পরের দিন খুব ভোরবেলাতেই ভল্লার ঘুম ভেঙে গেল। আজ বেশ সুস্থ বোধ করছে সে। শরীরের ব্যথা, বেদনা – গ্লানি নেই বললেই চলে। বিছানায় উঠে বসল, তারপর ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে এল। ভোরের আলো সবে ফুটেছে, বাইরের গাছপালার ডালে ডালে পাখিদের ব্যস্ততা টের পাওয়া যাচ্ছে তাদের কলকাকলিতে। হাওয়ায় সামান্য শিরশিরে ভাব। বিছানায় ফিরে গিয়ে সে গায়ের চাদরটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়াল। দড়ি থেকে টেনে নিল গামছাটা – কষে বেঁধে নিল মাথায়। তারপর প্রশস্ত অঙ্গন পেরিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে চলল পথের দিকে। কঞ্চি দিয়ে বানানো, বেড়ার পাল্লা খুলে সবে পথে নামতে যাবে, কমলি ডাক দিল, “অ্যাই, এই কাক ভোরে কোথায় চললি রে? পালাবার ফিকির বুঝি? এখনো তোর শরীর পুরোপুরি সারেনি…”। কমলির হাতে জলভরা ঘটি।
ভল্লা ঠোঁটে আঙুল রেখে কমলিকে ফিসফিস করে বলল, “প্রধানমশাই শুনতে পেলে এখনই হৈচৈ বাধাবে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শরীরে এবার ঘুণ ধরে যাবে। একটু ঘুরেঘেরে আসি…গাঁয়ের লোকদের সঙ্গে চেনা পরিচয় করে আসি…। আমি পালাইনি রে, মা। প্রধানমশাইকে আমি ভয় পাই নাকি? ভয় করি তোকে। তুই না তাড়ালে, আমি এ বাড়ি ছেড়ে, এই গ্রাম ছেড়ে সহজে নড়ছি না…এই বলে দিলাম, মা”।
ভল্লার চোখের দিকে তাকিয়ে কমলির চোখ ছলছল করে উঠল। বছর দশেক আগে তাঁর হারিয়ে যাওয়া দুই ছেলের বড়টি যেন ফিরে এসেছে তাঁর কাছে। কমলির প্রৌঢ় দুই পয়োধর আচমকাই যেন ভারি হয়ে ব্যথিয়ে উঠল। অস্ফুট স্বরে বললেন, “তার নাম ছিল বুকা – সে আজ থাকলে ঠিক তোর মতই হত…”
ভল্লা বলল, “আমিই তো সেই…নিজের ছেলেকে চিনতে পারিস না, কেমন মা তুই?” চোখ আর নাক কুঁচকে ভল্লা হাসল। কমলি চোখের জল এড়াতে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “একটু দাঁড়া, নাচ দুয়োরে জলছড়া দিই, তারপর বেরোস…নইলে অমঙ্গল হয়…বেশি দেরি করিস না ফিরতে…”।
পথে নেমে ভল্লার মনে পড়ল, সে এই গাঁয়ে ঢুকেছিল বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে। অতএব গাঁয়ে যেতে গেলে নিশ্চয়ই ডাইনে যেতে হবে। সে ডানদিকেই হাঁটা দিল ধীরে সুস্থে। পথের পাশে একটা বাবলা গাছ পেল। খুব সাবধানে কাঁটা সামলে ছোট্ট একটা ডাল ভেঙে, মুখে নিয়ে চিবোতে লাগল। নিমের ডালের থেকে তার বাবলার ডালই পছন্দ।
মন্থর পায়ে চলতে চলতে সে দেখল পথের দুপাশেই বাড়ি – তবে একটানা লাগাতার নয়। দুই বাড়ির মাঝখানে কোথাও খালি জমি – কোথাও পুকুর। বাড়িগুলি খুবই সাধারণ। বাঁশের বাতায় পুরু করে মাটি লেপে দেওয়াল। কাঠের কাঠামোর ওপর শালপাতার ছাউনি। ঝড়ঝাপটা, বৃষ্টি-বাদলায় এসব বাড়ি মোটেই নিরাপদ নিশ্চিন্ত আশ্রয় হতে পারে না। বেশ কিছু বাড়িতে ছাগলের খামার রয়েছে। সকাল বেলা সব বাড়ি থেকেই বেরিয়ে আসছে ছাগলের দল। কারো কম – চারপাঁচটা, কারো কারো বেশি পনের-বিশটা। দুটো ছোঁড়া হাতে পাঁচন বাড়ি নিয়ে তাদের জড়ো করছে। তারপর খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারণ জমির দিকে।
ভল্লা ছোঁড়াদুটোকে জিজ্ঞাসা করল, “শুধুই ছাগল, গরুবাছুর নেই?”
ছোঁড়াদুটো কথা বলল না, শুধু ঘাড় নেড়ে বলল, না।
“গ্রাম থেকে কতদূরে, রে? যেখানে এদের চড়াতে নিয়ে যাস?”
ছোঁড়াদুটোর একজন হাত তুলে দেখাল, বলল, “হোই তো হোথা”।
অন্যজন জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কমলিমায়ের বাড়ি এসেছ না? কোথা থেকে এসছ? যাবে কোথায়?”
ভল্লা ওদের মাথায় হাত রেখে বলল, “অনেকদূরের শহর থেকে এসেছি...তোদের সঙ্গে দেখা করতে, এখানে থাকতে...এখন আর কোত্থাও যাবো না আমি”।
ওদের তাড়া আছে, ভল্লার নেই। ছেলেদুটো ছাগলের পাল নিয়ে এগিয়ে গেল। ভল্লা দাঁতন চিবোতে চিবোতে বুঝতে লাগল, গ্রামের পরিস্থিতি। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে সে ধীরে ধীরে চলতে লাগল। এখনও পর্যন্ত কোন বাড়িতেই সে শস্যের গোলা দেখতে পেল না। এমনকি গ্রামপ্রধান জুজাকের বাড়িতেও সে শস্যগোলা দেখেনি। জুজাকের বাড়ির যে ঘরে রয়েছে, সে ঘরেরই এক কোণায় রাখা তিনটে বড় মাটির জালায় ভুট্টা আর জোয়ারের দানা দেখেছে। সে দিয়ে সারাবছরের খোরাক হয়ে যায়? জুজাক আর কমলিমায়ের মাত্র দুজনের সংসার…তাতেও সারাবছর চলতে পারে না। তাছাড়া শুধু পেটে খেলেও তো হয় না। তেল, নুন, কিছু কিছু মশলা, ধুতিশাড়ি, শীতের চাদর, কাঁথা-কম্বল সে সব কিনতেও তো ভরসা ওই শস্যদানাই! তার ওপর আছে শখ আহ্লাদ, পালা-পার্বণ, দায়-দৈব…।
রাজধানী শহরের বিত্তবান মানুষের কাছে শস্যদানা থাকে না। তাদের থাকে কড়ি, রূপোর মুদ্রা, সোনার মুদ্রা। সেই মুদ্রা দিয়ে জগতের সব কিছু কিনে ফেলা যায় – ঘরবাড়ি, মূল্যবান কাপড়চোপড়, গয়না-অলংকার, বিলাসব্যসন, সুরা… কি নয়? ভল্লার মনে পড়ল রাজশ্যালক রতিকান্তর কথা। রাজার অনুগ্রহে প্রতিপালিত নিষ্কর্মা, লম্পট লোকটা কত অর্থের অনর্থক অপচয় করে চলেছে প্রত্যেকদিন। অথচ এইখানে এই গ্রামে কী নিদারুণ কঠিন পরিস্থিতি।
হাঁটতে হাঁটতে ভল্লা গিয়ে পৌঁছল অনেকটা উন্মুক্ত এক জমিতে। বাঁদিকে বিশাল এক জলাশয়। জলাশয়ের তিনদিকে ঘন গাছপালার সারি আর ঝোপঝাড়। আর সামনেই পাথরে বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাট থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন এক অশ্বত্থ গাছ। শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে নিবিড় ছায়াময় করে তুলেছে বৃক্ষতল। সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে পাথর বিছানো বসার জায়গা। ভল্লার মনে হল, পাথরের ওই আসনগুলি গ্রামের মাতব্বর পুরুষদের বিশ্রম্ভালাপের জায়গা। অপরাহ্ণে হয়তো অনেকেই আসে - কথাবার্তা, শলা-পরামর্শ, পরনিন্দা-পরচর্চা সবই চলে। গ্রামের পালা-পার্বণে উন্মুক্ত এই জমিতেই হয়তো গ্রামবাসীরা সমবেত হয়। হইহুল্লোড়, নাচ-গান করে।
ভল্লা সেই জলাশয়ের ঘাটে গিয়ে দাঁড়াল। স্বচ্ছ নির্মল জলের ওপর ছায়া পড়েছে তিনপাশের গাছপালা আর মাথার ওপরের সুনীল আকাশের। জলাশয়ের বিস্তার এতই বড়ো, জলের উপরে তিরতিরে তরঙ্গ উঠছে, প্রভাতী বাতাসের স্পর্শে। ভল্লা ঘাটে নেমে জলস্পর্শ করল, মুখ ধুয়ে, মুখে চোখে জল দিল। কিছুটা জল পানও করল। চাদরে মুখ মুছে ঘাটেই বসল।
কিছুক্ষণ আগেই সূর্যোদয় হয়েছে তার সামনে, কিছুটা ডানদিকে। ওদিকে ছোট্ট টিলা আছে একটা। ভল্লার মনে পড়ল, এই গ্রামে ঢোকার মুখে সে একটা সরোবরের সামনে দাঁড়িয়েছিল। তার যতদূর ধারণা সেই সরোবরটা রয়েছে ওই টিলার কোলেই। ওখান থেকে আধক্রোশ মত পথ নেমে সে গ্রামে ঢুকেছিল। তার মানে সে এখন যে দীঘির সামনে বসে আছে, তার ওপারের ঝোপঝাড় বেয়ে ওই টিলার পায়ের কাছেই পাওয়া যাবে রাজপথ। কিন্তু ভল্লার মনে হল, সরোবরের পাড় ধরে যে পথে সে নেমে এসেছিল, সে পথ নেহাতই পায়ে চলা পথ। ও পথে গোরু কিংবা ঘোড়ার গাড়ির পক্ষে ওঠা-নামা সম্ভব নয়। অবশ্য দক্ষ অশ্বারোহী ওপথে যাওয়া আসা করতে পারবে। তাহলে এই গ্রামে ঢোকার জন্যে সদর রাস্তাটি কোনদিকে? ভল্লাকে সেটা জানতে হবে।
নোনাপুর গ্রাম এই রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রাম। অর্থাৎ এই গ্রামের পশ্চিম দিকে রয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যের সীমানা। সেই সীমানা এই গ্রাম থেকে কতদূরে? সাধারণতঃ কোন রাজ্যেরই সীমান্ত বরাবর কোন বসতি থাকে না। প্রতিবেশী দুই রাজ্যই জনহীন দূরত্ব বজায় রাখে। অতএব সেই অঞ্চলটি বনাকীর্ণ এবং হয়তো দুর্গম। যদিও ভল্লা জানে, প্রশাসনিক অনুমোদন না থাকলেও সাধারণ জনগণের কিছু অংশ এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাতায়াত করে থাকে। দৈনিক শ্রমের বিনিময়ে কিছু উপার্জনের আশায়। এবং নিয়ম বহির্ভূত কিছু বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। নোনাপুরের কথা সে যেমন শুনেছে এবং আজ সকালে গ্রামের পরিস্থিতি যতটুকু সে উপলব্ধি করেছে – তাতে পড়শি রাজ্যের সঙ্গে এই গ্রামের যোগাযোগ থাকা খুবই স্বাভাবিক।
“এই যে ছোকরা…”। পিছন থেকে পুরুষ কণ্ঠের আচমকা ডাকে ভল্লার ভাবনা সূত্র ছিন্ন হল। পিছন ফিরে দেখল, ঘাটের প্রথম ধাপে জনৈক মধ্যবয়সী পুরুষ তাকে ডাকছে, “সেই থেকে ঘাটে বসে কী করছ হে? জান না, সকালে গ্রামের মেয়েরা ঘাটে আসে নানান কাজে…”। মধ্যবয়সী পুরুষের পিছনে চার-পাঁচজন নারী, মাটির কলসি কাঁখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেরই মুখভাবে বিরক্তি।
ভল্লা দ্রুত উঠে এল ঘাট থেকে, করজোড়ে বিনীত স্বরে বলল, “আমাকে মার্জনা করবেন, আমার অন্যায় হয়েছে। আসলে বিগত কয়েকদিন আমার জীবনের ওপর দিয়ে যে প্রবল ঝড় বয়ে গেল, সেই সব কথাই ভাবছিলাম…এই জায়গাটা এতই নিরিবিলি আর সুন্দর…”।
মধ্যবয়সী পুরুষ বলল, “তোমাকে তো বিদেশী মনে হচ্ছে…তুমিই কী সেই যুবক যে ভয়ংকর অসুস্থ অবস্থায় গ্রামপ্রধান জুজাকের বাড়িতে এসেছ?”
ভল্লা আগের মতোই সবিনয়ে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ আমিই সেই হতভাগ্য যুবক”।
মধ্যবয়সী সেই পুরুষ ভল্লার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোমার কথা অনেক শুনেছি। এস, আজ তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয়টা সেরে নেওয়া যাক”।
মধ্যবয়সী সেই পুরুষের পিছনে পিছনে ভল্লা উপস্থিত হল প্রাচীন সেই অশ্বত্থ গাছের কাছে। ভল্লা দেখল সেখানে আরও তিনজন মধ্যবয়সী এবং দুজন প্রায় বৃদ্ধ পুরুষ বসে আছে। সকলেরই কৌতূহলী দৃষ্টি ভল্লার দিকে। ভল্লার সঙ্গী পুরুষ পাথরের আসনে বসতে বসতে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সেই যুবক, মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় জুজাকের ঘরে যে আশ্রয় নিয়েছিল। কবিরাজমশাইয়ের চিকিৎসায় এখন মনে হয় সুস্থ হয়ে উঠেছে”।
বৃদ্ধদের মধ্যে একজন বলল, “তা তোমার নামটি কি হে?”
ভল্লা মাটিতে উবু হয়ে বসে বলল, “আজ্ঞে আমার নাম ভল্লা”।
মধ্যবয়সীদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করল, “বলি ভল্ল-টল্ল ছুঁড়তে পারো? নাকি শুধু নামই সার”?
খুব বিনীত স্বরে ভল্লা বলল, “আজ্ঞে, একটু আধটু পারি, তবে সে বলার মতো কিছু নয়...”।
আরেকজন মধ্যবয়সী বলল, “তা তুমি পাথরের আসন ছেড়ে মাটিতে বসলে কেন?”
“ছি ছি, আপনারা এই গ্রামের গুরুজন, আপনাদের সঙ্গে একাসনে বসাটা আমার মতো সামান্য জনের পক্ষে ন্যায্য হতে পারে না”।
“তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে”?
“আজ্ঞে সেই সুদূর কদম্বপুর থেকে। তবে আমার বাড়ি কদম্বপুর থেকে দূরের এক গ্রামে। রাজধানীতে বাস করি কর্মসূত্রে”।
“তা রাজধানীতে কী রাজকার্য করা হয়?” একজন কিছুটা বিদ্রূপের সুরেই জিজ্ঞাসা করল।
লাজুক হেসে ভল্লা বলল, “আজ্ঞে রাজকার্য করার মতো বিচার-বুদ্ধি কিংবা বিদ্যা কি আর আমার আছে? গায়েগতরে কিছু বল আছে...সেই সুবাদে রাজধানীর অজস্র নগররক্ষীর মধ্যে আমিও একজন”।
ভল্লাকে যে ডেকে এনেছিল, সে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার কথা বিশ্বাস করা গেল না, হে। নগররক্ষীই যদি হবে – তবে চোরের মার খেয়ে রাজধানী থেকে পালিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হলে কেন?”
কয়েকজন মাথা নেড়ে সায় দিল, দুজন বলল, “ঠিক কথা। সত্যি কথা বল, না হলে এই গ্রাম থেকে তোমাকে আজই বিদেয় করা হবে...”।
ভল্লা বিনীত সুরে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল, “আজ্ঞে, শুধু এই গ্রাম নয়, এই রাজ্য থেকেই আমার বিদেয় হওয়ার কথা”।
উপস্থিত সকলেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, “তার মানে? নির্বাসন দণ্ড? তুমি অপরাধী?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। নির্বাসন দণ্ড। কিন্তু আমি অপরাধী এ কথা আমি স্বীকার করব না। আমার মনে হয়, আমার কথা শুনলে আপনাদের বিচারে আপনারাও আমাকে অপরাধী বলতে পারবেন না”।
কৌতূহলী ছয় পুরুষ নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর এক বৃদ্ধ বলল, “আমাদের বিচারে কী আসে যায়? আমরা তো প্রশাসনিক রায়ের ঊর্ধে নই। অতএব তোমার নির্বাসন দণ্ডের নিরসন আমরা করতে পারব না। কিন্তু তোমার কথা শোনার কৌতূহলও হচ্ছে। আমরা রাজধানী থেকে বহুদূরের বাসিন্দা – রাজধানীর পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। প্রত্যেক বছর কর আদায়ের জন্য যে করাধ্যক্ষ আমাদের অঞ্চলে দু-তিনমাসের অস্থায়ী শিবির স্থাপনা করে - তার থেকে এবং তার অধস্তন কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু সংবাদ পাই। তুমি বল হে ছোকরা। সত্যি মিথ্যে কিছু তো সংবাদ আমরা শুনতে পাবো”।
মাথা নীচু করে ভল্লা কিছুক্ষণ বসে রইল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকালেও অনুভব করল, তার পিছনেও অনেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং তার অনুমান তাদের অধিকাংশই তার সমবয়স্ক যুবক এবং তরুণ। নচেৎ তারাও সামনে আসত এবং হয়ত বয়স্কদের পাশে বসত কিংবা দাঁড়াত। এই অনুভবে ভল্লা নিশ্চিন্ত হল। এরকম আসরে তার বিবরণ শোনাতে পারলে, তাকে একই কাহিনী বারবার বলে কালক্ষয় করতে হবে না। সে নিশ্চিত তার ঘটনার কথা অচিরেই এই গ্রামে তো বটেই – আশেপাশের গ্রামগুলিতেও প্রচার হয়ে যাবে।
সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে, ভল্লা তার বিবরণ বলতে শুরু করল। সেদিনের মধ্যাহ্নের রাজপথে সেই বানজারা রমণীদের কথা। তাদের সঙ্গে রাজশ্যালক লম্পট রতিকান্তর দুরাচারের কথা। নগররক্ষী হয়ে তার দায়িত্বের কথা। এবং ক্রুদ্ধ হয়ে রাজশ্যালকের দিকে ভল্ল ছোঁড়ার কথা, সবই বলল। বর্ণনার শেষে বলল, “বিশ্বাস করুন, রাজশ্যালককে বিদ্ধ করে ওই স্থানেই আমি নিধন করতে পারতাম। করিনি, ভীরু কাপুরুষ লম্পট রাজশ্যালককে আমি শুধু ভয় পাইয়ে নিরস্ত করতে চেয়েছিলাম। রাজশ্যালকের দেহরক্ষীরা আমাকে বন্দী করল। নির্মম অত্যাচার করে উপনগরকোটালের কাছে আমায় সঁপে দিল। আমার প্রতি উপনগরকোটাল কিছুটা স্নেহাসক্ত ছিলেন, রাত্রের অন্ধকারে তিনিই আমাকে রাজ্যত্যাগ করতে আদেশ করলেন। নচেৎ পরেরদিন আমার হয়তো প্রাণদণ্ডও হতে পারত। প্রশাসনিক বিচারে আমার নির্বাসন দণ্ড হয়েছে। সে দুর্ভাগ্য আমাকে মাথা পেতে স্বীকার করে নিতে হয়েছে। কিন্তু এ কথা চিন্তা করে আনন্দও পাচ্ছি যে, লম্পট রাজশ্যালক যে শিক্ষা পেয়েছে, অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যে সে নিজেকে সংযত রাখবে। আর ওই বানজারা রমণীদের মতোই আরও অনেক কুলনারী, কুমারী কন্যারাও ওই লম্পটের গ্রাসমুক্ত থাকবে”।
অন্য এক বৃদ্ধ মন্তব্য করল, “ওই রাজশ্যালকের চরিত্রহীনতার কথা আমাদের কানেও এসে পৌঁচেছে। কিন্তু আমাদের রাজা তো মহান। বিচক্ষণ, প্রজারঞ্জক, দূরদর্শী। তিনি তাঁর এই শ্যালকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না?”
ভল্লা বিনয়ে হাতজোড় করে বলল, “অনেক কথাই কানে আসে। কিন্তু আপনারা প্রাজ্ঞ-গুরুজন, আমি অতি নগণ্য এক রাজকর্মী। আপনাদের সামনে আমার মতো ছোট মানুষের মুখে বড়ো কথা মানায় না। আমাকে ক্ষমা করবেন”।
পিছন থেকে কেউ একজন বলল, “আপনার আর ভয় কি? আমাদের এই গ্রাম শেষেই এক প্রহরের হাঁটাপথে এ রাজ্যের সীমানা। তার ওপারে গেলেই তো অন্য রাজ্য। আপনি নির্বাসনের দোরগোড়ায় পৌঁছেই গিয়েছেন। আপনি বলুন। আমরা শুনব”।
ভল্লা ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাল, দেখল তার পিছনে অন্ততঃ পনের জন যুবক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সঙ্গে আছে বেশ কিছু কিশোর ও বালক! ভল্লা ঘুরে বসল, যাতে দুপক্ষকেই দেখা যায়। তার বাঁদিকে পাথরের আসনে বসা প্রাজ্ঞজনেরা, আর ডানদিকে অর্বাচীন যুবক-কিশোরের দল। তার কাছে অর্বাচীন যুবক-কিশোররাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ – তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলাই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য।
ভল্লা প্রাজ্ঞজনদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের অনুমোদন ছাড়া সব কথা প্রকাশ্যে আনা উচিৎ হবে কি?”
যে বৃদ্ধ রাজশ্যালক সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনিই বললেন, “আমরা সত্য সংবাদ শুনতে চাই...তুমি বলো”।
ভল্লা এবার যুবকদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, ভাই? বসো না। নয়তো আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হবে”। ভল্লার অনুরোধে সকলেই বসল। কৌতূহলী মুখে তারা তাকিয়ে রইল ভল্লার মুখের দিকে।
ভল্লা বলল, “দেখুন, আমি নগররক্ষী বটি, কিন্তু বিশেষ নগররক্ষীদের মধ্যে একজন। এই বিশেষ ব্যাপারটি বুঝতে গেলে, রাজশ্যালকের চরিতামৃতকথাও জানতে হবে। আগে সেই কথাটিই সেরে নিই।
দুর্গ প্রাকারের মধ্যেই রাজশ্যালকের নিজস্ব একটি মহল আছে। কিন্তু সে মহলে তিনি রাত্রিযাপন করেন না। কারণ তাঁর রাত্রিযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যে বিপুল আয়োজন, তাতে দুর্গের প্রশাসনিক বিধিবিধান ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অতএব দুর্গের বাইরে ক্রোশ দুয়েক দূরে, রাজপথের ধারেই তাঁর নিজস্ব একটি প্রমোদভবন নির্মিত হয়েছে। তা প্রায় বছর ছয়েক তো হতে চলল। এবং বলা বাহুল্য, সে প্রমোদভবন নির্মাণ হয়েছে মহামান্য রাজার অনুমোদনেই!
সেই প্রমোদভবনের সম্মুখে আছে বিবিধ ফুল ও ফলের বিস্তৃত উদ্যান। বিচিত্র ফুলের প্রচুর লতাবিতান ও লীলাকুঞ্জ। বেশ কয়েকটি কৃত্রিম প্রস্রবণ। প্রমোদভবনে ঢোকার সিঁড়ির দুপাশে, অলিন্দে সাজানো আছে অজস্র নগ্নিকা মূর্তি। গৃহের অন্দরে কী আছে, জানি না, কারণ সেখানে আমাদের প্রবেশের অনুমতি নেই। ওই সমস্ত নগ্নিকা মূর্তির দুহাতে রাখা থাকে পেতলের দীপ। সন্ধ্যার পর সেই নগ্নিকা-মূর্তিদের করকমলের প্রতিটি দীপ যখন জ্বলে ওঠে সে প্রমোদভবনকে ঊর্বশী-রম্ভার নাচঘর মনে হয়।
সুসজ্জিত সেই প্রমোদভবনে রাজশ্যালক প্রতিদিন সন্ধ্যায় যান। সারারাত্তির সুরা ও নারীতে ডুবে থাকেন। খুব সম্ভবতঃ সূর্যোদয়ের পর দেড় প্রহরে তাঁর ঘুম ভাঙে এবং মোটামুটি দ্বিপ্রহরে তাঁর নিজস্ব ঘোড়ার গাড়িতে দুর্গ প্রাকারের ভিতর নিজের মহলে ফিরে যান। এই হচ্ছে তাঁর প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কোন ঋতুতেই তাঁর এই অভিসার যাত্রার কোন ব্যত্যয় হয় না – কারণ তাঁর কাছে সম্বৎসরে একটিই ঋতু – মধুর মধুঋতু!
নিত্যনৈমিত্তিক একই ভোগে সুরসিক রাজশ্যালকের সন্তুষ্টি হয় না। তিনি সর্বদা নিত্য-নতুন রমণী সম্ভোগের কামনা করেন। এবং কুলবধূদের কুলনাশ করে তিনি যে আনন্দ পান, বারবধূ সম্ভোগ তার তুলনায় কিছুই নয়। অতএব যাওয়া-আসার পথে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকে, যে কোন যুবতী রমণী – সে সধবা কিংবা বিধবা। অধবা তরুণী কিংবা বালিকা। তাদের কেউ যদি সুন্দরী হয়, তবে রাজশ্যালকের গ্রাস থেকে সেই অভাগীদের পরিত্রাণের উপায় থাকে যৎসামান্য।
মহানুভব রাজার এই বিষয়টি অগোচরে ছিল না। রাজশ্যালকের এই দুরাচারের প্রতিকার চিন্তা করে তিনি আমাদের মতো বিশেষ কিছু রক্ষীকে নিযুক্ত করলেন। আমাদের কাজ রাজশ্যালকের যাত্রাকালে, তাঁর যাত্রাপথে কোনভাবেই যেন কোন রমণী তাঁর দৃষ্টিপথে না আসে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এক কথায় ওই সময়ে সকল রমণী যেন গৃহের ভিতরে থাকে। কেউ যেন কোনভাবেই রাজপথে, নিজ গৃহের সামনে প্রকাশ্যে না আসে”।
সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা একটু বিরাম নিল, কিছুক্ষণ পর বলল, “মহানুভাব রাজা জেনেশুনেই এই ক্ষুধার্ত হায়নাকে রাজপথে অবারিত চলাচলের অনুমতি দিলেন। কিন্তু নিরীহ সাধারণ নগরবাসীকে পরামর্শ দিলেন ঘরের দরজায় খিল এঁটে থাক। আর আমাদের নির্দেশ দিলেন, সকলে দরজায় ঠিকঠাক খিল এঁটেছে কিনা সেদিকে নজর দিতে। স্বাধীন হায়নাটাকে জব্দ করার নির্দেশ তিনি দিতে পারলেন না!”
কথা থামিয়ে হঠাৎই ভল্লা যেন শিউরে উঠল, বলল, “ছি ছি। রাজার অন্নে প্রতিপালিত হয়ে আমি রাজ-সমালোচনা করে ফেললাম? আমার কর্তব্য বিনা বিবেচনায় রাজার নির্দেশ পালন করা। সেখানে বিবেকের তো কোন স্থান নেই! এ আমি, এ আমি কী বলে ফেললাম? ছিঃ”। মাথা নীচু করে ভল্লা মাটির দিকে তাকিয়ে বসে রইল চুপ করে।
উপস্থিত কেউই কোন কথা বলল না। সকলেই তাকিয়ে রইল ভল্লার দিকে। সকলেই যেন মনে মনে ভল্লার বক্তব্যের ভাল-মন্দ বিচার করে দেখছে। নির্বিচারে রাজাদেশ মান্য করাই উচিৎ নাকি কখনো কখনো বিবেকের নির্দেশকেও সমীহ করা বিধেয়?
সেই বৃদ্ধ আবার বললেন, “তুমি বলো ভল্লা। আমরা জানি তোমার বিচার এবং দণ্ডবিধান হয়ে গেছে। তার পরিবর্তন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু তুমি বলো, আমরা শুনব”। বৃদ্ধকে সমর্থন করে বেশ কিছু যুবক বলে উঠল, “হ্যাঁ, ভল্লাদা বলো”।
ভল্লা মাথা তুলে সকলের মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল, যুবকদের মধ্যে কয়েকজনের চোখে যেন ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। ভল্লা বিলম্ব না করে বলল, “সেদিনের ঘটনার কথা আপনাদের আগেই বলেছি। বিবেকের তাড়নায় আমি ওই কাজ করেছিলাম। কিন্তু হত্যা তো করিনি, চরিত্রহীন লোকটার মনে ভয় ধরাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সর্বশক্তিমান মহানুভব রাজা কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তাঁর ওই লম্পট শ্যালককে? লোকটা দিনের পর দিন অপরাধ করেও যে দিব্য স্ফূর্তিতে রয়েছে, সে কি রাজার প্রশ্রয়ে নয়? ওই গর্ভস্রাব লোকটি প্রত্যেক রাত্রে অজস্র অর্থের যে অপচয় করে চলেছে, সে অর্থ কি তার নিজের উপার্জিত নাকি রাজকোষের? অর্থ উপার্জনের মতো কোন যোগ্যতাই যে তার নেই – সে কথা আমরা সকলেই জানি। আপনাদের মতো লক্ষ লক্ষ প্রজার ঘাম-ঝরানো পরিশ্রমের শুল্ক থেকে ভরে ওঠা রাজকোষের অর্থ, কোন অধিকারে ওই লোকটি এভাবে অপচয় করে চলেছে সে প্রশ্ন আপনারা করবেন না?”
বয়স্ক মানুষরা ভল্লার এই কথায় চমকে উঠলেন। জনৈক বৃদ্ধ বললেন, “উত্তেজনার বশে এ সব বলা তোমার সমীচীন নয় ভল্লা। তুমি রাজার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছ? সরাসরি আমাদের রাজাকেই তুমি অভিযুক্ত করছ? এ তো বিদ্রোহের কথা?”
“কিন্তু প্রশ্নগুলো তো অবান্তর নয়, জ্যাঠামশাই” যুবকদের মধ্যে জনৈক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “ভল্লাদা, তুমি জান না, আমাদের এই রুক্ষ বৃষ্টি-বঞ্চিত অঞ্চলে আমরা কী কঠোর পরিশ্রম করি এবং কত সামান্য ফসল ঘরে তুলতে পারি। সেই ফসলেরও রাজকর দিতে হয় এক-তৃতীয়াংশ! সারা বছর আমরা কী খাব, কী পরব। সে কথা রাজা তো চিন্তা করেন না। আর তাঁর শালা রাজধানীতে বসে নিত্য মোচ্ছব চালিয়ে যাচ্ছে?”
বয়স্ক মানুষরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। কথায় কথায় ছেলে ছোকরার দল উত্তেজিত হয়ে উঠছে। এরপর আর সামলানো যাবে না। এসব আলোচনার কথা রাজকর্মচারীদের কানে গেলে অশান্তি শুরু হবে। এই প্রসঙ্গ এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। সেই বৃদ্ধ মানুষটি আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল হে, চলো বাড়ি যাওয়া যাক – স্নান খাওয়া সারতে অবেলা হয়ে যাবে”।
ভল্লাও উঠে দাঁড়াল। সকলকে নত হয়ে প্রণাম করে বলল, “হ্যাঁ তাইতো, বেলা অনেক হল। আর দেরি হলে ওদিকে কমলি-মা আমার পিঠ ফাটাবে। ছোটমুখে অন্যায্য কিছু কথা যদি বলে ফেলে থাকি, ক্ষমাঘেন্না করে নেবেন”।
ভল্লা গ্রামের ছোকরাদের আচরণে আশ্বস্ত হল। নিশ্চিন্ত হল। ছেলেগুলো একেবারে মিয়োনো নয়, ভেতরে আগুন আছে। ভল্লা তাড়াহুড়ো করবে না, ধৈর্য ধরে সে আগুনকে উস্কে নিতে পারবে। উত্তেজিত যুবকটির চোখে চোখ রেখে সে কিছুক্ষণ দাঁড়াল, তারপর একটু চাপা স্বরে বলল, “বাড়ি যাও ভাইয়েরা, পরে আরও কথা হবে”।
ক্রমশ...