এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • বিপ্লবের আগুন - পর্ব বাইশ

    কিশোর ঘোষাল
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৩২১ বার পঠিত
  • [প্রাককথাঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ হোক কিংবা প্রাচীন রাজতান্ত্রিক সমাজ – বিদ্রোহ, বিপ্লব সর্বদাই প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। নিরীহ, অনুন্নত এবং প্রান্তিক মানুষরা যুগেযুগে কীভাবে উদ্বুব্ধ হয়েছিলেন এবং হচ্ছেন? তাঁরা কীভাবে এগিয়ে চলেন বিপ্লবের পথে? কীভাবে তাঁরা অস্ত্র সংগ্রহ করেন? কোথা থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন সেই বহুমূল্য অস্ত্রসম্ভার? যার শক্তিতে তাঁরা রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রাখার বারবার স্পর্ধা করেছেন? কখনও তাঁরা পর্যুদস্ত হয়েছেন, কখনও ক্ষণস্থায়ী সাফল্য পেয়েছেন। আবার কখনও কখনও প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রকে তাঁরা পরাস্ত করে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতেও পুরোন বিদ্রোহ-বিপ্লবের আগুন নেভে না কেন? রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদতেই কি এ বিপ্লব চলতে থাকে আবহমান কাল ধরে?]

    ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়

    ২২


    ভল্লা আর রামালি ভোরে রওনা হল মহড়ার মাঠের দিকে। গতকাল গ্রামপ্রধানের দাহ সৎকার শেষ হতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে গিয়েছিল। ভল্লা ভেবেছিল নোনাপুরের কেউ আজ আর মহড়ায় আসবে না। কিন্তু দাহ শেষে কাল রাত্রেই ছেলেরা বলেছিল, তারা আজ আসবে। অন্যদিনের মতো একই নিয়মে মহড়া করবে। আজ সকালে মহড়ার মাঠে পৌঁছে ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা আশ্চর্য হল। প্রত্যেকটি ছেলের মুখ গম্ভীর। তাদের দু চোখে ছেলেমানুষী সরলতা নয়, জেগে উঠেছে দৃঢ় এবং নিষ্ঠুর প্রতিজ্ঞা। একজন শ্রদ্ধেয় মানুষের এমন অসম্মানের মৃত্যু, একরাত্রেই তাদের মনে অদ্ভূত এই রূপান্তর এনে দিয়েছে! ভল্লা কিছু বলল না। এক পাশে বসে, ছেলেদের অনুশীলন দেখতে লাগল, মন দিয়ে। একে একে সকলেরই অনুশীলন দেখে খুশি হল, ভল্লা।

    উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেদের কাছে গেল, সুরুল আর আহোকের কাঁধে হাত রেখে সকলের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “নাঃ এতদিনে তোরা সত্যিই এক-এক জন যোদ্ধা হয়ে উঠছিস। আমার মনে যেটুকু দ্বিধা ছিল সেটা কেটে যাচ্ছে। তোদের সকলকে নিয়ে প্রকৃত লড়াইয়ে নামার সময় এবার এগিয়ে আসছে। প্রতিশোধ। হ্যাঁ, এই প্রতিশোধের আগুনটা রাজধানী ছাড়ার পর থেকেই আমার বুকের মধ্যে জ্বলছে অহরহ। আজ তোদের মধ্যেও সেই আগুনটা আমি দেখতে পাচ্ছি। আর দশটা দিন এভাবেই তোরা অনুশীলন চালিয়ে যা। তারপরে গভীর রাত্রে আমরা আস্থানে যাব”। ভল্লা এবার গম্ভীর দৃঢ় স্বরে, প্রত্যেকটি কথা শান্ত নিষ্ঠুর উচ্চারণে বলল, “এবারে আর শুধু অস্ত্র-শস্ত্র চুরি নয় – সরাসরি আক্রমণ। আমাদের প্রধান লক্ষ্য থাকবে একটাই। কবিরাজমশাইয়ের মুক্তি। এই লক্ষ্য পূরণের জন্যে কিছু রক্ষীকেও হত্যা করতে হবে। তখন তোদের কারো...একজনেরও হাত যেন না কাঁপে”।

    ভল্লার শেষের কথাগুলো ছেলেদের কাঁপিয়ে দিল, একসঙ্গে সকলে গর্জে উঠল, “কাঁপবে না। রক্তের শোধ নেব রক্তেই”। ভল্লা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। বলল, “এই শপথের আগুন সর্বদা জ্বলতে থাকুক তোদের সবার মনে। নে আবার মহড়া শুরু কর। কাল যে রণপা চড়ে ভল্ল ছোঁড়া দেখিয়েছিলাম, সেটাও...। ওটা হয়ে গেলে শুরু হবে আমাদের রাত্রের মহড়া...”।

    ছেলেরা আবার অনুশীলন শুরু করতে, রামালিকে ডাকল ভল্লা, বলল, “আমাদের রণপা, ভল্ল, বল্লম কতগুলো আছে বলতো? গুণে দেখেছিস? আমাদের ছেলেদের সবার হয়ে যাবে?”
    রামালি বলল, “ছ’জোড়া রণপা বেশি আছে। ভল্ল বেশি আছে দুটো, আর বল্লম বেশি আছে প্রায় দশটা”।

    ভল্লা বলল, “মিলাদের ওখানে আপাততঃ কতগুলো দেওয়া যাবে?”

    রামালি বলল, “চারজোড়া রণপা, আর ছটা বল্লম দেওয়া যাবে... ভল্ল না দেওয়াই ভালো, ভেঙে-টেঙে গেলে, আমাদেরই অসুবিধে হবে। বালিয়াকে দিয়ে কিছু ভল্ল বানিয়ে নিলে হয় না?”

    “তা হয়, কিন্তু সরু ছোটছোট বাঁশের টুকরো পাবি কোত্থেকে, যার মাথায় ভল্লর ফলা জোড়া যাবে?”

    “হাত দেড়েক লম্বা টুকরো হলেই তো ভল্ল হয়ে যাবে, সে টুকরো বাঁশ কিন্তু আমাদের আছে”।

    “কোথায়?” অবাক হয়ে ভল্লা জিজ্ঞাসা করল রামালিকে।

    “আমাদের প্রত্যেকের যে রণপা রয়েছে, ভল্লাদাদা। তার মাথা থেকে হাত দেড়েক যদি কেটে নেওয়া হয়, তাতে কি অসুবিধে হবে?”

    ভল্লা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রণপা জোড়া খাড়া করে ধরল, দুটো বাঁশের দৈর্ঘ্যই তার মাথা ছাড়িয়ে গেল। ভল্লা বলল, “বাঃ এটা আমার মাথায় আসেনি তো! সবকটাই কি একইরকম লম্বা?”

    “হ্যাঁ ভল্লাদাদা সবকটাই – তার মানে ছত্রিশ জোড়া”।

    “বাঃ, তার মানে ছত্রিশ জোড়া ভল্ল হয়ে যাবে? রাজধানীর অস্ত্র-শস্ত্র আসা অবধি আমাদের চলে যাবে। এখন চল, মিলারা বোধহয় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মিলাদের কথা আমাদের ছেলেদের বলেছিস?”

    “না ভল্লাদাদা, বলিনি। নিজেদের অঞ্চলে ওরা তো আসলে ডাকাতি করছে…তাই…” একটু ইতস্ততঃ করে রামালি থেমে গেল।

    ভল্লা হাসল, বলল, “ধুর বোকা, ওরা ডাকাতি করছে টাকাকড়ির জন্যে, ওদের আসল উদ্দেশ্য তো রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ… আর এতদিনে তুই তো বুঝেই গেছিস, আমাদের পেছনে আছে, আমাদেরই প্রশাসন। অতএব শুরুতে আমাদের ডাকাতি করতে হল না। কিন্তু ওদের তো তা নেই…। আমাদের ছেলেদের সময়মতো বলে দিস। অন্য কারোর মুখে মিলাদের কথা শুনলে ছেলেরা ভুল বুঝতে পারে…”। ভল্লা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি রামালিকে নিয়ে একটা কাজে যাচ্ছি, তোরা কিন্তু মহড়া চালিয়ে যা। রামালি একটু পরেই ফিরবে…আমি আসব বিকেলে”।

    ছেলেরা বলল, “ঠিক আছে, ভল্লাদাদা”।

    ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “হ্যারে শল্কু আসেনি? কী হয়েছে ওর?”

    আহোক বলল, “জানিনা ভল্লাদাদা, আসার সময় ওর সঙ্গে ওর বাড়ির সামনে দেখা হল। জিজ্ঞাসা করলাম, কি রে যাবি না? বলল, তোরা চল, আমি যাচ্ছি একটু পরে… এখনও তো এল না”।

    বিনেশ বলল, “শল্কুটা বিগড়ে গেছে, ভল্লাদাদা…ওর হাবভাব ভালো ঠেকছে না”।

    ভল্লা আহোক আর বিনেশের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। তারপর রণপায় চড়ে বলল, “বেরোচ্ছি, রে”।

    * * *

    ভল্লা আর রামালি বাসায় পৌঁছে দেখল, মিলা, জনাদের সাতজন ছেলে তাদের ঘরের সামনে উঠোনে বসে হ্যা হ্যা করে হাঁফাচ্ছে। রামালির মনে পড়ল প্রথমদিন রামালিদেরও একই অবস্থা হয়েছিল।

    ভল্লা ওদের দেখে হাসল, বলল, “ভালই তো হাঁফাচ্ছিস, কতক্ষণ দৌড়লি? রামালি ওদের জন্যে রণপাগুলো নিয়ে আয়। আর তোরা বসে বসে হাঁফাস না, চল হাঁটি। তোদের মহড়ার মাঠটা দেখিয়ে দিই”।

    জনা বলল, “ওফ যা দৌড় করিয়েছ ভল্লাদাদা, একটু জিরোতে দাও”।

    “রামালিরা জানে, আমি ওদের জিরোতে দিই না – তোরাও জেনে যাবি - কয়েকটাদিন আমার সঙ্গে থাক”। ভল্লা হাসতে হাসতে বলল, “চল ওঠ, ওই দ্যাখ, রামালি তোদের জন্যে রণপা আর বল্লম নিয়ে চলে এসেছে”।

    রামালি ওদের হাতে চার জোড়া রণপার বাঁশ তুলে দিল। তারপর ভল্লা আর রামালি নিজেদের রণপায় চড়ে পড়ে, ভল্লা বলল, “তোরা কি রণপা আগে দেখেছিস? রণপা চড়ে খুব তাড়াতাড়ি হাঁটাচলা করা যায় – আর দৌড়তে পারলে, ঘোড়াকেও টেক্কা দিতে পারবি। চল মাঠে চ, তোদের শেখাবো”।

    মাঠ দেখে মিলাদের সকলেরই বেশ ভালো লাগল। চারদিকে ঘন গাছের জঙ্গল ঘেরা অনেকটা ফাঁকা জায়গা। ভল্লা বলল, “আপাততঃ চারটে রণপা জোগাড় করতে পেরেছি, বল্লম আছে গোটা দশেক - বিকেলে পেয়ে যাবি। এই নিয়েই শুরু কর, তারপর দেখছি কত তাড়াতাড়ি তোদের অস্ত্র যোগাড় করতে পারি”।

    রামালি চারজন ছেলেকে রণপায় চড়ে হাঁটতে শেখাতে লাগল। ভল্লা মিলা আর জনাকে বলল, “তোদের এখন তো কাজ নেই – চল কিছু কথা সেরে নেই। তিনজনেই মাটিতে বসল। ভল্লা বলল, “দ্যাখ মহড়ার মাঠ তো হল, কিন্তু তোদের একটা বা দুটো বড়ো ঘর তো চাই। যেখানে তোদের এই অস্ত্র-শস্ত্র সব রাখতে হবে। রোজ সন্ধেয় বাড়ি নিয়ে যাবি আর ভোরে সেসব সঙ্গে নিয়ে এখানে আসবি। লোকের বুঝতে কিছু বাকি থাকবে?”

    মিলা জনার দিকে তাকাল, বলল, “ঠিক কথা, এদিকটা আমরা ভাবিনি”।

    ভল্লা বলল, “এখান থেকে ক্রোশ খানেক দূরে একটা পুকুর আছে, তার পাশে কিছুটা জমি নিয়ে তোরা একটা বা দুটো ঘর বানিয়ে নিতে পারিস। কিন্তু কী দিয়ে বানাবি? ইঁট না কি বাতা?”

    মিলা বলল, “ইঁট দিয়ে বানালে ভাল হয় না”?

    “ভাল তো হয়ই, কিন্তু খরচ এবং সময় লাগবে বেশি। ইঁট যোগাড় করতে পারবি? তোদের ওদিক থেকে ইঁট আনতে গেলে – সকলেই জেনে যাবে”।

    জনা বলল, “রামালিরা যেখান থেকে ইঁট কেনে, সেখান থেকেই নিতে পারি আমরা। ইঁট, চুন, সুরকি – পুকুরের জল তো পেয়েই যাব। তাহলে আমাদের দিকের লোকেরা চট করে বুঝতে পারবে না। কিন্তু টাকাকড়ি?”

    ভল্লা বলল, “তোরা তো কাল দিয়েই গেলি – সেখান থেকে এখন নিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দে। আর ওই দুটো ঘরের ভেতর একটাতে, ছোট্ট একটা কুঠরি বানিয়ে তার মধ্যে একটা সিন্দুক বসিয়ে ফেল। তোরা টাকা-কড়ি যা যোগাড় করবি, ওখানেই রাখবি। অস্ত্র কেনার ব্যাপার হলে, আমাকে বা রামালিকে দিবি”।

    মিলা বলল, “রামালিকে তুমি এতটা ভরসা করছো ভল্লাদাদা?”

    ভল্লা হাসল, “তোরাও করবি, কয়েকটা দিন ওর সঙ্গে ওঠাবসা কর…। ওই দ্যাখ রামালি ওর নিজের রণপাজোড়াও দিয়ে দিল…ভাল করেছে… একসঙ্গে পাঁচজনই শিখতে পারবে। অ্যাই রামালি, এদিকে শোন…”।

    রামালি ওদের তিনজনের কাছে এসে বসতে ভল্লা বলল, “রামালি, এদের জন্যে দুটো ঘর বানানোর ব্যবস্থা করতে হবে – ওরা চাইছে ইঁটের দেওয়াল তুলতে, ইঁট-চুন-সুরকি যোগাড় করে দিতে পারবি? এবং কাজের লোক?”

    রামালি একটু চিন্তা করে বলল, “বীজপুরের একজন আমাদের এদিকে ঘর বানানোর কাজ করে...তাকে খবর দিতে পারি...তবে দু-তিনদিন সময় লাগবে...ওর কাছে সব পাওয়া যাবে...এমনকি ঘর ছাওয়ার টালি থেকে কাঠের বরগা-কড়ি সব...”।

    মিলা বলল, “বাঃ তাহলে তো খুব ভালো হয়...কিন্তু আমরা খবর দেব, সে আসবে...কথাবার্তা হবে...তারপর সে মালপত্র আনবে, লোক পাঠাবে...অনেক দেরি হয়ে যাবে তো!”

    ভল্লা বলল, “লোকটাকে তুই চিনিস? কোথায় থাকে জানিস?”

    রামালি বলল, “তা চিনি, কিন্তু বীজপুরে ঠিক কোথায় থাকে জানি না। তবে ওখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে...”।

    ভল্লা একটু চিন্তা করে বলল, “রণপা চড়ে বীজপুর যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে...তিন, সাড়ে তিন প্রহর?”

    রামালি হেসে ফেলল, বলল, “পায়ে হেঁটেও আমি কোনদিন বীজপুর যাইনি ভল্লাদাদা...। তবে যারা যাওয়া-আসা করে, তাদের মুখে শুনেছি পায়ে হেঁটে প্রায় ছ-সাত প্রহরের পথ”।

    ভল্লা বলল, “হুঁ, তার মানে রণপা চড়ে গেলে – তিন-চার প্রহরের মধ্যে পৌঁছনো সম্ভব। আমরা এখান থেকে যদি আজ মধ্য রাত্রিতে রওনা দিই, আগামীকাল সকাল-সকাল বীজপুর পৌঁছে যাবো...”।

    মিলা আর জনা চমকে উঠে বলল, “তুমি যাবে ভল্লাদাদা...কী বলছো?”

    ভল্লা মুচকি হেসে বলল, “একসঙ্গে যখন নেমেছি, তখন ক্ষতি কী? অবিশ্যি তোরা যদি না চাস তাহলে যাবো না”।

    মিলা লজ্জা পেয়ে বলল, “যাঃ কী যে বলো না, তা নয়...এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে?”

    ভল্লা এবার গম্ভীর মুখে বলল, “আমরা যদি যাই, আগামী কাল হয়তো দুজনেই থাকবো না...তাই বলে তোদের মহড়া যেন বন্ধ না হয়। পরশু এসে দেখতে চাই তোরা সবাই রণপা চড়তে শিখে গিয়েছিস”।

    মিলা বলল, “তুমি আমাদের জন্যে এত কিছু করছ...তার পরিবর্তে আমরা তোমায় ফাঁকি দেব? সে কথা মনেও স্থান দিও না ভল্লাদাদা”।

    ভল্লা বলল, “উত্তম। আরেকটা কথা – তোরা দুজন ছাড়া এই কথা কেউ যেন জানতে না পারে – এমনকি আমাদের এদিকের ছেলেরাও কেউ না...”।

    “জানবে না, ভল্লাদাদা”।

    “আমরা এখন উঠছি রে মিলা। আমাদের ও দিকে কী হচ্ছে একবার দেখে আসি। রামালি চল”।

    রামালি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জনা, তোরা ফিরবি কখন?”

    “সন্ধের দিকে”।

    “তাহলে যাওয়ার সময় রণপাগুলো ভল্লাদাদার বাসার কাছে রেখে দিয়ে আসবি”?

    ভল্লা বলল, “হুঁ, যতদিন না তোদের ঘর হচ্ছে, ততদিন ওগুলো আমাদের ওখানে রেখে দেওয়াই নিরাপদ”।

    জনা বলল, “ঠিক আছে ভল্লাদাদা। তার মানে তোমাদের সঙ্গে পরশু দিন আবার দেখা হবে...”।

    রামালি হেসে বলল, “কেন? আজ সন্ধেতেই আবার দেখা হবে। আমরা যদি নাও থাকি, একটু অপেক্ষা করিস, আমরা চলে আসবো”।

    -- -- --

    দুপুরের খাওয়ার পর ভল্লা আর রামালি গেল এদিকের মহড়ার মাঠে। ছেলেরা ঘাম আর মাটি মাখা শরীরে পূর্ণ উদ্যমে মহড়া করে চলেছে। ভল্লা কিছু বলল না, ওদের পাশে গিয়ে বসল। বিনেশ আর দীপান রণপা চেপে দৌড়তে দৌড়তে ভল্ল ছোঁড়ার মহড়া দিচ্ছিল। ভল্লা মন দিয়ে দেখল। খুশিই হল। চেঁচিয়ে বলল, “তোরা আগের মহড়াটা একবার করে দেখা তো। দেখি কেমন শিখেছিস, ভুলে গেলি কিনা?”

    দুজনেই রণপা থেকে নেমে আগের মহড়াটা তিনবার করে দেখাল। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ না হলেও, প্রায় নিখুঁত বলা যায়। ভল্লা ওদের ডাকল, বিনেশ আর দীপান হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বসল ভল্লার সামনে। এবার রামালি, মইলি আর সুরুল নামল মহড়ায়। ভল্লা ভুরু কুঁচকে বলল, “রামালি বলল, তোরা ঠিকঠাক লক্ষ্যভেদ করতে পারছিস, কই একটু ফস্কে যাচ্ছে যে?” দীপান বিনেশের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে বলল, “সে তো তোমার জন্যে -তুমি সামনে এসে দাঁড়ালেই বুকের ভেতরটা কেমন দুরদুর করে – তোমার মতো ঠিকঠাক পারবো তো?”

    ভল্লা হেসে উঠল হো হো করে, বলল, “বোঝো, আমার ভয়ে তোদের হাত কাঁপছে! কিন্তু যুদ্ধে যখন নামবি, ওই সূক্ষ্ম ভুলের ওপরই তোর জীবন-মৃত্যু নির্ভর করবে রে হতভাগা! লক্ষ্যভেদের সময় যুধিষ্ঠির এবং অন্য সকলে – ওখানে উপস্থিত সব্বাইকে দেখতে পাচ্ছিল – গুরুদেব দ্রোণকে, নিজেদের ভাইদের। আকাশ, গাছপালা, পাতা, ফুল – সবকিছু। আর অর্জুন দেখেছিল শুধু পাখির চোখ – আর কিচ্ছু না। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের গল্প শুনিসনি?”

    ভল্লার পাশে বসা ছেলেরা সকলেই ভল্লার কথা শুনল। কেউ কিছু বলল না। কথাবার্তার ফাঁকে সে রামালি, মইলি আর সুরুলের মহড়া দেখছিল মন দিয়ে। তিনজনেই নিখুঁত – প্রতিবার। ভল্লা খুব খুশি হল, বলল, “মনে হচ্ছে তোরা আজ দুপুরে খেতে যাসনি?”

    “নাঃ যাইনি। আজ থেকে আর যেতে হবে না। বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে যাবে”।

    ভল্লা ভীষণ অবাক হল, “তার মানে?”

    আহোক বলল, “প্রধানমশাইয়ের মৃত্যুটা গ্রামের সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে ভল্লাদাদা। বাবা-কাকাদের তো বটেই, বিশেষ করে মা-কাকিমাদেরও। বলেছেন এতটা পথ হেঁটে তোরা খেতে আসবি, ফিরে যাবি...অকারণ সময় নষ্ট। তোদের আসতে হবে না, ঠিক সময়ে খাবার পৌঁছে যাবে। চাষের সময় ঠিক যেভাবে মাঠে খাবার পাঠায় বাড়ির মেয়েরা...সেভাবে”

    ভল্লা অস্ফুট স্বরে বলল, “কী বলছিস”? অনেকক্ষণ কেউই কোন কথা বলল না। মহড়া শেষে রামালি, মইলি আর সুরুলও এসে বসল ওদের সঙ্গে। “সকলের এই আশীর্বাদের মর্যাদা যে আমাদের রাখতেই হবে...” ভল্লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “...সে কথা ভুলিস না। আয়, এবার ভাবনা চিন্তার মহড়া করা যাক”। ভল্লা মাঝখানে কিছুটা জায়গা রেখে সকলকে গোল হয়ে ঘিরে বসতে বলল।

    তারপর উঠে গিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে লাগল, গাছের ছোট একটা ডাল দিয়ে। চৌকো ঘর কেটে বলল, “এই হচ্ছে ধর আস্থানের সীমানা। চারপাশেই কাঠের বেড়া আছে – আর দুপাশে আছে আস্থানে ঢোকার দরজা। পশ্চিমে রাজপথের সামনের দরজাটাই প্রধান, সারা দিন-রাত ওখানে কড়া প্রহরা থাকে। রাত্রে ছজন প্রহরী থাকবেই থাকবে। কিন্তু পূবের দরজাটা প্রায় সবসময়েই বন্ধ থাকে। একমাত্র পণ্যবাহী গোযান ঢোকা বা বেরোনোর সময়, ওই দরজা খোলা হয়। রাত্রে ওদিকেও প্রহরী থাকে, কিন্তু কম – খুব বেশি হলে দু-তিনজন। তারাও গভীর রাত্রে অন্ধকার কোনায় বসে ঝিমোয়।

    এবারে লক্ষ্য কর। পূবদিকের দরজা দিয়ে ঢুকে, ডানদিকে রক্ষীদের থাকার জন্যে এই রকম বড়ো বড়ো দুটো ঘর আছে। তার পাশে পশুশালা। সেখানে থাকে বেশ কিছু ঘোড়া, কয়েকটা গাধা আর বলদ, কিছু দুধেল গাইও। তার পরেই কিছুটা জায়গা জুড়ে থাকে করাধ্যক্ষের পালকি, কিছু কাঠের শকট, গোশকট আরও অনেক ধরনের হাবিজবি কাজের দ্রব্য-যন্ত্রপাতি।
    এবার আসছি এই উত্তরদিকে – এখানে পরপর বেশ কিছু ঘর আছে, যেখানে থাকে করণিক আর আস্থানের কর্মচারীরা। তারপরেই এইখানে আছে বিশাল রান্নাঘর, আর তার পাশেই পাচক এবং নানান ভৃত্যদের থাকার জায়গা।

    এবারে চলে আসছি এই পশ্চিমের দিকে। এদিকে আছে কোষাধ্যক্ষ, তার সহকারী কর্মচারী এবং একটু উচ্চপদের কর্মীদের থাকার জায়গা। ওখানে রক্ষীসর্দার উপানুও থাকে। কোষাধ্যক্ষ আর উপানুর ঘরের ঠিক মাঝখানে আছে কোষাগার। এই যে এইখানে একটু জায়গা ছেড়ে আরেকটা পাকশালা আছে এবং তার পাশেই ছোটছোট ঘরে থাকে পাচক ও বিশেষ ভৃত্যরা। এগুলো সবই করাধ্যক্ষ ও অন্য উচ্চপদের আধিকারিকদের জন্যে।

    এবারে আসছি দক্ষিণ দিকে। এদিকে তিনখানা বড়োবড়ো ঘর আছে যেখানে শস্য জমা রাখা হয় – প্রয়োজন মতো ঘরের সামনেই বিশাল দাঁড়ি-পাল্লা খাড়া করা হয়। তাই দেওয়ালের ধারে ধারে রাখা থাকে ভারি ভারি লোহার ওজন। এক থেকে চল্লিশ সেরের। অন্ধকারে চট করে চোখে পড়বে না, কিন্তু পায়ে লেগে হোঁচট খেলেই সর্বনাশ। এই তিনটে শস্যভাণ্ডারের পাশেই – এই দক্ষিণপশ্চিম কোনায় - আছে বন্দীশালা। অবশ্য এই বন্দীশালাতে কবিরাজমশাইকেও রেখেছে কিনা আমি জানি না – সেটা দেখতে হবে। কারণ বন্দীশালায় সাধারণতঃ কর না দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো লোকদেরই শাস্তির জন্যে রাখা হয়।

    এবার আসি মাঝখানের খোলা জায়গাতে। এই যে এইখানে বসানো হয় করাধ্যক্ষের বিশাল শিবির। তার মধ্যেও তিনটে কক্ষ থাকে। একটায় ওঁনার কার্যালয়। এটা সভাকক্ষ – গোপন কথাবার্তার জন্যে। আর অন্যটা ওঁনার শয়ন এবং প্রসাধন কক্ষ। এই শিবিরের চারধারে বুক সমান উঁচু শক্ত বেড়া, তার বাইরে সাজানো ফুল গাছের সারি।

    এই শিবির ছাড়া আস্থানের অন্যান্য সব ঘরই ইঁটের ঘর। অর্থাৎ স্থায়ী। কিন্তু শিবিরটা করাধ্যক্ষের সঙ্গে আসে এবং চলে যায়। করাধ্যক্ষের সঙ্গে অনেক লোকজন যেমন আসে, তাঁর সঙ্গে তারা চলেও যায়। কিন্তু কিছু কিছু লোক সারা বছরই থাকে। আস্থানের দেখাশোনা, টুকটাক কাজকম্ম করে...”।

    ভল্লা কথা শেষ করে বসল, বলল, “নকশাটা মাথার মধ্যে গেঁথে নে। একজায়গায় বসে দেখিস না। ঘুরে ঘুরে দেখ। তাতে দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে কোনটা ডানদিকে কোনটা – মাথার মধ্যে বসে যাবে। দুটো কথা বলে রাখি – আমরা আস্থানে ঢুকব পূবের দরজা দিয়ে কারণ ওদিকের প্রহরা বেশ দুর্বল…। আর করাধ্যক্ষের শিবিরে আমরা ঢোকার চেষ্টাও করব না”।
    ভল্লা চুপ করে বসে ছেলেদের লক্ষ্য করছিল আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ছেলেদের প্রশ্নের। ওরা যদি নকশা দেখে নিয়ে ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ভল্লার এতদিনের পরিশ্রম এবং প্ররোচনার অনেকটাই বৃথা গিয়েছে।

    প্রথম প্রশ্নটা করল, মইলি, “পূবের দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁদিকের ঘরগুলো রক্ষীদের বললে না?”

    সুরুল বলল, ”হুঁ রক্ষীদের। ভল্লাদাদা ওদের ঘরের চালগুলো কি টালির?”

    ভল্লা হাসল, বলল, “হ্যাঁ। কেন পাতার ছাউনি হলে আগুন ধরাতিস? ওকথা ভুলেও ভাবিস না, আগুন লাগলে আস্থানের ওইটুকু জায়গায় এমন হুটোপাটি শুরু হবে – আমাদের আসল কাজই পণ্ড হয়ে যাবে”।

    সুরুল বলল, “রক্ষীগুলোকে শুরুতেই কিছুটা জব্দ করতে পারলে…”

    রামালি বলল, “ঘোড়াগুলোকে দড়ি কেটে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না, ভল্লাদাদা?”

    আহোক বলল, “উঁহু, সেটা শুরুতে করা যাবে না। মাঝ রাত্রে আচমকা ঘোড়ার দল ছুটতে শুরু করলে, তাদের ক্ষুরের শব্দে আস্থানের সকলেই সজাগ হয়ে যাবে। ঘোড়াদের তাড়াতে গেলে আমাদের কাজ সেরে বেরিয়ে আসার ঠিক আগে করতে হবে…”।

    রামালি বলল, “হুঁ ঠিকই বলেছিস। কিন্তু ঘোড়ার সামনে গিয়ে দড়ি কাটবে কে? শুনেছি ওরা ভয় পেলে পেছনের জোড়াপায়ে এমন লাথি ছোঁড়ে - বুকে লাগলে – পাঁজর ভেঙে মৃত্যু অনিবার্য”।

    সুরুল বলল, “আচ্ছা, আস্থানে ঢোকার পর আমরা দু তিনজন গিয়ে সব ঘরের শিকল তুলে দিই যদি… ব্যাটারা থাক না ভেতরে। রাত্রে কজন রক্ষী প্রহরায় থাকবে ভল্লাদা - পনেরজন? সে আমরা সামলে নেব”।

    বিশুন বলল, “বাঃ এটা ভালো বুদ্ধি”।

    ভল্লা মুখে মুচকি হাসি নিয়ে বলল, “তোদের ভাবনা-চিন্তাগুলো বেশ ভালই ঠেকছে। এক কাজ কর – তোদের সবাইকে কালকের পুরো দিনটা সময় দিলাম। পরিকল্পনাটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে চিন্তা কর। কে কোন কাজের দায়িত্ব নিবি সেটাও ঠিক করে ফেল। আজ রাত্রে আমি রামালিকে নিয়ে একটা কাজে যাবো…ফিরবো কাল রাত্রে। আমাদের পরশু সকালে আবার দেখা হবে। তা বলে মহড়ায় যেন এতটুকু ফাঁক না পড়ে। পরশু সন্ধের পর নতুন মহড়া শুরু হবে”।

    “সে কি? অন্ধকারে দেখব কী করে?” দলের চার-পাঁচজন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

    ভল্লা হাসল, বলল, “আলোর জন্যে মশালের ব্যবস্থা করা যাবে। আমরা তো অন্ধকারেই আস্থান আক্রমণ করব, তাই না? আধো অন্ধকারে লক্ষ্যভেদ করাটাও শিখতে হবে না?”
    কেউ কিছু বলল না। ভল্লা একটু পরে বলল, “বিকেল শেষ হতে চলল, এবার তোরা বাড়ি যা। আর মনে রাখিস আজকের এই আলোচনার কথা ভুলেও কারও সঙ্গে আলোচনা করবি না। শল্কুর সঙ্গেও না। মনে থাকবে? যাবার আগে নকশাটা ভালো করে মুছে ফেল”।

    মইলি বলল, “থাক না ভল্লাদাদা। ওটা থাকলে আমাদের আলোচনা করতে সুবিধে হবে তো”।

    ভল্লা বলল, “উঁহু, মুছে ফেলতে হবে। যখন দরকার এঁকে নিবি, কিন্তু আলোচনার শেষে প্রত্যেকবার মুছতেই হবে। আমরা চলে যাবার পর কারো চোখে পড়ে গেলে – এবং সে যদি চতুর হয় – বুঝে ফেলবে সব”।

    মইলি মাথা চুলকে বলল, “মুছে ফেললে, আঁকব কী করে – সবটা কী আর মনে আছে?”

    বিশুন পাতা সমেত গাছের একটা ডাল নিয়ে এসেছিল, সেটা দিয়ে দাগগুলো মুছতে মুছতে বলল, “চিন্তা করিস না, আমার মনে আছে”। “আমারও” একে একে বলল, সুরুল, আহোক এবং আরও দু-একজন।

    ভল্লা খুশি হয়ে হাসল, মইলির কাঁধে হাত রেখে বলল, “এবার বাড়ি যা। পরশু দেখা হবে”।

    রামালি বলল, “ভল্লাদাদা, আমাদের সঙ্গে মইলি, বিশুন আর আহোক যাবে। ভল্লর জন্যে বাঁশের টুকরো গুলো কাটা আছে - নিয়ে যাবো সবাই মিলে”।

    “কাটা হয়ে গেছে? বাঃ, এটা একটা কাজের কাজ হয়েছে”।

    ভল্লারা বাসায় ফিরে দেখল বালিয়া বসে আছে, বসে আছে বটতলির মিলা, জনারাও। জনাদের নিয়ে রণপাগুলো লুকিয়ে রাখার জায়গাটা দেখাতে নিয়ে গেল রামালি। আর ভল্লা তার পাথরের আসনে বসে বলল, “বালিয়া, এসে গেছিস? ভালই হয়েছে। রণপার কাজটা এখন কদিন বন্ধ থাক…তার আগে এই টুকরো বাঁশগুলোর আগায় ফলা বসিয়ে ভল্ল বানিয়ে দে তো চটপট…। কতগুলো আছে রে মইলি?”

    “এখন ছাব্বিশ জোড়া আছে, আর দশ জোড়া হবে… ওগুলো পরে দেব”।

    “ছাব্বিশ জোড়া – মানে বাহান্নটা ফলা, কতদিনে করতে পারবি, বালিয়া?”

    “দিন চারেক”।

    “বাঃ, তারপর রণপার কাজ শুরু করে দিবি, কেমন? তুই আহোক-মইলিদের সঙ্গে যা – বাঁশগুলো নিয়ে যেতে সুবিধে হবে। তোরা একটু বস, আমি আসছি – যাবো আর আসবো”।
    ভল্লা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। একটু পরেই রামালি ফিরে এল, ওদের দেখে বলল, “কী রে তোদের বসিয়ে রেখে ভল্লাদাদা কোথায় গেল?”

    “জানি না। ভল্লাদাদা বলল, যাবো আর আসবো, তোরা বস”। রামালি প্রদীপ জ্বালাল, উনুনের সামনে কাঠকুটো যোগাড় করে রাখল। তারপর মাটিতে বসল ওদের সঙ্গে।

    “কমলিমা কেমন আছে রে, আহোক?”

    “ভালো না। আমি তো যেতে পারিনি। মা আর দিদির মুখে শুনেছি। কেমন যেন হয়ে গেছেন। প্রধানমশাই মারা যাওয়ার পর একবারের জন্যেও কাঁদেননি। ভাবতে পারিস?”
    ভল্লা এসে ঢুকলো, ওদের কথার শেষটুকু শুনে জিজ্ঞাসা করল, “কে কাঁদেনি রে, আহোক?”

    “কমলিমায়ের কথা বলছিলাম, ভল্লাদাদা”। ভল্লা হাতের বটুয়া থেকে চারটে রূপোর মুদ্রা বের করে, বালিয়ার হাতে দিয়ে বলল, “কমলিমা কাঁদবেন, ভাবিস না। তিনি আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছেন। এই চারটে রূপো আপাততঃ রাখ, বালিয়া। লোহার জন্যে কাজ যেন না আটকায়। আর দেখছিস তো, এরা কী রকম লড়ছে… তোরা তাড়াতাড়ি অস্ত্র দিতে না পারলে…আমাদের সব কাজই আটকে যাবে”।

    “জানি ভল্লাদাদা”, বালিয়া বলল।

    চারজনে চার বোঝা বাঁশের টুকরো পিঠে নিয়ে অন্ধকার জঙ্গলে মিশে গেল রণপা চড়ে।

    ওরা চলে যেতে রামালি বলল, “পুকুর থেকে ঘুরে আসছি, ভল্লাদা”।

    “আজ পাঁচজনের রান্না করিস। কাল সকালে আমাদের লাগবে”। রামালি বেরিয়ে গেল - তাকে রান্নার যোগাড় করতে হবে।




    ক্রমশ...




    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৩২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন