এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পঞ্চকন্যা কথা

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ জুন ২০২৪ | ৫০০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • পঞ্চকন্যা কথা


    আরও একটি পাঁচই জুন এসে হাজির হলো আমাদের মাঝে। এ বছর ভোটের ফলাফলের তালগোলের মধ্যেই তার হাজিরা। তাই দিনটিকে নিয়ে আসর কতটা গরম হবে বা আদৌ এ নিয়ে হাওয়া গরম হবে কিনা তা বলা বেশ মুশকিল। অথচ আমাদের মধ্যেই এমন অনেক অনেক নিভৃত যাপনে অভ্যস্ত, নিরলস, উদগ্রীব মানুষ রয়েছেন যাঁরা এই দিনটিকে আঁকড়ে ধরেই আগামী দিনগুলোতে নিজেদের সঁপে দিতে চান ধরিত্রী মায়ের সেবায়, পরিবেশ সুরক্ষার কাজে। আজকের ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে পরিবেশের রক্ষায় যাঁরা কাজ করে গেছেন - নির্মাণ করে গেছেন এক অনুসরণীয় যাপনপথ অথবা আজ‌ও সেবা করে চলেছেন প্রকৃতির, তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করা কয়েকজনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যই এই নিবন্ধের অবতারণা। এই নিবন্ধে পঞ্চকন্যার কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বাদ পড়লেন আর‌ও অনেকেই। তাঁদের সকলের জন্য, সেই সব অনলস পরিবেশ সেবকদের জন্য র‌ইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।



    পরিবেশের সেবা? কথাটি কি নতুন ঠেকছে? নিশ্চয়ই নয়। কেননা এই দেশের ঐতিহ্যবাহী পরম্পরায় - পাহাড় পর্বত, নদীনালা , গাছপালা, পাখ পাখালি - সবকিছুকেই নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার কথা সেই কোন্ কাল থেকে বলা হয়েছে। তপোবনের আশ্রমিক পরিবেশের কথা মনে পড়ে? আসলে এভাবে বেঁচে থাকাতে একটা আনন্দ আছে, এর প্রতি সহজাত অনুরাগ আছে,সুখ আছে, সমৃদ্ধি আছে, স্থিতি আছে, স্বস্তি আছে। এটা সবথেকে ভালো জানেন যাঁরা, বোঝেন যাঁরা, তাঁরা হলেন সমাজের অর্ধেক আকাশ জুড়ে থাকা মহিলারা । ঘরের কাজ পরিপাটি করে করার পাশাপাশি পরিবেশ পরিসেবাতেও তাঁদের অনেকেই উজ্জ্বল, অনন্যা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেকসময়ই নারীদের কৃতীকে দাবিয়ে রাখা হয়,তার‌ই মধ্যে কেউ কেউ হয়তো “গন্ধ বিলানো ধূপের” সুবাস হয়ে আপন কর্মের সুবাদে পরিচিতি লাভ করেন বৃহত্তর নাগরিক সমাজে। দেশের পরিসীমা ছাপিয়ে কার‌ও কার‌ও পরিবেশ পরিসেবার অনন্য কীর্তিকলাপের কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে দেশান্তরের বিসারি দরিয়ায়। তখন তাঁদের পাশাপাশি গর্বিত হই আমরাও।

    পাঁচ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্যকে প্রেক্ষাপটে রেখে আজ বরং আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই আমাদের দেশের পাঁচজন অনন্যা পরিবেশ সেবিকার, লোকচক্ষুর প্রায় আড়ালে থেকে যাঁরা নিয়মিতভাবে পরিবেশের সেবা করে চলেছেন প্রকৃতি পরিবেশের প্রতি নিজেদের সুগভীর ভালোবাসার তাড়নায়। আজ যখন গোটা দুনিয়া জুড়ে এক বিপন্নতার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে, গেল গেল রব উঠেছে জল স্থল অন্তরীক্ষ জুড়ে, তখন এই সব মানুষীদের নীরব কর্মকাণ্ডের শরিক হতে মোটেই খারাপ লাগবে না।

    আমাদের দেশে পরিবেশ আন্দোলনের এক সুদীর্ঘ পরম্পরা বা ইতিহাস রয়েছে। বলতে ভালো লাগে যে এই আন্দোলনের ময়দানে অনেকক্ষেত্রেই বুঝি পুরুষদেরকে ছাপিয়ে গেছেন আমাদের দেশের বীরাঙ্গনা নারীরা। মানুষ পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন মুখর হয়ে ওঠে কখন? যখন সে উপলব্ধি করে তাঁর বা তাঁদের অনুমোদন ছাড়াই যথেচ্ছ ভাবে পরিবেশ পরিমণ্ডলের পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে যা আমাদের জীবনের প্রচলিত ভারসাম্যের নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবে। এতোসব উপলব্ধির পরেও পরিবেশের ওপর সবল শক্তির অভিঘাত মোটেই নতুন কোনো ঘটনা নয় । আমাদের মহাকাব্যের পাতাতেও অরণ্য সংহারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। সীতা মায়ের খোঁজে লঙ্কা অভিযানে গিয়ে রাক্ষসদের হাতে বন্দি হনুমানের লেজের আগুনে লঙ্কাদহন পর্ব কিংবা মহাভারতের খাণ্ডব বন দহনের বীরোচিত আখ্যানের মধ্যে চাপা পড়ে আছে বন কেটে বসত গড়ার কারণে পরিবেশের অবক্ষয়ের করুণ কাহিনি।

    আসলে অরণ্যের নিবিড় প্রশান্তিকে ঘিরে থাকা বনবাসী মানুষের জীবন যাপন ও জীবিকা যুগে যুগে আক্রান্ত হয়েছে। যখনই মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে, তখনই দানা বেঁধেছে প্রতিবাদী পরিবেশ আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের ময়দানে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন ভারতের নারীরা। কখনও কখনও পুরুষদের ভূমিকাকে ছাপিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এ দেশের মেয়েরা।

    ভারতে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রথম শহীদ হয়েছিলেন রাজস্থানের বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের বীরাঙ্গনা নারী অমৃতা দেবী আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত’শো বছর আগে। গুরু জাম্বেশ্বর মহারাজ তথা জাম্বোজীর অনুশাসনের অনুগামী বিষ্ণোইরা।

    গোড়াতেই খুব সংক্ষেপে সেই কাহিনি নিবেদন করি।

    মেওয়ারের রাজা অভয় সিংহ তাঁর নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণের জন্য যোধপুরের কাছে খেজরি গাছে ঘেরা খেজরিলি গ্রামকেই বেছে নিলেন। শাসকের তরফে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিবাদে মুখর হলো বিষ্ণোইরা। কারণ তাঁরা বুঝতে পারছিল রাজার খোয়াব পূরণ করার অর্থ হলো তাঁদের জীবন বিপন্ন হ‌ওয়া। শুরু হলো প্রতিবাদী আন্দোলন। আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন সাধারণ দেহাতি মহিলা মা অমৃতা দেবী। গাছগুলোকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে প্রতিবাদে সরব হলেন গ্রামবাসীরা। জান কবুল করে লড়াই চালিয়ে যান তাঁরা। রাজার পাঠানো ঘাতকের দল নির্মমভাবে হত্যা করে অমৃতা দেবী ও তাঁর তিন সন্তানসহ মোট ৩৬৩ জন অকুতোভয় বিষ্ণোই মানুষকে। রাজস্থানের মাটি সাক্ষী থাকলো এক নারীর আত্মত্যাগের। এই ঘটনার সূত্রেই বুঝি একাত্ম হয়ে যায় পরিবেশের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই আর মানবতার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। গৌরবান্বিত হয় ভারতবর্ষের পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাস। এই আন্দোলনের বহু বছর পর, ঐতিহাসিক চিপকো আন্দোলনের সূত্র ধরেই সজীব হয়ে ওঠে গাছ জড়িয়ে ধরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অনবদ্য ভারতীয় পরম্পরা। সেই আন্দোলনের ময়দানেও সক্রিয় ছিলেন অধুনা উত্তরাখণ্ডের বীরাঙ্গনারা । তাঁদের‌ই একজন, গৌরা দেবীর কথা দিয়েই আমরা বরং শুরু করি পরিবেশ সুরক্ষায় নিবেদিত প্রাণ পঞ্চ ভারতীয় কন্যার কথা।

    (১) চিপকো জননী গৌরা দেবী (১৯২৫-১৯৯১)


    চিপকো আন্দোলনের জননী হিসেবে পরিচিত গৌরা দেবীর জন্ম ১৯২৫ সালে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের চামোলি জেলার লতা গ্রামের এক সাধারণ আদিবাসী পরিবারে। গৌরা দেবীর বয়স যখন মাত্র বারো, তখনই তার বিয়ে হয় মেহেরবান সিং এর সাথে। আর পাঁচটা স্থানীয় পাহাড়ীয়া অধিবাসীর মতো রেনে গ্রামের মানুষ মেহেরবানের জীবিকা ছিল পাহাড়ী বুগিয়ালে পালিত ভেড়া চড়ানো আর পশমের বেচাকেনা করা। যখন গৌরা দেবীর বয়স বাইশ, মেহেরবান মারা যান। সদ্য যুবতী গৌরা হাল ছাড়েননি। সন্তানদের নিয়ে সংগ্রামী জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো তাঁর।

