এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • বিপ্লবের আগুন - পর্ব বারো

    কিশোর ঘোষাল
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৬ জুলাই ২০২৪ | ৫৯২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • [প্রাককথাঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ হোক কিংবা প্রাচীন রাজতান্ত্রিক সমাজ – বিদ্রোহ, বিপ্লব সর্বদাই প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। নিরীহ, অনুন্নত এবং প্রান্তিক মানুষরা যুগেযুগে কীভাবে উদ্বুব্ধ হয়েছিলেন এবং হচ্ছেন? তাঁরা কীভাবে এগিয়ে চলেন বিপ্লবের পথে? কীভাবে তাঁরা অস্ত্র সংগ্রহ করেন? কোথা থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন সেই বহুমূল্য অস্ত্রসম্ভার? যার শক্তিতে তাঁরা রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রাখার বারবার স্পর্ধা করেছেন? কখনও তাঁরা পর্যুদস্ত হয়েছেন, কখনও ক্ষণস্থায়ী সাফল্য পেয়েছেন। আবার কখনও কখনও প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রকে তাঁরা পরাস্ত করে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতেও পুরোন বিদ্রোহ-বিপ্লবের আগুন নেভে না কেন? রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদতেই কি এ বিপ্লব চলতে থাকে আবহমান কাল ধরে?]

    ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়


    ১২




    যাবতীয় অস্ত্র-শস্ত্র রাখার জন্যে ভল্লা তার নির্বাসন কুটির থেকে কিছুটা দূরে দুটি বিশাল গাছ নির্দিষ্ট করেছিল। সেই গাছের মাঝামাঝি উচ্চতায় দুটি শক্তপোক্ত মাচানও সেই বাঁধিয়ে রেখেছিল। ঘন পাতার আড়ালে সে মাচানের অবস্থান যথেষ্ট গোপন। ভূমি থেকে উপরের দিকে তাকালে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তার সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। গাছগুলিতে গুটি গুটি ফল হয়। সে ফল মানুষ কিংবা বাঁদরের ভক্ষ্য নয়। অতএব বাইরের উপদ্রব মুক্ত। হেমন্ত বা শীতেও সে গাছদুটির পাতা ঝরে না, চিরহরিৎ।

    মধ্যরাত্রি শেষের দণ্ড দেড়েক আগেই সেই গন্তব্যে পৌঁছে, টানা-শকটদুটি খালি করে সমস্ত অস্ত্র সম্ভার উঠে গেছে, দুই গাছের দুই মাচায়। অতএব এতক্ষণে অস্ত্র অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করল ভল্লা। সকলকে ডেকে চাপা স্বরে বলল, “ছেলেরা, আমাদের আপাততঃ কাজ শেষ, এই স্থান ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে আমরা দণ্ড দুয়েক বিশ্রাম নেব। তারপর ঊষাকালে যে যার বাড়ি ফিরে যাবি”। ছেলেরা ভল্লাকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে নিজেদের মধ্যে নানান কথাবার্তা বলতে লাগল। সকলেই প্রথম এই অভিযানের সাফল্যে গর্বিত, উচ্ছ্বসিত। একজন বলল, “ভল্লাদাদা, রাজার রক্ষীরা কোন ভুট্টার রুটি খায় গো? গুটিচারেক লোক ছাড়া কেউ আটকাতেই এল না! এই রক্ষীদের নিয়ে রাজ্য শাসন চলে?”

    ভল্লা হাসল, কোন উত্তর দিল না। অন্য আরেকজন বলল, “সত্যিই, আস্থান থেকে অস্ত্রশস্ত্র লুঠ করা যে এত সহজ হবে, কে জানত? যাবার সময় আমার তো রীতিমতো হাত-পা কাঁপছিল। ফুস্‌, গিয়ে দেখলাম কিছুই না, ছেলের হাতের মোয়া”!

