ভোর হতে আর দণ্ড তিনেক দেরি আছে হয়তো বা। ভল্লার ইচ্ছে ছিল এটুকু সময় সে একটু ঘুমিয়ে নেবে। সে আর হবে না। রামালির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া হল। ছেলেটা কখন এসেছিল তার কাছে? তার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়েই পড়েছে বেচারা। রামালির পাশেই মাটিতে বসল ভল্লা। ছেলেটির বাহুতে হাত রেখে মৃদু স্বরে ডাকল, “রামালি, এই রামালি”।
রামালি ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসল। ভল্লার দিকে তাকিয়ে দেখল, দেখল তার চারপাশ। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই রামালি বলল, “এঃ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!”
ভল্লা হাসল, “এসেছিস কখন?”
“অনেকক্ষণ। দেখলাম তোমার ঘর খালি। তুমি নেই। ভাবলাম গেছ কোথাও, চলে আসবে এখনই। তাই বসে পড়লাম তোমার অপেক্ষায়। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি...”।
ভল্লা বলল, “তো মাঝরাতে আমার কাছে কেন? কোন সমস্যা হয়েছে?”
মাথা নীচু করে রামালি বলল, “আমার সমস্যা তো তুমি জানই, ভল্লাদাদা। কাকিমা। হানোর মৃত্যু। আমাদের রামকথা শুনতে যাওয়া। আস্থানের ডাকাতি। কাল সারাদিনই গ্রামের বয়স্করা ব্যতিব্যস্ত ছিল নানান জল্পনায়। সন্ধের পর বাড়ি ফিরতে দেখি তুলকালাম কাণ্ড। দেখি কাকিমা কাকাকে যাচ্ছেতাই গালাগালি করছে আর শাপশাপান্ত করছে। কাকা বাইরের দাওয়ায় ভিজে বেড়ালের মতো বসে আছে। তার দুপাশে বসে আছে কাকার তিন ছেলেমেয়ে। আমি বাড়িতে পা দিতেই মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল, “মা, মা, রামালিদাদা এসেছে”। ব্যস, আর যায় কোথায়? কাকিমা ভেতর থেকে বেরিয়ে এল হাতে ঝ্যাঁটা নিয়ে। প্রথমেই অশ্রাব্য কিছু গালাগাল দিল, তারপর দাওয়া থেকে তাড়াহুড়োয় সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে, আছড়ে পড়ল মাটিতে। মাথার পিছনটা ঠুকে গেল সিঁড়ির নীচের ধাপিতে। অজ্ঞান হয়ে উঠোনে পড়ে রইল হাত-পা ছড়িয়ে। আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কাকা আর তার তিন ছেলেমেয়ে হাহাকার করে দৌড়ে গেল কাকিমার দিকে। তাদের চেঁচামেচি শুনে পাশের বাড়ির লোকজনও দৌড়ে এল। অনেকে মিলে কাকিমাকে তুলে নিয়ে গেল দাওয়ায়। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ তার মুখে মাথায় জলের ছিটে দিতে লাগল, কেউ পাখার হাওয়া করতে লাগল। আমি কী করব, কী করা উচিৎ না বুঝে, একইভাবে দাঁড়িয়েছিলাম। একফাঁকে কাকা এসে কানে কানে, তুই এখন যা রামালি। অশথ তলায় অপেক্ষা করিস। তোর কাকিমা একটু সুস্থ হলেই আমি যাবো। তুই এখন যা”।
এতক্ষণ ভল্লা চুপ করে শুনছিল। রামালি থামতেই ভল্লা উঠে গিয়ে চকমকি পাথর ঘষে আগুন জ্বালল। উনুনের মধ্যে আগুনটা গুঁজে দিয়ে আরো কিছু কাঠকুটো রাখলো উনুনের মধ্যে। তারপর ঘর থেকে গতকালের মালসাতে জল নিয়ে বসিয়ে দিল উনুনের ওপর। পাঁচ মুঠি চাল ফেলে দিল মালসায়। তারপর উনুনের আগুনটাকে উস্কে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কাকা এসেছিল?”
“এসেছিল। বলল, তুই আর বাড়িতে আসিস না, রামালি। দেখতে পাচ্ছিস তো, তোর কাকিমার অবস্থা? আমাকেও স্বস্তিতে বসতে দিচ্ছে না এক দণ্ড। এতদিন এসব সহ্য করেও চলছিলাম। কিন্তু আজ গ্রামে একটা কথা উঠেছে। কাল রাত্রে নাকি তোরা রামকথা শুনতে যাসনি? আস্থানে গিয়েছিলি ডাকাতি করতে! সে কথা তোর কাকিমার কানেও গেছে। সে কথা শোনার পর থেকেই উন্মত্ত হয়ে গেছে তোর কাকিমা”।
“তার মানে কাকার অন্ন তোর ঘুঁচল। তোদের আবাদী ক্ষেত কত আছে?”
