এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • বিপ্লবের আগুন - পর্ব চব্বিশ

    কিশোর ঘোষাল
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৭০ বার পঠিত
  • [প্রাককথাঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ হোক কিংবা প্রাচীন রাজতান্ত্রিক সমাজ – বিদ্রোহ, বিপ্লব সর্বদাই প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। নিরীহ, অনুন্নত এবং প্রান্তিক মানুষরা যুগেযুগে কীভাবে উদ্বুব্ধ হয়েছিলেন এবং হচ্ছেন? তাঁরা কীভাবে এগিয়ে চলেন বিপ্লবের পথে? কীভাবে তাঁরা অস্ত্র সংগ্রহ করেন? কোথা থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন সেই বহুমূল্য অস্ত্রসম্ভার? যার শক্তিতে তাঁরা রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রাখার বারবার স্পর্ধা করেছেন? কখনও তাঁরা পর্যুদস্ত হয়েছেন, কখনও ক্ষণস্থায়ী সাফল্য পেয়েছেন। আবার কখনও কখনও প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রকে তাঁরা পরাস্ত করে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতেও পুরোন বিদ্রোহ-বিপ্লবের আগুন নেভে না কেন? রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদতেই কি এ বিপ্লব চলতে থাকে আবহমান কাল ধরে?]

    ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়

    ২৪


    দিনের প্রথম প্রহরের মাঝামাঝি সময়ে, পিছনের দরজা দিয়ে, জনাইয়ের চটিতে ঢুকে পড়ল ভল্লারা। জনাইয়ের ঘরে গিয়ে দেখল, জনাই নেই। রণপাগুলো ঘরের বাইরে খাড়া করে রেখে, ঘরের ভেতরে ঢুকে ভল্লা বলল, “এখানেই আমাদের থলেগুলো রাখি, তারপর চ মুখ-হাত-পা ধুয়ে একেবারে স্নানটা সেরে নিই”।
    “এখানে কে থাকে, ভল্লাদাদা”?
    “বীজপুরের এই চটির অধ্যক্ষ – জনাই। যদিও এখন সে জন ঘরে নাই”। ভল্লার কথায় রামালি হাসল।

    স্নান করে ভল্লারা জনাইয়ের ঘরে এসে দেখল, ঘরের ভেতরে জনাই দাঁড়িয়ে আছে কোমরে হাত দিয়ে। ভল্লাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল জনাই, “শালা, ভল্লা! তুই হঠাৎ কোত্থেকে? ঘরে ঢুকে সেই থেকে আমি ভাবছি – বাইরে রণপা দুজোড়া, আমার ঘরে ঝোলাঝুলি – কে রেখে গেল, আর গেলই বা কোথায়?”
    ভল্লা হাসতে হাসতে ঘরের মেঝেয় বসল আরাম করে, বলল, “রামালি, বস। জনাই, এ হচ্ছে আমার সেনাপ্রধান, নাম রামালি। আর তোকে তো বলেছিলাম, জনাই হচ্ছে এই চটির সর্বেসর্বা”।

    জনাই রামালির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর হাসল একটু, বলল, “এখন কী খাবি বল? এত সকাল সকাল এখানে পৌঁছে গেলি, রাত্রে কখন বেরিয়েছিলি?”

    ভল্লা বলল, “এখন কিচ্ছু খাবো না, সঙ্গে খাবার নিয়ে বেরিয়েছিলাম, পথে খেয়েছি। তবে দুপুরের কী খাওয়াবি বল? মাছের ঝোল – ভাত খাওয়াতে পারবি?”

    জনাই বলল, “মাছ? এই সময়ে হাটে মাছ একটু কম আসে। তাও দেখছি – দাঁড়া হাটে লোক পাঠিয়ে আমি এখনই আসছি”। জনাই উঠতে যাচ্ছিল, ভল্লা তার হাত ধরে বসাল, বলল,

    “আরে অত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই... মাছ না পেলেও কিছু যাবে আসবে না। তার আগে যে জন্যে আসা সেটা আগে বলে নিই”। জনাই কিছু বলল না, ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

    “বীজপুরে কেউ একজন ইঁটের গাঁথনির ঘর বানায় – চিনিস? তাকে লাগবে – দুটো করে দু জায়গায় মোট চারটে ঘর বানাতে হবে, টালির চাল। খুব তাড়াতাড়ি দরকার”।

    “চিনি বৈকি! নাম সুমের। আমার এই চটিতে সে অনেক কাজ করেছে। ডেকে পাঠাচ্ছি, কথা বলে নে”।

    “কথা বলবি, তুই আর রামালি – আমি সামনে থাকব না”।

    “আচ্ছা। আর কিছু?”

    “কালো কাপড়ের থান– জনা চল্লিশেক ছেলের ধুতি বানাতে হবে। পাওয়া যাবে”?

    “ওরে বাবা। দশহাত মাপের ধুতিই যদি ধরি। চল্লিশখানা মানে – চারশ হাত কাপড়? তাও কালো? অসম্ভব। বীজপুরের বিপণিতে একসঙ্গে এত কাপড় পাওয়া যাবে না। আমি বলি কি চল্লিশখান সাদা ধুতিই কিনে নে না – তারপর সেগুলো কালো রঙে ছুবিয়ে নিবি ... চলবে না?”

    দিনের প্রথম প্রহরের সমাপ্তি ঘোষণা করে, প্রহরী চটির পেটা ঘন্টায় আওয়াজ তুলল ঢং।

    “কিন্তু রঙ উঠে গেলে?”

    “ধুর ব্যাটা। রঙ উঠবে কেন? আমি তো তাই করি। চটিতে নানান ধরনের লোকজন আসে। অনেকে বিছানাতে বসেই নেশা করে – খায় দায় – আর বিছানার চাদরে ছোপ ধরিয়ে দিয়ে যায়। সে ছোপ না উঠলে সুবিধেমতো রঙে ছুবিয়ে নিই। সে রঙ তো ওঠে না – তবে হ্যাঁ, কালো রঙ কোনদিন ব্যবহার করিনি”।

    একটু চিন্তা করে ভল্লা রামালির দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে তাই কর – চল্লিশটা সাদা ধুতি – আর পর্যাপ্ত কালো রঙের ব্যবস্থা কর। কত ব্যয় হবে?”

    “আমি আনিয়ে নিচ্ছি – যা ব্যয় হবে দিয়ে দিবি”।

    “আচ্ছা, এবার বল – বারো হাত লম্বা, দশ হাত চওড়া ইঁটের ঘর বানাতে কত ব্যয় হতে পারে? তোর কোন ধারণা আছে? সব কিছু নিয়ে – ভিত থেকে ছাদ অব্দি”।

    “দ্যাখ, এই চটিতে ভৃত্যদের থাকার ঘরগুলো মোটামুটি ওই মাপেই বানাই, তার ব্যয় হয় ঘর প্রতি তিনটে রূপো। কিন্তু তোদের নোনাপুরের ব্যয় অনেকটাই বেশি পড়বে – এখান থেকে ইঁট-চুন-সুরকি-বালি নিয়ে যাবে, কাজের লোকরাও অতটা দূরে গিয়ে থাকবে – তাদের থাকা, খাওয়া-দাওয়া...আমি ডেকে পাঠাচ্ছি – দেখি না কত বলে। আর কিছু?”

    “না আর কিছু না। আজ সন্ধের একটু পরেই আমরা কিন্তু বেরিয়ে পড়ব – কাল সকাল সকাল নোনাপুরে ঢুকতেই হবে”।

    “ঠিক আছে – আমি হাটে লোক পাঠাচ্ছি, আর সুমেরকেও বার্তা পাঠাচ্ছি। একটু বস”।

    জনাই উঠে দাঁড়াতে, রামালিও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভল্লাদাদা, আমি হাট থেকে একটু ঘুরে আসব? জনাইদাদার লোকটির সঙ্গে?”

    ভল্লা রামালির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কিছু চিন্তা করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে - যা ঘুরে আয়”।

    চটির কিছু কাজকর্ম সেরে জনাইয়ের ঘরে ফিরতে একটু দেরিই হল। ঘরে এসে দেখল, ভল্লা মাটিতে শুয়ে আছে। অবশ্য জনাইয়ের পায়ের শব্দে ভল্লা উঠে বসল, বলল, “বসে থাকতে থাকতে চোখটা একটু লেগে এসেছিল...”।

    জনাই মাটিতে ভল্লার মুখোমুখি বসে বলল, “তোর খবর মাঝেমাঝেই পাই। তুই তো আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিস চারদিকের গ্রামগুলোতে। তবে একথাও বলব, আস্থানের রক্ষীরাও এর জন্যে দায়ী। তারা মোটেই ঠিক কাজ করছে না - গ্রামপ্রধানকে পিটিয়ে মেরে ফেলল? তার ওপর কবিরাজমশাইকে মেরেধরে বন্দী করে রেখে দিল আস্থানে? ফসল ভালো হয়নি বলে, রাজকর কিছুটা কম করার অনুরোধ করেছিল। সেটা তাদের অপরাধ হয়ে গেল? ছি ছি তার জন্যে এরকম নৃশংস হত্যা? বড্ডো বাড়াবাড়ি করছেন আস্থানের আধিকারিক।

    আমাদের এই অঞ্চলের লোকরাও ক্ষেপে উঠছে, জানিস? এরকম চললে, নোনাপুর কিংবা সুকরা নয় আরও অনেক গ্রামেই এরকম আগুন ছড়িয়ে পড়বে। বীজপুরে তোর নাম এখন বীজমন্ত্র হয়ে উঠেছে, রে শালা”।

    ভল্লা খুব মন দিয়ে শুনছিল জনাইয়ের কথা। রাজধানীর নিবিড় ষড়যন্ত্রের কথা জনাই জানে না। ভল্লার এ অঞ্চলে আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তার ধারণা ভাসা-ভাসা। কিন্তু জনাই যেহেতু এই চটির অধ্যক্ষ, বহুলোক - ধনাঢ়্য তীর্থযাত্রী, সম্পন্ন বণিক এবং এই জনপদের সকল মানুষের সঙ্গেও তার নিত্য ওঠাবসা। বলা বাহুল্য সকলের সঙ্গেই তাকে সদ্ভাব রাখতে হয়। জনাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গী তার পরিচিত সকল মানুষের ধারণার প্রতিচ্ছবি। অতএব ভল্লার কাছে জনাইয়ের মন্তব্য অমূল্য।

    “শুনেছি গ্রামের লোকরা একবার আস্থানে হানা দিয়েছিল। আবার দেবে না তো? এখানকার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ছোকরার দল, কিন্তু চাইছে – নোনাপুরের ছেলেরা উচিৎ শিক্ষা দিক – আস্থানের রক্ষীদের। আর ওই যে উপানু – ও হতভাগা রক্ষীদলের সর্দার হল কী করে। ব্যাটা মাথামোটা, হোঁৎকা! শুনেছি আস্থানের অধিকারী শষ্পক সজ্জন-ভদ্র মানুষ – তিনি কী পারবেন এই পরিস্থিতি সামলাতে?”

    ভল্লা আলস্যে আড়মোড়া ভেঙে, বড়ো করে হাঁই তুলে বলল, “আমাকে বলছিস কেন? শষ্পককে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর। আমি নির্বাসনে থাকা অপরাধী – আমি কী করব?”

    জনাই তীক্ষ্ণ চোখে ভল্লাকে দেখল, বলল, “শালা, এমন ভাব করছিস ভাজা মাছ যেন উলটে খেতে জানিস না? চল্লিশটা কালো ধুতি নিয়ে কী করবি – তুই আর তোর ওই সেনাধ্যক্ষ রামালি? কী ভাবিস – আমি কিছুই বুঝি না?”