    ভল্লা হাসতে হাসতে বলল, “এই অভিযানটাকে তেমন গুরুত্ব দিস না। এর পরের অভিযানগুলোতে টের পাবি, লড়াই কাকে বলে। কী ভাবে সত্যিকার লড়াই লড়তে হয়। এসব কথা এখন থাক। মন থেকে এই অভিযানের কথা সম্পূর্ণ সরিয়ে দে। বাড়ি গিয়ে বাবা-মা ভাইবোন যখন প্রশ্ন করবে কী জবাব দিবি, সেটা এখনি ঠিক করে নে”।

    “কেন? তুমি গত পরশুই বাড়িতে বলতে বলেছিলে, আমরা রাম-কথা শুনতে যাবো, পাশের রাজ্যে। আমরা সেকথা বলেই তো এসেছি”।

    ভল্লা সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, “রামায়ণের কাহিনী বিশাল, তার মধ্যে কোন কাহিনী নিয়ে আমরা রামকথা শুনলাম, সেটা ভেবেছিস? নাকি নিজের নিজের বাড়ি গিয়ে সকলে আলাদা আলাদা গল্প শোনাবি? কেউ বলবি হরধনু ভঙ্গ, কিংবা বালি বধ, কিংবা সীতা হরণ – কোনটা? কিশনা ধর তুই তোর মাকে বললি, জটায়ূ বধের গল্প, আর মিকানি তার মাকে বলল মারীচবধের গল্প। এবার তোদের দুই মায়ের যখন দেখা হবে, তোদের মিথ্যে কথা ধরতে তাঁদের খুব সময় লাগবে কি?”

    কেউ কোন উত্তর দিতে পারল না। ভল্লা হাসল, বলল, “আবারও বলছি, আজকের এই অভিযানের কথা ভুলে যা। নিজেদের মধ্যে এখন রামকথা নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা কর। আমি যতদূর জানি, গতকাল রাত্রে হরধনু ভঙ্গ নিয়ে রামকথা হয়েছে। অতএব তোদের সবাইকে হরধনু ভঙ্গ নিয়েই কথা বলতে হবে। এর আগে কোথাও যদি দেখে বা শুনে থাকিস, সেটাকে সকলে মিলে মনে করার চেষ্টা কর। নইলে সবাই – সব্বাই - ধরা পড়ে যাবি। শুধু এ গাঁয়ে নয় আশপাশের গাঁয়েও ঢি ঢি পড়ে যাবে। আমি সুকরার চারজনকে রামকথা শুনতে পাঠিয়েছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের চলে আসা উচিৎ”।

    কিশনা বলল, “তারা এসে কী করবে?”

    “আজকের রামকথা তারা কেমন দেখল, কী দেখল, সে কথা তোদের বলবে। বিষয়টা কেন গুরুতর তোরা বুঝতে পারছিস না। আস্থানার অস্ত্র লুঠের সংবাদ আগামী কাল দুপুর থেকেই গ্রামের সকলে জেনে যাবে। তখন তোদের মিথ্যে গল্পের সঙ্গে আস্থান লুঠের যোগসূত্র বুঝে যাবে তোদের গ্রামের কুকুর-ছাগলগুলোও”!
    বিষাণ বলল, “আমি এর আগে দু বার হরধনু ভঙ্গ দেখেছি…তাহলে সে নিয়েই আলোচনা হোক”।

    ভল্লা হেসে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক। আরও একটা ঝুঁকির কথা বলি। ওই রামকথা শুনতে আশেপাশের গ্রাম থেকেও কিছু লোক গিয়ে থাকতে পারে। তারা তোদের কাউকে কাউকে হয়তো চেনে। তাদের কেউ বলতেই পারে – আমি তো কাল গেছিলাম, কই তোদের তো দেখলাম না! কোথায়, কোনদিকে বসেছিলি? সে বিপদের কথাও ভেবে রাখিস”।

    ছেলেরা ভল্লার কথায় অবাক হয়ে নির্বাক হয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভল্লা আবার হেসে বলল, “এই অভিযানটা তোদের ছেলের হাতের মোয়া মনে হচ্ছে তো? তার কারণ আমার কাছে খবর ছিল, গতকাল সন্ধ্যে থেকে আস্থানে পূর্ণিমা-উৎসব পালন করছে। রক্ষীদের অধিকাংশই রসের নেশায় মাতাল ছিল। সেই সুযোগটাকেই আমরা কাজে লাগিয়েছি মাত্র”। একটু থেমে আবার বলল, “এই অভিযান তখনই সফল হবে, যদি তোদের একজনও কেউ ধরা না পড়িস। মনে রাখিস, একজনও কেউ ধরা পড়লে, তার পেট থেকে সকলের নাম-ধাম বের করে নেওয়াটা রাজরক্ষীদের কাছে – ছেলের হাতের মোয়া”।

    ভল্লা ছেলেদের মুখ আতঙ্কের ছাপ দেখতে পেল, বলল, “ভয় পাস না। চিন্তা কর, ভাবনা কর। আর যেমন যেমন বললাম, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করে নে – সকলের বক্তব্য যেন একই হয়”।

    ভল্লা উঠে দাঁড়াল। চারপাশটা একবার দেখে আসা জরুরি। কথা বলতে বলতেও সে হানো, শলকু আর আহোকের দিকেও লক্ষ্য রাখছিল। হানোর অবস্থা এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। বরং তার পাগলামি বাড়ছে। ভল্লা হানোর কাছে গেল, তার কাঁধে হাত রেখে অনুভব করল ধূম জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। ভল্লার ভুরু কুঁচকে উঠল। একটু পাশে সরে এসে সে চিন্তা করতে লাগল, কী করে হানোকে নির্বিঘ্নে সরিয়ে ফেলা যায়। তার পাশে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল রামালি। “ভল্লাদাদা, হানোর জন্যে আমরা সবাই মনে হচ্ছে ডুববো”।
    ভল্লা তীক্ষ্ণ চোখে রামালির দিকে তাকাল, বলল, “হুঁ। কিন্তু কী করা যায়?”

    “সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর তো কোন পথ দেখছি না”।

    ভল্লা ভীষণ অবাক হল। রামালির মতো ছেলের মুখে এমন নির্বিকার সিদ্ধান্তের কথা, ভল্লা আশা করেনি। রামালি তার দলে ভিড়েছে প্রথম দিন থেকে। যে কোন বিষয় জানার এবং শেখার জন্যে তার যে তীব্র নিষ্ঠা, সেটা ভল্লার চোখ এড়ায়নি। কিন্তু ছেলেটার চোখেমুখে কোনদিন কোন উচ্ছ্বাস, আনন্দ, কষ্টবোধ সে লক্ষ্য করেনি। সে শুনেছে শৈশবে বাপ-মা মরা ছেলেটি বড়ো হয়েছে কাকা-কাকিমার সংসারে। রামালির প্রতি তার কাকার স্নেহ ও সহানুভূতি থাকলেও, কাকিমা তার ওপর সর্বদাই খড়্গহস্তা। ভল্লার মনে হয়েছে আশৈশব নানান অত্যাচার, বঞ্চনা এবং নির্স্নেহ - তার মানসিক চরিত্রটাকেই এভাবে বদলে দিয়েছে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে রামালির আশ্চর্য উদাসীন ব্যবহার চমকে দিল ভল্লাকেও।
    ভল্লা জিজ্ঞাসা করল “এখানে এতজনের সামনে, কী ভাবে?”

    এতটুকু সময় না নিয়ে রামালি বলল, “সাপ। দুর্ঘটনা – অপঘাত মৃত্যু। এই জঙ্গলে বেশ কিছু সাপের বাসা আমার জানা আছে – কেউটে, গোখরো”।

    অন্ধকারে, গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া চাঁদের ঝিলিমিলি আলোয় ভল্লা রামালির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। রামালি বলল, “তুমি অনুমতি দিলেই…”। ভল্লা তাকিয়েই রইল রামালির দিকে। একটু পরে রামালি দৌড়ে মিশে গেল অন্ধকার জঙ্গলে। ভল্লা সরে গেল অন্য দিকে। ছেলেরা নিজেদের মধ্যে হরধনু ভঙ্গ প্রসঙ্গে গবেষণায় নিবিষ্ট। ভল্লা সবার মুখই দেখতে লাগল ঘুরে ঘুরে। এখন হানোকে সে আর দেখছে না। তার চোখ বারবার ফিরে আসছে শলকু আর আহোকের মুখে। দুজনেই এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু তাও সে স্বস্তি পাচ্ছে না। এই সময়েই সুকরার চারজন ছোকরা এসে যোগ দিল ওদের দলে, ভল্লা যাদের রামকথা শুনতে পাঠিয়েছিল। ওদের দেখে ভল্লা বলল, “যা ওরা সবাই রামকথা নিয়েই আলোচনা করছে, ওদের ভাল করে বুঝিয়ে দে, তোরা ঠিক ঠিক কেমন দেখলি”।

    তার পরিকল্পনায় এখনও পর্যন্ত কোন ত্রুটি ঘটেনি – শুধু হানোর ব্যাপারটা ছাড়া। হানোর মতো উদ্যোগী এবং কর্মঠ এক যুবক যে মানসিকভাবে এত দুর্বল – সেকথা ভল্লা বুঝতে পারেনি। ভল্লা এখনও পর্যন্ত তার এই ভুলটুকুই খুঁজে পেয়েছে – তবে ভুলটা সামান্য নয়। এর ফল হতে পারে মারাত্মক।

    প্রত্যূষের দণ্ডখানেক পার হওয়ার পরেও ভল্লা কারও চোখেমুখে ক্লান্তি বা ঘুমের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না। প্রায় সারারাত পালাগান বা রামকথা শুনে, কবে কোন লোকের চোখেমুখে বিনিদ্র-ক্লান্তির লক্ষণ ফোটে না? কিন্তু এদের চোখে মুখে কোথাও ক্লান্তির লেশমাত্র নেই! প্রথম অভিযান এমন নির্বিঘ্নে সফল হওয়ার আনন্দে তাদের মন এতই আত্মতুষ্ট এবং গর্বিত যে তাদের ক্লান্তি নেই? ঘুম আসছে না? এদিকে ভোর হতেও আর দেরি নেই – ভোরে সকলের ঘরে ফেরা উচিৎ। ভল্লা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ছেলেরা এবার তোদের ঘরের দিকে রওনা হওয়া প্রয়োজন। এখনই রওনা হলে ভোরের দিকে গ্রামে পৌঁছতে পারবি। আশা করি নিজেদের মধ্যে আলোচনায় রাত্রের হরধনু-ভঙ্গ পালার প্রতিটি ঘটনা সকলেই জেনে গিয়েছিস। বাড়িতে জিজ্ঞাসা করলে সকলেই একই রকম কথা বলতে পারবি নিশ্চয়ই”।

    দলের ছেলেদের অধিকাংশই বলে উঠল, “পারবো, তুমি চিন্তা করো না, ভল্লাদাদা।“

    “বাঃ বেশ। আরেকটা কথা বলে রাখি। আগামীকাল তোদের বাবা-জ্যাঠারা হয়তো জেনে যাবেন, আস্থানে ডাকাতি হয়েছে। হয়তো তাঁদের মুখে শুনবি – দু তিনজন রক্ষীর মৃত্যু সংবাদও!”

    “কী বলছো, ভল্লাদাদা? তিনজন রক্ষী মারা গেছে ? আমাদের কেউ করেছে নাকি?” ছেলেরা আঁতকে উঠল ভয়ে।

    ভল্লা বলল, “হতে পারে। নাও হতে পারে। অনেক সময় প্রশাসন থেকে মিথ্যে কথাও বলা হয়, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে”।

    ছেলেরা ভল্লার মুখের দিকে আতঙ্কভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ভল্লা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এরকম উড়ো খবর শুনে বাবা-জ্যাঠাদের সামনে অমন ভয়ে শিউরে উঠবি নাকি? ডাকাতির সংবাদ শুনে, সবাই অবাক হয়ে যেমন “তাই নাকি?” বলে, সেরকমই বলবি। খুনের সংবাদ শুনেও একই ভাবে বলবি “বলছো কী? ইস্‌ কি ভয়ংকর”! ব্যস। তার বেশি বা কম নয়”।

    ভল্লা একটু সময় নিল, তারপর আবার বলল, “একটা কথা মনে রাখিস, শুধু অভিযান করলেই বীর হওয়া যায় না। তার পরেও প্রতিটি পা ফেলতে হয় বুদ্ধি আর বিবেচনা করে। এতটুকু ভুল কথা, সামান্য বেঠিক আচরণে তোরা সবাই বিপদে পড়ে যেতে পারিস। আশা করি এই একটা মাত্র অভিযান করেই তোদের কেউই চাইবি না, রাজার কারাগারে সারাজীবনটা কাটুক। প্রকৃত বীরকে অনেক পথ চলতে হয় অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে। এবার রওনা হয়ে পর। আর দেরি করিস না”।

    ছেলের দল উঠে দাঁড়াল। শলকু বলল, “আজকে আর সকালের মহড়ার কথা বলো না, ভল্লাদাদা”।

    ভল্লা হেসে ফেলল, শলকুর কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোদের মহড়া আজ বন্ধ। তবে আমি আজ সকালের দিকে চাষিভাইদের সঙ্গে মাঠে থাকবো। ওদের কাজকর্ম দেখাশোনা করবো। বাঁধটার আরও কিছু মেরামতি দরকার”।

    শলকু বলল, “তুমিও তো সারারাত ঘুমোওনি। আজ বিশ্রাম নিতে পারতে”।

    ভল্লা হেসে বলল, “কে বলল আমি কাল সারারাত ঘুমোইনি? আমি তো রামকথা দেখতে যাইনি। তোরা কাল রাত্রি দেড়প্রহরে বেরিয়ে যেতেই, আমি রান্নাবান্না করেছি, তারপর খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছি…। তোদের কারও সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি...।”

    ভল্লার কথা শেষ হল না, একজন দৌড়ে এসে চেঁচিয়ে বলল, “ভল্লাদাদা, হানোর কোন সাড়াশব্দ নেই, চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে, মারা গেছে”।
    ভল্লা অবাক হয়ে বলল, “কী যাতা বলছিস? কই চল তো দেখি”।

    সকলে হানোর পড়ে থাকা শরীরটার দিকে দৌড়ে গেল। ভল্লা উবু হয়ে বসে নাকের নিচে আঙুল রাখল, কবজি ধরে নাড়ি পরখ করল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, না প্রাণ নেই। হঠাৎ তার চোখ গেল হানোর বাঁ কানের নিচেয় – কালচে নীল হয়ে রয়েছে জায়গাটা। তার মাঝখানে দুটো সূক্ষ্ম ছিদ্র – সাপের ছোবল। ভল্লা কিছু বলল না। কিছু বলার দরকারও ছিল না। বছরে এমন একটা-দুটো সর্পদংশনের ঘটনা গ্রামের ছেলেরা ছোটবেলা থেকে বহুবার দেখেছে। তবে সেগুলো সাধারণতঃ হয় পায়ে, অন্ধকারে পথ চলতে গিয়ে, অথবা জমিতে নিচু হয়ে কাজ করতে গিয়ে, হাতে। সে সব ক্ষেত্রে কখনও সখনও মানুষ বেঁচে যায়। কিন্তু হানোকে ছুবলেছে – মোক্ষম জায়গায়, বেঁচে ফেরার কথাই ওঠে না।

    কিছুক্ষণ পর ভল্লা বলল, “চটপট একটা হালকা মাচা বানিয়ে, হানোকে সাবধানে নিয়ে যা। ছেলেটা সবে তৈরি হয়ে উঠছিল রে…এভাবে বেঘোরে মারা পড়ল…” ভল্লার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।
    গাছের ডাল কেটে মাচা বানিয়ে চার জন ছেলে হানোকে কাঁধে চাপিয়ে নিল। ছেলেদের সকলের মুখই এখন বিষণ্ণ। ক্লান্ত। অবসন্ন। এতক্ষণ তাদের মনে যে উত্তেজনা ও আনন্দ ছিল, সে সব মুছে দিয়ে গেল হানোর এই ভয়ংকর মৃত্যু। ভল্লা তাকিয়ে রইল দলটার দিকে। দলের পিছনে ছিল রামালি। রামালির সঙ্গে ভল্লার ক্ষণিকের চোখাচোখি হল। রামালির মুখও এখন আশ্চর্য অবসন্ন।

    ভল্লা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া লক্ষ্য করল। তারপর মুখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে। এখনও অন্ধকার। পাখিরা ঘুম ভেঙে সবে ডাকতে শুরু করেছে। ভোরের বাতাস গাছের পাতায় পাতায় তুলছে মর্মর শব্দ।




    ক্রমশ...




    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৬ জুলাই ২০২৪ | ৫৯২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০৬ জুলাই ২০২৪ ১৮:০২534268
  • কীভাবে বিষ ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে খুনী বানিতে ফেলা হয় মানুষকে... 
    পড়ছি।
  • Eman Bhasha | ০৭ জুলাই ২০২৪ ০০:২৭534281
  • পড়ছি মন দিয়ে। 
    নিয়মিত। 
    ভালো লেখা
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন