শিবিরের মেঝেয় পাতা মোটা আসনে বসে কাঠের পীঠিকার ওপর ভুর্জপত্রের স্তূপ নিয়ে বসেছিলেন করাধ্যক্ষ, শষ্পক। পীঠিকার উল্টোদিকে বসে ছিল দুই করণিক। দুজনে শষ্পককে নানান গ্রামে উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ, ধার্য খতিয়ান এবং কর আদায়ের পরিমাণ বোঝাচ্ছিল। বকেয়া কর কী ভাবে সংগ্রহ করা যায় – সে নিয়েও গম্ভীর আলোচনা করছিলেন শষ্পক। সেই সময়ে করাধ্যক্ষের শিবিরের পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন জুজাক, তার পিছনে ভল্লা। দুজনেই নত হয়ে নমস্কার করল শষ্পককে।
শষ্পক মুখ তুলে তাকালেন ওদের দিকে, প্রতি-নমস্কার করার পর, তাঁর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি ইশারায় করণিক দুজনকে শিবিরের বাইরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে, চুপ করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর ভল্লার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, “তোমার যে নির্বাসন দণ্ড হয়েছে, তুমি জান না, ভল্লা? আজ কুড়ি দিনের ওপর হয়ে গেল তুমি এখনও রাজ্যের সীমার মধ্যেই রয়েছ। উপরন্তু মাননীয় গ্রামপ্রধানের বাড়িতে রাজার হালে কাল কাটাচ্ছ?”
জুজাক খুব বিনীত ভাবে বললেন, “সত্যি বলতে অচেতন-মৃতপ্রায় অবস্থায় ও আমাদের গ্রামে পৌঁছেছিল – সে অবস্থায়...”।
শষ্পক বাঁহাত তুলে জুজাককে থামিয়ে বললেন, “ওসব কথা আমাকে বলে লাভ নেই, মাননীয় নগরপাল আমাকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন...তিনি আমার কোন কথাই শুনবেন না। বরং আপনিই বিড়ম্বনায় পড়বেন। আগামী দুদিনের মধ্যে ভল্লা যদি রাজ্যসীমার বাইরে না যায় – সেক্ষেত্রে ভল্লার চরম শাস্তি তো হবেই – আপনিও বিপদে পড়বেন...বলে রাখলাম”।
জুজাক একইরকম বিনীতভাবে বললেন, “আপনার নির্দেশের এতটুকুও অন্যথা হবে না, মান্যবর। আমি কাল সকালেই ওকে গ্রাম থেকে বিদায়ের ব্যবস্থা করব”।
শষ্পক বিরক্ত মুখে বললেন, “করলেই ভাল। মনে রাখবেন গত অমাবস্যায় যে আবেদন নিয়ে আপনি আমার কাছে এসেছিলেন, সেই সিদ্ধান্তও আমাকে স্থগিত রাখতে হয়েছে এই কারণেই। যে গ্রাম একজন অপরাধীকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়, তাকে রাজার অনুগ্রহের অনুমোদন দেওয়া কী ভাবে সম্ভব? আপনি এখন আসুন। ভল্লা থাক, ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে”।
জুজাক নমস্কার করে শিবিরের বাইরে যাওয়ার পর, শষ্পক নিচু স্বরে বললেন, “বস ভল্লা। কী সব শুনছি তোমার নামে? এর মধ্যেই নাকি তুমি গ্রামের ছেলেছোকরাদের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছ?”
ভল্লা বসল। মৃদু হেসে বলল, “সবই আপনাদের কৃপা এবং শিক্ষা, মান্যবর। আমাকে এই কাজের জন্যেই তো পাঠানো হয়েছে”।
শষ্পক বললেন, “তুমি কিন্তু যত শীগ্গির সম্ভব, সীমানার বাইরে থাকতে শুরু কর। সেখান থেকেই তোমার কাজ পরিচালনা কর। গ্রামের ছেলেদের তৈরি করে তোল দ্রুত – শুধু মনের আগুনে কিছু হয় না, সে তো তুমি আমার থেকেও ভাল জান, ভল্লা। মান্যবর নগরপাল তোমার জন্যে পর্যাপ্ত তির-ধনুক, ভল্ল, কৃপাণ এবং রণপা বানানোর বাঁশ পাঠিয়েছেন। আমার বাহিনীর মধ্যেই সেসব আছে – কিন্তু তোমাকেই সেগুলি সংগ্রহ করতে হবে”।
ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “আগামী পূর্ণিমার গভীর রাত্রে কী আমরা হানা দিতে পারি, মান্যবর?”
শষ্পক অবাক হয়ে বললেন, “আগামী পূর্ণিমা? মানে আর মাত্র সাতদিন? তাছাড়া চন্দ্রালোকে কোন গোপন অভিযান সমীচীন হবে কি? আমি তো ভেবেছিলাম অন্ততঃ মাসখানেক লাগবে তোমার ছেলেদের খেপিয়ে একটু শক্তপোক্ত বানিয়ে তুলতে”!
ভল্লা হাসল, বলল, “শুভস্য শীঘ্রম, মান্যবর। আমার অল্পশিক্ষিত সেনাদল অন্ধকার অমানিশায় অভিযান করে ওঠার মতো দক্ষ এখনও হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয় না এই অভিযান তেমন কিছু বিপজ্জনক হবে, সেই কারণেই পূর্ণিমার রাত্রি। হাল্কা উত্তেজনায় তাদের মানসিক আচরণ কেমন হয়, সেটাও বুঝে নিতে চাই”। একটু থেমে ভল্লা আবার বলল, “তবে আমার কিছু নগদ অর্থেরও প্রয়োজন – কিছু তাম্র বা রৌপ্য মুদ্রা হলে ভালো হয়”।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে শষ্পক বললেন, “কিন্তু কোষাগার অরক্ষিত রাখব কী করে? সন্দেহ করবে, অনেকেই ষড়যন্ত্রের কথা আন্দাজ করে নেবে”।
“সেদিন শিবিরে ছোট করে একটা উৎসব এবং তার সঙ্গে একটু মদ্যপানের আয়োজন করে দিন না, মান্যবর। বাকিটা আমি সামলে নেব। কোষাগারের পিছনের গবাক্ষ দিয়ে – গোটা তিন-চার মুদ্রার বটুয়া আমি তুলে নিতে পারব। তাতেই আপাতত চলে যাবে”।
শষ্পক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি এর মধ্যেই এই স্থানকের কোথায় কোষাগার, এবং সে কক্ষের পিছনে গবাক্ষ রয়েছে - দেখে নিয়েছ? আশ্চর্য!”
“আজ্ঞে, ওই একরকম আর কি। তবে মান্যবর, আমার ইচ্ছে আছে... আপনি এখান থেকে শিবির তুলে উত্তরের পথে যাওয়ার সময় – আপনার বাহিনীর ওপর ডাকাতি করব”।
“আচ্ছা? অতি উত্তম! কিন্তু সর্বস্ব লুঠ করো না, হে। তাহলে আমার আর রক্ষীসর্দারদের কর্মচ্যুত হতে হবে”।
ভল্লা হাসল, বলল, “চার-পাঁচটা গোশকট চুরি করলেই আমার চলে যাবে। নতুন সেনাদল নিয়ে সর্বস্ব লুঠ করা অসাধ্য। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না, মান্যবর। তবে...”। কথা শেষ করতে ভল্লা একটু ইতস্ততঃ করল।
শষ্পক উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তবে কি, ভল্লা?”
“পাঁচ-দশজন রক্ষীকে আহত হতে হবে...”।
শষ্পক নির্বিকার চিত্তে বললেন, “সে তো হবেই, তা নাহলে রাজধানীতে আমার পাঠানো লুণ্ঠনের সংবাদ বিশ্বাসযোগ্য হবে কী করে? দু-একজন নিহত হলেও... আমার আপত্তি নেই। তাদের পরিবারবর্গ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক কোথায় তুমি এই আক্রমণের পরিকল্পনা করেছ?”
ভল্লা বলল, “নোনাপুর গ্রাম পেরিয়ে, তেমাথা থেকে উত্তরের পথে। ওই মোড় থেকে চারক্রোশ দূরের জঙ্গলে। জঙ্গলের মধ্যে ওখানে কিছুটা উন্মুক্ত জমি আছে... ওখান থেকে রাজ্য সীমান্তও বেশ কাছে, সহজেই গোশকট নিয়ে পালাতে পারব। আপনি সেখানেই যদি রাত্রি বাসের জন্য শিবির স্থাপনা করেন...”।
শষ্পক বললেন, “তথাস্তু, ভল্লা। কিন্তু আশ্চর্য করলে ভল্লা। শুনেছি তুমি অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলে প্রায় সাত-আটদিন, তারপরে এই কদিনের মধ্যে এই গ্রামের পরিসীমা, তার জঙ্গল, পথঘাট সব তোমার দেখা হয়ে গেছে! রাজধানী থেকে সঠিক লোককেই যে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে আমার আর কোন সংশয় নেই।”
“আরেকটি অনুরোধ, মান্যবর”।
শষ্পক কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী বলো তো?”
“মাননীয় গ্রামপ্রধান আপনার কাছে কর হ্রাসের যে আবেদন করেছেন, সেটি অনুমোদন করবেন না”।
আশ্চর্য হয়ে শষ্পক বললেন, “কেন বলো তো?” ভল্লা কোন উত্তর দিল না। শষ্পক ভল্লার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, “বুঝেছি, তাই হবে”।
“আমায় তবে বিদায় দিন, মান্যবর”।
“এস। আরেকটা কথা, জনৈক নিশাচর ব্যক্তি তোমার কাছে যাবে। প্রয়োজনমতো। হয়তো তোমার পূর্বপরিচিত। সংবাদ আদান-প্রদানের জন্যে। তাতে পরবর্তী পরিকল্পনা করতে, উভয়তঃ সুবিধা হবে। ঠিক আছে? এবার এসো, সাবধানে থেক। তোমার মতো কর্মী রাজ্যের পক্ষে অমূল্য রত্ন বিশেষ”।
এতক্ষণ দুজনেই নিম্নস্বরে কথা বলছিলেন। অকস্মাৎ শষ্পক প্রচণ্ড উত্তেজিত স্বরে চিৎকার করে বললেন, “দূর হয়ে যা, আমার সামনে থেকে, পাষণ্ড। মহারাজা দয়ালু তাই তোকে শূলে চড়াননি – নির্বাসন দিয়েছেন মাত্র। তাঁর সে নির্দেশও তুই অমান্য করিস কোন সাহসে? আগামী পরশুর মধ্যে তুই যদি রাজ্যসীমার বাইরে না যাস, তোর মৃতদেহ আমি সবার সামনে ফেলে রাখব চার-রাস্তার মোড়ে – শেয়ালে শকুনে ছিঁড়ে খাবে – সেই হবে তোর উচিৎ শাস্তি, নরাধম...।”
লাঠির আঘাতে কুকুর যেমন আর্তনাদ করতে করতে ছুটে পালায়, ভল্লা সেভাবেই শিবির থেকে বেরিয়ে এল দৌড়ে...।
---
পূর্ব পরিকল্পনা মতো পূর্ণিমার মধ্য রাত্রে ভল্লা পনের জনের একটি দল নিয়ে হানা দিল আস্থানে। তার মধ্যে চারজন রইল ঠিক তার পিছনে। হানো, শলকু, আহোক আর মইলি। ভল্লা প্রথমে এবং তার পিছনে চারজন আস্থানের সদর প্রবেশদ্বার টপকে ভিতরে ঢুকল। সকলের হাতেই লাঠি। দ্বারের সুরক্ষায় তিনজন প্রহরী ছিল। তাদের লাঠির আঘাতে আহত করে প্রবেশদ্বার খুলে দলের আরও চারজনকে তারা ঢুকিয়ে নিল। সকলে মিলে অতি দ্রুত প্রহরীদের মুখে গামছা গুঁজে দিল। দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল তাদের হাত-পা। প্রহরী তিনজনকে টেনে একটু আড়ালে অন্ধকারে ফেলে রেখে, ভল্লা সকলকে নিয়ে দৌড়ল আস্থানার অন্য প্রান্তে। যেখানে অস্ত্রশস্ত্র রাখা আছে।
হানো, শলকু আর আহোক অন্ধকারে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। তিনটি কোনে লাঠি হাতে প্রস্তুত রইল পাহারায় – কোন রক্ষী কাছাকাছি এলেই বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের ধরাশায়ী করবে। বাকিরা আস্থানার বেড়া টপকে অস্ত্রশস্ত্র বাইরে পাচার করতে শুরু করল। বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে দলের বাকি সাতজন সেগুলি দ্রুত হাতে গুছিয়ে তুলতে লাগল বেড়া থেকে একটু দূরে একটা বড়ো গাছের ছায়ায়। সেখানে পাশাপাশি রাখা আছে কাঠের দুটি টানা-শকট।
