গতকাল দুপুরে নোনাপুর এবং সুকরা গ্রামের লোকদের সঙ্গে আস্থানের রক্ষীরা যে ব্যবহার করেছে, তারপরে আজকের ভোরটা ভল্লার কাছে অত্যন্ত সঙ্কটজনক। যদিও গতকাল রাত্রে সে আর রামালি দুই গ্রামেরই কিছু ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে। কিন্তু রাতের গোপন অন্ধকারে বড়ো বড়ো কথা বলা, আর প্রকাশ্য দিবালোকে নিজের নিজের পরিবার - মা-বাবা-ভাই-বোনদের সামনে দিয়ে হেঁটে, ভল্লার কাছে মহড়ায় যোগ দিতে আসার অন্য মাত্রা আছে। তার জন্যে প্রয়োজন প্রচণ্ড ক্রোধ আর ভয়হীন বুকের খাঁচা।
ছেলেদের পরিবার ও প্রতিবেশীদের সকলেই এখন সন্ত্রস্ত। তাদের চোখে-মুখে অসহায় বিপন্নতা। একে তো আস্থানের রক্ষীরা অভিযোগ করেছে, এই গ্রামের ছেলেরাই আস্থানে ডাকাতি করেছে। তিনজন রক্ষীকে মেরে ফেলেছে। তাদের আরও অভিযোগ, এসবই ঘটেছে, রাজার দণ্ড পাওয়া অপরাধী ভল্লার উস্কানিতে। কোন ঘটনা এবং অভিযোগেরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই – সবটাই অনুমান নির্ভর। সেই অনুমানের ভিত্তিতেই গতকাল তারা গ্রামের বয়স্ক মানুষদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। বন্দী করে নিয়ে গেছে সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবিরাজকাকাকে। বীভৎস প্রহারে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে গ্রামপ্রধান জুজাককে। তারপরেও গ্রামের ছেলেরা যদি ভল্লার কাছেই যায় শরীর চর্চা করতে, পরিবার-পরিজনদের এবং প্রতিবেশীদের আতঙ্ক বাড়বে। বাড়বে নিজের নিজের ছেলেদের প্রতি সন্দেহ। যারা বিশ্বাস করত, আমাদের ছেলেরা কোন কুকাজ করতে পারে না। তারাও এবার সন্দিহান হয়ে উঠবে। ছেলেদের এখন লড়তে হবে ঘরে এবং বাইরে। ঘরের লড়াইটাই বেশি কঠিন - স্নেহ-মমতাপ্রবণ পরিবারের সঙ্গে মানসিক লড়াই। তার থেকে বাইরের লড়াইটা অনেক বেশি স্পষ্ট।
নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নোনাপুর গ্রাম থেকে এল চোদ্দজন। আর সুকরা থেকে আটজন। ভল্লা সকলকে বসতে ইশারা করল। সকলে বসার পর ভল্লা বলল, “কী করে এলি তোরা? মা-বাবা, ভাই বোনরা কেউ মানা করল না?”
শল্কু হাসতে হাসতে বলল, “করেনি আবার? আমার মা তো হাতে পায়ে ধরতেই যা বাকি রেখেছেন। বোনদুটো এমন কাঁদছিল বেরোনোর সময়…”।
ভল্লা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে? পারবি? এই বাধা রোজ পেরিয়ে, লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত হতে?”
শল্কু বলল, “ভল্লাদাদা, কে কী করবে আমি জানি না। আমি তো আসবোই। রক্ষীদের নাম শুনলেই, ছোটবেলা থেকে আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদের দেখেছি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে। তোমার এখান থেকে গতকাল ফিরে গিয়ে যা দেখলাম, যা বুঝলাম, রক্ষীরাও ভয় পায়। এতদিন ওদের গায়ে কেউ হাত দেয়নি, ওরা যা খুশি করে গেছে। ওদের গায়ে আমরা একবার হাত তোলাতেই – ওরা ভয়ে দৌড়ে চলে আসছে গ্রামে গ্রামে। অপমান করছে গুরুজনদের। কবিরাজকাকাকে ধরে নিয়ে গেল...তিনি কি আমাদের ডাকাতি করতে শিখিয়েছেন? নাকি ডাকাতি করতে আমাদের উস্কেছেন? আসলে এবার ওরাও ভয় পেয়েছে। ভয় পেয়েছে ভল্লাকে। ভয় পেয়েছে ভল্লার দলকে। আমরা যদি ভয়ে সিঁটিয়ে আবার গিয়ে মায়ের আঁচলের তলায় ঢুকি, ওরা তো আমাদের সকলের ঘাড়ে বসে হাগবে, ভল্লাদাদা! যে পথে আমরা এগিয়েছি...সেখান থেকে আমি অন্ততঃ ফিরে আসবো না, ভল্লাদাদা। হয়তো মরবো, কিন্তু মরার আগে ওদের টের পাইয়ে দিয়ে মরবো”।
ভল্লা লক্ষ্য রাখছিল, শল্কু্র কথাগুলো বাকি সবাই মন দিয়ে শুনছে। তাদের মনে হয়তো কিছু দ্বিধা ছিল, সেটা ফিকে হয়ে উঠছে শল্কুর প্রত্যয়ী কথায়। তাদের চোয়াল শক্ত হচ্ছে, তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাতের শিরা ফুলে উঠছে। তাদের চোখে ফুটে উঠছে ক্রোধ।
ভল্লা সবাইকে ভাবতে একটু সময় দিল, তারপর বলল, “তোরাও কি শল্কুর সঙ্গে একমত? মনে কোন ভয় বা দ্বিধা নেই তো?”
ছেলেরা প্রায় একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “তুমি আমাদের লড়তে শেখাও, ভল্লাদাদা। আমরা লড়বো”।
ভল্লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বেশ। আমি শেখাবো। নিজে হাতে ধরেই শেখাবো। কিন্তু তার আগে শপথ নিতে হবে, আমাদের মধ্যে কেউ কোনদিন বিশ্বাস ভাঙবে না। প্রাণ দিতে হলেও না। একটা কথা মনে রাখিস – তোদের এই ভল্লাদাদাও কম নিষ্ঠুর নয়। চাপে পড়ে বা ভয়ে কেউ যদি রাজসাক্ষী হয়েছিস – কিংবা আমাদের কথা এই দলের বাইরের কাউকে বলেছিস, অন্য কেউ নয় - আমার হাতেই তার মৃত্যু হবে। রাজি?”
“রাজি”! সকলের সমবেত চিৎকার, জঙ্গলের মধ্যে গর্জনের মতো শোনালো।
ভল্লা সুকরা গ্রামের সুরুলকে বলল, “সুরুল, গতকাল রাত্রে তোর সঙ্গে কথা বলার সময়, তোর মধ্যে যে জেদ আর রাগ দেখেছিলাম, সেটা কি এখনো আছে? নাকি একটু ভয় ভয় করছে”?
সুরুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভীলককাকার মতো মানুষকে গতকাল ওরা যেভাবে অকারণ আঘাত করল, তার শোধ তো আমি তুলবই, ভল্লাদাদা। আমাদের সকলের মনের জোর আছে ভল্লাদাদা, কিন্তু রক্ষীদের সঙ্গে লড়ার দক্ষতা নেই...তুমি আমাদের শেখাও ভল্লাদাদা।
“তবে, মনে রাখিস, লড়াই শিখতে গেলে জরুরি হচ্ছে, ধৈর্য আর জেদ। এ দুটো যার যত বেশী, সে শিখবে তত তাড়াতাড়ি। চল, তাহলে এখনই শুরু করা যাক”।
ভল্লা রামালিকে বলল, “রামালি, আমাদের রণপাগুলো বের কর। আজ রণপার খেলা শেখাই সবাইকে”। রামালি দুজোড়া রণপা এনে ভল্লার হাতে দিল। ভল্লা একজোড়া রেখে অন্য জোড়াটা দিল রামালিকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “বাঁশের এই লাঠি দুটোয় চড়ে আমরা আজ হাঁটতে শিখব। আমাদের ঘোড়া নেই...ঘোড়ার বদলে আমাদের আছে রণপা। এই রণপা শুধু যে আমাদের পা দুটোকে লম্বা করে দেবে তাই নয়, প্রয়োজনে এই রণপা আমাদের অস্ত্রও হয়ে উটবে। এই লাঠির আঘাতে শত্রুর মাথাও ফাটানো যাবে অনায়াসে। কাজেই রণপা বড়ো কাজের জিনিষ। এখন আমি আর রামালি তোদের দেখাব – কীভাবে এতে চড়তে হয়, কীভাবে হাঁটতে হয়। পরে অভ্যাস হয়ে গেলে দৌড়তেও হবে”।
ভল্লা এবং রামালি দুজনেই রণপায়ে চড়ল। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে দেখাল সবাইকে। আহোক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুই কী করে শিখলি, রামালি?” রামালি স্বচ্ছন্দে হাঁটাহাঁটি করতে করতে বলল, “গতকাল ভোরে ভল্লাদাদা শেখাল। কাল সারাদিনে হাঁটতে শিখেছি...এবার দৌড়তেও শিখব”।
ভল্লা বলল, “তোরা অনেকেই জানিস, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র কোথায় লুকোনো আছে...চল সবাই ওদিকে যাই...ওখান থেকে রণপা নিয়ে এখনই মহড়া শুরু করব। রামালি তুই আস্তে আস্তে ওদের নিয়ে আয়, আমি এগিয়ে যাচ্ছি”।
পলক ফেলার আগেই রণপা চড়ে ভল্লা যেন উধাও হয়ে গেল জঙ্গলের ভেতর। দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠল উপস্থিত ছেলেরা। শুধু একজোড়া লাঠি নিয়েই এত দ্রুত চলাফেরা করা যায়? তাও এই জঙ্গলের রাস্তায়? রামালি ওদের পাশে রণপায় হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, “শল্কু, কাকার কী অবস্থারে?”
শল্কু খুব মন দিয়ে রামালির হাঁটা দেখতে দেখতে বলল, “আজ ভোরে শুনলাম একটু ভাল আছেন। উঠে বসেছেন। তবে তোর কাকি একদম চুপ মেরে গেছে, জানিস তো? চাইলে তুই আবার ফিরে আসতে পারিস। মনে হয় না, তোর ওপর কাকি আর কোন চোটপাট চালাবে।”
রামালি হেসে বলল, “ধূর কী হবে, কাকার সংসারের বোঝা হয়ে থেকে? আমাকে কিছু না বললেও, কাকাকে ছেড়ে দেবে? এই ভালো – ছোটবেলা থেকে বহু সহ্য করেছি... খুব ভয়ে ভয়ে বড়ো হয়েছি। আর না...এবার বাঁচবো...তার জন্যে যদি মরতে হয়...তাও। মরার আগে এটুকু অন্ততঃ জেনে যাবো... বসে বসে মার খাইনি, চেষ্টা করেছিলাম...”!
সুরুল জিজ্ঞাসা করল, “কাল তোমাদের গাঁয়ে এসে রক্ষীরা কী করেছে, শল্কুদাদা?”
শল্কু বলল, “গ্রামে এসেই তো শুয়োরের বাচ্চারা যাকে সামনে পেয়েছে চাবুক মেরেছে। কেউ কেউ তো আবার বল্লমের বাঁট দিয়ে এলোপাথাড়ি পিটিয়েছে। বাচ্চা, বুড়ো, মেয়েছেলে কাউকে ছাড়েনি। ভাবলেই মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল, কার কার বাড়িতে ডাকাতির মাল রাখা আছে...বার করে দে...নয়তো আগুন ধরিয়ে দেব সব কটা বাড়িতে। সেই সময় বাইরে বেরিয়ে এলেন কবিরাজকাকা। আর পৌঁছুলেন গ্রামপ্রধান জুজাককাকা...”।
আহোক বলল, “ভল্লাদাদা আমাদের গাঁয়ে ঢুকতে মানা করেছিল। আমরা থাকলে, ভয়ংকর কাণ্ড হয়ে যেত। আমার ছোটকাকার কাছে শুনলাম, প্রধানমশাই ওদের সামনে গিয়ে, বলার মধ্যে বলেছিলেন, “আমি এই গ্রামের প্রধান, আপনাদের কোন অভিযোগ থাকলে, আমাকে বলুন...যাকে তাকে সবাইকে এভাবে আপনারা মারতে পারেন না...দেশে কি রাজা নেই নাকি? এটা কি অরাজক দেশ?” ব্যস্, আর যায় কোথায়, গুয়োর ব্যাটারা শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রধানমশাইয়ের ওপর। কী মার কী মার। বল্লমের বাঁট, লাথি, চড় ঘুঁষি। কবিরাজকাকা গ্রাম প্রধানকে বাঁচাতে গিয়েছিল, তাকেও বেধড়ক মারল। লাথি মেরে ফেলে দিল মাটিতে।
এই সময়েই বেরিয়ে এসেছিল রামালির কাকি। গলার শির ফুলিয়ে নাকি চেঁচাচ্ছিল, “ওদের মারছো কেন? ওরা কী করেছে? ডাকাতি তো করেছে, বাপ-মা খেগো রামালি আর ওই আঁটকুড়ির বেটা ভল্লা। তাদেরকে ধরো না। ওদের কাছেই পেয়ে যাবে সব লুঠের মাল। এ গাঁয়ে কোন বাড়িতে কিচ্ছু নেই।
রামালির কাকির চিৎকারে রক্ষীরা একটু থমকে গিয়েছিল। না হলে গ্রামপ্রধান কালকেই শেষ হয়ে যেত। অকথ্য গালাগাল দিয়ে রক্ষীদের সর্দার বলল, এই রামালিটা আবার কোন বেজন্মা? রামালির কাকা গিয়েছিল, বউকে সামলাতে, সে বলল, আজ্ঞে আমার দাদার ছেলে, আমরা গতকালই ঝ্যাঁটা মেরে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। এবার শুরু হল রামালির কাকার ওপরে মার...শুয়োরের বাচ্চা, কে তোদের তাকে তাড়াতে বলেছে? সে এখন কোথায়? কাকাকে বাঁচাতে, কাকি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সে আর এই গ্রামে নেই... হাভেতে ভল্লার সঙ্গে গিয়ে জুটেছে।
রক্ষীরা যখন রামালির কাকা আর কাকিকে নিয়ে ব্যস্ত, ওদিকে প্রধানমশাইয়ের তখন জ্ঞান নেই, মাটিতে পড়ে আছেন মড়ার মতো। কবিরাজকাকা ধুলো থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে গেলেন প্রধানমশাইয়ের কাছে, ওখানেই তিনি নাড়ি পরীক্ষা করে দেখছিলেন প্রধানমশাই বেঁচে আছে, না মরে গেছে। রক্ষীসর্দারের চোখ শালা শকুনের মতো, ঠিক দেখেছে। রাক্ষসটা কবিরাজকাকার কাছে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে তাকে ওঠাল, বলল, অ তুই বুঝি সেই কবিরাজ? আশপাশের গাঁগুলোতে তোর কথাও তো খুব শুনেছি...তুইই শালা সবাইকে খেপাচ্ছিস। ঢ্যামনা ঢকঢকে বুড়ো তুই আমাদের সঙ্গে চল...তোর পেটে পা দিলেই, ভড়ভড় করে বেরিয়ে আসবে গোপন সব কথা।
লোকটা কবিরাজকাকাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গেল রামালির বাড়ির সামনে। প্রধানমশাইয়ের রক্তাক্ত দেহটা পড়ে রইল মাঠেই। রামালির বাড়ি তছনছ করে কী খুঁজল, দেখল কে জানে। যাবার সময় রামালির কাকাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে গেল ওদের উঠোনে। তারপর বাইরে এসে সকলে ঘোড়ায় চড়ল, কবিরাজকাকার দুই হাত আর কোমরে দড়ি বাঁধল। রওনা হওয়ার আগে গাঁয়ের সবাইকে শাসিয়ে গেল, ভল্লা আর রামালিকে যদি না পায়, ওরা আবার আসবে। ঘোড়া ছুটিয়ে ওরা বেরিয়ে গেল। কবিরাজকাকার পা দুটো ঘষটাতে লাগল মাটিতে, ঠোক্কর খেতে লাগল, পথের ধারের পাথরে, ঝোপঝাড়ে”।
আহোক বর্ণনা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। আহোক আবার বলল, “আমি বাড়িতে ফিরে এইসব ঘটনার কথা যখন শুনছি, সবাই ছিল সামনে - বাবা, জ্যাঠা, অন্য কাকারা...মা কাকিমারা...ভাইবোনগুলোও...আমি বললাম গাঁয়ের এতগুলো মানুষ রয়েছো – কেউ বেরিয়ে গিয়ে কোন প্রতিবাদ করলে না? জ্যাঠা গম্ভীর গলায় বলল, জুজাক তো গিয়েছিল। কবিরাজদাদাও গিয়েছিল...ওদের কী হয়েছে সবই তো শুনলি...আমরা গেলেও একই দশা হত...কী আর বলবো...বয়স্ক গুরুজন... রাজরক্ষীদের ভয়ে এরা কোনদিন মাথা তুলে বাঁচতেই শেখে নি...”
সুরুল বলল, “এসব দেখে শুনেও আমাদের রক্ত যদি গরম না হয়...যদি এর শোধ না নিই...রক্তখেকো রক্ষীদের যদি এখনই উচিৎ শিক্ষা না দিই...তাহলে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না, আহোকদাদা...রোজ রোজ তিলে তিলে মরার থেকে...ওদের অন্ততঃ একজনকে মেরে যদি মরি...সেটাই হবে প্রকৃত বাঁচা...”।
তেইশজন ছোকরা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলল গভীর জঙ্গলের পথে।
- - - -
সেদিন সন্ধের একটু পরে, ভল্লা ঘরের বাইরে বসেছিল, রামালি পুকুরে গিয়েছিল জল আনতে। হঠাৎই চার-পাঁচজন মানুষের পায়ের শব্দে ভল্লা সতর্ক হয়ে উঠল। যে পাথরে সে সাধারণতঃ বসে, তার ঠিক পিছনের দিকে মাটির কাছাকাছি একটা বড়ো খোঁদলের মধ্যে রাখা আছে ছোট্ট একটা ভল্ল। খোঁদলের মুখে ঘন ঝোপ-ঝাড়ের জন্যে সহজে তার সন্ধান পাওয়া যায় না। ভল্লা হাত বাড়িয়ে ভল্লটা ধরে থাকল। কে হতে পারে লোকগুলো? এই সন্ধেয় তাদের কী দরকার? একটু পরেই ঝোপের ওধার থেকে কেউ ডাকল, “ভল্লামশাই, রয়েছেন নাকি? আমি বণিক অহিদত্ত”।
কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে, অস্ত্রটা কোমরে গুঁজে ভল্লা উঠে দাঁড়াল, বলল, “বণিকমশাই, ওদিকে নয়, আপনি বাঁদিক দিয়ে ঘুরে আসুন। অনেকদিন পর, কী ব্যাপার?”
অহিদত্ত উঠোনে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, বললেন, “এই তাহলে আপনার নির্বাসনের বাসা?”
ভল্লা কিছু বলল না, হাসল।
“আপনার সঙ্গে কিছু গভীর কথা ছিল। এখানে কি নিরাপদ? তাছাড়া আমার সঙ্গে চারজন রক্ষীও রয়েছে...”।
এই সময়েই রামালি কলসিতে জল ভরে ফিরে এল। উঠোনে অপরিচিত লোকটিকে দেখে একটু অবাক হল। ঘরে ঢুকে চর্বির প্রদীপ জ্বালিয়ে বাইরে আনতে, ভল্লা বলল, “রামালি, ইনি অহিদত্ত। বিখ্যাত বণিক। তুই এখন রান্নাবান্না করবি তো? আমি ওঁনার সঙ্গে দণ্ড দুয়ের জন্যে ঘুরে আসছি। বণিকমশাই এই ছেলেটিকে চিনে রাখুন, রামালি। আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমার সঙ্গেই থাকে। আপনার রক্ষীদের বলুন, তারা এখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুক। চলুন, আমরা ঘুরে আসি”।
জঙ্গলের মধ্যে বেশ কিছুটা গিয়ে ভল্লা অহিদত্তকে নিয়ে ফাঁকা একটা জায়গায় বসল। আশপাশে ছোটছোট ঝোপ ঝাড়, কাছাকাছি কোন বড় গাছ নেই। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা কেউ শুনবে, সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
“বাঃ জায়গাটা বেশ বেছেছেন তো! চারদিকের জঙ্গল থেকে ঝিঁঝির যা আওয়াজ আসছে...এমনিতেই কিছু শোনা যাবে না...”।
ভল্লা হাসল, বলল, “কী সংবাদ বলুন। তার আগে আমার একটা অনুরোধ আছে, রাখতে হবে”।
“কী অনুরোধ?”
“আপনাদের ওদিক থেকে ভালো কোন কবিরাজকে পাঠাতে পারবেন?”
“প্রধানমশাইয়ের চিকিৎসার জন্যে?”
“শুনেছেন?”
“বাঃ শুনব না? কালকে দুপুরে আস্থানের রক্ষীরা নোনাপুর আর সুকরা গ্রামে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, সে খবর তো দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভল্লামশাই। প্রধানমশাইকে যাচ্ছেতাই মেরেছে। কবিরাজমশাইকে বন্দী করে নিয়ে গেছে। সুকরার ভীলকদাদাকেও বিচ্ছিরি মেরেছে কোন কারণ ছাড়াই। আস্থানের রক্ষীদের ভয়ে সহজে কেউ আসতে চাইবে না হয়তো। তবু আমি পাঠিয়ে দেব, কাল সকালেই, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন”।
“প্রধানমশাই ছাড়াও, রামালির কাকাকে একবার দেখতে হবে। আর সুকরার ভীলককাকাকেও...”।
“রামালি? যার সঙ্গে আপনি এই মাত্র পরিচয় করিয়ে দিলেন?”
“হ্যাঁ ওর কাকা। ওঁনার অবস্থা ততটা সঙ্গীন নয়, তবুও আপনাদের কবিরাজমশাই যাচ্ছেন যখন একবার দেখে এলে ভাল হয়”।
“ঠিক আছে, হয়ে যাবে। আর কিছু?”
ভল্লা হাসল, বলল, “নাঃ আর কিছু না। এবার কাজের কথা বলুন”।
অহিদত্ত মুচকি হেসে বললেন, “আপনি এদিকের পরিস্থিতি যে ভাবে পাকিয়ে তুলেছেন, তাতে আপনার অনেক অস্ত্রশস্ত্র লাগবে তো?”
ভল্লাও হাসল, বলল, “শুধু এদিকের না, আপনাদের দিকের ছেলেরাও অস্ত্র কিনতে চাইছে...আমার কাছে ওরা তিন-চারদিনের মধ্যেই আসবে পাকা কথা শোনার জন্যে”।
“আমাদের দিকের ছেলেরা? কী বলছেন, ভল্লামশাই?”
“আপনাদের রাজা নাকি, প্রজাদের মঙ্গলের জন্যে রাস্তা-ঘাট না বানিয়ে, সেচব্যবস্থা না করে, গ্রামে গ্রামে মন্দির বানিয়ে চলেছেন?”
“হুঁ, তা চলেছেন। আর সে মন্দির বানানোর কাজ পাচ্ছে রাজধানীর জনা তিনেক বড়োবড়ো শ্রেষ্ঠী। ব্যাটারা একএকজন টাকার কুমীর। রাজ্যের ছোট-বড়ো সমস্ত আধিকারিকদের সঙ্গে জোটপাট করে, রাজ্যের সবদিকে তারা অজস্র মন্দির বানিয়ে চলেছে। কিন্তু তার সঙ্গে গ্রামের সাধারণ ছেলেদের কী সম্পর্ক?”
“তারা নিজেদের আর আশেপাশের গ্রামের ওই দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকদের জব্দ করতে চাইছে। তার জন্যে ওদের অস্ত্র চাই”।
অহিদত্ত বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “আপনি কি জানেন, আপনাদের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে পুরোনো অস্ত্র কেনার একটা দায়িত্ব আমি পেয়েছি? সে অস্ত্র আপনি আমার থেকেই পাবেন, এদিককার আন্দোলনের জন্যে। কিন্তু আমাদের রাজ্যের ছেলেদের...না ভল্লামশাই, আমাদের রাজ্যের ছেলেদের অস্ত্র দিলে আমি ভয়ানক বিপদে পড়ে যাবো। আমাদের রাজধানীতে এই খবর একবার পৌঁছলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী বণিকরা আমার পিছনে লাগার দারুণ সুযোগ পেয়ে যাবে। আধিকারিকদের সঙ্গে মিলে আমার ভিটেমাটি চাঁটি করে দেবে...”।
“তাহলে? ওরা অস্ত্র পাবে না?”
“পাবে না কেন? আপনি ওদের দেবেন। আমি দেব আপনাকে। তাতে সবারই শুভ লাভ হবে”।
“শুভ লাভ?”
“বুঝলেন না? ধরুন আমি আপনাকে কিছু অস্ত্র দিলাম এক টাকার বিনিময়ে। আপনি ওদের দেবেন, সোয়া দুটাকা কিংবা আড়াই টাকা দরে। এক টাকায় আপনি আমার দেনা শোধ করে দেওয়ার পরেও, আপনার হাতে থাকবে দেড়টাকা। আপনাদের খরচ-খরচা, আর ভবিষ্যতের সঞ্চয়। আপনার দল বাড়লে তার খরচও তো বাড়বে ভল্লামশাই”।
“কিন্তু আপনাদের ছেলেরা কতদিন আর অস্ত্র কিনবে, কতটুকুই বা কিনবে?”
বণিক অহিদত্ত অদ্ভূতভাবে হাসলেন, বললেন, “আমি আপনাদের রাজধানীতেই অতি বিচক্ষণ একজন মানুষের কাছে, কিছুদিন আগেই, একটা কথা শুনলাম। সেটাই আপনাকে বলি। আপনি আমার থেকেও অনেক বেশী প্রত্যক্ষদর্শী, বিচক্ষণ। ওঁনার কথাগুলোর মর্ম আপনি আমার থেকেও ভালো ধরতে পারবেন।
উনি বলছিলেন, ক্ষমতার মতো দুর্ধর্ষ নেশা আর হয় না। তার তুলনায় অর্থ, মদ, গাঁজা, চরস, ভাঙ, নারীর যৌবন কিস্সু না। একবার যদি কেউ এই ক্ষমতার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে, তার ফিরে আসার সব পথ বন্ধ। এই ক্ষমতা সে কিভাবে অর্জন করতে পারে? প্রথমে ছোট করেই শুরু হবে...কিছু সাঙ্গোপাঙ্গ জোটাবে, ছোটখাটো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে খুচখাচ কিছু চুরি, ডাকাতি করবে...কিছু অর্থ উপার্জন করবে। সেই অর্থ দিয়ে তারা আরো অস্ত্রশস্ত্র কিনবে, আরও বড়ো বড়ো ডাকাতি করবে। তার ক্রিয়াকলাপে আকৃষ্ট হয়ে আরো অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ এসে জুটবে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে তার ক্ষমতার চারাগাছটি – মহীরূহে পরিণত হবে...। ব্যস্, এই পরিস্থিতিতে তার কাছে সব আছে... ক্ষমতা, অর্থ, লোকবল। এখন সে একটা ছোট্ট অঞ্চলের রাজাই বলা চলে।
কোন রাজার পক্ষেই রাজ্যের আপামর জনসাধারণকে সমভাবে তুষ্ট রাখা অসম্ভব। তার কারণ প্রশাসনের গাফিলতি থাকতে পারে। তার কারণ আঞ্চলিক পরিবেশ – মানে কোথাও সুজলা, সুফলা উর্বর, আবার কোথাও রুক্ষ, ঊষর – হতে পারে। কোথাও প্রচুর খনিজ সম্পদ, আমাদের এদিকে যেমন সবই ঢুঢু। সমুদ্র উপকূলবর্তী এবং নদীবহুল অঞ্চলে বাণিজ্যের যেমন সহজ প্রসার হয়, আমাদের এই অঞ্চলে দেখুন, সে সম্ভাবনাও অপ্রতুল। অতএব নানান কারণে কোন কোন অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের বঞ্চনার শিকার মনে করে ক্ষুব্ধ হতে থাকে।
সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ওই আঞ্চলিক রাজা এবার মূল প্রশাসনের সমান্তরালে, জনদরদী এক আঞ্চলিক প্রশাসন গড়ে তুলতে শুরু করে। এদের ঘনিষ্ঠ সাঙ্গোপাঙ্গোরা হয়ে ওঠে ওই প্রশাসনের আধিকারিক। ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী জনগণ হয় এদের অনুগামী সমর্থক। তখন কিন্তু ওরা আর ডাকাত নয়, নিজেদের পরিচয় দেয় বিদ্রোহী, বিপ্লবী কিংবা সমাজ-সংস্কারক। উল্টোদিকে মূল রাষ্ট্র এবং প্রশাসন, তাদের নাম দেয় বিচ্ছিন্নতাকামী, সন্ত্রাসবাদী – রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নাশক পরজীবী গোষ্ঠী।
এবার সে রাজ্যের রাজার সঙ্গেই বিপ্লবে নামতে পারে। সরাসরি বিচ্ছিন্ন কিছু যুদ্ধেও নামতে পারে। আর সে রাজ্যের রাজা যদি সাধারণ প্রজাদের অপছন্দের রাজা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। দেখা যাবে, ধীরে ধীরে সে রাজাকেই পরাস্ত এবং হত্যা করে – রাজ্যের অধীশ্বরও হয়ে উঠতে পারে। অবিশ্যি সবাই যে অতদূর যেতে পারবে, তা নয়, ক্বচিৎ দু একজনই পারে। আপনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাম শুনেছেন?”
ভল্লা মাথা নাড়ল, না।
“আমিও শুনিনি। উনি কোন এক সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের নাম বললেন। তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, নাম চাণক্য। বহু যুগ আগে দুজনে মিলে পরাক্রমশালী নন্দবংশের সম্রাটকে পরাস্ত করে মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন”।
“তিনি তো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই করেছিলেন। তিনি বিদ্রোহী হতে পারেন, কিন্তু ডাকাত হতে যাবেন কেন?”
“আমিও একই প্রশ্ন করেছিলাম, ভল্লামশাই। তিনি উত্তরে বললেন, ইতিহাসে তিনি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত নামেই প্রসিদ্ধ। শুরুর দিকে, যখন তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক চন্দ্রগুপ্ত মাত্র, যখন নন্দ-সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী কিছু কিছু অঞ্চল তিনি নিজের আয়ত্তে আনছিলেন, রাজধানীতে নন্দরাজার সেনাপ্রধানরা, তাঁকে ডাকাতই মনে করেছিল। তারা ভাবত, হতভাগা ডাকাতটাকে, একবার ধরতে পারলে শূলে চড়াবো। সেনাপ্রধানদের সে স্বপ্ন অবশ্য পূর্ণ হয়নি।
ওসব বড়ো বড়ো কথা ছেড়েই দিন ভল্লামশাই। এখানেই দেখুন না, প্রশাসন আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে, রাজার বিরুদ্ধে কিছু বিদ্রোহ বানিয়ে তোলার জন্যে। আপনার ছেলেরা সবাই ভাবছে তারা বিদ্রোহ করছে। কিন্তু আপনার প্রশাসন গতকাল গ্রামে গিয়ে, বিদ্রোহের নয় - ডাকাতির তদন্ত করেছে। গ্রামের বয়স্ক মানুষদের পীড়ন করেছে, ভয় দেখিয়েছে, যাতে তারা এই ধরনের ডাকাতি ভবিষ্যতে আর না করে।
অতএব, কে কি নামে ওদের ডাকল, তাতে কিছু এসে যায় না, ভল্লামশাই। আসল কথাটা হল, ক্ষমতার নেশায় মজে থাকা এই গোষ্ঠীগুলির, নিয়মিত অস্ত্রের সরবরাহ না পেলে চলবে কী করে ভল্লামশাই? ও নিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন”।
ভল্লা চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, “ঠিক কবে থেকে আপনি অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবেন?”
“রাজধানী থেকে গত পরশু রওনা হয়েছে। আপাততঃ চারটি গোশকটে। আশা করি দিন দশেকের মধ্যে আস্থানে পৌঁছে যাবে”।
ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “অস্ত্র-শস্ত্রের মূল্য কী রকম ধরছেন?”
অহিদত্ত হেসে বললেন, “আমি কে মশাই? মূল্য তো আপনি ঠিক করে দেবেন। শষ্পকমশাই নির্দিষ্ট দিনে তাঁর লোক পাঠাবেন...আমিও থাকব...সকলে মিলে বসে মূল্য ঠিক করা যাবে।
কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেল ভল্লামশাই – আমি আজ উঠি – অনেকটা পথ যেতে হবে...। রাজধানীর অস্ত্র কাছাকাছি পৌঁছলেই আমি আবার আসব...”।
ভল্লা উঠে দাঁড়াল, বলল, “হ্যাঁ চলুন এগোনো যাক – ভয়ংকর এক বিদ্রোহের দিকে...”।
অহিদত্ত ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেসে বললেন, “নাঃ, সে এখনও দেরি আছে। আপাততঃ আপনার বাসার দিকেই যাওয়া যাক...”।
ক্রমশ...