এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • বিপ্লবের আগুন - পর্ব উনিশ

    কিশোর ঘোষাল
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৪ আগস্ট ২০২৪ | ৩৪৯ বার পঠিত
  • [প্রাককথাঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ হোক কিংবা প্রাচীন রাজতান্ত্রিক সমাজ – বিদ্রোহ, বিপ্লব সর্বদাই প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। নিরীহ, অনুন্নত এবং প্রান্তিক মানুষরা যুগেযুগে কীভাবে উদ্বুব্ধ হয়েছিলেন এবং হচ্ছেন? তাঁরা কীভাবে এগিয়ে চলেন বিপ্লবের পথে? কীভাবে তাঁরা অস্ত্র সংগ্রহ করেন? কোথা থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন সেই বহুমূল্য অস্ত্রসম্ভার? যার শক্তিতে তাঁরা রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রাখার বারবার স্পর্ধা করেছেন? কখনও তাঁরা পর্যুদস্ত হয়েছেন, কখনও ক্ষণস্থায়ী সাফল্য পেয়েছেন। আবার কখনও কখনও প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রকে তাঁরা পরাস্ত করে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতেও পুরোন বিদ্রোহ-বিপ্লবের আগুন নেভে না কেন? রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদতেই কি এ বিপ্লব চলতে থাকে আবহমান কাল ধরে?]

    ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়

    ১৯



    পরের দিন সকালে বসে অনেকক্ষণ ছেলেদের মহড়া দেখছিল ভল্লা। একসময় অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, “কিছুই হচ্ছে না। কিচ্ছু হচ্ছে না...এভাবে তোরা কোনদিনই কোথাও পৌঁছতে পারবি না...”। ভল্লার কথায় ছেলের দল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভল্লার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পরে শল্কু বলল, “তুমি তো এভাবেই আমাদের অভ্যাস করতে বললে, ভল্লাদাদা”।

    সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা বলল, “বলেছি। কিন্তু এমন তো বলিনি এটুকু শিখলেই আমাদের শিক্ষা সব শেষ? রণপায় চড়ে স্বাভাবিক হাঁটাহাঁটি করতেই কাল সারাটা দিন চলে গেল – এখনও ঠিকঠাক চলতে পারছিস না। টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিস বারবার। ভল্ল ছোঁড়ার অভ্যেস করতে বললাম, কুড়িবার ছুঁড়লে খুব জোর তিনবার লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছচ্ছিস। বাকিগুলো বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে নয়তো গাছের গুঁড়িতে বিঁধছে...। একই জিনিষ নিয়ে কতদিন কতবার রগড়াবি?”

    কেউ কোন কথা বলল না, মাথা নীচু করে রইল। শল্কু বলে উঠল, “আহা একদিনেই সবাই পারে নাকি...সবাই কী আর তোমার মতো হতে পারে? তুমিই কী একদিনে সব শিখে ফেলেছিলে?”

    ভল্লা বিরক্ত মুখে বলল, “একদিনে শিখে ফেলা যায় না, সে কথা তোর থেকে আমি অনেক ভালো জানি, শল্কু। কিন্তু কালকের শিক্ষার থেকে আজকের শিক্ষায় যদি কোন উন্নতির লক্ষণ না দেখা যায় – সে রকম দায়সারা শিক্ষায় লাভ কী? মনে এই সামান্য জেদটুকুই যদি না আসে – আজ যেটুকু শিখব সেটা নিখুঁত শিখব। আগামীকাল সেটাকে নিয়ে আবার না রগড়ে – নতুন কিছু শিখবো। তা নাহলে এতো অনন্তকাল চলতেই থাকবে...”।

    ভল্লা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “দ্যাখ সব জিনিষ সবাইকে দিয়ে হয় না। একলক্ষ লোকের মধ্যে খুব জোর হলে হাজার পাঁচেক রক্ষী হয় আর হাজার দুয়েক সৈন্য হয়। আমি আর দু’-তিনদিন দেখব...উন্নতির কোন লক্ষণ না দেখলে বলব”...ভল্লা হঠাৎ হাতজোড় করে বিদ্রূপের স্বরে বলল, “ক্ষ্যামা দাও বাপাসকল, অনেক হয়েছে, এবার বাড়ি যাও – বাপের সঙ্গে চাষবাসের কাজে লাগো গে...নয়তো দীঘীর পাড়ের অশথ তলায়, গুটি সাজিয়ে বাঘবন্দী খেলো গে...”। ভল্লা উঠে দাঁড়িয়ে রণপা নিয়ে বেরিয়ে এল ছেলেদের অনুশীলনের মাঠ থেকে।

    দুপুরে খেতে এসে রামালি বাসায় ফিরে দেখল, ভল্লা ঘরের সামনে নির্দিষ্ট পাথরে বসে গম্ভীর মুখে কিছু চিন্তা করছে। রামালি কিছু বলল না। ঘরে ঢুকে জলের কলসি নিয়ে পুকুরের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর স্নান সেরে ভরা কলসিটা ঘরে রেখে রান্নার যোগাড় করতে করতে লক্ষ্য করল, ভল্লা একই ভাবে বসে আছে। রামালি উনুন ধরিয়ে বলল, “কী ভাবছো, ভল্লাদাদা? তুমি রাগ করে চলে আসার পর ছেলেরা সত্যিই ভয়ানক পরিশ্রম করছে। ওরা আজ খেতেও যায়নি। বলেছে সন্ধ্যে পর্যন্ত অভ্যাস করে, কাল তোমাকে ওরা চমকে দেবে...”।
    ভল্লা মুখ তুলে রামালির মুখের দিকে তাকাল। বলল, “তাই? আর ওই শল্কু?”

