" মানুষ সচরাচর একজন শিল্পীকে সেই সঙ্গীতধারার সঙ্গেই চিহ্নিত করে যেখানে তিনি কিছু নতুন সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি খ্যয়াল শৈলীতেও যথেষ্ট তালিম নিয়েছি এবং নিয়মিত গেয়েও থাকি, কিন্তু শ্রোতারা আমাকে ঠুমরির রানি হিসেবেই দেখতে চায়। যদিও আমার মতে এই সম্মান শুধু সিদ্ধেশ্বরী দেবীই পেতে পারেন।"
সিদ্ধেশ্বরী দেবী – কাফি
এই স্বীকারোক্তি সেই শিল্পীর যাঁকে দীর্ঘকাল ধরে মানুষ ঠুমরি গায়নের শেষকথা বলে জেনেছে। নাম গিরিজা দেবী। নিকটজনের কাছে অপ্পাজি। শুধু খ্যয়াল নয়, যাবতীয় উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতধারার তিনি একজন দিগগজ শিল্পী ছিলেন। কিন্তু বনারসি ঠুমরি'র চিরন্তন দৈবী ত্রিভুজ বড়ি মোতিবাই, সিদ্ধেশ্বরীবাই এবং রসুলনবাইয়ের উত্তরাধিকারকে তিনি শুধু উপযুক্ত সম্মানই দেননি, তাকে বিবর্তিত করেছিলেন যুগধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে। এই কাজে তাঁর সাফল্য নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। তাঁকে নিয়ে চর্চা, মানে মূলত বনারসি ঠুমরি বা বৃহদর্থে ঠুমরি নিয়েই গুফতগু।
বড়ি মোতিবাই – পানি ভরে রে কওন অলবেলি-ভৈরবী
বনারসি গানের একটা অন্য ঐতিহ্য রয়েছে। শাস্ত্রীয় গায়নে লোকজ আবেগের উৎসার বনারসের মতো আর কোথাও দেখা যায়না। যদি শাস্ত্রীয় গায়ন, অর্থাৎ ধ্রুপদ, ধমার, চতুরঙ্গ,খ্যয়াল, ইত্যাদি সব ধারাতেই এই মাটির আঘ্রাণ এতো স্পষ্ট হয়, তবে উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত, অর্থাৎ, টপ্পা, ঠুমরি, দাদরা, কাজরি, হোরি, চৈতি, তরানা, ঘাটো ইত্যাদি শৈলীতে তো কথাই নেই। এইসব ধারার সব থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপায়ণ আমরা বনারসি বনাওটে খুঁজে পাই। এছাড়া অপ্রচলিত তিরওয়ত, সদরা, খামসা, লাওনি, কীর্তন, ভজন, কথাগায়ন, রামায়নগায়ন, রাগমালা, কব্বালি ইত্যাদি সব ধরণের সঙ্গীতধারাই বনারসে চর্চিত হয়েছে। এখানে কেতাবি শাস্ত্রীয়তা আর লোকজ সঙ্গীত কেতা চিরকাল সমান ইজ্জতের সঙ্গে মানুষের কাছে আদৃত রয়ে গেছে। গান শোনার জন্য বনারসের নানা ঠেকে তাঁরা জড়ো হ'ন। তা সে সংকটমোচন মন্দিরে হোক বা গঙ্গা উৎসবে, তুলসিঘাটের ধ্রুপদমেলা বা বালাজিমন্দিরে। শ্রোতাদের মধ্যে কেউ পানবিক্রেতা, কেউ রাবড়িওয়ালা, কেউ বিখ্যাত অধ্যাপক, কেউ বা বরিষ্ঠ রাজপুরুষ বা যজমান পুরোহিত, অথবা পরিচয়হীন, ধারালো, বনারসি ভবঘুরে পথের লোক। এমন কি তথাকথিত 'লপুয়া' 'লফঙ্গা' 'ইতর' সমাজের লোকজনকেও দেখা যাবে এককোণে মাটিতে বসে দাদ দিয়ে চলেছেন গানের সঙ্গে। সব মিলিয়েই ফুটে ওঠে বনারসি চাল। বনারসি অদার সঠিক এই ধরণ। লোকজ গানের সম্ভ্রম আর সম্ভ্রান্ত গানের লোকজ উল্লাস সবই বনারসে পরস্পর আলিঙ্গন করে চলে। এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারিনী গিরিজা দেবী'র গায়নেও বনারসি অদার ছাপ চিরকাল অতি স্পষ্ট বিরাজমান ছিলো।
রসুলন বাই – ভৈরবী - ফুল গেন্দওআ না মারো
'ঠুমরি' শব্দটি এসেছে 'ঠুমক' থেকে। নৃত্যাঙ্গনাদের একটা বিশেষ চলার ধরণকে ঠুমক বলা হয়। কেউ আবার বলেন লখনউ আর রামপুরের মাঝামাঝি একটা গ্রাম আছে এই নামে। 'ঠুমরি' গান সেখান থেকেই নাকি এসেছিলো। তবে তা নেহাতই শোনা কথা। ঠুমকচাল বস্তুত একটি শৃঙ্গারভঙ্গি।। ঠুমরি গায়ন, উদ্ভবকালে কথকনৃত্যের সুরসূত্র হিসেবেই গণ্য হতো। বয়সে তা নেহাৎ অর্বাচীন। লখনউ দরবারের নবাবরাই এই ধারাটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীত, লোকজ-গীতরীতি আর দরবারি নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে নাট্যরস সৃষ্টি করাই ছিলো রাজাগজাদের শৈল্পিক লক্ষ্য। পরবর্তীকালে স্বাধীন গীতশৈলী হিসেবেও ঠুমরি লোকমনে নিজস্ব স্থান করে নেয়। লখনউ দরবারে ঠুমরির রূপ ছিলো বোলবাট। অর্থাৎ কথকনৃত্যের নাট্যরসকে ফুটিয়ে তুলতে সঙ্গীত সহকারীর কাজ করতো। কিন্তু লখনউ দরবারের পতনের পর সেখানকার কলাবন্তরা বনারসে এসে, স্থানীয় গুণীদের সহভাগিতায় ঠুমরিকে যে নতুন রূপে সজ্জিত করেন তার সংক্ষিপ্ত নাম বোলভাও(ভাব) বা বোল বনানা। যে শৃঙ্গাররসকে লখনউ ধারায় মূলত নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো, বনারসে এসে সেই ভাব সম্পূর্ণভাবে সঙ্গীতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর নাম দেওয়া হয় পূরব অঙ্গ। যদিও সমস্ত ঘরানার শিল্পীরাই অল্পবিস্তর ঠুমরি গেয়ে থাকেন, কিন্তু ঠুমরির আদত ঘরানা বলতে লখনউ আর বনারস। ব্যক্তিগতভাবে আমার অতি প্রিয় বহু ঠুমরি এসেছে কিরানা বা পটিয়ালা ঘরের দেবতাদের থেকে, কিন্তু তাঁরা নিজস্ব কোনও ঠুমরি শৈলী তৈরি করেননি।
সিদ্ধেশ্বরী দেবী - মুরলিয়া কওন গুমানভরি
গিরিজা দেবী –পানি ভরে রে কওন
তিনি জন্মেছিলেন গতশতকের দ্বিতীয় দশকে বনারসের কাছে একটি গ্রামে। এক গ্রামীণ জমিদারের সাতটি সন্তানের মধ্যে একজন হয়ে। পিতা রামদেও রাই'কে একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র বলতে হবে। তিনি কন্যা গিরিজাকে বাল্যকাল থেকে সাঁতার, ঘোড়ায় চড়া, লাঠিখেলার শিক্ষা দিতেন। আবার কন্যার সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ দেখে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে গুরু সরযূপ্রসাদ মিশ্রের কাছে নাড়া বাঁধিয়ে দেন। সেকালে সামন্ততন্ত্রের শিখরে থাকা বনারসের এক রাজপুত জমিদার কী ভেবে তাঁর শিশুকন্যাকে সঙ্গীতরসে মজে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তা বোঝা নিতান্ত দুষ্কর। গিরিজার মা এবং ঠাকুমা তাঁর গানশেখা নিয়ে অত্যন্ত বিমুখ ছিলেন। তাঁদের মতে গান গাওয়া বাইজিদের পেশা। নাচঘরের প্রকাশ্য জমায়তে তার স্থান। এক সম্ভ্রান্ত, ধনী পরিবারের সুশীল কন্যা গান শিখে করবেটা কী? মা-ঠাকুমার তরফ থেকে তুমুল বাধা কিন্তু পিতার অনুপ্রেরণায় কাটিয়ে উঠেছিলেন গিরিজা। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলোনা তাঁর।পনেরো-ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় ব্যবসাজীবী মধুসূদন জৈনের সঙ্গে। বিস্ময়কর, শ্রী জৈনও ছিলেন কবিতা ও সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ। তিনিও গিরিজার সাঙ্গীতিক সত্ত্বাকে পূর্ণ পোষকতা দিতেন। কন্যার জন্মের পর গিরিজার মনে হয় সংসারের চাপে তিনি সঙ্গীতের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। স্বামীকে অনুরোধ করেন তিনি দূরে গিয়ে থাকতে চা'ন। তখন তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয় শহর থেকে দূরে সারনাথের কাছে একটি বাড়িতে। যেখানে তিনি একা একজন পরিচারিকার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। শিশুকন্যা থাকতেন বনারসে গিরিজার মায়ের কাছে। প্রতিদিন সন্ধেবেলা তাঁর পতিদেব ও তৎকালীন গুরু শ্রীচন্দ মিশ্র বনারস থেকে সারনাথ যেতেন তালিম দেবার জন্য। গিরিজা রেওয়াজ করতেন ভোর সাড়ে তিনটে থেকে সারাদিন ধরে। পরবর্তীকালে তিনি বলেছিলেন, সাধনা যে কী বস্তু, তখনই তা প্রথম বুঝতে পারেন। বেশ কিছুদিন এই পর্ব চলার পর তিনি বনারসে ফিরে আসেন। কুড়ি বছর বয়সে আকাশবাণী ইলাহাবাদে তাঁর প্রথম সঙ্গীতপরিবেশনা।
গিরিজা দেবী – ইতনি অরজ মোরি মান - মিশ্র খমাজ
পূরব অঙ্গ নামে খ্যাত বনারসি ঠুমরির বোল বনাও সিলসিলা শুরু করেছিলেন জগদীপ মিশ্র। বাবু বচ্চু সিং ১৮৯৪ সালে একটা বই লিখেছিলেন, নাম 'বেশ্যাস্তোত্র।' সেই বইয়ে একশোজনেরও বেশি বাইজিদের নাম ছিলো যাঁরা জগদীপজির অনুসরণে বোল বনাও শৈলিতে ঠুমরি গেয়ে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিদ্যাধরীবাই, বড়ি ময়নাবাই, রাজেশ্বরীবাই, হুসনাবাই প্রমুখ। কিন্তু বনারসি ঠুমরি উৎকর্ষের স্তর স্পর্শ করে বড়ি মোতিবাই, সিদ্ধেশ্বরীবাই এবং রসুলনবাইয়ের প্রযত্নে। এঁদের মধ্যেও উজ্জ্বলতম ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী বাই। সেকথা অন্য সবার মতো গিরিজাদেবীও উল্লেখ করেছিলেন।
হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীত অনুযায়ী ঠুমরি গানেরও দুটি অংশ রয়েছে, স্থায়ী আর অন্তরা। টেকনিক্যালি ঠুমরি গানের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদি রাগের দিকটা নিই, তবে দেখবো মোটামুটিভাবে কাফি, পিলু, গারা, খমাজ, সিন্ধু, কালিঙ্গড়া, পহাড়ি, ভৈরবী, জোগিয়া'র মধ্যেই তা ঘোরাফেরা করে। অন্যদিকে তালের ক্ষেত্রেও দাদরা, কাহারবা, দীপচন্দি, আদ্ধা বা যৎ। রসুলনবাই প্রমুখ ঠুমরি গায়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতেন বোলভাও প্রকরণকে। তানকারি বা সুরের বৈচিত্র্যের অংশটি তেমন গুরুত্ব পেতোনা। বোলভাওয়ের নাট্যরসটি অবশ্যই আদায় হতো তাঁদের পেশকারিতে। কিন্তু ধিমাতালে দীপচন্দি বা যৎ'তালে শুরু করে দ্রুত লগ্গি অংশে পৌঁছোনো পর্যন্ত সুরের কারুকার্যের থেকে বোলভাও'ই অগ্রাধিকার পেতো। শৃঙ্গাররসের মাদকতা এবং কামনাবিহ্বলতা, সুরের সম্পন্ন