কমলিমায়ের উঠোনে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল ভল্লা আর রামালি। ঘরের দরজাটা বন্ধ নয়, ভেজানো। দরজার ফাঁক দিয়ে দীপের ম্লান আলোর আভাস আসছে। ভল্লা দাওয়ায় উঠল – হাল্কা চাপ দিতে খুলে গেল দরজাটা। কমলিমা মেঝেয় বসে আছেন, খাটিয়ার ওপর দুহাতের মধ্যে মাথা রেখে। খাটিয়ায় পরিষ্কার বিছানা টানটান করে পাতা, যেন কেউ এখনই আসবে – এসে শোবে। আর তার অপেক্ষাতেই বসে থেকে থেকে কমলিমা ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভল্লার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। কী অসহায় শূণ্যতা নিয়েই না এখন বেঁচে রয়েছেন কমলিমা। ভল্লা নিঃশব্দে কমলিমায়ের পাশে গিয়ে বসল। তার পিছনে সামান্য দূরে বসল রামালি।
ভল্লা অতি সন্তর্পণে কমলিমায়ের কাঁধে হাত রেখে চাপা স্বরে বলল, “এমন করে বসে আছিস, কেন রে মা?”
কমলিমা মাথা তুলে তাকালেন, ভল্লাকে দেখে বললেন, “ভল্লা? কতক্ষণ এসেছিস, তুই? জানতেই পারিনি”। কমলিমা হাসলেন – সে হাসির মধ্যে এতটুকু আনন্দ প্রকাশ পেল না, বরং ফুটে উঠল বিষণ্ণ নির্লিপ্তি। কমলিমা আবার বললেন, “এতদিনে তোর সময় হল? ওই দিন আমার কাছে একটি বারের জন্যেও আসতে পারলি না? কিন্তু শুনলাম তুই শ্মশানে গিয়েছিল?”
“হুঁ। গিয়েছিলাম। তোর কাছে আসতে সেদিন ভয় পেয়েছিলাম মা। সেদিন গ্রামের মেয়ে-পুরুষ অনেকেই তোর কাছে ছিল...তারা কে কী বলবে...সেই ভয়...”।
“হ্যাঁ এসেছিল, গ্রামের সবাই। কবিরাজদাদা আর তুই - ছাড়া। সবাই বলছিল আমাকে মুখে আগুন দিতে হবে। আমাকে শ্মশানে যেতে হবে। পাগল নাকি? তাই কখনও হয়, বল? মেয়েরা শ্মশানে যায়? আর আমি কেন মুখে আগুন দিতে যাব? আমি কী আঁটকুড়ি নাকি? গাঁয়ের লোক কী যে বলে না...”। ভল্লা কোন কথা বলল না, তাকিয়ে রইল কমলিমায়ের শীর্ণ অবসন্ন মুখের দিকে।
“তুই এলে, তোকেই বলতাম। যা ছেলের কাজটা করে আয়। এলি না। হ্যারে মুখে আগুন না দিলে আত্মার সদ্গতি হয় না, না? তাহলে কী হবে? এখন মনে হচ্ছে ভুলই করেছি...লোকের কথা শুনে...শ্মশানে গেলেই হত...হ্যারে আমার কী পাপ হল?” গলার কাছে রুদ্ধ হয়ে থাকা কষ্টটাকে ভল্লা এতক্ষণ সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। মুখ তুলে কমলিমায়ের শিরা-বিকীর্ণ কঙ্কালসার হাতটা দুহাতে ধরে বলল, “পাপ কেন হতে যাবে রে, মা? আর প্রধানমশাইয়ের আত্মার সদ্গতিই বা হবে না কেন? এইসব কথা চিন্তা করে তুই বসে বসে রাত জাগছিস, মা? গ্রামের মেয়েদের কেউ রাত্রে তোর কাছে থাকে না”?
“ধুর। সন্ধে হলেই আমি তাদের তাড়িয়ে দিই। খুব ভয় করে জানিস? কচি কচি মেয়েগুলো সারারাত আমার সঙ্গে থাকবে – যদি কিছু হয়ে যায়? খুব ভয় করে। বলি পালা আমার সামনে থেকে”।
“কিসের ভয় মা?”