দুজন রক্ষী দলটাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে আসছিল। শলকু আর আহোক আড়াল থেকে লাফিয়ে, এমনই লাঠির আঘাত করল, দুজনেই নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তিনজনে মিলে দেহদুটো আড়ালে সরাতে গিয়ে হানো আর শলকু দেখল, ওদের মাথার পিছন থেকে রক্ত ঝরছে। শলকু কেঁপে উঠল, বলল, “এত রক্ত? মরে গেল না তো? ভল্লাদাদা কোথায় রে?” চারদিকে তাকিয়ে তারা ভল্লাকে দেখতে পেল না। এই তো একটু আগেও সে সামনেই ছিল, গেল কোথায়? শলকু আর আহোকের হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। দুজনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল মাটিতে। হানো আহত দুই রক্ষীকে খুঁটিয়ে দেখল – নাকের সামনে আঙুল রেখে দেখল শ্বাস চলছে – তবে খুব মৃদু। হানো আরেকবার ভল্লাকে খুঁজল। দেখতে না পেয়ে শলকু আর আহোকের কাঁধে হাত রেখে চাপা স্বরে বলল, “তোরা এভাবে বসে থাকিস না, শলকু। বিপদ ঘটতে পারে। শরীর খারাপ লাগল, বাইরে গাছতলায় গিয়ে বস। যা। এখানে থাকিস না”।
শলকু আর আহোক নিজেদের সামলাবার চেষ্টা করছিল। মহড়া দেওয়ার সময়, ভল্লাদাদা বারবার বলেছে, লড়াই করতে হলে শত্রুপক্ষের রক্ত ঝরাতে হবে। নয়তো তোর নিজেরই রক্ত ঝরবে। আহত মানুষের আর্ত চিৎকার শুনলে, কিংবা তার রক্ত দেখলে, মন দুর্বল যেন না হয়। হানো আবারও বলল, “যা ওঠ। তাড়াতাড়ি বাইরে যা”। হঠাৎই তার পাশে এসে দাঁড়াল ভল্লাদাদা। নিঃশব্দে, বেড়ালের মতো। তার কাঁধে এখন মাঝারি আকারের একটা ঝোলা। হাতে একটা বল্লম। কোন দিক দিয়ে এল, কীভাবে এল, সে টেরই পেল না? হানো ভাবল, ভল্লাদাদার মতো দক্ষ রক্ষী এ আস্থানায় যদি দু-পাঁচজন থাকত, তাহলে এতক্ষণ তাদেরই হয়তো মাটি নিতে হত।
ভল্লা চাপা স্বরে বলল, “হানো ঠিক বলেছে, তোরা বাইরে যা। আমাদের ছেলেরা বেড়ার কিছুটা ভেঙে দিয়েছে। আমরা ওই পথেই পালাব”। ভল্লার কথায় শলকু চাপা ডুকরে উঠে বলল,
“ভল্লাদাদা, এ আমি কী করলাম, লোকটা মনে হয় মরে গেছে…”। ভল্লা চাপা গর্জনে বলল, “তোর এই নাকে কান্নার জন্যে, আমাদের একজনারও যদি কোন ক্ষতি হয় শলকু, আমি তোকে বাঁচতে দেব না। এখনই ওঠ, বেরিয়ে যা”। শলকু আর আহোক উঠে দাঁড়াল, হেঁটে গেল তাদের দলটির দিকে।
হানো ওদের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল, বলল, “ওদের মন যে এত দুর্বল, বোঝাই যায়নি”।
ভল্লা হেসে হানোর কাঁধে হাত রাখল, বলল, “নিজের হাতে একটা - দুটো শত্রুর প্রাণ নে, তারপর… ”। কথার মাঝেই ভল্লা তার হাতের বল্লমটা বিদ্যুৎ বেগে ছুঁড়ে দিল একটা অন্ধকার কোনার দিকে। লোহার ফলা চাঁদের আলোয় ঝলসে উঠল। হানো কাউকে দেখতে পেল না, কিন্তু লোকটার গলা থেকে যে আওয়াজটা বের হল, সেটা যে তার অন্তিম কণ্ঠস্বর বুঝতে তার অসুবিধে হল না। তারপরেই ভারি কিছু মাটিতে পড়ে যাওয়ার শব্দ। ভল্লা দুটো আওয়াজই উৎকর্ণ হয়ে শুনল। তারপর নিশ্চিন্ত স্বরে আগের কথার জের টেনে বলল, “…তারপর তোকে বীর বলব। দাঁড়া বল্লমটা তুলে আনি”। ভল্লা দ্রুত পায়ে দৌড়ে গেল।
মরার আগে লোকটার ওই অস্ফুট আওয়াজটা হানোর কানে বারবার ফিরে আসছে। হানোর পেটের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। তার মাথার মধ্যে গমগম করছে সেই আওয়াজ “ওঁখ্”। সমস্ত শরীর দুমড়ে তার বমি আসছে। সে উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
ভল্লা ফিরে এল হাতে দুটো বল্লম নিয়ে। দ্বিতীয় বল্লমটা ওই মৃত প্রহরীর। হানোর অবস্থা দেখে ভল্লা মুচকি হাসল, কিন্তু একটু রুক্ষ স্বরে বলল, “চ, ওঠ। ছেলেদের হয়ে গেছে, ঝটপট কেটে পড়ি”। ভল্লা হানোর হাত ধরে টেনে তুলে, তাকে টানতে টানতে বেড়ার ওপারে পৌঁছল। ছেলেরা তাদের অপেক্ষাতেই ছিল। ভল্লার নির্দেশে টানা-শকট নিয়ে তারা দ্রুত ঢুকে পড়ল ঘন জঙ্গলের মধ্যে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজ্যের সীমানার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের স্বস্তি নেই।
দলটি বেশ দ্রুতই হাঁটছিল। দণ্ড দুয়েকের মধ্যে তারা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ল গভীর জঙ্গলে। ভল্লা হাঁটছিল দলটির পিছনে। তার আশঙ্কা আস্থানের রক্ষীরা তাদের মৃত ও আহত সঙ্গীদের দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। ওরা প্রতিশোধ নিতে দৌড়ে আসতে পারে তাদের পিছনে। তাদের অনেকেই অশ্বচালনায় এবং রণপা ব্যবহারে কুশল। তারা পিছু নিলে, অচিরেই এই দলটিকে ওরা ধরে ফেলতে পারবে। সেই উদ্বেগে ভল্লা সতর্ক ছিল। তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় সজাগ। গভীর জঙ্গলের পাতার আড়ালে আকাশের দিকে তাকাল ভল্লা, চাঁদের অবস্থান দেখে তার মনে হল, রাত্রি প্রথম প্রহরের মধ্য যাম চলছে। হাতে খুব বেশি সময় নেই। গন্তব্যে পৌঁছেই অস্ত্রগুলির এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কাল প্রভাতে কারও চোখে না পড়ে।
ভল্লা মাঝে মাঝে চাপা স্বরে দলটিকে উৎসাহ দিচ্ছিল। আর বারবারই আগামী কর্মকাণ্ডের চিন্তায় ডুব দিচ্ছিল। পিছনের বিপদের কারণে সে সজাগ ছিল ঠিকই, কিন্তু একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত ছিল, প্রশাসন তাকে সাহায্য – সহযোগিতা করছে এবং করবে। সে অত্যন্ত জটিল একটি প্রশাসনিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। এ কথা জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়লে, তার মৃত্যুদণ্ড ছাড়া প্রশাসনের হাতে অন্য কোন উপায় থাকবে না। অতএব তার বিপদ যেমন পিছনে, তেমনি সামনেও। তীক্ষ্ণ নজরে সে লক্ষ্য রাখছিল হানো, শলকু এবং আহোকের দিকে। শলকু আর আহোক এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তাদের ধারণা দুটি মানুষকে তারা আহত করে, সংজ্ঞাহীন করেছে মাত্র। মানুষদুটির ক্ষত সেরে উঠলেই তারা সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু ভল্লা জানে, তারা দুজনেই মৃত। আপাতত শলকু আর আহোক তার প্রধান মাথাব্যথা নয়। ভল্লা হানোর আচরণে ভীষণ উদ্বিগ্ন। হানো এতক্ষণ দলের সঙ্গে দলের মধ্যে থেকেও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছে না। অপ্রকৃতিস্থ প্রলাপ বকছে। তার দুই চোখ রক্তবর্ণ। এই ছেলেটি তার এবং প্রশাসনের পক্ষে বৃহৎ বিপদের কারণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা।
ক্রমশ...