    রামালি হাসল, বলল, “ওর তেমন হেলদোল নেই, ওর ধারণা ও সব শিখে ফেলেছে”।

    “তাই, না? হতভাগার ডানা গজিয়েছে – পিমড়ে – ডানা গজালেই ভাবে উড়তে শিখেছে...মরবে”। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, “বালিয়া আর আসে না কেন রে?” বালিয়া নোনাপুর গ্রামেই থাকে, বাপ-ঠাকুদ্দাদের সময় থেকেই তারা লোহার কাজ করে। রামালি বলল, “লড়াই-টড়াই করা ওর পছন্দ নয়। শান্তিপ্রিয় নিরীহ ছেলে। ও বলে আমাদের খেটে খেতে হবে রামালিদা – লড়াই শিখে করবো কি আর খাবোই বা কি? ভল্লাদাদাকে বলো অন্য কাজ থাকলে, আমাকে যেন বলে”।

    ভল্লা খুশিই হল, বলল, “বাঃ, বালিয়া বেশ বুঝদার ছেলে তো! ঠিকই বুঝেছে - লড়াই সবার জন্যে নয়। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে, ওকে খবর পাঠাস তো। ওকে দিয়ে কিছু কাজ করাব। রণপাগুলোর তলায় লোহার খুড়ো আর ডগায় লোহার ফলা বসাতে হবে। এখন আমরা মাটিতে চলাফেরা করছি বলে তেমন ক্ষইছে না। কিন্তু পাথরে বাঁধানো পাকা রাস্তায় চললে বাঁশের ডগাগুলো দাঁতনের মতো ছরকুটে যাবে। লোহার খুড়ো দিয়ে বাঁধিয়ে নিলে বেশি দিন টিকবে”।

    “আজ বিকেলেই এক ফাঁকে গিয়ে বলে আসবো”।

    অনেকক্ষণ কেউ কিছু কথা বলল না। রামালি রান্না নিয়ে ব্যস্ত, ভল্লা আগের মতোই চুপ করে বসে কিছু চিন্তা করতে লাগল। রান্নাটা মোটামুটি গুছিয়ে নিয়ে রামালি জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি বটতলির সনাতন কবিরাজকে আমাদের গ্রামে পাঠিয়েছিলে?” রামালির আচমকা এই প্রশ্নে ভল্লা আকাশ থেকে পড়ল, “বটতলির সনাতন কবিরাজ? আমি তাকে চিনিই না, ডাকব কী করে?”।

    অবাক হয়ে রামালি বলল, “তাহলে? কে ডাকল তাঁকে? আজ সকালে আমাদের গ্রামে এলেন। প্রধানমশাইকে, আমার কাকাকে দেখে গেলেন। বিনা দক্ষিণায় ওষুধ-পথ্যি করে গেলেন। কেন?” ভল্লার মনে পড়ল এবার, বলল, “ও হ্যাঁ হ্যাঁ। গতকাল বণিক অহিদত্তকে বলেছিলাম বটে। আমাদের কবিরাজকাকা তো গ্রামে নেই, যদি ওদিক থেকে কাউকে... বাঃ, তার মানে বণিক অহিদত্ত কথা রেখেছে? দেখে কী বলল?”।

    রামালি মাথা নাড়ল, বলল, “কাকার অবস্থা তেমন কিছু নয়, দু-পাঁচদিনের মধ্যেই সেরে উঠবে। কিন্তু প্রধানমশাইয়ের অবস্থা ভয়ংকর। দিনের অধিকাংশ সময়ই তিনি অচৈতন্য থাকেন। সনাতন কবিরাজ তেমন ভরসা পাচ্ছেন না”।

    “বলিস কী?”

    রামালি কোন উত্তর দিল না, রান্না সারতে লাগল চুপ করে। ভল্লা আবার জিজ্ঞাসা করল, “আর ভীলককাকা?”

    “ভীলককাকার তিনটে দাঁত ভেঙে গেছে – মাড়ি ফেটে গেছে। জিভও কেটে গেছে অনেকটা। চোয়ালে গভীর ক্ষত। কিছু বটিকা দিয়েছেন, জলে গুলে খাওয়াতে হবে আর প্রলেপ দিয়েছেন। বলেছেন সামনের তিন-চারদিন খুবই সংকট – সাবধানে থাকতে হবে। এরমধ্যে ক্ষতগুলো যদি বিষিয়ে না যায়, তাহলে ধীরে ধীরে সেরে উঠবেন, নচেৎ...”।
    ভল্লা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। রামালির রান্না হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করল, “চান করেছ ভল্লাদাদা? আমার রান্না হয়ে গেছে”।

    ভল্লা বিষণ্ণ মুখে বলল, “এদিকে প্রধানমশাইকে প্রায় শেষ করে দিল আর ভীলককাকারও যা অবস্থা কতদিনে সুস্থ হবেন তার ঠিকানা নেই। ওদিকে কবিরাজমশাইকেও আস্থানে নিয়ে গিয়ে, কী অত্যাচার করছে, কে জানে? ওই কটা রক্ষী এসে, নোনাপুর আর সুকরা গ্রামদুটোকে একেবারে কানা করে দিয়ে গেল”।

    রামালি কিছুক্ষণ ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি চলে আসার পর মহড়ার মাঠে শল্কু বলছিল, তুমি রাজি হলে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমরা আস্থান আক্রমণ করব। গ্রামে এসে রক্ষীদের অত্যাচারের চরম শোধ তুলব আমরা”।

    ভল্লা রামালির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর কী মনে হয়, তোরা পারবি?”

