"... নরক কি এ-রকম? বাংলার গ্রাম ও শহরে
লক্ষজন দগ্ধগৃহ, কেউ বেশ ওসারে বহরে,
নরকে না জানি শুনি আছে তারা দুরন্ত নরকে,
রৌরব-প্রাসাদে হাসে শাদা কালো গৌরব প্রহরে,
দধীচির হাড় জ্বলে, কী দেয়ালি বিব্স্ত্র মড়কে!"
(আইসায়ার খেদ-বিষ্ণু দে)
ইজাইয়াহ ছিলেন একজন ইহুদি প্রফেট। বিষ্ণু দে লিখতেন 'আইসায়া।' বেঁচে ছিলেন যিশুর জন্মের প্রায় আটশো বছর আগে। তাঁর বাণী ও রচনা নিয়ে একটি সংকলন আছে, নাম 'বুক অফ ইজাইয়াহ'। তিনটি সেমিটিক ধর্মবিশ্বাসেই তাঁকে প্রফেটের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেমিটিক দর্শনের তিনি একজন আদি ব্রাহ্মণ। রাজা জেমসের বাইবেলে ইজাইয়াহর নামে প্রচলিত একটি উক্তি আছে, '' Holier than thou"(৬৫ঃ৫)। ইজাইয়াহ এখানে 'ঈশ্বরে'র বকলমে বলছেন, " দাঁড়িয়ে থাকো। আমার কাছে এসোনা। আমি তোমাদের থেকে পবিত্রতর।" যদিও ইজাইয়াহর কাছে এই পবিত্রতার অর্থ ‘নৈতিক শুদ্ধতাজাত’ মানবিক উত্তরণ, কিন্তু লৌকিক বিশ্বাসে এই মনোভাবটি থেকে চিরস্থায়ী বিষবৃক্ষের বীজ রোপিত হয়েছিলো। তাঁর ব্যাখ্যায় ঈশ্বর দাবি করছেন তিনি প্রকৃতিপূজকদের থেকে অধিক পবিত্র। এই নির্ণয়টি থেকে সেমিটিক দর্শনের একেশ্বরবাদী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস করা হয়েছিলো ।
শুদ্ধ থাকার তাগিদে ইজাইয়াহর আপ্তবাক্যটিকে প্রশ্নহীন নিষ্ঠায় গ্রহণ করেছিলেন তাঁর অনুগামীরা। কিন্তু প্রফেট প্রচারিত নৈতিক শুদ্ধতার আবেগটি লৌকিক অভ্যাসের চাপে সম্পূর্ণভাবে ভিন্নমুখী হয়ে পড়ে । তিনটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস মিলিয়ে তাঁরা সংখ্যাগতভাবে বিশ্বের বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী। নৈতিক আকুলতা নিয়ে তাঁরা পবিত্রতর বা পবিত্রতম হতে চেয়েছেন । কিন্তু তাঁরাই ইতিহাসের হিংস্র অমানবিক কার্যকলাপগুলিও ক্রমাগত ঘটিয়ে চলেছেন। এই ঐতিহ্য এখনও বরকরার। ইহুদি ব্যতীত অপর দুই ধর্মবিশ্বাস এই 'শুদ্ধতা'র প্রতি অতিমাত্রায় নিবেদিত। হিদেন বা কাফির জাতীয় কল্পিত প্রত্যয় থেকে প্রেরিত হয়ে তাঁরা 'অবিশ্বাসী'দের শুদ্ধীকরণ করতে চেয়েছেন । ঘৃণায়, হিংসায়, হত্যায়। অধিকতর শুদ্ধতার দাবি নিয়ে একদল মানুষ অন্যদলের প্রতি নিরন্তর অসূয়াবর্ষণ করে গেছেন । ক্রমাগত হিংস্র আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করে গেছেন। এর কোনও ক্ষান্তি আমরা ইতিহাসে দেখিনি। এই মূহুর্তেও, শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে শুদ্ধতার প্রশ্নে মানুষকে উত্তম বা অধম চিহ্নিত করার বিপজ্জনক আগুনখেলা চোখে পড়ে । কোটি কোটি মূঢ় মানুষ নিজেদের সে খেলায় নিযুক্ত করে চলেছেন। আমাদের দেশ তাদের মধ্যে এই মূহুর্তে অগ্রগণ্য ।
ইল্বল ছিলেন একজন প্রভাবশালী দৈত্য। ভাগবতপুরাণ অনুযায়ী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পৌত্র। পিতা হ্রাদ ও মাতা ধমনী। অন্যমতে হিরণ্যকশিপুর ভগ্নী সিংহিকার পুত্র। সমস্ত প্রধান অসুর, যেমন বৃত্র বা বলি'র অনুচর হিসেবে ইল্বলের নাম পাওয়া যায়। মহাভারত অনুযায়ী তিনি মণিমতী নগরবাসী একজন মহাধনী অসুররাজ। বিবিধ পুরাণ, রামায়ণ বা মহাভারত অনুযায়ী ইল্বল অসুরকুলের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব । রামায়ণে তাঁকে নিয়ে একটি গল্প আছে। তার সঙ্গে শূর্পনখা আখ্যানের সমান্তরাল দেখা যায়। অশুদ্ধ অনার্যদের প্রতি বিশুদ্ধ আর্যদের ঘৃণা ও অসূয়া।
ইল্বল একবার এক ব্রাহ্মণের কাছে ইন্দ্রের সমতুল গুণবান পুত্রলাভের আশায় বর প্রার্থনা করেছিলেন। ব্রাহ্মণ তাঁর অনুরোধ সপাটে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, যতই সমৃদ্ধ বা প্রতিষ্ঠাপন্ন হোন না কেন, ইল্বল একজন অনার্য অসুর। তাঁর একজন আর্যগুণসম্পন্ন পুত্রের জন্য প্রার্থনা কিছুতেই স্বীকার করা যায়না। এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ইল্বল চিরতরে ব্রাহ্মণবৈরি হয়ে যান। তাঁকে নিয়ে যে গল্পটি আমরা রামায়ণের মাধ্যমে ছোটবেলা থেকে জানি, তার সঙ্গে তাঁর ভাই বাতাপিও জড়িত। ইল্বল সরাসরি ব্রহ্মহত্যা করতেন না। মায়াজাল বিস্তারের মাধ্যমে বাতাপিকে মেষরূপ ধারণ করিয়ে নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের জন্য তাঁর রন্ধিত মাংস পরিবেশন করতেন। ভোজনপরিতৃপ্ত ব্রাহ্মণ যখন বিশ্রামে রত, তখনই ইল্বল বাতাপিকে তিনবার আহ্বান করলে বাতাপি ব্রাহ্মণের উদরভেদ করে বেরিয়ে আসতেন। 'মায়াজাল' অংশটি আর্ষপ্রয়োগ বলেই বোধ হয়। কারণ হত্যা করতে চাইলে এই অসুররাজ অনায়াসেই সরাসরি সেটা করতে পারতেন। বাতাপিকে ডাকার প্রয়োজন হতনা। কিন্তু এই আখ্যানটির প্রতীকী ব্যঞ্জনা একটু অন্যরকম। ব্রাহ্মণের মৃত্যু হত ভোজ্যের লোভে। যে ব্রাহ্মণ শুদ্ধতার প্রশ্নে অসুরের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট, সে যদি মেষমাংসের লোভে অসুররাজের নিমন্ত্রণ উপেক্ষা না করতে পারে, তবে তার মৃত্যুই ভালো। অসুররা জানতেন আর্যদের স্বভাবে নানাবিধ রিপুর প্রকট প্রাদুর্ভাব রয়েছে। তাঁরা নিজেদের সম্বন্ধে যতই দৈবী শুদ্ধতার দাবি করুন না কেন, মানুষ হিসেবে তাঁরা অসুরদের মতই নশ্বর, ভঙ্গুর ও রিপুবশ। অতএব 'শুদ্ধতর' হবার পুণ্যে তাঁদের শিরোধার্য করে রাখার সঙ্গত কোনও কারণ নেই। জ্ঞানী ও বীর্যবান অসুরদের দেবতারা এই জন্যই সহ্য করতে পারতেন না। অনার্যদের বলবুদ্ধির প্রতি অসূয়া ও একধরণের শ্রেণীঘৃণা থেকে সমাজবিন্যাসে বর্ণাশ্রমবাদের মত একটি তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন আর্য ব্রাহ্মণ্য শক্তি।
যূথবদ্ধতাই সমাজসৃষ্টির প্রথম সোপান। সমাজসৃজন থেকেই গড়ে ওঠে নানান সভ্যতা। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় 'সভ্যতা'র বিকাশ চালনা করে পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন থাকার ডায়নামিকসগুলি। ইজাইয়াহ বা ইল্বলের উপাখ্যান মানুষের ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার শব্দরূপমাত্র। বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসে বিপন্নতা। বিপন্নতাই যাবতীয় হিংসার মূল। সভ্যতার সার্থকতা হিংসার সম্ভাবনাগুলিকে সফলভাবে নিষ্ক্রিয় করতে পারার মধ্যে। পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতাবোধের উৎস যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৈষম্য, তাও নয়। বিপর্যস্ত সামূহিক অহম থেকে জটিল বিপন্ন মানসিকতা জন্ম নেয়। সারা বিশ্বেই এই বিড়ম্বনার কোনও ব্যতিক্রম নেই।
সঙ্ঘমনা হয়ে ওঠার যে আর্ষবাক্য সর্বকালে পৃথিবীর মনীষীরা স্মরণ করিয়ে এসেছেন, তার আবেদন মানুষের বিবেকে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি । আজ তা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেছে। শুদ্ধতার ছলে মানবিক আদর্শের হনন এবং ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার নিদর্শনগুলি আজ নিতান্ত প্রকট । মানুষের গভীরতম পতনের সূচক তারা । প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির অধ্যাত্ম অংশটি সর্বজনীন হবার আশ্বাস দেয়। কিন্তু লৌকিক অংশে গোষ্ঠীগত ভেদভাবকে তুমুল উৎসাহ দেওয়া হয়ে থাকে। শৈব বনাম বৈষ্ণব, সনাতনী বনাম সদ্ধর্ম, খ্রিস্টিয় বনাম ইহুদি, ইহুদি বনাম ইসলামি, ইসলামি বনাম বৌদ্ধ, খ্রিস্টিয় বনাম ইসলামি, সনাতনী বনাম ইসলামি, এসব তো রয়েইছে। তার উপর একই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য বনাম ইতর, ক্যাথোলিক বনাম প্রটেস্ট্যান্ট, লুথেরন বনাম অর্থোডক্স, সুন্নি বনাম শিয়া, ওয়াহাবি বনাম সলাফি, ইত্যাদি,ইত্যাদি । বিচ্ছিন্নতার কোনও সীমা নেই। আমাদের দেশে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঐতিহ্যটি শুরু হয় বর্ণবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। এর শিকড় ছিলো প্রাগৈতিহাসিক গোষ্ঠীচেতনার মধ্যেই।
বর্ণ ও জাতি দুটি পৃথক ধারণা। জাতির বর্গীকরণ হতো বৃত্তিগত আনুগত্য থেকে। কিন্তু বর্ণবিভাগের যুক্তি ছিলো শুদ্ধতার বর্গীকরণে। 'শুদ্ধতম' বর্ণের প্রতিষ্ঠাও উচ্চতম। যদিও নৃতত্ত্বের যুক্তিতে সামাজিক শুদ্ধতার ধারণাটিই সোনার পাথরবাটি। তার প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা দৈবী সাক্ষ্যপ্রমাণ। এই সব প্রতারণা ধীরে ধীরে সামাজিক ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে যায় এদেশে। উল্লেখ্য, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুযায়ী ভারতীয় সমাজে গোটা সাতেক বর্গবিভাগ ছিলো। এর কোনওটাই কিন্তু জন্মগত 'শুদ্ধতা'র যুক্তিতে করা হয়নি। সমাজে উচ্চতম স্থান ছিলো 'দার্শনিক'দের। দার্শনিকদের মধ্যে ছিলেন ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ উভয় পক্ষই। শ্রমণরা সচরাচর ব্রাহ্মণবিরোধী হতেন। কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠায় তাঁরা ছিলেন সমমর্যাদাসম্পন্ন। নিজেদের 'শুদ্ধ' মনে করলেও ব্রাহ্মণদের অবস্থান ছিলো লৌকিকধর্মের রক্ষক হিসেবে। অধ্যাত্মদর্শনের দায় তাঁদের বিশেষ বহন করতে হতনা। ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতাবাদের উৎস ছিলো দেবতা ব্রহ্মার মর্জিমেজাজের উপর। বিভিন্ন বর্ণ সৃষ্টি হয়েছিলো এই দেবকল্পনাটির নানা অঙ্গ থেকে। বৈদিকসাহিত্যের কল্পিত সন্দর্ভগুলিই ছিলো লৌকিকধর্মের ভিত্তি। লৌকিকধর্ম দাঁড়িয়ে ছিলো বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা, দুটি ধারণার স্তম্ভের উপর। ব্রাহ্মণরা ‘শুদ্ধতম’ বলে লৌকিকধর্মের রক্ষক ও ব্যাখ্যাকারী। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুযায়ীই বর্ণব্যবস্থার সংরচনাটি নির্দিষ্ট রূপ পেয়েছিলো। অধ্যাত্মব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ, যুদ্ধব্যবসায়ী ক্ষত্রিয়, বাণিজ্যব্যবসায়ী বৈশ্য এবং শ্রমব্যবসায়ী শূদ্র, সমাজক্ষেত্রের চারটি বাহু। মজার কথা, সমাজের বৃহত্তম সংখ্যাগত বর্গটি কিন্তু ছিলো এই হিসেবের বাইরে। তাঁরা ছিলেন অচ্ছুতবর্গ। মূলত আর্যবলয়ের বাইরের স্থানীয় উপজাতিক মানুষেরা।
'জাতি' শব্দটি জন্মের সঙ্গে জড়িত। জাতিপরিচয় সর্বদা জন্মগত উৎস থেকেই বিচার্য। সঙ্গতভাবেই তাকে পাল্টানো যায়না। কিন্তু বর্ণবিভাগ উন্মেষকালে অপরিবর্তনীয় ছিলোনা। ব্রাহ্মণ্যধর্মে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় পরস্পর জায়গাবদল করতে পারতেন। আবার শ্রমণধর্মে বৈশ্য ও শূদ্রদেরই আধিপত্য। কর্মসুবাদে তাঁদের বর্ণপরিচয়কে অতিক্রম করতে অসুবিধে ছিলোনা। মানুষসমাজের এই জটিল বর্গভেদের কেন্দ্রে ছিলো 'অশুদ্ধে'র বিরুদ্ধে 'বিশুদ্ধে'র ঘৃণাস্বভাব। ভারতীয় সমাজকে আবহমানকাল ধরে এই ঘৃণাসঞ্জাত হিংসার অভিশাপ বহন করে আসতে হয়েছে। যুদ্ধজয় করে এদেশে বহু বহিরাগত শক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো । তুর্কি, আরবি ও ইরানি ইসলামি সভ্যতা এবং পরে য়ুরোপিয় উপনিবেশবাদীরা, সবাই ব্যতিক্রমহীনভাবে এদেশের বর্ণাশ্রমভিত্তিক শ্রেণীভেদ ও তজ্জনিত জাতিহিংসার প্রতি কটাক্ষ করে গেছে।
শুদ্ধতাবোধকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতাবাদ, মধ্যপ্রাচ্য বা য়ুরোপে সমানভাবেই বিপর্যয় সৃষ্টি করে এসেছে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে। শাদা য়ুরোপিয়রা যখন জানতে পারে তাদের পূর্বপুরুষেরা বস্তুত আফ্রিকার কালোমানুষদেরই শাখামাত্র, তারা প্রথম অবস্থায় বলপূর্বক তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। পরবর্তীকালে কিছু ধীমান মানুষ তত্ত্বটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ য়ুরোপিয়দের কাছে 'সত্য যে কঠিন' আপ্তবাক্যটিকে প্রত্যাখ্যান করার প্রবল প্রয়াস দেখা যায়। য়ুরোপের ইতিহাসে বর্বরতম অধ্যায়টির জন্য দায়ী ছিলো এই জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদী ঘৃণা। নাৎসিরা যেমন মনে করত, কিছু মানুষ অন্য মানুষদের থেকে শুদ্ধতর এবং অশুদ্ধের প্রতি বিশুদ্ধের ঘৃণাটি সঙ্গত ও নিয়তিনির্দিষ্ট। উপজাতিক আরবি সংস্কৃতির মুসলমান এবং প্রাচীন পারস্য সভ্যতার পুণ্যভোগী মুসলমান পরস্পরের প্রতি যুযুধান অবস্থান নিয়ে আবহমানকাল ধরে অভ্যস্ত। অথচ ইসলামের উদ্গাতাদের আদি নির্দেশ যে কোনও মূল্যে ‘বিশ্বাসী’ মানুষদের মধ্যে ভেদভাব নিবারণ করতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে ইসলামের উম্মাতত্ত্বকে ধূলিসাৎ করে মুসলিম জগৎ পরস্পর বিচ্ছিন্ন সহিংস আক্রমণে মত্ত। প্রবুদ্ধ ইসলামি দর্শন কালক্রমে শুধু বইয়ের পাতায় সাজানো দীর্ঘশ্বাস।
আদিশংকর গভীর রাজনৈতিক উদ্যম নিয়ে প্রয়াস করেছিলেন। শৈব, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য, শক্তিপূজক, প্রকৃতিবাদী, পরস্পর খেয়োখেয়িতে মত্ত বিপুল ভারতীয় জনসমষ্টিকে সনাতনধর্মের ছাতার তলায় এনে, দর্শন না হোক, অন্তত লৌকিকতার সূত্রে একীভূত করে ফেলার চেষ্টা ছিলো তাঁর। নবধর্ম ইসলামের সংহত চাপে ভারতীয় ধর্ম বা দর্শন যাতে নিষ্পিষ্ট না হয়ে যায়। যা ঘটেছিলো, তাতে তাঁর উদ্দেশ্য বাহ্যত হয়তো সফল হয়েছিলো কিছু মাত্রায়। কিন্তু মনোজগতে সনাতনধর্মীয় মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস বা নির্ভরতা কখনই গড়ে ওঠেনি। এর মূল কারণ যে যখন রাজশক্তির অধিকারী হয়েছে, কেউই চায়নি মানুষে মানুষে সহজাত অহমিকাপ্রসূত বিচ্ছিন্নতা কখনও বিনষ্ট হয়। তথাগতের ধর্ম, তার জন্মস্থান থেকে নির্বাসিত হয়ে দূরগামী হয়েছিলো কালের নিয়মে। সবচেয়ে বিস্ময় জাগে এই ভেবে যে বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র নীতিবাদী, লৌকিকতাহীন দর্শনটিও অনুগামীদের মধ্যে পরস্পর বিচ্ছিন্নতাবোধের অভিশাপ এড়াতে একান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো।
শংকরের 'ধর্ম', মোহম্মদের 'ধর্ম', তথাগতের 'ধর্ম', খ্রিস্টের 'ধর্ম', সবই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেছে। মনস্বী মানুষদের আপ্রাণ প্রয়াস ছিলো এই পরিস্থিতি যেন না আসে। কত কিছু কল্পনা করতে হয়েছিলো তাঁদের। ঈশ্বর, দেবতা, অবতার, পুনর্জন্ম, কর্মফল, পাপপুণ্যের জটিল অঙ্ক, অন্তহীন অধ্যাত্মদর্শনের আশ্বাস; কার্যক্ষেত্রে সবই ব্যর্থ হয়েছে। মুখে যাই বলুক, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার প্ররোচনা মানুষ কখনও জয় করতে পারেনি। ইজাইয়াহর উক্তি 'Holier than thou' তাই সর্বযুগে, সর্বকালে মানুষের গভীরতম পতনের শব্দরূপ।
ফরাসি বিপ্লবের পর একটা প্রয়াস হয়েছিলো। নিখিল বিশ্বের মানুষজনকে কীভাবে আরো কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়। যদিও এই উদ্যমটির ভিত্তি ছিল প্রতীচ্যের দর্শনভূমিতে। Liberté, égalité, fraternité, স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের রূপরেখা, প্রাচী ও প্রতীচীর কাছে আলাদা। কিন্তু ফরাসি নেপলিয়ঁর রুশদেশ আক্রমণ রুশদের মনে পশ্চিম য়ুরোপ বিষয়ে আবহমানকালের অবিশ্বাস, বিতৃষ্ণাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। " The paradigm of Russia’s opposition to the “West” emerged only in the 19th century in the wake of the wars waged by Napoleon. It reveals some traits of a late ‘social myth," বলেছিলেন য়ুরি লেভাদা। রুশ কবি আলেকজান্দার ব্লোক তাঁর 'সাইথিয়ান' কবিতায় লিখেছিলেন রাশিয়া চিরকাল পশ্চিম য়ুরোপকে একসাথে ঘৃণা আর প্রেমের দৃষ্টিতে দেখেছে। এর ইতিহাসটি একটু বিচিত্র। ১৪৮০ সালে তাতার আমলে রাশিয়া য়ুরোপিয় খ্রিস্টিয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখানে য়ুরোপিয় রাজতন্ত্রের থেকে আলাদা প্রাচ্য মডেলের একতন্ত্রী স্বৈরাচারী রাজাদের প্রাদুর্ভাব ঘটে। আইভান দ্য টেরিবল তার একটি প্রধান উদাহরণ। এমন কি পিটার দ্য গ্রেট'ও এজাতীয় ব্যবস্থার ব্যতিক্রম ছিলেন না। একবার একটি ব্রিটিশ রণতরী দেখতে গিয়ে অবাক হয়েছিলেন যখন তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সেই জাহাজটির ক্যাপটেন একজন নাবিককে অহেতুকভাবে বেত্রাঘাত করতে অস্বীকার করেছিলেন। রাজা পিটারের অনুগামী রাশিয়া, ফরাসি বিপ্লবের সব চেয়ে তিক্ত সমালোচক ছিলো। রাশিয়ায় 'আদর্শে'র শাসনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো আইনের শাসনের চেয়ে। য়ুরোপিয় পণ্ডিতদের মতে, "There is a wide-spread opinion that a fundamental incompatibility of views between Russia and the West derives from the idea that Russia, in adopting the Eastern Orthodox faith, cut itself off from Europe. In this scheme, Russia's Byzantine orientation resulted in a conservative, anti-intellectual, and xenophobic worldview that became increasingly isolated from the mainstream of European history for a number of centuries, and Communism is perceived as a modern form of Orthodoxy." পশ্চিম য়ুরোপের সঙ্গে রাশিয়ার মনোজগতের বিচ্ছিন্নতা সোভিয়েৎ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে দুরতিক্রম্য হয়ে যায়। প্রথমে নেপলিয়ঁ, তার পর হিটলার শুদ্ধতার যুক্তিতে রাশিয়ার অধঃপতিত জনতার ত্রাতা হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। তাঁদের পরাজয় মানে শুধুমাত্র রাশিয়ার জয় নয়। এটি আবহমান কাল ধরে মানুষের গড়ে তোলা কষ্টকল্পিত, ভিত্তিহীন 'শুদ্ধতা' নামক ধারণাটির পরাজয়মাত্র। কিন্তু এই শাশ্বত 'ভুল'টিকে প্রমাণ করতে গিয়ে অগণ্য, অসংখ্য মানুষকে হাজার হাজার বছর ধরে প্রাণ দিয়ে আসতে হয়েছে। মজার কথা, এখনও সেই ট্র্যাডিশনে বিরাম নেই।
পশ্চিম য়ুরোপের লোকজন আর পূর্ব য়ুরোপের স্লাভ-স্লোভাকদের মধ্যে সম্পর্ক আমাদের দেশের মতো বর্ণাশ্রমের নিয়ম মেনে চলেছে। একজন জর্মন, থাকতেন ইংলন্ডে, আদৃত ছিলেন ফ্রান্সে, ভাবতেন আমেরিকাকে নিয়ে। কিন্তু তাঁর পথ নিলো একটা স্লাভ-কসাকদের দেশ। যাদের পশ্চিম য়ুরোপে মানুষই মনে করা হতনা। য়ুরোপের 'যুক্তিবোধ' অর্থোডক্স চার্চের 'গণতন্ত্রহীন' আনুগত্যকেই সাম্যবাদের বীজতলা হিসেবে ভেবে নিয়েছিলো। সেই কোনকালে যখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পাহাড়ে থাকতেন, সারদাদেবী খুব উদ্বিগ্ন, রাতে ঘুম আসেনা। তাঁকে লোকজন বলেছে রাশিয়ান দানবরা আসবে পাহাড় পেরিয়ে। সব্বাইকে জ্যান্ত খেয়ে নেবে। তখন কোথায় মার্ক্স-এঙ্গেলস, কোথায় লেনিন? তার পর আবার সেই দাড়িওয়ালা জর্মনের পথ নিল য়ুরোপের বিচারে একটা অর্ধসভ্যদেশ, চিন। কেন ফ্রান্স পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হলনা? সেটাই তো স্বাভাবিক ছিলো। ভলতেয়রের থেকে মার্ক্সের বিবর্তনটিই সরলতম উপপাদ্য হতে পারতো। চিরন্তনভাবে অ্যাডাম স্মিথ বা হেগেলের পথ দিয়ে ডিসকোর্সটিকে ব্যাখ্যা করার থেকে একটা ব্যতিক্রমী সমান্তরাল বিকল্পও তো সম্ভব ছিলো। সত্যিকথা বলতে কী, একসময় রাশিয়ার সব চিন্তাশীল, অগ্রণী মানুষেরা প্রশ্নহীনভাবে ফরাসি মননকেই অনুসরণ করতেন। তবু ফ্রান্স সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সারোগেট মা হয়েই থেকে গেলো। অথবা জর্মনটির নিজের দেশ? তারা হয়ে গেল নাৎসি। পশ্চিম য়ুরোপের কোনও দেশ এই দর্শনটিকে আত্মসাৎ করার হিম্মত দেখাতে পারলে সমাজতন্ত্রকে আর জুজু ভাবার অবকাশ থাকতো না কারো কাছে।
রইলো বাকি, বাজার, বাজার, তোমার মন নাই, মানুষ?
বস্তুবাদ-ভাববাদ-অধ্যাত্মবাদ নিয়ে চটজলদি টিভি-প্যানেল মার্কা হাস্যকর নির্ণয়সমূহ দিয়ে আমাদের ভিতরের 'শুদ্ধতাবাদী' অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো যাবেনা। আমাদের দেশে অন্ধত্ব-কুসংস্কার-নরকবাদী রাজনীতির পচনশীল পাঁকের রমরমা। 'দেশপ্রেমে'র বানভাসি স্রোতের টানে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক লাগেনা। কারণ য়ুরোপীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারণা আর আমাদের জাতির বর্ণাশ্রমজাত শুদ্ধতাবাদ, অভিন্ন পচনধর্ম। আমাদের বাংলায় মানুষজন নিজেদের বেশ 'প্রগতিশীল' মনে করেন। কেন করেন, জানিনা। আগে ইংরিজি শিখেছিলেন তাঁরা, তাই কী? অথবা নানা ঐতিহাসিক কারণে আর্যাবর্তের সঙ্গে কৌমসমাজের মিলনপ্রক্রিয়ার সূত্রে একটু অন্যরকম নৃতাত্ত্বিক পরিচয় আছে তাঁদের। কারণটা এখনও খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাঁরা একটা প্রচ্ছন্ন সেরিব্রাল উচ্চমনত্ব ভাব নিয়ে তৃপ্ত থাকেন। এই বাংলার একদা শাসকদল দুপ্রজন্ম শাসন করে ভেবে নিয়েছিলেন বাঙালিরা সত্যিই 'প্রগতিশীল।' 'শুদ্ধতাবাদী' পিছুটান বাঙালির বোধ থেকে ধুয়ে দেওয়া গেছে। ও সব আর নেই। কিন্তু সেই অন্ধকার যে কত গভীরভাবে রয়ে গেছে, সেটা আর তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করতেই পারলেন না। যে বিষবৃক্ষটি ভিতর থেকে উপড়ানোর ছিলো, তাকে শুধু ব্রিগেড করে উপড়ানো যায়না। শুধু অপারেশন বর্গা দিয়ে একটা জাতির রক্তে গহনগামী বিষ ধুয়েও দেওয়া যায়না। স্রেফ মার খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য বাঙালিও ক্রমাগত পতাকা বদলে যায়। তাঁদের সঙ্গে আর কারো কোনও তফাৎ নেই।
রামায়ণের ইল্বল আর বাতাপির গল্প মনে আসে। ব্রাহ্মণরা বাতাপিকে ভোজন করে যখন পরিতৃপ্ত, তখনই ইল্বলের ডাক। ভোজতৃপ্ত ‘ব্রাহ্মণ’দের উদর বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসা চিরকালের সত্য। রূপকটি আমাদের দেশে সব ‘শুদ্ধতাবাদী’ রাজনৈতিক দলের মনে রাখা দরকার। যখনই তারা ভাববে জনতা তাদের অপরিসীম লোভের আগুনে পরিপাক হয়ে গেছে, তখনই কোনও ইল্বল ডেকে উঠবে 'বাতাপি, বাতাপি'....
ইজাইয়াহ যাই ভাবুন না কেন, আমাদের ইল্বল'কে বড়ো দরকার....