    গ্রামের লোকজন গৌরা দেবীর মধ্যে এক লড়াকু সৈনিকের অস্তিত্বের আভাস পেয়েছিলেন, তাই তাঁকেই গ্রামের মহিলা মঙ্গল দলের প্রধান নির্বাচন করা হলো, যাঁদের প্রধান কাজই ছিল গ্রামের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, বনের বৃক্ষরাজির সুরক্ষার দেখভাল করা। ১৯৬২ র চিনা আগ্রাসনের পর থেকেই সীমান্তবর্তী এলাকায় সামরিক প্রয়োজনে সড়ক, সেতু নির্মাণের কাজকর্ম নতুন গতি পায়। ৭০’ এর গোড়াতেই এমন উন্নয়নের ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো উত্তরপ্রদেশের শান্ত, সমাহিত চামোলি জেলায়। রেনে গ্রামের পাহাড়ি ঢালের মাটি আঁকড়ে, আকাশপানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বহুকালের গাছগুলোর ওপর নজর পড়ল কাঠ কাটার বরাদ্দ পাওয়া ঠিকাদারদের। প্রমাদ গুনলেন গৌরা দেবী ও তাঁর দলের মহিলা সহযোগীরা। বড়ো বড়ো গাছগুলো কেটে ফেলা হলে যে তাঁদের রেনে গ্রামের পাহাড়ি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে - নষ্ট হয়ে যাবে তাঁদের ছোট ছোট চাষের ক্ষেত, সবুজ ঘাসের গালিচায় ঢাকা বুগিয়াল, বিপন্ন হবে জলের উৎস পাহাড়ি ঝোরা আর চশমা গুলো। এমনটা যে মেনে নেওয়া যায় না। মেনে নেওয়া হলে যে মৃত্যুকে ডেকে আনতে হবে। তাহলে উপায়?



    গৌরা দেবী প্রতিরোধের এক আশ্চর্য উপায় বাতলালেন। তিনি তাঁর সঙ্গীনিদের উদ্দেশ্যে বললেন – “ডরো মাত্ । চলো, হাম সব পেড়োকো আপনে হাতোসে চিপককে রাখেঙ্গে। হমে বগড় মারকে উনলোগ পেড়োকো কাট নহী সকোগে। মত ডরো, জিৎ হামারা হি হোঙ্গে”। একদল অতি সাধারণ, নিরক্ষর গ্রামীণ মহিলার দুর্দমনীয় মনোবল ও পরিবেশ প্রকৃতির প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিল চামোলির অতুলনীয় অরণ্য সম্পদকে। গোটা বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো চিপকো আন্দোলনের চমকপ্রদ সাফল্যের বার্তা। নতুন ইতিহাস গড়লেন গৌরা দেবী ও রেনের মহিলা মঙ্গল সংগঠন। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ১৯৯১ সালে চিপকো জননী গৌরা দেবী মারা যান। তাঁর কৃতী কথা আজও সমুজ্জ্বল।

    (২) হিমাচলের কিঙ্করি দেবী (১৯২৫–২০০৭)


    ১৯২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি হিমাচল প্রদেশের সিরমৌর জেলার ঘাটো গ্রামের এক দরিদ্র দলিত পরিবারে কিঙ্করি দেবীর জন্ম। বাবা ছিলেন একজন সামান্য কৃষক। পারিবারিক আর্থিক চাহিদা মেটাতে সেই শৈশব কালেই প্রতিবেশীদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে বাধ্য হন তিনি।

    যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৪, কিঙ্করি দেবীর বিয়ে হলো শামু রাম নামে এক সামান্য চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের সঙ্গে। কিন্তু কপালে সুখ (?) স‌ইলো না। বিবাহিত জীবনের মাত্র আট বছরের মাথায় শামু রাম টাইফয়েডে মারা গেলেন। কিঙ্করির বয়স তখন মাত্র বাইশ।

    সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ জুটলো স্থানীয় প্রশাসনিক দপ্তরে। সন্মার্জনী হাতে প্রতিদিন কাজ করতে করতে তিনি আবিষ্কার করলেন -- “ অবাক কাণ্ড! পাহাড়ি অঞ্চলে রোজ রোজ এতো ধুলো বালি আসে কোথা থেকে? ছিঃ, ছিঃ এত্তা জঞ্জাল!” খোঁজখবর নেওয়া শুরু হলো। দিন কয়েকের মধ্যেই উত্তর খুঁজে পাওয়া গেল। তাঁদের গ্রামের আশেপাশের এলাকায় পাহাড় ফাটিয়ে চুনাপাথর উত্তোলনের কাজ শুরু হয়েছে জোরকদমে। তাই এতো ধুলোবালির প্রকোপ।

    কিঙ্করি দেবী দেখলেন এই খণির কারণেই বাড়ছে ধুলো, পাহাড়ি জলের উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ধানের খেত ছেয়ে গেছে সূক্ষ্ম ধুলোবালির আস্তরণে। এমন হলে তো সর্বনাশ!



    এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন ঐ সামান্য দলিত কন্যা অসামান্যা হয়ে। নিজে লেখাপড়া জানেন না, জনবল, অর্থবল কিছু নেই আছে কেবল অদম্য ইচ্ছা আর মনোবল। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন “People’s Action for People in Need” এর সদস্যরা কিঙ্করি দেবীর পেছনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সিমলা হাইকোর্টে ৪৮ জন খাদান মালিকের বিরুদ্ধে জনস্বার্থের মামলা দায়ের করলেন তিনি। কিন্তু চিরকাল‌ই যে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। খাদান মালিকদের সংগঠনের সঙ্গে এঁটে উঠবেন কি করে ঐ সহায় সম্বলহীনা দলিত মহিলা। সবাই তাঁকে বোঝালো – “কিঙ্করি! জলে থেকে তুমি কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করছো? তুমি আর‌ও বিপদে পড়বে।”

    এতো চাপের মুখেও কিঙ্করি অনড়, কিঙ্করি নিরুত্তাপ। তিনি জানতেন – সত্যের নাহি পরাজয়।

    অনশনে বসলেন কিঙ্করি। সেই গান্ধিবাদী পথ। সিমলা হাইকোর্টের বাইরে টানা উনিশ দিন ধরে চললো অনশন। বিচারবিভাগ নমনীয় হলো তাঁর আর্জি শুনতে। ততদিনে কিঙ্করি দেবীর এমন অনমনীয় মনোভাবের কথা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে কানাচে,এমনকি দেশের বাইরেও।১৯৮৭ সালে হাইকোর্টের রায় ঘোষণা করা হলো। তাতে কিঙ্করি দেবীর প্রিয় পাহাড়তলিতে সমস্ত রকম খাদানের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হলো। খাদান মালিকদের পক্ষ থেকে এই রায়ের বিরোধিতা করে আপীল করা হলো সুপ্রীমকোর্টে। দীর্ঘ শুনানির পর ১৯৯৫ সালে খাদান মালিকদের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। ভারতে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে আরও একটি নতুন অধ্যায়ের সংযোজন ঘটলো কিঙ্করি দেবীর হাত ধরে। ইচ্ছাশক্তির ওপর ভরসা রাখলে একজন অতি সাধারণ অবস্থায় থাকা মানুষ‌ও যে অনেক বড়ো কাজ করতে পারে, কিঙ্করি দেবী সেটাই আমাদের শিখিয়েছেন তাঁর মহতী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। শেষ জীবনে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তেমন ছিলনা। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হিলারি ক্লিনটন তাঁকে সাহায্য করে গেছেন। তাঁর এলাকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য কলেজ স্থাপনের পেছনে গভীর অবদান ছিল। ২০০৭ সালে প্রয়াত হন কিঙ্করি দেবী; তাঁর বয়স তখন ৮২ বছর।

    (৩) অরণ্যের জীবন্ত বিশ্বকোষ তুলসী গৌড়া


    রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হল। এই ঐতিহাসিক দরবার হলে আজ একেবারে চাঁদের হাট বসেছে।

    আজ দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্ম পুরস্কার প্রাপকদের হাতে তুলে দেবার দিন। ঘোষকের ঘোষণা অনুসারে একে একে পুরস্কার নিতে এগিয়ে আসছেন মাননীয় সম্মান প্রাপকরা রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দের সামনে। উপস্থিত দর্শকদের তুমুল করতালির মধ্যে ঘোষিত হলো পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য মনোনীত শ্রীমতি তুলসী গৌড়ার নাম। ধীর অকম্পিত পদক্ষেপে নগ্ন পদে প্রথাগত আদিবাসী পোশাক পরে এগিয়ে আসছেন তুলসী, দরবার হল তখন মুখরিত আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশে ব্যস্ত বিশিষ্টজনদের তুমুল করতালির শব্দে।

    কে এই তুলসী গৌড়া? সেকথা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সুদূর দক্ষিণী রাজ্য কর্ণাটকে। সেখানকার উত্তর কন্নড় জেলার বন দফতরের এক সরকারি নার্সারিতে ছোট ছোট চারা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত এক মহিলা, নার্সারিতেই কাজ করেন তিনি। তাঁর পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায় একটা ছোট্ট মেয়ে, মায়ের সঙ্গে সেও মেতে থাকে গাছের যত্ন আত্তিতে। মাঝে মাঝেই মা হাঁক পাড়েন – “তুলসী এল্লিড্ডিয়া? তুলসী তুমি কোথায়?” কচি কন্ঠের উত্তর ভেসে আসে – “আম্মা নানু ইল্লিড্ডেনে - মা,আমি এখানে।”

