বিকেলে ভল্লা নোনাপুর গ্রামে গেল বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলতে। আর সেই একই সময় রাজধানী কদম্বপুরের মুখ্য প্রশাসনিক কার্যালয়ের কর্মব্যস্ততা আচমকাই কিছুটা বেড়ে উঠল। অন্যান্য আধিকারিকদের সঙ্গে রাজ্যাধিকারিক গভীর কিছু আলোচনা সেরে, হন্তদন্ত হয়ে দেখা করতে গেলেন, মহামন্ত্রীর কার্যালয়ে। মহামন্ত্রী তাঁর নিভৃত কক্ষে একলাই বসে কাজ করছিলেন। কক্ষের দ্বার ঈষৎ ফাঁক করে রাজ্যাধিকারিক বিধিবন্ত অনুমতি চাইলেন, “মান্যবর, ভেতরে আসতে পারি?”
মহামন্ত্রী মুখ তুলে বিধিবন্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এস বিধিবন্ত। বস। মনে হচ্ছে খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছ? কী ব্যাপার?”
পুরু গদির ওপর দুধসাদা চাদর বিছানো তক্তপোশের এক প্রান্তে বসেছিলেন মহামন্ত্রী। বিধিবন্ত সেই তক্তপোশের অন্য প্রান্তে বসে বললেন, “আজ্ঞে মান্যবর, রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের আস্থান থেকে ওখানকার করাধিকারিকের একটি দীর্ঘ পত্র পেলাম একটু আগে। ওদিকের অবস্থা সাংঘাতিক”।
মহামন্ত্রী নিরুদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রকম?”
“আজ্ঞে, মান্যবর বিগত সোমবার, ঘোর অমাবস্যার রাত্রিতে – আশেপাশে গ্রামের কিছু উদ্ধত ছোকরা মধ্যরাত্রে আস্থান আক্রমণ করেছিল। সশস্ত্র ছোকরার দল প্রায় এক ঘটিকা ধরে তাণ্ডব চালিয়ে, হত্যা করেছে আস্থানের রক্ষীসর্দার উপানুকে এবং আস্থানের চোদ্দজন রক্ষীকে। ছোকরার দল চলে যাবার পরেই, অবশিষ্ট রক্ষীরা আতঙ্কে আস্থান ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবার ভোর থেকে করাধিকারিক শষ্পকের ব্যক্তিগত রক্ষীরাই আস্থানের সুরক্ষার দায়িত্ব হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। মান্যবর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে অনেক বেশি সংখ্যক নতুন রক্ষী পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে – নচেৎ আস্থানে সঞ্চিত রাজসম্পদ আর রক্ষা করা যাবে না”।
“এতে এত উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন, বিধিবন্ত? এরকম যে ঘটতে চলেছে, সে তো আমাদের জানাই ছিল”।
“মান্যবর, তা ছিল। কিন্তু এতগুলি রক্ষীসহ রক্ষী-সর্দারের মৃত্যু - আমাদের সুরক্ষা মন্ত্রক সহজে মেনে নেবে না। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে এটা প্রশাসনিক দুর্বলতা। গ্রামের ছাপোষা ঘরের ছেলেপুলের দল কীভাবে এত অস্ত্র পেল? এবং কীভাবেই বা তারা প্রশিক্ষিত রক্ষীদের আক্রমণ করার সাহস পেল? এ সব তো একদিনে হয়নি, মান্যবর। ওরা বলবে, আগে থেকে আমাদের গুপ্তচরবাহিনী এই ঘটনা যে ঘটতে পারে, আঁচ করতে পারেনি কেন?”
মহামন্ত্রী কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন, “বিধিবন্ত, স্বীকার করছি, প্রশাসন এই ঘটনার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কিন্তু রাজ্যে কোথায় কোন গ্রামে কী ধরনের ক্ষোভ বা অশান্তি ঘনিয়ে উঠছে – তার সংবাদ রাখার প্রধান দায়িত্ব সুরক্ষা মন্ত্রকের। তাই না?” একটু বিরতি দিয়ে তিনি আবার বললেন, “রাজধানী থেকে অস্ত্র বিপণন করার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে তুমি অবহিত বিধিবন্ত। সোমবারের ঘটনা যে সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ – একথাও তোমার না বোঝার তো কোন কারণ নেই। এ বিষয়ে আমরা সুরক্ষামন্ত্রক এবং সেনামন্ত্রককে কিছুই জানাইনি – অন্ধকারে রেখেছি। তার কারণ এ ধরনের পরিকল্পনা সকল মন্ত্রককে জানিয়ে, সকলের অনুমোদন নিয়ে করতে গেলে – গোটা কাজটাতেই বিলম্ব হত এবং নানান বিঘ্ন এবং বিরুদ্ধ মতামত উপস্থিত হয়ে ভেস্তে যেতে পারত”।
“সে কথা সত্যি, মান্যবর। এবং একথাও সত্যি – আমাদের পরিকল্পনা যে সফল হতে চলেছে, এ ঘটনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ”।
“তাহলে? তুমি এত উতলা হয়ে উঠছো কেন বলো তো? সুরক্ষা মন্ত্রক এই প্রসঙ্গ নিয়ে আমার কাছে আসার আগেই, আগামীকাল মন্ত্রীসভায় আমি নিজেই এ প্রসঙ্গে তুলবো। সুরক্ষা মন্ত্রককে কোনভাবেই মাথা তুলতে দেওয়া যাবে না। নচেৎ আমার তো বটেই স্বয়ং মহারাজের পক্ষেও ব্যাপারটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে”। একটু চিন্তা করে মহামন্ত্রী বললেন, “তোমার ওই ছোকরা আধিকারিক – কী নাম বললে যেন?”
“আজ্ঞে শষ্পক, মান্যবর”।
“হ্যাঁ শষ্পক। তার পাঠানো যাবতীয় পত্রাদি তোমার কাছে আছে?”
“আছে মান্যবর”।
“এখনই আমার কাছে নিয়ে এস। আমরা আবার বসব। তার মধ্যে আমি মহারাজার সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। তাঁকে এই সাম্প্রতিক ঘটনার সংবাদটা দিয়ে, আগামী কাল মন্ত্রীসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকার অনুমোদনটাও নিয়ে আসি। আর শোন, তোমার কার্যালয়ে অকারণ আতঙ্ক, উদ্বেগ ছড়িও না। তোমার অধীনস্থ যে দু’জন দক্ষ গুপ্তকর্মী এই কাজে নিযুক্ত – তাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে তুমিই আমাকে একসময় যথেষ্ট আস্থা জানিয়েছিলে। সে বিশ্বাস তোমার থাকা উচিৎ”।
“ঠিকই মান্যবর। হঠাৎ সংবাদটা পেয়ে আমি কিছুটা...মানে এত হত্যা, তাও আমাদেরই রক্ষীদের...আমি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম, সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যদি”?
মহামন্ত্রী হাসলেন, “তুমি যাও পত্রগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে এস...আর আমিও মহারাজের সঙ্গে দেখা করে আসি”।
পরদিন প্রথম প্রহর সমাপ্তির দণ্ডখানেক আগেই সভাঘরে আহুত মন্ত্রীগণ একে একে উপস্থিত হলেন। তাঁদের সঙ্গে এলেন সকল মন্ত্রকের মুখ্য আধিকারিকগণও। পারষ্পরিক কুশলবার্তা বিনিময় করে, প্রত্যেকেই মর্যাদা অনুযায়ী নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। তারপর মৃদু গুঞ্জনে আলাপ শুরু করলেন, বিশেষ এই অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় কী? আকস্মিক এই সভা আহ্বানের কারণই বা কী?
একমাত্র রাজ্যাধিকারিক ছাড়া উপস্থিক কেউই এই সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত নন। এবং রাজ্যাধারিকও সকলকে অবহিত করায় আদৌ উৎসাহী ছিলেন না। অতএব উপস্থিত মন্ত্রী ও মুখ্যাধিকারিকদের অনুমান এবং কোঁতূহলী আলোচনার গুঞ্জন চলতেই থাকল।
রাজসভার বাইরে প্রহরী প্রথম প্রহর সমাপ্তির তৃতীয় ঘন্টা বাজিয়ে দিতেই – গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেল। সভাঘরে উপস্থিত সকলেই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আর ঠিক তখনই রাজান্তঃপুরের দিকের দরজা খুলে সভাঘরে প্রবেশ করল রাজরক্ষীর দল। ঘোষণা করল রাজার আগমনবার্তা। রক্ষীদলের পিছনে মহারাজা এলেন। তাঁর পিছনে এলেন মহামন্ত্রীও। সশস্ত্র রক্ষীরা নিয়মনিষ্ঠ শৃঙ্খলায় দাঁড়িয়ে পড়ল সিংহাসনের পিছনে ও দুপাশে এবং সভাঘরের প্রত্যেকটি দরজায়। মহারাজ সিংহাসনের সামনে এবং মহামন্ত্রী নিজ আসনের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে অভিবাদন করলেন। তারপর মহারাজ সিংহাসনে বসে সকলকে বসার অনুরোধ করতে, সকলেই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। তারপর মহারাজের ইঙ্গিতে, জনৈক প্রহরী মৃদু কিন্তু গম্ভীর একটিমাত্র ঘন্টাধ্বনি দিয়ে সভার শুরু ঘোষণা করল।
মহারাজা অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, “মহামন্ত্রী মহোদয়, আজকের এই বিশেষ অধিবেশনের আহ্বায়ক আপনিই। অতএব আপনার বক্তব্য দিয়েই আজকের সভার সূচনা করুন”।
মহামন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, মহারাজাকে অভিবাদন করে সভাস্থ সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মাননীয় সহমন্ত্রীবৃন্দ এবং আদরণীয় আধিকারিকদের সকলকেই আমার শুভেচ্ছা জানাই। গতকাল অপরাহ্নে মুখ্যাধিকারিক, বিধিবন্ত মহাশয় আমাকে ভয়ানক একটি সংবাদ শোনালেন। বার্তাটি শুনে আমি যেমন বিচলিত তেমনই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। তৎক্ষণাৎ রাজপুরীতে গিয়ে আমি মহারাজ সকাশে বার্তাটি নিবেদন করে, মহারাজের অনুমতিক্রমে আজকের এই বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করি।
বার্তাটি সংক্ষেপে বলি। বিগত সোমবার মধ্যরাত্রে, স্থানীয় কিছু উচ্ছৃঙ্খল সশস্ত্র যুবক বিনা প্ররোচনাতেই আমাদের পশ্চিম-সীমান্তবর্তী আস্থানে আচমকা হানা দিয়েছিল। এই আক্রমণে নিহত হয়েছেন ওই আস্থানের রক্ষীপ্রধান এবং তাঁর সহকর্মী চোদ্দজন রক্ষী”।
সভায় উপস্থিত সকলেই বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে অস্ফুট আওয়াজ করে উঠল।
“যতদূর জানা গেছে হিংস্র ওই যুবকদলের উদ্দেশ্য ছিল, আস্থানে বন্দী প্রাজ্ঞ ও বৃদ্ধ এক কবিরাজকে মুক্ত করা। কিন্তু ওই বৃদ্ধ কবিরাজকে আস্থানের বন্দীশালা থেকে মুক্ত করার আগেই, তিনি ইহলোকের মায়া থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু ঠিক কী কারণে হয়েছিল – স্পষ্ট জানা যায়নি। তাঁর মৃত্যুর জন্যে কারা দায়ী সে কথাও স্পষ্ট হয়নি”। সামান্য বিরতি দিয়ে মহামন্ত্রী আবার বললেন, “ওই যুবকের দল আস্থানে যদৃচ্ছা তাণ্ডব করার পর এবং কবিরাজের মৃতদেহ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর, ভীত-সন্ত্রস্ত অবশিষ্ট রক্ষীদের সকলেই আস্থান ত্যাগ করে চলে গেছে। অর্থাৎ এখন আস্থান প্রায় অরক্ষিত। করাধিকারিকের প্রশাসনিক রক্ষী আছে আটজন। তারাই আপাততঃ রয়েছে আস্থানের সম্পূর্ণ দায়িত্বে।
আমাদের আশু কর্তব্য - যত শীঘ্র সম্ভব আস্থানের পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে প্রশাসনের সদ্ভাব ফিরিয়ে আনা। যাতে এরকম চরম অপ্রীতিকর ঘটনা ভবিষ্যতে কোন ভাবেই আর না ঘটে। এই অধিবেশনে এই বিষয়েই পর্যালোচনা করে, আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট করতে চাই”।
বক্তব্য শেষ করে মহামন্ত্রীমশাই আসন গ্রহণ করা মাত্র, আন্তঃরাজ্য সুরক্ষা মন্ত্রী উত্তেজিত হয়ে বললেন, “মহামান্য মহারাজ এবং সম্মাননীয় মহামন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন – এতগুলি রক্ষী এবং স্বয়ং রক্ষীপ্রধানের হত্যার ঘটনা ভুলে গিয়ে – আঞ্চলিক লোকদের সঙ্গে কী ভাবে সদ্ভাব ফিরিয়ে আনা সম্ভব? নিহতরা এই জঘন্য হত্যার কোন প্রতিকার পাবে না?”
মহামন্ত্রী বললেন, “কী ধরনের প্রতিকার আপনি আশা করছেন, মন্ত্রীমশাই? যে যুবকেরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের নির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া সম্ভব হবে কি? যদি সম্ভব হয় তাদের বিচার করে উপযুক্ত শাস্তিবিধান করা যেতেই পারে। আর যদি তা না করা যায় আমরা কি সন্দেহের বশে গ্রামবাসী সকল মানুষকেই উত্যক্ত করবো? ভুলে যাবেন না ওই মানুষগুলিও আমাদেরই রাজ্যবাসী। হাতে গোনা কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল যুবকের জন্যে – নিরীহ গ্রামবাসীদের সকলকে বিক্ষুব্ধ করে তুললে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। যতদূর জানি প্রথম থেকেই উভয়পক্ষের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত হয়েছিল। আমি চাই সেই ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক”।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বললেন, “আমি মাননীয় মহামন্ত্রীর সঙ্গে পূর্ণতঃ একমত। ওই গ্রামগুলি এমনিতেই সীমান্তবর্তী সংবেদনশীল অঞ্চল। তার ওপর যতদূর জানি – অনুর্বর ও রুক্ষ ওই অঞ্চলটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত দুর্বল। অতএব অধিবাসীদের আরও ক্ষুব্ধ না করে তুলে – মীমাংসা করে শান্তি স্থাপনা করাই এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ”।
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কথায় সুরক্ষামন্ত্রী বেশ উষ্মা নিয়েই বললেন, “আমিও মীমাংসার পক্ষেই রয়েছি, মহারাজ। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত কোন পক্ষের থেকে শুরু হয়েছিল - এই মন্ত্রীসভার সেটাও জানা প্রয়োজন”।
মহারাজ বললেন, “এই সভা আহুত হয়েছে সব কথা পর্যালোচনার জন্যেই – আপনি বলুন, মন্ত্রীমশাই”।
সুরক্ষামন্ত্রী বেশ উৎসাহিত হয়ে বললেন, “এই যুবক দলটি এর আগেও একবার আস্থানে হানা দিয়েছিল মহারাজ – প্রায় মাস দেড়েক আগে। সেবারও আমাদের তিন রক্ষীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ওই আক্রমণে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র অপহৃত হয়েছিল, এবং কোষাগার থেকে কিছু রৌপ্যমুদ্রাও চুরি গিয়েছিল”।
মহামন্ত্রী রাজ্যাধিকারিক বিধিবন্তকে বললেন, “আধিকারিকমশাই, আপনি এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে পারেন কি?”
বিধিবন্ত আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে প্রণাম করে বললেন, “হ্যাঁ মন্ত্রী মহোদয় ওই ঘটনার পর আমাদের আস্থানের আধিকারিকমশাই, যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার সংক্ষিপ্তসার হল – ওই অঞ্চলের নোনাপুর গ্রামের গ্রামপ্রধান আমাদের আধিকারিককে রাজস্ব হার কিছুটা কমানোর অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়। কারণ ওই গ্রামপ্রধান নির্বাসন দণ্ড পাওয়া এক অপরাধীকে, নিজের বাড়িতে বেশ কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন”।
সুরক্ষামন্ত্রী বললেন, “হ্যাঁ মহারাজ, ওই ঘটনাতেই গ্রামবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং আস্থান আক্রমণ করে”।
মহারাজ বললেন, “বুঝলাম, তারপর?”
বিধিবন্ত বললেন, “আস্থান আক্রমণের পর আধিকারিক রক্ষীপ্রধানকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন, অপরাধী যুবকদের চিহ্নিত করতে এবং চুরি যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রগুলির সন্ধান করতে। তাঁর ধারণা ছিল, চুরি যাওয়া রৌপ্যমুদ্রা গোপন করা সহজ হলেও, অতগুলি অস্ত্র রাতারাতি গোপন করা সহজ হবে না”।
মহারাজ বললেন, “নিঃসন্দেহে উচিৎ সিদ্ধান্ত। তারপর?”
বিধিবন্ত বললেন, “মান্যবর মহারাজ, কোন যুবককেই চিহ্নিত করা যায়নি – এবং কোন অস্ত্রশস্ত্রেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি”।
মহারাজ বিস্মিত হয়ে সুরক্ষামন্ত্রীর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। সুরক্ষামন্ত্রী ইতস্ততঃ করে বললেন, “হ্যাঁ, আমাদের রক্ষীপ্রধান গ্রামগুলিতে একবার তদন্ত করতে গিয়েছিল – কিন্তু সফল হয়নি… তারপর আধিকারিকমশাইও এই ব্যাপারে তাদের আর কোন নির্দেশ দেননি”।
বিধিবন্ত অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, “মান্যবর মন্ত্রীমশাই, আমাদের আধিকারিক রক্ষীপ্রধানকে আর কোন নির্দেশ দেননি – এই কথাটি ঠিক নয় – প্রকৃতপক্ষে তিনি নির্দেশ দিতে ভয় পেয়েছিলেন”।
মহারাজ অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আধিকারিক ভয় পেয়েছিলেন? কেন?”
