১.
উত্তর কলকাতার অন্ধগলিতে সূর্যের আলো হয়তো ঢুকতে পারেনা। কিন্তু মানুষের হিংসার গতি নির্বাধ ছুটে যায় আনাচে কানাচে। বালকটির বয়স ন'বছর, কিন্তু তাকে পালিয়ে যেতে হচ্ছে শবদেহের পাহাড় পেরিয়ে অন্য কোনোখানে, যেখানে আগুনহল্কার তপ্ত অন্ধনরক নেই। নিরাপত্তার শূশ্রূষা রয়েছে, অথচ ঠিক কোথায় সেই আশ্রয় তা'ও জানা নেই। হঠাৎ একটি এরকম মৃত মানুষের ঢিবির উপর দেখতে পায় একটি সম্পূর্ণ নগ্ন প্রবীন নারীদেহ, যার বুকের অস্ত্রাঘাত থেকে তখনও বয়ে যাচ্ছে রক্তধার, ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মৃতদেহের সোনার কণ্ঠহার। থমকে যায় তার পা, ভাই হাত টেনে ধরে বলে , দাদা পালা। ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং।
২.
তাঁকে কেউ নাম দিয়েছিলো 'অন্ধকারের কবি'। আলোর কথা তো সবাই আঁকে, কিন্তু অমাবস্যার গান আঁকার লোক আর ক'জন? বন্ধু শিল্পী ভূপেন কক্কড় বলেছিলেন, তাঁর মনোজগতে শুধু আঁধার মাণিকের রং চমক দিয়ে যায়। মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর বাল্যস্মৃতি জড়াজড়ি করে বেঁচেছিলো। কালো, ঘন নীল, বিভিন্ন ছায়ের ধূসর, বাদামি আর সিঁদুরে মাটি রং গড়ে তুলেছিলো তাঁর ক্যানভাসের জগৎ। শিকড়ে ছিলেন গগন-অবন আর আকাশে ছিলেন ফ্রান্জ হাল, রেমব্রান্ট আর পল ক্লী। লক্ষ্যনীয়, এই তিন দিকপাল শিল্পীরই আলো আর রং নিয়ে খেলার মেজাজ ধরতে চেয়েছেন তিনি সারা জীবন ধরে। রঙের কথা যদি ছেড়েও দিই তবুও দেখবো তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশের মঞ্চ সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্টসের অন্যান্য সতীর্থদের থেকে তাঁর ড্রইং কতোটা আলাদা। কাছাকাছি আসেন শ্যামল দত্তরায়, কিন্তু ফিগারেটিভ ড্রইঙের সমকালীন মুখ্যনাম গুলি যেমন প্রকাশ কর্মকার, যোগেন চৌধুরি, পরিতোষ সেন'দের থেকে তিনি নিজেকে কতো পৃথক করে ফেলতে পেরেছিলেন। ক্রমপরিণতির পথে তিনি অর্জন করেন শিল্পীর শিল্পী জাতীয় স্বীকৃতি। শিল্প সমালোচক রঞ্জিত হসকোটে তাঁর '"Reflections on the Art of Ganesh Pyne", Ganesh Pyne: A Pilgrim in the Dominion of Shadows ' প্রবন্ধে বলেছিলেন, তাঁর প্রবল আত্মবিশ্বাস তাঁকে কিন্তু চমকপ্রদ মানের সৃষ্টির ব্যাকরণ থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারেনি। তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দর্শক ক্রমাগত নিজেকে আবিষ্কার করে যায়। দর্শকের মনে যে ক্ষেত্রটি প্রস্তুত রয়েছে, গণেশ সেটিতে জলসেচন করতে থাকেন। তাঁর আঁকা ক্যানভাস যেন অর্ধেক আকাশ, দর্শকের মননে তা পূর্ণতা পায়। তিনি একটা বারুদের খেত তৈরি রাখেন, দর্শক শুধু ফুলকিটুকু লাগায়। তাঁর আপাত বিষাদমগ্নতার মধ্যেও একটা বালকের খেলাচ্ছল রয়েছে। তিনি গড়ে তুলছেন গোপন অ্যালেগোরি, যার শিকড় লুকিয়ে আছে কোথায় যেন, কোনো অজানা বিশ্বে অথবা তিনি তাকে আবিষ্কার করেও চাবিকাঠিটি নিজের কাছে রেখে দিচ্ছেন। দর্শক সম্মুখীন হবে এমন এক আখ্যানের সামনে যা নিতান্ত আনপ্রেডিক্টেবল, শিল্পী তাকে হ্যামলিনের বাঁশির মতো টানছেন তাকে নিজের মতো করে ক্যানভাসটিকে চিনে নিতে। সতীর্থ শিল্পী মানু পারিখ বলেছিলেন, গণেশের কল্পনাশক্তি তাঁকে ভবিষ্যতের চিত্রকর করে তুলেছিলো। নিজের জীবৎকালের থেকে অনেক পরে আসবে তাঁর নিজস্ব সময়কাল। তাঁর টেকনিক অনন্য আর তিনি নিজের সৃষ্ট বিশ্বের মধ্যেই সমহিমায় বেঁচে থেকেছেন। তার বাইরে আসার প্রয়োজন বোধ করেননি। গুরু অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে এইখানে তাঁর বিশেষ মিল। রবিকা'র শত অনুরোধেও অবন ঠাকুর নিজের তৈরি করা শিল্পবিশ্বের থেকে দূরে গিয়ে 'নতুন' কোনো অনুপ্রেরণার সন্ধান করেননি।
৩.
একবার কেউ অঞ্জলি এলা মেনন'কে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন, তাঁর ছবি সর্বোচ্চ দামে বিকোবার সুখে। অঞ্জলি বলেছিলেন, ছবি বিক্রির দাম দিয়ে উৎকর্ষ বিচার করাটা মূর্খতা। হতে পারে তাঁর একটা ছবি বাজারে অত্যন্ত মহার্ঘ মূল্য পেয়েছে, কিন্তু এটা জেনে রাখা দরকার গণেশ পাইনের আঁকা ছবির মূল্য নির্ধারন হয় প্রতি বর্গ ইঞ্চির হিসেবে। শিল্পী হিসেবে তাঁর সিদ্ধির কাছাকাছি অতি সামান্য ক'জনই আসতে পারেন। দীর্ঘদিন তাঁর তেল রং কেনার সামর্থ্য ছিলোনা। মন্দার মল্লিকের স্টুডিওতে অ্যানিমেশনের কাজ করতেন। সেই উপার্জনে জলরঙে ছবি আঁকতেন। সেভাবেই ওয়াশ থেকে গুয়াশ এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সিদ্ধির আসন পাতা হয় টেম্পেরা মাধ্যমে। অত্যন্ত স্বল্প মাত্রায় ছবির জন্ম হতো তাঁর হাতে। একার ক্যানভাসে একটা প্রদর্শনী ভরা যেতোনা, তাই ঐ মাপের শিল্পী হয়েও গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে ছবি দেখাতেন। তিরিশ চল্লিশ লাখে এক একটা ছবি বিকোনো খুব মামুলি ব্যাপার ছিলো তাঁর কাছে। সতীর্থ ও বন্ধুরা তাঁর এই সাফল্যে ঈর্ষাপর হয়ে পড়ায় আশির দশকে বেদনাবশে দীর্ঘকাল ছবি আঁকেননি। একান্ত অন্তর্মুখী ও প্রচারবিমুখ শিল্পী ছিলেন তিনি। তাঁর আঁকা সত্তর দশকের টালমাটাল সময়ের চিত্রকাব্য দেখে মকবুল ফিদা হুসেন মুম্বাইয়ের একটি পত্রিকায় গণেশের মুক্তবন্ধ প্রশংসা করেন। কলকাতার সীমাবদ্ধ শিল্প বাজারের থেকে তাঁর ছবি এইভাবে বিশ্বের দরবারে হাজির হয়। তার পর আর ফিরে তাকাননি তিনি। সত্যি কথা বলতে ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর সেই সর্বনেশে সত্তরের ক্যানভাসমালা দেখেই মন্ত্রবন্দী হয়ে পড়েছিলুম। একদিকে কলকাতাকেন্দ্রিক পৃথিবীর 'গভীর, গভীরতর অসুখ', অধ্যাপক আর ট্র্যাফিক পুলিশ হত্যার বিপ্লব । অন্যদিকে এশিয়ার মুক্তিসূর্যের হাতে জরুরি অবস্থার 'অনুশাসন পর্ব'। মানুষের শুভবুদ্ধি আর বিবেকী আয়োজনের নাভিশ্বাস। সেই সময়ের পটপ্রেক্ষায় গণেশের ক্যানভাস মানুষের কষ্ট, যুদ্ধ ও প্রতিবাদের একটা সেরিব্রাল দলিল হয়ে উঠেছিলো।
৪.
তাঁর আঁকা 'বারান্দা' আর 'ফুল' ছবিদুটি দেখে একসময় 'গণেশ পাইনের রানি' পদ্যটি লিখে ফেলেছিলুম। তাঁর প্রয়াণের পর তার দ্বিতীয় পাঠটি লেখা হয়ে গেলো। তাঁর যেকোনো ছবিই আমার চেতনাকে মাটির থেকে একটু উপরে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক যেমন ভীমসেন যোশীর গান বা শঙ্খ ঘোষের শব্দমালা। অনেক ছবির মধ্যে তবু মনে পড়ে যায়, 'নিশীথ অশ্বারোহী', ' কালো চাঁদ', 'নীড়', 'মুখোশ', 'জন্তু', 'ফুল', 'বারান্দা', 'মহাভারত' এবং অসংখ্য অন্যান্য ক্যানভাস। তাঁর ছবি আঁকার কলাকৌশল বা বিষয় নির্বাচনের ইতিকথা বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে। লেখার জন্য তো বটেই, পড়ার জন্যেও। ইচ্ছে থাকলো কখনও তাঁর কিছু নির্বাচিত ছবি ধরে সহমর্মী গুণগ্রাহীদের সঙ্গে বিশদ বিনিময় করার , তবে জানিনা সময় কবে হবে। কারণ আমার ব্যক্তিগত ধারণা, কবিতার শব্দবোধ বা সঙ্গীতের সুরলয়বোধ খানিকটা গ্রাহীর আয়ত্বের মধ্যে থাকে, সহজাতভাবে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে ছবির দৃশ্যবোধের সঠিক মালিকানা হাসিল করতে অনেক অধিকমাত্রায় প্রস্তুতি নিতে হয়। কারণ ছবির রসকে যথাসাধ্য নাগালের মধ্যে আনার জন্য কিছু বৌদ্ধিক শ্রম করতেই হবে। যতো সহজে একটি গান 'কানে' শুনে একটা ধারণায় পৌঁছোনো যায়, ছবির ক্ষেত্রে হয়তো ব্যাপারটি ততো সহজ নয়।
৫.
আঁধারের কবিকে আলো জোগাতো দেশজ লোকায়ত আখ্যান ও মিথস্ক্রিয়ার অনন্ত প্রাণচঞ্চল স্রোত। রোমান্টিকতা, ফ্যান্টাসি মিশে গেছে মহাকাব্যিক চেতনায়, আলোছায়া, রংবেরঙের মগ্ন বিশ্বে। পরিকল্পিত বিকৃতি ও কাল্পনিক অতিশয়োক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো একটা পরাবাস্তব ছবির ঘরানা তৈরি করেছিলেন তিনি। অপূর্ব দক্ষতায় বাংলা লিখতেন। যদি চিত্রকর না হতেন, তবে সফল কলমবশ তো নিশ্চয় হতেন। তাঁর গুণগ্রাহীরা অপেক্ষা করতেন, পরের ছবিটিতে তিনি অন্ধকারকে কীভাবে পুনরায় ব্যাখ্যা করবেন। মৃত্যু, কঙ্কাল, করোটির সঙ্গে মায়াবিনী নারীরা আর প্রত্নজীবের চারণক্ষেত্রে লতাপাতা ঘেরা অস্থিপুরাণের উপকথা চিরকাল ধুয়ে দিতে চেয়েছে শবের বুকে প্রলম্বিত রক্তাক্ত নেকলেসটিকে । মানুষের শেষ আশাবাদ অলকনন্দার ধারার মতো তাঁর ক্যানভাসে ধরা থাকবে।
'..... ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ করে শোনা যায়, শূশ্রূষার মতো শত শত
শত জলঝর্ণার ধ্বনি......'