“নিজের পেটের দু-দুটো ছেলেকে খেয়েছি। স্বামীকে খেয়েছি। আমার বিয়ে হয়েছিল আট বছর বয়সে, এ বাড়িতে এসেছি আমার তের বছর বয়সে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বলতেন আমি নাকি খুব লক্ষ্মীমন্ত। কবিরাজদাদা বলত তুই খুব ডাকাবুকো ছেলে – ভয়ডর কম। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল তো – ভয় করছে না? আমার চোখে অকল্যাণের ছায়া দেখতে পাচ্ছিস না? পুকুরে চান করতে গিয়ে জলে ছায়া পড়ে – স্পষ্ট দেখতে পাই একজোড়া ডাইনীর চোখ”।
চণ্ড রাগে ভল্লা বলে উঠল, “কী আজেবাজে বকছিস, মা? মা কোনদিন ডাইনী হয়? তুই আমার সঙ্গে চল, মা। এই ঘরে একা একা সারাদিন এইসব চিন্তা করে তুই নিজেকে শেষ করে দিবি নাকি? কোন কথা নয় - এখনই ওঠ। সারাদিন তোর কাজ নেই কম্মো নেই, নাওয়া নেই খাওয়া নেই, ঘুম নেই...। আর তাকিয়ে দ্যাখ, রামালি আর আমি সারাদিন-রাত খেটে মরছি। তারপরেও ঘরে ফিরে রামালি দু বেলা হাত পুড়িয়ে রান্না করে – নিজে খায়, আমাকে খাওয়ায়...। আজ তুই চ আমাদের সঙ্গে – এ ঘরে তোকে আমি রাখব না। কত বড়ো ডাইনী তুই হয়েছিস, আমাদের দেখা তো, মা? তোর চোখের বিষে আমাদের কেমন শুকিয়ে মারতে পারিস – চল আমাদের সঙ্গে – দেখি। ওঠ। না উঠলে, তোর ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে যাবো, এই বলে রাখলাম, মা। এই গোঁয়ার-গোবিন্দ ছেলেকে তুই ভালই চিনিস। এখনই ওঠ...”।
“পাগল হয়েছিস, ভল্লা? এ আমার স্বামীর ভিটে – এ আমার শ্বশুরের ভিটে...এ সব ছেড়ে...। তাছাড়া তোরা সব উড়নচণ্ডে ছেলে...দল বেঁধেছিস লড়াই করবি বলে...”।
ভল্লা উঠে দাঁড়াল, বলল, “হ্যাঁ, তাই...কিন্তু উড়নচণ্ডেদেরও মা থাকে, ভাইবোন থাকে...রামালি ওঠ। এই বিছানা, আর কমলিমায়ের শাড়ি-টাড়ি গামছা-টামছা – হাতের সামনে যা পাচ্ছিস নিয়ে একটা পুঁটলি বানা...চল। আর এক মুহূর্তও এখানে নয়...”। রামালি উঠে পড়ল - দ্রুত হাতে গুছিয়ে তুলতে লাগল কমলিমায়ের কাপড়-চোপড়।
কমলিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, “অ্যাই, রামালি – যেমন ছিল সব রেখে দে - কিচ্ছুতে হাত দিবি না – ঠ্যাং ভেঙে দেব...”।
ভল্লা হা হা করে হেসে উঠল, পাঁজাকোলা করে দুহাতে তুলে নিল কমলিমাকে, বলল, “তুই যদি রামালির ঠ্যাং ভাঙতে পারিস, তাহলে আমরাও তোর ঘাড় ভাঙতে পারি, মা। কী শরীর, রে তোর? আমাদের ওদিকের পায়রাগুলোও তোর থেকে ভারি হয় ...হা হা...”
কমলিমা কঠোর চোখে ভল্লার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমায় নামিয়ে দে ভল্লা। সেবা-যত্ন করে তোকে সুস্থ করে তুলেছিলাম, আমার সঙ্গে এই ব্যবহার করবি বলে?”
ভল্লা হাসতে হাসতে বলল, “তোর ওই ডাইনী চোখের ভিরকুটিতে আমি ডরাবার পাত্র নই... আর আমি যে ডাকাত - সে কথা কবিরাজদাদা তোকে বলেনি? সারা জীবনে অনেক ডাকাতি করেছি - অস্ত্র-শস্ত্র, টাকাকড়ি...কিন্তু মা ডাকাতি কোনদিন করিনি...”।
ভল্লা দাওয়া পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠোনে নামল, রামালি প্রদীপ নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার শেকল তুলে দিল। তার কাঁধে বেশ বড়ো একটা পুঁটলি। দুজনে অন্ধকারের মধ্যে কমলিমায়ের বাড়ির বেড়া টপকে এগিয়ে চলল জঙ্গলের দিকে। ভল্লার বুকের মধ্যে শীর্ণ পাখির মতোই আবদ্ধ কমলিমা অনর্গল বকাবকি করতে লাগলেন ভল্লাকে...হতভাগা ছেলে, গাঁয়ের লোক কি বলবে? আমার সন্তান গেছে – আমার স্বামীও গেল – এ গ্রামে বাকি ছিল একটু মান-সম্মান – সেটাও গেল তোর জন্যে – কাল সকালে গাঁয়েগাঁয়ে ঢিঢি পড়ে যাবে প্রধানের বউ – ভল্লার সঙ্গে পালিয়েছে – এখনও বলছি আমায় নামিয়ে দে ভল্লা – মুখপোড়া বাঁদর – তোর জ্বালায় আমাকে শেষ অব্দি গলায় দড়ি দিতে হবে…”!
উপানুদের মারে মারাত্মক আহত হয়ে গ্রামপ্রধান জুজাক যেদিন থেকে নিশ্চেতন অবস্থায় শয্যাশায়ী হলেন – সেই দিন থেকেই কমলিমায়ের অনিয়ম শুরু হয়েছিল। তাঁর জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল নিয়মিত নাওয়া-খাওয়া, ঘুম-বিশ্রাম, হাসি-আনন্দ, এমনকি প্রতিবেশী মহিলাদের সঙ্গে স্বাভাবিক বাক্যালাপও। আজ ভল্লার সঙ্গে দীর্ঘ বাক-যুদ্ধের উত্তেজনা এবং ভল্লার উদ্ভট এই আচরণের অসহায় প্রতিবাদ করতে করতে তিনি একসময় ভেঙে পড়লেন। তিনি যেন ভল্লার বুকেই নিজেকে সমর্পণ করে ফেললেন। জুজাকের মৃত্যুতেও যিনি এতটুকু অশ্রুপাত করেননি, আজ ভল্লার ওপর রাগে, অভিমানে তাঁর দুচোখে নেমে এল রুদ্ধ অশ্রুস্রোত।
ভল্লা অন্ধকারেও টের পেল, কমলিমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “কেঁদে নে মা, কেঁদে নে…বুকের মধ্যে অনড় পাথরের মতো জমে ওঠা যত অপমান, দুঃখ-শোক বেরিয়ে আসুক চোখের জল হয়ে। একদিন সকলকেই মরতে হবে। কিন্তু এভাবে তুই নিজেকে শেষ করতে পারিস না, মা – আমাদের জন্যেই তোকে বাঁচতে হবে। বাঁচতে হবে রামালির জন্যে – এই গ্রামের জন্যে।
জঙ্গলে ঢুকে ভল্লা কমলিমাকে সাবধানে ঘাসে বসাল, তারপর রামালিকে বলল, “তোর পুঁটলি থেকে একটা শাড়ি বের কর তো, রামালি। তারপর ঝোলা বানিয়ে আমার পিঠে শক্ত করে বেঁধে দে বুড়িটাকে। দেখিস একটুও যেন নড়তে না পারে”।
কান্না রুদ্ধ গলায় কমলিমা বলে উঠলেন, “কেন? আমি তো পাখির মতো হাল্কা, আমাকে নিয়ে এটুকু আসতেই তোর হাঁফ ধরে গেল?”
ভল্লা কমলিমায়ের পায়ের ওপর হাত রেখে বলল, “আমরা এখন রণপা চড়ে যাবো, তোকে দুহাতে ধরতে পারবো না, সেই জন্যেই রামালিকে বলছি আমার পিঠে তোকে ঝুলিয়ে দিতে। রাগ করিস নে মা। একজন মা স্বেচ্ছায় তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে, সে কথা বুঝেও কোন ছেলের পক্ষে ঠাণ্ডা থাকা সম্ভব? আচ্ছা বেশ, আমি তো তোর ছেলে নই – তাহলে তুই কেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে আমার সেবা করে সুস্থ করেছিলি? আমি তোর ছেলে নই, তাই কোন অধিকারে আমি তোর ওপর এমন জোর খাটাচ্ছি, এখন তোর তাই মনে হচ্ছে, না রে মা…?”
কমলিমা হঠাৎই ফুঁসে উঠলেন, দুহাতে ভল্লার চুলের মুঠি ধরে বললেন, “আমি তোকে তাই বললাম বুঝি?” তারপর দুহাতে ভল্লার মাথাটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ভল্লা ভীষণ নরম গলায় বলল, “কাঁদ মা, কাঁদ – কেঁদে হাল্কা হ। কিন্তু এত উত্তেজিত হস না, তোর দুর্বল শরীর…”। রামালি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল কমলিমাকে, এরকমই কী হয় মায়েরা? ধীরে ধীরে সেও ওদের কাছে এসে বসল। ভল্লা রামালিকে দেখিয়ে বলল, “দ্যাখ মা, রামালির মুখটা দ্যাখ। হতভাগা বাচ্চাবেলায় মাকে হারিয়েছে – বড়ো হয়েছে কাকির গালমন্দ খেতে খেতে – কেমন অবাক হয়ে তোকে দেখছে দ্যাখ…”। রামালিকেও কাছে টেনে তার মাথায় হাত রেখে কমলিমা কান্নাভেজা গলায় বললেন, “কোন চুলোয় নিয়ে যাবি চল, রাত শেষ হতে চলল – ছেলেরা বলে তুই আর রামালি নাকি খুব খাটিস সারাদিন… ঘুমোবি কখন?”
-- -- --
দিনের প্রথম প্রহরটা এখন মিলাদের মহড়ার মাঠেই নিয়মিত থাকে ভল্লা। প্রথম-প্রথম তার মনে হয়েছিল ছেলেগুলোর আসল উদ্দেশ্য দ্রুত অর্থ উপার্জন করা – সে ডাকাতি করেই হোক বা সার্থবাহদের গো-শকটবাহিনীর ওপর আচমকা আক্রমণ করেই হোক। কিন্তু জনা এবং মিলাদের সঙ্গে এই কদিনের ঘনিষ্ঠতায় ভল্লার সে ভুল ভেঙেছে। দুনীতিগ্রস্ত রাজকর্মচারী এবং আঞ্চলিক প্রশাসকদের দমন করা এবং প্রয়োজনে নিকেশ করাই যে জনাদের মুখ্য উদ্দেশ্য সেটা এখন বুঝেছে ভল্লা।
ওদের জন্যে মাত্র ছটা রণপাই দিতে পেরেছে ভল্লা। ভল্ল দিয়েছে কুড়িটা আর বল্লম চারটে। উপকরণের স্বল্পতা সত্ত্বেও ছেলেদের শেখার উৎসাহে ঘাটতি নেই এবং বটতলির দল দ্রুত উন্নতি করছে। ভল্লার ধারণা সকলের জন্যে পর্যাপ্ত অস্ত্র এসে গেলে – বটতলির দলও, মাসান্তে, নোনাপুরের ছেলেদের মতোই দক্ষ হয়ে উঠবে।
ছেলেদের কিছু কিছু মহড়া দেখিয়ে দিয়ে ভল্লা মাঠের একধারে বসল। ডেকে নিল মিলা আর জনাকে। বলল, “আমাদের অস্ত্রসম্ভার গত রাত্রেই বীজপুর পৌঁছে গেছে। দু-তিনদিনের মধ্যে আমাদের অস্ত্র ভাণ্ডারে পৌঁছে যাবে। আমাদের কাছে দুটো হাতে-টানা শকট আছে, তোরা ওগুলো নিতে পারিস – অস্ত্র-শস্ত্র বয়ে আনতে সুবিধে হবে। কাজ হয়ে গেলে ফেরত দিয়ে দিবি”।
“বাঃ, সে তো ভালোই হবে। কিন্তু তোমাদের অস্ত্রভাণ্ডার মানে? কোথায় বানিয়েছ? এত তাড়াতাড়ি বানালে কী করে?”
ভল্লা বলল, “নোনাপুরের মহড়ার মাঠটা তোরা চিনিস তো? ওখান থেকে ক্রোশ দুয়েক দূরে – সোজা দক্ষিণে। জঙ্গলের ভেতর। চিনতে অসুবিধে হবে না। আমাদের লোকজন থাকবে – ভাণ্ডারে অস্ত্র ঢুকুক। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে”।
জনা বলল, “অস্ত্রগুলো হাতে পেলে, রামালিদের মতো আমরাও দিন-রাত এক করে মহড়া দেব ভল্লাদাদা। তারপর প্রথম আঘাতটা হানব গ্রামপ্রধানের বাড়িতে”।
“গ্রামপ্রধানের বাড়ি? তোদের বটতলি গ্রামের?”
“তাকে তুমি নোনাপুরের গ্রামপ্রধানমশাইয়ের মতো ভাবছো, ভল্লাদাদা? হুঁঃ - সে হচ্ছে শকুন – গ্রামের লোকেদের রক্ত চুষে খায়। তার বাড়ি-ঘর, বিলাসিতা, আর উৎসবের জমক দেখলে মনে হবে – ছোটখাটো রাজাই বোধ হয়। এরকম বহু আছে আশেপাশের সব গ্রামেই”।
“কী করবি?”
মিলার চোখ যেন ঝলসে উঠল, বলল, “ভিখিরি করে দেব – ওর গোলার শস্য বিলিয়ে দেব গ্রামের গরীব মানুষগুলোকে। পেতল-কাঁসার বাসন-পত্র, কাপড়-চোপড় – যা পাবো সব বিলিয়ে দেব। আর টাকাকড়ি গয়না-গাঁটি যা পাবো – কিছুটা রাখব – কিছুটা গ্রামের কাজে লাগাবো। ওই প্রধানের বাড়িতেই একটা পুকুর আছে, ভল্লাদাদা, সেখানে গ্রামের কাউকে ঢুকতে দেয় না। সেটাকে আরও বড়ো করে কাটাবো, কাছাকাছি লোকেরা ওই পুকুরের জল ব্যবহার করুক না – টুকটাক সেচের কাজে কিংবা নিত্য প্রয়োজনে…”।
ভল্লা একটু চিন্তা করে বলল, “সামনের অমাবস্যায় আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে। হাতে খুব বেশি সময় নেই – এ কটাদিন আমি আর রামালি একটু ব্যস্ত থাকব। ওটা হয়ে গেলে, আমি তোদের সঙ্গেই বেশি থাকব। শুধু দক্ষতা দিয়ে লড়াই জেতা যায় না, মিলা – তার জন্যে আগে থেকে পরিকল্পনা করতে হয়। সেটাও তোদের শিখতে হবে”।
“পরিকল্পনা মানে”।
ভল্লা একটু হেসে বলল, “এখনই পুরোটা বলব না – শুরুটা বলছি। তোদের ওই প্রধানের বাড়িতে দিনে-রাতে দুটো চালাক-চতুর ছেলে লাগিয়ে রাখ – পারলে, কোন কাজের ছুতোয় বাড়িতে ঢুকিয়ে দে। তারা সব কিছু জেনে নিক। কোন ঘরে কে থাকে? কোন ঘরে টাকা-কড়ি গয়না-গাঁটি রাখা থাকে? সিন্দুকের চাবি কার কাছে থাকে? রাত্রে কজন পাহারা দেয় – তাদের ভাবগতিক কেমন? এরকম আর কি – এই সন্ধানগুলো আগে থেকে জানলে – খুব কমসময়ে কাজটা মনোমত ভাবে সেরে ফেলা যায়। নিজেদের বিপদও কমানো যায়”।
জনা আর মিলা অবাক হয়ে ভল্লার কথা শুনছিল, বলল, “বাস্ রে, ঠিক তো…, বুঝতে পারছি একটু একটু…”।
ভল্লা উঠে দাঁড়াল, বলল, “এখন এটুকুই কর - বাকি পরে বলব। এখন চলি রে। ওঃ মনে আছে তো, কাল সকালে কুলিকপ্রধান তার লোকজন নিয়ে আসবে তোদের ঘর বানানোর কাজ শুরু করতে। এলেই আমি বা রামালি নিয়ে আসব এখানে…”।
ভল্লা রণপায়ে চড়ে দৌড়ে চলল নোনাপুরের মহড়া-মাঠের দিকে।
মহড়া-মাঠে পোঁছে ভল্লা একধারে বসল। দেখল ছেলেরা তির ছোঁড়া অভ্যেস করছে। ভল্লাকে দেখেই আহোক আর বিশুন দৌড়ে এল, বলল, “ভল্লাদাদা, শুনেছো? সেদিন থেকে শল্কুর তো কোন সন্ধান পাওয়াই গেল না, তার ওপর আজ ভোর থেকে কমলিমাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না”।
“শল্কুর মামাবাড়িতে যারা গিয়েছিল, তারা ফিরে এসেছে?”
“হ্যাঁ ভল্লাদাদা, শল্কুর দুই দাদা গিয়েছিল। ওখানে শল্কু যায়নি”।
“যাচ্চলে – গেল কোথায় ছেলেটা? আশ্চর্য ব্যাপার! সন্ন্যাসী হয়ে কোথাও চলে যায়নি তো, নেড়ামুণ্ডিদের বিহারে? আমাদের ওদিকের ছেলেপুলেরা খুব যায়”।
“কিন্তু কমলিমায়ের কী হল?”
ভল্লা হাসল, বলল, “কমলিমায়ের আবার কী হবে? কিছুই হয়নি। গতকাল মাঝরাত্রে কমলিমাকে আমি আর রামালি গিয়ে তুলে এনেছি। আমার বাসাতেই আছে…আমাদের জন্যে দুপুরের রান্না করছে”।
“তোমরা? কমলিমাকে তুলে এনেছ?”
“হ্যাঁ – কেন? কিছু অন্যায় করে ফেললাম নাকি? কালকে দেখতে গিয়েছিলাম – দেখেই বুঝলাম কমলিমায়ের বাঁচার কোন ইচ্ছে নেই। চান নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই…কী দশা হয়েছে আমার কমলিমায়ের! বললাম, আমার সঙ্গে চল - কিছুতেই আসবে না। তারপর জোর করে ধরে এনেছি। বাসায় ফিরে রামালি রান্না করল। ওই রাত্রেই কমলিমা পুকুরে গেল চান করতে – কতদিন পরে নাইল কে জানে? ফিরে এসে রামালির রান্না খেয়ে কেঁদেকেটে একসা। আজ ভোরে বেরোনোর সময় দেখি – বেড়ার দরজায় – জলছড়া দিচ্ছে। বুঝলাম কমলিমা আবার “কমলিমা” হয়ে উঠছে”।
“ইস্, এত কাণ্ড করেছো – কিন্তু রামালি কিছু বলল না কেন?”
“রামালিকে চিনিস না? সাত চড়ে রা কাড়ে? হতভাগার কথা বলতে, গায়ে যেন জ্বর আসে। কিন্তু শল্কুটা গেল কোন চুলোয়? ছেলেটা ভাবিয়ে তুলল তো…”। কথা বলতে বলতেও ভল্লা ছেলেদের দিকে লক্ষ্য রাখছিল – তির ছোঁড়াটা ওরা বেশ ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে। “বাঃ তির ছোঁড়াটাও ভালোই শিখছিস”।
বিশুন বলল, “তোমার ওই বল্লম বা ভল্ল ছোঁড়ার থেকে তির ছোঁড়া অনেক সহজ। তুমি যে আগেই কেন তির ছোঁড়াটা শেখাওনি…!”
ভল্লা বিশুনের মাথায় হাল্কা চাঁটি মেরে বলল, “তোর মুণ্ডু। তির ছোঁড়াটাই সব থেকে কঠিন – ওটা প্রথমে শুরু করলে – আজও তির ছোঁড়াতেই আটকে থাকতিস। ভল্ল আর বল্লমের অভ্যাস করার জন্যে তোদের হাত আর চোখের তাল-মিলটা তৈরি হয়ে গেছে। সেই জন্যেই সহজ লাগছে তির ছোঁড়াটা। মহড়া তো ভালই হচ্ছে - এখন সবাইকে ডাক, একটু উপদেশ দিই”।
আহোক আর বিশুন ডাকতে সকলে ওদের কাছে এল, ভল্লা বলল, “সবাই বস, কাল রাত্রে কতক্ষণ মহড়া দিলি?”
আহোক বলল, “প্রায় এক প্রহর”।
“বাঃ। কিন্তু অতক্ষণ এখানে থাকলে বিশ্রাম নিবি কখন? মহড়ার শেষে তোদের বাড়ি ফিরতেও তো দণ্ড দুয়েক লাগে…। রাত্রের মহড়ার উদ্দেশ্য হল আলো-ছায়াতে চোখের দৃষ্টিটাকে তীক্ষ্ণ করা। দিনেরবেলায় সূর্যের আলোতে দৃষ্টিবিভ্রম হয় না বললেই চলে। কিন্তু আলো-আঁধারে খুব হয় – বিশেষ করে জ্যোৎস্না রাতে। মাঠের দিকে তাকালে একটু দূরের ঝোপঝাড়গুলোকে মনে হয় কোন জন্তু। এমনও মনে হয় সেগুলো বুঝি চলে ফিরে বেড়াচ্ছে – একটু আগে ওটা কি এত কাছে ছিল? একটু দূরে ছিল না? ঝোপঝাড়কে জন্তু ভাবলে কোন ক্ষতি নেই – কিন্তু একটা লোক একটু অন্ধকারে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে – তোর চোখে পড়ল – কিন্তু তুই ভাবলি - ধুর গাছের ছায়াটাকে মানুষ মনে হচ্ছে। সেটা কিন্তু মারাত্মক হতে পারে। অন্ধকারে তীক্ষ্ণ নজরের অভ্যাস সেই বিভ্রমটা কাটিয়ে দেয়। রাত্রের দিকে যখনই ঘরের বাইরে বেরোবি – একটু দূরের অন্ধকারের যে কোন বস্তুকে সঠিক চিনতে চেষ্টা করবি। তাহলেই দেখবি অন্ধকারেও চোখ চলবে…। বোঝা গেল?”
একটু থেমে ভল্লা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “এতদিন আমিই লক্ষ্যভেদ বলতে মানুষের হৃৎপিণ্ডের কথা বলেছি তোদের – তোরাও সেভাবেই অভ্যাস করেছিস। আজ বলছি – লক্ষ্যটা প্রয়োজনে বদলাতেও পারে। অনেক সময় রাজরক্ষীরা গায়ে লোহার কবচ পড়ে – তার বুকে ভল্ল ছুঁড়লে ঠিকরে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য বদলাতে হবে। একটা লোককে মারতে আর কোথায় কোথায় চরম আঘাত হানা যায়? মাথায়, চোখে, কানে, গলায় এবং পিছন থেকে হলে ঘাড়ে। মাথাতেও অনেকসময় রক্ষীরা কবচ পরে – তার নাম শিরস্ত্রাণ। সেক্ষেত্রে বাকি রইল চোখ, কান, গলা অথবা ঘাড়। বল্লমের অথবা তিরের বা ভল্লর ফলা এই মোক্ষম জায়গাগুলিতে গেঁথে দিতে পারলেই – শত্রুর শেষ। বল্লমটা লাগে সামনাসামনি লড়াইয়ের সময়। একটা বল্লম আমাকে দে – দেখাই। এই দ্যাখ বল্লমের ফলাটা যখন ঢোকে – খুব সহজেই ঢুকে যায় – কিন্তু বের করার সময় –ফলার এই কানদুটো – আশেপাশের মাংসপেশী এবং ধমনী বা শিরাকে ছিঁড়ে নিয়ে বের হয় – সেটা আরও বেশি মারাত্মক। কাজেই বল্লমে কাউকে গাঁথলে অবশ্যই গায়ের জোরে টানবি। ভল্ল বা তির অনেকটাই দূর থেকে ছোঁড়া হয় বলে, সহজে টেনে নেওয়ার উপায় নেই – শত্রু মরেছে নিশ্চিত হলেই কাছে গিয়ে টেনে তোলার প্রশ্ন আসবে”।
সুরুল বলল, “শত্রু নিশ্চিত মরেছে কিনা জানার কোন উপায় আছে, ভল্লাদাদা?”
“ভালো প্রশ্ন করেছিস, সুরুল। সহজ কোন উপায় নেই। তোর আঘাতে শত্রু ধর মাটিতে পড়ে ছটফট করছে – অথবা টলতে টলতে দৌড়ে পালাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সন্তর্পণে এগিয়ে যাবি এবং শেষ আঘাতে শত্রুকে শেষ করবি। কিন্তু খুব সাবধান – তুই হয়তো একজনের দিকে লক্ষ্য রেখে এগোচ্ছিস – কিন্তু তোর আশেপাশে বা পিছনে অন্য শত্রু হয়তো এগিয়ে আসছে – সেক্ষেত্রে আহত শত্রুকে তখনকার মতো ছেড়ে দে – অন্য শত্রুর দিকে মন দে। এখানে আরও বলি – আস্থানের ছবিটা তোদের নিশ্চয়ই মনে আছে – সে ঘরগুলোর কিছু ঘরে ছাদ আছে, কিছু ঘরে টালির চাল। সেক্ষেত্রে তোর শত্রু ওপরেও থাকতে পারে। অতএব একজনকে লক্ষ্য রাখছিস বলে – অন্যদিকে চোখ রাখবি না – এমন যেন কখনোই না হয়। যে যতবেশী সতর্ক – সে ততবেশি নিরাপদ”।
সকলকে কিছুটা সময় দিয়ে ভল্লা আবার বলল, “কিছু কিছু অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের আবার আশ্চর্য মানসিক নিয়ন্ত্রণ থাকে – তারা মরণ আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করেও মাটিতে মরার মতো নিশ্চল শুয়ে থাকতে পারে। কাজেই তোর আঘাতের পরেই কেউ মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেল দেখে – চট করে তার কাছে যাবি না – সে হয়তো অপেক্ষাতে আছে – মরার আগে তোকে একটা শেষ আঘাত হানার জন্যে। আবারও বলি - যে যতবেশী সতর্ক – সে ততবেশি নিরাপদ। মনে রাখিস - নিজের জীবনের থেকে মূল্যবান, জগতে আর কিচ্ছু হতে পারে না”।
সকলেই চুপ করে রইল ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে। ভল্লা হাসল, বলল, “কী হল? সবাই ভয়ে ভেবলে গেলি নাকি? প্রথম দিন থেকেই তোদের বলেছিলাম, ভালো যোদ্ধা হতে হলে দরকার শক্তি, দক্ষতা এবং মস্তিষ্ক। মনে আছে? তোরা দক্ষ হচ্ছিস, তোদের শক্তি বাড়ছে – সেই সঙ্গে বাড়িয়ে তোল মস্তিষ্কের দক্ষতাও! তবে না লড়াইয়ের মজা”।
একটু সময় দিয়ে প্রসঙ্গ বদলাতে ভল্লা বলে উঠল, “হ্যারে রামালি, তোদের সেই কবিরাজ ছেলেটি, বড়্বলাকে বার্তা পাঠিয়েছিস?”
“না গো ওদের খাবার আনতে গ্রাম থেকে যারা আসবে, তাদের বলে দেব - সন্ধ্যে বেলায় তোমার বাসায় যেন দেখা করে”।
“ঠিক আছে”। তারপর সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা মজা পাওয়া মুখে বলল, “কিন্তু ছেলেটি আমাদের বাসায় গিয়ে চমকে উঠবে, বল? কমলিমা বেরিয়ে এসে যখন বলবেন – কেমন আছিস, বাবা?”
তিনজন ছাড়া সকলেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “তোমার বাসায় কমলিমা?”
“কেমন দিলাম বল? রামালি তো সবটাই জানে – আহোক আর বিশুনকে একটু আগেই সব বলেছি – ওদের থেকে শুনে নিস। কিন্তু শল্কুটার কী হল বল তো? বিশুন বলছিল ও নাকি মামাবাড়িতেও যায়নি”।
সুরুল বলল, “সত্যি কিনা জানি না। আমাদের গ্রামের এক রাখাল বলছিল, ওই দিন একজন লোককে নাকি সে – আমাদের গ্রামের পিছনদিকের মাঠ পেরিয়ে দক্ষিণদিকে যেতে দেখেছিল। মোটামুটি প্রথম প্রহরের শেষ কিংবা দ্বিতীয় প্রহরের শুরুতে। রাখালটা নাকি জিজ্ঞাসাও করেছিল – কোথা থেকে আসা হচ্ছে কত্তা – যাবেই বা কোথায়? তাতে লোকটা নাকি কোন সাড়া না দিয়ে – মুখটা গামছায় ঢেকে দৌড়তে শুরু করেছিল। রাখাল ছেলেটি লোকটার চেহারার যা বর্ণনা দিল, সে শল্কু হলেও হতে পারে। আমাদের গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণে আস্থান ছাড়া ও আর কোথায় যাবে, ভল্লাদাদা? ওদিকে কাছাকাছি বলতে, তিন-চার ক্রোশের আগে আর তো কোন গ্রাম নেই!”
“একা একা আস্থানে গিয়েছিল? কী বলছিস? এতটা সাহস ওর হবে? আমার মনে হয় না, সুরুল। ও অন্য কেউ হবে…। কিন্তু… যদি শল্কুই হয়, আর যদি সত্যিই ও আস্থানে গিয়ে থাকে…তাহলে এতদিনেও ফিরল না কেন? ওকে কি বন্দী করে রেখে দিয়েছে? শল্কু যদি গিয়ে থাকে – কী করতে গিয়েছিল? আমরা কী করছি না করছি - সব কথা জানাতে গিয়েছিল? তাহলে তো সে এখন রাজসাক্ষী। তার মানে, ও কি এখন আস্থানেই আছে? কিন্তু আস্থানের রক্ষীরা এই কদিনে এদিকে এল না কেন? যে কোনদিন এলেই তো রক্ষীরা আমাদের সকলকে এই মহড়া মাঠে পেয়ে যেত – আস্থান থেকে লুঠ করে আনা সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সহ…। উঁহু। আমার মনে হচ্ছে শল্কু আস্থানে যায়নি। অন্য কোথাও গিয়েছে”।
ছেলেরা ভল্লার যুক্তিতে কোন ফাঁক খুঁজে পেল না। চুপ করে সবাই ভাবতে লাগল। ভল্লা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এখন চলি রে। খেয়ে এসে আমাদের পরিকল্পনাটা আরেকবার ঝালিয়ে নেব। শল্কুর কথা চিন্তা করে লাভ নেই – ও নিজে না ফিরলে আমাদের কী করার আছে? রামালি চল। কমলিমা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন…”।
ক্রমশ...