“রক্ষীপ্রধান ও তাঁর সঙ্গীদল প্রথম দিন গ্রামে গিয়েই তদন্ত করার নামে সাধারণ বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের ওপর যে বীভৎস অত্যাচার করেছিলেন – আপনার রাজত্বকালে ওরকম লজ্জাজনক ঘটনা এর আগে কোনদিন কোথাও হয়নি, মহারাজ। রক্ষীপ্রধান নিজের হাতে পাশের সুকরা গ্রামের শ্রদ্ধেয় এক বয়স্ক ব্যক্তিকে অকারণ এমনই প্রহার করেছিলেন - সে ব্যক্তি আজও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। রক্ষীপ্রধান ও সঙ্গীরা নোনাপুর গ্রামের বৃদ্ধ প্রধানকে এমনই মেরেছিলেন – অসহায় বৃদ্ধ আটদিন অচৈতন্য থাকার পর দেহরক্ষা করেছেন। রক্ষীপ্রধান ওই অঞ্চলের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয় এবং প্রাজ্ঞ ও বৃদ্ধ কবিরাজমশাইকে বন্দী করে আস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে।
প্রয়োজনে অত্যন্ত মাননীয় ব্যক্তিকেও বন্দী করতে হয় মহারাজ, কিন্তু তার মধ্যেও যথেষ্ট শালীনতা বজায় রাখাই বিধি – কারণ তিনি সাধারণ উঞ্ছ প্রবৃত্তির চোর নন। তাঁর পক্ষে আস্থানে নিজে গিয়ে ডাকাতি করা অথবা যুবকদের ডাকাতি করতে প্ররোচিত করা – একেবারেই অসম্ভব। একথা বুঝেও রক্ষীপ্রধান তাঁর ঘোড়ার পিঠে বৃদ্ধকে ঝুলিয়ে প্রায় চারক্রোশ দূরের আস্থানের বন্দীশালায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধ কবিরাজমশাইয়ের দুটি পা পথের পাথরে, ঝোপেঝাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আস্থানের বন্দীশালায় তিনি নিজেই নিজের চিকিৎসা করছিলেন ঠিকই, কিন্ত সুস্থ হলেও, তাঁর পক্ষে কোনদিনই আর নিজের পায়ে হাঁটা-চলা করা সম্ভব হত না। আমরা সংবাদ পেয়েছি - গত সোমবারের আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ওঁনাকে আমাদের বন্দীশালা থেকে মুক্ত করা…”।
দীর্ঘ ও আবেগপূর্ণ বিবৃতির পর বিধিবন্ত চুপ করলেন। মহারাজ খুব বিরক্তমুখে তাকালেন সুরক্ষা মন্ত্রীর দিকে, বললেন, “আপনার এ বিষয়ে কোন বক্তব্য আছে মন্ত্রী মহোদয়?”
সুরক্ষামন্ত্রী কিছুটা ইতস্ততঃ করে বললেন, “রক্ষীরা আস্থানে যখন থাকে তখন আধিকারিকই তাদের একমাত্র পরিচালক, মহারাজ। হয়তো তাঁর নির্দেশেই …”।
বিধিবন্ত বললেন, “আমাকে ক্ষমা করবেন মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, আধিকারিকের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল তদন্ত করার এবং প্রয়োজনে কিছুটা আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি করে গ্রামবাসীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা। তার অর্থ এই নয় গ্রামপ্রধানকেই হত্যা করতে হবে, কিংবা বৃদ্ধ কবিরাজকে বিকলাঙ্গ করে তুলতে হবে। সত্য বলতে মান্যবর, এই দুই ব্যক্তির প্রতি আমাদের রক্ষীদের এই চূড়ান্ত দুর্ব্যবহার, শুধু ওই কয়েকটি গ্রামেই নয়। সুদূর বীজপুর জনপদের জনগণ – এমনকি আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের সংলগ্ন গ্রামবাসীরাও অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং বিচলিত”।
সুরক্ষামন্ত্রী বললেন, “মাননীয় মহারাজ, আমাদের রক্ষীরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে একথা সত্যি – তার জন্যে তাদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া যেত”।
মহামন্ত্রী বললেন, “এ সব ঘটনা প্রায় দেড়মাস আগেকার, তাই না বিধিবন্ত? এতদিনেও তাদের বিচার বা শাস্তি কিছুই না হওয়াতেই, সাধারণ প্রজা ক্রুদ্ধ হচ্ছে, হিংস্র হয়ে উঠছে…”।
সুরক্ষামন্ত্রী বললেন, “আস্থানের আধিকারিক রক্ষীপ্রধানের কোন পরামর্শই গ্রহণ করতেন না, মহামন্ত্রী মহোদয়। এই তো - সম্প্রতি গ্রামের কোন এক যুবক রক্ষীপ্রধানের কাছে এসেছিল রাজসাক্ষী হয়ে – সে বলেছিল – গ্রামের যুবকদের মধ্যে কারা কারা ডাকাতি করেছে এবং অস্ত্রশস্ত্র কোথায় রাখা থাকে সব দেখিয়ে দেবে। রক্ষীপ্রধানের সে কথায় কর্ণপাতই করেননি আধিকারিক। বরং তিনি রক্ষীপ্রধানকে এই বলে নিরস্ত করেছিলেন – ওই যুবক মিথ্যা আশ্বাসে ভুলিয়ে রক্ষীদের গ্রামে নিয়ে যেতে চাইছে – এবং সেখানে ফাঁদে ফেলে সকলকেই বিপদে ফেলবে…। সেদিন রক্ষীপ্রধান আধিকারিকের সহযোগীতা পেলে, সোমবারের ভয়ানক ঘটনা হয়তো ঘটতোই না”।
বিধিবন্ত বললেন, “এ কথা যথার্থ মন্ত্রী মহোদয় – কারণ আমাদের আধিকারিক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রক্ষীপ্রধানের থেকে অনেক বেশী অবহিত – এবং তাঁর দায়িত্ব গ্রামবাসীদের সঙ্গে লড়াই করা নয় – বরং গ্রামবাসীদের সহযোগীতায় প্রশাসনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া… তাঁর কাছে নিশ্চয়ই কিছু তথ্য ছিল – যার ভিত্তিতে তিনি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তাছাড়া আরও একটি অত্যন্ত অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ, আমি এই সভায় প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি, মাননীয় মহারাজ। আমার ধারণা সুরক্ষামন্ত্রীমহোদয় এই তথ্যটি জানেন না – কিন্তু আমার মাননীয় সহকর্মী সুরক্ষাধিকারিক জানেন। আমি নিজেই তাঁকে ওই রক্ষীপ্রধানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযোগ জানিয়েছিলাম।
আস্থানের রক্ষীপ্রধান একজন কদর্য চরিত্রের ব্যক্তি। তিনি আস্থানের ভিতরেই একটি বালকের সঙ্গে নিত্য ব্যাভিচারে লিপ্ত ছিলেন। শোনা যায় দূর কোন গ্রামের অনাথ ওই বালকটিকে তার অভিভাবকের থেকে কিনে এনেছিলেন রক্ষীপ্রধান – এবং প্রায় প্রতি রাত্রেই তিনি ছেলেটিকে বলাৎকার করতেন। ছেলেটি বেশ কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেছিল – কিন্তু রক্ষীবাহিনীর কেউ না কেউ তাকে আবার ধরে এনেছে। মাননীয় মহারাজ, এই ঘটনার কথা আশেপাশের গ্রাম ও জনপদগুলিতে সকলেই জানে – এবং এই নিয়ে তারা রাজ্য প্রশাসনকে রীতিমতো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে…। মাননীয় মহারাজ, এই ধরনের উদ্ধত, অহংকারী, দূরদৃষ্টিহীন নির্বোধ এবং চরিত্রহীন রক্ষীপ্রধানকে আমাদের আধিকারিক ভরসা করতে পারেননি – সেটা তাঁর দুর্ভাগ্য হতে পারে – কিন্তু অপরাধ নিশ্চয়ই নয়”।
বিধিবন্ত কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর মহারাজ বেশ দৃঢ়স্বরে বললেন, “মহামন্ত্রী মহোদয়, যা হয়ে গেছে – তা নিয়ে বিচার-বিবেচনা যা করার পরে করা যাবে। কিন্তু এই ভয়ংকর অচলাবস্থার অবসান করে স্বাভাবিক অবস্থায় কী ভাবে ফেরা যায়?”
মহামন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীমহোদয়কে – এখনই এক গুল্ম সশস্ত্র সেনা ওই অঞ্চলে পাঠাতে অনুরোধ করব। তবে হাতি এবং রথ যাবে না – সাতাশটি ঘোড়া সহ মোট নব্বই জনের দল। সেনাদের উপস্থিতি গ্রামবাসীদের মনে কিছুটা ভয় এবং ভরসা দুইই দেবে। ভয় – সেনাদের সঙ্গে চট করে কোন যুবকই লড়তে চাইবে না। আর ভরসা – আস্থানের রক্ষীবাহিনী আচমকা তাদের আক্রমণ করতে পারবে না।
আর সুরক্ষামন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ – রক্ষীপ্রধান সহ, বেশ ভালো একটি সুরক্ষা দল পাঠানোর ব্যবস্থা করুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ হয়তো আর একমাসের মধ্যেই ওখান থেকে আস্থান গুটিয়ে আধিকারিককে উত্তরের দিকে যেতে হবে”।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বললেন, “ঠিক কতদিনের জন্যে আপনি সৈন্যবাহিনী চাইছেন মহামন্ত্রী মহোদয়?”
মহামন্ত্রী একটু চিন্তা করে বললেন, “অন্ততঃ মাস ছয়েকের জন্য তো বটেই। কারণ ওই অঞ্চলের উন্নতিবিধানের জন্য রাজশ্যালক রতিকান্ত মহোদয়কে বিষয়াধিপতি করে পাঠানোর পরিকল্পনা আমাদের আছে। তাঁর বাসভবন নির্মাণও প্রায় শেষের দিকে। কার্যভার নিয়ে তিনি সুস্থিত না হওয়া পর্যন্ত, ওঁর ব্যক্তিগত সুরক্ষাবাহিনী ছাড়াও সেনাবাহিনীকে থাকতে হবে”।
মহারাজ বললেন, “উত্তম। আজকের সভা তাহলে এখানেই সমাপ্ত হোক। মহামন্ত্রী মহোদয় আপনি সকলের সঙ্গে কথা বলে, আগামীকাল সকালে আমাকে জানাবেন – সর্বশেষ পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে। এমন লজ্জাজনক অপ্রীতিকর ঘটনা আমাদের রাজ্যে আর কখনও যেন না হয় – সে দিকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে”।
মহামন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “যথা আজ্ঞা মহারাজ”। অন্যান্য মন্ত্রী ও আধিকারিকরাও সসম্ভ্রমে মাথা নত করে মহারাজাকে বিদায় জানালেন।
-- -- --
শিবিরের কার্যালয়ে বসে শষ্পক এবং তাঁর সচিব রাজধানীতে পাঠানোর জন্য একটি পত্র রচনা করছিলেন। চোখ বন্ধ করে শষ্পক বলছিলেন এবং তাঁর সচিব অতি দ্রুত হাতে শ্রুতিলিখনে ব্যস্ত ছিলেন। মারুলা আর রামালিকে সঙ্গে নিয়ে ভল্লা তাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, “ভেতরে আসতে পারি, মান্যবর?”
শষ্পকের মনঃসংযোগে কিছুটা বিঘ্ন হল, কিন্তু খুশিই হলেন, বললেন, “এস ভল্লা। বস”। তারপর সচিবকে বললেন, “বলাহ, তোমাকে যে কাজগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো এইবেলা সেরে ফেল। আমার একটু সময় লাগবে…আর যাওয়ার সময় প্রহরীদের বলবে, শিবিরের আশেপাশে কেউ যেন না আসে”।
বলাহ বেরিয়ে যেতে শষ্পক মৃদু হেসে বললেন, “কী ব্যাপার, ভল্লা, শুনতে পাই তুমি প্রতিরাত্রেই নাকি আস্থানে আসছো, কিন্তু আমাকে দর্শন দিচ্ছ না…”।
“মান্যবর আমি আর রামালি আসি মধ্যরাত্রে, আমাদের ছেলেগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা দেখতে…সে সময় আপনার সঙ্গে দর্শন করতে চাইলে, আপনার প্রহরীরা আমাদের বক্ষ বিদীর্ণ করতে দুবার ভাববে না – সেই ভয়ে…”, মুখে সামান্য হাসির রেশ নিয়ে ভল্লা উত্তর দিল।
“আচ্ছা? তুমিও তাহলে ভয় পাও…জানা রইল…এই ছেলেটি কে, চিনতে পারলাম না তো!”