“তা আছে – ওই সাত-আট বিঘে মতো”।
“তাতে তোর মানে তোর বাবার অংশ নেই?”
“আছে বৈকি। যা ক্ষেত তার অর্ধেকটা তো বটেই। সেটাই তো কাকিমার আক্রোশ, ভল্লাদাদা। বড় হচ্ছি, আমি যদি বাবার অংশের ভাগ চাই? সংসারে ভাইপো পোষা আর দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পোষা একই ব্যাপার”। রামালি বিষণ্ণ হাসল, তারপর বলল, “কী হবে ওই ভাগের ক্ষেত নিয়ে? আমারও পেট ভরবে না, কাকারও নয়। মাঝের থেকে উঠতে-বসতে কাকিমা বাপান্ত করবে আমার এবং কাকারও”।
“হুঁ। তাহলে? এখন কোথায় থাকবি? খাবি কি?”
একটু ইতস্ততঃ করে রামালি বলল, “তুমিও নির্বাসিত, আমিও তাই। তোমাকে নির্বাসন দিয়েছে রাষ্ট্র, আমাকে আমার পরিজন। তোমার কাছেই থাকব। তুমিই খাওয়াবে!”
ভল্লা উনুনের মুখে আরো কিছু কাঠকুটো গুঁজে দিয়ে, ফুটন্ত জলের থেকে দু-চারদানা ভাত তুলে দেখল, সেদ্ধ হয়েছে কিনা। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে রামালির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাঃ বেড়ে বুদ্ধি খাটিয়েছিস, তো? কাকাকে ছেড়ে দিয়ে এখন আমার ঘাড়ে এসে চড়বি?”
রামালি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ভল্লার চোখের দিকে। তারপর মাথা নীচু করে অনেকক্ষণ ভাবল। তারপর আবার মাথা তুলে, চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি শক্তি চাই। আমি দক্ষতা চাই। তোমার মতোই জীবন-মৃত্যুকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাই। এতদিন যে মরার মতো বেঁচে রয়েছি, তার থেকে মুক্তি চাই। মাথা তুলে বুক চিতিয়ে লড়তে চাই। বাঁচতে গিয়ে যদি মরতেও হয় – তাতেও আমি রাজি। তুমি আমাকে গড়ে তোল, ভল্লাদাদা”। তীব্র জেদ আর ক্রোধে রামালির দুই চোখ এখন আগুনের মতো জ্বলছে।
ভল্লা রামালির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘরে ঢুকে বাঁদিকের কোনায় দেখবি একটা ঝুড়িতে পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা আছে, নিয়ে আয়। ওই সঙ্গে একটা সরাও আনবি আর নুনের পাত্রটা…” রামালি উঠে ঘরের দিকে যেতে ভল্লা বলল, “তুই তো আর নরম কাদার তাল নোস, রামালি, আর আমিও কুমোর নই। গড়তে হলে, তোকে নিজেকেই গড়তে হবে – আমি পাশে থাকব – মাঝেসাঝে দেখিয়ে দেব, ব্যস্ ওইটুকুই”।
ভাতটা হয়ে এসেছিল। উনুনের গর্ত থেকে জ্বলন্ত কাঠ-কুটো সরিয়ে নিয়ে ভল্লা বলল, “সরাটা নিয়ে বস, গরমগরম দুটো ফ্যানভাত খা। পেঁয়াজ-লঙ্কা যা নেবার নিয়ে নে”। কাঠের হাতা দিয়ে মাটির সরায় ভাত তুলতে তুলতে ভল্লা আরও বলল, “কাল নিশ্চয়ই সারাদিন-রাত পেটে কিছু পড়েনি? খিদে পেলে না, আমারও মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয় সব শালাকে দেখে নেব। ওই তাদের – যাদের দুবেলা দুমুঠো খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও, দেয় না। যেমন তোর কাকা-কাকিমা, তোর পৈতৃক অংশের ভাগও দেবে না, আবার তোকে খেতে না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবে…। নে, শুরু কর”।
ভল্লা যে তার কথা ভেবেই এই শেষ রাত্রে ভাত রান্না করল, এই সামান্য আন্তরিকতায় রামালি অভিভূত হয়ে পড়ল। বলল, “ভল্লাদাদা, তুমি শুধু আমার জন্যেই…”?
ভল্লা হাসল, বলল, “তা নয়তো কি, আমার জন্যে? শেষ রাতে কেউ, নিজের জন্যে রাঁধতে বসে? কিন্তু এতক্ষণ তো তোর চোখে দিব্যি আগুন দেখতে পাচ্ছিলাম, সামান্য ফানভাত আর পেঁয়াজেই চোখে জল এসে গেল? চোখে জল নিয়েই কি তুই বুক চিতিয়ে লড়বি, রামালি?”
রামালি বাঁহাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হেসে ফেলল, গরমভাত মুখে তুলে পেঁয়াজে কামড় দিয়ে বলল, “না ভল্লাদাদা, বেশ কিছু দিন ধরেই মনে হচ্ছিল এভাবে সারাক্ষণ লাথি-ঝ্যাঁটা খেয়ে বেঁচে থাকার মানে হয় না। হয় লড়তে হবে নয় মরতে হবে। এই সময়েই তুমি আমাদের গ্রামে এলে…”।
ভল্লা রামালির সরায় আরও দুহাতা ভাত দিয়ে বলল, “গ্রামের কী পরিস্থিতি বল তো? শল্কু আর আহোক ঠিক আছে?”
“হানোর মৃত্যুতে গভীর দুঃখ পাওয়া ছাড়া গ্রামের মানুষদের তেমন কোন হেলদোল নেই, ভল্লাদাদা। দুপুরের পরে গ্রামে বার্তা এল, আস্থানে ডাকাতি হয়েছে, তিনজন রক্ষী মারা গেছে। তাতেও গ্রামের লোক তেমন উৎসাহ দেখাল না। বিকেলের দিকে শুনলাম, কেউ নাকি বলেছে, সে রাত্রে রামকথা দেখতে যাওয়ার নাম করে, আমরাই নাকি আস্থানে ডাকাতি করতে গিয়েছিলাম”।
“কে ছড়ালো কথাটা, জানিস? আমাদের মধ্যেই কেউ বলে দেয়নি তো? শালু বা আহোক, বা অন্য কেউ?”
“মনে হয় না। আমরা তো প্রায় সারাক্ষণই হানোকে নিয়ে ছিলাম। একটু বেলা হলে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করা হল। ওর বাবা চিতাগ্নি করল। আমাদের মধ্যে কেউ বলেছে বলে মন হয় না, ভল্লাদাদা”।
“সারা দিনে কেউ বাড়ি যায়নি? দুপুরে খেতেও যায়নি”।
“না, ভল্লাদাদা। একবার মড়া ছুঁয়ে ফেললে, সে দেহের দাহ সৎকার না করলে, বাড়ির লোকেরা আমাদের ঢুকতেই দেয় না। হানোর সৎকার করতে করতে সন্ধে হয়ে গেল, তারপরেই দীঘির জলে স্নান সেরে আমরা যে যার বাড়ি ফিরেছিলাম”।
“খাওয়া হয়ে গেছে? যা মুখ হাত ধুয়ে আয়। ওই সঙ্গে এই মালসা, সরাগুলোও ধুয়ে আনবি। বাড়ির বাইরে যখন বেরিয়েছিস, নিজের কাজ এখন নিজেকেই করতে হবে”।
ভল্লার কথায় রামালি উজ্জ্বল চোখে হাসল, “করবো, ভল্লাদাদা। আমি এ সবই করেছি। ছোটবেলায় বাপ-মা মরা ছেলেদের এ সব করতেই হয়”।
ভল্লা এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে যা। সব কথাতেই এমন নাকে কান্না শোনাস না তো! জগতে তোর নাকে কান্না শোনার জন্যে কেউ বসে নেই। কথাটা মনে রাখিস”। রামালি পুকুর থেকে ফিরতে ফিরতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। ধোয়া পাত্রগুলো ভল্লার ঘরে সাজিয়ে রেখে রামালি বাইরে আসতেই ভল্লা বলল, “চ তোকে একটা যন্ত্র দেখাই”। ঝোপের আড়াল থেকে লুকোনো দুজোড়া রণপা বের করে ভল্লা এক জোড়া রামালির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এ দুটো কি জানিস”?
রামালি বলল, “বাঁশ, আমাদের এখানে হয়না। শুনেছি পূবের জঙ্গলে হয়। খুব কাজের জিনিষ”।
ভল্লা মুখ ভেটকে বলল, “ব্যাঁশ...বাঁশ তো সবাই জানে...বাড়িতে তুই যে কাঠের পিঁড়িতে বসিস, সেটা কি শুধুই কাঠ? চাষের সময় যে লাঙল ঠেলিস, সেটাকেও কি কাঠ বলিস?” রামালি কিছু বলতে পারল না। বাঁশের গায়ে হাত বুলিয়ে সে ভাবতে লাগল।
“বুঝতে পারলি না তো? এটাকে রণপা বলে”।
“রণপা? তাই? শুনেছি, এতে চড়ে লোকেরা নাকি খুব দৌড়তে পারে। দেখিনি কোনদিন”। রামালি এবার বাঁশের খুঁটি দুটোকে অন্য চোখে দেখতে লাগল।
“এই দ্যাখ” বলে, দুহাতে বাঁশ দুটো ধরে, ভল্লা তুড়ুক লাফে উঠে পড়ল বাঁশের গায়ে বেরিয়ে থাকা দুটো ফেঁকড়ি কঞ্চির ওপর। তারপর চারপাশে কিছুক্ষণ হেঁটে চলে দেখাল। রামালি অবাক হয়ে দেখছিল, আর ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। মানুষের পাদুটোকে যদি আরও হাত দেড়-দুয়েক লম্বা করে ফেলা যায় – তাহলে হাঁটার গতি তো বাড়বেই। আর দৌড়তে পারলে তো কথাই নেই।
রামালি দুহাতে চেপে ধরল বাঁশদুটোকে, তারপর লাফ দিয়ে উঠে পড়ল কঞ্চির ওপর। টলমল করছিল, কিন্তু চেষ্টা করতে লাগল দুই রণপায়ে সমান ভর দিয়ে দাঁড়াতে। এবার ভল্লাই বেশ অবাক হল, বলল, “বাঃ, তোর বেশ এলেম আছে তো? প্রথম বারেই দিব্যি চেপে পড়লি। আমি বাবার কাছে শিখেছিলাম, প্রথমবার চড়তে গিয়ে কতবার যে আছাড় খেয়েছিলাম...। এই দ্যাখ, এইভাবে সোজা হয়ে দাঁড়া। ও দুটো যে বাঁশের লাঠি, ভুলে যা। মনে কর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছিস, সোজা। চেষ্টা কর পারবি...”।
রামালি পারছিল, কিন্তু কিছুক্ষণের জন্যে...তারপরেই টলমল করছিল আবার। ভল্লা বলল, “বাচ্চারা যখন প্রথম হাঁটতে শেখে দেখিস নি? তোকেও কি এখন হাঁটতে শেখাতে হবে? বলছি না, ওদুটো যে তোরই পা, সেটা মনে গেঁথে ফ্যাল। হাতের টানে আর পায়ের ঠেলায় হাঁটতে চেষ্টা কর। ভল্লা বার কয়েক হেঁটে দেখাল। রামালি পারল না, হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেল। হাত থেকে খুলে গেল লাঠি দুটো।
ভল্লা কোন গুরুত্বই দিল না, বলল, “ঠিক আছে, আবার চেষ্টা কর, হয়ে যাবে...মনে রাখিস সকাল হলেই তুই রণপা চড়ে এই জঙ্গলের সীমানায় যাবি। রণপা চড়ে গ্রামে ঢুকবি না। সেখানে রণপা রেখে, শল্কু, আহোক এবং আমাদের দলের আরও কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে আসবি। বলবি ভল্লাদাদা ডাকছে। তারপর আবার রণপা চড়েই আমার কাছে ফিরে আসবি। রাত জেগে তোকে ভাত রেঁধে খাওয়ালাম, কি অমনি অমনি? ও হ্যাঁ, গ্রামের লোকদের বলে দিস, আজ বা কাল আস্থান থেকে রক্ষীদের দল আসতে পারে...ডাকাতির তদন্ত করতে। আমাদের ছেলেদের মানা করে দিবি, ওদের সামনে যেন না যায়। কোন তর্কাতর্কি, ঝগড়া-ঝাঁটিতে জড়াতে নিষেধ করবি। .গ্রামের বয়স্ক মানুষরাই যেন ঠাণ্ডা মাথায় ওদের মুখোমুখি হয়। মনে থাকবে? এখন কিছুক্ষণ অভ্যাস করে নে, তারপর রণপায় চড়ে ঘুরে আয়”।
টলমল করে রামালি একটু একটু এগোচ্ছিল, আর উলটে পড়ছিল ধপ ধপ করে। জঙ্গলের সরু পথে দুপাশেই রয়েছে ছোটছোট ঝোপঝাড়। পড়ে গেলে খোঁচা-টোঁচা লাগবে, ছড়ে-টড়ে যাবে – তবে বড়ো কোন আঘাত লাগবে না। ভল্লা সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মৃদু হাসল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, “আমার চোখের আড়াল হলেই, তুই যে রণপা ছেড়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে যাবি আর ফিরে এসে আমাকে ফাঁকি দিবি, সে কথা মনেও ঠাঁই দিস না, রামালি। বুঝতে পারলে তোর ঠ্যাং ভেঙে আমিই গিয়ে তোর কাকির কাছে আবার ফেলে আসব। বলব, আমার কাছে যাতে আর না আসতে পারে, তাই ওকে রেখে গেলাম। মনে থাকে যেন”।
রামালি চেঁচিয়ে উত্তর দিল, “আর যদি পারি?”