আয়োজনকে তেমন আমল দিতোনা। সিদ্ধেশ্বরীবাই কিন্তু তালিম পেয়েছিলেন কয়েকজন মহীরুহের ছায়ায়। বনারসের গুরু বড়ে রামদাস, লাহোরের উস্তাদ ইনায়ত খান বা গোয়ালিয়রের রজব আলি খান সঙ্গীত সম্বন্ধে সিদ্ধেশ্বরীর ধারণাকে পরিণত করে তোলেন। ঠুমরির বোল বানানোর প্রক্রিয়াটির মধ্যে তিনি একটা নির্দিষ্ট স্তরীয় বিন্যাস নিয়ে আসেন। এই স্তরনির্মাণের কলাটি বস্তুত বড়া খ্যয়ালের অনুকরণে করেছিলেন তিনি। ঠুমরির বোল বানানো'ও যে খ্যয়ালের মতো ধাপে ধাপে শিখরের দিকে যেতে পারে, সেই কৌশল বা নির্মাণটি সিদ্ধেশ্বরীর কীর্তি। গিরিজাদেবীও তাঁর ঠুমরির বোল বানানোর প্রক্রিয়াটি সিদ্ধেশ্বরীবাইয়ের দেখানো পথেই শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। তাঁর সৃজনশীলতা ছিলো একান্ত নিজস্ব।
গিরিজা দেবী - পিয়া নহি আয়ে - দে
হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীতের দেবতাদের মধ্যে উস্তাদ আবদুল করিম খান, উস্তাদ ফ্যয়েজ খান, উস্তাদ বড়ে ঘুলাম আলি খান ছাড়াও নজাকত-সলামত আলি খান, বরকত আলি খান বা স্বয়ং পণ্ডিত ভীমসেন জোশিও ঠুমরি গেয়েছেন অনেক। তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ শিল্পী। তাঁদের গাওয়া ঠুমরি ছিলো খ্যয়ালের জমকালো সাজসজ্জায় উজ্জ্বল অনন্য, কিন্তু লঘুতর শিল্প। তার সঙ্গে আমরা পণ্ডিত মহাদেবপ্রসাদ মিশ্র বা পণ্ডিত ছন্নুলাল মিশ্রের ঠুমরির তুলনা করতে পারিনা। পূরব অঙ্গের ঠুমরির বিপরীতে অনেকে পটিয়ালা ঘরের ঠুমরিকে পঞ্জাব অঙ্গ নামে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই ধারণাটির বিরোধিতা করেছিলেন স্বয়ং উস্তাদ বড়ে ঘুলাম আলি খান এবং তস্য পুত্র উস্তাদ মুনাব্বর আলি খান। তাঁদের মতে পটিয়ালাঘরের ঠুমরিতে কিছু অন্যধরণের অলংকার থাকে। যার উৎস পঞ্জাব ও রাজস্থানের লোকগান থেকে পাওয়া নানা টেকনিক। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাকে একটা পৃথক অঙ্গের স্বীকৃতি দেওয়া যায়না। পণ্ডিত ছন্নুলাল মিশ্র যখন মুডে থাকেন, খমাজে "অব না বজাও শ্যাম" খটকা, মুড়কি, গিটকিরি, পুকার সব কিছু ছড়াতে ছড়াতে আসরে ঠুমরির মাহৌল জমাতে থাকেন। কিছু গয়া'র গিটকিরি, কিছু পঞ্জাবি মুড়কি, সংলাপও চলতে থাকে সমানে। আসা যাওয়া করে। সুননেওয়ালা বলে উঠবে, হায় হায়, য়হি হ্যাঁয় অসলি বনারসি চাল। তাঁর তালিম কিরানা ঘরের হলেও উস্তাদ আবদুল করিম খান বা পণ্ডিত ভীমসেন জোশির পরিবেশিত ঠুমরির সঙ্গে একেবারেই মিলবে না। আসলে বোল বানানোর সেরিব্রাল স্তর আলাদা হয়ে যায়। কেউ একেবারে মৃত্তিকাজাত তপ্ত শরীরী মেজাজকে ধরতে চা'ন, কারো কাছে মগ্ন মস্তিষ্কটিই শৃঙ্গারের শীর্ষ তৃপ্তি।
ছন্নুলাল মিশ্র-খমাজ- অব ন বজাও শ্যাম
বিরজু মহারাজ - কানহা ম্যঁয় তোসে হারি - শতরঞ্জ কে খিলাড়ি
ঠুমরি শৈলী উন্মেষপর্বে ছিলো একান্তভাবে তওয়ায়েফ নির্ভর কলা। তওয়ায়েফরা নিছক গণিকা ছিলেন না। নবাবি-সংস্কৃতির সূক্ষ্ম পরিশীলনের অন্যতম প্রধান সূচক যে সঙ্গীত ও নৃত্যকলা, তার একটা বড়ো দায়ভাগ তওয়ায়েফদের বহন করতে হতো। শুধু নৃত্যগীত কুশলতা নয়, তাঁদের পরিশীলিত আচরণ সৌকর্যের পাঠ নেওয়া একই রকম জরুরি ছিলো। শ্রীমতী রেবা মুহুরী তাঁর 'ঠুমরি ও বাইজি' গ্রন্থে এই প্রসঙ্গ নিয়ে নানা সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। তিনি ও তাঁর পিতৃদেব অমিয়নাথ সান্যাল মশায় এই সংস্কৃতি বিষয়ে প্রকৃত আলিম মাহির । বনারসের তওয়ায়েফরা প্রায় সবাই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। অন্তত নিয়মিত আসাযাওয়া করতেন। বাঙালি সঙ্গীতগুণী ও সমঝদার শ্রোতারা সেই সব গান্ধর্বীদের সঙ্গ করেছেন। যে তিনজন শিল্পীর নাম আগে করেছি তাঁদের সঙ্গে গিরিজা দেবীর একমাত্র বনারস আর ঠুমরি ছাড়া কোনও সমান্তরাল নেই। পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি কিছু শিল্পীকে, যাঁরা তওয়ায়েফদের সঙ্গীতধারার সঙ্গে আত্মস্থ হবার জন্য তাঁদের দৈনন্দিন যাপনকে অবিকলভাবে অনুকরন করেছেন। গিরিজা দেবী তার ব্যতিক্রম ছিলেন। তওয়ায়েফদের সাধিত সম্ভ্রমবোধের সঙ্গে তাঁদের জীবনযাপনের যে প্রত্যক্ষ ফারাকটি ছিলো, গিরিজা দেবীকে কদাপি সেই দুর্ভোগের ভাগী হতে হয়নি। সিদ্ধেশ্বরী দেবীর কলাকৃতি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করলেও তাঁর বোধের জগৎ ছিলো তওয়ায়েফদের একেবারে ভিন্ন। বনারসি ঠুমরির যে প্রাণস্রোত ভাও বনানা, তাতে শৃঙ্গাররসের মানুষী আবেগকে পরিস্রুত করে ঐশী মাত্রা দেবার প্রয়াস তাঁকে অন্যতর প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। প্রথম জীবনেই তাঁর ভাবনায় সাঙ্গীতিক চর্চার মানচিত্রটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। ১৯৭৫ সালে তাঁর পতিবিয়োগের পর তাতে একটি বড়ো বিবর্তন হয়। প্রায় বর্ষাধিক কাল তিনি প্রকাশ্যে গান করেননি। গুণগ্রাহীদের আবেদনে আবার মঞ্চে ফিরে আসেন, কিন্তু শুধু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নয়, পরিপূর্ণ শিল্পী হয়ে। ঠিক এইসময়েই ১৯৭৭- ৭৮ সালে তিনি বিজয় কিচলু ম’শায়ের আগ্রহাতিশয্যে সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে গুরু হিসেবে যোগ দেন। কলকাতার সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্ক আমৃত্যু থেকে গিয়েছিলো।
আখতারি বাই - কয়সে ইয়েহ ধুম মচাই-কাফি
গিরিজা দেবী যাঁদের কাছে তালিম হাসিল করেছিলেন বা যাঁদের গান শুনে প্রস্তুত হয়েছিলেন, কাউকেই অবিকল অনুসরণ করেননি। রেবা মুহুরী তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, "....উনি খেয়াল গান করেন। ওঁর সঙ্গে আমার আলাপও হয়েছিল। ওঁর ঠুমরী যেগুলো শুনেছি, সেগুলো কিন্তু না-মোতিবাই, না-সিদ্ধেশ্বরী, না-রসুলনবাঈ-ওটা কার স্টাইল আমি জানিনা। এই নিয়ে আমি ওঁর সঙ্গে আলোচনাও করিনি। কেননা আলোচনা করার সুযোগ আমি পাইনি। তবে একটা কথা বলা যায়, গানগুলো শুনতে খুবই ভালো লাগে। তবে সব চেয়ে বড় কথা, গানের গলা। গিরিজা দেবীর গলা এত সুন্দর, এত তেজি যে উনি গলা খুললেই মনপ্রাণ সব স্তব্ধ হয়ে যায়।.... যখন সুস্থ ছিলেন, তখন ওঁর গান শুনলে মনে হত, বুকের মধ্যে কে যেন ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে।"
আমি সামনে বসে ওঁর গান দুবার শুনেছিলুম। প্রথমবার ১৯৭৯ সালে কলকাতায়। দ্বিতীয়বার ১৯৯৯ সালে পাটনায়। দুবারই শুরু করেছিলেন ছোটা খ্যয়াল গেয়ে। কিন্তু তার পরে দু'বারই তিন-চারটি ঠুমরি ও দাদরা গেয়েছিলেন। একবার কজরিও শুনেছিলুম পাটনায়। কলকাতায় প্রথমবারে তাঁর কণ্ঠ শুনেছিলুম অত্যন্ত তেজি এবং নিখুঁতভাবে সুরেলা। তখন, অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে ঠুমরি শোনার কান আমার তেমন পাকেনি। একটু রাফ লেগেছিলো। মনে হয়েছিলো ঠুমরি গানে অতোটা তেজ যেন একটু বেমানান। তখন এখনকার মতো অবলীলায় চাইলেই বনারসি ঠুমরির দিকপালদের গান শুনতে পাওয়া যেতোনা। একমাত্র ভরসা আকাশবাণীতে অখিল ভারতীয় কার্যক্রম। ঘড়ঘড় আওয়াজ আর খারাপ মানের শব্দ। উস্তাদ আবদুল করিম খান, ফ্যয়েজ খান ও বড়ে ঘুলাম আলি খানের কিছু রেকর্ডের ঠুমরি শোনার অভিজ্ঞতা ছিলো। বেগম আখতারের কয়েকটি ঠুমরি শুনেছিলুম। কিন্তু ঘজলের সফিস্টিকেশন তাঁর গাওয়া ঠুমরির উপর এতই প্রত্যক্ষ ছিলো যে কান জুড়িয়ে গেলেও ঠুমরির ভাও বানানোর খেলাটি যেন খুঁজে পাওয়া যেতোনা। কানের মধ্যে বসে গিয়েছিলো রেবা মুহুরীর কণ্ঠে 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি' আর 'জয় বাবা ফেলুনাথে' গাওয়া গান দুটি। গিরিজা দেবীর ঠুমরির সঙ্গে এর কোনোটারই মিল পাইনি। তবে পরে ওঁর গানের স্পিরিটটা একটু একটু মাথায় ঢুকেছিলো। ১৯৯৯ সালে যখন পাটনায় স্পিকম্যাকের একটি অনুষ্ঠানে ওঁর ঠুমরি শুনি তখন ওঁর জাদুটি কিছু বুঝতে পারি। সঙ্গে এটাও বুঝেছিলুম গান শোনার বিদ্যাটি আমার নাগালে নেই। পরবর্তীকালে শ্রদ্ধেয় আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বিশ্লেষণে গিরিজা দেবীর ঠুমরি সম্বন্ধে অনেকটা ওয়কিফ হই।
‘Rasa, the expression of emotion, became the primary focus… I worked… to convey the various forms of love such as love of god, love for your beloved, and simple maternal love… I decided to change the entire complexion of thumri… to give it a new face… a medium through which to express myself. The emotions of love, longing and devotion are an integral part of thumri and I thought that with the right kind of music I could make the lyrics come alive… to have a physical form like a painting.’একটি সাক্ষাৎকারে গিরিজা দেবী তাঁর নিজস্ব সঙ্গীত ভাবনা বিষয়ে এই কথাগুলি বলেছিলেন। ঠুমরি গায়ন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা কীভাবে প্রস্তুত হয়েছিলো সে নিয়ে অতি সংক্ষেপে কিছু কথা হতে পারে।