গতকাল সারা দিন ও রাত একটানা হেঁটেছে ভল্লা। একে তো তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। যন্ত্রণা এবং ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে তার শরীর। তবু সে হেঁটেছে অবিরাম। আজ রাত্রির আট প্রহরে সে এসে পৌঁছল বিশাল এক সরোবরের পাশে। বীজপুর চটির জনাই তাকে দিক নির্দেশ করে বলেছিল, এই পথ ধরে একদম নাক বরাবর গেলে ডানদিকে একটা সরোবর পাবি। ওই সরোবরটা ছোট্ট একটা পাহাড়ের কোলে। ওখান থেকে নিচের দিকে তাকালে দেখতে পাবি – যতদূর চোখ যায় – ছোটছোট ঝাড়ি আর কাঁটাঝোপের জঙ্গলে ভরা ঢালু জমি। তার মানে তুই নোনাপুর গ্রামের চৌহদ্দিতে পৌঁছে গেলি। ভল্লার মনে হল এটাই সেই সরোবর।
জনাই আরও বলেছিল, ওই সরোবরের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়ালেই তোর ডানদিকে দেখতে পাবি একটা পায়েচলা সরুপথ নেমে গেছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। ওই রাস্তা ধরে, খুব বেশি না, আধক্রোশেরও কম, হাঁটলেই পেয়ে যাবি, নোনাপুরের গ্রামপ্রধানের বাসা। নাম জুজাক। এমনিতে লোক খারাপ না, তবে বড্ডো বদরাগী। একবার রেগে গেলে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তবে ওর বউটা খুব ভালো। মনে খুব মায়া-মমতা।
জনাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল জুজাকের দু-দুটো ছেলে – ছোটবেলাতেই একসঙ্গে মারা গিয়েছিল।
কৌতূহলে ভল্লা জিজ্ঞাসা করেছিল, “সে কি? কী করে?”
“কী আর বলব? সে কথা মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই ওই জায়গাটা অফসলী। বৃষ্টি কম। সামান্য কিছু আবাদি জমি আছে, সেখানে সামান্য কিছু ভুট্টা, জোয়ার-টোয়ার হয়। তাতে সম্বৎসরের খোরাক হয় কি না হয়। তোরা তো এদিককার লোক নোস, জানবি না। বছর দশেক আগে, এদিকে পরপর চার বছর খরা হয়ে – জমি-জঙ্গল একেবারে ঝলসে গিয়েছিল। খিদের জ্বালা সবচে বড়ো জ্বালা রে, ভল্লা। সে জ্বালা যে কোনদিন ভোগ করেনি – সে বুঝতে পারবে না। দুই ভাই মিলে, বছর দশ আর আটের দুই ছেলে, কন্দ খুঁজতে ঢুকেছিল পাশের জঙ্গলে। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে”।
জনাই আবার চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, বলল, “সেই থেকেই জুজাক কেমন যেন বদমেজাজি হয়ে গেল। আর ওর বউটা হল উলটো”।
সরোবরের পশ্চিম পাড়ে বসে থাকা ভল্লার ঝিমধরা মাথায় এই সব কথাই ভনভন করছিল মাছির মতো। পুব আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। অজস্র পাখিদের কলকাকলিতে ভরে উঠছে বিশ্বচরাচর। ভল্লা ডানদিকে সরু সেই পায়েচলা পথটাও দেখতে পেল, জনাই যেমনটি বলেছিল। ওই পথ ধরেই তাকে পৌঁছতে হবে নোনাপুরে। সে জানে না, সেখানে কী অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। তবে সে সব কথা সে এখন ভাবছেও না। সে ভাবছে তার সঙ্গের এই বিপুল বোঝাটাকে টেনে টেনে কী করে পৌঁছবে আধক্রোশ দূরের ওই গ্রামে।
নিজের শরীর নিয়ে বড় গর্ব ছিল ভল্লার – চিতার মতো সর্বদাই টগবগে আর চনমনে তাজা। অথচ গতকাল সেই শরীরটাকেই বইতে চাইছিল না তার পাদুটো। যদি ফেলে আসা যেত কোথাও – কিছুটা হাল্কা হওয়া যেত। আর এই মাথাটা - দুই হাতে ধরে যেটাকে সে এখন সামলাচ্ছে? অসহ্য যন্ত্রণায় দপদপ করছে সর্বক্ষণ। সেটাই বা কম কি? এখন ইচ্ছে হচ্ছে এই নিরিবিলি সরোবরের পাড়ে, ভোরের নরম মায়াবী আলোমাখা প্রান্তরে নিজের শরীরটাকেও ঘাসে বিছিয়ে দিতে। চুলোয় যাক তার কাজ, চুলোয় যাক তার শরীরের সকল যাতনা। ভল্লা সত্যি সত্যিই দুই হাত-পা মেলে নিজেকে ছড়িয়ে দিল মাটিতে। নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ভল্লা, তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে… উদাসীন। তার চোখের ওপরে প্রতি ক্ষণে বদলে যাচ্ছিল আকাশের রঙ… নতুন দিনের ভোর এগিয়ে চলেছে নবীন সকালের দিকে। তার চোখ বুজে এল।
চিকা তার কর্তব্যে কোন অবহেলা করেনি, সূর্যোদয়ের অনেক আগেই সে ভল্লাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। তার গায়ে হাত রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছিল, “তুই যাবি কী করে ভল্লা? এতটা পথ। জ্বরে যে তোর গা পুড়ে যাচ্ছে। একটা দিন অন্ততঃ থেকে যা। আমি কিছু জড়িবুটির ব্যবস্থা করি – একটা দিন বিশ্রাম নে, কাল বেরোবি”। ভল্লা সে কথায় কান দেয়নি। দ্রুত নিত্যকর্ম সেরে রওনা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। চিকা বলেছিল, “তাহলে তুই যাবিই”? ভল্লা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেছিল, “আমার রণপা”? রণপা আর চিকার দেওয়া পুঁটলিতে বাঁধা কিছু খাবার নিয়ে ভল্লা রওনা হয়েছিল জনাইয়ের চটির দিকে।
জনাইয়ের চটিতে পৌঁছতে ভল্লার বেশ দেরিই হয়েছিল, প্রায় মধ্য রাত্রি। দরজা খুলে জনাই বেশ বিরক্ত হয়েই বলেছিল “কি রে? এত দেরি করলি?” তারপর প্রদীপের আলোয় তার চেহারা দেখে চমকে উঠেছিল জনাই, “শরীরের এই অবস্থায় রণপা নিয়ে তুই এতটা পথ এলি কী করে? চিকার চটিতেই একটা দিন বিশ্রাম করতে পারলি না? একটা দিনে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত শুনি? হতভাগা, পথে-ঘাটে মরে পড়ে থাকলে – কেউ জানতে পারত? শেয়ালে-শকুনে ছিঁড়ে খেত। তখন কে করত তোর কাজ?”
ভল্লা জনাইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিল, “একটু শোবার জায়গা করে দিবি? ঘুমোব”। জনাই খাবার এনে দিয়েছিল, ভল্লা খেতে পারেনি। খেতে ভালো লাগছিল না। খড়ের গদির ওপর চাদর বিছিয়ে, বেশ ভালই বিছানা করে দিয়েছিল, জনাই। ভল্লা ভেবেছিল একবার শুতে পারলে ঘুম আর ঠেকায় কে? কিন্তু আশ্চর্য, ঘুম এলই না। যখনই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়, একএকটা ছবি ভেসে উঠছিল চোখের সামনে…তন্দ্রা টুটে যাচ্ছিল। ভল্লা পাশ ফিরে শুল। আবারও তন্দ্রা এল, চোখের সামনে ভেসে উঠল অন্য এক ছবি…। আধো জাগরণ, আধো তন্দ্রায়, এভাবেই এক প্রহর কাল কাটিয়ে সে উঠে বসল। তার পাশের বিছানায় ঘুমোচ্ছে জনাই। জনাইকে ডেকে তুলে জিজ্ঞাসা করল “নোনাপুর গ্রামটা কোনদিকে রে?”
জনাইয়ের দেওয়া খাবারের পুঁটলি নিয়ে বিদায়ের সময় ভল্লা জিজ্ঞাসা করেছিল, “হ্যারে, রণপা জোড়া দে না, এতটা পথ পায়ে হেঁটে যাওয়ার থেকে – অনেক তাড়াতাড়ি…”।
জনাই কঠিন মুখে বলল, “তোকে তো বারবার বললাম, একটা দিন থেকে যা। শুনলি না। তুই জানিস না? ওপরের নির্দেশ, বাকি পথটা তোকে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে! তোর আসল পরিচয় গোপন রাখতে সেটা জরুরি”!
ভল্লা চকিতে উঠে বসল, তার সামনে সরোবরের জলে আকাশের ছায়া, ঈষৎ সবজে। আকাশে সকালের আলো, পূর্ব দিগন্তটা লাল হয়ে উঠেছে। সূর্যোদয় হতে দেরি নেই। জলের কাছে নেমে মুখচোখে জল দিল, মাথাটাও ভিজিয়ে নিল। স্নিগ্ধ শীতল জলের স্পর্শে কিছুটা আরাম পেল। গামছায় মুখ হাত মুছে, সেটা মাথায় বাঁধল শক্ত করে, মাথার দপদপানি কিছুটা কমল। তারপর পাড়ে উঠে হাঁটতে শুরু করল। জনাই বলেছিল, খুব বেশি না, আধক্রোশ মত হবে…শালা, জানোয়ারের বাচ্চা জনাই, সরু সরু দুটো মাত্র পায়ে ভর দিয়ে এই ভারি শরীর আর মাথাটাকে আধক্রোশ টেনে নিয়ে যাওয়াটা, তোর কাছে ছেলেখেলা না? কোন ধারণা আছে তোর, সুস্থ সবল একটা শরীর কখন নিজের কাছেই অবাঞ্ছিত মনে হয়? নামতে নামতে সে একবার পড়ে গেল, ঢালু রাস্তায় গড়িয়ে নেমে এল বেশ কিছুটা।
ভল্লা কোনরকমে উঠে দাঁড়াল, আবার হাঁটতে লাগল। একটা পা মাটি থেকে তুলে সেটাকে সামনে এগিয়ে রাখতে এত যে কষ্ট হয়, ভল্লা এর আগে কোনদিন টের পায়নি। তার সারা শরীর কাঁপছে। তার পিছনের পা কাঁপছে থরথর করে। তবু ভল্লা এগিয়ে চলল। গুয়োর ব্যাটারা, এতদিন খাওয়ালাম, পরালাম, এখন এই আধক্রোশ পথ পার হতে হেদিয়ে মরছিস? তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। সামনে পড়ে থাকা মেটে রঙের মাদুরের মতো বিছানো পথ। তার দুপাশে একঘেয়ে সবুজ পর্দার মতো ঝোপঝাড়। কোন কিছুই তার চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ছে না। পাখিদের প্রভাতী ব্যস্ততা, তাদের অজস্র ওড়াউড়ি, সে কিছুই দেখছে না। এমনকি অজস্র পাখিদের ব্যস্ত-কাকলিও তার কানে আসছে না। তার কানে আসছে শুধু তার নিজেরই বুকের শব্দ। ধক ধক – ধক ধক। তার সমস্ত চেতনা জুড়ে এখন ওই একটাই আওয়াজ।
কতক্ষণ ভল্লা জানে না। তার মনে হল, হয়তো মাসাধিক কাল, কিংবা কয়েক বছর ধরে চলছে তার এই পথ চলা। একসময় তার নজরে এল পথের ডানদিকের সবুজ পর্দাটা আর নেই… ছোট্ট পাতায় ছাওয়া বাড়ি, তার সামনে কাঠের খুঁটির বেড়া দেওয়া প্রশস্ত অঙ্গন। ঘটিতে জল নিয়ে এক রমণী দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে, অবাক চোখ মেলে তাকেই দেখছে। ভল্লার দুই পা এবার জলস্রোতে নদীর পাড়ভাঙার মতো ধ্বসে পড়ল। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে ভল্লা অস্ফুট স্বরে ডাকল, “মা…”। তার চেতনা থেকে সকালের স্নিগ্ধ আলোটুকু নিভে গেল। সে ডুব দিল নিশ্চিন্ত অন্ধকারে।
ক্রমশ...