“তাহলে ওই রণপাজোড়া তোর – আর ওই সঙ্গে পাবি নতুন একটা বল্লম”।
“আমি আসছি ভল্লাদাদা, বল্লমটা এনে রাখো”।
রামালি দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে ভল্লা রণপা থেকে নেমে কিছুক্ষণ বসে রইল। এখন তার তেমন কিছু করার নেই। বসে থাকলে নানান চিন্তায় মাথাটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে – কিছু কাজ হবে না। ভল্লা উঠে দাঁড়াল, রণপা দুটো আগের জায়গাতেই লুকিয়ে রেখে উঠে পড়ল সামান্য দূরের একটা বড়ো গাছে। ওই গাছের ওপরেই রয়েছে তার ঘুমোনোর ঠেক। ভল্লা নিজের কুটিরে কখনোই ঘুমোয় না, বেশিক্ষণ থাকেও না। তার কাজটা এমনই, নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব শুধু তারই। সে প্রশাসনের গোপন কাজ করছে বলেই, প্রশাসন তার জীবনের দায় নিয়ে নিয়েছে এমন নয়। কোন শত্রু বা গুপ্ত ঘাতকের হাতে তার প্রাণ গেলে, প্রশাসন বিন্দুমাত্র দায় নেবে না। কিংবা বলবে না, আমাদের কাজ করতে গিয়ে মহান ভল্লা তার প্রাণটাকে উৎসর্গ করেছে!
এই কুটিরের আশেপাশের চারটে গাছে তার শোয়ার জায়গা বানানো আছে। কবে কোথায় সে শোবে, সে নিজেও জানে না। ভল্লা সেরকমই একটা গাছে উঠে পড়ল। অনেকটা উঁচুতে দুই ডালের মধ্যে বানানো কাঠের মাচায় উঠে সে এলিয়ে দিল শরীরটাকে। রামালির ফিরতে প্রহরখানেক তো লাগবেই। অতএব এখন কোন কাজ যখন নেই, শরীরটাকে কিছুক্ষণ আরাম দেওয়া যাক।
- - - -
খট খট আওয়াজে ভল্লার কাকনিদ্রা টুটে গেল। উপুড় হয়ে মাচার কিনারা থেকে দেখল, ব্যাপারটা কি? রামালি রণপা চড়ে ফিরল। তার কাঁধে ছোট্ট একটা ঝোলা। ভল্লা খুশি হল, হতভাগা ভালই রপ্ত করেছে। এরপর ওকে রণপা নিয়ে ছোটাতে হবে। ভল্লা কোন সাড়া না দিয়ে চুপ করে দেখতে লাগল।
রামালি তার কুটিরের সামনে এসে দাঁড়াল। ছোট্ট লাফ দিয়ে মাটিতে নামল রণপা থেকে। রণপাজোড়া তার দেখানো ঝোপের মধ্যেই লুকিয়ে রাখল। তারপর তার ঘরের মধ্যে উঁকি দিল। তারপর পুকুরের দিকে গেল। একটু পরে আবার ফিরে এল। ফিরে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। বকের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। ভল্লাকেই খুঁজছে, হতভাগা। পাখির মতো রামালির কার্যকলাপ দেখতে ভল্লার বেশ মজা লাগছিল। শুধু যে মজা লাগছিল তাই নয়, নিজেকে ভগবান বলে মনে হচ্ছিল।
বহুদিন আগে দূরের কোন এক গ্রামের একটি মন্দিরে তাকে রাত কাটাতে হয়েছিল। মন্দিরের পুরোহিত তাকে মন্দিরে ঢুকতে দেয়নি। কারণ সে শূদ্র। ভল্লা মিথ্যে করে নিজেকে ক্ষত্রিয় বলতেই পারত। বলেনি। পুরোহিতের দেওয়া প্রসাদ খেয়ে মন্দিরের বাইরে চাতালে শুয়েই রাত কাটিয়েছিল। সেই পুরোহিত তাকে বলেছিল, “জাত-পাত নিয়ে দুঃখ করিস নি, বাপু। এসব তো আর আমরা বানাইনি, বানিয়েছেন ভগমান। তোকে যদি মন্দিরে থাকতে দিই, ভগমান ঠিক দেখতে পাবেন। তিনি ওপর থেকে সবার দিকে সবসময়ই লক্ষ্য রাখেন কিনা? তাঁর বিচারে আমাদের যে নরকে ঠাঁই হবে, বাপু”। দুঃখ করার লোক ভল্লা নয়। সে দুঃখ পায়ওনি।
পরেরদিন সূর্যোদয়ের আগেই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, এবং দৈবাৎ তার চোখে পড়েছিল মন্দিরের দরজা ফাঁক করে চুপিসাড়ে বেরিয়ে আসছে একটি মেয়ে। মেয়েটির চটকদার চেহারা, চালচলন, পোষাক-টোষাক দেখে, তাকে পতিতা গোত্রের রমণী বলেই মনে হয়েছিল ভল্লার। ব্রাহ্মণী হতেই পারে না – নিশ্চয়ই কোন অন্ত্যবাসিনী। দেখে হাসি চাপতে পারেনি, হো হো করে হেসে উঠেছিল। তার হাসির শব্দ শুনে বেরিয়ে এসেছিল পুরোহিত ব্যাটাও। ভ্রূকুটি করে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এই সাতভোরে হ্যা হ্যা করে হাসছিস কেন রে, শূদ্দুরের পো?” ভল্লা হাসতে হাসতেই বলেছিল, “আপনার ব্রাহ্মণীটি কিন্তু বেশ পুরুতমশাই। আপনার ভগমান দেখেছেন। চিন্তা করবেন না, আপনার জন্যে নরকে নয়, স্বর্গেই পাকা বাসা তৈরি হচ্ছে...”। পুরুতটা দাঁতে দাঁত চেপে তার বাপান্ত করেছিল, বেশি চেঁচামেচি করতে পারেনি - লোক জানাজানি হওয়ার ভয়ে।
সেই ভগবানের মতোই দেখছিল ভল্লা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রামালি ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এল, বড়ো কলসিটা হাতে নিয়ে। ভল্লা জানে ওটা খালি। খালি কলসি নিয়ে রামালি পুকুরের দিকে গেল। এবার নীচেয় নেমে এল ভল্লা। পুকুর থেকে ফেরার আগেই ভল্লা তার কুটিরের সামনে গিয়ে বসল। রামালি কলসিতে জল ভরে ফিরল। তার একহাতে ভরা কলসি আর অন্য কাঁধে বেশ কিছু শুকনো ডালপালা।
রামালি জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় গেছিলে, ভল্লাদাদা?”
“ঘুমোচ্ছিলাম। তোর রণপার আওয়াজে ঘুম ভাঙল”।
“ঘরে ঘুমোও না? কোথায় ঘুমোও তাহলে?”
“না রে, ঘরে ঘুমোনোর কপাল কী আর আমাদের?”। রামালি উনুনের সামনে ডালপালাগুলো ঢেলে দিয়ে ঘরে গেল কলসিটা রাখতে। বেরিয়ে এসে উনুনের সামনে বসে কাঠকুটোয় আগুন ধরিয়ে, উনুনে গুঁজে দিল। কিছু ডালপালাও গুঁজে দিল তার মধ্যে। ভল্লা বলল, “তুই রান্না চাপাবি নাকি”?
মালসায় জল ভরে ঘরের বাইরে এল রামালি, মালসাটা উনুনের ওপর চাপিয়ে বলল, “কী খাবে? গ্রাম থেকে কিছু আনাজ এনেছি। লওকি, মেটেকন্দ আর কুঁদরি”।
“কোথা থেকে আনলি?”
“কেন আমাদের বাড়ি থেকে? আমাদের বাড়ির পেছনে অনেকটা জায়গা, সেখানে ভালই আনাজ-টানাজ হয়।”
“বলিস কী? তোর কাকি কিছু বলেনি?”
“বলেনি আবার? আমিও বললাম, ক্ষেতি-বাড়ির অর্ধেক ভাগ তো ছেড়েই দিলাম, দুটো আনাজ নিয়েছি...উরে বাব্বা...”, রামালি হাসতে লাগল খুব, হাসির বেগ কিছুটা কমিয়ে বলল, “যা বুলি ছোটাল না, ভল্লাদাদা...যত গাল দেয় আমিও হাসি...”, আবারও হাসতে হাসতে বলল রামালি।
ভল্লা বেশ অবাক হল, রামালির সঙ্গে যেদিন থেকে তার পরিচয়, কোনদিন ওকে হাসতে দেখেনি। সেই ছেলেটা এক রাত্তিরে এমন বদলে গেল কী করে? এই ছেলেটাই সেদিন গভীর শীতলতায় এতদিনের বন্ধুকে নির্দ্বিধায় হত্যা করেছে। তার মুখে চোখে আচরণে কোথাও সে ঘটনার জন্যে কোন গ্লানি নেই। এই যে হাসছে ও, ভল্লার মতো মানুষও আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে...এত সুন্দর সরল হাসি হাসতে পারে ছেলেটা? সাংঘাতিক তো!
“যাগ্গে কী খাবে বলো। খিচড়ি বানাবো? তোমার ঘরে দেখলাম, চাল-ডাল আছে। তার সঙ্গে মেটেকন্দ আর কুঁদরি ভাজা...”
ভল্লা উদাস সুরে বলল, “বানা, আজকে তুই যা খাওয়াবি, সব খাবো। এমনিতেই আমি তো হেরে ভূত হয়ে গেছি”।
“কার কাছে”? অবাক হয়ে রামালি জিজ্ঞাসা করল।
“তোর কাছে রে হতভাগা। রণপা জোড়াও গেল, চকচকে একটা বল্লমও গেল”।
“সত্যি, ভল্লাদাদা”? উচ্ছ্বসিত আনন্দে রামালি চিৎকার করে উঠল। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল ভল্লাকে।
ভল্লা তার পিঠে চাপড় মেরে বলল, “এ তো সবে শুরু রে রামালি, এর থেকেও অনেক বড়ো বড়ো কাজ তোকে করতে হবে...। কিন্তু শল্কুরা কখন আসবে”?
“আসছে। ওরা ছজন আসছে। দুপুরের খাওয়ার পর ওদের আসতে বলেছি...” একটু ইতস্ততঃ করে আবার বলল, “তোমার এদিককার অবস্থা তো জানি, ওরা সবাই না খেয়ে এলে, তুমি সামলাতে কী করে?”
ভল্লা হাসল, কিছু বলল না।
রান্না করতে করতে, তাঁতের মাকুর মতো রামালি ঘর-বার করছিল, সে সময় হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, “ভল্লাদাদা তুমি তো ঘুমোচ্ছিলে - কেমন করে জানলে আমি রণপায়ে হাঁটা শিখে গেছি?”
ভল্লা বলল, “ঘুম ভাঙল তোর রণপায়ের খট খট আওয়াজে… তারপর ভগবানের মতো ওপর থেকে সব দেখলাম…”।
“ভগবানের মতো? তার মানে”?
ভল্লা তার সেই মন্দিরের পুরোহিত আর তার ভগবানের গল্পটা রামালিকে শোনালো। রামালি হাসতে হাসতে বলল, “তুমি খুব বেঁচে গেছ ভল্লাদাদা। আমাদের এদিককার পুরোহিতরা, রেগে গিয়ে পৈতে ছিঁড়ে কাউকে অভিশাপ দিলে, সে নাকি সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। চিন্তা করো, লোকটা অভিশাপে মরল বটে, কিন্তু বেঁচে গেল তার যাবতীয় শ্মশান-খরচ!”।
রামালি হাসল না, কিন্তু তার কথার ভঙ্গীতে ভল্লা হেসে উঠল হো হো করে। কিছুক্ষণ পর ভল্লা বলল, “অনেকদিন পর এমন হাসলাম, বুঝলি রামালি। সারাদিন নানান কূটকচালি চিন্তা, লোকজনের বজ্জাতি সামলাতে সামলাতে হাসি উপে গিয়েছিল। পুকুরে জল খেতে গিয়ে দেখতাম, মুখখানা দিন-কে-দিন হাসের পোঁদের মতো হয়ে উঠছে”।
অনেক হাসাহাসি হল, ফচকেমি হল। ভল্লা এবার গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল,”গ্রামের পরিস্থিতি কেমন?”
রামালি খিচড়ির মালসা নামিয়ে, উনুনে একটা সরা চাপিয়ে একটু তেল ঢালল, বলল, “আমি তো তেমন কিছু বুঝলাম না, ভল্লাদাদা। আমাদের দলের ছেলেরা ছাড়াও বড়দের সঙ্গেও দেখা হল। কারও মনে তোমার ওপরে কিংবা আমাদের ওপরে কোন রাগ আছে বলে মনে তো হল না। বরং জিজ্ঞাসা করল, শুনলাম তোর কাকি তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে? তা এখন রয়েছিস কোথায়?” গরম তেলে, জিরে আর শুকনো লংকা ছেড়ে কাঠের হাতা দিয়ে নাড়তে নাড়তে রামালি বলল, “বললাম, বাড়ি থেকে কাকি তো আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে – অতএব রয়েছি আরেকজন নির্বাসনের সাজা পাওয়া অপরাধীর সঙ্গে”। ভাজা হয়ে যেতে রামালি সরা থেকে গরম তেলটা ঢেলে দিল খিচড়ির মালসায় – ফোড়নের দেওয়ার শব্দে আর রুচিকর গন্ধে ভরে উঠল বনস্থলী।
“এতদিনে আমাদের এই জঙ্গলের বাসাটাকে গেরস্থ বানিয়ে তুললি রে, রামালি। খিচড়িতে আবার ফোড়ন!”
রামালি কোন উত্তর দিল না, সরাটাকে আবার উনুনে বসিয়ে আরো তেল দিল, উনুনে গুঁজে দিল আরও কিছু কাঠ। তেল গরম হতেই তাতে ছেড়ে দিল কুঁদুরির ফালিগুলো। দুবার নাড়াচাড়া করে, মাটির থালা চাপা দিয়ে দিল সরার ওপর। তারপর বলল, “গ্রামের বয়স্কদের মধ্যে দু-তিনজন অনেক কথাই বলছে, তোমার নামে, আমাদের নামে। কিন্তু বাকি সবাই, আমার মনে হয়, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না। ওরা হয় ওদের কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারেনি। নয়তো কথাগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারেনি”।
“কিন্তু খুব শিগ্গির বুঝতে পারবে। আজকে না হলেও, কালকে রক্ষীদের দলবল গাঁয়ে আসবে, জঙ্গলের ঢোলের মতো”।
“ঢোলটা কী বস্তু ভল্লাদাদা?”
“ওরে বাপরে, বস্তু না রে, জন্তু। আমাদের রাজ্যের মাঝের বিষয়গুলোতে গভীর জঙ্গল তো! সেখানে তারা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। এক একটা দলে পঁচিশ- তিরিশটা – ওদের সামনে পড়লে কেঁদো বাঘও লেজ গুটিয়ে পালায়”।
“আচ্ছা? বাঘও তাদের ভয় পায়? তবুও বলব, রাজার রক্ষীদল ঢোল হোক বা হায়না, আমার মনে হয় গ্রামের মানুষ মনে মনে প্রস্তুত হয়ে উঠছে। বললে বলবে, আমি তোমার আমড়াগাছি করছি... কিন্তু একথা সত্যি যে, তুমি এই গ্রামের নির্জীব মানুষগুলোর মনেও কম-বেশি একটা আলোড়ন তুলে দিয়েছ। আগে রক্ষীরা এসে ক্যাঁৎক্যাঁৎ করে লাথি মারলেও, এরা যেন কৃতার্থ হয়ে যেত। তারা বিশ্বাস করত আমাদের পালন করতে ভগবান, রাজা বানান। সেই রাজার রক্ষী মানে তারাও ভগবানেরই অংশ। অতএব রক্ষীদের লাথি ছিল, প্রকৃতপক্ষে ভগবানের আশীর্বাদ – বাপ-মা যেমন ছেলেমেয়েদের পেটায়। কিন্তু কিছুদিন দেখছি, বয়স্ক মানুষদের মনে সেই বিশ্বাস কিছুটা টুটেছে – তাদের মনেও কেমন যেন ধন্দ জাগছে”।
ভল্লা খুব মন দিয়ে রামালির কথা শুনছিল। আজ শেষরাত থেকে তার যত পরিচয় সে পাচ্ছে, তার মতামতের গুরুত্ব ভল্লার কাছে ততই বাড়ছে। ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “কবিরাজবুড়োর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
“নাঃ। বোধহয় বাড়িতেই ছিল। ভাগ্যে দেখা হয়নি, হলেই এক ঝুড়ি উপদেশ ঝাড়ত”।
“কবিরাজবুড়ো আর তোদের গ্রামপ্রধান জুজাক। তারা তো আমার বিরুদ্ধেই সবাইকে তাতাচ্ছে!”
ভল্লার কথায় রামালি হাসল। সরার ঢাকা সরিয়ে কুঁদরিগুলো একটু নাড়াচাড়া করে সামান্য জলের ছিটে দিল। সরার মুখ আবার ঢেকে দিয়ে বলল, “তাতাবে না? এতদিন গ্রামপ্রধান আর কবিরাজের কথা সকলে বেদবাক্যের মতো মানত। এখন তারা তোমার কথা শুনছে। আমরা – গ্রামের ছেলেপুলেরা - তোমার কথায় উঠছি বসছি। তাদের হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে... এত সহজে তারা ছেড়ে দেবে? রাখালের হাত থেকে পাঁচন-বাড়ি কেড়ে নিলে – তার আর থাকল কি?”
ভল্লা আবারও অবাক হল। এভাবে তো সে ভাবেনি! এভাবে চিন্তা করলে, জুজাক এবং কবিরাজের আচরণের যুক্তি মেলে বৈকি! আরেকটু স্পষ্ট করার জন্যে ভল্লা বলল, “তার মানে?”
“এতদিন আমরা ছিলাম, ছাগল-ভেড়ার পাল। ওরা দুজন ছিল আমাদের রাখাল। আমরা ভাবতাম, ওরাই বুঝি আমাদের রক্ষাকর্তা। তুমি এসে বোঝালে আমাদের এবং ওই রাখালদেরও প্রকৃত প্রভু হল রাজার আধিকারিক আর তার রক্ষীরা। ওদের হাতে কিস্সু নেই। তোমার বিরুদ্ধে ওরা আমাদেরকে তাতাবে না তো, কী করবে?”
রামালি কুঁদরির সরা নামিয়ে, অন্য এক সরায় জল নিয়ে উনুনে চাপাল। তার মধ্যে ছেড়ে দিল মেটেকন্দর বেশ কিছু টুকরো। উনুনের গর্তে বেশ কিছু শুকনো পাতা আর ডালপালা গুঁজে, আগুনটা উস্কে দিয়ে বলল, “কখন খাবে ভল্লাদাদা? আমার রান্না কিন্তু শেষের দিকে। চান করে খেতে বসলেই হল”।
রামালির কথাগুলোই চিন্তা করতে করতে ভল্লা বলল, “তুই যা, চান করে আয়”।
“ঠিক আছে, তাই যাই। তাহলে তোমাকে একটু লক্ষ্য রাখতে হবে, সরার জল যেন শুকিয়ে না যায়, আর উনুনের আগুন যেন ঝিমিয়ে না যায়”।
খালি কলসি এবং আরও কিছু বাসন কোসন নিয়ে রামালি পুকুরে গেল। ভল্লা গাছের ছায়ায় বসে এক মনে উনুনের দিকে তাকিয়ে রইল। তলায় তলায় আগুন জ্বলছে। সেই তাপে ধীরে ধীরে সেদ্ধ হচ্ছে মানুষজনের মন।
ক্রমশ...