    ভল্লা হেসে ফেলল, বলল, “না রে - তুই কী ভাবছিস জানি না। গ্রামের কিছু ছোকরা ঠিক করেছে – এখন থেকে তারা সাদা ধুতি পরবে না। সাদা ধুতি ময়লা হয় বেশি – দাগছোপ ধরে তাড়াতাড়ি – তার চে কালো ধুতি পরা ভালো। ওরা সবাই দরিদ্র – জানিস তো? প্রতিদিন কাপড় কাচাও ওদের কাছে বিলাসিতা”।

    জনাই মুখের সামনে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল, “তোকে আমি আজ থেকে চিনি ভল্লা? সেই ছোকরা বয়েসের ডামল থেকে চিনি। তুই কোনো গোপন কাজে, গোপন নামে এখানে এসেছিস, সে আমি জানি। কিন্তু কাজটা কী – সেকথা তুই বলবি না, সেও জানি। আর আমিও জানতে চাই না। কিন্তু তাও বলব, এদিকের সাধারণ লোক চাইছে – তোরা কিছু একটা কর, রক্ষীদের গুমোর ভেঙে দে”।

    “পাগল হয়েছিস? আমি ওসবের মধ্যে জড়াবো কেন? আর আস্থানের রক্ষীরা জব্দ হলে, রাজধানী থেকে সেনাবাহিনী পাঠাবে। সে ধাক্কা গ্রামের সাধারণ এই ছোকরার দল সামলাতে পারবে”? জনাই ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভল্লা হেসে জনাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমার কাজের কোন কথাই তোকে বলতে পারব না, বন্ধু। কিন্তু ধৈর্য ধরে দেখতে থাক – আগে আরও কী কী হয়। এটুকু বলতে পারি – নোনাপুরের ছেলেরা তোকে এবং বীজপুরবাসীদের হতাশ করবে না। যাগ্‌গে ওসব ছাড় – আমার মাছের ঝোল কী হল?”

    “শালা তোর কপালটা ভালো – প্রায় দুসেরের একটা রহু পেয়েছি – একদম জ্যান্ত – এতক্ষণে মনে হয় রান্না শুরু হয়ে গেছে”। হাসতে হাসতে জনাই বলল।

    “ওফ্‌, সেই পিপুলতলা ছাড়ার পর এই প্রথম মাছের ঝোল আর ভাত খাবো। ভুট্টার রুটি আর সেদ্ধ ভুট্টা খেতে খেতে জিভে চড়া পরে গেছে, রে জনাই”।

    ওদের কথার মধ্যে রামালি ঘরে ঢুকল। ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “বীজপুরের হাট দেখলি?”

    “হ্যাঁ, ভল্লাদাদা - কী না পাওয়া যায় হাটে, বাস্‌ রে – অর্ধেকের বেশি পসরা এই প্রথম চোখে দেখলাম”! রামালি মেঝেয় বসতে বসতে একটু উচ্ছ্বসিত হয়েই বলল।
    ভল্লা হাসল, বলল, “ধুতি পেয়েছিস?”

    রামালি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ধুতি – কালো রঙ সবই পাওয়া গেছে। শাম্‌লা – যার সঙ্গে আমি হাটে গেলাম – বলল এখানেই কালো রঙ করে দেবে...”।

    জনাই বলল, “হ্যাঁ আমাদের বাঁধা রজক আছে – বড়বড়ো মাটির গামলায় রঙ গুলে একসঙ্গে সব ছুপিয়ে দেবে। শুকোতে দেওয়ারও অনেক জায়গা – রোদ্দুরে মেলে দিলে দণ্ড দুয়ের মধ্যে শুকিয়েও যাবে। তোরা ওসব করেছিস কখনো? গণ্ডগোল হয়ে গেলে শালা পুকুরের জলই কালো হয়ে কেলেংকারি কাণ্ড হবে – একবার ডুব দিলে কেলেকাত্তিক হয়ে উঠে আসবি... তুই মাছ খাস তো রামালি?”

    রামালি বলল, “কয়েকবার খেয়েছি – তবে আমাদের দিকে তেমন কেউ খায় না”।

    জনাই হেসে বলল, “ব্যস্‌ ব্যস্‌, ওতেই চলবে। তুই ভাই নিরিমিষ হলেও আমার কোন অসুবিধে নেই – চটিতে সব ব্যবস্থাই রাখতে হয়…”।

    চটির ঘন্টা দুবার বাজল ঢং ঢং করে। জনাই ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে বলল, “ওঃ দুই প্রহর শেষ হয়ে গেল…ভল্লা, আমি একটু ঘুরে আসি রে - জনা চারেক মাননীয় অতিথি আছে – মাঝে মাঝে গিয়ে আমার মুখটা না দেখালে – তাদের রাগ হয়ে যাবে। বড়োলোকের পীরিত – শালা ক্ষণে রঙ্গ, ক্ষণে ভঙ্গ... ”। জনাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল, “খাওয়ার সময় চলে আসব, একসঙ্গে খাবো”।

    জনাই বেরিয়ে যেতে রামালি ভল্লাকে জিজ্ঞাসা করল, “ভল্লাদাদা, প্রতি প্রহর শেষ হলেই কি এখানে ঘন্টা বাজানোর নিয়ম? সকালে শুনলাম একবার, এখন দুবার। সারা দিনরাতে এরকম মোট আটবার ঘন্টা বাজানো হয় - প্রতিদিন?”

    ভল্লা বলল, “হ্যাঁ। চটির অতিথি এবং কাজের লোকদের সুবিধের জন্যেই ঘন্টা বাজাতে হয়। কাকে কখন খেতে দিতে হবে। কার কখন কী কাজ - সেসব মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে…”।
    “বাবা। কী করে বোঝে ঠিক কখন কখন প্রহর শুরু হচ্ছে আর শেষ হচ্ছে? সূর্য দেখে?”

    “সূর্য দেখে মোটামুটি বোঝা যায় ঠিকই – কিন্তু মেঘলা দিনে কিংবা রাত্রে – সূর্য দেখা যায়?”

    “না। তাহলে?”

    “ঘড়ি আছে – জলঘড়ি”।

    “জলঘড়ি? সে এবার কী?”

    “ঘড়ির দুটো মানে হয় – ঘটিকা বা ঘন্টা – মানে প্রতি প্রহরের তিনভাগের এক ভাগ। আবার যে যন্ত্র দিয়ে এই ঘটিকা মাপা যায় – তাকেও ঘড়ি বলে। বিকেলে জনাইকে বলব, জলঘড়ি কেমন হয় তোকে দেখিয়ে দেবে। ব্যাপারটা বেশ মজার। বড়োসড়ো একটা গামলায় জল ভরে রাখা থাকে। সেই জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় ছোট্ট একটা ঘটি। সেই ঘটিটা সাধারণ নয় – তার তলায় খুব ছোট্ট একটা ছিদ্র করা থাকে। সেই ছিদ্র দিয়ে গামলার জল ধীরে ধীরে ঘটিতে চুঁয়ে চুঁয়ে ঢোকে। এভাবে জল ঢুকতে ঢুকতে ওই ফুটো-ঘটিটা ভরে গেলেই, টুপ করে গামলার জলে ডুবে যায়। ওই ঘটিটা ভরতে যত সময় লাগে সেটাই হল এক ঘটিকা বা ঘন্টা। এরকম তিনবার হলে – এক প্রহর হয়। এই ব্যবস্থার জন্যে নির্দিষ্ট লোক আছে – যাদের কাজ হল – ঘড়িটা সঠিক চালানো - এবং ঘটিকা গুণে প্রহর শেষের ঘন্টা বাজানো। বড়ো বড়ো শহরে – প্রতি ঘটিকাতেই ঘন্টা বাজানো হয়, আবার প্রহর শেষেও ঘন্টা বাজানো হয়”।
    রামালি অবাক হয়ে ভল্লার কথা শুনছিল। কথা শেষ করে ভল্লা আবার বলল, “নে এবার বাঁধানো মেঝেয় গা এলিয়ে একটু আরাম করে নে, এমন সুযোগ আবার কবে পাবি কে জানে। কেমন দেখলি বীজপুর?”

    রামালি মেঝেয় শুয়ে শুয়েই বলল, “কী বলি বলো তো ভল্লাদাদা? শহর তো কোনদিন দেখিনি, অন্যের মুখে শুনেছি। এখানে এসে ভাবলাম, এটাই বুঝি শহর। শাম্‌লাকে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ল, বলল, ধুস্‌ - এটা নাকি শহর! শহর হল অনন্তপুর – বছর চারেক আগে একবার গিয়েছিলাম। শহর বটে একখানা। জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা আবার কোনদিকে? বলল, এখান থেকে তিনদিনের হাঁটা পথ – রাজপথ ধরে পুবমুখো গেলেই হল”।

    ভল্লা হাসল, বলল, “এই তো সবে শুরু রে, রামালি। অনেকদূর যাবি, অনন্তপুর তো তুচ্ছ, রাজধানী কদম্বপুরে তুই দাবড়ে ঘুরে বেড়াবি”। রামালি স্বপ্ন দেখা চোখে বলল, “সে আর কবে হবে, ভল্লাদাদা। আমার কপালে এই অব্দি যে এসেছি সেই ঢের”।

    ভল্লা এবার একটু বিরক্ত হল, “আজ থেকে ছমাস আগে বীজপুর আসবি ভেবেছিলি? কপাল-টপাল কোন কাজের কথা নয়, রামালি। ওসব অকর্মাদের ধূর্তামি – আধাখ্যাঁচড়া কাজ করে মনোমত ফল না পেলে, বলে কপালে নেই তো করবো কী? তুই তো তেমন নস, তুই কেন কপালের দোষ দিবি?”

    রামালি ঠোঁটে বিটলেমির হাসি নিয়ে বলল, “তুমি যদি নোনাপুরে না এসে, অন্য কোন দূরের গ্রামে যেতে – তাহলে আমার কপাল খুলত কি?”

    মুখে বিরক্তির আওয়াজ তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিল ভল্লা, রামালির মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল, তারপর হেসে বলল, “চ্যাংড়ামো করছিস না? কিন্তু সেটাও কপাল নয় – সুযোগ। তুই একটা সুযোগ পেয়েছিস – তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছিস। অনেকে সুযোগ পেয়েও যোগ্য হতে পারে না – তারা হিংসুটে শল্কু হয়। নে অনেক বকবক হয়েছে, জনাই আসা পর্যন্ত একটু ঘুমিয়ে নিই চল...”

    -- -- --

    মহড়ার মাঠ থেকে সন্ধের পর ভল্লা আর রামালি বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই, বালিয়া এল। পিঠের বোঝা থেকে বের করল অনেকগুলো ভল্ল, বলল, “ভল্লাদাদা, পনের জোড়া মানে তিরিশখানা ভল্ল হয়ে গেছে। একবার দেখে নাও তো, ঠিকঠাক হয়েছে কিনা?” বালিয়া পাঁচটা ভল্ল এগিয়ে দিল ভল্লার দিকে।

    “বাবা, একদিনের মধ্যে তিরিশখানা?” বালিয়ার হাত থেকে নিয়ে ভল্লগুলো পরখ করতে করতে, ভল্লা বলল।

    “আমার ছোটভাইকেও লাগিয়ে দিয়েছি ভল্লাদাদা। ও লোহার পাত বানায়। আমি ফলার তির-মুখগুলো বানাই আর বাবা, ঘষে মেজে ফলাগুলোকে ধারালো বানায়। বাস, তারপর ভাই আর আমি দুজনে মিলে বাঁশের আগায় ওগুলো বসিয়ে দিই”।

    ভল্লা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, “ভালই তো হয়েছে রে। এর আগে রণপার খুড়ো আর ফলাগুলোও ঠিকঠাক হয়েছিল। তুই এক কাজ কর, আজ জোড়া ছয় সাতেক রণপাও নিয়ে যা, কাল বাকি ভল্লগুলো আর যতগুলো সম্ভব রণপা বানিয়ে নিয়ে আসবি। কি রে রামালি, রণপা দিলে অসুবিধে হবে?”

    রামালি বলল, “তা একটু হবে, কিন্তু রণপাগুলো তাড়াতাড়ি ঠিকঠাক করে না নিলে নষ্ট হয়ে যাবে। তুই ছজোড়া রণপা এখন নিয়ে যা, পারলে কালই নিয়ে আসিস”।

    বালিয়া চলে যেতে রামালি রান্নার যোগাড়ে বসল। ভল্লা একটু চাপা স্বরে রামালিকে জিজ্ঞাসা করল, “অমাবস্যার আর কয়েকটা দিনই বাকি। আমাদের ছেলেরা পারবে? তোর কী মনে হয়, রামালি?”

    রামালি রান্না করতে করতে বলল, “আমাদের মধ্যে বারো-তের জন তো ভালই তৈরি হয়েছে…এ কদিনে বাকিরাও হয়ে যাবে। আমার মনে হয় একটা ঝুঁকি আমরা নিতেই পারি”।

    ভল্লা বলল, “নিজের সম্পর্কে তোর কী ধারণা, পারবি রক্ষীদের কোমর ভাঙতে?”

    রামালির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, ঘাড় ঘুরিয়ে ভল্লার দিকে তাকিয়ে বলল, “পারতেই হবে - আর আমার হাতেই উপানুর মরণও হবে – এ আমি তোমায় বলে রাখলাম ভল্লাদাদা”।
    ভল্লা দেখল রামালির মুখের ওপর আগুনের আভা খেলা করছে এবং তার দু চোখে জ্বলছে আগুন…। ভল্লা কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল রামালির দিকে।

    মারুলা নিঃশব্দে ঢুকল ভল্লার উঠোনে, ভল্লার পাশে বসে বলল, “কখন ফিরলি তোরা, বীজপুর থেকে?”

    ভল্লা বলল, “শেষ রাতে”।

    “রামালি, বীজপুর কেমন দেখলি? কিছু আনিসনি ওখান থেকে?”

    “এনেছি বৈকি। ভালো চাল-ডাল, আনাজ-পত্র… চাল-ডালের খিচুড়ি আর ভাজি বানাচ্ছি…” রামালি হেসে উত্তর দিল।

    “যাক বাবা, রোজ তোর ওই জোয়ারের রুটি আর ভুট্টার ঝোল খেতে খেতে জিভটা চামচিকের পাখনা হয়ে উঠছিল - আজ স্বাদ বদলাবে। একটা সুখবর দিই ভল্লা, রাজধানীর গোশকটগুলো আজ রাত্রে বীজপুরে ঢোকার কথা। তার মানে আর তিন-চারদিনের মধ্যে আমাদের অস্ত্রভাণ্ডারে পৌঁছে যাবে”।

    “অস্ত্র ভাণ্ডারের কী অবস্থা?”

    “চারপাশের দেওয়াল হয়ে গেছে। সামনের দিকে আর উত্তরের দিকে লোহার গেট লেগে গেছে। তুই যে চারটে ঘর দেখে এসেছিলি, তার মধ্যে বড়ো ঘরদুটোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভাণ্ডারের দেওয়ালে তাক ঝোলানোও হয়ে গেছে। তুই বলেছিলি দেওয়ালে বড়ো বড়ো লোহার কীল বসিয়ে কাঠের মোটা পাটা বসিয়ে দিতে। কুলিকপ্রধান কীলগুলোকে দেওয়ালে গেঁথেছে, তার ওপর, দেওয়ালের একটু ওপর থেকে লোহার শিকলের টানা লাগিয়ে দিয়েছে। বলেছে তাকগুলো এমন পোক্ত হবে, যত ভারই দিন – ভেঙে পড়বে না। তুই দেখলে তোর তাক লেগে যাবে, রে শালা”।

    “বাঃ, রাজধানীর অস্ত্রভাণ্ডারের দেওয়ালেও একই রকম ব্যবস্থা দেখেছি। তার মানে কুলিকপ্রধান যথেষ্ট অভিজ্ঞ। কিন্তু বাকি ঘরদুটো কবে শেষ হবে”?

    “ঘর হয়ে গেছে, ছাদের কাঠামোও হয়ে গেছে। টালি দিয়ে ছাইতে আর কদিন – খুব জোর তিন-চারদিন”?

    “হুঁ, তার মানে, রাজধানীর অস্ত্র-শস্ত্র এসে গেলে, ওখানেই রাখা যাবে। কিন্তু শষ্পক কী করছে? বলেছিল সমস্ত ব্যয়-ট্যয় ধরে, অঙ্ক কষে অস্ত্র-শস্ত্রের কী মূল্য হতে পারে, জানাবে? জানালো না তো?”

    “এখনও হয়নি। বলছে, গোশকট থেকে নামিয়ে, অস্ত্রভাণ্ডার পর্যন্ত সমস্ত অস্ত্র ঘরের ভিতর সাজিয়ে তুলতেও অনেক শ্রমিক লাগবে – সে সব ব্যয় ধরে, তারপর তোকে পাঠাবে”।

    “ঠিক আছে, বুঝলাম”। একটু চিন্তা করে ভল্লা মারুলাকে জিজ্ঞাসা করল, “আস্থান থেকে অস্ত্রভান্ডারের দূরত্ব কতটা হবে বল তো?”

    “আস্থান থেকে উত্তর-পশ্চিমে, তা ধর ক্রোশ দুয়ের বেশিই হবে”।

    “অমাবস্যার রাতে আস্থান থেকে কাজ সেরে, আমাদের ছেলেরা যদি এদিকে না এসে অস্ত্রভাণ্ডারের দিকে যায় – ওখানে কয়েকটাদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকা সম্ভব?”
    মারুলা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “বুদ্ধিটা মন্দ নয় ভল্লা, রণপা চড়ে তোরা একবার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে – রক্ষীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ওদিকে চলে যাওয়া সহজ হবে…”।

    “দাঁড়া, তার আগে আমাদের পুরো পরিকল্পনাটা তোকে বলি, তাহলে তোর বুঝতে সুবিধা হবে। রামালি তোর রান্না কদ্দূর?”

    “এই হয়ে এসেছে, তুমি শুরু কর আমি আসছি”। রামালি সাড়া দিল।

    ভল্লা উঠে গিয়ে প্রদীপটা নিয়ে এসে উঠোনে বসল, বলল, “মারুলা এদিকে আয়”। তারপর মাটিতে কাঠি দিয়ে আস্থানের রেখাচিত্র আঁকতে লাগল। আঁকা শেষ হওয়ার আগেই রামালিও এসে ভল্লার পাশে বসল। মারুলা কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখল, বলল, “আস্থানে তুই দুবার গিয়েছিলি, না? একবার দিনে আরেকবার রাত্রে…নিখুঁত এঁকেছিস। কিন্তু তোর ছেলেদের আক্রমণের পর – শষ্পককে বলে, উপানু চার কোনে চারটে প্রহরী-স্তম্ভ বানিয়ে তুলেছে। কাঠের কাঠামো - বারো হাত উঁচুতে বাঁধা মাচায় একজন করে রক্ষী সারারাত পাহারা দেয়”। মারুলা খিঁকখিঁক করে একটু হাসল, বলল, “অবিশ্যি মাঝরাতে পেচ্ছাপ ফিরতে উঠে – ব্যাটাদের প্রতিদিনই নিশ্চিন্তে ঝিমোতে দেখেছি…। যাগ্‌গে এবার তোর পরিকল্পনাটা শুনি। ঠিক কিসের জন্যে আক্রমণ করতে চলেছিস”?

    ভল্লা মুখ তুলে তাকাল মারুলার দিকে, বলল, “মুখ্য উদ্দেশ্য শোধ নেওয়া – বেশ কিছু রক্ষীকে যমের দুয়োরে পাঠানো – পারলে উপানুকেও!”

    মারুলা উত্তেজিত হয়ে বলল, “শালা উপানুকেও? শষ্পক শুনলে তোকে মাথায় করে নাচবে”।

    “তার মানে? তার রক্ষী-সর্দারকে মারলে সে খুশি হবে?”

    “রক্ষী-সর্দার না, ব্যাঙের মাথা। ওর ধামাধরা জনা আষ্টেক রক্ষী ছাড়া, অন্য রক্ষীরাই সুযোগ পেলে শালাকে মাটিতে পুঁতে দেবে। উপানু কোন ঘরে শোয় জানিস?” ভল্লা রেখাচিত্রের ওপর আঙুল দিয়ে উপানুর ঘরটা দেখাল। মারুলা আবার খিঁক খিঁক করে হাসল খানিকক্ষণ, তারপর বলল, “ঠিকই দেখিয়েছিস…কিন্তু বেজন্মটা একটু রাত হলেই – এই যে এই ঘরে...”, আঙুল দিয়ে ঘরটা দেখিয়ে মারুলা বলল, “এই ঘরে পীরিত করতে যায়?”

    ভল্লা এবং রামালি দুজনেই অবাক হয়ে বলল, “তার মানে?” রামালি বলল, “আস্থানে মেয়েরাও থাকে নাকি”?

    মারুলা রামালির কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোকে এসব কথা বলতে লজ্জা করে, রামালি। কিন্তু না বলারও কোন মানে হয় না। বড়ো হচ্ছিস, নিজের পায়ে দাঁড়াবার মতো একটা জায়গা তৈরি করছিস। জগৎটাকে জানতে এবং চিনতে তো হবেই। জেনে রাখ, ছেলেতে ছেলেতেও পীরিত হয় – বিরল ঘটনা যদিও – কিন্তু হয়। মাস ছয়েক আগে উপানু এই ছেলেটিকে ওর নিজের সহকারী বলেই আস্থানে এনেছিল। দেখতে-শুনতে ভালো, একটু নাদুস-নুদুস ধরনের। কত বয়েস হবে – চোদ্দ-পনের? কিছুদিনের মধ্যেই উপানুর দুর্মতি টের পাওয়া গেল। ওই ঘরটিতেই সে ছেলেটিকে থাকতে দিল এবং রাত্রে নিয়মিত ছেলেটির বিছানায় যাওয়া শুরু করল। প্রথম দিকে ছেলেটি চেঁচামেচি করত, কান্নাকাটি করত। উপানু মারধোর করত। দু’-তিনবার পালাবার চেষ্টাও করেছিল। পারেনি – উপানুর আমড়াগেছো রক্ষীরা তাকে ঘাড় ধরে আস্থানে ফিরিয়ে এনেছে। উপানু মরলে অসহায় ছেলেটাও পিশাচের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে”।

    ভল্লা বলল, “শষ্পক জানে না? সে কিছু করছে না কেন?”

    মারুলা বলল, “তুই তো জানিস, ভল্লা। শষ্পক প্রসাশনের লোক আর উপানুরা হল, নগরকোটালের অধীন। এখানে শষ্পকের নির্দেশ মানতে উপানু বাধ্য – কিন্তু উপানুর ব্যক্তিগত বিষয়ে কিংবা ওর অধীনস্থ কোন কর্মচারীর ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অধিকার শষ্পকের নেই। সেই সুযোগটাই উপানু নিয়ে যাচ্ছে”। মারুলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, “আমার হাতেই উপানুর মৃত্যু লেখা আছে…একবার সুযোগ যদি পাই…”।

    “না মারুলাদাদা, উপানু আমার শিকার, আমার হাতেই ও মরবে…”। রামালি দাঁতে দাঁত চেপে মারুলার দিকে তাকিয়ে বলল, “কবে থেকে আমি ওর আয়ু গুনছি…”। মারুলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রামালির চোখের দিকে, তারপর মুচকি হেসে বলল, “ঠিক আছে, তোকেই দিলাম… পাঁঠাটাকে তুইই বলি দিবি…কিন্তু আমি তোর কাছাকাছি থাকবো…শালা ভয়ানক ঘুঘু…একটু ঊণিশ-বিশ হলেই ফস্কে যাবে”।

    অনেকক্ষণ পর ভল্লা বলল, “উপানুর স্থায়ী ব্যবস্থা তো তোরা করেই ফেললি। এবার মূল পরিকল্পনাটা বলছি, শোন মারুলা। আমরা ঢুকবো পূবের দরজা দিয়ে। যতদূর জানি মাঝরাত্রে ওই দরজায় প্রহরা কিছুটা দুর্বল থাকে”।

    “একদম ঠিক। আমি বলব, পূব দিকের দুই স্তম্ভের দুই প্রহরীকে প্রথমেই টপকে দে। অন্ধকারে বেড়ার বাইরের ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে ভল্ল বা তীর ছুঁড়ে। তারপর তিন থেকে চারজন বন্ধ দরজা টপকে নিঃশব্দে ঢুকে পড়, আর প্রহরীগুলোকে ঝপাঝপ সাবড়ে দে। রাত্রে ওদিকে জনা তিন-চার থাকে সবকটাই ঢ্যাঁড়স, সুযোগ পেলেই ঝিমোয়। তারপর বাঁদিকের রক্ষীদের ঘরের চারটে দরজায় শেকল তুলে দে। ব্যাটারা থাক বন্দী হয়ে, হঠাৎ কেউ বেরিয়ে পড়লেই বিপদ। এবার পশুশালা পার হয়ে পশ্চিমদিকে যেতে যেতে করণিক আর পাকশালার দরজাগুলোও বন্ধ করে দে। তারপর প্রথমে চল উপানুর অভিসার ঘরে। সেখানে উপানুকে শেষ করে, চারজন ছোট পাকশালার ঘুপচিতে গা ঢাকা দিয়ে প্রস্তুত থাক। সুবিধে হল, ওখান থেকে দুটো দিকেই লক্ষ্য রাখা যাবে”।

    এইবার আমাদের সব থেকে কঠিন কাজটার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে। পাকশালার ঘুপচিতে ঢুকেই বাইরের ছেলেদের সংকেত দিতে হবে। তারা আগের মতোই বাইরে থেকে দুই স্তম্ভের দুই প্রহরীকে শেষ করবে। এবং একই সময়ে পশ্চিমের প্রধান দরজার উল্টোদিকে - রাজপথের ওপাড়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে থাকা ছেলেরা আক্রমণ করবে। ওখানে দরজার সামনে থাকা দু-তিনজন রক্ষীকে মারতে পারলে, বাকি রক্ষীরা পিছিয়ে যেতে যেতে আস্থানের অন্যান্য রক্ষীদের বেরিয়ে আসার সংকেত দেবে...কিন্তু রক্ষীদের ঘর বন্ধ এবং ততক্ষণে উপানু টেঁশে গেছে – আমাদের পেছনে চট করে কেউ আসতে পারবে না। এইসময় আমাদের ছেলেরা ঘুপচি থেকে হঠাৎ বেরিয়ে পিছিয়ে আসা রক্ষীদের আক্রমণ করবে। এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের প্রহরা-স্তম্ভে উঠেও আমাদের ছেলেরা রক্ষীদের আক্রমণ করতে পারবে।

    এই কাজটা যত অল্প সময়ে যত নিখুঁত আমরা করতে পারবো, ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল”।



    ভল্লা আর রামালি ছবিটার দিকে তাকিয়ে মারুলার পুরো পরিকল্পনাটা নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। বেশ কিছুক্ষণ পর ভল্লা বলল, “আমার তো ভালই লাগছে পরিকল্পনাটা। তুই খেয়ে দেয়ে কেটে পর মারুলা। কালকে দিনের বেলা ছেলেদের সঙ্গে একটু আলোচনা করে, কাল রাত্রে আবার তোর সঙ্গে বসব...। দক্ষতা অনুযায়ী কোন ছেলে কোথায় থাকবে – সেটা আমাদের কালকেই ঠিক করে নিতে হবে”।

    রামালি খাবার বাড়তে বসে গেল দেখে, মারুলা বলল, “আমাকেও তোর দলে নিতে পারিস, তবে আমি বাইরে থাকব, আস্থানে ঢুকব না। আমি উত্তরের দুটো প্রহরা-স্তম্ভের প্রহরীকে মেরে পশ্চিমের দরজার উল্টোদিকে ঝোপের আড়ালে থাকবো। সংকেত পেলেই দরজার সামনে থাকা কম করে দুটো রক্ষীকে তো আমি খসাবোই! ভালো কথা সংকেতটা কী হবে? সেটাও ভেবে ঠিক করে নিস”।

    “বাঃ তুমি যে বললে, উপানুকে মারার সময় তুমি পাশে থাকবে?” রামালি ভল্লা আর মারুলার হাতে খাবারের থালা দিতে দিতে বলল।

    ভল্লা বলল, “না রে, আমাদের সঙ্গে আস্থানের ভেতরে ঢুকলে মারুলাকে কেউ চিনে ফেলতে পারে…। তোর পাশে আমি থাকবো রামালি, তোর পাঁঠাকে তুই কাট না – তবে লেজ নয় – ব্যাটার মুড়োটাই কাটিস”।

    মারুলা খেতে খেতে বলল, “তোদের ছেলেরা সাদা ধুতি পরলে – অন্ধকারেও কিন্তু বোঝা যাবে ভল্লা, বেশি সময় নেই – তা নাহলে কালো ধুতি যোগাড় করতে বলতাম”। ভল্লা রামালির মুখের দিকে তাকাল, কিছু বলল না। রামালি হেসে বলল, “কালো ধুতি আমরা কিনেছি তো, বীজপুর থেকে”।

    মারুলা বলল, “জানি ভল্লাব্যাটার সব দিকেই লক্ষ্য, তবু একবার মনে করালাম। আচ্ছা শোন, তোর জন্যে শষ্পক চার বটুয়া রূপো পাঠিয়েছে…খেয়ে উঠে দিচ্ছি। শষ্পককে বলেছিলাম – তোরা বীজপুর গেছিস, ঘর-টর বানাতে হবে – শুনেই বলল, ভল্লার টাকা চাই তো…নিয়ে যাও… আরও দুটো বটুয়া থাকল আমার কাছে...। তোর ওই গচ্ছিত টাকার জন্যে শষ্পকের রাত্রে ঘুম হয় না, মনে হয়”।

    ভল্লা বলল, “ঠিক আছে, দিয়ে যা। কিন্তু মারুলা, আমি ভাবছিলাম, আমাদের একজন কবিরাজ বা বৈদ্যকে দরকার – কিছুদিনের জন্যে। কী করা যায় বল তো?”

    “কিসের জন্যে?”

    “ধর আমাদের মধ্যে ওই দিন কেউ কেউ আহত হলাম, চিকিৎসার জন্যে কাউকে তো দরকার…”।

    মারুলা বলল, “হ্যাঁ দরকার তো বটেই – কিন্তু হুট করে বিশ্বাসযোগ্য পাবি কাকে? যে ব্যাটাকে আনবি সে ব্যাটা হয়তো তোদের ওই শল্কুর মতো আস্থানে চলে গেল… তখন? তাকে ঘুম পাড়াতে আবার এই মারুলার খোঁজ পড়বে!”

    রামালি বলল, “একজন আছে ভল্লাদাদা, আমাদেরই গ্রামে – নাম বড়্‌বলা। আমাদের গ্রামে আরেকজন বলা আছে, তাকে আমরা ‘ছোট্‌বলা’ ডাকি। আমাদের কবিরাজমশাইয়ের সঙ্গে বড়্‌বলা দীর্ঘদিন ছিল। কবিরাজ নয় কিন্তু কিছু কিছু শিখেছে - ক্ষত সেলাই, প্রলেপ বানানো, কিছু কিছু জড়িবুটি বানানো...কবিরাজমশাই না থাকাতে, এখন তো তাকেই ডাকছে গ্রামের লোকরা”।

    ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “সে করবে?”

    “কেন করবে না? এখন আমাদের আর সুকরা গ্রামের সমস্ত লোক আমাদের সাহায্য করার জন্যে মুখিয়ে আছে – করবে না মানে? আরেকজন আছেন সুকরা গ্রামের কুশানকাকা – বলার থেকে কুশানকাকা ভালো কবিরাজি করে – তবে কুশানকাকা, সুরুলের মুখে শুনেছি, একটু বেশি রাজভক্ত। কাজেই কুশানকাকাকে দিয়ে আমাদের চলবে না”।

    “বড়্‌বলাকে কাল একবার ডাক না, কথাবার্তা বলি”। ভল্লা বলল।

    সকলেরই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। রামালি এঁটো বাসন তুলতে তুলতে বলল, “ঠিক আছে”।

    রামালি পুকুরের দিকে চলে যেতে ভল্লা মারুলাকে বলল, “ভাবছি, পরশু ছেলেদের নিয়ে একবার অস্ত্রভাণ্ডার থেকে ঘুরে আসব। কোন সময় যাওয়া ঠিক হবে বল তো”?

    “দিনের বেলায় যা – আলো থাকতে থাকতে। কুলিকপ্রধানকে আমি বলে দেব - পরশু কেউ যেন কাজে না আসে। নিশ্চিন্তে ঘুরে আয় – সামনের দরজা নয়, পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকবি। কোন সময় যাবি – আমিও থাকব তাহলে”।

    একটু চিন্তা করে ভল্লা বলল, “উঁহু। এখনই ছেলেদের সঙ্গে তোর পরিচয় হওয়াটা ভয়ানক ঝুঁকি হয়ে যাবে। এই দলটার মধ্যে থেকে যদি আরেকজন শল্কু বেরিয়ে পড়ে – তুই এবং শষ্পক দুজনেই বিপদে পড়ে যাবি। এবং আমাদের আস্থান আক্রমণের পরিকল্পনাটাও ভেস্তে যাবে”।

    এই সময় রামালি ফিরে এল পুকুর থেকে। ঘরের মধ্যে থালাবাটি হাঁড়িকুড়ি রেখে দিয়ে বাইরে এল।

    মারুলাও চিন্তা করে বলল, “ঠিকই বলেছিস”।

    ভল্লা তারপর রামালির দিকে তাকিয়ে বলল, “এক কাজ করতে পারিস। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেই পরশুদিন রামালি চলে যাক। ওর সঙ্গে তুই ওখানে দেখা করে নে। আমি ছেলেদের নিয়ে বিকেলের মধ্যে পৌঁছে যাবো”।

    “কিন্তু রামালি চেনে না, তো”!

    “ধ্যার ব্যাটা। জঙ্গলের পথে সোজা দক্ষিণে – অতখানি জায়গা জুড়ে অস্ত্রভাণ্ডার – রামালি চিনতে পারবে না? কী যে বলিস!”

    “ঠিক আছে, তাহলে ওই কথাই রইল। আমি এবার কেটে পড়ি। এই নে শষ্পকের দেওয়া বটুয়া চারটে রাখ”।

    “যা। আমি আর রামালি এখন কমলিমায়ের বাড়ি যাবো”।




    ক্রমশ...




    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন