হাটের কেনাকাটা সেরে ডামল নদীর ঘাটে এসে বসল। এখান থেকে নদী পার হয়ে ওপাড়ে পৌঁছতে হবে তাকে। নদী পার হয়ে ক্রোশ দুয়েক হাঁটলেই পিপুলতলা গ্রাম। ওপাড়ের বেশ কিছু যাত্রী নিয়ে এদিকেই আসছে নৌকোটা। ভাদরের ভরা নদীতে স্রোত আছে ভালই – বিশেষ করে মাঝগাঙে। সেই স্রোত এড়াতেই ওপাড়ের ঘাট ছেড়ে, নৌকোটা নদীর আড়াআড়ি উজানে বয়ে গেল বেশ কিছুটা। এখন নৌকোটা এপাড়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে আসছে। দেখলে মনে হবে, এ পাড়ের ঘাটটা যে ও পাড়ের সোজাসুজি উল্টোদিকে – সে কথা নাইয়া যেন ভুলে গেছিল। বহতা নদীর ঘোলাটে সবুজ জলের দিকে ডামল তাকিয়ে রইল।
ঘাটের পইঠাতে পা ঝুলিয়ে ছজন হাটুরে ছোকরা গাঁজা খাচ্ছিল। তাদের হাতে হাতে ঘুরছিল জ্বলন্ত কলকে। নদীর আঁশটেগন্ধী হাওয়ার সঙ্গে ডামলের নাকে আসছিল গাঁজার ধোঁয়ার গন্ধও। একটু বিরক্ত হচ্ছিল ডামল, কিন্তু কিছু করার নেই। এ দেশের ছেলেপিলেরা গাঁজার নেশায় পোক্ত না হতে পারলে সাবালক হয় না। বোধহয় সে অন্যতম ব্যতিক্রম। তার বাবাকেও সে কোনদিন নেশা করতে দেখেনি। হয়তো সে কারণেই নেশার ব্যাপারে তার কোনদিনই কোন আগ্রহ জন্মায়নি। কিন্তু সে দেখেছে গাঁজার আসরে বসা, মানুষগুলির মধ্যে নিবিড় একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। এমন কি নেশার টানে আসা অচেনা অজানা রসিক মানুষও সেই আসরে যোগ দিতে চাইলে, সকলেই সাগ্রহে অনুমতি দেয়। এবং কলকের প্রসাদ আস্বাদনের মধ্যে অচেনা লোকটিও হয়ে ওঠে পরম মিত্র।
এ ব্যাপারে মারুলা রীতিমতো অভিজ্ঞ। হতভাগার নেশা নেই, কিন্তু প্রয়োজনে এরকম গাঁজার আসরে সে অনায়াসে ভিড়ে যেতে পারে। কলকেটা তার হাতে দু-তিনবার ঘুরতে না ঘুরতেই, সে আসরের লোকদের থেকে অচেনা গ্রামের হাঁড়ির খবর বের করে আনতে পারে।
মারুলার কথা মনে হতেই ডামল কিছুটা আনমনা হয়ে গেল। হতভাগাটা এখন কোথায়? বাড়ি এসেছে? নোনাপুরের কী সংবাদ? রতিকান্তকে শেষ পর্যন্ত খাসি করতে পেরেছিল মারুলা? কমলিমা, রামালি, কুসিরা, অন্যান্য ছেলেরা - কেমন আছে? প্রায় সাতমাস সে নোনাপুরে ছিল। ভালো-মন্দ মিলিয়ে ওখানকার লোকগুলোর সঙ্গে সে বড্ডো বেশিই জড়িয়ে পড়েছিল। কারণ সত্যি বলতে, পনের বছর বয়সে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে তার বাবা যেদিন থেকে তাকে এই রাজ কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল, তারপর থেকে, সে নিজের গ্রামেই একসঙ্গে টানা সাতমাস থাকেনি।
সে বাড়ি এসেছে জষ্টির শেষ দিকে। আড়াই মাসের ওপর হতে চলল। তার কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে আসার মাস খানেক আগেই। বাড়ি ফিরে সদ্যজাতা শিশুকে প্রথম কোলে নিয়ে তার চোখে জল চলে এসেছিল। সে অশ্রু আনন্দের না কষ্টের – সে কথা আজও সে বুঝতে পারেনি। প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার আনন্দ তো ছিলই। কিন্তু কষ্টও ছিল। নিজের প্রথম সন্তানের জন্মের মতো আশ্চর্য এক ঘটনার মুহূর্তে সে উপস্থিত থাকতে পারেনি। হুল এবং মায়ের চরম উদ্বেগের সময় পাশে থেকে পিতৃসুলভ কোন কর্তব্যই সে পালন করতে পারেনি। রাষ্ট্রের ব্যবস্থায় একজন অভিজ্ঞা ধাই এবং সেবিকা অবশ্য ছিল সর্বক্ষণ। সেবিকা মহিলা তার বাড়িতেই এখনও রয়েছে। প্রতি পক্ষান্তরে ধাইমা আসে শিশু ও তার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। একথা সত্যি কোথাও কোন ত্রুটি ঘটেনি। ত্রুটি যা কিছু ঘটেছে, সে সব তার অর্থাৎ কন্যার পিতার পক্ষ থেকেই।
সেদিন ডামলের মনে হয়েছিল, এরকম কাজের তার কী প্রয়োজন? যে কাজের জন্যে সে নিজের পরিবার, নিজের সন্তানের পাশে সময়মতো থাকতে পারে না? কিসের জন্যে সে ছুটে চলেছে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে? তার পরিবারের সুখ-শান্তি-নিরাপত্তার জন্যেই তো? গ্রাম প্রধানকে বলে এই গ্রামে কিছু জমি নিয়ে – সে যদি অন্যান্য গ্রামবাসীদের মতো চাষবাস শুরু করে – অনায়াসে সে পেয়ে যেতে পারে নিশ্চিন্ত সুস্থির একটা জীবন। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সমান ভাগীদার হয়ে সে সর্বদা থাকতে পারবে, তার এই ছোট্ট সুন্দর পরিবারের সঙ্গে।
একথা সে আর কাউকেই বলেনি, একমাত্র হুলকে ছাড়া। শুনে হুল অনেকক্ষণ কিছু বলেনি, তাকিয়ে ছিল ডামলের চোখের দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “চাষবাসের কাজ তোমারে মোটেই মানাবে গো...।
অবাক হয়ে ডামল একটু জেদ নিয়ে জবাব দিয়েছিল, “কেন? মানাবে না কেন? গোটা রাজ্য জুড়ে এত লোককে মানাচ্চে, আর আমি কোন রাজার ব্যাটা এয়েচি?”
চোখের দৃষ্টিতে ঈষৎ ধমক দিয়ে বিরক্ত হুল বলল, “ও আবার কী কতা? এর মধ্যে বাবাঠাকুরকে টানচ কেন?” ডামল একটু থতমত খেয়ে বলল, “বাবাকে আবার কখন টানলাম?”
“বারে, ওই যে বল্লে, আমি কোন রাজার ব্যাটা?”
“বোজো, বাবাকে টানব কেন? ও একটা কতার কতা…”
খুব গম্ভীর স্বরে হুল বলল, “অমন কতার কতাও বলতে নেই, ঠাকুর পাপ দেন”।
ডামল হেসে ফেলে বলল, “ওই দ্যাক, তোর মেয়ে কেমন মা-সোহাগী হয়েচে – পা ছুঁড়ে আমাকে লাথি মারল। তুই যে আমার ওপর রেগে গেচিস, এইটুকুনি মেয়েও বুজে ফেলেচে”।
ফিক করে হেসে হুল বলল, “মা-সোহাগী না হাতি। যবে থেকে মেয়ে তার বাপকে পেয়েচে – তখন থেকেই সে বাপকে চোকে হারাচ্চে…”।