    এভাবেই জীবনের শুরুর অধ্যায় কেটেছে তুলসীর
    – মায়ের কাজের সূত্রে রোজ নার্সারিতে যাওয়া, গাছ, গাছের বীজ, উত্তর কন্নড়ের গহীন অরণ্যের লতাগুল্ম, গাছগাছালির নিরন্তর সঙ্গ তুলসীকে একটু একটু করে গাছপালাদের বিষয়ে অভিজ্ঞ করে তোলে। তুলসীর জন্ম সম্ভবত ১৯৩৮ সালে কর্ণাটক রাজ্যের উত্তর কন্নড় জেলার হোনাল্লি গ্রামের এক হত দরিদ্র হালাক্কি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর পরিবারে। যখন তাঁর বয়স মাত্র দুই, তুলসী হারান তাঁর বাবাকে। সেই থেকেই চলছে তাঁর লড়াই, মাথা উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। মায়ের পর নার্সারির কাজে যোগ দিলেন তুলসী - দিনমজুরের অস্থায়ী বন সহায়িকার কাজ। ছোট বেলা থেকে বনের বৃক্ষরাজির সঙ্গে কাজ করতে করতে তুলসী হয়ে ওঠেন একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, যাঁর জ্ঞান কেতাবি ব‌ই নির্ভর নয়, জীবনের নিখাদ ভালোবাসায় ভরপুর অভিজ্ঞতা লব্ধ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও তিনিই তাঁর বাস্তব জ্ঞানের সুবাদে হয়ে ওঠেন “উদ্ভিদবিজ্ঞানের‌ জীবন্ত বিশ্বকোষ” । জীবনের দীর্ঘ ৩৫টি বছর বনবিভাগের দৈনিক মজুরির এক সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পর কর্ণাটক রাজ্যের বনবিভাগ তাঁকে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করেন।এটা হলো তুলসী গৌড়ার ঐতিহ্যবাহী পরম্পরাগত জ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।



    বনের বৃক্ষরাজির যেকোনো গাছের মাতৃ প্রজাতি শনাক্ত করার বিষয়ে তুলসীর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় এই মাতৃ বৃক্ষের ভূমিকা অনন্য। এগুলিকে যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ ও প্রতিপালনের মাধ্যমেই একটি অরণ্যের প্রাকৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে। তুলসী গৌড়া এই শুদ্ধতা বজায় রাখতে সাহায্য করেন বনবিভাগকে। এই কাজ তিনি করে চলেছেন নিরলস প্রচেষ্টায়। গাছের সেবা মানে প্রকৃতির সেবা, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করা; এর থেকে জরুরি কাজ আর কিইবা হতে পারে? তুলসীকে তাঁর জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আদর করে ডাকে “বনদেবী, অরণ্যের জননী,কাদিনা দেবাতে।” প্রকৃতির সেবায় নিয়োজিত এই অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রতি র‌ইলো একরাশ ভালোবাসা আর পরিবেশ দিবসের শুভেচ্ছা। ভালো থাকবেন তুলসী। আজকের পৃথিবীতে আপনাকে বড়ো প্রয়োজন আমাদের।

    (৪) দ্য লেডি টারজান যমুনা টুডু (১৯৮০)


    শকুন্তলার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? কন্ব মুনির পালিত কন্যা। তপোবনের ছায়াঘন আশ্রমিক পরিবেশের মধ্যেই তাঁর ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠা। সহজ সরল আনন্দময় যাপনে অভ্যস্ত বনবালার জীবনে পশু পাখি, গাছপালা লতা বিতানের প্রভাব ছিল অপরিসীম। অরণ্যের শান্ত সমাহিত পরিবেশ‌ই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র আশ্রয়। অরণ্য হলো জীবদাত্রী, জীবধাত্রী। আর তাই সবুজের সমারোহ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে মন চায় না।

    আমাদের এই পর্বের নায়িকা যমুনা টুডুর জীবনের গল্পটাও অনেকটাই এমন। বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব চাকুলিয়া গ্রামের গৃহবধূ যমুনা টুডুর বাপের বাড়ি ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে। ১৯৮০ সালে ময়ূরভঞ্জের রায়রঙপুর গ্রামের এক সাধারণ আদিবাসী কৃষক পরিবারে যমুনার জন্ম। পড়াশোনার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল,তাই বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। দশম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ হলে বছর ১৮ র যমুনার বিয়ে হলো পূর্ব সিংভূম জেলার মুতুরাখাম গ্রামের মান সিং টুডুর সঙ্গে। ওড়িশার শকুন্তলার নতুন ঠাঁই হলো জঙ্গলে ঢাকা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে।

    কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধান ভানে। যমুনার বেলাতেও তেমনি ঘটলো। ওড়িশায় থাকতে বাবাকে দেখেছেন বাড়ির আশপাশে থাকা গাছেদের পরিচর্যা করতে। বাবার মুখেই সে শুনেছে আদিবাসী মানুষের জীবনে গাছপালা, বনজঙ্গলের গভীর প্রভাবের কথা। বাবা বলতেন – “গাছ হলো মাটি মায়ের প্রাণ। তাই তাদের যত্ন নিতে হবে, না হলে যে পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে মারাঙ্ বুরুর অভিশাপ”। ওপর‌ওয়ালা তাঁকে ঘর আলো করে থাকা একটা সন্তান দেননি, কিন্তু সেই দুঃখ ভুলে তিনি অরণ্য সংরক্ষণের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন। সবুজ গাছেরাই হয়ে উঠলো যমুনার পরম আত্মীয়, আত্মার আত্মজন।

    কিন্তু এখানে কাজটা ময়ূরভঞ্জের মতো মোটেই সহজ ছিল না।

    সিংভূমের জঙ্গলে কাঠ মাফিয়াদের দাপাদাপি ভীষণ রকমের। মাটি থেকে আকাশ ছোঁয়া বড়ো বড়ো শালগাছ, কেমন সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সে সবে অবশ্য মন মজেনা মাফিয়া বাহিনীর। রাতের অন্ধকারে সেই গাছগুলো কেটে শহরে পাচার করে তারা। এমনটা নজরে আসতেই যমুনা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। তাঁর একার মানায় কাজ হাসিল হবেনা বুঝতে পেরে তিনি ধীরে ধীরে সংগঠিত করতে শুরু করলেন গ্রামের মহিলাদের। ১৯৯৮ সালে মাত্র পাঁচজন মহিলাকে নিয়ে তৈরি হলো “বন সুরক্ষা সমিতি”। শুরুতে অনেক অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে যমুনাকে। “গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে” – তাঁর মুখে এমন কথা শুনে গ্রামের মানুষজন‌ই প্রথমে বিরোধীতা শুরু করে। তাদের প্রশ্ন – “গাছ না কাটলে উনুন জ্বালানোর রসদ মিলবে কোথা থেকে?”এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একটুও বেগ পেতে হয়নি যমুনার। তাঁর উত্তর শুনে একটু একটু করে যমুনার ওপর ভরসা রাখতে শুরু করে গাঁয়ের লোকজন। যমুনা বুঝতে পারেন, ঘরের লড়াইকে এবার বাইরের ময়দানে নিয়ে যেতে হবে। লড়াই হবে মুখোমুখি - এক দিকে কাঠ মাফিয়াদের সংগঠিত চক্র,যারা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের মৌরসিপাট্টা কায়েম করে রেখেছে সিংভূমের বনাঞ্চলের ওপর, অন্যদিকে অকুতোভয়ী যমুনা টুডু ও তাঁর সদ্যগঠিত বন সুরক্ষা সমিতি। অসম লড়াই জেনেও যমুনা পিছপা হননি, আক্রান্ত হয়েছেন, গাছ কাটা বন্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন একাধিকবার, তবুও হতোদ্যম হননি। নিজের বিশ্বাসে অটুট থেকেছেন।

    তাঁর এই লড়াইয়ের কথা ছড়িয়ে পড়তেই ভিড় বেড়েছে বন সুরক্ষা বাহিনীর ছাতার তলায়। প্রতিরোধের মুখে আরও মরীয়া হয়ে ওঠে বন মাফিয়া আর চোরাচালানকারীরা। ২০০৪ সালে যমুনাদের বাড়ির ওপর হামলা চালায়, প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় বেশ কয়েকবার। কিন্তু কোনোকিছুই যমুনাকে টলাতে পারেনি। ২০০৮ সালে মাফিয়াদের দলবল এক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে যমুনা ও তাঁর পরিবারকে নিকেষ করে দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু সমবেত প্রতিরোধের কাছে পরাভূত হয় অশুভ শক্তি। বন বিভাগ তথা প্রশাসনের নজরে আসে যমুনা টুডু ও বন সুরক্ষা সমিতির সদস্যদের হার না মানা লড়াইয়ের কথা। এতো কাল চোখ বুজে থাকা প্রশাসন নড়েচড়ে বসতেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে মাফিয়া চক্রের লোকজন। জয় হয় মানুষের সম্মিলিত শক্তির, জয় হয় বন সুরক্ষা প্রচেষ্টার,জয় হয় যমুনা টুডুর।



    এতোদিন বেআইনিভাবে জঙ্গল কেটে মুনাফা অর্জন ছিল ঐ অঞ্চলের এক শ্রেণির মানুষের উপার্জনের একটি সহজ মাধ্যম। যমুনা জানতেন সে কথা। তাই তিনি তিলতিল করে নিজেকে ও তাঁর এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নারীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন চরম লড়াইয়ের জন্য। বন-মাফিয়া এবং কাঠপাচারকারীদের থেকে বারবার হুমকি,বাধা পেয়েও থেমে থাকেননি যমুনাদেবী। বন্দুকবাজ বন-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লাঠি, তীর-ধনুক, বর্শা হাতেই স্থানীয় মহিলারা তাঁর নেতৃত্বে বনরক্ষার লড়াই শুরু করে জয় সহজে আসবেনা জেনেও। অবশেষে স্বস্তি ফিরে আসে পূর্ব সিংভূমের জঙ্গলতলিতে। মুতুরাখাম গ্রামের প্রমীলা বাহিনীর লড়াইয়ের কথা আজও আলোচনার টেবিলে ঝড় তোলে।

    বর্তমানে সেই পাঁচজন মহিলাকে নিয়ে গড়া বন সুরক্ষা সমিতির কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে অনেকটাই।

    এখন "বন সুরক্ষা সমিতির", ৩০০ টি দল রয়েছে এবং প্রত্যেক দলে ৩০ জন করে সদস্য রয়েছেন। তাঁরা যমুনাদেবীর নেতৃত্বে আজও বনভূমি বাঁচাতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। এখন ঝাড়খন্ড পুলিশ ও বনবিভাগ তাঁদের নিয়ে যৌথভাবে বনরক্ষার কাজ পরিচালনা করেন। ঝাড়খন্ড সরকার বর্তমানে যমুনাদের গ্রামটিকে দত্তক নিয়েছেন। শিক্ষা ও জল পরিষেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে যমুনার নিরলস লড়াইয়ে সুফল হিসেবে। এখন তাঁর গ্রামের কোনো পরিবারে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হলে ১৮ টি নতুন চারাগাছ এবং কন্যার বিবাহ হলে ১০ টি নতুন চারাগাছ রোপণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গাছের সঙ্গে মানুষের সখ্যতা চিরন্তন। তাই প্রতিবছর রাখী পূর্ণিমার দিন যমুনার নেতৃত্বে গ্রামের লোকজন গাছেদের রাখী পড়ায় মহা ধূমধামের সঙ্গে। যমুনা টুডু বিশ্বাস করেন ভাইয়েরা যেমন বোনেদের রক্ষা করে সমস্ত আপদ বিপদের হাত থেকে, ঠিক একই ভাবে গাছেরাও জীবনভর রক্ষা করে সমগ্র বিশ্বকে। এই গভীর ভালোবাসা আর অন্তহীন বিশ্বাস‌ই যমুনা টুডুর মতো এক সাধারণ আদিবাসী মহিলাকে স্বতন্ত্র, অনন্যসাধারণ করে তোলে। তাঁকে কুর্ণিশ জানাই।

    (৫) লিসিপ্রিয়া কাঙ্গুজাম (২০১১)


    ওর যা বয়স তাতে করে এখন খেলে বেড়ানোর কথা। সেই সবে মেতে না থেকে অথবা সেই সব করেও আমাদের এই ছয় ছোট্ট কন্যাটি নিয়মিত হিল্লি - দিল্লি, বেজিং - নিউইয়র্ক চষে বেড়ায়। এই ছোট্ট মেয়েটিই হয়তো আগামীদিনে ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী যদিও এখনও অনেক অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে ওকে।

    এই মেয়েটিই হলো লিসিপ্রিয়া কাঙ্গুজাম, ভারতের গ্রেটা থুনবার্গ। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সর্ব কনিষ্ঠ পরিবেশ কর্মী।

    মণিপুর কন্যা লিসিপ্রিয়ার জন্ম ২০১১ সালের ২ অক্টোবর বাশিখঙ্ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মৈতেই উপজাতীয় পরিবারে। বাবা কানারজিৎ ও মা বিদ্যারাণী দেবীর দুই মেয়ের মধ্যে লিসিপ্রিয়া বড়ো। এই ছোট্ট মেয়েটির পরিবেশের প্রতি অনুরাগের পেছনে সুইডিশ কন্যা গ্রেটা থুনবার্গের খুব বড়ো ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
    লিসিপ্রিয়া নিজেও এ কথা স্বীকার করে নিয়েছে।

    এতে এই ছোট্ট মেয়েটির কৃতিত্ব কোনোভাবেই খাটো হয়না, কেননা কেউ অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবেন এটা খুবই স্বাভাবিক , বিশেষ করে মহতী কোনো উদ্যোগের ক্ষেত্রে। যখন লিসিপ্রিয়ার বয়স মাত্র সাত, তখনই সে প্রথম পৃথিবীর বদলে যাওয়া বাতাবরণের সংকটের কথা এবং তার ফল হিসেবে বিপর্যয়ের সম্ভাব্যতা বিষয়ে মুখ খোলে।

    ২০১৮ সালেই সে তার বাবার সঙ্গে পাড়ি জমায় সুদূর মঙ্গোলিয়ায় সংযুক্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের দ্বারা আয়োজিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিষয়ক এক আলোচনা সভায়। এই সভায় উপস্থিত বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যে লিসিপ্রিয়া এতটাই প্রাণিত হয় যে দেশে ফিরেই সে চাইল্ড মুভমেন্ট নামে একটি সংগঠন স্থাপনের কথা ঘোষণা করে। জয় মা বলে উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি দেবার সেই শুরু।



    ২০১৮ সালে বানভাসি কেরালার মানুষজনের সাহায্যে ১০০০০০ টাকা তুলে দিয়ে আবারও সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে লিসিপ্রিয়া। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর চিঠিতে লিসি জানিয়েছিল, এই সামান্য সাহায্য যেন বন্যা পীড়িত শিশু কিশোরদের সহায়তায় খরচ করা হয়। এভাবেই সে একজন সংবেদনশীল মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

    ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর এক প্রতীকী সারভাইভাল কিট সামনে এনে রীতিমতো হইচই ফেলে দেয় লিসিপ্রিয়া। পৃথিবীর বায়ুদূষণ সমস্যা একটা ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছেছে। এরফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের প্রবীণ ও শিশুদের ভবিষ্যৎ। অথচ এই বিষয়ে সরকার তথা দেশের নাগরিক সমাজের খুব যে হেলদোল আছে তা মোটেই মনে হয় না। লিসিপ্রিয়া উদ্ভাবিত SUKIFU (Survival Kit for the Future) এই দূষণ সমস্যার থেকে স্বস্তি পাওয়ার একটা উপায় হয়ে উঠবে বলেই মনে করে এই ছোট্ট মেয়েটি। আইআইটি কাশ্মীরের অধ্যাপক চন্দন ঘোষের সহায়তায় তৈরি এই কিট-টি দিল্লির ভয়াবহ দূষণের কথা মাথায় রেখেই হয়তো তৈরি তবে আগামী দিনে এইটি হয়তো পৃথিবীর সবার জন্যই অনিবার্য হয়ে উঠবে।



    লিসিপ্রিয়া কাঙ্গুজাম ভারত তথা গোটা বিশ্বের জাগ্রত পরিবেশ চেতনার প্রতীক। আগামী পৃথিবীর ভার লিসিপ্রিয়াদের হাতে। এই হাত যত বেশি শক্তিশালী হবে তত টেকস‌ই হবে পৃথিবীর পরিবেশের ভবিষ্যৎ। সবে শুরু তাঁর দীর্ঘ পদযাত্রা। কোনো গিমিক নয়, লিসিপ্রিয়া বেড়ে উঠুক আপন চেতনার আলোকে। আমরা তাঁর বৃহত্তর কর্মকাণ্ডের জন্য অপেক্ষা করে থাকবো।

    অন্ত্যকথা

    বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ভারতের পাঁচজন কৃতী পরিবেশবিদদের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। পরিবেশ নিয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এইসব মানুষদের আরও বেশি করে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে হবে আমাদের। এই পঞ্চকন্যার কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ করে যদি আমাদের নবীনতর প্রজন্মের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে পারে তাহলে সেটাই হবে পরিবেশ দিবস উদযাপনের সবথেকে বড়ো সার্থকতা।

    সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
    মধ্যমগ্রাম।
    জুন ৫, ২০২৪
     
    এই লেখার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ছবিগুলো যোগ করে দিয়েছেন আমাদের প্রবাসী সুজন শ্রী কল্পতরু বর্মন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ০৫ জুন ২০২৪ ০৭:১৮532701
  • খুব ভালো লাগল এই কৃতী পরিবেশবিদদের কথা জেনে। অনেক ধন্যবাদ।
  • kk | 172.56.***.*** | ০৫ জুন ২০২৪ ০৮:০০532702
  • এঁদের কথা জেনে খুব ভালো লাগলো।
  • Ritabrata Gupta | 2401:4900:7077:7feb:8fc8:2181:bd70:***:*** | ০৫ জুন ২০২৪ ০৯:১১532704
  • অসম্ভব ভালো লাগলো! চিপকো আন্দোলন ছাড়া বাকি কিছু জানতাম না। দারুন লিখেছেন সোমনাথদা! ঋদ্ধ হলাম! 
  • সম্রাট রায় | 2409:40e0:101:3aee:9f78:d7bc:a9e0:***:*** | ০৫ জুন ২০২৪ ১০:২৪532708
  • অসাধারণ। খুব প্রয়োজনীয় লেখা।
  • সুমিত মুখার্জী | 2401:4900:3141:27b1:0:62:8a40:***:*** | ০৫ জুন ২০২৪ ১৮:১৭532728
  • একসঙ্গে পাঁচজন পরিবেশ তারকার পরিচয়, সত্যিই প্রশংসার দাবী করে।
  • সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় | 2409:40e0:5c:a567:8000::***:*** | ০৮ জুন ২০২৪ ১১:৩১532900
  • পরিবেশ ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ সেবক এই পঞ্চকন্যার কথা জেনে মুগ্ধ হলাম শ্রী সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য লেখাটির মাধ্যমে। লেখককে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। এদের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরিবেশ রক্ষার লড়াইটা লড়তে হবে আমাদের সবাইকে, একজোট হয়ে। তামাম মানুষের মনে পরিবেশ সচেতনতার সুবুদ্ধি জাগ্রত হোক।
  • Somnath mukhopadhyay | ০৯ জুন ২০২৪ ০০:১৪532922
  • পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে আজ কোমর বেঁধে সবাইকে নেমে পড়তে হবে। এক উষ্ণায়নের সমস্যা অন্য সমস্যাগুলোকে প্রকট করে তুলছে। আমাদের জীবন পরিবেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রহিত হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ রুক্ষতাকে ডেকে আনা । অথচ নিবন্ধে বর্ণিত পঞ্চকন্যা প্রকৃতিকে নিবিড় সম্পর্কে বেঁধে রাখার লড়াইয়ের কথাই বলেছেন। এদের কথা ছড়িয়ে পড়ুক।
  • aranya | 2601:84:4600:5410:2c81:2fef:d745:***:*** | ০৯ জুন ২০২৪ ১১:২১532940
  • অসাধারণ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন