সালে দিল্লিতে তুঘলকদের হাতে খলজিরা রাজত্ব হারানোর পর প্রতাপরুদ্র ১৩২৩ সাল পর্যন্ত আবার স্বাধীন রাজা হয়ে থাকলেন। কিন্তু ১৩২৩ সালে মুহম্মদ বিন তুঘলকের সেনাপতি উলুঘ খান প্রথম বার পরাজিত হলেও দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় ওয়রঙ্গল দখল করে রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র কে বন্দী করলেন। দিল্লি যাবার পথে নর্মদা পেরোবার সময় দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হলেন। এইভাবে শেষ হয়ে যায় দাক্ষিণাত্যের প্রবল প্রতাপী কাকতীয় রাজত্ব। তার পর কাকতীয়দের ধ্বংসস্তূপের উপর রাজত্ব করে যান রেড্ডি, পদ্ম নায়ক, বিজয়নগরের রাজারা। শেষে কাকতীয়দের সেনাপতি বংশ মুসুনারি নায়কেরা দিল্লি সলতনতের হাত থেকে ওয়রঙ্গলকে উদ্ধার করে প্রায় পঞ্চাশ বছর আধিপত্য বজায় রাখেন। নায়কদের সঙ্গেই অস্ত গেলো তেলেঙ্গানায় হিন্দু রাজাদের পরাক্রম।
১৩৪৭ সালে মুহম্মদ বিন তুঘলকের সুবেদার উত্তরপূর্ব আফঘানিস্তানের বাদখশান থেকে আসা তাজিক ভাগ্যান্বেষী অলাউদ্দিন বাহমন শাহ ওরফে জাফর খান আহসনাবাদে (আজকের গুলবর্গা) দিল্লি সলতনতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীন রাজধানী স্থাপন করলেন। শুরু হলো বাহমনি রাজবংশের অভিষেক। এঁরা পরবর্তী প্রায় দুশো বছর ডেকানের উপর একছত্র রাজত্ব করে গেছেন। বাহমনিরা ছিলো তাজিক। ইরান থেকে আসা ফার্সি ভাষী শিয়া মুসলিম। দাক্ষিণাত্যে শিয়া মুসলিমদের আধিপত্য তখন থেকেই প্রকট হতে শুরু করে।
বাহমনিরা ছিলেন দাক্ষিণাত্যে প্রথম স্বাধীন ইসলামি সলতনত। ১৪২৫ সালে বাহমনিদের রাজধানী আহসনাবাদ বা গুলবর্গা থেকে মহম্মদাবাদ বা বিদরে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। বাহমনি ওয়জির মহম্মদ গওয়ান ছিলেন ঐ রাজবংশের সেরা শাসক। বিদরে তাঁর কীর্তির নানা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষত তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদরাসার মহিমা এখনও বিস্ময়কর লাগে। বিজয়নগর রাজত্ব দখল করা ছিলো মহম্মদ গওয়ানের স্বপ্ন। তাই তিনি প্রয়াস চালিয়ে যান সমানে। কিন্তু বিজয়নগরে তখন রাজত্ব করতেন স্বয়ং রাজা কৃষ্ণদেবরায়। মহম্মদ গওয়ানের স্বপ্ন পূর্ণ তো হলো'ই না, উপরন্তু বাহমনি রাজত্ব ধ্বংস হয়ে গেলো কৃষ্ণদেবরায়ের আক্রমণে। পাঁচ টুকরো হয়ে গেলো এককালের প্রতাপশালী বাহমনি সলতনত। আহমদনগরের নিজামশাহি, গোলকোণ্ডার কুতবশাহি, বিদরের বারিদশাহি, বেরারের ইমাদশাহি আর বিজাপুরের আদিলশাহি। এই পাঁচটি রাজত্ব মিলিয়ে বলা হয় ডেকান সলতনত।
---------------------------------
১৩৭৫ সালে আজকের আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, উত্তরপশ্চিম ইরান, পূর্ব তুরস্ক আর উত্তরপূর্ব ইরাকে রাজত্ব করতেন কৃষ্ণমেষ ( ব্ল্যাক শীপ) গোত্রের ওঘুজ শিয়া তুর্কমান উপজাতির শাসকেরা। যাঁদের বলা হতো কারা কোইনলু। তাবরিজ থেকে মোসুল পর্যন্ত ছিলো তাঁদের শাসন কেন্দ্র। এই গোষ্ঠীর একজন ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা ইরানের হামাদান থেকে ষোড়শ শতকের গোড়ায় দিল্লি আসেন। নাম কুলি কুতুব শাহ। দিল্লিতে তেমন সুবিধে করতে না পেরে তিনি বাহমনিদের সঙ্গে যোগ দেন। বাহমনি সলতনত ধ্বংস হয়ে যেতে তিনি গোলকোণ্ডা অধিকার করে কুতুবশাহি সলতনত প্রতিষ্ঠা করেন ১৫১৮ সালে। গোলকোণ্ডা রাজত্বের সূত্রপাত তখন থেকেই শুরু। যেকোনও ভাগ্যান্বেষী তুর্কি যোদ্ধার মতো কুলি কুতুব শাহও ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী। ওড়িশার সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত কৃষ্ণদেবরায়ের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি ওয়রঙ্গল, কোণ্ডাপল্লি, এলুরু আর রাজমহেন্দ্রি দখল করে নেন। কিন্তু তাঁর রাজত্ববিস্তারের স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে যায় কৃষ্ণদেবরায়ের প্রধানমন্ত্রী তিমারাসুর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে। তিনি আবার ফিরে আসেন গোলকোণ্ডা দুর্গে। সেখান থেকেই রাজত্ব চালান ১৫৪৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তুর্কি উপজাতিক রক্তক্ষয়ী ক্ষমতালিপ্সার শিকার হ'ন তিনি। একদিন নমাজ অদা করার সময় তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জমশীদ কুলি কুতুব শাহ তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। অন্ধ করে দেন সিংহাসনের অধিকারী তাঁর বড়ো ভাই কুতুবুদ্দিনকে। অন্য ভাই ইব্রাহিম কুলি কুতুব শাহ পালিয়ে যান বিজয়নগরে কৃষ্ণদেবরায়ের আশ্রয়ে। জমশীদ কুলি গোলকোণ্ডার সিংহাসন দখল করে নেন।
পিতৃঘাতী, ভ্রাতৃঘাতী জমশীদ কুলিকে পাপের ভার বেশিদিন বইতে হয়নি। ১৫৫০ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু হয় তাঁর। জমশীদের সাত বছরের বালকপুত্র সুভান কুলি 'রাজা' হ'ন কয়েকদিনের জন্য। খবর পেয়ে জমশীদের বিতাড়িত ভাই ইব্রাহিম কুলি ফিরে আসেন বিজয়নগর থেকে। ভাইপো, বালকরাজা সুভান কুলিকে কত্ল করে দখল করে নেন গোলকোণ্ডার মসনদ।
-------------------------------------------
ইব্রাহিম কুলি দক্ষ প্রশাসক ও উদার মানুষ ছিলেন। বিজয়নগরের রাজা আলিয়া রামারাওয়ের কাছে তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকতেন। তাঁর দুঃসময়ে (১৫৪৩-১৫৫০) রামারাও সসম্মানে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁকে। বিজয়নগরে থাকার সময় ইব্রাহিম কুলি তেলেগু ভাষা শেখেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন গোলকোণ্ডা অধিকার করতে হলে স্থানীয় মানুষ ও সংস্কৃতিকে চিনতে হবে। ব্যাপক মাত্রায় হিন্দু তেলেগু অধিবাসীদের নিয়োগ করেছিলেন সেনাবাহিনী ও শাসন ব্যবস্থায়। এই ব্যাপারে তিনি মুঘল সম্রাট মির্জা জলালুদ্দিন শাহ আকবরের পূর্বসূরি ছিলেন। বিবাহ করেছিলেন হিন্দু তেলেগু কন্যা ভাগীরথীকে। নিজে হিন্দু নাম নিয়েছিলেন, মালকি ভরামা। ভাগীরথীকে লোকে বলতো 'কাব্য কন্যাকা'। তিনি কবি ছিলেন। তাঁর পুত্র মহম্মদ কুলিই পিতার সিংহাসন পেয়েছিলেন ১৫৮০ সালে পিতার মৃত্যুর পর। ইব্রাহিম কুলি কবিদের সম্মান করতেন। তাঁর রাজসভায় বহু তেলেগু কবির নাম পাওয়া যায়। আজ যে গোলকোণ্ডা কিলা আমরা দেখতে পাই তার নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম কুলি। কুলি কুতব শাহি বংশের তিনিই প্রথম রাজা যিনি 'সুলতান' উপাধি নিয়েছিলেন।
'কুফর রীত ক্যা হোর ইসলাম রীত
হর এক রীত মেঁ হ্যাঁয় ইশক কা রাজ'
কাফিরের ধর্ম বা ইসলামের ধর্ম, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? দুই ধর্মই তো শুধু ভালোবাসার কথাই বলে।
(সুলতান মহম্মদ কুলি কুতব শাহ)
কুতবশাহি শাসকদের মধ্যে মহম্মদ কুলি ছিলেন সব চেয়ে বর্ণাঢ্য চরিত্র।
তিনি মাত্র পনেরো বছর বয়সে সুলতান হ'ন। তাঁর বৃহত্তম কীর্তি ১৫৯১ সালে মুসিনদীর দক্ষিণ তটে ভাগ্যনগর (হায়দরাবাদ) শহরের পত্তন আর চারমিনার নির্মাণ। তিনি ছিলেন কবি-রাজা। নিজে উর্দু, তেলেগু আর ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। ফারসি 'দিওয়ান' শৈলী তিনিই প্রথম রেখতা (উর্দুভাষা)য় নিয়ে আসেন। তাঁর নিজের কাব্যশৈলীর নাম ছিল ঘজল-ই-মুসলসল'। আঠেরোশো পাতা দীর্ঘ 'কুল্লিয়ৎ-এ-কুলি কুতব শাহ' নামের কাব্যগ্রন্থটি তিনি রচনা করেছিলেন। তাঁর আগে পর্যন্ত এদেশে ফার্সি কবিতায় শুধু ঈশ্বরভজনা ছাড়া আর কোনও বিষয় ছিলোনা। তিনি বিষয়বৈচিত্র্যে ফার্সি কাব্যভুবনকে ভরিয়ে তোলেন। ঋতু, ফুলফল, তরিতরকারি, উদ্যান, সামাজিক জীবন ও প্রথা, উৎসব ইত্যাদি বিষয় নিয়েও যে লেখা যায়, আগে কেউ ভাবেনি। সবার উপরে ছিলো মানসিক উদারতার প্রসার। তাঁর দিওয়ানে ঘজল, কশিদা, মসনবি, মর্সিয়া , সব ধরনের উর্দু কবিতা সংকলিত ছিল। স্থানীয় দেবদাসী নর্তকী ভাগ্যমতীর সঙ্গে তাঁর প্রণয়কাহিনী যদি সত্যি হয় তবে পৃথিবীতে আর এমন কোনও রাজা পাওয়া যায়না, যিনি তাঁর প্রণয়িনীর নামে শহরের নামকরণ করেছিলেন। বিশেষ করে সবাই জানেন মধ্যযুগে তুর্কি শিয়া মুসলিম সুলতান আর হিন্দু দয়িতা'র সম্পর্ক কখনও উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি। পরবর্তীকালে বাদশা ঔরঙ্গজেবের চাপে শহরের নাম পাল্টে ভাগনগর থেকে হায়দরাবাদ করা হয়েছিল। তাও অবশ্য ভাগ্যমতীর নামেই। সুলতান মহম্মদ কুলি তাঁর কাব্যে ভাগ্যমতীর কাব্যিক নাম দিয়েছিলেন হায়দরমহল। ভাগমতীর নামাঙ্কিত একটি দেবী মন্দির এখনও চারমিনারের ভিতর রয়েছে। গোলকোণ্ডায় ছড়িয়ে আছে ভাগমতীর নামে নানা পুরাকীর্তি। গোলকোণ্ডা কিলার চূড়ায় রাজার দিওয়ান-ই-খাস প্রাসাদ বারাদরি থেকে সোজা দেখা যায় ভাগমতীর প্রাসাদ ।
অবশ্য ভাগমতীর এই গল্পটি কিংবদন্তি হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। নামকরণের দুটি উৎস থাকতে পারে। এক চতুর্থ খলিফা আলির উপাধি হায়দ্র থেকে। অথবা ফার্সি 'হায়দর' অর্থে সিংহপ্রতিম বীর্যবান। তাঁর আশা ছিলো নতুন বসতিটি বীরপুরুষদের শহর হবে। এছাড়া 'ভাগনগর' শব্দটি সম্ভবত 'বাগনগর' অর্থাৎ উদ্যানপূর্ণ নগরী হিসেবেই দেওয়া হয়েছিলো। কারণ যাই হোক, মহম্মদ কুলি কুতব শাহের শাসনপ্রণালীর কিছু এই দিকটা বেশ কৌতুহল জাগায়। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার ছাপ ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়ে গেছে।
“The Kingdom of Golconda, speaking generally, is a rich country, abounding in corn, rice, cattle, sheep, fowls, and other commodities necessary to life…. Nature has contributed more than art to make these tanks, of which the country is full. They are generally situated in somewhat elevated positions, where it is only necessary to make a dam on the side of the plain in order to retain the water. These dams are sometimes half a league long, and after the season of the rains is past they open the sluices from time to time in order to let the water run into the fields, where it is received in diverse small canals to irrigate the lands of private individuals.”
(Chapter 10: Taverniers Travellogue)
ফরাসি পর্যটক জাঁ ব্যাপতিস্ত ত্যাভর্নিয়রের দৌলতে হায়দরাবাদ সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই ভদ্রলোক ১৬৫২ সালে হায়দরাবাদে এসেছিলেন। শহরটি দেখে তাঁর মনে হয়েছিলো স্বদেশে অরলিয়ন্স শহরটির সঙ্গে এর তুলনা করা যায়। ১৬৭২ সালে অ্যাবি কার (Abbe Carre) বলেছিলেন, হায়দরাবাদ সমগ্র প্রাচ্যের বাণিজ্যের মুখ্য কেন্দ্র। সুলতান এই নতুন শহরটিকে নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সামনে উদাহরন ছিলো ইরানের ইসফাহান শহর। 'ফরখন্দা বুনিয়াদ', অর্থাৎ সৌভাগ্যসূচক ভিত্তি স্থাপন ছিলো তাঁর অগ্রাধিকার। শহরটির ভিতরে বাইরে প্রচুর উদ্যান স্থাপন করা হয়েছিলো। এখনও হায়দরাবাদ শহরের অনেক বসতির সঙ্গে 'বাগ' উপসর্গটি জোড়া আছে। বশীরবাগ, কুন্দনবাগ, রানিবাগ, কিশনবাগ, কাঞ্চনবাগ, রেশমবাগ, ললিতাবাগ, কাদেরবাগ, ইব্রাহিমবাগ, বাগ লিঙ্গমপল্লি, বাগ অম্বরপেট ইত্যাদি। ফরাসি পর্যটক থেভেওঁ বিস্মিত হয়েছিলেন কীভাবে বিভিন্ন প্রাসাদের খিলানের উপর বিশাল উদ্যান রচনা করা হতো। বস্তুত ত্যাভার্নিয়র, বের্নিয়র,ফেরিশতা, অ্যাবি কার, ইত্যাদি সব বিদেশী অতিথিরাই হায়দরাবাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন। অনেকেই বিশ্বাস করতেন সৌন্দর্যের বিচারে হায়দরাবাদ, মুঘল আগ্রা বা লাহোরের থেকে অনেক এগিয়ে ।
“….The culture of Golconda owed much to the rule of the Qutb Shahis. Indeed, Tavernier couldn’t have felt as comfortable as he did in Hyderabad without the unique cosmopolitan world the Qutb Shahis had fostered there. Golconda’s immensely cultured ruling dynasty was of Persian origin, blended with Arab and Turkish – a heritage reflected in the distinctly western Asian designs, so different from Mughal architecture, of the Qutb Shahis’ magnificent tombs next to Golconda Fort. And the Qutb Shahis also invited, for purposes of trade, huge numbers of Europeans into Hyderabad. As Thevenot wrote, “there are many Franks in this city,” and by this he meant firangis of many nations: Portugal, Holland, and England as well as France. Vestiges of Golconda’s cosmopolitan culture remain in modern Hyderabad where signs are written in four languages – Telugu, Urdu, Hindi and English.”
(The Heera-Wallah of Golconda: Jonathan Gil Harris)
যদি স্থাপত্যকলার উৎকর্ষের প্রশ্ন ওঠে, তবে বহুলোকই সুলতান মহম্মদ কুলি কুতুব শাহকে বাদশাহ শাহজহানের সঙ্গে একাসনে বসাতে চান। সুলতান ফতোয়া দিয়েছিলেন তাঁর তৈরি করা হায়দরাবাদ শহর যেন বেহেস্তের 'আভেস্তাঁ পাইরি দ্বয়েজা' অর্থাৎ Garden of Paradiseএর আদলে গড়ে ওঠে।
মহম্মদ কুলি কুতব শাহ নির্মাণ করেছিলেন দেশের একটি অতি বিখ্যাত দিকচিহ্ন, হায়দরাবাদের চারমিনার। ১৫৯১ সালে তাঁর নতুন শহরে মারাত্মক প্লেগের উপদ্রব হয়। তিনি শহরের কেন্দ্রে একটি স্থানে বসে রোগশান্তির জন্য প্রার্থনা করেন। প্রতিজ্ঞা করেন যদি মহামারী দূর হয়, তবে এই স্থানেই একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই অনুযায়ী ঐ স্থানে নির্মিত হয় বিখ্যাত মক্কা মসজিদ। সুদূর মক্কা থেকে নাকি ইঁট নিয়ে আসা হয়েছিলো এই কাজে। এর স্থাপত্য আর কারিগরি আজও আমাদের অবাক করে। ত্যাভার্নিয়র সাহেব এটি দেখে মন্তব্য করেছিলেন, " It is about 50 years since they began to build a splendid pagoda in the town which will be the grandest in all India when it is completed. The size of the stone is the subject of special accomplishment, and that of a niche, which is its place for prayer, is an entire rock of such enormous size that they spent five years in quarrying it, and 500 to 600 men were employed continually on its work. It required still more time to roll it up on to conveyance by which they brought it to the pagoda; and they took 1400 oxen to draw it."
শাহজহানের নির্মাণ করা দিল্লির জামা মসজিদের প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে মহম্মদ কুলি কুতব শাহের তৈরি মক্কা মসজিদ দেশের বৃহত্তম মসজিদ ছিলো। এখনও সেখানে একসঙ্গে বিশ হাজার লোক প্রার্থনা করতে পারেন।
চারমিনার ছিলো ইসলামি স্থাপত্যের বিজয়তোরণ। একটি মৌলিক ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। বর্গাকার চারটি মিনারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই নির্মাণটি ছিলো নতুন শহরের কেন্দ্রবিন্দু। মক্কা মসজিদের দ্বারপথ। তৈরি হয়েছিলো গ্র্যানাইট, চুনাপাথর, সুরকি আর মার্বলপাথরের গুঁড়ো দিয়ে। এর উপর দাঁড়ালে সারা হায়দরাবাদ শহরের চারদিক দেখতে পাওয়া যেতো। একটা কিংবদন্তি আছে। গোলকোণ্ডা দুর্গ থেকে চারমিনার পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিলো। মূল কারণ দুর্গ আক্রান্ত হলে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছোনোর উপায়। অন্যটা কিংবদন্তি। মহম্মদ কুলি কুতব শাহ নাকি গোলকোণ্ডা থেকে সুরঙ্গপথে এসে হায়দরাবাদে ভাগমতীর সঙ্গে মিলিত হতেন। সুড়ঙ্গটি অবশ্য এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। চারমিনারকে ঘিরে চোদ্দো হাজার বিপণী,বসতবাড়ি, সরাইখানা, হম্মাম, মক্তব-মদ্রাসা এবং মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন সুলতান। তার মধ্যে দর-উল-শিফা (হাসপাতাল) এবং আরও কয়েকটি বিশাল ভবন এখনও টিকে আছে। গোলকোণ্ডা পতনের পর অওরঙ্গজেব হায়দরাবাদ শহরের জাঁকজমক দেখে চমৎকৃত হয়ে যান। যদিও বেশিরভাগ নির্মাণই ১৬৮৭ সালে তাঁর সঙ্গে আসা মুঘল সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো।
ভাগমতীর উদ্দেশ্যে লেখা এই রেখতাটি পড়লে মহম্মদ কুলির ভাবনাকে কিছুটা ছোঁয়া যায়,
'পিয়া বয় প্যালা পিয়া জায়ে না; পিয়া বয় ইক তিল জিয়া জায়ে না,
কটে হ্যাঁয় পিয়া বিন সবুরি করো; কহা জায়ে অম্ম কিয়া জায়ে না ।।
নহি ইশক ইয়ে, উওহ বড়া কূর হ্যাঁয়; কড়ি উস সে মিল ওয়্সা জায়ে না
কুতব শাহ ন দো মুঝে দিওয়ানে কো পন্দ; দিওয়ানে কো কুছ পন্দ দিয়া জায়ে না।'
(মহম্মদ কুলি কুতব শাহ)
(প্রিয়ার বিহনে পেয়ালাও পান করা যায়না। প্রিয়ার বিহনে এক মুহূর্ত বেঁচে থাকা যায়না। কে আমায় ধৈর্য ধরতে বলে? যা বলা সহজ কিন্তু করে ওঠা যায়না। যে ভালোবাসা বোঝেনা সে মূর্খ। তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায়না। আমার মতো উন্মাদকে উপদেশ দিতে যেওনা। কোনও উন্মাদকে কিছু বোঝানো যায়না।)
মহম্মদ কুলির সঙ্গে মুঘল সম্রাট জহাঙ্গিরের তুলনা করা যায়। তিনি সেকালে 'বড়ো' রাজা হবার নিয়মকানুন, অর্থাৎ একের পর এক যুদ্ধ করে রাজত্ব বাড়ানোর নেশায় ব্যস্ত ছিলেন না। এক আধটা যুদ্ধ করেছিলেন। জিতেছিলেন বটে, তবে হেরেও ছিলেন। কৃষ্ণানদীর পূর্বদিকে রাজত্ব বাড়াতে পারেননি। কিন্তু পিতৃদত্ত রাজত্বও হারাতে হয়নি। নিশ্চিন্তে নিজের প্রিয় ব্যসন যাপন করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। হায়দরাবাদের বিখ্যাত গঙ্গা-জমনা তহজিবের জন্ম ও লালনপালন তাঁর দৌলতেই হয়েছিলো। মধ্যযুগে তাঁর প্রদর্শিত 'সেক্যুলার' প্রবণতাগুলি আর কোনও তুর্কি-ইরানি শাসকের মধ্যে দেখা যায়নি।
গোলকোণ্ডার গল্প অসম্পূর্ণ থাকে একজন নারীর উল্লেখ ছাড়া। এদেশের ইতিহাসে একজন হারেমের অন্তঃপুরিকা হিসেবে ঐ পর্যায়ের প্রভাবশালী কেউ হতে পারেননি। কন্যা, ভার্যা ও মাতা হিসেবে তিনি তিনজন সুলতানের আমলে রাজধর্মের মূল কেন্দ্র ছিলেন। অসাধারণ বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ এবং ক্ষমতাশালী মানুষ ছিলেন তিনি। নাম, হায়াত বকশি বেগম। তাঁর পিতা মহম্মদ কুলির কোনও পুত্র সন্তান ছিলোনা। গোলকোণ্ডা দুর্গের নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনে অল্পবয়স থেকেই হায়াত বকশি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর পিতার আমলে কুতুবশাহি রাজবংশের প্রতাপ ও নাম সারা পৃথিবীর মানুষের জানা ছিলো। আড়ালে থেকে রাশ টেনে রাখার কাজটি করতেন হায়াত বকশি বেগম। ১৬০৭ সালে তাঁর বিবাহ হয় সুলতান মহম্মদের সঙ্গে। সুলতান মহম্মদ কুতব শাহ ছিলেন মহম্মদ কুলির ভাগিনেয়। মাত্র চোদ্দ বছর রাজত্ব করেন তিনি। কুতবশাহি বংশের ইতিহাস রচনা ছিলো তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। সুলতান মহম্মদের আমলে হায়াতই ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্র। শুধু প্রাসাদ নয়, রাজ্যের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই থাকতো। তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ কুতব শাহ মসনদ অধিকার করেন ১৬২৬ সালে। তরুণ বয়সে আবদুল্লাহ ছিলেন একজন আবেগপ্রবণ, অনুশাসনহীন, মাথাগরম মানুষ। তাঁকে নিয়ে শুধু পিতা-মাতা নয়, সারা রাজ্যের লোক তটস্থ থাকতো। একবার হুসেইনি আলম এলাকায় রাজার হাতিশালার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কী খেয়াল হলো, তিনি চাইলেন সুলতানের প্রিয় হাতি মুরতের পিঠে চড়বেন। হাতিটি তখন 'মস্ত' অবস্থায় ছিলো। তাকে বিরক্ত করা বিপজ্জনক হবে এই বলে মাহুত আবদুল্লাহকে নিরস্ত করতে চাইলেন। কিন্তু একবার গোঁ ধরলে শাহজাদা কারো কথা শোনেন না। তিনি আধপাগল মুরত হাতির পিঠে চড়ে গোলকোণ্ডা দুর্গের দিকে যাত্রা করলেন। পথে পড়লো মুসি নদী। এখন মুসিনদীকে দেখলে কেউ ঠাহর করতে পারবে না। এককালে নদীটি কীরকম প্লাবিত হয়ে যেতো বন্যায়। আবদুল্লাহকে নিয়ে হাতি নদীর কাছে আসতেই দেখা গেলো নদী খেপেছে। তুমুল স্রোত আর জলের গর্জন শুনে হাতি জলে নামতে রাজি নয়। কিন্তু আবদুল্লাহও রাজি ন'ন নামতে। শেষে মাহুত নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন হাতিকে বশ মানাতে। কিন্তু হঠাৎ হাতি খেপে গিয়ে মাহুতকে শুঁড় দিয়ে তুলে ফেলে পদদলিত করে দিলো। তাতেও শান্তি নেই, বেশ কিছু মানুষ যাঁরা শাহজাদার অনুগমন করছিলেন তাঁদের পদপিষ্ট করে নিহত করে হাতিটি ছুট দিলো দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। পিঠের উপর শাহজাদা কোনমতে হাওদা আঁকড়ে বিপন্ন অবস্থায় টিকে থাকতে চাইছেন। হাতি সবার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো।
দুর্গে এই বিপর্যয়ের খবর পৌঁছোতেই দিকে দিকে সৈন্যসামন্ত ছুটতে লাগলো। কিন্তু একটা গোটা দিন কেটে যাবার পরেও যুবরাজের কোনও খোঁজ নেই। তখন হায়াত বেগম সব প্রজাদের অনুরোধ করলেন তাঁরা যেন সারা রাজ্যে উঁচু বৃক্ষের শাখায় কিছু খাদ্যদ্রব্য ও পানীয়জলের আধার বেঁধে রাখেন। হাতি যদি যুবরাজকে নিয়ে সেসবের নিচে দিয়ে যায় তবে তিনি হয়তো ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারবেন। কিন্তু তিন দিন কেটে যাবার পরেও ভবিষ্যত সুলতানের কোনও খোঁজ নেই। ইতোমধ্যে মহরমের চাঁদ দীদার হয়ে গেছে। বিপর্যস্ত, অবসন্ন মাতা ইমাম হুসেনের প্রতি আর্জি জানালেন, যদি আবদুল্লাহ নিরাপদে ফিরে আসেন তবে তাঁকে শিকলে বেঁধে তিনি মার্জনা ভিক্ষা করার জন্য হুসেইনি আলমের আশূরখানায় নিয়ে আসবেন । কয়েকদিন পর দেখা গেলো যুবরাজ সেই হাতির পিঠে চড়েই পৌঁছে গেছেন দুর্গের দ্বারপথে। হাতিটি ততোদিনে শান্ত হয়ে গেছে বটে। কিন্তু যুবরাজ শ্রান্ত, ক্লান্ত, অভুক্ত, দুর্বল, ত্রস্ত। হায়াত বেগম কিন্তু পুত্রকে দুর্গ প্রবেশের অনুমতি দিলেন না। তাঁর মানত যতোক্ষণ না পূর্ণ হচ্ছে যুবরাজ দুর্গে ফিরতে পারবেন না। স্বর্ণকারদের ডাকা হলো। চল্লিশ মন সোনা দিয়ে তৈরি হলো রাজকীয় শিকল। যার নাম লঙ্গর। পরের দিন দুর্গের দুয়ার থেকেই সোনার শিকলে বাঁধা যুবরাজ ও তাঁর হাতিকে নিয়ে বেগম শোভাযাত্রা করে চললেন শহরের দিকে। হুসেইনি আলমের আশূরখানায়। সেখানে পৌঁছে যাবার পর চল্লিশ মন সোনার শিকলটি ভেঙে দরিদ্র প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে বিপুল ভোজের আয়োজন। আবদুল্লাহ কতোটা শুধরে ছিলেন জানা নেই, কিন্তু আজও হায়দরাবাদে নিরুপায় বাবা-মায়েরা 'অবাধ্য' পুত্রদের হুসেইনি আলমের আশূরখানায় নিয়ে এসে শুধরাবার চেষ্টা করেন।
গোলকোণ্ডার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা বিচিত্র চরিত্র। একজন হলেন কাঞ্চরলা গোপান্না (১৬২০-১৬৮০)। লোকে তাঁকে জানে ভক্ত রামদাস বা ভদ্রাচল রামদাস। তিনি ছিলেন সতেরো শতকের একজন বিখ্যাত তেলুগু কবি ও কর্ণাটিক সঙ্গীতজ্ঞ। তেলুগু ক্লাসিক পর্বে তিনি প্রসিদ্ধ 'বাগগেয়কার' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ত্যাগরাজা,ক্ষেত্রায়্যা, আন্নামায়্যা, শ্যামাশাস্ত্রী প্রমুখ তেলুগু সাহিত্যের দিকপাল প্রতিভারা ছিলেন রামাদাসের অনুরক্ত অনুগামী।
ভক্ত রামদাস ছিলেন তেলুগু নিয়োগী ব্রাহ্মণ। উত্তর অন্ধ্রের খম্মম এলাকার লোক। তাঁর প্রধান পরিচয় অব্শ্য, তিনি মদন্না এবং অক্কান্নার ভাইপো। মদন্না আর অক্কান্না ছিলেন দু ভাই। অল্প বয়সে গোলকোণ্ডার তিজারতে (কোষাগার) কেরানি হয়ে ঢুকেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই সয়ীদ মজহর নামে একজন ইরানি রাজপুরুষের নজরে পড়ে যান। তার পর থেকে পিছু ফিরে তাকাননি। অচিরেই সেকালের সব চেয়ে ক্ষমতাশালী আমলাদের একজন হয়ে যান। মদন্না ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান আর সতর্ক লোক। সয়ীদ মজহর, আবুল হাসান তানা শাহকে কুতব শাহি রাজ্যের সুলতান করার উদ্যোগে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর সুপারিশে সুলতান এই দুই ভাইকে কোষাগারের মালিক করে দেন। কিন্তু ক্রমশ তাঁরা সুলতান আবুল হাসান তানা শাহকেই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। ধর্মে হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও এই দুই রাজপুরুষের এজাতীয় প্রতাপ দেখলে অবাক লাগতে পারে। তখন সমস্ত সেনা ও প্রশাসনের কর্তা ছিলেন মূলত ইরানি শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম আমির ওমরাহ'রা। সমকালীন ইতিহাস ছাড়াও গোলকোণ্ডা দুর্গের মধ্যে তাঁদের বিশাল কার্যালয়টি দেখলে মদন্না-অক্কান্নার রোয়াব বোঝা যায়। ১৬৭৪ থেকে ১৬৮৫ পর্যন্ত তাঁরা ছিলেন কর আদায়ের কর্তা। কেউ বলেন তাঁরা খুব সক্ষম প্রশাসক ছিলেন, কেউ বলেন অত্যাচারী। মুঘল বাদশাহ অওরঙ্গজেবকে সামলানোর দায়িত্ব পালন করতেন ছলে-বলে-কৌশলে। সুলতান তানা শাহ তো গীত-বাদ্য-নৃত্য-পদ্য নিয়েই মশগুল।
আমরা গোপন্না বা ভক্ত রামদাসের গল্পে ফিরে আসি। কাকাদের দৌলতে গোপন্না 'পালওয়ঞ্চা পরগনা'র তহসিলদার হয়ে যান। তিনি ছিলেন খুব সৎ ও সক্ষম প্রশাসক। যত্ন করে দায়িত্ব পালন করতেন। তবে তাঁর প্রিয় কাজ সবসময় রামনাম করা এবং দরিদ্র মানুষদের ভোজন করানো।
অন্ধ্রপ্রদেশের (এখন তেলেঙ্গানা) উত্তরদিকে ভদ্রাচলম নামে একটি স্থানে একটি প্রাচীন রাম-মন্দির আছে। কিংবদন্তি অনুসারে রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষণ বনযাত্রার কালে এইখানে এসেছিলেন। তাঁরা একটি পর্ণকুটির নির্মাণ করে এখানে থাকতেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে শবরীর দেখা হয়েছিলো। যদিও শবরীর সঙ্গে কিস্কিন্ধ্যা রাজত্বের যোগসূত্রও দেখতে পাওয়া যাবে। ঘটনা যাই হোক, ভক্তরা ভদ্রাচলমের সঙ্গে রামচন্দ্রের সরাসরি যোগাযোগ স্বীকার করে থাকেন। এহেন ভদ্রাচলম মন্দিরে একবার বিখ্যাত রাম যাত্রার সময় এসে গোপন্না মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে খুব ব্যথিত হয়ে পড়েন। মন্দির নির্মাণের জন্য তিনি অর্থসংগ্রহ শুরু করেন। গোদাবরী নদীর তীরে ভদ্রাচলমে বা ভদ্রাদ্রিতে সীতারামচন্দ্রস্বামীর মন্দির যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই জানের কী বিপুল সেই নির্মাণ। যখন নিজের সংগ্রহ ফুরিয়ে গেলো, তখন তিনি প্রজাদের থেকে আদায় করা রাজস্ব তছরুপ করে ছ'লক্ষ টাকা মন্দির নির্মাণে লাগিয়ে দিলেন। এই কাজে তিনি সুলতানের অনুমতি নেননি। ওদিকে স্বয়ং রামচন্দ্র তাঁকে স্বপ্নে আদেশ করলেন গোদাবরী নদী থেকে সুদর্শন চক্র উদ্ধার করে তাকে মন্দিরের চূড়ায় স্থাপন করার জন্য।
দারুণ একটা মন্দির তো তৈরি হলো, কিন্তু চরেরা সুলতানের কাছে গোপন্নার তহবিল তছরুপের খবর পৌঁছে দিলো। সুলতান দারুণ রেগে গোপন্না রামদাসকে গোলকোণ্ডা দুর্গের কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। আদেশ হলো ছ'লক্ষ টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত রামদাসকে হাজতবাস করতে হবে। রামদাস সারাদিন ধরে কারাগারে বসে রামকীর্তন লেখেন আর গান করেন। রাম কিন্তু আর আসেন না তাঁকে উদ্ধার করতে। তাঁর নাকি পূর্বজন্মে পাপ ছিলো।
বারো বছর কাটার পর হঠাৎ একদিন গভীর রাতে সুলতান দেখেন তাঁর শোবার ঘরে দুজন অতি সুন্দর যুবক এসে পরিচয় দিলেন রামোজি আর লক্ষ্মোজি নামে। তাঁরা রামদাসের মুক্তিপণ হিসেবে ছ'লক্ষ টাকার সোনার মোহর আর সুদ হিসেবে ছ'লক্ষ টাকার রূপোর মোহর নিয়ে এসেছেন। মোহরগুলিতে রামচন্দ্রের নিজের নাম ছাপা আছে। সুলতানের তো চক্ষু চড়কগাছ। এভাবে মাঝরাতে তাঁর শোবার ঘরে দুজন ঢুকলো কী করে? অন্যদিকে তিনি এই দুজন আগন্তুকের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ। সুলতান রামদাসের মুক্তি পরওয়ানা স্বাক্ষর করে দিলেন। সেই রাতেই ঐ দুই যুবক কারাধ্যক্ষকে ফরমান দেখিয়ে রামদাসকে মুক্ত করে দিলেন।
পরদিন সকালে হইহই ব্যাপার রইরই কাণ্ড। সুলতান ও রামদাস দুজনেই বুঝতে পেরেছেন ঐ দুজন যুবক কে ছিলেন? রাজা তো চমৎকৃত। আর রামদাসের বিলাপ বাধা মানেনা। তিনি বারবার বলছেন, রামলক্ষ্মণ ভক্তকে দর্শন না দিয়ে কেন যবন রাজাকে করুণা করলেন? সেই রাতে রাম গোপন্নাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে জানালেন, সুলতান পূর্বজন্মে এক শিবভক্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন। শিবের আদেশে তিনি তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ধরে রুদ্র-অভিষেকম ব্রত পালন করেছিলেন। কিন্তু শেষদিনে কোনও ভ্রান্তির জন্য ব্রত একদিন কম পড়ে যায়। সেই অপরাধে শিব তাঁকে দেখা দেননি। ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ শিবলিঙ্গ ভেঙে ফেলেন। সেই পাপে তাঁর যবনজন্ম হয়। কিন্তু শিব তাঁকে এ আশ্বাসও দেন তিনি যেহেতু তিনশো চৌষট্টি দিন ব্রত পালন করেছিলেন সে জন্য রামচন্দ্র তাঁকে দর্শন দেবেন। রোমাঞ্চিত সুলতান রামলক্ষ্মণ প্রদত্ত সব অর্থ ভদ্রাচলম মন্দিরের উন্নতির জন্য দান করে দেন। মৃত্যুর পর রামদাসকে স্বর্গীয় রথে চড়িয়ে সরাসরি বৈকুণ্ঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।
এহেন রামদাসের সঙ্গে বিজড়িত কারা-গুহাটি গোলকোণ্ডা দুর্গের একটি প্রধান দ্রষ্টব্য।
মধ্যযুগীয় রাজাগজাদের রাজত্ব ঘিরে বহু কিংবদন্তি জড়িয়ে থাকে। বিশেষত মাণ্ডু, গোলকোণ্ডা, বিজাপুর, ওর্ছা বা অবধ জাতীয় অপেক্ষাকৃত ছোটমাপের নবাব-সুলতানদের বৃত্তগুলি বেশ রহস্যময়। গল্পের শেষ নেই।যেমন সপ্তম কুতবশাহি সুলতান আবদুল্লাহ কুতব শাহের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তারামতীর গল্প। গোলকোণ্ডা কিলায় বালা হিসারের ঝরোখা থেকে অনেকটা দূরে চোখে পড়বে তারামতী বারাদরির উদ্যান প্রাসাদ। যার অনুষ্ঠান মণ্ডপটিতে বারোটি বিশাল দেউড়ি এপারওপার। মাটি থেকে সত্তরটি উঁচু উঁচু ধাপ চড়ার পর ঐ মণ্ডপটিতে পৌঁছোনো যাবে। হাওয়ায় ভাসাভাসি। সেকালে এরকম স্থাপত্যের অন্য কোনও জুড়ি নেই।
তারামতী আর তাঁর ভগ্নী প্রেমমতী ছিলেন সুলতানের সভানর্তকী। সুলতান তারামতীর রূপ ও গুণমুগ্ধ ছিলেন। আরেকটা অনারকলির গল্প। সময়ের বিচারে কিছুদিন পরে অবশ্য। কিংবদন্তি, তারামতী, তাঁর প্রাসাদ আর পাহাড়ের উপর গোলকোণ্ডায় সুলতানের মহল বালা হিসারের মধ্যে বাঁধা একটি দড়ির সেতুর উপর নাচতে নাচতে সুলতানের কাছে পৌঁছে যেতেন। আবদুল্লার পূর্বপুরুষ মহম্মদ কুলি কুতব শাহ আর ভাগমতী বা হায়দরমহলের কিংবদন্তির পুনরাবৃত্তি যেন। যাকে বাংলায় বলে 'গল্প করবো, অল্প নয়'।
গোলকোণ্ডা দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিলো চারশো ফুট উঁচু একটি গ্র্যানাইট পাহাড়ের উপরে। চারদিকে ধু ধু ঊষর সমভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজকীয় নির্মাণটির দৃশ্য এককথায় রোমাঞ্চকর। দুর্গটির আকার রম্বাস সদৃশ। চারদিকের ভূবলয় ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। দুর্গের বাইরের প্রাকারটির পরিধি সাত কিমি।প্রাকারটি গভীর, প্রশস্ত পরিখা দিয়ে ঘেরা। তিনটি প্রাচীরের বৃত্ত এই দুর্গকে প্রায় দুর্ভেদ্য করে রেখেছিলো। পাহাড় থেকেই গ্র্যানাইট পাথর কেটে প্রাকার ও অন্য নির্মাণগুলি করা হয়েছিলো। ভিতরে ঢোকার পথ ছিলো মোট আটটি। তবে তার মধ্যে চারটি ছিলো প্রধান। পূর্বদিকে ফতেহ দরওয়াজা। পশ্চিমে মক্কা দরওয়াজা। উত্তরে বঞ্জারা আর উত্তর-পশ্চিমে পত্তনচেরু দরওয়াজা। হায়দরাবাদের দিক দিয়ে এলে ফতেহ দরওয়াজা দিয়েই ঢুকতে হয়। ফতেহ দরওয়াজা অর্থাৎ বিজয়দ্বার।
তিনটি প্রাকারশ্রেণীর প্রথম প্রাকারটি ঘিরে আছে সম্পূর্ণ পাহাড় এবং চারদিকের সমভূমি। দ্বিতীয় প্রাকারটি রয়েছে পাহাড়ের পদদেশে। তৃতীয়টি ঘিরে আছে Citadel বা বালা হিসার অংশটি। প্রাকারগুলি মোটামুটিভাবে সতেরো থেকে চৌঁত্রিশ ফুট চওড়া। পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট উঁচু। তিনটি প্রাকার মিলিয়ে মোট সাতাশিটি অর্ধচন্দ্র বুরুজ রয়েছে। যেখানে সান্ত্রী ও অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত থাকতো। বিশাল গ্র্যানাইটের ব্লক সাজিয়ে তাদের নির্মাণ করা হয়েছিলো। উত্তর -পশ্চিম কোণায় রয়েছে পেটলা বুর্জ। মানে বিশাল উদর বুরুজ। তার উপর একটি বিশাল কামান, নাম ফতে রাহবার, শত্রুর দিকে উদ্যত তাকিয়ে থাকতো। পেটলা বুর্জ ছাড়াও আরও দুটো প্রধান বুরুজ ছিলো ঐ প্রাকারসারিতে। নাম মুসা বুর্জ আর কাঘজি বুর্জ। আবদুল্লাহ শাহের প্রধান সেনাপতি মুসা খান ঐ বুরুজ থেকে কামান দেগে ১৬৫৬ সালে প্রথম মুঘল আক্রমণকে প্রতিহত করেছিলেন। বিখ্যাত আঢ়াপাইকার কামানটি এখানে স্থাপন করা ছিলো। কাঘজি বুর্জের ইতিহাসটি ইতিহাসটি একটু ব্যতিক্রমী। অওরঙ্গজেবের কামানের গোলায় এই বুরুজটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সুলতানের কারিগররা মুঘল সৈন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য একরাতের মধ্যে কাগজবোর্ড দিয়ে অবিকল একটি নকল বুর্জ তৈরি করে দিয়েছিলেন। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। বহু বুরুজে তেলুগু লিপি উৎকীর্ণ থাকতে দেখা গেছে। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি কুতবশাহিদের আনুকূল্য বেশ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
বাইরের প্রাকারটির আটটি দরওয়াজার নাম, ফতেহ, বাহমনি, মক্কা, পত্তনচেরু, বঞ্জারা, জামালি, নয়াকিলা আর মোতি দরওয়াজা। প্রধান দরওয়াজাটি এখন ফতেহ দরওয়াজা। কুতবশাহি পতনের পর এই প্রবেশ পথ দিয়ে বাদশা অওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ মোয়াজ্জেম গোলকোণ্ডার দখল নিতে ঢুকেছিলেন।
গোলকোণ্ডা দুর্গের যে অংশটি চলতি কথায় এখন 'গোলকোণ্ডা', সেটির আসল নাম 'বালা হিসার'(Citadel)।একটা উঁচু গ্র্যানাইট পাহাড়ের চূড়ায় এই সুরক্ষিত রাজমহলটির নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম শাহ। এই মুহূর্তে পর্যটকরা প্রবেশ করেন বালা হিসার দরওয়াজা দিয়ে। এটাই দুর্গের কেন্দ্রস্থল। ঢোকার মুখে বিশাল দরজাটি কাঠের। তার সর্বাঙ্গে পিতল বাঁধানো কীলক হাতিফৌজের আক্রমণ থেকে দুর্গকে রক্ষা করতো। বালা হিসারের স্থাপত্যের আদর্শ ছিলো বাহমনি রাজ্যের নির্মাণ কৌশল। গোলকোণ্ডার কুলি কুতবশাহি রাজত্বের উপর বাহমনি সাম্রাজ্যের প্রভাব বেশ জোরদার ছিলো। ষোলো শতকের শেষদিকে বা সতেরো শতকের প্রথমদিকে কুতবশাহিরা অনেকটা স্বাধীন হয়ে যান। গোলকোণ্ডা দুর্গের ভিতরে তখন মস্তো মস্তো নির্মাণ হতে থাকে। বালা হিসার ছাড়াও অন্যান্য প্রাসাদ আর মসজিদগুলিও এসময় নির্মিত হয়েছিলো। রাজপরিবার ও আশ্রিতদের জন্য দুর্গের উত্তরদিকে নির্মাণগুলি রাখা ছিলো।
বালা হিসার দেউড়ির রক্ষী ছিলেন অ্যাবিসিনিয়া থেকে আসা সৈন্যদের বাহিনী। ঐ পথ দিয়ে ঢুকলেই শুরু হয়ে যেতো হাবসি সৈন্যদলের এলাকা। নাম, হাবসি কমান। ভিতরে প্রথমেই একটি খিলান দেউড়ি রয়েছে। যার নাম 'তালি ফটক' বা Clapping Pavilion। ওখানে দাঁড়িয়ে তালি দিলেই সুদূর পাহাড় শিখরে বারাদরির রক্ষীরা শুনতে পেতেন সেই শব্দ। তার সামনে স্থাপন করা হয়েছে একটি সেকালের কামানের নমুনা। বাঁদিকে বাদশাহি আশুরখানা। ফতেহ দরওয়াজা আর মুসা বুর্জের মাঝামাঝি যে বিশাল প্রাসাদের অবশেষ দেখা যায় সেটি দিওয়ান মহল। সেখানে মীর জুমলা মহম্মদ সয়ীদ থাকতেন। পরবর্তীকালে তা মদন্না-অক্কান্নার বাসভবন হয়ে যায়। ডানদিকে চলে গেছে গোলকোণ্ডা কিলার বিশ্বখ্যাত মিনাবাজার, নগিনাবাগ। যেখানে ছিলো এদেশের সব চেয়ে বিলাসবহুল ও মূল্যবান রত্নসামগ্রীর বিপণীগুলি। নগিনাবাগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুলতানের অনুগত সেনাধ্যক্ষ আব্দুল রজ্জাক লারি'র নাম। যিনি শেষ পর্যন্ত মুঘল সৈন্যদের প্রতিরোধ করেছিলেন। তাঁকে আহত, মুমূর্ষূ অবস্থায় নগিনাবাগেই পাওয়া গিয়েছিলো। তিনি সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন। স্থানীয় লোককথার সূত্রে লারি একজন প্রবাদপ্রতিম বীর হয়ে যান। হাবসি কমান ধরে সোজা পশ্চিমদিকে গেলেই প্রথমে হাতিশালা আর অতিথিশালার টানা কাতার। বালা হিসার দরওয়াজা পেরোলেই টানা রাস্তার বাঁদিকে রয়েছে সিলাহখানা বা অস্ত্রাগার। সিলাহখানার ডানদিকে ছিলো সেনাবাস। তৃতীয় প্রাকারটি পর্যন্ত সেটি বিস্তৃত ছিলো। অস্ত্রাগার পেরোলেই দুর্গের 'অন্দরমহল' শুরু হয়ে যেতো। সিলাহখানার বিপরীতদিকে একটি প্রাচীন মসজিদের অবশেষ পাওয়া যায়। তার পর থেকে দেখা যাবে একের পর এক বিস্তৃত অঙ্গন। রাজপ্রাসাদের পূর্বদিকে একটি সমতল স্থান রয়েছে যেখানে সুলতান সৈন্যদের অভিবাদন গ্রহণ করতেন। তাকে ময়দান-এ-জিল্লুখানা -ই আলি বলা হতো। তাত্ত্বিকভাবে সৈন্যরা ঐ মসজিদের সামনে আল্লাহ তালার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতেন। কিন্তু সেখানে সুলতান নিজে উপস্থিত থাকার জন্য তিনিও একসঙ্গে অভিবাদিত হয়ে যেতেন।এর দক্ষিণদিকেই বিখ্যাত মদন্না-অক্কন্নার প্রাসাদ ও প্রশাসন ভবন। কুতুবশাহি সাম্রাজ্যের আর্থিক মেরুদণ্ডের ভিত্তি ভবনগুলি। আর ছড়ানো ঘাসজমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট্টো, কিন্তু নয়নাভিরাম প্রার্থনা ভবন, তারামতী মসজিদ। এই নির্মাণগুলো পেরিয়ে এগোলেই শুরু হয়ে যায় গোলকোণ্ডার সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থাপত্য ও জেল্লাদার অংশ। মূল রাজপ্রাসাদটির আবাসিক অংশ এখান থেকেই আরম্ভ হয়। এই অট্টালিকাগুলি দোতলা থেকে ছ'তলা পর্যন্ত উঁচু। হারেম, সরাই, ঘরের পর ঘর,অন্তঃপুর, বিশাল হলঘর, ফোয়ারা, ঝিল সব কিছু নিয়ে সেকালের স্থপতিদের শিল্প ও নির্মাণকৌশল এখনও দর্শকদের মুগ্ধ করে। সমগ্র রাজপ্রাসাদ মহার্ঘ গালিচা, বাতিদান, বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, পর্দা দিয়ে সাজানো ছিলো। গোলকোণ্ডা দুর্গ দখল করার পর অওরঙ্গজেব সেখানে বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তিনি এতো বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকতে পছন্দ করতেন না।
একটি বিশাল অঙ্গন ঘেরা রানিমহল থেকেই দুর্গের জনানামহল শুরু হয়ে যায়। অঙ্গনের ঠিক মাঝখানে একটি সুরম্য ফোয়ারা। আয়তাকার ক্ষেত্রটিকে ঘিরে দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সারিসারিপ্রাসাদ আর অট্টালিকা। একের পর এক দেখা যাবে রাজসিক প্রাসাদ আর তার ভিতরের বিশাল আর্চদেওয়া ঘরদুয়ার। একের ভিতর দিয়ে অন্যটি চলে যাচ্ছে।
গোলকোণ্ডা দুর্গের স্থপতিদের আরেকটি বিস্ময়কর কীর্তি এই জলসম্পদে কৃপণ প্রকৃতি থেকে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা করা। পাঁচ কিমি দূরে অবস্থিত দুর্গমচেরুভু ( গোপন জলাশয়) থেকে তাঁরা জল প্রবাহিত করে আনার কৌশল আয়ত্ব করেছিলেন। আরও চমকপ্রদ ছিলো নিচে থেকে চারশো ফুট উপরে জল তোলার প্রযুক্তি।
বালা হিসার ওঠার সিঁড়ি এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়। পাহাড় চড়ার পাথরের ধাপগুলি ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে উপরে। মাঝামাঝি জায়গায় সম্প্রতি একটি দেবীমন্দির তৈরি হয়েছে। এটি অর্বাচীন নির্মাণ। তার দুদিকে দুটি বিশাল গ্র্যানাইট পাথরের প্রাকৃতিক স্তম্ভ অজানা রহস্যে সোজা ,সন্তুলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পরেই রয়েছে বিশাল অম্বরখানা বা শষ্যাগার। আর একটু উপরেই রাজপরিবারের প্রার্থনার জন্য ইব্রাহিমশাহের তৈরি করা মসজিদটি। এর স্থাপত্য মূলত বাহমনি মেহরাবের ধরনে হলেও পরবর্তীকালে এই নির্মাণে কুতবশাহি মিনারগুলি যোগ করা হয়েছিলো। মানে চোদ্দো শতক থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত ক্রমপর্যায়ে এর নির্মাণ হয়েছিলো। পাহাড়ের শিখরে বালা হিসারের শীর্ষ প্রাসাদ ‘বারাদারি’ দেখা যায়। এখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত সমগ্র উপত্যকাটি নির্বাধ দেখা যায়। 'বারাদারি' শব্দের অর্থ বারোটি দুয়ার দেওয়া উদ্যানভবন। কিন্তু এর অর্থসম্প্রসারণ ঘটে গেছে সময়ের সঙ্গে। এই প্রাসাদটি দোতলা । এর শীর্ষে রয়েছে সুলতানের মসনদ বা সিংহাসন। সেখানে বসে তিনি আয়েশ করে পারস্যের শিরাজি সেবন করতে করতে নিজের রাজ্যদর্শন করতেন। এই সমস্ত নির্মাণের স্থাপত্যের প্রধান অবলম্বন ছিলো বিশাল মাপের, নানা আকারের গ্রানাইট পাথরের চাঁই। দুর্গের নিরাপত্তাই ছিলো প্রধান শর্ত। তাই তা নিয়ে কোনও ঝুঁকি নেওয়া হতোনা। বালা হিসারের এক কোণে একটি বৃহৎ সুড়ঙ্গের খোঁজ পাওয়া যায়। সংকটকালে রাজপরিবার এই সুড়ঙ্গটি দিয়ে আট কিমি দূরের গোশামহল নামে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে পারতেন। এখন সেটি বন্ধ আছে।
য়ুরোপে গোলকোণ্ডার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো তার হিরের সম্ভার থেকে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম হিরেগুলোর মধ্যেও প্রধানতম হিরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো গোলকোণ্ডা রাজ্যের হিরেখনি থেকে। দরিয়া-ই-নূর, নূর-উল-আইন, কোহ-ই-নূর, হোপ, রিজেন্ট এবং উইটেলসবাখ নামের হিরেগুলির জন্মস্থান গোলকোণ্ডার হিরেখনি। সামগ্রিকভাবে সম্পন্নতা ও জাঁকজমকের বিচারে মুঘল ভারতে গোলকোণ্ডার স্থান হয়তো খুব একটা উপরে নয়। কিন্তু তাকে জেল্লা মহিমা দিয়েছিলেন ফরাসি হিরে ব্যবসায়ী ত্যাভার্নিয়র। যাঁর কথা আগেই লিখেছি। দেশীয় কথকদের থেকে অনেক বেশি রঙিন করে গোলকোণ্ডার কুতবশাহি রাজত্বের শীর্ষপর্বটি তিনি বর্ণনা করেছিলেন । নিজে কতোটা বিজড়িত ছিলেন, বলা শক্ত। কারণ এ বিষয়ে তিনি বিশেষ ঝেড়ে কাশেননি। তবে ত্যাভার্নিয়র সাহেব হিরে ছাড়াও আরেকটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর লেখায় বিশদ এসেছে গোলকোণ্ডার নগরবধূদের গল্প। গণিকা বা নর্তকী, যে পেশাতেই তাঁরা থাকুন না কেন, সাহেবের নেকনজর এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাঁর হিসেবে মতো ঐ শহরে অন্তত বিশ হাজার জনবধূ কর্মরত ছিলেন। এই মহিলাকুলের সংযোগ ছিলো শৌণ্ডিকদের সঙ্গে। সুরাব্যবসায়ী আর জনপদ ললনাদের প্রাচুর্য শুধু ত্যাভার্নিয়র নয়, তাঁর স্বদেশীয় জাঁ দ্য থিবিওঁকেও বিস্মিত করেছিলো। তাঁরা ঐ আবহে নিজেদের বেশ 'মুক্ত' মনে করতেন। সাহেবের বর্ণনা অনুযায়ী পুরুষ-নারী নির্বিশেষে গোলকোণ্ডার জনসাধারণ ছিলেন সুদর্শন, সুঠাম, মোটামুটি গৌরবর্ণ। কৃষিজীবী মানুষজন অবশ্য শ্যামবর্ণই হতেন।
(…All the people of Golconda, both men and women, are well proportioned, of good stature, and of fair countenances, and it is only the peasantry who are somewhat dark in complexion.)
তাঁদের পোশাক-আশাকও মুগ্ধ করেছিলো ত্যাভার্নিয়রকে। ব্যবসার খাতিরে তাঁকে সারাদেশে আসাযাওয়া করতে হতো। কিন্তু গোলকোণ্ডাই ছিলো তাঁর প্রথম প্রেম। সুলতানি সংস্কৃতির টান তাঁর ক্রমশ বেড়েই চলেছিলো। একটি স্থানীয় মাছের পদ ছিলো তাঁর অবশ্যভক্ষ্য।
“….As there are numerous *tanks*, there is also an abundance of good fish, and you find more particularly a kind of smelt, which has but one bone in the middle and is of very delicate flavour.”
(Tavernier)
হায়দরাবাদ শহর তখন নির্মিত হচ্ছে। বছর পঞ্চাশ বয়স। চারমিনার এবং তার চারদিকে তৈরি হওয়া হর্ম্যসারিরা ত্যাভার্নিয়রকে ভালো লাগাকে বেঁধে রাখতো। হায়দরাবাদের প্রশস্ত রাজপথগুলি, তার উদ্যান , মুসিনদীর উপর নবনির্মিত সেতুগুলি, সব মিলিয়ে তিনি এককথায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতেন। আর যদি প্রসঙ্গ ওঠে গোলকোণ্ডা কিলার, তবে সাহেবের অন্তহীন প্রশস্তির জন্য তৈরি থাকতে হবে।
ত্যাভর্নিয়র বন্দর আব্বাস থেকে এদেশে এসে নেমেছিলেন মসুলিপতনম বন্দরে। প্রথমে গিয়েছিলেন ম্যাড্রাস। তখন সে জায়গা ছিলো ইংরেজদের অধীনে। সেখান থেকে তিনি গান্দিকোটে গোলকোণ্ডা রাজত্বের প্রধান ওমরাহ মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করেন। তারপরেই তাঁর প্রথম গোলকোণ্ডা যাত্রা। আবার সুরত থেকে ফেরার পথে হিরেখনি, বর্তমান কুর্নুলের কাছে রাওলকোণ্ডা, হয়ে এসেছিলেন গোলকোণ্ডায়।
সেকালের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির মধ্যে গোলকোণ্ডা ছিলো একমাত্র সম্পন্ন শহর যা কোনও নদী বা সমুদ্রের তীরে অবস্থিত ছিলোনা। কিন্তু ঐ শহরের জৌলুস এতোই বেশি ছিলো যে সারা পৃথিবী থেকে বণিকরা হয় সুরত বা মসুলিপতনম বন্দর হয়ে তাঁদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে এখানে আসতেন। লক্ষনীয় ব্যাপার, এতো দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা বণিকদের নিরাপত্তার অভাব ছিলোনা। মধ্যভারতের কুখ্যাত দস্যু ও ঘাতকদের সুলতান নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন। প্রথম দিকে গোলকোণ্ডার কাছাকাছি রাস্তাঘাট বিশেষ সুগম ছিলোনা। বিশেষত নদীর উপর কোনও সেতু ছিলোনা। সব কিছু সত্ত্বেও বণিকরা দেশের সব চেয়ে সমৃদ্ধ শহরটিতে বাণিজ্যের সুযোগ অবহেলা করতে পারতেন না।
শুধু হিরে নয়, গোলকোণ্ডার খনি থেকে গার্নেট,পোখরাজ, নীলা, অ্যাগেট প্রভৃতি নানা মূল্যবান পাথর পাওয়া যেতো। শুধু মুক্তো আমদানি করা হতো পারস্য থেকে। গোলকোণ্ডার কারিগরদের মণিকার হিসেবে সারা পৃথিবীতে খ্যাতি ছিলো।
১৬৪৫ সালে ত্যাভার্নিয়র যখন প্রথম গোলকোণ্ডায় এসেছিলেন তখন চারমিনারের উত্তরে আর গোলকোণ্ডার দক্ষিণে মুসি নদীর অন্যপারে 'কারওয়ান' নামের একটি গ্রামে কুতুবশাহি মণিরত্নশিল্পের মূল কেন্দ্রটি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর মতে অসংখ্য শিল্পী ও কারিগর এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় কোল্লুর নামের হিরে খনিতে ষাট হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এই খনি থেকেই ত্যাভার্নিয়র ১৬৫৬ সালে একটি আকাট ৭৮৭ কারাটের হিরে উদ্ধার করে সুলতান আবদুল্লাহ শাহকে দিয়েছিলেন। গোলকোণ্ডার প্রধান মন্ত্রী বা মীর জুমলা এই হিরেটি উপহার দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজহানকে। ত্যাভার্নিয়র সাহেব ১৬৬৫ সালে অওরঙ্গজেবের কোষাগারে এই হিরেটিকে আবার একবার দেখেছিলেন। তখন তার নাম কোহ-ই-নূর। এই হিরেটির ইতিহাস রোমহর্ষক। সম্প্রতি ড্যারিম্পল সাহেব তাকে নিয়ে একটা দারুণ বই লিখেছেন।
গোলকোণ্ডা দুর্গকে কেন্দ্র করে কুলি কুতবশাহি রাজত্বকে গড়ে তুলেছিলেন ইব্রাহিম শাহ। তিনি দুর্গটিকে শুধু যে সম্প্রসারিত করেছিলেন তাই নয়, তাকে দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। তার ফলেই অওরঙ্গজেবের বিপুল সৈন্য বাহিনীকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিলো সুযোগের অপেক্ষায়। তাঁদের মূল ছাউনি ছিলো গোলকোণ্ডা থেকে বেশ দূরে একটি প্রান্তরে । যার আজকের নাম ফতেহ ময়দান। তবু হয়তো গোলকোণ্ডা অপরাজেয় থেকে যেতো। কিন্তু 'আপন'জনদের বিশ্বাসঘাতকতা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াও তাকে মনের মতো করে সাজিয়ে তুলেছিলেন ইব্রাহিম শাহ। সাফা মসজিদ ও দওলতখানা-এ-আলি'র নির্মাণও হয়েছিলো তাঁরা শাসনকালে। ঐতিহাসিক ফিরিশতা লিখেছেন তাঁর সময় গোলকোণ্ডাকে প্রায় নতুন করে নির্মাণ করা হয়। প্রজাদের জন্য তিনি বহু লঙ্গরখানা, জলাশয়, মসজিদ, মদ্রাসা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমির-ওমরাহরা তাঁদের উদ্যানঘেরা সুরম্য প্রাসাদগুলিও নির্মাণ করেছিলেন দুর্গপ্রাকারের ভিতরেই। প্রশস্ত রাস্তাঘাট, ঝলমলে পণ্যবিপণী, যাবতীয় সুযোগসুবিধেসহ ছবির মতো একটি অপরূপ দুর্গশহর ছিলো গোলকোণ্ডা। গোলকোণ্ডার বাজারে সারা পৃথিবীর সেরা পণ্যগুলি সাজানো থাকতো।
১৬৫৬ সালে প্রথম মুঘল আক্রমণের পর সুলতান অবদুল্লাহ শাহ উত্তর পূর্ব কোণে একটি নতুন কেল্লা নির্মাণ করেন। তার নাম নই কিলা। সেটি ছিলো দুর্ভেদ্য। মুঘলরা সেদিক দিয়ে দুর্গজয়ের চেষ্টাই করেননি। তাঁরা ফতেহ দরওয়াজার দিক দিয়েই আক্রমণ করেছিলেন।
মীর মহম্মদ সয়ীদ ছিলেন সুলতানের মীর জুমলা বা প্রধান সেনাধ্যক্ষ। তাঁর রণকৌশল ও বীরত্ব ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর আমলে গোলকোণ্ডার সাম্রাজ্য বিরাটভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিলো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অহংকারী এবং উচ্চাভিলাষী। তা ছাড়াও মুঘল বাদশাহ শাহজহানের অনুগত ছিলেন। এই জন্য তিনি বহুসময়েই সুলতানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতেন। তাঁর বিলাসপ্রিয়তা সুলতান আবদুল্লাহ শাহ সুনজরে দেখতেন না। একবার একবার সুরা উন্মত্ত অবস্থায় মীর জুমলার পুত্র মহম্মদ আমিন রাজসভায় সুলতানের সিংহাসনের উপর বমন উদগার করে ফেলেন। এই অবমাননা আবদুল্লাহ শাহের পক্ষে বরদাস্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সুলতান মীর জুমলার পুত্রকে কারারুদ্ধ করেন। প্রতিশোধ নেবার জন্য মীর জুমলা মুঘল বাদশাহকে অভিযোগ জানান। বাদশাহ এই রকম একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি গোলকোণ্ডা আক্রমণ করার ছল খুঁজে পেলেন। ১৬৫৬ সালে অওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে মুঘলরা প্রথমবার গোলকোণ্ডা আক্রমণ করলো। সেযাত্রা নিরুপায় আবদুল্লাহ শাহকে প্রচুর রাজস্ব ও সম্পদের বিনিময়ে অওরঙ্গজেবের থেকে সন্ধি ক্রয় করতে হয়েছিলো। সুলতান আবদুল্লাহ শাহ মুঘল বাদশা শাহজহানকে 'পেশকশ' হিসেবে দিয়েছিলেন রত্নসম্ভার, সোনা,হাতি, ঘোড়া, ইত্যাদি বহু কিছু। তা ছাড়া তাঁর কন্যা পাদশাহ বিবি সাহিবার বিবাহ দিতে হয়েছিলো অওরঙ্গজেবের বড়ো ছেলে মহম্মদ সুলতান মির্জার সঙ্গে।
কুতবশাহি রাজবংশের শেষ সুলতান আবুল হাসান তানা শাহ ছিলেন অন্যধরনের মানুষ। তিনি ঠিক তুর্কো-ইরানি রক্তপিপাসু রাজকীয় ঐতিহ্যের অংশীদার ছিলেন না। তাঁরা বাল্যকাল বিষয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়না। এটা ঠিক যে তিনি কুতবশাহি রক্তের উত্তরাধিকারী ছিলেন, কিন্তু বাকি বিশদ কিছু জানা যায়না। আবুল হাসান ছিলেন বিখ্যাত সুফি সন্ত শাহ রজিউদ্দিন হুসেইনি, যিনি শাহ রাজু কওত্তল নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁর অনুগত শিষ্য। তিনি তাঁর গুরুর সঙ্গে রাজকীয় জাঁকজমক ভরা জীবন ত্যাগ করে নিস্পৃহ জীবন যাপন করতেন। শাহ রাজু ছিলেন সুলতান আবদুল্লাহ শাহের শ্রদ্ধেয় গুরু। হায়দরাবাদের সুলতান থেকে পথের ভিক্ষুকরাও সন্ত শাহ রাজুর নিবেদিত ভক্ত ছিলেন। আবদুল্লাহ শাহের নিজের কোনও পুত্র সন্তান ছিলোনা। গুরুর আদেশে তিনি আবুল হাসানকে জামাতা পদে বরণ করেন। ফলে কুতবশাহি পরম্পরা অনুসারে আবুল হাসান সুলতানের পদ লাভ করেন। অবশ্য ব্যাপারটা অতোটা সহজ ছিলোনা।খোদ অওরঙ্গজেবের বড়ো ছেলে মহম্মদও আবদুল্লাহ শাহের জামাই ছিলেন। মুঘলদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তাঁরই গোলকোণ্ডার মসনদ পাবার কথা ছিলো। কিন্তু যখন তাঁর পিতা অওরঙ্গজেব, তাঁর পিতামহ শাহজহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তখন যুবরাজ পিতার বদলে পিতামহকে সমর্থন করেছিলেন। ফলে মহম্মদকে সারাজীবনের জন্য কারারুদ্ধ হতে হয়েছিলো। ফলে তাঁর নসিবে আর গোলকোণ্ডার মসনদ লাভ লেখা ছিলোনা। আবুল হাসান শাহের বাল্যকালেই শাহ রাজু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই ছেলে চোদ্দো বছরের জন্য সুলতান হবেন। আপাতভাবে অসম্ভব এই ঘটনা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছিলো।
আবাল্য গুরু শাহ রাজুর তত্ত্বাবধানে থাকার ফলে আবুল হাসানের মধ্যে একধরনের গভীর আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও করুণার প্রবণতা দেখা যেতো। তাঁর এই স্বভাবের জন্য তিনি গোলকোণ্ডার অভিজাত ও নিম্নবর্গীয় সমস্ত জনতার কাছে প্রিয় ছিলেন। ১৬৭২ সালে সুলতান আবদুল্লাহ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা সৈয়দ আহমেদ সিংহাসনের দাবি করেন। কিন্তু গোলকোণ্ডা দরবারের সমস্ত আমির-ওমরাহরা অবিসম্বাদিতভাবে আবুল হাসানকে সমর্থন করেন। ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর সিংহাসন লাভ ঘটে।
ক্ষমতা অধিকার করার পর আবুল হাসানের সামনে চ্যালেঞ্জটি ছিলো বেশ বড়ো। ঐ পরিস্থিতিতে গোলকোণ্ডার কুতবশাহির গৌরব ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন কাজ ছিলো। দিনে দিনে মুঘলদের দেয় পেশকশের মাত্রা আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আদায় বাড়াতে গেলে যতোটা নির্মম হতে হয়, তা সুলতানের না-পসন্দ। অথচ নতুন সুলতানের থেকে সবার প্রত্যাশা অন্তহীন। তিনি মদন্না আর অক্কন্না নামে হানমকোণ্ডার দুই ব্রাহ্মণ ভাইকে গোলকোণ্ডার আর্থিক স্থিতি শুধরাবার জন্য নিযুক্ত করলেন। তাঁদের মর্যাদা ছিলো মীর জুমলার সমান। তাঁদের প্রসঙ্গ এই লেখায় আগেই এসেছে। এই দুই ভাইকে এতো উচ্চ পদ দেবার বিরুদ্ধে কুতবশাহি অভিজাতশ্রেণী সরব হয়েছিলেন। কিন্তু আবুল হাসান তাঁর গুরুর নির্দেশে ছোটোবেলা থেকেই উদার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। বাল্যকালে তাঁর মধ্যে একধরনের নিস্পৃহ আধ্যাত্মিকতা লক্ষ করে গুরু শাহ রাজু তাঁকে 'তানা শাহ' বা শিশু সন্ত বলে সম্বোধন করতেন। আবার তাঁকে আদর করে 'তানি শাহ' বা উদার রাজা বলেও ডাকতেন। ছোটোবেলা থেকেই তিনি খুব ভালো গান গাইতেন। গুরু তাঁর কাছে সুফি প্রার্থনাসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হতেন। তিনি সুলতান থাকার সময় দেশে সাহিত্যসংস্কৃতি চর্চার জোয়ার আসে। ধর্মসমন্বয় ছিলো তাঁর প্রিয়তম চর্চা। তেলুগু ভাষাকে তিনি ফার্সির সঙ্গে রাজভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গীতপ্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অওরঙ্গজেবের চক্ষুশূল ছিলো। তিনি প্রচার করতেন আবুল হাসান একজন সংকীর্ণ, রিপুপ্রবণ, খলস্বভাব, বিধর্মী কাফির। বাদশা নিজেই ঘৃণাসহকারে বলতেন আবুল হাসানের স্বভাবের নীচতা, চরিত্রহীনতা বর্ণনার অতীত। অওরঙ্গজেব দাবি করতেন একজন সচ্চা মুসলিম ও আল্লাহের সেবক হিসেবে সুলতান আবুল হাসানকে বিনাশ করা তাঁর নৈতিক দায়িত্ব। বাদশাহের ইচ্ছায় মুঘল ঐতিহাসিকরা তাঁদের রচনায় 'তানাশাহি' নামে একটি প্রতীক সৃষ্টি করেছিলেন। যার আরোপিত অর্থ অনুশাসন ও যুক্তিহীন নিষ্ঠুর রাজার শাসনব্যবস্থা। এখনও হিন্দি ও উর্দু ভাষায় এই অর্থে প্রতিশব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর রাজত্বে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, সবার কাছে সুলতান আবুল হাসান তানা শাহ চিরকাল হৃদয়সম্রাট হয়ে থেকে গেছেন। এমন কি আজকের দিনেও একজন হায়দরাবাদি তহজিবের বিশ্বস্ত অনুগামীর কাছে তানা শাহ ইতিহাসের এক অনন্য নায়ক। কুতবশাহি শাসন পতনের পর মুঘল সৈনিকরা গোলকোণ্ডার অধিবাসীদের যেভাবে লুঠতরাজ এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো, তার সামনে নাদির শাহের অত্যাচারও ম্লান হয়ে যায়। বিখ্যাত কবি নেমত খান আলি, নিজে মুঘলসংস্কৃতির অংশ হলেও লিখেছিলেন,
"হায় আল্লাহ, পয়গম্বর নূহের দিব্যি,
গোলকোণ্ডায় করা আমাদের অত্যাচারের অপরাধে
আরেকবার মহাপ্লাবন আসুক।।"
গোলকোণ্ডার মানুষ এই নৃশংসতার স্মৃতি কখনও ভোলেননি। অওরঙ্গজেব যেমন সুলতান আবুল হাসান তানা শাহের উদার মানবতাবোধকে 'তানাশাহি' নাম দিয়ে অপমান করতেন, তেমনই গোলকোণ্ডার মানুষ যেকোনও অত্যাচার, অনাচারকে অওরঙ্গজেবের নামে 'আলমগিরি' নাম দিয়ে ঘৃণা করেন।
মুঘলদের চাপে বিপর্যস্ত কুতবশাহিরা বিকল্প ভাবতে শুরু করলেন। মদন্না ছত্রপতি শিবাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। শিবাজী ও সুলতান একটি চুক্তির মাধ্যমে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। শিবাজী কর্ণাটকের যে অংশটি তাঁর পিতার অধিকারে ছিলোনা, তার অধিকার সুলতান তানা শাহকে দিয়ে দিলেন। উপরন্তু সুলতান আবুল হাসান মুঘলদের বিরুদ্ধে বিজাপুরের সুলতান সিকন্দর আলি শাহকে সাহায্য করার কথা দিলেন। অওরঙ্গজেব সব খবরই রাখতেন। ক্রমশ তাঁর ক্রোধ বেড়ে উঠছিলো। ১৬৮৩ সাল থেকে তানা শাহ মুঘলদের অন্যায় রাজস্বের দাবি অস্বীকার করে পেশকশ দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। ১৬৮৫ সালে যুবরাজ আজমের নেতৃত্বে মুঘল ফৌজ বিজাপুরকে 'শিক্ষা' দিতে অগ্রসর হলে সুলতান আবুল হাসান মুঘলদের বিরুদ্ধে বড়ো ফৌজ পাঠিয়ে দিলেন। এর পরেই মুঘল বাদশা যুবরাজ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে কিলিচ খানকে সেনাপতি করে গোলকোণ্ডা আক্রমণ করার আদেশ দিলেন।
১৬৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিশাল মুঘল বাহিনী গোলকোণ্ডা যাত্রা করলো। আবুল হাসান তানা শাহ হায়দরাবাদ ছেড়ে তখন গোলকোণ্ডা দুর্গে বাস করছেন।যুবরাজ মোয়াজ্জেম সুলতানের কাছে দুটি দাবি জানালেন। প্রথমটি, অবিলম্বে দু লাখ হুন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অন্যটি মদন্না ও অক্কান্নাকে বরখাস্ত করে শাস্তি বিধান করতে হবে। সুলতান রাজি হলেন না। তিনি নজরানা হিসেবে উনষাটটি থালা ভরে হিরে জহরাত মুঘলদের পাঠিয়ে দিলেন। মুঘল সেনা অস্থায়ীভাবে চাপ কমাতে রাজি হলো। ইতোমধ্যে মদন্না ও অক্কন্নাকে রাজকীয় পাচক জমশীদ বিষপ্রয়োগে হত্যা করে ফেলেছে। বিজাপুরকে দমন করে ততোদিনে মুঘল সেনাদল পূর্ণ শক্তিতে গোলকোণ্ডা জয়ের লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। শেষ পর্যায়ের যুদ্ধ শুরু হতে আর দেরি হলোনা। মুঘল বাহিনী একশোটি কামান দিয়ে গোলকোণ্ডা কিলা ঘিরে ফেললো। তাঁরা জানতেন গোলকোণ্ডার দুর্ভেদ্য গ্র্যানাইট প্রাকার ধ্বস্ত করা সহজ কাজ নয়।কুতবশাহির তোপদারও তাঁর বিশাল রাহবান, ফতে রাহবার আর আঢ়দাহা পাইকার কামানগুলি সাজিয়ে ফেললেন মুঘল বাহিনীর দিকে তাক করে। প্রথম দুটি কামান থেকে একবারে পঁয়ত্রিশ কিলো, অর্থাৎ এক মণ ওজনের গোলা দাগা যেতো। শেষ কামানটির গোলার ওজন ছিলো পঞ্চাশ কিলো। মুঘলদের গোলাবাজির বিরুদ্ধে পেটলা বুর্জ থেকে গোলকোণ্ডার তোপদারদের গোলাবর্ষণও চলতে থাকলো। সাকি মুস্তাদ খানের বর্ণনা অনুযায়ী মুঘলদের উপর রাতদিন বাঁশের রকেটও ছোঁড়া হচ্ছিলো। এর মধ্যে ঘোর বর্ষার কারণে পাশের মঞ্জীরা নদীতে বান এসে গেলো। মুঘল বাহিনীর রসদে টান, হাতিঘোড়ার দল মারা যাচ্ছে, সৈন্যদেরও তথৈবচ অবস্থা। অওরঙ্গজেব বিপদে পড়ে প্রায় ছত্রভঙ্গ সেনাদলকে গুছিয়ে নিতে কাঠ আর কাদা দিয়ে ছাউনি তৈরি করতে প্রস্তুত হলেন। তাঁর আশংকা ছিলো যে কোনও সময় গোলকোণ্ডা দুর্গ থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে এসে তাঁদের বিনাশ করতে পারে।
কিন্তু দুর্গ থেকে কুতবশাহি ফৌজ বেরিয়ে এলোনা। তাঁদের অবিরাম গোলাবর্ষণে নিহত হলেন একজন প্রধান মুঘল সেনাপতি কিলিচ খান খ্বাজা আবিদ সিদ্দিকি। সব রকম প্রয়াস করেও মুঘল সৈন্য গোলকোণ্ডা কিলার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনও রকম ফাঁকফোকর খুঁজে পাচ্ছিলো না। শেষে অওরঙ্গজেব রাতের আঁধারে প্রাকারের গায়ে ভারা বেঁধে দুর্গের ভিতরে হক্কা (গ্রেনেড) ছুঁড়তে লাগলেন। তাতেও বিশেষ লাভ হলোনা। মুঘলবাহিনীর রসদ ফুরিয়ে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হলো। ভাগ্যক্রমে শেষে মুঘল নৌবাহিনীর সেনাপতি মুনাব্বর খান নদীপথে রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু গোলকোণ্ডার প্রাকার তখনও মুঘলদের কাছে দুর্ভেদ্য।
সরাসরি যুদ্ধে সুবিধে করতে না পেরে মুঘল বাহিনী অন্য পন্থা নিলো। দুর্গের ভিতরের 'বিশ্বাসঘাতক'দের সাহায্য নেবার চক্রান্তে তাঁরা জয়ী হলেন। ১৬৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরন্দাজ খান নামে একজন কুতবশাহি সৈন্য মুঘলদের দুর্গের পিছন দিকে একটি গোপন পথের সন্ধান দিয়ে দিলেন। নিহত সেনাধ্যক্ষ কিলিচ খানের পুত্র ঘাজিউদ্দিন খান সিদ্দিকি ফিরুজ জঙের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী গোলকোণ্ডার ভিতর ঢুকে পড়লে কুতব শাহি আর মুঘল সৈন্যদের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। ১৬৮৭ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর আবদুল পন্নি নামে একজন আফঘান সৈন্য ফতেহ দরওয়াজা খুলে দেওয়ায় বন্যার মতো মুঘল সৈন্যরা বালা হিসারের অন্দরমহল প্লাবিত করে দিলো। তাদের হাতে সুলতান আবুল হাসান শাহ গ্রেফতার হয়ে গেলেন। ফিরুজ জং কোল্লুর রত্নখনিরও দখল নিয়ে ফেলেছিলেন। কিলার ভিতরে কুতবশাহি ফৌজকে নিরস্ত্র করে ফেলার পর অওরঙ্গজেবের পুত্র মোয়াজ্জম খান ফতেহ দরওয়াজা দিয়ে গোলকোণ্ডা দুর্গে প্রবেশ করলেন। আত্মসমর্পণের শর্ত হিসেবে তানা শাহ অওরঙ্গজেবকে যে হিরেগুলি নজরানা দিয়েছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম নূর-উল-আইন, দরিয়া-এ-নূর, কারা, হোপ, উইটেলসবাখ আর রিজেন্ট।
গোলকোণ্ডা দুর্গে কুতবশাহি রাজবংশের দিন চিরতরে শেষ হয়ে গেলো। সুলতান আবুল হাসান তানা শাহের কারাদণ্ড হলো দৌলতাবাদ দুর্গে। বারো বছর কারা অন্তরালে থাকার পর তাঁর ইন্তেকাল হল ১৭০০ সালে। তাঁর শবদেহ কুতবশাহি সমাধিক্ষেত্রে জায়গা পায়নি। মুঘলরা দৌলতাবাদ আর অওরঙ্গাবাদের মাঝখানে খুলদাবাদে তাঁকে সমাহিত করেছিলো।
আমার দীর্ঘ হায়দরাবাদ বসবাসপর্বে গোলকোণ্ডা দুর্গ ছিলো আমার নিয়মিত গন্তব্য। আমার বাড়ি থেকে দফতর যাওয়ার পথে ছিলো টোলি চওকির মোড়। গোলকোণ্ডা যাবার পথ সেখান থেকেই শুরু হয়। দুদণ্ড ফুরসত পেলেই ঐ ধ্বংসাবশেষের গভীরে, আনাচেকানাচে কোথায় কী সুর বাজে, খুঁজতে যেতুম। অন্ধকার হারেমের কোঠি থেকে সহস্র বাদুড় উড়ে যেতো আলোর দিকে। আবার ফিরেও যেতো আরও বেশি অন্ধকারে। পর্যটকের রাশি উপচে পড়তো শীতের দিনগুলোতে। অন্য সময়ও বিশেষ কমতি দেখা যেতোনা। কী দেখতে যায় এতো মানুষ? শুধু কি পর্যটন দফতরের প্রচারের আশ্বাসই তার লক্ষ? সত্যি কথা বলতে কি এদেশের গণনাহীন ভাঙাচোরা কেল্লাদের সঙ্গে ভেটমুলাকাত আর বিশেষ বাকি নেই আমার। বাঙালিরা যাতে বিজয়নগরকে যাতে ভুলে না যায় সেজন্য শরদিন্দু সর্ব শক্তি নিয়োগ করেছিলেন। গোলকোণ্ডার সে নসিব হয়নি। আমার মেহদিপতনমের বাড়ি থেকে সান্ধ্য পদচারণা করতে গিয়ে আসিফনগর পেরিয়ে মাঝে মাঝেই চলে যেতুম কারওয়ান মহল্লার সরু, বাঁকা রাস্তাগুলোর ধুলোর গন্ধ নিতে। গোলকোণ্ডার নগিনাবাগের মিনাবাজারে এখান থেকেই তৈরি হয়ে যেতো সেই সব হিরে জহরাতের চোখ ধাঁধানো সম্ভারগুলি । সারা পৃথিবীর রসিকরা ভিড় জমাতো সেখানে হিন্দুস্তানের শানশওকত অবলোকন করতে। এহেন নগিনাবাগেই পাওয়া গিয়েছিলো গোলকোণ্ডার অদম্য যোদ্ধা আব্দুল রজ্জাক লারির ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। সবাই যখন ছেড়ে পালাচ্ছিলো প্রভুকে , এই ফৌজি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে নমক কা ইজ্জত অদা করে গিয়েছিলেন। লোকে বলে, মেহর আলির মতো তাঁর রূহ ঘুরে বেড়ায় নগিনাবাগের সবুজ চৌকো কাটা ঘাসরেশম জমির প্রতিটা তৃণফলকে। আমিও চিনতে যেতুম সেই লোকটিকে যে রোজ-এ-কয়ামতের দিন বাদশা আলমগিরের দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করার হিম্মত রেখেছিলেন,
সব ঝুঠ হ্যাঁয়...