ডামল মেয়ের ছোট্ট নাকে নাক ঘষতে, মেয়ে হাঁ করে চেঁটে দিল ডামলের থুতনি। খিলখিল করে হাসল ডামল, এবং ফোকলা মুখে হাসল ওদের কন্যাও। ডামল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মেয়ের মুখের দিকে, চোখের দিকে। আত্মজার মুখের এই হাসি, তার দুই চোখের এমন নিষ্পাপ নির্ভরতা ছেড়ে সে কোথায় ঘুরে বেড়াবে শহরে শহরে, গ্রামে-প্রান্তরে, বনে-বাদাড়ে? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস? ডামল হুলকে জিজ্ঞাসা করল, “তোর কেন মনে হচ্চে চাষ-বাস আমাকে মানাবে না? ঘরেই থাকব, চাষবাস করব, চোখের সামনে দেখব তিল তিল করে মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠা। দুজনে মিলে মেয়েটারে খুব আদর-যত্নে বড়ো করে তুলব রে, হুল”।
হুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “গেরামের সারাদিনের কটকেনা নিয়ে থাকলে অধিকাংশ মানুষই কেমন জানি ছোট মনের হয়ে যায়। ঘাটে নাইতে গিয়ে মেয়ে-বউদের মুখে, গ্রামের পুরুষদের কিত্তিকলাপ শুনি তো…। অনেকেই গাঁজা খায়, মদ খায়। চণ্ডীমণ্ডপে বসে হয় গুটি খেলে, নয় এর নামে তার নামে চুকলি কেটে সময় কাটায়। করবেই বা কী? চাষবাসের কাজ মানে তো - বীজ-বোনা আর ফসল কাটা – বছরে সাকুল্যে চারমাস কি বড়ো জোর পাঁচ মাস? বাকি সময় - সকাল থেকে রাতের দু প্রহর পর্যন্ত গাব-জ্বাল দেয়া ছাড়া করবে কী লোকগুলো”? একটু থেমে হুল আবার বলল, “সত্যি-মিথ্যে জানি না, শুনেছি দু-একজন টাকার কুমীর আবার নগরে যায় – নানান কুকিত্তি করতে”।
ডামল কোন কথা বলল না। রেশমী চুলে ভরা মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মন দিয়ে সে হুলের কথা শুনছিল। হুল আড় চোখে তাকিয়ে দেখল ডামলের গম্ভীর মুখটা। তারপর আবার বলল, “তোমার কাজের কতা কিচু কিচু শুনেচি ধাইদিদির কাচে। তুমি কোতায় কোতায় ঘুরে বেড়াও। রাজধানীর কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে তোমার চেনাশোনা। তুমি না থাকলে, ফুলকিদিদি নিয়মিত আসে আমাদের দেখাশোনা করতে। ধাইদিদি আর বিম্লাকে তো ফুলকিদিদিই সঙ্গে করে এনেচিল। ও সময় এ গাঁয়ের ধাইমাও এয়েচিল, পাড়ার বউদের সঙ্গে। কিন্তু ধাইদিদির সঙ্গে কতাবাত্তা বলে সে একেবারে যেন বোবা হয়ে গেল। সারাক্ষণ সঙ্গে ছিল, কিন্তু একটাও রা কাড়েনি। অবিশ্যি ফুলকিদিদি তার পাওনাগণ্ডা পুরো মিটিয়ে দেওয়াতে ধাইবুড়ি খুব খুশি হয়েচে। মেয়েকে বুকে নিয়ে আশীব্বাদ করেচে খুব”।
ডামল কিছু বলল না দেখে, একটু পরে হুল বলল, “এই সব দেখেশুনে গাঁয়ের মানুষরা তোমারে এখন যেমন সমীহ করে। তুমি ওদের মতো চাষবাস করলে, কিংবা ওদের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপে বসে দুবেলা গুটি চালাচালি করলে কী তোমারে আর সে মর্যাদা করবে? তোমারেও ওদের দলে টেনে নামানোর তরে ওরা সব্বাই উঠে পড়ে লাগবে না?”
