ওরা চলে যেতে ভল্লা গ্রামের দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করল। গ্রামের এদিকটা এখনও তার দেখা হয়নি। এদিকে বসত কম। বিচ্ছিন্ন কিছু আবাদি জমি, আর অধিকাংশই অনাবাদি পোড়ো জমি। ভল্লা হাঁটতে লাগল। অনেকক্ষণ চলার পর তার মনে হল, সে গ্রামের সীমা ছাড়িয়ে এসেছে। জনহীন প্রান্তর - কিছু বড় গাছপালা, ছোটছোট ঝোপঝাড় সর্বত্র। আরও কিছুটা গিয়ে তার কানে এল বহতা জলের শব্দ। অবাক হল – এমন রুক্ষ প্রান্তরে কোথা থেকে আসছে এই ক্ষীণ জলধ্বনি। এগোতে এগোতে ভল্লা ছোট্ট একটা নালার পাশে দাঁড়াল। পূব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলেছে জলধারা। খুবই সামান্য – কিন্তু ভল্লার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোথা থেকে আসছে, এই জলধারা? এ অঞ্চলে বর্ষা হয় সামান্যই – তাহলে কোন উৎসমুখ এই জলধারাকে সজীব রেখেছে এই মধ্য শীতেও।
এই গ্রামের অবস্থান চিত্রটি সে মনে মনে চিন্তা করল কিছুক্ষণ। এই গ্রামে আসার সময় পাহাড়ের কোলে রাজপথের ধারে সেই সরোবর দেখেছিল। সেই রাজপথ থেকে অনেকটাই নিচে এই গ্রামের অবস্থান। আজ সকালে যে দীঘির ঘাটে সে বসেছিল, সেটি এই গ্রামের পূর্ব সীমানায় এবং তার পরেই রয়েছে খাড়া অনুচ্চ যে পাহাড়টি – তারই শীর্ষে রয়েছে রাজপথের সরোবরটি। আজ সকালে গ্রাম পরিক্রমণের সময় আরও কয়েকটি পুকুর সে লক্ষ্য করেছে। তাহলে ওই দুই সরোবর, ওই পুকুরগুলি এবং এই নালার উৎস কি একই? প্রকৃতির কি আশ্চর্য লীলা – সরোবর কিংবা পুকুরগুলি কখনো প্লাবিত হয় না, কিংবা জলহীনও হয় না। ওগুলিকে সম্বৎসর পরিপূর্ণ রেখে উদ্বৃত্ত জলরাশি প্রবাহিত হয় এই নালাপথে! বর্ষায় হয়তো এই নালার প্রবাহ গতি পায়। ভল্লা আশ্চর্য হল। সে নালাপথের উজান বরাবর এগিয়ে চলল পূর্বদিকে। লক্ষ্য করতে করতে চলল নালার এপাশের জমির প্রকৃতি, গাছপালা ঝোপঝাড়। ভল্লার কৃষিকাজে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। তবু রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে যেটুকু সে দেখেছে, তার মনে হল, আপাত অনুর্বর এই জমিকেও কৃষিযোগ্য করে তোলা সম্ভব। একটু পরিশ্রম করলে, এই নালার জল কৃষিকাজে সম্বৎসর ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রায় ক্রোশার্ধ হেঁটে সে পৌঁছল গ্রামের পূর্বসীমানার সেই পাহাড়তলিতে। এই জায়গাতেই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা একটি শীর্ণ জলধারা সমতলে নেমেছে। এই জায়গায় জলধারা কিছুটা বিস্তৃত, বড়ো বড়ো কিছু পাথর আর নুড়ির মধ্যে দিয়ে পথ করে কিছুদূর বয়ে গেছে। তারপরেই শুরু হয়েছে শীর্ণ নালা প্রবাহ। ভল্লা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করল, আশপাশের জমি-জায়গা। তার মনে হল, এই সব পাথর-নুড়ি আর মাটি দিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব দুর্বল বাঁধ। তার উজানে বানিয়ে তোলা যেতে পারে ক্ষুদ্র জলাধার। এই স্থানটির অবস্থান যেহেতু একটু উঁচুতে, অতএব ওই জলাধার থেকে কৃত্রিম নালি কেটে জলকে চারিয়ে দেওয়া যেতে পারে সংলগ্ন নাবাল জমিগুলিতে। নিষিক্ত জমিতে চাষ করা যেতে পারে কিছু কিছু উপযোগী ফসল।
ভল্লা দক্ষ সৈনিক, তীক্ষ্ণবুদ্ধি গুপ্তচর। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে জানে, একটি গ্রামের সকল অধিবাসীকে কখনও উত্তেজিত করা যায় না। কতিপয় মানুষ বিদ্রোহী হয়। ভল্লা জানে এই গ্রামেরও নির্বিবাদী অধিকাংশ মানুষ হয় উদাসীন থাকবে, নয়তো ক্ষুব্ধ হতে থাকবে ভল্লার ওপর। বিদ্রোহী ছেলেদের বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা পরিজন সকলেই ভল্লার ওপর ক্রুদ্ধ হতে থাকবে, তাদের ছেলেদের “মাথাগুলি চিবিয়ে খাওয়ার” জন্যে। সেই ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হতে পারে, গ্রামের অর্থনৈতিক কিছু উন্নতির দিশা দেখাতে পারলে। সামান্য হলেও, ওই জলাধার এবং উদ্বৃত্ত কিছু ফসলযোগ্য জমির সৃজন, বাড়িয়ে তুলবে ভল্লার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা।
সন্ধ্যার কিছু আগে ভল্লা আগের জায়গাতেই ফিরে এল। সূর্য অস্ত গেলেও পশ্চিমদিগন্তে তার আলোর রেশ এখনও রয়েছে। বড়ো গাছের নিচে বসতে গিয়ে দেখল, তিনজন ছোকরা মাটিতে শুয়ে আছে। হাপরের মতো ওঠানামা করছে তাদের বুকগুলো। ভল্লা খুশি হল, কিন্তু চেঁচিয়ে ধমক দিল তিনজনকেই। বলল, “দৌড়ে এসে হাঁফাচ্ছিস, কিন্তু শুয়ে শুয়ে হাঁফাচ্ছিস কেন? একজায়গায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাঁফানো যায় না? ওঠ, উঠে বস। এতক্ষণের পরিশ্রমে পুরো জল ঢেলে দিলি, হতভাগারা”। ভল্লার কথায় তিনজনেই উঠে বসল এবং হাঁফাতে লাগল। ভল্লা বলল, “ধর শত্রুপক্ষের তাড়া খেয়ে, এ অব্দি নিরাপদেই এসেছিস। কিন্তু এরপর কী করবি?”
“ওফ্। আগে একটু শ্বাস নিতে দাও ভল্লাদাদা”।
ভল্লা আবারও ধমকে উঠল, “না, শ্বাস নিতে হবে, তার সঙ্গে ভাবনা চিন্তাও করতে হবে”। এই সময় আরও পাঁচজন ছেলে পৌঁছল। ভল্লা বলল, “বাঃ, প্রথম দিনেরপক্ষে ভালই – চল আমরা এসসঙ্গে নামতা বলি...এক এক্কে এক, এক দুগুণে দুই...জোরে জোরে চেঁচিয়ে...সবাই একসঙ্গে”। সন্ধের আগেই বাইশ জন এসে পৌঁছল, আরেকটু পরে পৌঁছল আরও বারো জন।
সকলে একটু ধাতস্থ হতে ভল্লা বলল, “বিয়াল্লিশ জন ফিরেছিস দেখছি, বাকিরা?”
“ওরা সরোবর অব্দি গিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামেনি, ফিরে আসছে গ্রামের পথেই”।
ভল্লা হাসল, “এরকম রোজ দুবেলা দৌড়তে পারবি? খুব ভোরে আর আজকের মতো বিকেলে?”