“আমারই ভুল, মান্যবর – প্রথমেই বলা উচিৎ ছিল - ওর নাম রামালি – এখন এই অঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা”।
“ওঃ তুইই রামালি। তোর নাম মারুলা আর আমাদের রক্ষী সর্দার দেবানের মুখে খুব শুনেছি”।
“মান্যবর, রামালিকে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যেই আজ এনেছি – আমার যতদূর ধারণা এখানে আমার আয়ু ফুরিয়ে আসছে…”
শষ্পক বিস্মিত হয়ে বললেন, “তুমি সবকিছু কী করে টের পেয়ে যাও বলো তো? গতকালই আমার কাছে রাজধানী থেকে এক দীর্ঘ পত্র এসেছে…সেখানেই জানলাম তোমাকে এখানেই মরতে হবে…”।
ভল্লা হেসে বলল, “রাজধানীর পরিকল্পনা মতো – এখানকার কাজ শেষ হলেই ভল্লাকে মরতে হবে ... আমার কাজ এখন শেষের দিকে...অতএব আয়ু ফুরিয়ে আসছে...”।
ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে শষ্পক বললেন, “বুঝলাম। কিন্তু এখন ও কথা থাক। রাজধানী থেকে গতকাল যে বার্তা এসেছে, তার কথা এক এক করে বলি। আগামী কাল রাজধানী থেকে একটি গুল্ম যাত্রা শুরু করছে। অবিশ্যি তাতে হাতি আর রথ থাকবে না। সাতাশটি ঘোড়া সহ নব্বইজনের সশস্ত্র বাহিনী আসছে”।
রাজধানী থেকে সশস্ত্র সেনা আসার কথা শুনে রামালি বেশ ভয় পেল। ভল্লা এবং মারুলা, দুজনের মুখের দিকেই তাকাল রামালি – দুজনেই নির্বিকার মুখে তাকিয়ে রয়েছে শষ্পকের মুখের দিকে।
“প্রশিক্ষিত স্থানীয় ছেলেদের থেকেই রক্ষী নিয়োগ নিয়ে আমার প্রস্তাবটি, রাজধানী থেকে অনুমোদিত হয়েছে। শুধু এই আস্থানেই নয়, এই বিষয়ের সকল আস্থানের জন্যেই স্থানীয় ছেলেদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। অতএব রামালি তোর প্রশিক্ষণের মহড়া আরও বাড়িয়ে তোল। আশেপাশের গ্রামগুলিতেও এই বার্তা ঘোষণার দ্রুত ব্যবস্থা কর। প্রসঙ্গতঃ একটা সুসংবাদ দিই, রাজধানী আমাকে পশ্চিমবিষয়ের আধিকারিক পদে নির্বাচিত করেছে। এর সঙ্গে দুঃসংবাদটিও বলে ফেলি রাজশ্যালক রতিকান্ত আমার মাথায় থাকবেন – তিনি হবেন বিষয়াধিপতি। তিনিও আগামী কাল সপার্ষদ রাজধানী ত্যাগ করছেন, ওই গুল্মর সঙ্গেই”।
মারুলা বলল, “রতিকান্ত আসছে মানে সত্যিই আমাদের কাজ এবার শেষের দিকে...কিন্তু মান্যবর আমাদের একটা সাধ ছিল – এবারেও মনে হয় সেটা হয়ে উঠবে না...”।
শষ্পক ও ভল্লা চোখাচোখি করে মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না।
রামালি ইতস্ততঃ করে তার ভয়ের ব্যাপারটা বলেই ফেলল, “মান্যবর, আপনি বলছেন ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রক্ষী বানাতে – আর এদিকে যে সশস্ত্র সেনা আসছে? তারা তো আমাদের শেষ করে দেবে”!
রামালির উদ্বেগে শষ্পক হাসলেন। ভল্লা বলল, “সেনার কাজ সীমান্ত প্রহরা এবং সীমান্তবর্তী গ্রামের লোকদের নিশ্চিন্ত করা। তারা তোকে বা তোদের রক্ষীদলকে শেষ করবে কেন? মান্যবর অনুমতি দিলে গ্রামের ভেতরেই এখন তুই নতুন মহড়াক্ষেত্র বানাতে পারিস। আমার মনে হয় নোনাপুর আর সুকরার মাঝে যে প্রচুর অনাবাদী জমি আছে – সেখানে। সেনাদল তোকেও সুরক্ষা দেবে, তুই তো আর কোন অন্যায় কাজ করছিস না... এ নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব, রামালি”।
একটু সময় নিয়ে শষ্পক বললেন, “ভল্লা, এই আস্থান থেকে শিবির উঠিয়ে চৈত্র পূর্ণিমায়, আমার যে উত্তরে যাওয়ার কথা ছিল – সেটা এখন আর হচ্ছে না। উত্তরদিকে যাবে নতুন আধিকারিক, রাজধানী থেকে পাঠাচ্ছে। আর আমাকে এখানেই থাকতে হবে। রতিকান্তকে সব কিছু বুঝিয়ে তারপর আমি আমার নতুন কার্যালয়ে যোগ দিতে পারবো”।
“ঠিকই আছে মান্যবর – আপনার উত্তরের অস্থায়ী শিবিরে আমাদের আক্রমণের এখন তো আর কোন প্রয়োজন নেই, মান্যবর। আমাদের উদ্দেশ্য তার অনেক আগেই সমাধা হয়ে গেছে। কিন্তু, আপনার নতুন কার্যালয় কোথায়, মান্যবর”। ভল্লা জিজ্ঞাসা করল।
“একটু উত্তরে – মাধো ঘাট – রাজপথের ওপরেই। বড়ো জনপদ। বীজপুরের মতো ওখানেও বড়ো চটি আছে। রামালি আর মারুলাকে নিয়ে সময় করে একবার দেখে আসতে পারো, তাতে ভবিষ্যতে রামালির সুবিধাই হবে”।
ভল্লা মারুলাকে জিজ্ঞাসা করল, “মাধোঘাটের চটিতে কে আছে রে? চিনিস মারুলা”?
মারুলা বলল, “তুইও চিনিস – নিপাল। আগে ও শতেরা চটির অধ্যক্ষ ছিল – এখন এখানে আছে”।
ভল্লা বলল, “ঠিক আছে, একদিন যাবো মান্যবর। রামালিরও ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘ পথ চলার একটা ভালো অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে। রাজধানী থেকে আর কী বার্তা এল, মান্যবর?”
শষ্পক বললেন, “রতিকান্তর সঙ্গে দুজন জনাধিকারিকও আসছে। এদিকের গ্রামগুলোর উন্নতির জন্যে কী কী করা যায় - সে নিয়ে গ্রামবাসীদের নিয়ে তারা আলোচনা করবে। রামালি, নোনাপুর গ্রামে এখন কেউ প্রধান নেই – গ্রামের লোকদের বল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন গ্রামপ্রধান নির্বাচিত করতে। তা না হলে জনাধিকারিকরা কার সঙ্গে আলোচনা করবে?”
রামালি বলল, “আমাদের গ্রামপ্রধান ঠিক হয়ে গেছে, মান্যবর – আমাদের কমলিমা – গ্রামপ্রধান জুজাকমশাইয়ের বউ”।
একটু অবাক হয়ে শষ্পক বললেন, “গ্রামপ্রধানের স্ত্রী? বাঃ, মহিলা গ্রামপ্রধান তেমন কোথাও চোখে পড়েনি – অভিনব বটে”! একটু চিন্তা করে আবার বললেন, “গ্রামের মানুষের কাছে মাতৃতুল্যা মহিলা, কোন পিছুটান নেই – প্রধানের স্ত্রী হিসেবে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা...আমার তো মনে হচ্ছে খুবই ভালো হবে। রামালি, এর মধ্যে তোরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নে, রাজধানী থেকে কী কী সাহায্য তোরা নিতে চাস। যেমন ধর, সেচের জন্যে কিছু পুকুর বা গভীর কুয়ো করাতে পারিস। তোদের গ্রামগুলোতে অনেক অনাবাদী জমি – সেখানে গরু বা ছাগল পালন করা যায় কিনা। তাছাড়া তোদের তো চাষ করার হাল-বলদ নেই – কয়েকটা হাল-বলদ পেলেও তোদের অনেক উপকার হবে। শুনেছি ভল্লা একটা বাঁধ বানিয়েছে – সেটাকে আরও ভালো করা যায় কিনা। প্রয়োজনীয় শস্যবীজ...এরকম আরকি”! একটু থেমে আবার বললেন, “তোরা মাছ-মাংস বা ডিম খাস না, রামালি?”
রামালি ম্লান হেসে বলল, “পেলে নিশ্চয়ই খাই, মান্যবর – কিন্তু পাওয়াই তো দুঃসাধ্য”।
শষ্পক বললেন, “ধূর পাগল, তোদের গ্রামে অত পুকুর রয়েছে, মস্তো দীঘি রয়েছে – সবাই হাঁস পুষলে কত সুরাহা হয়ে যায়! হাঁসের ডিম – মাংস। জনাধিকারিককে বলবি – ভালো জাতের বেশ কিছু হাঁস দরকার। আমার কথা হল – রক্ষীদের মেরেছিস বলে, কোন রকম ভয় পাবি না বা সংকোচ করবি না – তোদের যা যা মনে হবে বলবি। বুঝেছিস?”
রামালি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল, কিছু বলল না। ভাবল, রাজাধিকারিকরা গ্রামের বয়স্ক মানুষদের এতকাল অপমান আর অবহেলাই করে এসেছে – আজ সেই আধিকারিকরাই একেবারে মুক্তহস্ত! মাস তিনেক আগে প্রধানমশাইকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই শষ্পকমশাই – আজ তিনিই রামালির মতো এক ছোকরার সঙ্গে বসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন! এ সবই তাদের দলগত সাহস ও দক্ষতার ফসল, সে সাহস এবং দক্ষতা যুগিয়েছে ভল্লাদাদা!
রাজধানী থেকে ষড়যন্ত্র বানিয়ে ভল্লাদাদা তাদের গ্রামে এসেছিল। প্রথমে তারা কিছুই বোঝেনি। কিন্তু এখন বুঝছে ভল্লাদাদা তাদের অনেক ক্ষতি করেছে – প্রধানমশাইয়ের মৃত্যু, কবিরাজমশাইয়ের মৃত্যু। তার কাছে হানো বা শল্কুর মৃত্যু হয়তো শোকাবহ নয় – কিন্তু ওরাও তো মারা গেছে – ওই দুটি পরিবারের কাছে সে ক্ষতিও তো অপূরণীয়!
কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ মনে হচ্ছে – ক্ষতির থেকে লাভও কিছু কম হয়নি। এই যে দুই গ্রাম মিলিয়ে বত্রিশজন ছেলে রক্ষীর কাজ পেয়েছে – কাজ পেয়েছে তিনজন রাঁধুনি। পাশাপাশি গ্রামের অনেক ছেলেরা ভবিষ্যতেও অনেক কাজ পাবে। ছোটবেলা থেকে সে গ্রামের মানুষের হাতে টাকা দেখেছে ক্বচিৎ-কখনো। কেনাকাটার একমাত্র উপায় ছিল – চাষ করা ফসল বিনিময়। আজ এতগুলো পরিবার মাসান্তে নিয়মিত হাতে পাবে এতগুলি তাম্রমুদ্রা! চারটি পরিবারের ক্ষতির তুলনায় - এতগুলি পরিবারের এই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তা কী অনেক বড়ো নয়? তাছাড়া তার মতো যৎসামান্য এক ছোকরা আজ কিনা আধিকারিকের সামনে বসে, চোখে চোখ রেখে কথা বলছে?! প্রধানমশাইকে কোনদিন বসতে বলেছিল – এই আধিকারিক…!
ভল্লা রামালির গায়ে হাত দিয়ে বলল, “অ্যাই রামালি, কী ভাবছিস বল তো? কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রামালি একটু লজ্জা পেল, সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “না...মানে গ্রামের কথাই ভাবছিলাম...”।
ভল্লা কিছুক্ষণ রামালির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা যে গ্রামের নাম বদলে জুজাকপুর করতে চাস, সেটা মান্যবরকে বল”।
“হ্যাঁ, মান্যবর সকলেই চাইছে গ্রামের নাম হোক জুজাকপুর”, রামালি বলল।
শষ্পক বললেন, “দ্যাখ ভাই, এটা আমার হাতে নেই – আমাদের মন্ত্রকের অধীনে ভূমি-রাজস্ব কার্যালয় একটা আলাদা সংস্থা। তাদের কাছেই সমস্ত বিষয়, বিষয়ের অধীনে ভুক্তি এবং ভুক্তির অধীনে সকল গ্রামের নাম এবং তার জমির পরিমাণ নথিভুক্ত আছে। গ্রামের নাম পরিবর্তন ওরাই করতে পারবে। আমি তোদের এই প্রস্তাব আমি তাদের কাছে জানিয়ে দেব। একটু সময় লাগবে কিন্তু আশা করি হয়ে যাবে - ঠিক আছে?” রামালির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শষ্পক বললেন,”আর কিছু কথা আছে?”
রামালি ভল্লার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের আরও অস্ত্র চাই, মান্যবর। বণিক অহিদত্তকে আমরা বলেছি। আপনি যদি রাজধানীতে একটু বলে দেন, তাহলে একটু তাড়াতাড়ি হবে”।
শষ্পক অবাক হয়ে ভল্লার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সে কি, অত অস্ত্র সব শেষ হয়ে গেল?”
ভল্লা রামালির মুখের দিকে তাকাল। রামালি বলল, “হবে না, মান্যবর? বটতলির দল ওদিকের প্রধানের বাড়ি লুঠ করার পর – প্রতিদিনই ওদের দলে ছেলে বাড়ছে। এখানকার আস্থানের রক্ষীবাহিনীদের সকলকে অস্ত্র-শস্ত্র দিয়েছি, তা ছাড়া এদিকের নতুন ছেলেদের মহড়াতেও অস্ত্র-শস্ত্র লাগছে…আপাততঃ চলে যাবে – তবে দিন পনেরর মধ্যে না এলে – সমস্যায় পড়ে যাবো, মান্যবর”।
শষ্পক বললেন, “আজই লিখে পাঠাচ্ছি। ভালো কথা, বণিক অহিদত্তের পাওনা-গণ্ডা সব মিটে গেছে?”
“হ্যাঁ মান্যবর। ভল্লাদাদা সব মিটিয়ে দিয়েছে”।
“বেশ করেছে। ধার-বাকি থাকলে বণিকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে”, শষ্পক মৃদু হেসে বললেন, “তবে এর পরের বারে অস্ত্র-শস্ত্রের মূল্য কিঞ্চিৎ বাড়বে – রাজধানী থেকে যা অনুমান করেছিল, সে তুলনায় কিছু বেশী ব্যয় হয়ে গেছে – সেটুকু মানে…ধরো শতকরা তিন থেকে চার ভাগ মূল্য বাড়বে”।
ভল্লা বলল, “ওটুকু মূল্যবৃদ্ধি, রামালি সামলে নিতে পারবে, মান্যবর। কিন্তু তার বেশি হলে বিপদে পড়বে। কারণ আমরা ইচ্ছামতো অস্ত্র-শস্ত্রের মূল্য বাড়ালে বটতলির ছেলেরা আমাদের সন্দেহ করবে – ভাববে সুযোগ বুঝে আমরা ওদের সঙ্গে তঞ্চকতা করছি”।
“ঠিক কথা, ভল্লা। এ ধরনের ব্যবসা চলে মূলত কথার মূল্যে। আচ্ছা, রামালি এবার কত গোশকট অস্ত্রশস্ত্র আনলে তোর অন্ততঃ মাসখানেক চলে যাবে? কারণ বুঝতেই পারছিস – আমরা সপার্ষদ রতিকান্ত এবং গুল্ম বাহিনী নিয়ে বেশ কিছুদিন ব্যতিব্যস্ত থাকবো”।
রামালি চিন্তা করতে করতে বলল, “আজ্ঞে মান্যবর, গতবার চারটি শকট এসেছিল, এবার আটটি গোশকট হলে ভালো হয় – বেশ কিছুদিন চালিয়ে নিতে পারবো”।
“বলিস কী?” শষ্পক রীতিমতো চমকে উঠলেন, “জানি না, রাজধানী কী সিদ্ধান্ত নেবে – আমার মনে হয় – একসঙ্গে আট শকট অস্ত্রশস্ত্র সকলের চোখে পড়ে যাবে। আট শকট অস্ত্র-শস্ত্র মানে রক্ষীদল নিয়ে অন্ততঃ বারো শকটের বহর…। রাজপথের সাধারণ মানুষ কৌতূহলী হয়ে উঠবে…। দেখছি কী করা যায় – একসঙ্গে না হলেও – কিছু দিনের ব্যবধানে ছয় ছয় করে দুই বহর পাঠালেও তোর চলে যাবে, তাই না?”
“হ্যাঁ মান্যবর – তা হয়ে যাবে”।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে শষ্পক বললেন, “বেশ, আমাদের আলোচনা আজ এখানেই শেষ করা যাক – আমাকে দণ্ডদুয়েকের মধ্যেই পত্র সহ একজন দূতকে রাজধানী পাঠাতে হবে। তোমরা এখন এসো – কিন্তু রতিকান্ত আসার আগে আমাদের মাঝেমাঝেই এরকম আলোচনায় বসা প্রয়োজন। আমাদের ঘুড়ি এখন ভালোই উড়ছে। রামালির হাতে লাটাই তুলে দিয়ে এবার ভল্লা এবং মারুলার চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে...”।
ক্রমশ...