শুকনো পাতা দিয়ে বানানো গদিতে ভল্লা শুয়ে আছে। আজ পাঁচদিন হল সে একইভাবে শুয়ে আছে, নিশ্চেতন। তার মাথার কাছে বসে আছেন জুজাকের বউ। জুজাক দাঁড়িয়ে আছেন পায়ের দিকে। আর নিচু হয়ে বৃদ্ধ কবিরাজ হাতের নাড়ি পরখ করছেন ভল্লার। কিছুক্ষণ পর কবিরাজ ভল্লার হাতটা নামিয়ে দিলেন, বিছানায়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “জুজাক, আমার মন বলছে, ছোকরা এ যাত্রায় বেঁচে গেল। হতভাগার বাপ-মায়ের কপাল ভালো বলতে হবে।”
জুজাকের বউ, জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “ওফ্ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল। ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন”।
জুজাক বিরক্ত হয়ে বললেন, “ছোকরা যদি বাঁচে - সে কবিরাজদাদার ওষুধে আর তোমার সেবায়। এর মধ্যে ভগবান এল কোত্থেকে? যত্তো সব। আমি কিন্তু অন্য কথা ভাবছি, কবিরাজদাদা। ছোকরা চোর না ডাকাত? নাকি পালিয়ে বেড়ানো অপরাধী? কিছুই জানি না আমরা। ছোকরা একটু সুস্থ হলেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দূর করে দেব গ্রাম থেকে”।
কবিরাজ বললেন, “দেখ জুজাক, আমাদের কর্তব্য অসুস্থকে সারিয়ে তোলা। সে ডাকাত হোক কিংবা সাধু মহারাজ, তাতে কিছু যায় আসে না। আমার ধারণা আর এক-দুদিনের মধ্যে ও উঠে-হেঁটে বেড়াতে পারবে। তারপরে তুমিও গ্রাম-প্রধানের কর্তব্য শুরু করতে পারো। আমার কোন বক্তব্য থাকবে না”।
জুজাকের বউ উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, “কিন্তু কবিরাজদাদা, ওর তো এখনও জ্ঞানই ফিরল না। একবারের জন্যেও চোখ মেলে তাকাতে পারল না। আপনি বলছেন, দু-একদিনের মধ্যে…”।
কবিরাজ বললেন, “শাস্ত্রে বলে, আমাদের জীবনকে চালনা করে প্রাণশক্তি। ওর ভেতরে সেই প্রাণশক্তির সাড়া আমি পেয়েছি, মা কমলি। চিন্তা করো না আজ বিকেলে অথবা কাল সকালে ওর জ্ঞান ফিরবে, চোখ মেলে তাকাবে। ওর জ্ঞান ফিরলেই আমাকে সংবাদ দিও মা, আমি আসব। এখন আসি”।
জুজাক কবিরাজমশাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে অঙ্গন পার হয়ে পথ পর্যন্ত সঙ্গ দিলেন, তারপর বিদায় জানিয়ে, ঘরে ফিরে এসে বললেন, “যত্তো উটকো ঝামেলা, ঘাড়ে এসে আচ্ছা জুটল। কোথাকার কে, ঠিক, ঠিকানা নেই…”।
কমলি বললেন, “ভোরবেলা সদরে জলছড়া দিতে গিয়ে দেখলাম, বেচারা আমাদের দুয়োরের সামনেই পা দুমড়ে, মুখ থুবড়ে একবার যে পড়ল আর উঠল না। একজন মানুষের এমন অসহায় অবস্থায় ওকে রাস্তাতেই ফেলে আসব?”
জুজাক একটু বিরক্ত স্বরে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, সে কী আর আমি জানি না? আশেপাশের লোককে ডেকে এনে, ব্যাটাকে ঘরে এনে তুললাম তো। তুমিও তো দিন নেই, রাত নেই। নাওয়া নেই খাওয়া নেই সেবা করে চলেছ। বলি, আর কদ্দিন? কবিরাজদাদা বললেন, আজই ওর জ্ঞান ফিরবে, আমি কাল পরশু গ্রামের দশজনকে নিয়ে সভা ডাকব…তার পর দূর দূর করে তাড়িয়ে দেব। হতভাগা যেখানে খুশি চলে যাক, আমাদের কোন মাথাব্যথা থাকবে না”।
কমলি মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, “অসুস্থ একটা মানুষকে নিয়ে তোমার খালি এক কথা – ঘাড় ধাক্কা দেব, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেব…”
জুজাক কিছু বললেন না, “ঘোঁত”, নাক দিয়ে শব্দ করলেন।
কবিরাজমশাইয়ের কথাই ঠিক হল, সেদিন বিকেলেই ভল্লার জ্ঞান ফিরল, চোখ মেলে তাকাল। সে কতদিন অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে, সে জানে না। কিন্তু অবরে সবরে অর্ধচৈতন্য অবস্থাতেও যখনই সে ঘোলাটে চোখ মেলেছে- দেখেছে মায়াবী এক রমণীর মুখ। তার মুখের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রয়েছেন…। আজ জ্ঞান ফেরার পর চোখ মেলে তাকিয়ে সেই রমণীর মুখই সে দেখতে পেল। গভীর কৃতজ্ঞতায় সে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করতে পারল শুধু একটিই শব্দ, “মা…। কমলির মুখে হাসি, দু চোখে অশ্রুর প্লাবন। দু হাতে ভল্লর মুখটি ধরে বললেন, “কি বলছিস, বাবা?” তারপর চেঁচিয়ে স্বামীকে ডাকলেন, বললেন, “শুনছো, ছেলেটা কথা কয়েছে, আমাকে মা ডেকেছে…” ।
জুজাক উঠোনে খাটিয়ায় বসে চারজন প্রবীণ প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্পগাছা করছিলেন। বউয়ের ডাক শুনে দৌড়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন কমলির মুখের হাসি, আর চোখে জল। রাগত স্বরে বললেন, “হুঁঃ তবে আর কি? উলু দাও, শাঁখ বাজাও… আমি ততক্ষণ কবিরাজদাদাকে সংবাদ পাঠাই”।
সন্ধের একটু পরে কবিরাজমশাই এসে ভল্লাকে দেখে সন্তুষ্ট হলেন, তাঁর মুখে মৃদু হাসি। তিনি পুরোনো ওষুধ পালটে কিছু নতুন বটিকা দিলেন। বললেন, “বৌমা, এবার কিন্তু আর শুধু সেবা নয়, উপযুক্ত পথ্যিও দরকার মনে রেখো”। কমলিকে তিনি নতুন বটিকা আর পথ্যের নির্দেশ বুঝিয়ে জুজাককে বললেন, “চলো জুজাক, আমরা বাইরে বসি”।
কবিরাজ মশাই বাড়ির বাইরে আসতেই প্রতিবেশীদের সবাই উঠে দাঁড়াল, জিজ্ঞাসা করল, “কেমন দেখলেন, কবিরাজমশাই?”
কবিরাজমশাই আসনে বসতে বসতে বললেন, “তোমরা সবাই অমন উঠে পড়লে কেন হে? বসো, বসো। ছোকরার বিপদ কেটে গেছে, আর কোন ভয় নেই। আমার ধারণা, কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবে”।
সকলেই বসতে বসতে বলল, “যাক বাবা, যে অবস্থায় এসেছিল, অচেনা আগন্তুক – তবু মানুষতো...”।
জুজাক ঝেঁঝে উঠে বললেন, “আমার ঘাড় থেকে হতভাগা নামলে বাঁচি। ওঠা-হাঁটা শুরু করলেই স্পষ্ট বলে দেব, পথ দেখ বাছা...”।
কবিরাজমশাই হাসলেন, বললেন, “মাতৃবৎ সেবা করে বৌমা যেভাবে ওকে বাঁচিয়ে তুলল, তাতে ব্যাপারটা অত সহজ হবে না, জুজাক”।
জুজাক বললেন, “ছেলেটার সম্বন্ধে আমরা কোন কিছুই জানি না। কোথায় কোন অপাট কাজ করে এখানে গা ঢাকা দিয়ে থেকে গেল – তারপরে রাজাধিকারিকদের কানে গেলে, আমাকে ভিটেমাটি ছাড়া করবে যে, কবিরাজদাদা?”
কবিরাজমশাই বললেন, “তা বটে। কিন্তু আমরা ধরেই বা নিচ্ছি কেন, ছেলেটা কোথাও কুকীর্তি করে এখানে জুটেছে। ওর পরিচয় কি? কোথা থেকে এল? কী করে এমন অবস্থা হল? সেসব কথা বলার একটা সুযোগ কী আমাদের দেওয়া কর্তব্য নয়? কী বলো হে, তোমরা?”
উপস্থিত প্রতিবেশীরা বললেন, “ঠিকই বলেছেন কবিরাজমশাই, তবে জুজাকভাইয়ের ওপরে চাপটা তো বেড়েই যাচ্ছে”।
জুজাক বললেন, “সে কথাটা তোমরা একবার ভাল করে বোঝাও দেখি, আমার বউকে আর কবিরাজদাদাকে...। আমরা তো আর উত্তর কিংবা পূবের লোকদের মতো সম্পন্ন নই, যে অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞানে সেবা করে প্রচুর পুণ্য কামাব। নিজেরাই ঠিক মতো খেতে পাই না...তার মধ্যে এই উটকো আপদ...”।
কবিরাজমশাই চিন্তিত মুখে বললেন, “তোমার উদ্বেগের কারণ আমি বুঝছি, জুজাক। তবে আমি ছেলেটির স্বাস্থ্য, হাত-পায়ের লক্ষণ দেখে যেটুকু বুঝেছি – বসে বসে অন্ন ধ্বংস করার ছেলে এ নয়। যথেষ্ট দক্ষ এবং খাটিয়ে ছেলে। যে অবস্থায় ওকে প্রথম দেখেছি, সাধারণ, মানে আমাদের ঘরের ছেলেপুলে হলে, অনেক আগেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হত”।
জুজাক সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওকে তোমার অসাধারণ বলে মনে হচ্ছে, কবিরাজদাদা?”
কবিরাজমশাই মৃদু হাসলেন, বললেন, “অসাধারণ তো বটেই এবং যথেষ্ট শক্তিমান যুবক। ওর বুকে পেটে, হাতে পায়ে, বেশ কিছু পুরোনো ক্ষতের দাগ রয়েছে। কিন্তু পিঠে তেমন কিছু নেই। এ সবই একজন বীর যোদ্ধার লক্ষণ জুজাক”।
কবিরাজমশাইয়ের কথায় কেউই কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ পরে কবিরাজমশাই আবার বললেন, “যদি বিশেষ কোন উদ্দেশে এখানে না এসে থাকে, একটু সুস্থ হলে ও নিজেই চলে যাবে। তবে ছেলেটি এসেছে অনেক দূর থেকে – সেক্ষেত্রে হয়তো এখানে আসাটাই ছিল ওর উদ্দেশ্য”।
জুজাক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার তাই মনে হচ্ছে? কিন্তু রাজ্যের এই প্রান্তসীমায় একা একজন বীর যোদ্ধা আসার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, কবিরাজদাদা?”
কবিরাজমশাই হাসলেন, বললেন, “তা তো বলতে পারব না। আমি কবিরাজ, গণৎকার নই। কয়েকটাদিন ধৈর্য ধরে দেখা যাক না, ছেলেটি কী বলে। তারপর না হয়, আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত স্থির করব। আজ উঠি। আমি পরশু আবার এসে একবার দেখে যাব”।
ক্রমশ...