“পারবো”।
“ঘোড়ার ডিম পারবি। কাল সকালে গায়ের ব্যথায় উঠতেই পারবি না। বোনকে দিয়ে গা-হাত-পা টেপাবি”।
“পারবো”। কেউ কেউ বলল, কিন্তু তাদের গলায় আগেকার সে জোর নেই।
ভল্লা হাসল, “কাল সকালে পায়ে, গায়ে, কাঁধে ব্যথা হবে। হবেই। কিন্তু কালকেও দৌড়তেই হবে, আজকের মতো এত তাড়াতাড়ি না হলেও – হাল্কা ছন্দে। একটু দৌড়লেই দেখবি – গায়ের ব্যথা কমে যাবে – কষ্ট কমে যাবে। আর দৌড়তে দৌড়তেও ভাববি, চিন্তা করবি – যা খুশি, যা তোর মন চায়। মনে রাখিস দৌড়লে আমাদের সর্বাঙ্গের পেশীর শক্তি বাড়ে। শক্তি বাড়ে আমাদের ফুসফুসের, আমাদের হৃদয়ের। কিন্তু মস্তিষ্ক? তার কী হবে? ভয়ংকর পরিশ্রমের মধ্যে, প্রচণ্ড আতঙ্কে, ভীষণ ক্লান্তিতেও আমাদের মাথা যেন কখনো অলস না থাকে। কোন কিছু না পেলে আমাকেই খুব গালাগাল দিবি। ভাববি কি কুক্ষণেই না ভল্লাদাদার কাছে গিয়েছিলাম। শয়তান লোকটা আমাদের সবাইকে খাটিয়ে মারছে, আর নিজে বসে বসে শুধু উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। ও হ্যাঁ, কাল সকালে আমিও তোদের সঙ্গে দৌড়বো। কমলিমায়ের যত্নে শরীরটা বড়ো অলস হয়ে উঠেছে – সেটাকে আবার চাঙ্গা করতে হবে”।
অন্যদিনের তুলনায় আজ বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হল জুজাকের। কমলি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন – বারবার বেরিয়ে বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন, মানুষটা আসছে কিনা। আজ অমাবস্যা। দুপাশের গাছপালা, ঝোপঝাড়ে গভীর অন্ধকার। তারার আলোয় পথটাকেই অস্পষ্ট ঠাহর করা যায়। পথের প্রেক্ষাপটে মানুষের অবয়ব বুঝতে পারা যায়। কমলির উদ্বেগ বাড়ছিল, জুজাক গ্রামপ্রধান ঠিকই, তবে তিনি শুনেছেন রাজধানী থেকে আসা রাজকর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামপ্রধানকে সমীহ করে না। তারওপর জুজাক কিছুটা মুখফোঁড় বদরাগীও বটে। আধিকারিকদের কোনো তির্যক প্রশ্নের ব্যাঁকা উত্তর দিয়ে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে তার জুড়ি নেই। তার এই স্পষ্টবাদী সরল চরিত্রের জন্যেই গ্রামের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে গ্রামপ্রধান বানিয়েছে। জুজাকের জন্য একদিকে কমলি যেমন গর্ব অনুভব করেন, অন্যদিকে ততটাই শঙ্কিতও থাকেন সর্বদা। তিনি জানেন দিনকাল বদলে চলেছে নিরন্তর। অপ্রিয় সত্যকথা কেউই সহ্য করতে পারে না। প্রশাসনিক আধিকারিকরা তো নয়ই।
আজ অন্য আরেকটি বিষয়ও কমলির দুশ্চিন্তাকে বাড়িয়ে তুলেছে। ভল্লা। আজ গ্রামে সকলের সামনে সে নিজের মুখেই স্বীকার করেছে তার অপরাধের কথা। তার নির্বাসন দণ্ডের কথা। রাজকর্মচারীদের কাছে কী সে সংবাদ পৌঁছে গিয়েছে? যদি তারা জেনে গিয়ে থাকে ভল্লা জুজাকের ঘরেই আশ্রয় পেয়েছে। এই ঘরেই সে চিকিৎসা এবং সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে। সেটা কি তারা রাজদ্রোহীতা বলে মনে করবে? জুজাককে শাস্তি দেবে? কশাঘাত করবে? কিংবা বন্দী করে রক্ষীদের দিয়ে শারীরিক অত্যাচার করবে?
হতভাগা ছেলেটা গেলই বা কোথায় কে জানে? নিজের ঘরে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে “আমি একটু ঘুরে আসছি, মা” বলে বেরিয়েছিল শেষ দুপুরে। এখনও পর্যন্ত তারও দেখা নেই। ঘরে থাকলে, একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আসতে পারত ছেলেটা। জুজাকের সঙ্গে যারা গিয়েছিল তাদের বাড়ি গিয়েও খবর আনতে পারত। বলা যায় না, জুজাক হয়তো, তাদের কারো বাড়িতে বসে জমিয়ে গল্প করছে। লোকটার কাণ্ডজ্ঞান ওরকমই। তার জন্যে ঘরে যে কেউ উৎকণ্ঠায় বসে আছে, সে কথা তার মনেই পড়ে না।
ঘরবার করতে করতে কমলি লক্ষ্য করলেন, তুলসীমঞ্চের প্রদীপে তেল ফুরিয়ে এসেছে, সলতেটা ম্লান হয়ে জ্বলছে। দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে রেডির তেল এনে প্রদীপে ঢাললেন, সলতেটা একটু উস্কে দিলেন। আর তখনই বেড়ার দরজা খোলার শব্দ হল, চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, জুজাক ঢুকছেন।
“এত রাত হল? কিছু গোলমাল হয়নি তো?”
জুজাক কোন উত্তর দিলেন না, ঘোঁত করে নাকে শব্দ করে, দাওয়ায় বসলেন। কমলি দৌড়ে গিয়ে ঘটি করে পা ধোয়ার জল আনলেন। ঘর থেকে নিয়ে এলেন জুজাকের গামছাখানা। জুজাক ঘটির জলে পা ধোয়া শুরু করতে, কমলি বললেন, “কিছু বললে না, তো? এত দেরি হল কেন?”
দুই পা ধুয়ে, গামছা দিয়ে ধীরেসুস্থে পা মুছতে মুছতে জুজাক বললেন, “গাঁয়ে ফিরেছি অনেকক্ষণ। ও পাড়ায় ঢুকতেই লোকজনের মুখে তোমার ছেলের গুণকীর্তন শুনছিলাম। তুমি শুনেছ?”
“শুনেছি”।
“তা আর শুনবে না? তোমার আদরের ছেলের জন্যে কাছারিবাড়িতেও আমাকে কত কথা শুনতে হল। খাবার জল দাও তো”।
কমলি ঘর থেকে খাবার জল এনে দিলেন। “কী বলেছে তারা?”
জুজাক মাটির ঘটি হাতে তুলে নিয়ে নিঃশেষ করলেন ঘটিটা। তারপর তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন, “হবে আর কী? গিয়েছিলাম কান্নাকাটি করে এ গ্রামের মানুষদের কিছুটা কর যদি কমানো যায়। অন্ততঃ সম্বৎসর সকলের পেটটা যাতে চলে যায়। সে কথায় কানই দিল না? বললে, ভল্লা তোমার বাড়িতে আছে? বললাম, আছে। বললে, একজন অপরাধী – যার রাজধানীর প্রশাসন থেকে নির্বাসন দণ্ড ঘোষণা হয়েছে। তাকে তুমি বহাল তবিয়তে খাওয়াচ্ছো, দাওয়াচ্ছো, চিকিৎসা করাচ্ছো। আর রাজার কর দিতেই তোমার নাকে কান্না শুরু হয়ে গেল?”
কমলি উদ্বেগের স্বরে বললেন, “কী অবস্থায় ছেলেটা এসেছিল তুমি বললে না?”
জুজাক একটু ঝেঁজে উঠে বললেন, “বলব না কেন? সবই বলেছি”। তারপর একটু থেমে নরম স্বরে বললেন, “ওরা রাজ কর্মচারী। তাদের কাছে ভল্লার পরিচয় অপরাধী। সে আর মানুষ নয়, জন্তু। ওদের কথা, ঘেয়ো কুকুরের মত যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই ওকে তাড়িয়ে দিইনি কেন? জগৎটা তোমার মতো মায়ের মন নিয়ে যে চলে না, কমলি”।
কমলি জুজাকের সহানুভূতির সুরে আশ্বস্ত হলেন। মানুষটাকে ওপরে ওপরে কঠোর মনে হলেও, মনটা নরম। তা যদি না হত, জুজাক জোর করেই ভল্লাকে তাড়িয়ে দিতে পারতেন। তৎক্ষণাৎ না হলেও, যেদিন ভল্লার প্রথম জ্ঞান হল, সেদিনই। আজকে রাজ-প্রতিনিধির যে তিরষ্কার তিনি শুনে এলেন – এমন যে হবে সেকথা জুজাক বহুবার বলেছেন। বারবার বলেওছেন, হতভাগাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেব – কিন্তু দিতে পারেননি। মানবিক বোধের কাছে তার বাস্তব যুক্তি হার মেনেছে।
কমলি জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু ওদের কাছে এ খবর পৌঁছে দিল কে? নিশ্চই এই গাঁয়েরই কেউ?”
“সে তো বটেই। সব গ্রামেই ওদের গুপ্তচর থাকে। তাদের কাজই তো ওদের খবর দেওয়া। সে যাক, ছোঁড়াটাকে ডাক দেখি একবার”।
“সে তো সেই দুপুরের দিকে বেরিয়ে গেছে, এখনও ফেরেনি”।
“কোথায় গিয়েছে তোমাকে বলেও যায়নি? আশ্চর্য। কবিরাজদাদার বাড়িতে আমরা বেশ কয়েকজন কথাবার্তা বলছিলাম। সেখানে শুনলাম, সকালে ভল্লার বক্তৃতা শুনে কয়েকজন ছোকরা নাকি বেশ বিগড়ে গেছে। দুপুরের পর থেকেই তারাও বাড়িতে নেই। তবে কি...”।
কমলি আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “তবে কি গো? ওই ছোঁড়াগুলো কি ভল্লাকে মারধোর করবে?”
জুজাক হেসে ফেললেন কমলির সরলতায়, বললেন, “মেয়েদের লাঞ্ছনা রোধ করতে গিয়ে সে অপরাধী হয়েছে। রাজ-প্রশাসন লম্পট মানুষটাকে শাস্তি না দিয়ে, সাজা দিয়েছে ভল্লাকে। এ গাঁয়ের ছোকরাদের চোখে ভল্লা এখন বীর-নায়ক। কবিরাজদাদা বলছিলেন, ভল্লা বোধ হয় ছোকরাদের নিয়ে একটা দল গড়তে চাইছে”।
কমলি অবাক হয়ে বললেন, “কিসের দল?”
জুজাক আবার একটু ঝেঁজে উঠলেন, বললেন, “তার আমি কী জানি? তোমার মনে আছে, কবিরাজদাদা ওর শরীরের লক্ষণ দেখে বলেছিলেন, ভল্লা সাধারণ এলেবেলে ছেলে নয়। যথেষ্ট শক্তিশালী যোদ্ধা। আরও বলেছিলেন, ওই চরম অসুস্থ অবস্থায় ওর এখানে আসাটা হয়তো আকস্মিক নয়। হয়তো গোপন কোন উদ্দেশ্য আছে। আজকে সকলের সামনে কবিরাজদাদা সে প্রসঙ্গ তোলেননি। কিন্তু আমারও এখন মনে হচ্ছে কবিরাজদাদার কথাই ঠিক”।
কমলি কিছু বললেন না। হাঁটুতে থুতনি রেখে গভীর চিন্তা করতে লাগলেন, ভল্লাকে দেখে কই আমার তো তেমন কিছু মনে হয়নি। এ গ্রামে আসা থেকে আমি তাকে যত কাছে থেকে দেখেছি, আর কে দেখেছে? তার কথাবার্তায়, তার মা ডাকে কোথাও কোন উদ্দেশ্যর সন্ধান তো তিনি পাননি। আজকে গ্রামের সবার সামনে মন খুলে নিজের অপরাধের কথা যে ভাবে সে স্বীকার করেছে, তার মনে যদি সত্যিই কোন পাপ বা অপরাধ বোধ থাকত, পারত ওভাবে বলতে?
জুজাক বললেন, “খাবার বাড়ো, খেয়ে শুয়ে পড়ি”।
কমলি তাড়াতাড়ি উঠে খাবার আনতে ঘরে ঢুকলেন। সেদিকে তাকিয়ে জুজাক বললেন, “তোমার ছেলে যত রাতই হোক বাড়িতে তো ঢুকবেই। তুমি ছাড়া তার জন্যে কে আর রাত জেগে খাবার কোলে বসে থাকবে? এলে বলে দিও, সামনের অষ্টমীতে ওকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে কাছারি শিবিরে যেতে হবে। বলে দিও, না গেলে ওর তো বিপদ হবেই, আমাদেরও রক্ষা থাকবে না”।
ক্রমশ...