ভল্লা নালার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছোল বাঁধের কাছে। প্রভাত সুর্যের আলো তখন সবে ছড়িয়ে পড়ছে গাছের পাতায় পাতায়। বাঁধের উঁচু পাড়ে উঠে ভল্লা চারদিকে তাকাল। এই বাঁধের বাঁদিকে নোনাপুর গ্রাম। আর ডানদিকে সুকরা। এই নালাই এতদিন ছিল দুই গ্রামের সীমানা। যখন থেকে ভল্লা এই নালায় বাঁধ বানানোর তোড়জোড় শুরু করেছে, দুই গ্রামের লোকজন কৌতূহলী হয়েছে। ভল্লার কথায় তারা বুঝেছে, এই বাঁধের জলে গ্রামের পুরো ক্ষেত না হোক কিছু কিছু জমিতে সারা বছর চাষবাস করা সম্ভব। সেই থেকে তারা ভল্লার সঙ্গে মেতে উঠেছে, তাকে সর্বতো সাহায্য করেছে, বাঁধ নির্মাণে। দুপক্ষই উৎসাহী হয়ে নালার দুপাশের অনাবাদী বেশ কিছু জমিকে আবাদযোগ্য করে তুলেছে। সরু সরু শিরার মতো নালা কেটে তারা দুপাশের জমিতে চারিয়ে নিয়েছে বাঁধের জল। বপন করেছে বাদাম ও তুলোর বীজ। বিগত পনের-বিশ দিনে সে বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়ে সবুজ হয়ে উঠেছে বিস্তীর্ণ কয়েকটি মাঠ।
একধরনের নেশা আছে সবুজ রঙে। বিশেষ করে সে সবুজ যদি হয় সম্ভাব্য শস্যের স্বপ্ন। সে স্বপ্নে চাষীরা বিভোর হয়ে থাকেন। সারাদিন মাঠের কাজ সেরে, বাড়িতে গিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। রাত্রে ঘুম ভেঙে বারবার উঠে বসেন। জঙ্গলের ইঁদুর, খরগোশ, শজারুরা রাত্রেই খাবারের সন্ধানে বের হয়। চারাগাছ উপড়ে বীজ খেয়ে তারা যদি শস্যের সর্বনাশ করে? যতদিন না গাছগুলি স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, ততদিন এই দুশ্চিন্তা।
ভল্লাকে দেখে সুকরা গাঁয়ের বয়স্ক চাষী ভীলককাকা একগাল হেসে বললেন, “গতকাল রাত্রে গাঁয়ের ছোকরারা সব রামকথা শুনতে গিয়েছিল। তুই যাসনি, বেটা?”
ভল্লা হাসল, বলল, “ইচ্ছে তো ছিল, কাকা। রামকথা শুনতে অনেক ধরনের লোক যায় – আমাকে চিনে ফেললে, বিপদে পড়ে যাব। সেই ভয়ে যাইনি। এই যে তোমাদের এখানে এসেছি, ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে…কেউ দেখে ফেললেই বিপদ”।
ভীলককাকা বললেন, “হুঁ। তার মানে তুই জানিস না। নোনাপুরের এক ছোকরাকে কাল রাতে সাপ কামড়েছে!”
“সাপে কেটেছে? কই শুনিনি তো! কাকে কেটেছে জানো, কাকা?”
“হানোকে। ডাকাবুকো তাজা ছেলেটা – এভাবে মারা যাবে - ভাবা যায় না”।
“হানো? কী বলছো, কাকা? সেই জন্যেই আজ ভোরে কেউ আসেনি আমার কাছে। ভাবলাম, পালাগান শুনে হয়তো শেষ রাত্রে বাড়ি ফিরে সব ঘুমোচ্ছে...। কিন্তু...কিন্তু আমার এখন কী করা উচিৎ, কাকা? আমার যে একবার হানোর বাড়িতে যাওয়া খুব দরকার। ছেলেটা আমাকে এত ভালোবাসত – যা বলতাম সব শুনত - দারুণ কাজের ছেলে”।
ভীলককাকা বললেন, “সবই বুঝছি, ভল্লা। কিন্তু এসময় তোকে গাঁয়ে দেখলে, সকলেরই বিপদ বাড়বে। শত্রুর তো আর শেষ নেই গ্রামে”।
ভল্লা চিন্তাগ্রস্ত মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা ঠিক”। কোন কথা না বলে নোনাপুর গ্রামের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর গভীর অবসন্ন গলায় বলল, “আমি নোনাপুর গ্রামে আসার পর থেকেই নানান অঘটন ঘটে চলেছে, কাকা। আমার মনে হয় এই অঞ্চল ছেড়ে আরও দূরে কোথাও আমার চলে যাওয়া উচিৎ”।
ভীলককাকা বললেন, “অঘটন? অঘটন আবার কী ঘটল?”
অন্যমনস্ক ভল্লা বলল, “ওই যে, রাজকর্মচারী শষ্পক গ্রামপ্রধানকে অপমান করল। গ্রামপ্রধান কর আদায়ে কিছুটা ছাড়ের জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। শুনলাম শষ্পক এককথায় তাঁর সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। আমাকে নিয়েও কি কম কথা শুনিয়েছে, বয়স্ক সম্মানীয় গ্রামপ্রধানকে। যাচ্ছেতাই, সে সময় আমি তো ছিলাম সামনে, সব শুনেছি। সে সব কথা কানে শোনাও পাপ। এখন আবার হানোটা এভাবে অপঘাতে চলে গেল...না কাকা, এ অঞ্চলে আর নয়”।
ভীলককাকা সান্ত্বনার সুরে বললেন, “বুঝতে পারছি, হানোর এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা তোর বুকে বড়ো বাজছে। কিন্তু এসবের জন্যে তুই নিজেকে দুষছিস কেন? তুই কী করবি? জ্ঞান হয়ে থেকে রাজকর্মচারীদের ঔদ্ধত্য আর অপমানের কথা আমরা শুনে আসছি, আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদের থেকে। ও সব আমাদের কাছে নতুন নাকি? আর সাপে কামড়ানোর কথা বলছিস? আশেপাশের চার-পাঁচখানা গাঁয়ে খোঁজ নিয়ে দেখ। ছেলে-ছোকরা, ব্যাটাছেলে বা মেয়েছেলেদের মধ্যে দু-একজনের অপঘাত মৃত্যু হয়নি – এমন একটা বছর আমাকে দেখা তো। সাপেকাটা, জলে ডোবা, গলায় দড়ি... একটা না একটা অপঘাত মৃত্যু লেগেই আছে প্রতি বছর। এই তো গত বছর, একটু মেঘ করে – চটাপট এমন শিলাবৃষ্টি হল, আমাদের গাঁয়ের রাখাল কালডি মারা গেল ফাঁকা মাঠের মাঝখানে। সঙ্গে মরল চারটে ছাগল। এসবই আমাদের জীবনের অঙ্গ রে ভল্লা, তোর থাকা না থাকায় কী আসে যায়? তোর কমলিমা আর গ্রামপ্রধান জুজাকের দুটি ছেলেই যে সাপের কামড়ে মারা গেছিল – সে কথা শুনিসনি?”
বাঁধের ওপর ভীলককাকা আর ভল্লা দুজনেই চুপ করে পাশাপাশি বসে রইল অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ পর ভীলককাকা আবার বললেন, “তুই এসে এই যে নালার মধ্যে বাঁধ গড়ার বুদ্ধি দিলি। তোর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে আমরা সেই বাঁধ বানালাম। আমাদের দুটি গ্রামের বেশ কিছু বাঁজা জমিকে আমরা সবাই মিলে আবাদী করে তুললাম। এর মূল্য কিছু কম নাকি? সে কথা ভুলে যাচ্ছিস কী করে?”
ভল্লা বলল, “কাকা, এ বাঁধটা আমরা ভালই বানিয়েছি, কী বলো?”
“সে কথা আর বলতে! বাপ পিতেমোদের সময় থেকেই তো এই নালা বয়ে চলেছে। কারও মাথায় আসেনি এখানে বাঁধ দিয়ে কিছু জমি চাষবাস করা সম্ভব। তুই এসে পথ দেখালি, রে ব্যাটা”।
“কিন্তু এ বাঁধের নিচের সরু সরু ছিদ্র দিয়ে জল কিন্তু ভাটায় বেরিয়ে চলেছে, কাকা। সেই জলের গতি কমাতে না পারলে, এ বাঁধ কিন্তু দুর্বল হয়ে যাবে। সামনের বর্ষায় হয়তো ভেঙেই পড়বে”।
“এ কথা তুই আগেও বলেছিস, বেটা। কিন্তু কী দিয়ে আটকাবো?”
“শক্ত এঁটেলমাটি যোগাড় করতে পারো না, কাকা? তোমাদের সুকরা কিংবা নোনাপুরে?”
“সে হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সে মাটিতে কী হবে?”
“এঁটেলমাটির বড়ো বড়ো চাঙর বাঁধের জলে ফেলে দিও। সে মাটি গলে গিয়ে জলের সঙ্গে বইতে থাকবে ওই সরুসরু নালিপথে। ধীরে ধীরে কমে যাবে জলের ধারা”। ভল্লা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “নোনাপুরের কেউ আজ মাঠে আসেনি – হানোর হঠাৎ মৃত্যুটা সবাইকে পাথর করে দিয়েছে, না কাকা?”
“হ্যাঁ। ও গাঁয়ের পাঁচজন লোক সারারাত পাহারা দিয়েছে, আমাদের লোকদের সঙ্গেই। যেমন রোজ দেয়। কিন্তু সকালে কেউ আসেনি”।
“রাতে কিসের পাহারা, কাকা?”
“ইঁদুর, শজারু আছে, মাঝে মাঝে আসে হরিণের পাল – তাদের থেকে শস্য পাহারা দেওয়া আমাদের বরাবরের অভ্যাস বেটা। ডপলি, ঢাকের আওয়াজ করে, আগুনের মশাল জ্বেলে তাদের দূরে রাখতে হয়”।
“তাই? দুটো শস্যের জন্যে কী পরিশ্রমই করতে হয়, তাই না, কাকা? কিন্তু রাজারা রাজস্ব আদায়ের সময় এসব কথা চিন্তাও করে না”। ভল্লার স্বরে কিছুটা উষ্মা।
“এটা ঠিক নয়, বেটা। তোরা আজকালকার ছেলে ছোকরারা বুঝিস না, রাজা এই সমস্ত জমির মালিক। তিনিই আমাদের জীবন ধারণের জন্য বাস্তু আর আবাদের জমি দিয়েছেন। তার বদলে তাঁরা কর নেবেন না? কর না নিলে তাঁদের চলবে কী করে? কী করে বানাবেন রাস্তাঘাট? কী করে রাজ্যের সুরক্ষা সামলাবেন?”
“রাজা কী করে জমির মালিক হলেন? এই মাটি, জল, হাওয়া, রোদ্দুর, শস্যের বীজ সবই তো ভগবান সৃষ্টি করেছেন”।
ভীলককাকা প্রশ্রয়ের হাসি মাখা মুখে বললেন, “ভগবানই তো সৃষ্টি করেছেন, বেটা। কিন্তু এসবের সুষ্ঠু বিলিব্যবস্থার জন্যে তিনি তো রাজাকেও নিয়োগ করেছেন”।
ভল্লা কিছুক্ষণ ভীলককাকার স্নেহসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “সেই রাজার শালা, বছরের পর বছর মেয়েদের যাচ্ছেতাই অসম্মান করবে। রাজা মুখ বুজে বসে বসে দেখবে। আমরা রক্ষীরা তাকে শায়েস্তা করলে আমাদের নির্বাসন দেবে। এই কাজের জন্যেও কি ভগবান রাজাকে নিযুক্ত করেছিলেন, কাকা?” হঠাৎ করেই ভল্লা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “কাকা তুমি আমাকে যতই বোঝাও, আমি বুঝব না। আমি এখন চলি কাকা, তোমরা সাবধানে থেক।”
বাঁধ থেকে নেমে নালার ধারের ঝোপঝাড়ের আড়ালে হনহন করে ভল্লা এগিয়ে গেল তার কুটিরের পথে। ভীলককাকা তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলেন, “ভগবান যে এই সব কিছুর মধ্যে নেই, সে কথা কী আর আমরা বুঝি না, বেটা? আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগে, তোর মতো কেউ পাশে দাঁড়ালে, হয়তো আমরাও…। ভগবান তোকে দীর্ঘ পরমায়ু দিন, বেটা”।
সকালে মাঠ থেকে ফিরে, সে সোজা গিয়েছিল, সেই দুই গাছের নিচে। যে দুই গাছের ওপরের মাচায় রাখা আছে কালকের আনা অস্ত্রশস্ত্রগুলো। মাচা থেকে একটা দা কোমরে গুঁজে নিল, তারপর চারটে বাঁশ নামাল নিচেয়। ওখানেই বসে বাঁশগুলোকে ছেঁটে বানিয়ে ফেলল একজোড়া রণপা। বাঁশের নিচের প্রান্ত থেকে হাত দেড়েক ওপরে একটা করে শক্ত ফেঁকড়ি রাখা আছে। দুহাতে দুটো-দুটো বাঁশ ধরে, দুদিকের ফেঁকড়িতে পা রেখে সে চড়ে পড়ল রণপায়। তারপর দ্রুত দৌড়ে চলল নিজের কুটিরের দিকে। বহুদিন পর এই রণপা তাকে এনে দিল স্বাচ্ছন্দ্য আর আত্মবিশ্বাস।
নিজের কুটিরে এসে দুজোড়া রণপা সে লুকিয়ে ফেলল, গভীর ঝোপের ভেতর। তারপর একটু বিশ্রাম করে সামান্য কিছু রান্না করল। স্নান সেরে খাওয়াদাওয়া করে, সে কুটিরের সামনে বসল। এখন আর কোন কাজ নেই ভল্লার। বসে বসে চিন্তা করা ছাড়া।
নোনাপুর গ্রামের পরিস্থিতি এখন কেমন হতে পারে, সেটাই চিন্তা করছিল ভল্লা। তাজা জোয়ান এক ছেলের সাপের দংশনে মৃত্যু হলে, সে পরিবারটি মানসিক দিক থেকে ধ্বস্ত হয়ে যায়। কমলিমা ও জুজাকেরও দুই ছেলে সাপের ছোবলে মারা গিয়েছিল। ভয়ংকর এই অভিঘাতে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজনও বেশ কিছুদিন নির্মোহ উদাসীন হয়ে ওঠে। কোন জীবনই যে নিত্য নয়, সে কথা কে না জানে। কিন্তু এমন এক একটা ঘটনা যেন চোখে আঙুল দিয়ে সকলকে বুঝিয়ে দেয়। জীবন এই আছে, এই নেই। তারা যেন অনুভব করতে পারে, আড়ালে বসে থাকা ভাগ্যদেবতার ক্রূর হাসি। ভল্লার ধারণা হানোর এই মৃত্যু-শোক তার ছেলেদের পক্ষে কিছুটা হলেও রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াল। ছেলেরা সত্যিই রামকথা দেখতে গিয়েছিল কিনা। নাকি তারাই আস্থানে ডাকাতি করতে গিয়েছিল। এসব ভাবনা চিন্তা করার মতো সুস্থির মতি গ্রামের অধিকাংশ মানুষেরই আপাতত নেই। এই বিষণ্ণতা কাটিয়ে, সকলে যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে, ততদিনে আস্থানের ডাকাতির ঘটনা গুরুত্ব হারাবে। তবে ভল্লার ভয় কবিরাজমশাই এবং গ্রামপ্রধান জুজাককে। দুজনেই অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বহুদর্শী।
ভল্লা সতর্ক হল। কিছুক্ষণ থেকেই কুটিরের পিছন দিক থেকে সে চার-পাঁচজনের পায়ের শব্দ পাচ্ছিল। আর কানে আসছিল তাদের চাপা কথাবার্তার আওয়াজ। এই অসময়ে কে হতে পারে? আস্থানের রক্ষীরা? তাদের তো এখানে আসার কথা নয়। “ভল্লাদাদা ঘরে আছো?” এবার অপরিচিত গলার ডাক শুনতে পেল ভল্লা। আস্থানের রক্ষীরা তাকে নিশ্চয়ই ভল্লাদাদা বলে পীরিত দেখাতে আসবে না। সামনের পথ ঘুরে পাঁচজন ছোকরা এসে দাঁড়াল ভল্লার সামনে। ভল্লা কোন কথা বলল না, জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।
“আমরা আসছি, পাশের রাজ্য থেকে ভল্লাদাদা। আমাদের গ্রামের নাম বটতলি। আমরা পাঁচজন বন্ধু তোমার কাছে সাহায্যের জন্যে এসেছি। আমি মিলা, এরা ভট্টা, জনা, পুনো আর সুরো”।
ভল্লা বিরক্তির সঙ্গে বলল, “আমি সকলকে অকাতরে সাহায্য বিতরণ করে থাকি, এ সংবাদ তোমাদের কে দিল? যাই হোক, বসো। নিজের রাজ্য ছেড়ে আমার কাছে এসেছ সাহায্য চাইতে, এ খবর চাপা থাকবে না। বিপদে পড়বে – সেটা জানো তো?”
জনা খুব দৃঢ় স্বরে বললে, “বিপদকে আমরা ভয় পাই না”।
ভল্লা তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে নিয়ে বলল, “খুব আনন্দ পেলাম শুনে। আসন্ন বিপদকে যদি কেউ বুঝতেই না পারে, সে বিপদকে ভয় পাবে কেন? একটি শিশু যখন জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা ধরতে যায়, তাকে সাহসী বলব, না বীর বলব, আমি আবার ঠিক বুঝে উঠতে পারি না”।
মিলা চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ভল্লার দিকে, তারপর বলল, “এই জন্যেই তো আমরা তোমার সাহায্য চাইতে এসেছি”।
ভল্লা বলল, “কিসের সাহায্য?”
মিলা বলল, “আমাদের অঞ্চলে পাশাপাশি অনেকগুলি গ্রাম মিলে আমরা একজোট হয়ে উঠছি। আমরা লড়তে চাই”।
ভল্লা বলল, “গ্রামের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে লড়াই? বাস্রে। কার বিরুদ্ধে”?
“কেন? আমাদের রাজার বিরুদ্ধে! রাজাকে তো সামনে পাবো না, তার প্রতিনিধি বিষয়পতির বিরুদ্ধে”। মিলা বলল।
“বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ তোমরা রাজার ওপর এমন খেপে উঠলে কেন? যতদূর জানি, তোমাদের রাজা বেশ ধার্মিক রাজা। প্রজাদের নিজের সন্তানের মতোই মনে করেন। তোমাদের রাজ্যে কোথাও কোন বিদ্রোহ বা অসন্তোষের কথাও কোনদিন শুনিনি”।
“ঠিকই, এতদিন আমরাও আমাদের রাজাকে খুবই শ্রদ্ধা-ভক্তি করতাম। কিন্তু ইদানীং তাঁর যে উপসর্গ উপস্থিত হয়েছে, তাকে মতিভ্রম ছাড়া আর কী বলা যায়, আমরা জানি না”।
ভল্লা বলল, “বলো কী? এই বয়সে নারীতে আসক্তি?”
মিলা জিভ কেটে বলল, “ছি ছি, তা নয়। বরং ধর্মাচরণে অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়েছেন”।
“আচ্ছা? অতিধার্মিক রাজাও এখন তোমাদের গাত্রদাহ? বেশ, সে কী রকম, শুনি?”
মিলা তার চার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভল্লাদাদা, এই দিকের গ্রামগুলিতে চাষবাসের অবস্থা যেমন তুমি দেখছ, আমাদের গ্রামগুলিতেও একই অবস্থা। কোথাও কোথাও আরও সঙ্গিন। আমরা গ্রামিকদের মাধ্যমে বিষয়পতির কাছে বার বার অনুরোধ করেছি – কিছু কিছু কুয়ো বানিয়ে যদি সেচ ব্যবস্থার সুরাহা করা যায়। কিংবা বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্যে যদি কিছু পুকুর বানানো যায়। কিন্তু সে কথায় কেউ কোনদিন কর্ণপাতই করল না। অথচ বিগত দু তিন বছরে, গ্রামে গ্রামে ধর্মস্থান এবং দেবালয় বানানোর ধুম পড়ে গেছে। ভল্লাদাদা, মানুষের পেটে দুবেলা দুমুঠো অন্ন যদি না জোটে, তারা দেবালয় নিয়ে কী করবে বলো তো?”
“ওই সব দেবালয়ে কোন দেবতার পুজো হচ্ছে?”
“দেবরাজ ইন্দ্রের। তিনি নাকি বৃষ্টির দেবতা! গ্রামে গ্রামে তাঁর পুজো হলে, তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের প্রচুর বৃষ্টি দিতে পারেন”।
“ভালই তো। দেবতারা এত ধরনের কৃপা-বর্ষণ করতে পারেন, আর দুমুঠো মেঘ এনে সাত-কলসি বৃষ্টি-বর্ষণ করতে পারবেন না? তা এই মন্দির কারা বানাচ্ছে, তোমাদের গ্রামের মানুষরাই তো?”
“না ভল্লাদাদা। গ্রামের মানুষদের কাছে পয়সা কোথায়? এই মন্দির বানিয়ে দিচ্ছে প্রশাসন”।
“তাতেই বা মন্দ কি? গ্রামের মানুষ কাজ পাচ্ছে, কিছু মানুষের উপার্জন হচ্ছে...”।
“হ্যাঁ কিছু মানুষ কাজ পাচ্ছে, শ্রমিকের কাজ। সে তো সামান্য। আমরা মন্দির নির্মাণের কী জানি? মন্দিরের আসল কাজ তো করছে বাইরে থেকে আসা শিল্পী ও কুলিকরা। এমনকি আমাদের মাটি ভাল নয় বলে, এখানকার ইঁটও ব্যবহার করা হচ্ছে না। ইঁট বানিয়েও কিছু মানুষের উপার্জন হতে পারত। আমাদের কোন জমির মাটিতে ইঁট বানালে, সে জমিতে ছোটখাটো একটা পুকুরও গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু না, মন্দিরের ইঁট, পাথর, চূণ, সুরকি, বালি - অন্যান্য যাবতীয় উপকরণ সবই আসছে বাইরে থেকে। রাজধানীর বড়ো বড়ো বণিকরা সেই সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে”।
মিলা চুপ করে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইল। ভল্লা কোন কথা বলল না। উদাস চোখে ধৈর্য ধরে উপস্থিত পাঁচজনের মুখভাব লক্ষ্য করতে লাগল মন দিয়ে।
মিলা একটু পরে বলল, “রাষ্ট্রীয় অর্থের এই বিপুল অপচয় আমরা যতই দেখছি, আমাদের রক্তে আগুন জ্বলছে, ভল্লাদাদা। মন্দির নির্মাণের নামে, রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত - প্রশাসনের সর্বস্তরের সঙ্গে বণিকদের গড়ে উঠেছে ভয়ানক এক বোঝাপড়ার জাল। আমাদের গ্রাম-মণ্ডলের সদস্য থেকে গ্রামিক, বিষয়পতিরা দ্রুত অবস্থাপন্ন হয়ে উঠছে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা যখন অর্ধাহারে কাল কাটাচ্ছে, ওরা প্রচুর আহার, আমোদ ও উল্লাসে উচ্ছৃঙ্খল”।
মিলা সামান্য বিরতি দিতেই, ভল্লা একটু ঠাট্টার সুরে বলল, “তোমরাই মণ্ডল-সভার সদস্যদের নির্বাচন করো, গ্রামিককেও নির্বাচন করো, তাই না? তারা কিনা তোমাদের ভাগ না দিয়ে উপরি-উপার্জনে আহ্লাদ করছে? ওদের প্রতি তোমাদের ঈর্ষা এবং রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক”।
মিলা এবার হতাশ সুরে বলল, “আমাদের বিদ্রূপ করছ, ভল্লাদাদা? ঈর্ষা যে করছি না, তা নয়। কিন্তু তার থেকেও বেশি, আমরা ভয় পাচ্ছি। গ্রামের পরিবেশটাই বিষিয়ে উঠছে প্রতিদিন। পরিশ্রমী কৃষক, কর্মকার, কুম্ভকার সকলেই হতাশাগ্রস্ত। তাদের ধারণা হচ্ছে পরিশ্রমের কোন মূল্য নেই। মূল্য আছে শুধু শঠতা, তঞ্চকতা আর বঞ্চনার। এভাবে চললে গ্রামগুলি আর গ্রাম থাকবে না। হাতে গোনা কিছু উদর-সর্বস্ব বিলাসী মানুষের শোষণে ও শাসনে, গ্রাম হয়ে উঠবে মরণাপন্ন হতে থাকা শীর্ণ-কংকালসার অজস্র হতদরিদ্র মানুষের আবাস”।
মিলা চুপ করে গেল। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। ভল্লাও কোন উত্তর দিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর মিলা হঠাৎই উঠে দাঁড়াল, বলল, “সন্ধে নামছে, আমরা এখন চলি, ভল্লাদাদা। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম..."।
মিলার কথায় অন্য চারজনও উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল ভল্লাও, মিলার দু-কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোরা যে কাজের সংকল্প করেছিস, তাতে এত সহজে হতাশ হলে চলবে, মিলা? নাকি ঝট করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব? তোদের ভল্লাদাদা তো আর দেবরাজ ইন্দ্র নয়। সে তোদের মতোই জীবনের আগুনে দগ্ধ হতে থাকা জলজ্যান্ত মানুষ...”। ভল্লার “তুই” সম্বোধনের আন্তরিকতা এবং সহানুভূতির কথায় ওরা পাঁচজনেই উচ্ছ্বসিত আবেগে বলে উঠল, “ভল্লাদাদা...”।
ভল্লা বলল, “ঠিক কী ধরনের সাহায্য তোরা আমার থেকে চাইছিস খুলে বল তো”।
মিলা উৎসাহ নিয়ে বলল, “এদিককার ছেলেদের তুমি যেমন লড়াকু বানিয়ে তুলছ, আমাদেরও সেভাবে তৈরি করে তোল। আমরা লড়তে চাই, ভল্লাদাদা”।
“সে না হয় শিখলি, কিন্তু খালি হাতে তো আর লড়াই করা চলে না। অস্ত্রশস্ত্র চাই তো, সে সব পাবি কোথায়?”
“আমাদের গ্রাম থেকে চার ক্রোশ দূরে সীমান্তরক্ষীদের স্থায়ী শিবির আছে। সেখান থেকে লুঠ করে আনব”।
“পাগল হয়েছিস? আত্মহত্যা করার এতই যখন শখ, তখন জলে ডুবে মর না, কিংবা বিষ খেয়ে। খালি হাতে সীমান্ত রক্ষীদের শিবির থেকে অস্ত্র লুঠ করতে যাবি? একজনও সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি? ভেবেছিলাম, তোরা অনেককিছু ভেবেচিন্তে এসেছিস – কিন্তু এ তো একেবারেই ছেলেমানুষী...। তোদের বা আশেপাশের গ্রামে ধনী মানুষদের টাকা-পয়সা কেমন আছে? ডাকাতি করে লাভ হবে? নাকি ছুঁচো মেরে শুধু হাতেই গন্ধ হবে?”
“তা আছে। অন্ততঃ দশ-বারো ঘর তো আছেই যাদের বিস্তর টাকা”।
“তাদের দিয়েই শুরু কর না। অস্ত্রশস্ত্র যোগাড়ের জন্যে টাকা চাই। টাকা যোগাড় হলে, অস্ত্রের ব্যবস্থা আমি করে দেব। আরও একটা উপায় আছে। রাজধানীর বণিকরা মন্দির বানানোর সামগ্রী পাঠাচ্ছে বলছিলি না? কিসে পাঠাচ্ছে – নিশ্চয়ই গোরু বা ঘোড়ার শকটে? তার থেকেও কিছু টাকাকড়ি আয় করা যায় – ধরা যাক প্রতি পাঁচ গাড়ি পাথর বা ইঁটের জন্যে একটা তামার মুদ্রা”।
মিলারা পাঁচজনেই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “বাঃ এ তো খুব সহজ”।
ভল্লা মুচকি হেসে বলল, “কোনটাই সহজ নয় বৎস। তোদের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার জন্যে বণিকরা সর্বদা মুখিয়ে রয়েছে – এরকম ভাবছিস কেন? এ সবের জন্যেও সাহস লাগে – কৌশল জানতে হয়। ঠিকঠাক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে – গাড়ি-পিছু তোদের পাওনা বণিকরাই নিয়মিত মিটিয়ে দেবে”।
মিলা বলল, “তুমি আমাদের শিখিয়ে দাও ভল্লাদাদা”।
ভল্লা বলল, “সে না হয় দিলাম। কিন্তু এমন যদি হয়, এরকম বেশ কিছু পয়সা জমিয়ে তোরা নিজেরাই ধনী হয়ে উঠলি। তোরাই গ্রামমণ্ডল গড়ে – তোদের মধ্যে একজন কেউ গ্রামিক হয়ে উঠলি। তারপর পায়ের ওপর পা তুলে রাজার হালে দিন কাটাতে শুরু করলি। লড়াই-টড়াই সব গেল চুলোর দুয়োরে। গ্রামের সকলের মঙ্গলের জন্যে তোদের এই বিপ্লব করার স্বপ্ন পড়ে রইল পথের ধারের আস্তাকুঁড়ে! কাঁচা টাকা বড়ো সাংঘাতিক – সে টাকা যদি সোনা বা রূপোর হয় - তার ঝিলিকে চোখ, মন এবং মাথা ঘুরে যায় রে...”।
মিলা কিছু একটা বলতে চাইছিল, ভল্লা ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “এখন আর কোন কথা নয় – যা যা বললাম, ভাবনা-চিন্তা করে, পাঁচ-সাতদিন পরে আসিস – রাত হয়েছে, এখন বাড়ি যা”।
ক্রমশ...