ডামল তবুও কোন উত্তর দিল না। গোঁজ হয়ে বসেই রইল বিছানার একধারে। এরপর হুল আর কথা না বাড়িয়ে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অস্ফুটে বলেছিল “মায়ের ওপর দিয়ে কদিন বড্ডো ধকল গেচে, আমি আসচি...”।
এই নিয়ে ডামল আর কথা বাড়ায়নি। হুলের কথায় সে কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল ঠিকই – কিন্তু এটাও ঠিক গ্রামের মানুষরা তার সঙ্গে ভাবসাব করার জন্যে মুখিয়ে বসে আছে তাও নয়। তার বাবার সময় থেকেই গ্রামের পাঁচজনের সঙ্গে তাদের পরিবারের একটা দূরত্ব ছিলই। বড়ো হয়ে বাবার হাত ধরে সেও রাজকাজে যোগ দেওয়ার কারণে সে দূরত্ব বেড়েছে বই কমেনি। সেই দূরত্বের কারণ তাদের কাজের গোপনীয়তা। আর্থিক স্বাচ্ছল্য। বিপদে আপদে প্রতিবেশীদের ওপর নির্ভরশীল না থাকা। অর্থাৎ এই রাজকাজ শুধু নিজের পরিবার নয়, গ্রামের মানুষদের থেকেও তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ডামল দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করেছিল – অনেক হয়েছে, আর নয় – এভাবে চলতে পারে না। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে স্বাভাবিক হৃদ্যতা গড়ে তুলতেই হবে – আর কাল হরণ নয়, এবার তেড়েফুঁড়ে লাগতে হবে।
প্রায় পক্ষকাল লেগেছিল গ্রামের বয়স্ক এবং তার সমবয়সী মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে। যে পরিচয়ে বিকেলের দিকে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে সকলের সঙ্গে সুখদুঃখের আলাপ আলোচনা করা যায়। কটা দিন বেশ ভালই লাগছিল ডামলের। তারপর থেকেই বেরিয়ে আসতে লাগল ওদের আসল রূপ। হয়তো তার প্রতি সমীহবশতঃ অথবা চক্ষুলজ্জার কারণে প্রথম কয়েকটা দিন তারা নেশাটেশা করেনি। কিন্তু নেশাখোর মানুষ কতদিন আর অমন সুন্দর বৈকালগুলোকে বিফলে যেতে দেবে? একদিন তারা সসঙ্কোচে প্রস্তাব করেই বসল, “বাইরে বাইরে খুব ঘোরাঘুরির কাজ, তা ভায়ার নিশ্চয়ই ঘাসের নেশায় কোন আপত্তি নেই”? ডামল হেসে ফেলে বলেছিল, “নাঃ, কোনদিনই করিনি, করার ইচ্ছেও নেই”। “বেশ, বেশ, খুব ভালো। কিন্তু আমরা যদি সকলে বাবার প্রসাদ একটু পেতে ইচ্ছে করি, তাতে ভায়ার কোন আপত্তি হবে না আশা করি”। ডামল উত্তর দিয়েছিল “আমার আবার আপত্তি কিসের? আপনারা শুরু করুন”।
সেদিন ডামল আপত্তি করলেও ওরা নিরস্ত হত কি? হত না। বাবার-প্রসাদ বঞ্চিত কয়েকটা দিন যে তাদের কী ভাবে কেটেছে – সে তারাই জানে। আপত্তি করলেও সেদিন তারা নেশা করতই। গাঁজার কলকে সকলের হাত ঘুরতে ঘুরতে নিমেষে যেমন শেষ হচ্ছিল, তেমনই ভরেও উঠছিল তৎক্ষণাৎ। নেশার সঙ্গে সঙ্গে আসর জমতেও সময় লাগল না। বদলে যেতে লাগল তাদের ভাষা এবং আচরণ। সে ভাষা যেমন অশ্রাব্য, তেমনি কদর্য তাদের অঙ্গভঙ্গি। কেউ কেউ অশ্লীল আদিরসের গল্প বললেই – অন্যরা ফেটে পড়ছে উল্লাসে। ডামল দেখল এবং শুনল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে সরে এল সেখান থেকে। এমন মানুষজনের সঙ্গী হওয়ার থেকে নদীর নির্জন ঘাট তার কাছে অনেক শান্তির। হুলই সঠিক চিনেছে, গ্রামের এই পরিবেশকে এবং তার কন্যার বাপটিকেও।
ডামলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল। কাঁধে হাত রেখে তার ডানপাশে এসে কেউ বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মারুলা! অবাক আনন্দে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, জিজ্ঞাসা করল, “তুই এখানে? কোত্থেকে এলি, যাবি কোথায়?”
মারুলা বলল, “আসছি বাড়ি থেকে। যাবো তোর বাড়ি। আমাকে দেখে তেমন খুশি হলি না মনে হচ্ছে?”
“শালা তোর তাই মনে হচ্ছে? কিন্তু আমি এখানে বসে আছি তুই জানলি কী করে?”
মারুলা স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলল, “অচেনা মানুষ দেখেই হাটের মোদকমশাইয়ের বেজায় কৌতূহল। জিজ্ঞাসা করল, কোথা থেকে আসা হচ্ছে, যাওয়া হবে কোথায়? তোর আর তোর গ্রামের নাম বলতেই বলল, একটু আগেই ঘাটের দিকে এসেছিস...চলে এলাম। দেখলাম জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনার জাবর কেটে চলেছিস”।
ওদের কথার মধ্যেই নৌকোটা পাড়ে এসে ঠেকল। ডামল হাসল, বলল, “চল। যেতে যেতে কথা হবে”।
দুপুরের খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম সেরে মারুলাকে নিয়ে ডামল গেল তাদের বাড়ির পিছন দিকে। বিরাট এক জারুল গাছের ছায়ায় গিয়ে দুজনে বসল।
ডামল বলল, “হুঁ। রাজধানী থেকে কী বার্তা নিয়ে এলি? একটু ঝেড়ে কাশ তো!”
“মাস খানেক পরে বেরোতে পারবি?”
“এবার কোন দিকে?”
“পূবদিকে। পাশের রাজ্যের এক মাকাল অস্ত্র কিনতে চায়। হতভাগা, ওই রাজ্যের এক বিষয়াধিকারিকের ভাগ্নে। বটতলি গ্রামের কাহিনী শুনে তার বীরত্ব চেগে উঠেছে। বিদ্রোহ করতে চায় নিজেরই মামার বিরুদ্ধে”।
“মামা বিষয়াধারিক মানে, সে তো রাজবংশেরই একজন। মামাকে শেষ করে ভাগ্নে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার সাধ হয়েছে? কিন্তু সাধ্য আছে?”
“তা তো জানি না রে। আমাদের লখাই - এদিকের আস্থানের আধিকারিককে এই গোপন বার্তা পাঠিয়েছে। সে সংবাদ গিয়েছে রাজধানীতে। নোনাপুর থেকে ফেরার পথে যখন রাজধানী গিয়েছিলাম, মান্যবর নিবাত বলেছিলেন – বর্ষার পরে তুমি ডামলের সঙ্গে যোগাযোগ করে – রাজধানীতে আসবে। তারপর দুজনে মিলে লেগে পড়ো। আরও বললেন, এবারের কর্মকাণ্ডে তোর নাম হবে চণ্ড”।
“তুই কবে ফিরেছিস, নোনাপুর থেকে?”
“এই তো মাস দেড়েক হল। ঘরে আর মন টিকছে না, শালা। শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে গতরে ঘুণ ধরে যাচ্ছে। ভাবছি আশ্বিনের পূর্ণিমা সেরে রাজধানী যাবো – তুই যাবি তো?”
মারুলার “শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে গতরে ঘুণ ধরে যাচ্ছে” কথাটা ডামলের মনে ধরে গেল বেজায়। বাড়ি আসার পর মাস খানেক বেশ ভালই লাগছিল – কিন্তু তার পর থেকেই তারও মন চঞ্চল হচ্ছিল ধীরে ধীরে। এভাবে শুয়ে বসে আর কতদিন? নিশিদিন অপেক্ষা করছিল রাজধানী থেকে কবে তার ডাক আসবে। মারুলার কথায় স্বস্তি পেল ডামল, কিন্তু সরাসরি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ওদিকের কী খবর? খাসি হয়ে রতিকান্ত খুশি?”
“বেশ বলেছিস, শালা” বেশ কিছুক্ষণ খিঁক খিঁক করে হাসল মারুলা, তারপর বলল, “রাজবৈদ্যদের লাগাতার চিকিৎসায় হতভাগার ঘা সারতে মাস দেড়েক লেগেছিল। শষ্পকের মুখে শুনেছি সে এখন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। দু বেলা ঘন্টা নাড়িয়ে পুজো করে। মুখে সর্বদা ঠাকুরদেবতাদের নাম। আমিষ খাবার ছোঁয় না, শাক-সব্জি, ঘাস-পাতা চিবোচ্ছে চারবেলা”। আবার কিছুক্ষণ খিঁক খিঁক হেসে বলল, “শালা এক পাপের প্রতিমূর্তিকে, পুণ্যের পথে ঠেলে দিলাম – আমার কি একটুও পুণ্য সঞ্চয় হবে না রে, ডামল”?
ডামলও হাসল, বলল, “সত্যিই ভাবা যায় না। আর ওদিকের কী খবর – কমলিমা, রামালি…”।
মারুলা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “ভালই আছে, রে সবাই ভালো আছে। কমলিমায়ের কথা মনে পড়লেই মনে কেমন একটা পাপবোধ আসে। অমন মানুষটাকে বহু বছর আগেই শোকে-তাপে পুড়িয়েছিলেন ঈশ্বর। এতদিন পরে আমরাও তাঁকে ভয়ানক আঘাত দিয়েছি। সেই সমস্ত ক্ষতে প্রলেপের ব্যবস্থা তুইই তো করে এসেছিলি, ডামল, তিনজনকে এক সুতোয় বেঁধে। রামালি আর কুসিকে বুকে নিয়ে কমলিমা ভালই আছেন”।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডামল কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রইল, একটু পরে বলল, “ওদিকে বটতলির ছেলেদের কী খবর – কিছু শুনেছিস?”
“আরেব্বাস রে, ওরা তো কাণ্ড বাধিয়ে ফেলেছে! ওখান থেকে বেরিয়ে আসার কয়েকদিন আগে রামালির মুখে শুনলাম। ওদিকের কোন এক আস্থানে আক্রমণ করে সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে এনেছে। বেশ কিছু রক্ষী এবং রক্ষীসর্দার মারা গেছে। এখানে আসার আগে বীজপুরে ছিলাম দুদিন। হাটের লোকজন দেখলাম খুব উত্তেজিত। খুব বাগ্বিতণ্ডা চলছে – একপক্ষ বলছে ঠিক করেছে, কতদিন মানুষ পড়ে পড়ে মার খাবে? আরেক পক্ষ বলছে, এভাবে রাজার বিরুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক নয়। তোমাদের অভাব-অভিযোগের কথা রাজাকে জানাও। তার উত্তরে প্রথম পক্ষ বলছে, রাজাকে পাচ্ছি কোথায় যে বলব? আমাদের কাছে রাজকর্মচারীরাই তো রাজা – ব্যাটারা চুরি করে আর দুর্নীতি করে আমাদের শেষ করে দিল”। মারুলা একটু থেমে আবার বলল, “বললে বলবি আমি বানিয়ে বলছি – প্রথম পক্ষের কাছে “ভল্লা” এখন বীর, যে ন্যায়ের পক্ষে লড়ে প্রাণ দিয়েছে। আর দ্বিতীয়পক্ষের কাছে “ভল্লা” ডাকাত – যে ছোকরাদের মাথাগুলো চিবিয়ে খেয়ে গেছে”।
ডামল কোন কথা বলল না, দূরের মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। পশ্চিমদিকে সূর্য হেলে পড়েছে। পাখপাখালির দল ফিরে আসছে তাদের বাসায়। খুব শান্ত-নিরিবিলি চারদিক।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডামল বলল, “আবারও সেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। শান্তির জায়গাতে অশান্তি তৈরি করা। ঠিক আছে - আশ্বিনের কৃষ্ণা তৃতীয়ায় আমি রাজধানী পৌঁছে যাবো…ওখানেই তাহলে তোর সঙ্গে দেখা হবে?”
মারুলা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
ডামল একটু পরে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আমাদের কাজটা শুধু অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রি করা”?
“মনে হয় না। মান্যবর নিবাতের কথা শুনে মনে হল, বটতলির ছেলেদের মতোই এদের ছোকরাদেরও যুদ্ধ শেখাতে হবে। তা নাহলে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে করবে কি?”
“বটতলির ছোকরারা হল সাধারণ ঘরের ছেলে। রাজকর্মচারীদের ওপর তিতিবিরক্ত হয়েই ওরা একাজে নেমেছে। কিন্তু এ তো বলছিস বিষয়াধিকারিকের ভাগ্নে – বড়োলোকের লালু ছোকরা। সে কী করে বিদ্রোহ করার ফন্দী আঁটছে – আর তার কথা শুনে সাধারণ ছেলের দল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমে যাবে? ব্যাপারটা ঠিক বুঝছি নারে, মারুলা”।
ক্রমশ...