    “আমাদের মধ্যে অন্ততঃ জনা ছয়েক বল্লম চালানো আর রণপা ব্যবহারে মোটামুটি দক্ষ তো হয়েছি”, ইতস্ততঃ করে রামালি বলল, “অবশ্য, সে বিচার তুমিই ভাল করতে পারবে। কিন্তু সুরুল আর আমার মত অন্য। এত তাড়াহুড়ো করে নিজেদের বিপদ বাড়ানোর মানে হয় না। আমরা যতটুকু শিখেছি, তাতে রক্ষীদলের কোমর ভাঙা সম্ভব হবে না। উলটে আমাদেরই কোমর ভেঙে যেতে পারে। রক্ষীদলের দু-তিনজন হয়তো আমাদের হাতে মরবে, কিন্তু আমাদের মরবে কিংবা আহত হবে তার থেকে অনেক বেশি। আমাদের এই ছোট্ট দলের পক্ষে সে আঘাত হবে মারাত্মক। এবং সেই আঘাত সেরে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সময়ই পাবো না। তার আগেই রক্ষীরা আমাদের গ্রামগুলোকে জ্বালিয়ে আমাদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চিন্ত আশ্রয়গুলোকে উচ্ছন্ন দেবে”।

    ভল্লা রামালির বিচক্ষণতায় আশ্চর্য হল। রামালির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আস্থান থেকে যেদিন আমরা অস্ত্র লুঠ করলাম, সেদিন আমাদের গায়ে কোন আঁচও তো লাগেনি। তখন তো তোরা লড়াই করার কিছুই জানতিস না, তাই না? উলটে ওদেরই তো তিনজন পটল তুলল”।

    রামালি অনেকক্ষণ ভল্লার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মুচকি হেসে বলল, “ভল্লাদাদা, একথার উত্তর দিলে ছোট মুখে বড়ো কথা হয়ে যাবে কিন্তু”।

    ভল্লা রামালির মুখের ওই হাসি এবং তার কথা বলার ভঙ্গিতে রীতিমতো সতর্ক হয়ে উঠল। আচমকা বলে উঠল, “না রে, তোর কথা পরে শুনব। এখানে নয়, নিরিবিলিতে। খুব খিদে পেয়েছে। চট করে পুকুরে কটা ডুব দিয়ে আসি দাঁড়া – তুই খাবার বাড়…”।

    রামালি গম্ভীর হয়েই ভল্লাদাদার কথাগুলো শুনলো, তার মুখে হাসি নেই। তবে তার মনে তৃপ্তির হাসি, ভল্লাদাদার মতো দক্ষ রাজাধিকারিকও তার কথায় এমন চমকে উঠল?

    - - - - - -

    সন্ধের মুখোমুখি মহড়ার মাঠ থেকে রামালি ফিরল, ওর সঙ্গে এল বালিয়া। ভল্লা বালিয়াকে দেখে খুশি হল, বলল, “আয় বালিয়া, বস। আজকাল তুই আর মহড়ায় যাস না। রামালির থেকে শুনলাম, লড়াই-টড়াই করা তোর নাকি পোষাবে না”। বালিয়া মাটিতে বসল, ইতস্ততঃ করে বলল, “হ্যাঁ ভল্লাদাদা, আমার বাড়ির যা পরিস্থিতি, সেটাই একটা বড়ো লড়াই। তারওপর বাইরের লড়াই আর পেরে উঠবো না”।

    “কেন? কী পরিস্থিতি বাড়ির?”

    “সংসারে আমরা তিনভাই, চারবোন, ভল্লাদাদা – আর বাপ-মা, বুড়ি ঠাকমা। ভাইবোনদের মধ্যে আমিই সবার বড়ো। বছর খানেক আগে, বাবার ডান কাঁধে একটা ফিক ব্যথা হয়েছিল, তারপর থেকে ওই হাতে আর ভারি কাজ করতে পারে না। তুমি তো জানো, ভল্লাদাদা, কামারের কাজই হল গরম লোহায় ভারি হাতুড়ির ঘা মারা। সে কাজটা বাবা আর পারছে না। এখন আমাকেই বাবার কাজগুলো করতে হচ্ছে। বাবা সঙ্গে থাকে, সাহায্য করে। আমি যদি সারাদিন তোমার এখানে মহড়ায় থাকি, আমাদের এতগুলো পেট উপোস করে মরবে, ভল্লাদাদা”।

    “ঠিকই করেছিস, বালিয়া। আমি তো পরিবারকে ডুবিয়ে লড়াইয়ে নামতে বলিনি। কিন্তু তাও তুই আমাদের সাহায্য করতে পারিস। করবি?”

    “আমি করব সাহায্য?” বালিয়া অবাক হয়ে রামালির দিকে তাকাল, “কী সাহায্য, ভল্লাদাদা”?

    “আমাদের রণপাগুলো দেখেছিস তো? ওর তলার দিকে লোহার খুড়ো লাগাতে হবে। এই ধর আঙুল চারেক গভীর লোহার এমন বাটি বানাতে হবে, যার মধ্যে রণপার ডগাটা একদম সেঁটে বসে যাবে। পারবি?”

    “পারব, বল্লমের ফলা তো আমরা বানাই। এক্ষেত্রে ফলাটা থাকবে না শুধু বাঁশের মাথায় চেপে বসার মুণ্ডিটা তোমার লাগবে”।

    “একদম ঠিক। ব্যাপারটা তুই বুঝেছিস, পারবি। ওই সঙ্গে কিন্তু বল্লমের ফলাও লাগবে”।

    “কতগুলো?”

    “অনেক, আপাততঃ ধর পঁচিশ জোড়া। প্রত্যেকটা রণপা – একদিকে যেমন তাড়াতাড়ি চলতে-ফিরতে কাজ দেবে, তেমনি, মাটিতে নেমে পড়লে, সেটা বল্লম হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে”।

    “অনেক লোহা লাগবে, লোহা কিনতে যে প্রচুর অর্থও লাগবে ভল্লাদাদা?”

    ভল্লা রামালির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “বালিয়া কী বলছে রে, রামালি?”

    রামালি হেসে ফেলল, বলল, “ভল্লাদাদা তোকে কি বিনা মূল্যে দিতে বলেছে? অর্থ না দিলে, তুই করবি কী করে কাজটা?”

    বালিয়া একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “না মানে, ভল্লাদাদা বলল, সাহায্য করতে হবে, তাই ভাবলাম...সাহায্য করে তো আর অর্থ নেওয়া যায় না”।

    ভল্লা হো হো করে হেসে উঠল, বলল, “কত লোক জনগণকে সাহায্য করে, জনগণের সেবা করে বড়োলোক হয়ে যাচ্ছে রে, বালিয়া... আর তুই ভাবছিস বিনামূল্যে সাহায্যের কথা? সে যাকগে, এক একটা রণপা বানাতে কত খরচ হবে, এবং কতদিন লাগবে, সেটা আমাকে বল। লোহা তোকেই কিনতে হবে...ভালো লোহা - ভেজাল মেশানো নয়...আমরা শুধু মুল্য ধরে দেব। কবে বলতে পারবি?”

    একটু চিন্তা করে বলল, “একটা দুটো রণপা কি এখন পাওয়া যাবে? তাহলে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে, কাল জানিয়ে দিতে পারব”।

    রামালি বলল, “তুই যে দুটো চড়ে আমার সঙ্গে এলি, সে দুটোই নিয়ে যা। কিন্তু গ্রামে রণপা চড়ে ঢুকবি না। হাতে করে নিয়ে যাবি তোদের ভাটিতে”।

    ভল্লা দুটো ব্যাপারে অবাক হল এবং খুশিও হল। বালিয়া রণপা চড়া শিখে নিয়েছে! আর রামালি নিজে থেকেই কিছু কিছু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে। এটা ভল্লার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভল্লা বলল, “রামালি যেমন বলল, তাহলে তাই কর। আর মনে রাখবি, কাজটা গোপনে করতে পারলে ভালো হয়। যা কিছু আদান-প্রদান, রাত্রে করাই ভালো। দিনের আলোয় কক্ষণো নয়। তোদের ভাটিতেও কাজটা যতটা সম্ভব লুকিয়ে করতে হবে – এতগুলো বল্লমের ফলা বানাতে দেখলে – সকলের মনেই সন্দেহ হবে – সাবধান”।

    “সাবধানেই করব, ভল্লাদাদা। দুটো রণপার নমুনা নিয়ে, আমি কাল একটু রাত্রের দিকেই আসব, তুমি পরীক্ষা করে দেখে নিও। ঠিক-ঠাক থাকলে পরেরগুলোও বানাতে শুরু করব”।

    “তাই আসিস”।

    বালিয়া উঠে পড়ল, ঝোপের ওপাশ থেকে দুটো রণপা বের করে চড়ে পড়ল, বলল, “আসি গো ভল্লাদাদা, রামালি আসছি”। এই অন্ধকারেও বালিয়া খুব সাবলীল হেঁটে গেল বনের পথে, ভল্লা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বালিয়া রণপায়ে এমন হাঁটা কবে শিখল রে, রামালি? এই অন্ধকারের মধ্যেও দিব্যি চলে গেল তো...”!

    রামালি উনুন জ্বালিয়ে রান্নার যোগাড় করতে করতে মুচকি হেসে তাকাল ভল্লার দিকে, বলল, “কেউ কেউ এমন থাকে গো, ভল্লাদাদা – যারা চুপচাপ কাজ করতে এবং শিখতে ভালোবাসে”। প্রদীপের ম্লান আলোতেও রামালির চোখমুখের উজ্জ্বলতা ভল্লার দৃষ্টি এড়ালো না, কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল, সে তো তোকে দেখেই বুঝছি, রামালি।

    বালিয়া চলে যাওয়ার দণ্ড দুয়েক পরেই মারুলার ডাক শোনা গেল। “ভল্লা আছিস? নাকি কোথাও চড়তে বেরিয়েছিস?” নিঃশব্দে উঠোনে ঢুকে মারুলা ভল্লার পাশেই বসল। রামালিকে দেখে বলল, “এ ছোকরা কবে থেকে তোর রান্না করছে ভল্লা? দেখি কেমন রাঁধতে পারিস”! রামালি হাসল, বলল, “আচ্ছা। একটু দেরি হবে কিন্তু”।

    “সে হোক, আমার কোন তাড়া নেই”।

    ভল্লা বলল, “ও রামালি। আমার নিত্য সহচর, ডানহাত। চৌখস ছেলে। ওকে তুই রাঁধুনি ভেবে বসলি নাকি?”

    মারুলা বলল, “আচ্ছা? সে কথা আমি কী করে জানব? আমি ভাবলাম, সাক্ষীগোপালের মতো বসে বসে তুই বুঝি আমোদ করছিস”।

    ভল্লা বলল, “গতকালকেই বণিক অহিদত্ত এসেছিল, আর আজ তুই উদয় হলি। ভাবছি তোদের মতলবটা কী? শালা নির্বাসনে এসেও তোদের জন্যে একটু শান্তি পাবো না? আস্থানের কী খবর বল। কবিরাজমশাই কেমন আছেন? কবে ছাড়া পাবেন কিছু জানিস?”

    মারুলা উত্তর দেওয়ার আগে রামালির দিকে ইঙ্গিত করে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, ওর সামনে বলা যাবে? ভল্লা চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল, বলা যাবে। মারুলা তাও কিছুটা চাপা স্বরে বলল, “শষ্পকমশাই তো তোদের কবিরাজকে ছেড়ে দিতে পারলেই বাঁচেন। সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থা। না পারছে্ন গিলতে – না পারছেন ফেলতে। এই গ্রাম বা প্রতিবেশী গ্রামগুলি নয়, পাশের রাজ্যের লাগোয়া গ্রামগুলিতেও কবিরাজের অসম্ভব জনপ্রিয়তা। অতএব তাঁকে বিনা দোষে দীর্ঘদিন বন্দী রাখলে চারদিকেই বিরূপ সমালোচনায় পড়তে হবে শষ্পককে। সেই ভয়ে শষ্পক তাঁর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলেন। “আপনাকে আমি এখনই ছেড়ে দেব, একটা মাত্র শর্তে, আপনি যা জেনেছেন, যা বুঝেছেন, সে সব কথা বাইরের কাউকে বলা চলবে না। কেউ কিছু জানতে চাইলেও বলবেন, আমি ওসবের কিছুই জানি না। আমি আদার ব্যাপারী জাহাজের কথা কী করে জানব?””

    ভল্লা লক্ষ্য করল, রান্নার ব্যস্ততার মধ্যেও রামালি মন দিয়ে মারুলার কথা শুনছে। ভল্লা মারুলাকে জিজ্ঞাসা করল, “কবিরাজমশাই কী বললেন?”

    “ঘাড়ত্যাড়া বুড়োর ভয়ানক গোঁ। বললেন, “মিথ্যা কথা তো আমি বলতে পারব না, বাবা শষ্পক। কেউ যদি জানতে চায় - সব জেনেবুঝে আমাদের গ্রামের আসন্ন বিপদের কথা তাদের বলব না? এ হতে পারে? সে বাবা তোমরা আমায় মেরেই ফেল আর কেটেই ফেল”। এ কথাগুলো বলতে বুড়োর গলা এতটুকু কাঁপল না, তাঁর চোখেমুখে এতটুকু ভয়ের লেশমাত্র দেখলাম না। শান্ত ধীর কণ্ঠে শষ্পকের চোখে চোখ রেখে কথাগুলো উনি বললেন। অতএব এই পরিস্থিতিতে কবিরাজবুড়োকে শষ্পক মুক্ত করতেও পারছেন না”।

    মারুলা কথা শেষ করার পরে কেউ কোন কথা বলল না। অনেকক্ষণ পর মারুলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এত জায়গায় ঘুরে বেড়াই, কত রকমের মানুষ দেখেছি। কিন্তু রাজ্যের এত দূর প্রান্তে, রুক্ষ দরিদ্র এই গ্রামে এসে, এমন একজন মানুষের দেখা পাবো, ভাবতে পারিনি রে ভল্লা”।

    তিনজনেই বসে বসে নিজের মনে ভাবতে লাগল কবিরাজমশাইয়ের কথা। একটু পরে মারুলা হঠাৎ বলে উঠল, “আরে রামালি, তোর রান্না কদ্দূর, আমার তো পেটে আগুন জ্বলছে রে…”।

    “রান্না তো হয়ে গেছে, খাবার বাড়বো?”

    ভল্লা বলল, “হ্যাঁ বেড়ে ফেল। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা তিনজনে বেরোব। অনেক কাজ আছে”।

    খাওয়াদাওয়া সেরে ভল্লা বলল, “বালিয়া তো একজোড়া রণপা নিয়ে গেল, আমাদের তো তাহলে হেঁটেই যেতে হবে রে, রামালি”। রামালি বলল, “রণপা আছে। চিন্তা করো না ভল্লাদাদা। আমাকে একটু সময় দাও পুকুর থেকে রান্নার বাসনগুলো চট করে ধুয়ে আনি”।

    ভল্লা অবাক হয়ে বলল, “সে তুই ঘুরে আয়। কিন্তু রনপা তো আমাদের দুজোড়াই ছিল…”। ভল্লা পুকুরের দিকে যেতে যেতে বলল, “আমি আসছি, একটু দাঁড়াও না, ব্যস্ত হচ্ছো কেন?”। রামালি চলে যেতে মারুলা বলল, “ছেলেটা বেশ সপ্রতিভ তো, ভল্লা! একে পেলি কোথায়”।

    “নোনাপুরের ছেলে। ছোটবেলায় বাপ-মাকে হারিয়েছে। কাকা-কাকির কাছে মানুষ। দিনকয়েক আগে দজ্জাল কাকি ওকে তাড়িয়ে দেওয়াতে, আমার সঙ্গে রয়েছে। দারুণ কাজের ছেলে তো বটেই, তার ওপর বুদ্ধিমানও। সব কিছু ঠিকঠাক চললে, ওই এই দিকের নেতা হয়ে উঠবে, এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি”।

    “বলিস কী? তুই এতটা ভরসা করছিস?”

    “শুধু আমি না, তুইও করবি – দুএকদিন দেখ, ভালভাবে পরিচয় হোক”। রামালি পুকুর থেকে ফিরে এল। ঘরের মধ্যে বাসনপত্র গুছিয়ে রেখে, বাইরে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল তিন জোড়া রণপা নিয়ে। ভল্লা এবং মারুলার হাতে দুজোড়া দিয়ে বলল, “চলো এবার, কোথায় যাবে”। রণপায়ে চড়তে চড়তে ভল্লা বলল, “তুই কি জানতিস নাকি আজ মারুলা আসবে? এনে রেখেছিলি?”

    তিনজনেই রণপায় চড়ে হাঁটতে শুরু করার পর রামালি বলল, “মহড়ার পর ছেলেদের সবাইকে আমি এখানেই রণপা রেখে যেতে বলি – সামান্য দূরে একটা বড়ো গাছের ওপর”। ভল্লা

    অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

    রামালি একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “আমাদের কাছে রণপা চড়ে ঘোরাঘুরি করাটা একটা আশ্চর্য কৃতিত্বের ব্যাপার, ভল্লাদাদা। তুমি যতই মানা কর, আমাদের মধ্যে দুচারজনের মনে, রণপা চড়ে গ্রামের সবাইকে অবাক করে দেওয়ার লোভ আসতেই পারে। আমি তাই ঝুঁকি নিইনি। গ্রামের লোক আমাদের চালচলনে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। তারওপর তাদের সামনে রণপা চড়ে ছুটোছুটি করলে আর দেখতে হবে না…”।

    বণিক অহিদত্তকে নিয়ে যে খোলা জায়গায় গিয়েছিল, ভল্লা ওদের নিয়ে সেখানেই গেল। তিনজনে মুখোমুখি বসল। ভল্লা বলল, “এবার বল, মারুলা”।

    “এক এক করে, বলি। অহিদত্ত এসেছিল যখন, নিশ্চয়ই জানিস, ওর হাত দিয়েই রাজধানী থেকে অস্ত্র-শস্ত্র আসছে। রওনা হয়ে গেছে, আট-দশ দিনের মধ্যেই মনে হয় এখানে চলে আসবে”।

    “হুঁ, বলেছে”।

    “ওগুলো রাখার জন্যে বেশ বড়ো একটা অস্ত্রাগার বানানো হচ্ছে, তোর বাসা থেকে মোটামুটি ক্রোশ চারেক দূরে। প্রশাসন থেকে তার জন্যে একজন করণিক এবং পর্যাপ্ত রক্ষী নিয়োগ করবে। কিন্তু অস্ত্রাগারের দায়িত্ব থাকবে তোর হাতেই। তোর অনুমতি ছাড়া অস্ত্রাগারের থেকে একটা ছুঁচও বেরোবে না”।

    মারুলা একটু অপেক্ষা করল, কিন্তু ভল্লা কোন কথা না বলাতে, আবার বলল, “আস্থানের পাশেই বিস্তীর্ণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে নির্মাণ হবে রতিকান্তর শীতাবাস”।

    “শীতাবাস?” ভল্লা একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল।

    “হুঁ, শীতাবাস। রাজধানী কদম্বপুরের শৈত্যপ্রবাহ রতিকান্তর সহ্য হচ্ছে না। তাই তাকে এই পশ্চিম সীমান্তে পাঠানো হবে, কারণ এদিকে শীতের প্রকোপ অনেকটাই কম। রাজধানী থেকে লোকজন নিয়ে দুজন স্থপতি এসে গেছে, তারা আস্থানেই আছে। কাজ শুরু হল বলে। কথা আছে, শষ্পক এখান থেকে উত্তরে রওনা হওয়ার আগেই, শীতাবাসের প্রধান কক্ষগুলি শেষ করে যাবে। কদম্বপুরে তার প্রমোদভবনটি নাকি আজকাল তার আর তেমন পছন্দ হচ্ছে না। অতএব রতিকান্ত এখানে আসছে শষ্পক আস্থান ছেড়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে। সে এসে কক্ষগুলির রূপচর্চা এবং প্রসাধনী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করাতে চায়”। কথা শেষ করে মারুলা ফিচেল হাসল খিঁক খিঁক করে।

    ভল্লা রামালির মুখের দিকে তাকাল, তারার আবছা আলোয় তার মুখভাব তেমন বোঝা গেল না। ভল্লা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বাঃ”!

    মারুলা রীতিমতো ঝেঁজে উঠল,”তুই মাকড়া “বাঃ” বলছিস? আমি শালা একটা সুযোগ পেলে, ওকে কিন্তু প্রাণে মারব না, শুয়োরের বাচ্চাকে খাসি করে ছেড়ে দেব। ঢ্যামনা ভাদুরে কুত্তা, শুধুমাত্র রাজার বউয়ের ভাই বলে, এভাবেই সর্বত্র ফূর্তি লুঠবে?”

    ভল্লা বলল, “আঃ মারুলা, রামালি রয়েছে – ছোট ছেলে...ওর সামনে এত গালাগাল করিস না...”।

    মারুলা বলল, “ছোট আছে তো কী হয়েছে? বড়ো হবে না? সব কথাই ওর জানা উচিৎ, শোনা উচিৎ - এই গালাগালিগুলোও...”।

    “হতভাগাকে মেরে ফেলার চিন্তা আমি অনেকদিন ধরেই করছি, কিন্তু তোর এই বুদ্ধিটা মন্দ নয়, শালা...”।

    “কোন বুদ্ধিটা...?”

    “খাসি করে দেওয়াটা”।

    “তবে? হতভাগার চারপাশে নগ্ন রমণীরা ঘোরাফেরা করছে... আর রতিকান্ত নিজের ওইটা ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে...ব্যাপারটা ভাবতে পারছিস ভল্লা? রতিকান্ত আমাদের থেকেও বড়ো মুতিকান্ত হয়ে যাবে, রে ভল্লা, – মোতা ছাড়া অন্য আর কিচ্‌ছু হবে না ওটা দিয়ে...” ভল্লার সমর্থনে উত্তেজিত হয়ে উঠল মারুলা।

    ভল্লা হাসল। রামালির দিকে তাকাল। রামালি হাসছে না, শুনছে...। ভল্লা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “রতিকান্তকে এখন ছাড়। তার আগে বল, অস্ত্রাগারের রক্ষণাবেক্ষণ করবে প্রশাসন, সেখান থেকে দু-দশখানা হাওয়া হয়ে গেলে, আমি তো জানতেই পারব না, কিন্তু তার দায় তো আমাদের ঘাড়ে এসে পড়বে...”।

    মারুলা বলল, “না রে বাবা, সে সব কি আর রাজধানীর মাথারা ভাবেনি? রাজধানী থেকে যা সরঞ্জাম পাঠাবে, তার বিবরণ তোর কাছে চলে আসবে, চলে যাবে অহিদত্তের কাছেও। রাজধানী থেকে আসার পথেও চুরিচামারি হতে পারে তো। অতএব অস্ত্রাগারে পৌঁছনোর পর গোনাগুণতি করে যা পাওয়া যাবে – সে বিবরণও তোর কাছে চলে আসবে। এরপর তো তুই যেমন যেমন বলবি, সেভাবেই...”।

    “বুঝলাম। অস্ত্র-শস্ত্রের দর-টর কিছু ঠিক হয়েছে?”

    “না। ওটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে...রাজধানী থেকে অহিদত্ত কত দামে কিনেছে সেটা পাঠাচ্ছে। তারওপর শষ্পক যোগ করবে অস্ত্রাগার নির্মাণ, কর্মচারীদের মাসোহারা, পরিবহনের ব্যয়, অহিদত্তের লভ্যাংশ এবং আরও হয়তো টুকটাক কিছু। এসবের পর আমরা ঠিক করব, মোট কত মূল্য হওয়া উচিৎ। সবশেষে আমরা বসব অহিদত্তের সঙ্গে। কারণ অহিদত্তের টাকা এবং লভ্যাংশ আমাদেরই দিতে হবে”। মারুলা একটু থেমে রামালির দিকে তাকিয়ে বলল, “কথাগুলি কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়, রামালি। এই ছয়কান ছাড়া আর কোন কানে যেন না যায়”।

    রামালি এতক্ষণ মন দিয়েই সব কথা শুনছিল এবং আঁচ করতে চেষ্টা করছিল গভীর ও ব্যাপ্ত এই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য কি? তার ধারণায় ষড়যন্ত্র সবসময়েই শত্রুর বিরুদ্ধেই করতে হয়। এখানে শত্রুপক্ষ কে? ঠিক কার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র? এই চিন্তার মধ্যে মারুলার আচমকা সতর্কবার্তা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “ছয়কান কেন, বলছো মারুলাদাদা – আমরা তো তিনজন এখানে”।

    রামালির কথায় মারুলা হেসে উঠল হো হো করে। ভল্লাও হেসে, রামালির কাঁধে হাত রেখে বলল, “তিনজনের কটা কান থাকে? মারুলা ওরকমই – গম্ভীর কথার মধ্যেও চ্যাংড়ামি করাটা ওর চিরকালের স্বভাব”। নিজের বোকামিতে যদিও একটু লজ্জা পেল রামালি, কিন্তু আনন্দও পেল। আজ কিছুক্ষণ আগেই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়, এর মধ্যেই তার সঙ্গে ফক্কুড়ি করছে মারুলাদাদা! এর অর্থ মারুলাদাদা তাকে বিশ্বাস করছে। এর পেছনে ভল্লাদাদার হাত নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কিছুটা হলেও তার কৃতিত্বও কম নয়।

    ভল্লা বলল, “এদিকে পাশের রাজ্য থেকেও তো আমাদের কিছু ক্রেতা জুটছে। তারা অস্ত্র-শস্ত্র কিনতে চায়। তাদের কী করবি?”

    মারুলা ভল্লার উরুতে চাপড় মেরে বলল, “কী আবার করবি? বেচবি। আমাদের খরচ-খরচা বাদে তিনগুণ দামে! কত চাই তাদের?”

    “বলছে তো অনেক কিছু। লম্বা লম্বা বিপ্লবের কথা। কদ্দূর কি দাঁড়াবে জানি না। বলছে আমাদের লড়াই করতে শেখাও, ভল্লাদাদা। আমরা লড়ব”।

    “অহিদত্ত জানে?”

    “হ্যাঁ, আমিই বলেছি”।

    “ধ্যাৎ শালা, অহিদত্তকে বলতে গেলি কেন? ও ব্যাটা তো, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবে। শালা সরাসরি বেচে ভাল পয়সা কামাবে”।

    “আমি না বললে, ও বুঝি জানবে না? কী যে বলিস না? তবে অহিদত্ত ও রাস্তায় হাঁটবে না। এ কি ধান-গমের ব্যবসা? যাকে খুশি বেচে দিতে পারবে? উলটে সে ভয় পেয়েছে। এ রাজ্য থেকে অস্ত্র কিনে, ও রাজ্যের ছেলেদের অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রি করলে, ওদের প্রশাসন একসময় জানতে পারবেই। আর জানতে পারলে, ওর পাছার চামড়া খুলে নিতে কতক্ষণ”?

    “আবে, তুই এত ভদ্রলোক কবে হলি রে, ভল্লা? বল পোঁদের খোসা…। তাহলে আর চিন্তা কিসের? শষ্পক যা দাম ঠিক করে দেবে, চোখ বুজে তার ওপর তিনগুণ চাপিয়ে আমরা বেচব...”।

    “হুঁ। তবে কালনেমির লঙ্কাভাগ করে লাভ নেই, ওরা আসুক, পাকা কথাবার্তা হোক। টাকাকড়ি ব্যবস্থা কী করছে, বুঝি, তারপর ভাবব...”।

    “ওরা কবে আসবে আবার?”

    “হয়তো কাল বা পরশু বা তার পরেরদিন। কিন্তু ওরা যদি সত্যি সত্যি টাকা-পয়সা সঙ্গে নিয়ে চলে আসে, বিপদে পড়ে যাবো”।

    “যা শালা, বিপদ আবার কিসের? টাকা আনলে নিয়ে নিবি”।

    “আবে গাড়ল, সে টাকা রাখব কোথায়? আমাদের সিন্দুক আছে, নাকি আস্থানের মতো সুরক্ষিত কোষাগার আছে?”

    মারুলা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “দাঁড়া শষ্পকের সঙ্গে কথা বলে, কাল রাত্রের মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করছি। আচ্ছা ধর, বড়সড় একটা সিন্দুক যদি নিয়ে আসি, তালা-চাবি সমেত। সেটাকে মাটিতে কোথাও পুঁতে রাখা যাবে না? নিরাপদে?”

    ভল্লা বলল, “মাটিতে পোঁতা থাকবে? কেউ টাকা দিলে বা দরকারে টাকা তোলার সময় আমি আর রামালি কোদাল বেলচা দিয়ে মাটি খুঁড়ব? এমন কথা বলিস না গেঁড়ের মতো”!

    মারুলা ফিচেল হাসল, বলল, “আহা কতদিন পর তোর মুখ থেকে একটা গাল শুনলাম রে, হতভাগা – তাও গেঁড়ে বলেই ছেড়ে দিলি, পুরোটা বললি না?”

    ভল্লাও হেসে ফেলল, মারুলার কাঁধে একটা থাবড়া মেরে বলল, “চ্যাংড়ামি নয়, মারুলা - তোরাও ভাব, আমরাও ভাবছি। তাছাড়া আরো একটা সমস্যা আছে। ওরা যদি ডাকাতি করে টাকা যোগাড় করে, তাহলে সোনার গয়না, মণিমুক্তো এনেও হাজির করতে পারে। সে সোনার কতটা খাঁটি, কতটা খাদ, কত রতি, কত ভরি, তার মূল্য কত, কে ঠিক করবে? শষ্পকের সঙ্গে কথা বল। শুধু একখানা সিন্দুক নিয়ে আমরা কী করব? যাক, এবার তুই কেটে পড়, অনেক রাত হল। আমি আর রামালি যাবো গ্রামপ্রধানের বাড়ি।

    মারুলা বলল, “তোর সমস্যার কথাগুলো শুনলে শষ্পকের… হে হে হে… রাতের ঘুম চটকে যাবে! কাল একটু বেলার দিকে যেতে পারবি? যেখানে অস্ত্রাগার বানানো হচ্ছে?”

    “কোথায়, কতদূরে?”

    “বললাম যে, তোর বাসা থেকে দক্ষিণে মোটামুটি ক্রোশ চারেক দূরে...কালই চলে আয় না। শষ্পককেও বলব। ওখানে বসে, শষ্পকের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বললে...কাজের সুবিধে হবে...আমিও থাকব”।

    একটু চিন্তা করে ভল্লা বলল, “কথাটা মন্দ বলিসনি, ঠিক আছে কাল যাবো”।

    “সেই ভাল, তাঁতের মাকুর মতো, তোর আর শষ্পকের বার্তা নিয়ে ঘুরছি...”

    “কিন্তু কাল রাত্রেও তোকে কিন্তু আসতে হবে মারুলা। দরকার হবে”।

    “সে তো আসবই। এখন তো মনে হচ্ছে আমায় রোজই আসতে হবে। এখন চলি রে। এই রামালি, রণপা জোড়া নিয়ে যাবো রে? তোদের মহড়ায় কোন অসুবিধে হবে না তো? কাল রাত্রে আসার সময়, আমার রণপা জোড়া নিয়ে আসব, আর তোদের জোড়া ফেরত দিয়ে যাবো”। রামালি একটু চিন্তা করে বলল, “নিয়ে যাও, মারুলাদাদা, চালিয়ে নেব কালকের দিনটা”।




    ক্রমশ...




    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ আগস্ট ২০২৪ | ৩৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন